এক্সপেক্টেশন
শুভব্রত দাশগুপ্ত
বাংলা তর্জমা করলেই পাওয়া যাবে, শব্দটি আছে – প্রত্যাশা। কিন্তু, ‘এক্সপেক্টেশন’ আরও অনেক কিছুকে ধরে নেয় বলে আমার ধারণা। তাই নির্দ্বিধায় ওই শব্দটির আশ্রয়
নিলাম। কারন না থাকলে তিলক কলকাতায় ফিরে যেত না, অন্তত
কথা শুনে এমনটাই মনে হয়েছে আমার – বাবা রিটায়ার করলেন যেবার তার
চার বছর বাদে তিলক চাকরী নিয়ে রাঁচি চলে যায়। সেলসম্যান হতে পছন্দ করত না তিলক, তাও মার কথা রাখতে চাকরীটা নিতেই হল। বরাবর চেয়েছিল তিলক
থিয়েটার-স্টেজ-স্ক্রিপ্ট-রিহার্সাল-অভিনয়...
এসবের মধ্যে বাঁচতে। মেকআপের গন্ধ, স্টেজের আলো, স্বপ্নের মতো ডায়ালগ মনে ভাসে – সেখানে ডিটারজেন্ত-হ্যান্ডওয়াশ-সোপ-টয়েলেট ক্লিনার-ডিশওয়াশের গন্ধ তাকে কাঁদায়, আছাড় দেয়। আমি তিলককে প্রথম দেখি রাঁচি থেকে দূরে গুমলা নামে এক ছোট্ট শহরতলীতে; হাতে কালো গাবদা ব্যাগ – চোখে শূন্যদৃষ্টি। দোকানে তার সিনিয়র বিপিন, কথার ফুলঝুরি ছোটাচ্ছে আর সে দাঁড়িয়ে দোকানের পিছনে মস্ত শিমূলগাছের পানে তাকিয়ে পাখির ডাক শুনছে। আমি তার দৃষ্টির পিছু পিছু তাকিয়ে দেখলাম বহুদুরে ঘনসবুজের মাঝে একঝাক টিয়া উড়ে বেড়াচ্ছে আর সেখানে ছোকরা হারিয়ে গেছে। একই কাজে একই অঞ্চলে সবাই অন্যজনকে চেনে, আমি চাপা গলায় বললাম, ‘বিপিন কিন্তু দেখছে ব্রাদার !!’
এসবের মধ্যে বাঁচতে। মেকআপের গন্ধ, স্টেজের আলো, স্বপ্নের মতো ডায়ালগ মনে ভাসে – সেখানে ডিটারজেন্ত-হ্যান্ডওয়াশ-সোপ-টয়েলেট ক্লিনার-ডিশওয়াশের গন্ধ তাকে কাঁদায়, আছাড় দেয়। আমি তিলককে প্রথম দেখি রাঁচি থেকে দূরে গুমলা নামে এক ছোট্ট শহরতলীতে; হাতে কালো গাবদা ব্যাগ – চোখে শূন্যদৃষ্টি। দোকানে তার সিনিয়র বিপিন, কথার ফুলঝুরি ছোটাচ্ছে আর সে দাঁড়িয়ে দোকানের পিছনে মস্ত শিমূলগাছের পানে তাকিয়ে পাখির ডাক শুনছে। আমি তার দৃষ্টির পিছু পিছু তাকিয়ে দেখলাম বহুদুরে ঘনসবুজের মাঝে একঝাক টিয়া উড়ে বেড়াচ্ছে আর সেখানে ছোকরা হারিয়ে গেছে। একই কাজে একই অঞ্চলে সবাই অন্যজনকে চেনে, আমি চাপা গলায় বললাম, ‘বিপিন কিন্তু দেখছে ব্রাদার !!’
চমকে তিলক আমার দিকে তাকালো, পরোক্ষনে ডাক শুনে দোকানের দিকে
এগিয়ে গেল,
‘কি কি করলাম দেখেছো কি?’ বিপিন
কড়াচোখে তিলকের দিকে তাকিয়ে। আমি ঝপ করে বলে উঠলাম, ‘বিপিন
!! এক মিনিট...’
আমাকে দেখে বিপিন হাসিমুখে এগিয়ে আসে, ‘বল মামা! ...আরে? কাল কোথায় ছিলি? সারাদিন
দেখা নেই?’
- চিরকুণ্ডায় যেতে হল, স্টক নিয়ে ঝামেলা হচ্ছিল। আমি
সিগারেট এগিয়ে দিলাম।
- আমি তাই ভাবি... অনিল আর
অরবিন্দ আমার রুমে এসেছিল, তোকে খুঁজছিল। কখন ফিরলি?
- সাড়ে নটা-পৌনে দশটা হবে !! আমি
সিগারেট ধরাই,
‘ওটি কি নতুন?’ তিলককে দেখিয়ে শুধাই।
- এইতো দশ-বারোদিন হল। মাল একদম
খাজা!! এইমাসটা টিকলে হয়!! কি যে সব জয়েন করে !!?
- কেন? কি
সমস্যা? আমি ধোঁয়া ছেড়ে মুচকি হাসি –
- একই ডেমো তিনবার হয়ে গেল, এখনও মাথায় ঢুকলও না !!! বসকে বলেছি...
- আমার হাতে ছাড় দুটোদিন !! আমি দোকানের দিকে তাকাই, তিলক ডিসপ্লে সাজাচ্ছে।
- ভাগ শালা !! তুই হচ্ছিস
কম্পিটিটর ব্র্যান্ড !! বস জানতে পারলে –
- তুই না বললেই হল !! দে না, কটাদিন একটু রগড় করি... বুক ভরে ধোঁয়া টানলাম।
বিপিন সিগারেটে টান মেরে মাটিতে ফেলে লম্বা ধোঁয়া ছেড়ে তাকালো, ‘কেন রে?
আমার চাকরীটা না খেয়ে ছাড়বি না?’
আমি কাঁধে হাত রেখে তাকাই, ‘কাল সকালে শ্রীকৃষ্ণ ভাণ্ডারে
নটায় পাঠিয়ে দে,
রাতে কথা হবে’ সিগারেটটা টান মেরে টোকা
মেরে রাস্তার ধারে ফেলে হাঁটা দিই।
শ্রীকৃষ্ণ ভাণ্ডার আপারবাজারে পঞ্চাশবছরের পুরনো দোকান, রাঁচির নামকরা ডিষ্টরিব্যুটর। গত তিনবছর ধরে আমি কোলগেটের সিনিয়র ইঞ্ছারজ।
বাজারে নামডাক আর জনপ্রিয়তা তুঙ্গে, বিপিন তাই বেশি না ঘাঁটিয়ে
পাঠিয়ে দিয়েছে ছেলেটিকে।
- কি পড়েছো? আমি চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে
আলগোছে তাকাই।
- ইংলিশ অনার্স, কলকাতা থেকে, গতবছর পাস করেছি, বাবা
মারা গিয়েছেন তিন বছর হল, আমি ছাড়া আরনিং মেমবার নেই, তাই এখানে আছি... এক নিশ্বাসে বলে
আমার দিকে তাকাল, ‘আমার নাম তিলক দে, টালিগঞ্জে
বাড়ি। ......কিছু মনে করবেন না, আজ ষোলদিন হল এখানে, প্রায় ৮-৯জনকে ইন্টাভ্যু দিতে হয়েছে, আমি সবটাই বলে দিলাম।
আমি সিগারেট বের করে এগিয়ে দিলাম, ‘চলে?’
তিলক মাথা ঝাঁকায়, ‘না!’
আমি মৃদু হেসে সিগারেটে আগুন ধরিয়ে তাকাই, ‘কাল, গুমলা যায়গাটা কেমন লাগলো?’
- অপূর্ব। প্রকৃতির অকৃত্তিম
ভাণ্ডার।
- লিভারসে কি করে চাকরী পেলে? আমার হাসি ঠোট বেয়ে সারা মুখে
ছেয়ে গেছে।
- ইন্টাভ্যু দিয়েছিলাম, ছোটমামার বন্ধু এখানে অফিসার, তিনিই পাইয়ে দিয়েছেন
আমি চমৎকৃত হই, এত সাহস এই আপাত-নিরিহ শরীরে কোথা থেকে বাসা
বাঁধলো?
আমি সাবধানী চোখে তাকাই, ‘না করে দিলে না কেন?’
- মা মাথায় হাত দিয়ে বললো... তিলক চুপ করে যায়, যেন গোপন কথা বলে ফেলেছে সে।
- কি বললেন? আমি ঝুঁকে বসি।
- কি করবেন জেনে? চোখে তেজ ঝিলিক দিয়ে
ওঠে।
আমি হাতদুটো টেবিলে জড় করে বসি, ‘আমার নাম অরিজিত দত্ত। তোমার
বয়সী আমার কাকার ছেলে গতবছর দিল্লীতে গ্র্যাজুয়েট হয়ে বসে আছে, চাকরী করছে না। আমি তাই ভাবলাম এইধরনের শখ তোমরাই বোধহয় করতে পারো !! আমাদের
কেউ জিজ্ঞাসা করেনি কখনো – কি করতে চাই!! ... কি চাও ভাই??’
তিলক এই প্রথম শান্ত হয়ে তাকায়, ‘স্যার!! আমি সেলসম্যান হতে
চাইনি কোনদিনই!!! বিশ্বাস করুন!’
- কি চেয়েছিলে? আমি মুখের হাসি ধরে রেখে বলি।
- থিয়েটার। ওতেও ফিউচার আছে !!
কেউ শুনল না। এই প্রথম দেখলাম
ছেলেটার মুখে উত্তেজনা।
- Actor?? অভিনেতা?? Interesting!!! আমি ভ্রূ নাচাই।
- আপনি থিয়েটার দেখেন? শুধু বাংলা থিয়েটার নয়, পৃথিবীতে কতভাষায় থিয়েটার হয়!!
জানেন?
- না। সত্যিই জানি না।
- 6900 languages are spoken across the globe. থিয়েটার এর অধিকাংশ ভাষাতেই কোন না কোন সময়ে সংগঠিত হয়েছে। আমরা তার আর
কতটুকুর খবর রাখি? ভাবতে পারেন, কত কাজ
বাকি?
সে সব কে করবে? সাবান-তেল বিক্রি কেউ না
কেউ তো করেই দেবে... আমি না হয় নাই করলাম
!!
আমি একটু চমকে গেলাম, এমন ভাবে তো ভেবে দেখিনি !! আমি
এই কাজ একঘেয়ে করে চলেছি প্রায় ৯-১০ বছর… বিয়ে করে ২বছরের ছেলে
কলকাতায় বাড়িতে রেখে এসেছি; দুমাসে-তিনমাসে দিন তিন-চারেক
কাটিয়ে আসি। স্ত্রীও তার বেশী আশা করে না – অন্তত
তেমনটাই কানে শুনেছি।
- স্যার আপনি human
expectations জানেন তো? আমরা সবাই সেটাতেই বাঁধা
আছি। তিলক চোখ নামিয়ে নেয়।
ছেলেটি মাসদুয়েক টিকেছিল, বিপিনের বস কড়ামানুষ, এসব অপোগণ্ডদের পুষে রাখতে পছন্দ করেন না… আমি, পরে জানতে পারি, তিলক কলকাতায় ক্যুরিয়র কোম্পানিতে
মার্কেটিংএর কাজ করে। মা তাতে কতটা খুশি জানা হয়নি। তবে, তিলক
নিয়ম করে থিয়েটার-টা করে…
গৌতম সাহার সাথে পরিচয় রাঁচি ছেড়ে রায়পুরে গিয়ে। একটা হোটেলে সার্ভিসবয় আমার
সাথে বাংলায় কথা বলাতে আমি একটু অবাকই হই। ছোটবেলায় ছবির বইয়ে ইয়ুরোপের ছবি দেখে
যাওয়ার কথা ভেবে ফ্যালে, হয়তো খুব কঠিন গল্প নয়; তবে সবাই একইরকম ভাবে সব জিনিষ দেখতে পায় কিনা সেটা একটা প্রশ্ন। অন্তত, গৌতমের সাথে দেখা না হলে কথাটা মনে আসতোই না –
- এখানে ভাই কি ভাবে এলে ?
- স্যার অনেক কথা, ...আমি কলকাতায় যাইনি প্রায় ৭বছর হল, জানেন?
- কেন? কেউ
নেই বুঝি? আমি জিজ্ঞাসা করি।
- স্যার, আপনি
কোন যায়গায় থাকেন? গৌতমের
আকুতি দেখে অবাক হই –
- রিজেন্ত পার্ক, টালিগঞ্জ। আমি সাবধানে বলি।
- আপনি তো তাহলে সেলিমপুর চেনেন? গৌতম উৎসাহ নিয়ে বলে;
- চিনি... ঢাকুরিয়া ছাড়িয়ে –
- স্যার গড়িয়াহাট রোডে ‘চায়না-হাট’, সেলিমপুরে ঢোকার মুখে দেখেছেন? আছে?
না???
আমি চিনবার চেষ্টা করি, ‘চায়না-হাট? খাওয়ার দোকান?’
- কেন স্যার, এখন কি নেই? গৌতম মুষড়ে পড়ে।
- আহা, সে কথা
কখন বললাম? আমি বিরক্ত হই –
- না না স্যার... খুবই চালু দোকান
স্যার !! গৌতম কাতর হয়ে পড়ে।
- আমি অনেকদিন হল ওদিকটা যাই
না... নিশ্চয়ই আছে!! ...
- থাকারই তো কথা !!! গৌতম এদিক ওদিক তাকিয়ে হনহন করে চলে যায়, আমি খাওয়া শেষ করে বেসিনে হাত ধুতে উঠে যাই।
প্রায় দিন-দশেক বাদে ওই হোটেলে ঢুকি রাতের খাওয়া সারতে, এদিন গৌতমকে দেখতে না পেয়ে ম্যানেজারকে শুধাই –
- No Sir!! ও
দু-তিনদিন আসছে না, জ্বর হয়েছে শুনলাম… any problem?
- No problem – এমনি
জানতে চাইলাম। আমার জাতভাই তো…!!! আমি আশ্বস্ত করি।
দিন-সাতেক বাদে গৌতম আমাকে অবাক করে রাস্তায় ধরে, ‘স্যার!!
অনেকদিন হল আসছেন না?’
- ভাই, তুমিই
ছিলে না। জ্বর সেরেছে? কেমন আছো? আমি পিঠে হাত রাখি।
- না স্যার জ্বর আমার নয়, আমার মার ছিল, সেটা বললে তো ছুটি দিত না !! কিছু না কিছু
সমস্যা থেকেই যাচ্ছে – কাল আসবেন তো?
- শহরে থাকলে নিশ্চয়ই আসবো!!
কটাদিন বাদে হোটেলে গিয়ে খবর পাই গৌতমের চাকরী গিয়েছে – বড্ড বেশী কামাই করছিল। আমি ওর সাথীদের থেকে ঠিকানা জোগাড় করে পৌঁছে যাই
পরদিনই।
আমাকে দেখে হাউ হাউ করে কেঁদে ফ্যালে গৌতম, ‘স্যার
মাকে বাঁচাতে পারলাম না!!’
আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করি, ‘এখানে পড়ে আছো, কলকাতায় নিয়ে গেলে না কেন?’
- স্যার দাদা-রা মাকে রাখল না, দোকান নিজেদের নামে করে নিল, আমাকে চোর অপবাদ দিয়ে শহর ছাড়া
করল!! কি করে কলকাতায় ফিরি বলুন তো?
- থানা-পুলিস কি নেই? আমি অবাক হই।
- সব কেনা স্যার ! সব কেনা
!! আমাদের তিনতলা বাড়ি, বাবা বলে গেলেন তিনভাই আলাদা থাকবে না, মা
যতদিন বাঁচবে সবাই একত্রে বাস করবে। পরে যে যার মতো থাকবে, কোন
ঝগড়াঝাটি চাই না। বউরা এসে দাদাদের মাথা ঘুরিয়ে দিল – দোকানে
ক্যাশবাক্স সরিয়ে আমাকে চোর বানালো, মাকে অপমান করে ঘরছাড়া করল।
পুলিসের কাছে গেলাম – উলটে আমাদেরই শাঁসালো!! ব্যাস, মা বললও –
ছেড়ে দে; ছেড়ে দিলাম। চলে এলাম এখানে...
- এখানে কি ভাবে এলে? আমি হতবাক।
- আমার বন্ধু এখানে চাকরী করতো, সেই বলল... আমিও চলে এলাম।
- সেই বন্ধু কোথায়?
- সে এখন নাগপুরে, আমি কি আর তার পিছু, সর্বত্র যেতে পারি?
আমি গৌতমের পিঠে হাত রাখি, আর কি বলবো মাথায় এলো না। চোখের
জল মুছে একটু হাসি এনে গৌতম তাকায় আমার দিকে –
- তা, এখন কি
করবে? আমি শুধাই
গৌতম অবাক করে দিয়ে বললো, ‘স্যার, আমি
ছোটবেলা থেকে স্বপ্ন দেখেছি ইয়ুরোপের – ভেনিস, মার্সাই,
বার্সিলোনা, প্যারী... আমি পায়ে হেঁটে দেশ
ছেড়ে বেরবো।
আমি বিস্মিত চোখে তাকিয়ে থাকি, ‘পায়ে হেঁটে??’
‘আপনি দেখে নেবেন স্যার, ঠিক পৌঁছে যাব।‘
- কিন্তু, গিয়ে
করবে-টা কি?
খেয়ে বাঁচতে হবে তো? আমার স্বর আটকে যায়।
- স্যার, এখানে
হোটেলে কাজ করে দুবেলা দুমুঠো তো জুটত !!
- কিন্তু, পায়ে
হেঁটে... ইয়ুরোপ ?? Impossible !!
- But, I will… there are ways & means –
আমি বোবা হয়ে উঠে আসি, গৌতমের মুখে চোস্ত ইংরেজি শুনে
থমকে যাই। আর কখনো দেখা হয়নি, হবে কি না জানি না –
নতুন চাকরী নিয়ে চলে আসি কলকাতায়, ছেলে তার বাপের কথা
প্রায় ভুলে যেতে বসেছিল। নীলা, আমার স্ত্রী বোধহয় খুশি হল, তবে সে খোঁজ আমি সে সময় নিইনি।
রিজেন্ত পার্ক থেকে গণেশ চন্দ্র এভিন্যু যাতায়াত, আমার
সবচেয়ে আরামের পর্ব। মেট্রোরেল চড়ার কথা অনেকদিনই ভুলে যেতে বসেছিলাম। হঠাৎই একদিন
সুমির সাথে দেখা। সুমি আমাদের পাড়াতে দুটোবাড়ি পরেই থাকতো। আমাদের চেয়ে বছর
পাঁচেকের ছোট –
বেশ দেখতে ছিল। দুলু, পিনটু, গনা,
বাবলা বেশ কিছুদিন ঘোরাঘুরি করেছিল কিন্তু, কব্জা করে উঠতে পারে নি। কোথা থেকে গণেশ নামের এক ম্যাদ্রাসি-ছেলের আবির্ভাব
হল,
বছর ঘুরতে না ঘুরতে বিয়ে, ব্যাঙ্গালোরে
চালান।
- অরিজিতদা না? এক আগাপাস্তলা সাজগোজে-মোড়া
মহিলা টালিগঞ্জ মেট্রো ষ্টেশনে আমাকে সাবধানী গলায় জিজ্ঞাসা করে।
আমি হ্যাঁ-না বলার আগেই একগাল হেসে তাকায়, ‘আমি
সুমি!! মনে আছে?’
আমি অবাকই হই, সুমি প্রথমত, আমাদের
কারোর সাথে দাঁড়িয়ে কথা বলেছে এটাই মনে পড়ে না – তার
উপর এতদিন বাদে,
- ইয়ে হ্যাঁ, ম-মনে আছে !! আমাকে বোবায় পায়।
- এখানে থাকো না? সুমি একপা এগিয়ে এসে
দাঁড়ায়,
কথা বলার আগ্রহ দেখে আমি একটু সাবধানী হই।
- থাকতাম না, এই,
কয়েক মাস আগে নতুন চাকরী নিয়ে এসেছি...
- আমিও এই দিন-দশ হল এসেছি। সুমি যেন শোনানোর জন্যই বললও।
- ও !! ...তা সব ভাল তো? আমি
পাস কাটানোর ইচ্ছা নিয়ে একটু তফাতে দাঁড়াই।
- তুমি বিয়ে করেছো? বাচ্চা ? সুমি আগ্রহ নিয়ে জানতে
চায়।
- ক-করেছি। ...ছেলে, ক্লাস সেভেন পার করবে – এই ডিসেম্বরে !!
- তোমার অফিসে vacancy আছে?
একটু বলবে? সুমি অকস্মাৎ বলে –
- আম-আমাদের অফিসে? …এটা জানা নেই, আমি জাস্ট দু-মাস হবে জয়েন করেছি। আচ্ছা আমি
এগোই,
দেরী হচ্ছে। তার শরীরের পারফিউম এখনও আমার সাথেই চলেছে যেন… পিছনে আর তাকাইনি।
সপ্তাহখানেক বাদে সুমিকে আবার সেই মেট্রোতেই দেখলাম, আমায়
দেখতে পায়নি। লেডিস-সিটে ফোন-কানে ধরে বসে আছে। আমি আড়চোখে দেখছিলাম; সেই যৌবনের আঁচটা কমলেও চোখে পড়ার মতো এখনো সে !! এসপ্ল্যানেডে নেমে গেল, হাতে বড় ব্যাগ – আমি নিজেকে আড়াল রেখে চুপচাপ উঠে দাঁড়ালাম, পরের স্টপ চাঁদনি চৌক।
রোববার,
বাজারের থলেটা বগলে চেপে সবে সিগারেটটা ধরিয়েছি, গনা হাঁক দিল চায়ের দোকান থেকে,
- চা-টা না খেয়ে সিগারেট আগে না
ধরালেই পারতিস?
- দাঁড়া, বাজারটা
সেরে আসি !! আমি অলস পায়ে এগিয়ে যাই।
- বাবা!! এতো তাড়া?? গনা লেড়ো-বিস্কিটে
হাল্কা কামড় দেয়।
- মাছ না এনে দিলে, ঘ্যানঘ্যান চলতে থাকবে... আমার আধঘণ্টা লাগবে –
- তাহলে কালুদার দোকানে থাকবো, দুলু আর বাবলা আসবে...
আমি হাত নেড়ে বাজারে ঢুকে পড়ি। ছেলেটা কদিন ধরেই মাংস খেতে চাইছে, আগেই লাইনে দাঁড়িয়ে পড়ি, মাছ কিনতে টাইম লাগবে না।
হঠাৎ বাজারের ভিতর থেকে হইচই – ধরধর!! পড়ে গেল নাকি?? তারপরই দেখি ধরাধরি করে এক
মহিলাকে বের করে আনছে লোকজন... কাছে আসতে বুঝি ওটা সুমি; গায়ে-মাথায়
মাছের বাজারের ময়লা!!
সেলুনের দোকানে বসিয়ে চোখে-মুখে জলের ঝাঁপটা দেওয়ার পর সাড় ফিরল – আমি লাইন ছেড়ে একটুকুও নড়ি নি। আসে পাশের থেকে মন্তব্য ভেসে এলো, ‘আমি কিছুক্ষণ ধরেই দেখছি মহিলা কেমন জানি করছে, বুঝিনি
যে পড়ে যাবে,
নয়তো.....!! মুখে গন্ধ পেলাম, সকাল
সকালই টেনেছে কিনা কে জানে?’
আমি মুখ লুকিয়ে নিয়ে মাংস কিনে, মাছের বাজারে গা-ঢাকা দিলাম; কোন প্রয়োজন ছিল না যদিও।
এক-দুদিনের মধ্যেই, সুমির সাথে পাড়ার মুখে দেখা, আমি স্বতঃস্ফূর্ত এগিয়ে গেলাম, ‘শরীর ঠিক আছে তো?’
- হ্যাঁঅ্যাঁ - কেন বলো তো? সুমি চোখে জিজ্ঞাসা।
- না না এমনি, সেদিন তো তাড়ায় ছিলাম... আমি
সামাল দিই।
- ভালই, তা
তুমি কি জানতে পেরেছো কিছু? সুমি একগাল হেসে এগিয়ে আসে –
- ক-কি... বলতো?? আমি বুঝবার চেষ্টা করি।
- তোমার অফিসে? vacancy? ...মনে পড়ছে না??
- ওও !! আমি সম্বিৎ ফিরে পাই, ‘নাহ !!! জানোই তো, যা কাজের চাপ !!!’
- ভুলেই গেলে?? সুমি
যেন আঘাত পেল –
- ক-কার জন্য সেটা তো
বলোইনি... আমি হুমড়ি খেয়ে বলি।
- আমার জন্য...!!! সুমি আত্মাভিমান সহ বলে... ‘জানোই তো সব কিছু?’
- ক-কি জানবো?? আমি সত্যিই অবাক হই –
- আমি চলে এসেছি – for good – এখন আমি একা !! গণেশ is a sly !!! তখন বুঝি নি, যা হয়…
একটু বেশিই বোকা ছিলাম।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে আমার মুখের দিকে তাকায় সুমি, ‘উপকার
হবে,
একটু চেষ্টা করবে? প্লিজ???’
আমি থতমত খেয়ে বলি, ‘ঠ-ঠিক আছে, ঠিক আছে!!! চেষ্টা করবো –‘
প্রায়ই ট্যুরে বেরোতাম, সেবার গৌহাটিতে ২দিন কাটিয়ে
শিলং যাচ্ছি সাথে আসামের রিপ্রেসেন্তেটিভ, সামন্ত।
সামন্ত আমাকে তোয়াজ করে নিয়ে চলেছে শিলং, ‘স্যার !! আপনি একটিবার
গেলেই হবে –
ডিষ্টরিব্যুটরকে ঠিক মতো বুঝিয়ে দেবো, কোম্পানি যে-সে নয়।‘
- তোমাকেই সামলাতে হবে, আমি ৯মাসে ৬মাসে এক-আধবার আসবো!! আমি
বোঝাবার চেষ্টা করি –
- না না স্যার!! আপনি এবারটা চলুন, আর যেতে হবে না !!! সামন্ত সামলানোর
জন্য বলে।
রাতে পুলিশবাজারে ছোট-খাটো একটা হোটেলে ডিষ্টরিব্যুটরই থাকার ব্যাবস্থা করে
দেয়,
সারাদিন আমাদের সাথে ব্যাবসাগত মারামারি সেরে আমাদের
আদর-আপ্যায়নে যাতে ত্রুটি না থাকে সেটা নিয়ে মালিকের বাড়াবাড়িটা আমরা উপভোগই
করছিলাম। ব্যাটা মাড়ওয়ারী, কোম্পানির বড়কর্তার কিসে রুচি
তার হদিশ পেতে সবেরই ব্যাবস্থা করে রেখেছিল বুঝলাম। দামী স্কচ ঘরে পাঠানোর
সাথেসাথে আমি ডেকে পাঠাই, ‘মিথিলেশবাবু !! আপনি যদি আমার
সাথে বসে পান করেন তো এটা খুলবো, নয়তো ফেরত নিয়ে যান!!’
- কি যে বোলেন দোত্তসাব !! বাড়িতে
আমাকে একদোম ঘুসতে দেবেনা !!
- কে ??
আমি চমৎকৃত,
- আমার পিতাজি !!!
আমি হাহা করে হেসে বললাম, ‘পাট্যাঁয়াতে গিয়েতো সেবার
সবচেয়ে বেশী নাচা-গানা-স্কচ-মেয়েবাজীতো আপনিই করেছিলেন? না ??‘
কানধরে ফিসফিস গলায় মিথিলেশ আমার দিকে ঝুঁকে বলে, ‘এখানে
সে-সোব মানা !!’
‘পিতাজী,
তাই-তো???’ আমি হো-হো শব্দে হাসতে থাকি।
মিথিলেশ হার মানবার পাত্র নয়, আপনাদের ক্যালকাটার স্যাম্পল
একটা আনিয়েচি কাইন্ডলি না কোরবেন না ...
সামন্ত গলা খাঁকড়িয়ে উঠে দাঁড়ায়, ‘স্যার আমি একটু রুম থেকে
আসছি...’ আমি উৎসুক হই, ‘স্যাম্পল?
কি সেটা??’
মিথিলেশ ফোনে কাউকে বিড়বিড় করে কিছু নির্দেশ করার সাথে সাথেই প্রায় দরজায়
টোকা...
আগাপাস্তলা সাজগোজে-মোড়া সুমি এসে ঢুকে দাঁড়ালো আর বিদ্যুতের মতো শিহরিত হোল
দুটো শরীর। আমি আধশোয়া থেকে সটান উঠে দাঁড়াই – মিথিলেশ
কালচে দাঁত মেলে হাসে, ‘টোপ-ক্লাস স্যাম্পল স্যার!!’
সেবার গৌহাটিতে ফিরে ইম্ফল আর আগরতলা যাওয়ার প্ল্যান ছিল, সবটাই ক্যান্সেল করে কলকাতা ফিরে আসি, আর
নিতে পারছিলাম না। অফিসে তিনদিনের ছুটি নিয়ে বাড়িতেই শুয়ে বসে কাটালাম – নীলা,
আমার এই নতুন রুপ দেখে অবাক, ‘তোমার
শরীর খারাপ??
তোমার????’
আমি চোখ বুজে ফেলি, চাকরী করতে করতে ছেলে-বউ কাউকেই
সময় দিইনি আজ অবধি। খেয়াল করলাম তেরো-বছরের বিয়ে আর বারো বছরের ছেলে নিয়ে
প্রাপ্তির কোন ঠিকানা খুঁজি-নি। তারা আমার শরীরের অব্যাবহার্জ দুটো অঙ্গের মতো
আটকে রয়েছে –
ব্যাথা বেদনা না হলে টের পাই না।
ছেলেকে ডাকলাম, ‘অভি, সিনেমা
যাবি ?
কি চলছে-রে এখন?’ ছেলে দু পা পিছিয়ে আমাকে দেখতে লাগলো, আমি
আশ্বস্ত করি,
‘সত্যি সত্যি !! ইভনিং-সো তারপর রাতে বাইরে খাবো!!’
পনেরো মিনিট পর পা টিপে টিপে ঘরে ফেরত আসে অভি, পিছনে
তার মা,
‘তুমিই বললে না, সিনেমার কথা?? মা বিশ্বাস করছে না !!’
আমি ঘাড় নাড়ি, ‘আজ যাবোই, মাল্টিপ্লেক্সে-রিক্লাইনিং
চেয়ারে বসে সিনেমা, তারপর রেস্টরেন্ত!!! যেটা বলবি !!’ ছেলের নাড়ি-দ্রুত হয়, ‘...যেটা বলবো???’ আমি ঘাড় নাড়ি, ‘হ্যাঁ।‘
কলকাতায় কোম্পানি আমাকে বেশীদিন রাখতে চাইলোনা, আমিও
বিশেষ আপত্তি করিনি। এবার ঠিকানা জুটল লখনউয়ে। নীলা প্রথম কলকাতার বাইরে পা রাখলো, ছোটবেলায় বার-দুয়েক পুরী যাওয়া বাদে ট্রেনেও চাপেনি বিশেষ। এবার তো
কলকাতা-লখনউ ফ্লাইট... window seat, aisle seat এইসব
শব্দ প্রথমবার শুনে সে মুগ্ধ। আমার সাথে প্রথম গা ঘেঁষে বসলো নীলা, আমি নিঃস্বার্থে আইল-সিটে বসলাম, ছেলেকে জানলা-ছাড়া করা
সম্ভবপর নয় অতএব দুটি ঘণ্টা স্ত্রীর মাথার ভার কাঁধে নিয়ে কলকাতা-ছাড়া হলাম ফের।
ওয়াজেদ আলির শহরে পরিবার নিয়ে শান্তিতেই কাটতে লাগলো আমার – English medium
schoolয়ে ভর্তি হতে বিশেষ বেগ পেতে হোল না। নতুন স্কুল, নতুন ড্রেস,
নতুন সাথী – ছেলে কিছুদিনেই মিলেমিশে গেল।
কদিনেই অল্পস্বল্প উর্দু তার বচনে জুড়ে নিয়ে সুবিধামতন ছুঁড়ে ছুঁড়ে মাকে বেকায়দায়
ফেলতে শুরু করল অভি। আমিও নিশ্চিন্তে নতুন বাতাবরণে অভিসিক্ত হলাম।
রুস্তম শাহ্-কে পেলাম অফিসে প্রথমদিনই, হাসিখুশি
প্রাণবন্ত ছেলে। আমি যে কলকাতা থেকে আসছি খবর তো ছিলই, রতন
ভাঙ্গা-বাংলায় আমাকে স্বাগত করে, ‘আসুন স্যার!! খুব খুশি আমরা
আপনাকে পেয়ে !!’
একদিন বলল,
‘স্যার আপনি কলকত্তার লোক, বাপ
আমার খুউব খুশি হবে…!! একদিন যাবেন আমার সাথে।‘ আমি বললাম, ‘বেশ,
যাব।‘
যাব যাব করতে করতে রতন একদিন অফিসের শেষে ধরে বসলো, ‘আজই
চলুন!!’ আমি এড়াবার জন্য বললাম,
- আজ ছেলে বিরয়ানী খাবে বলে সকাল
থেকে দুবার ফোন করেছে… আরেকদিন হবেখন!!’
- তাহলে তো আজই দাওয়াতে সবাই ভাল
আনন্দ পাবেন,
আপনাকে খাস নওয়াবী বিরয়ানী খাওয়াব, যা এখন
অবধি খাননি… কোন কথা শুনছি না, আমার ভাই গাড়ি নিয়ে আপনার দরজায় সাড়ে আটটাতে পৌঁছে যাবে। ১০মিনিটের রাস্তা, সব ইন্তজাম তৈয়ার থাকবে।
ওজর-আপত্তির একটা শুরুয়াত করতে গিয়ে বুঝলাম রুস্তম আমার সামনে দাঁড়িয়ে ফোনে সব
ব্যাবস্থা পাকা করে ফেলেছে, মিনমিন করে শুধু বললাম, ‘আচ্ছা…!!’
সত্যিই রুস্তম তার ভাইকে গাড়ি সহ আমার বাড়ির সামনে সময়মতই পাঠিয়ে দেয়, ‘নমস্তে স্যার ! ম্যেয় ইয়ুসুফ হু!! আপ মুঝে মুন্না বুলা সকতে...!!’
গাড়িতে সওয়ার হয়ে জিজ্ঞাসা করে ফেলি, রুস্তম বাংলা বোঝে, তা...তুমি’
–
- হামি বুঝি, থোড়া থোড়া!! গাড়ি চালাতে চালাতে
মুন্না হাসি মুখে বলে
- যাক, তা
বাড়ি তোমাদের কতদুর?
- নজদিক!! ব্যস... ছে-কিলোমিটার
!! দশমিনিট –
পুরনো মহল্লা, প্রাচীন বাড়ি, পাথরের
শাণ-বাধানো সরু রাস্তা, গাড়ি ছেড়ে আমরা এখন পদব্রজে
ঢুকে পড়েছি স্যাঁতস্যাঁতে গলিতে। বাঁকে বাঁকে সাহেবি আমলের বাতিদান, তাতে যে আলো বসানো পঁচিশ গজের বেশী দৃশ্যমান নয়। আলো-আধারি পথ পেরিয়ে একটা
বাড়ির সামনে আসতেই পরিচিত কণ্ঠস্বর পেলাম,
- কষ্ট হল তাই না ? এখানে তো গাড়ি ঢোকে না !! নমস্কার
ভঙ্গিতে এগিয়ে আসছে রুস্তম।
আমি আস্বত করি, ‘আরে না না !! এইটুকু তো ??’
- প্রনাম ভাবিজী !! নীলা মাথা ঝুকিয়ে প্রতিনমস্কার জানায়।
- Welcome Abhijit !! এটা
লখনউএর সবচেয়ে পুরনো ইলাকা !! করিব-করিব… তিনশো বছর !!
অভি অবাক চোখে তাকায়, ‘তি-ন-শো !!!’
বাড়িটা বাইরে থেকে তেমন বোঝার উপায় ছিল না, ভিতরে
গিয়ে বুঝলাম ওয়াজেদ আলির সময়কে আদর দিয়ে ধরে রেখেছে। রুস্তম একটা সাবেকী আসবাব
সাজানো ঘরে আমাদের নিয়ে এল – সেখানে এক বৃদ্ধ বড় চেয়ারে আসীন, ‘আমার ওয়ালেদ !!’ আমি
ঝুঁকে নমস্কার জানাই – ভদ্রলোক উঠে দাঁড়িয়ে আমার হাতদুটো ধরে হেসে ঝকঝকে
বাংলায় বললেন,
“বড় খুশি হলাম!!”
আমার বিস্ময় তাঁর চোখ এড়ালো না, হেঁসে বললেন, ‘কলকাতায় বিশ-সাল কি এমনি এমনি কাটালাম?’
আমাকে ছাড়িয়ে তাঁর নজর আমার স্ত্রী আর পুত্রের দিকে, ‘এটা
আপনাদেরই বাড়ি!! ইয়ুসুফ আপনাদের অন্দরে নিয়ে যাবে।‘ ইয়ুসুফ কথা শেষ হওয়ার আগেই চিক
সরিয়ে আহ্বান জানায় ভিতর-মহলের জন্য। এবার রুস্তম আর বৃদ্ধ আমার সামনে, ‘বসুন !!’ নরম সোফায় আমি যেন মিশে গেলাম –
- বেশ পুরনো... এই মহল্লা!! আমি কথা বলার কিছু পেলাম
- হা !! আমার ধারনায় সাড়ে
তিনশো-চারশো বছর তো হবে !! আমি আমার ছেলেবেলা যদিও অনেকটাই অন্য অন্য যায়গায় ছিলাম, কলকাতায় তো পরে গেলাম!!
- কলকাতায়... কি ভাবে?
- ও অনেক ঘটনা!! সময় লাগবে – আপনি শুনান,
এখানে ট্র্যান্সফার কি আপনিই চাইলেন?
- আমি কিছু বলিনি, এসব বলে তো কিছু হয় না... আমি বললাম যেখানে বলবেন; লখনউ
যেতে বলল,
চলে এলাম।
আমি বেশী গল্প ফেঁদে কথা বলতে পারি না।
- ভাল করলেন !!! লখনউ আপনার ভাল
লাগবে,
আপনি কিছু কি দেখলেন এসে?
- না, বাড়ি
পেতে একটু সময় লাগলো, তাঁর আগে ছেলের স্কুল... বুঝতেই পারছেন !!!
- সে ঠিক, সে
ঠিক!! লখনউ আপনার পালিয়ে যাচ্ছে না, আগে যে সব দরকারি কাজ...
রুস্তম মুখের সামনে হাত রেখে বাপকে কিছু একটা বলাতে বৃদ্ধ সামলে নিলেন, ‘আরে!! আমি শুধু বলেই চলেছি, অপরাধ নেবেন না!! আপনি ভি চলেন
সাথে!!’
রুস্তম আমাকে আদরের সাথে ভিতরে নিয়ে যায়, মস্ত দালানের সামনে আমরা দাঁড়িয়ে। মস্ত ঝাড়লন্ঠন ঠিক মাঝে অনেক উঁচুতে ঝুলছে, তাতে বাতি আপাতত জ্বলছে না। সেটার দিকে তাকিয়ে রুস্তম হাসল, ‘ওটা এখন জ্বালানো হয় শুধু ঈদে!!’ তাতে কোন সমস্যা নেই কারন অনেকগুলি বাহারি বাতিদানে ঘেরা মস্ত হলঘরটা ঝলমল
করছে ঝাড়লন্ঠন ছাড়াই। ইয়ুসুফ হাসিমুখে একটা ঘর থেকে বেরিয়ে আমাদের হাত দেখিয়ে
ভিতরে আসতে অনুরোধ করে – রুস্তম
আমাকে নিয়ে সেই ঘরে ঢোকে। মাঝারী মাপের ঘরে খাওয়ার ব্যাবস্থা করা একটা শ্বেতপাথরের
টেবিলে ঝকমকে কাঁসার থালা, রকমারি বাটি আর গেলাস। আমি
ইতস্তত করি,
রুস্তম হাত তুলে আমাকে আশ্বস্ত করে, ‘আমরা
সবাই আপনার সাথে বসবো !! এখানে মেহমানকে একা আমরা খেতে বলি না।‘
- না মানে, ও-ওরা !! আমি এদিক ওদিক তাকাই।
- ভাবি আর অভিজিৎ অন্দরে আছেন, ওখানে আমার আর ইয়ুসুফের বিবি আছে, আমার মা আছেন, ওদের নিয়ে চিন্তা করবেন না!!
রুস্তম হাসতে থাকে।
বৃদ্ধ ততক্ষণে এসে দাঁড়িয়েছেন, ‘আসুন আসুন!! এটা আমাদের
দস্তুর!!’
সেদিনের ভোজ সম্পর্কে বিস্তারিতে যাওয়াটা আড়ম্বর মনে হবে। অভি বাড়িতে পৌঁছে
বলেছিল,
‘বাবা, রুস্তম-কাকুদের বাড়ি আমি কিন্তু
আমি আবার যাবো !!’
দিন-পনেরো বাদেই রুস্তম বিকেলে বাড়ি ফেরার মুখে একটু ইতস্তত করে বলে ফেললো, ‘আজ কি খুব ব্যাস্ত আছেন?’
আমি জিজ্ঞাসু চোখে তাকাই, ‘কেন রুস্তম?’
- একবার যদি বাড়ি চলেন আমার
সাথে... রুস্তম চোখ নামিয়ে বলে।
- আজই ? কাল-পরশু
হলে হবে না?
অভি-ও খুশি হবে –
- না স্যার, আপনি গেলেই ভাল হয়, বাপজান আপনার সাথে দেখা করতে
চাইছেন। আমি গাড়ি এনেছি –
- না সে ঠিক আছে… বাড়িতে তো জানে না – আমি যুক্তি টানার চেষ্টা করি;
- আমি গিয়ে ভাবিজী-কে বলে আসবো, দয়া করে আসবেন একবার !! রুস্তম একটু জোরই ফলায়।
আমি অবাক হই, অনিচ্ছা-সহই হাত দেখাই, “চলো,
আমরা কিন্তু ১০টাতে ডিনার করি...”
রুস্তম খুশি মুখে তাকায়, ‘আমি আপনাকে নিজে পৌঁছে দেবো, ভাব্বেন না !!’
আজ বাইরের ঘরে শুধু আমি আর রুস্তমের বাপজান; রুস্তম
আমাকে বসিয়ে বেরিয়ে যায়, “ভাবিজীকে জানিয়ে আসছি !!”
বৃদ্ধ আমার দিকে শীর্ণ হাতখানি বাড়িয়ে কৃতজ্ঞ চোখে তাকালেন, ‘আমার বড় উপকার করলেন আপনি…’
আমি হেসে বলি, ‘সামান্য এলাম, তাতে
কি আর...!!’
- আমি আপনার দামী সময় নিচ্ছি, সেটা কি কম হোল? বৃদ্ধ আমার হাতদুখানা ধরে আছেন।
- এমন ভাবে বলবেন না, কতটুকু আর …
রুস্তম আমার খুব প্রিয় –
- ওর জন্যই আমি ডাকা-করলাম আপনাকে… কথা বলা খুব দরকার হয়ে গেল, দোষ নেবেন না। একটু বসুন আগে…
আমি সোফাতে বসি, বৃদ্ধ আমার সোজাসুজি বসলেন, ‘আগে একটু চা পেশ করতে বলি?’ আমি মাথা নাড়ি।
চা এসে পড়ার পর বৃদ্ধ আমার কাছে সরে এসে বললেন, ‘যা
বলবো,
সেটা আপনি জানবেন প্রথম, সেটা
আগে বলি।‘
আমি চায়ে চুমুক দিয়ে তাকাই, বৃদ্ধ নিজের চা নামিয়ে রেখে যেন
প্রস্তুত করলেন নিজেকে।
- আমার নাম আমীর কাসেম, আমাকে আমীর নামেই জানে সবাই; আমার তখন ২৮/২৯ বয়েস, আমার বিয়ে হয়ে এক মেয়ে হয়ে গেছে। তারা এই মহলেই থাকতো, আমি
মাঝেমাঝে এসে দেখা করতাম। তখন দেশ স্বাধীন হয়েছে সবে, বাটোয়ারা
হয়ে গেছে,
আমার বড় ভাইজান পাকিস্তানে চলে গেলেন, যাওয়ার সময় আমার মেয়ে আর বিবিকেও নিয়ে চলে গেলেন।
আমি চমকে উঠি, ‘বিবিকেও...??’
- হাঁ... জানতাম না, আমার বিবিকে প্যার ভি করতো আর মেয়েটাও আমার ছিল না। বৃদ্ধ আমার বিস্মিত মুখের দিকে চেয়ে হাসলেন।
যখন ভাইজান নিয়ে চলে গেলেন তখন বুঝলাম... ভালই করলেন, নয়তো
আমার কি হাল হত ভাবুন !!
আমি আমার চায়ের কাপ নামিয়ে রাখি, এমন ঘটনা আমার কাছে
অভাবনীয়।
- আমি খুব দুঃখ পেলাম, কিন্তু কিছুদিন পর ভুলেও গেলাম। ২/৩ বছর পর চাচা কলকাতা থেকে এসে আমাকে বললেন – এখানে থেকে কি করছিস, আমার সাথে কাম-কাজ করবি, ভাল থাকবি। চলে গেলাম, বৌবাজারে চাচার একটা ঘরের
আস্তানা ছিল,
ওখানেই উঠলাম। চাচা পারফিউমের সাপ্লাইএর কাজ করতেন, আমি কিছুদিনেই কাজ শিখে নিলাম – কলকাতাকেই ঠিকানা বানিয়ে নিলাম।
আমি ভাল গান জানতাম, আমার ওয়ালেদ মীর উমর হাসন, বড় উস্তাদ ছিলেন। এখানে দরবার হত, অনেক আমের-উমরাহ্ আসতেন, ভিতরে বড় হল দেখেছেন না?
আমি মাথা নাড়ি, ‘হ্যাঁ...!’
- বৌবাজারে জাহান-মহল ছিল আমার
বাড়ির কাছেই,
সেখানে মাঝেমাঝেই মজলিশ হত – আওয়াজ
পেতাম। ওয়াসিম নামে এক বন্ধু হল, সেই একদিন আমাকে নিয়ে গেল
লুকিয়ে দেখবার জন্য। জানলাম সেখানে মুজরা হয়। আল্লার দুয়ায় ভালই দেখতে ছিলাম, ওয়াসিম আমাকে বুদ্ধি দিল – ওখানে ভাল গাইবি তো ভাল নজরানা
পাবি। আমি ভয় পেতাম – চাচা জানতে পারলে... ওয়াসিম আমাকে বোঝাল – আরে
তোর ওয়ালেদ মীর উমর হাসন এতো বড় উস্তাদ, তাঁর ছেলে গাইবে না? চাচা খুশি হবে।
আমি উসখুস করছি দেখে বৃদ্ধ হেসে ফেললেন, ‘নেশা
আছে?
চিন্তা নেই – আরে খান খান, দোষ লাগবে না…!!’ আমি শেষমেশ সিগারেট বের করে ধরিয়ে ফেলে বললাম, ‘থামবেন
না…
বলুন !!’
- চাচা বললেন – এখানে আর থাকবো না, বড় ঘর পেয়েছি। আমি সাহস জুটিয়ে
বলে ফেললাম –
আপনি যান, আমি এখানেই থাকবো। চাচা আপত্তি
করলেও শেষে মেনে নিলেন, সেই আমার স্বাধীন জীবনের
শুরুওয়াত। ততদিনে আমি কলকাতার গলি-রাস্তা সব চিনে নিয়েছি, বাংলা
শিখে নিয়েছি। চাচা দেখলেন আর ধরে রাখা যাবে
না;
আমি হোটেলে খেতাম – সারাদিন
পারফিউম সাপ্লাইএর কাজ করতাম – রাত হলেই ওয়াসিম আর আমি
জাহান-মহলে চলে যেতাম। রফিকভাই ছিলেন সেখানে, ওয়াসিমের
চেনা –
আমাকে প্রথম দর্শনেই ভাল লেগে তাঁর। আমার গানও শুনে নিলেন – ব্যাস !!!
একদিন মেহফিল বসলো, আমাকে গান গাইতে বলা হল... আমি
গাইলাম। রুক্সানাবিবি আমাকে ভিতরে নিয়ে চলে গেলেন – আমার
কাছে আয়,
আমি তোকে আরও গান শেখাবো। শেখালেনও আমাকে, প্রায় ১বছর টানা। মুজরা বসলেই আমার ডাক পড়তে লাগলো, আমি
ভাল কামাতে লাগলাম। ধীরে ধীরে সাপ্লাইএর কাজ কমিয়ে দিলাম – পারছিলাম
না। রাত জেগে গান গেয়ে আর রাস্তায় বেরিয়ে কাজ করা যেত না।
রুস্তম এসে দাঁড়ালো, ‘স্যার নটা বাজে, এবার চলুন !!’ আমি
ঘড়ির দিকে চেয়ে অবাক হই... ‘সেকি !!’
অফিসের নানান কাজে লখনউ ছেড়ে ট্যুরে যেতে হত মাঝেমাঝে। সেরকমই সেবার দিল্লীতে
ছিলাম দিন-দুয়েক, আগ্রা যাওয়ার পথে খবর এলো রুস্তমের বৃদ্ধ
পিতা অসুস্থ,
হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছে – আমি
রুস্তমকে ফোন করলাম, ‘দরকারে ছুটি নাও, বাবার
কাছে থাকো।‘ আমার মনটাও আনচান করছিল
নিঃসন্দেহে,
সেদিনের অধুরা কাহিনী শোনা হয়েনি যে...
খানিকটা চিন্তা বয়ে ফিরে এলাম পরদিনই, সন্ধ্যেবেলা
আর কাটলো না,
বৃদ্ধের ইন্তেকাল হল হাসপাতালেই। রুস্তমকে ভেঙে পড়তে দেখে
মনটা খুবই ভারী হয়ে গেল, মাত্র দুটোদিনের আলাপে ভদ্রলোক
আমার যেন খুবই আপন হয়ে উঠেছিলেন। তাঁর কাহিনী যে শোনা হয়ে উঠবে না, এটা ভাবিনি।
নীলা আমাকে জোর করলো, ‘না গিয়ে দাঁড়ালে অসভ্যতা !!’ দুজনে হাতে থলে ভরা ফল নিয়ে
হাজির হলাম পরদিন, শোকস্তব্ধ বাড়িতে বসতে একদমই ভাল লাগছিল না
আমার;
ইয়ুসুফের শুকনো মুখখানা বারবার মনে করিয়ে দিচ্ছিল প্রথম
দিনটার কথা। একটি ছোট ছেলে এসে ইয়ুসুফের কানে ফিসফিস করে কিছু বলার পর দেখলাম
ইয়ুসুফ ভ্রূ-কুঁচকে আমার দিকে তাকাল – পরোক্ষণেই ছোট করে হেসে
আমাকে চাপা গলায় জানালো, ‘আন্দার আপকো বুলায়া গয়া
হ্যাঁয়...’
আমি বিস্মিত হই, ইয়ুসুফ উঠে দাঁড়িয়ে আমাকে ইশারায় দরজার দিকে
নির্দেশ করে,
আমি যন্ত্রচালিতের মতো এগিয়ে যাই। হাল্কা আলোর একটা মাঝারি
মাপের ঘরে নিয়ে সেই বালক বসতে বলে পর্দার পাশ দিয়ে মিলিয়ে গেল, শরীর ভর্তি অসোয়াস্তি নিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম আমি। কিছুটা বাদে অল্প শব্দে
ঘুরে তাকালাম –
বোরখা পরিহিতা নারীমূর্তি আমার সামনে আদাব জানিয়ে দাঁড়ালেন – আমি নমস্কার জানিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম;
- জনাব, আমি
রুস্তমের আম্মি !! আমিই আপনাকে ডেকেছি – একটু যদি বসেন, কথা ছিল।
আমি চেয়ারে বসি, মহিলাও বসলেন আমার সামনেই।
- রুস্তমের ওয়ালেদ আমাকে বলেছিলেন, আপনাকে তাঁর মনের কথা বলতে চান। আমি বাঁধা দিইনি। আমি শুনলাম, পুরনো কিছু কথা বলে উনি হাল্কা হতে চেয়েছিলেন – সেটাও
তাঁর অসম্পূর্ণ থেকে গিয়েছে। সেটা আমি জেনেছি, পরে – আমি জানি না উনি কেন বলতে চেয়েছিলেন।
- ছেড়ে দিন সে সব কথা... আমি বাঁধা দেওয়ার চেষ্টা করি।
- আপনার নিশ্চয়ই জানার ইচ্ছা
হয়েছিল,
আমি কোথা থেকে এলাম? উনিই
বা লখনউয়ে ফিরলেন কেন...!!
- স-সে তো ... তবে এখন আর সে সব
বলার জন্য উনি তো নেই !!
- আমি তো আছি !! অদ্ভুত একটা ইঙ্গিত যেন মহিলা দিলেন।
রুস্তমের গলা পেলাম ঘরের বাইরে, ‘আম্মি, কিছু
মেহমান এসেছেন,
আপনি কি বসতে বলবেন?’ মহিলা আমাকে বসতে ইশারা করে
বেরিয়ে গেলেন। আমি স্তব্ধ হয়ে বসে রইলাম ...
কিছুক্ষণ বাদে ইয়ুসুফ এসে দাঁড়ায়, “ভাবিজী, বাহার মে...!!”
থেকে উঠে দাঁড়ালাম – এভাবে বসে থাকতে আমার খুবই
অসোয়াস্তি লাগছিল। ঘর ছেড়ে, দালান ছেড়ে সদর দরজার সামনে
দেখি নীলা আমার জন্য অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে, পাসে রুস্তম – স্যার !! আপনি এসে ভাল করলেন, আম্মি খুশি হয়েছেন। কিন্তু, আজ অন্য লোক এসে পড়ায় কথা বলতে পারেননি... গুস্তাখি !!”
আমি হাতটা ধরে বলি, “আরেকদিন আসবো...” রুস্তমের চোখ চিকচিক করে ওঠে।
প্রায় মাস-খানেক পেরিয়ে গেছে, আমি কাজেকর্মে ভুলেও গেছিলাম, রুস্তম রুমে এসে দাঁড়ায়, “স্যার ! আম্মি ইয়াদ করছিলেন...”
আমি,
“যাব নিশ্চয় !” বলে এড়িয়ে যাচ্ছিলাম, রুস্তম মাথা নামিয়ে দাঁড়ায়, ‘আজ যাবেন?’
সন্ধ্যে হতে রুস্তম গাড়ি নিয়ে এসে দাঁড়ায়, “স্যার, বাড়িতে আজ চাচা থাকবেন কথা বলা অসুবিধা হবে, আম্মি
আমার বোনের বাড়িতে আপনার জন্য অপেক্ষা করছেন !”
আমি অবাক হই, “তাড়া তো ছিল না… “
রুস্তম শুকনো হেঁসে তাকায়, “আম্মি দেরী করতে চান-না।“ আমি নিঃশব্দে জানলার বাইরে
তাকিয়ে থাকি,
কেন আমাকে ডাকছেন এই মহিলা ? কি
জানতে হবে আমাকে – কেন ?
লখনউএর মোতি ঝিলের পার ঘেঁষে গাড়ি এসে দাঁড়ালো ছোট এক-মহলার সামনে; বাড়ির বাহির মহলেই বসার ব্যবস্থা। চিকের এপারে বসে আমি বৃদ্ধার সুরেলা কণ্ঠে
শুনতে লাগলাম এক অদ্ভুত কাহিনী –
- আমীরসাহিব আপনাকে নিশ্চয়ই
জাহান-মহলের কথা বলেছেন?
- হ্যাঁ, শুনেছি
! আমি অপেক্ষা করি পরের কথাগুলির
জন্য;
- আমি জাহান-মহলে পৌঁছই যশোর হয়ে, আমার বাড়ি খুলনা। আমি তখন ১৬ বছরের মেয়ে, ঘুমের
ওষুধ খাইয়ে আমাকে চুরি করে আমাদের প্রতিবেশী ওয়াসিম মণ্ডল। আমার হুঁশ আসে যখন, আমাকে একটা গরুরগাড়িতে মুখ বেঁধে, হাত বেঁধে রাখা।
কথাবার্তায় জানতে পারি তখন আমরা যশোরে, আমাকে আর একটা মেয়েকে
পাঠানো হবে কলকাতা – রফা বনছে না, ওয়াসিম
চাইছে ৮০০ টাকা,
কিন্তু ৫০০র বেশী দাম পাবে না। শেষমেস দুজনের জন্য ১৩০০টাকা
নিয়ে ওয়াসিম ছেড়ে দিল আমাদের। দুজন মাঝবয়সী মহিলার হাত ধরে পৌঁছলাম জাহান-মহলে।
- পালাতে পারেন নি? আমি শুকনো গলা ঝেড়ে কোনক্রমে
বলি।
- গ্রামের বাইরে পা দিইনি কখনো, পালিয়ে যাবোটা কোথায়?
- তা-র-পর ?
- রুক্সানাবিবি আমাকে আর গীতাকে
যত্নে রেখেছিলেন।
- গী-তা ? আমি জিজ্ঞাসা করি।
- অন্য যে মেয়ে-টা, সেই তো গীতা। ওর বয়েস আমার চেয়েও কম, ১২/১৩ হবে। আমার ভাগ্য
ভাল ছিল,
গাইতে পারতাম, গীতা পারতো না। আমাকে
রুক্সানাবিবি নথ-তোড় করতে পাঠায় নি। বেচারা গীতার সে সুখ জুটল না। খুব কাঁদতো সে, আমি বুকে জড়িয়ে রাখতাম তাকে। যা হোক, এক বছর কেটে গেল – আমাকে তখন মুজরাতে বসিয়ে দিল রুক্সানাবিবি, সেটা
তো হওয়ারই ছিল। হিন্দি, উর্দু শিখলাম – নতুন নাম পেলাম হাসীনা। ধীরে ধীরে বাড়ির কথা ভুলে গেলাম – আমীরসাহিবকে সেখানেই দেখলাম – ভালবাসলাম।
- তা-র-পর ?
- একদিন আমীরসাহিব চুপিচুপি বললেন
– পালাবো !! সেদিন খুব বৃষ্টি, আমীরসাহিব আমাকে বুরখা পরিয়ে
জমাদারের সিঁড়ি দিয়ে নামিয়ে ট্যাক্সিতে চাপিয়ে নিয়ে রাখলেন খিদিরপুরে। সেখানে একটা
ছোট্ট ঘরে সারাদিন বন্ধ থাকতাম, সন্ধ্যেবেলা আমীরসাহিব আসতেন, আধঘণ্টা বড়জোর থাকতেন; যাওয়ার সময় বলে যেতেন, ‘ব্যাস অর দো-দিন!!’ আমি চোখের জলে দিন কাটাতাম।
বুঝতাম না,
কি হতে চলেছে... আমীরসাহিবকে যতটুকু দেখেছিলাম মনে হয়েছিল – ভরসা করা যায়। যদিও, আমার মকসদ আমি তো খুদার হাতেই
ছেড়ে দিয়েছিলাম – তুমি যা চাও, তাই
হবে!! রাতেরবেলা একজন মাঝ-বয়সী অউরত আসত আমার কাছে শুতে, আমি ভয়
পেতাম,
আমাকে ধমকাতো, ‘এ বুড়বক! ডরটা ক্যু?’ ৩দিন কাটার পর আমীরসাহিব
ভোরবেলা হাজির,
‘চল আভি চলেঙ্গে!!’ আমিও যা ছিল হাত বাড়িয়ে
নিয়ে আবার একটা ট্যাক্সিতে চড়ে হাওড়া ষ্টেশনে পৌঁছলাম। ট্রেনে পাটনা আনলেন, সেখানে নেমেই বড়া-মসজিদে নিকাহ হল। আমি নতুন নাম আবার পেলাম – ফাতিমা। আজ আমি রুস্তম আর ইয়ুসুফের আম্মি।
আমি দমবন্ধ হয়ে শুনছিলাম, সিনেমার চেয়ে কোন অংশে কম নয়, কিন্তু,
আমি এটা বুঝতে পারছিলাম না, এই
ইতিহাস শোনানোর জন্য এঁরা আমাকে কেন জরুরী তলব করছিলেন!!
রেকাবীতে ফিরনী, আঙুর, কলা, আম আর লস্যি এলো। আমি কিছু বলার আগেই ফাতিমাবিবি বললেন, ‘কষ্ট করে আমার কথা শুনলেন, এইটুকু খেতে পারবেন – ফল আমার জামাইএর বাগিচার, চিন্তা করবেন না।
আমি ফিরনীতে চামচ ডুবিয়ে তাকালাম, ‘মাসী, আপনি আমাকে…!!’
ফাতিমাবিবির নকাব সরে গেল, ‘আমাকে বলতে হবে নয়তো, আমার বাবার কাছে খবর দেব কি করে – আমি ভাল আছি?’
আমি ভিসম খেয়ে তাকাই, ‘বা-বা?? আপনার
বাবা... তি-নি –‘
- বেঁচে থাকলে ৯০ বছর তো হবেই!!
জানিনা কোথায় আছেন –
- খবর কি ভাবে...
- আপনার কথা মনে হল, আপনি পারবেন না?
- আ-আমি ?? আমি তো
বাংলাদেশে ...
- তাঁরা সে দেশ ছেড়ে কলকাতাতে
আছেন –
- কি করে জানলেন? খবর –
- পেয়েছি। দমদমে আছেন, আমার ভাই আছে, আমার দিদি আছে ... শুধু আমি নেই।
প্রথমবার মহিলাকে কাঁদতে দেখলাম, দু-চোখ বেয়ে জল তাঁর
নিটোল মুখখানি ভিজিয়ে আরও রাঙিয়ে তুল্ল, আমি স্তব্ধ হয়ে বসে
রইলাম,
আম আর গলা দিয়ে নামছে না।
রুস্তম আমাকে ঠিকানা দিয়েছিল, আমি ডাইরিতে যত্ন করে লিখেও
রেখেছিলাম। কলকাতায় ফিরে আসি বরাবরের মতো তিন বছরের মাথায়। এর মধ্যে কলকাতায় যখনই
এসেছি,
মার শারীরিক কারণে, ফলত
বিশেষ এদিকসেদিক আর যাওয়া হত না। ষ্টেশনে রুস্তম ছাড়তে এসে মাথা নামিয়ে প্রায়
বিড়বিড় করে বলে – আম্মি আপনাকে একটা
ঠিকানা দিয়েছিলেন...
আমি কাঁধে হাত রেখে আশ্বাস দিই, ‘আমি যাব।‘
কলকাতায় ফিরে মাস ছয়েক বাদেই চাকরীটা ছেড়ে দিই, আসলে
ওঁরাই চেয়েছিলেন আমি চলে যাই। বয়েসের সাথে-সাথে নাকি শ্রম-মুল্য কমতে থাকে।
ইতমধ্যে,
ছেলে স্কুল ছেড়ে কলেজের গণ্ডীতে পা রেখেছে, নীলাও মধ্যবয়সের উঠোনে পৌঁছেছে। হিসেব করে দেখলাম ৭বছর আগেই আমার গাড়ি থমকেছে, এবার কি করা যায় সে নিয়ে বিস্তর আলাপ-প্রলাপে দিন কাটছে। কবে যে মাসগুলি ঘুরতে
ঘুরতে বছর পেরোতে লাগলো টের পেলাম যখন কলেজ ছেড়ে অভিজিৎ এসে বললো, ‘বাবা আমি পুনে যাব।‘
- কেন? আমি অবাক।
- বিনায়ক যাচ্ছে, আমাকেও যেতে বললো…
- বিনায়ক কে?
- ক্লাসমেট, তুমি দেখেছো। কোটাক মাহিন্দ্রাতে চাকরী পেয়েছে, আমার
কথা বলে রেখেছে – ফর্মাল ইন্টারভ্যু হবে, ব্যাস।
- চাকরী?? ক-কি-কি
বলছিস?
এখনই?? আমি যেন ভুত দেখছি…
- বাবা !!! এমন বলছ কেন? তুমি এই বয়সে চাকরী করোনি?? অভিজিৎ বিরক্ত হয়।
আমি অবাক চোখে চেয়ে দেখি, ছেলের গালেতে চাপা দাঁড়ি, কাঁধটাও যেন আমার মতই; উঠে আয়নায় দেখি সামনেটা ফাঁকা, আশেপাশের চুলগুলো বেশিটাই সাদা। এটাকেই কি রিটায়ারমেণ্ট বলে?
ট্রেনে তুলতে গিয়ে নীলা কেঁদেই ফেললো, আমারও
কষ্ট হচ্ছে। অভিজিৎ অপ্রস্তুত চোখে তাকায়,
- তোমরা এমন করলে কি করে হবে?
- সাবধানে যাস !!! আমি ফিসফিসিয়ে বলি।
এই জীবনে আমিই বেশী অভ্যস্ত ছিলাম, আজ যেন সেটাই নতুন
ঠেকছে। নীলা বাড়ি এসে উপোষ দিল, আমারও যেন খিদেটা আজ আর পাচ্ছে
না।
রুস্তমের ফোন এসে আমাকে একটু নাড়িয়েই দিল, লখনউ
ছেড়েছি আজ কতদিন হয়ে গেল, রুস্তম আমাকে কিন্তু ভোলেনি।
- স্যার !! আম্মির দেহান্ত হল আজ, আপনাকে ইয়াদ করছিলেন কদিন –
- স-সেকি?? আমি লজ্জায় মিশে যাই, তাঁর অন্তিম ইচ্ছা আমার পূর্ণ করার কথা ছিল...
- হ্যাঁ স্যার, আম্মি খুঁজছিলেন আপনাকে, আমি মিথ্যে বলে থামিয়ে রাখি যে, এখন আপনি কলকাতায় নেই –
- আ-আমি কি আসবো?? আমি পাপবোধ থেকেই বলে ফেলি।
- না স্যার, এখন আর দরকার নেই, এই তো গোর দিয়ে এলাম, সবাই খুব মুসীবতে পড়ল। আম্মি একাই সব সামলাতেন তো!!
পুরনো ডাইরি ঘেঁটে ঠিকানাটা পেলাম, মহিলা লিখিয়ে দিয়েছিলেন, আমি আর চেয়ে দেখিনি কখনো – নামটা দেখে চমকে উঠলাম ‘গিরিজা শঙ্কর মুখার্জি’!!
- এখানে গিরিজা শঙ্কর মুখার্জি
থাকেন? একটা ঘিঞ্জি বাড়ির উঠোনে এসে
দাঁড়িয়েছি আমি –
- কাকে খুঁজছেন? মাঝবয়সী খালি গায়ে ব্যাক্তি
আমার সামনে এসে দাঁড়ালও।
আমি নামটা আবার বলাতে সে অবাক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাল, ‘উনি এখানে থাকেন, এটা আপনাকে কে বললো?’
আমি আমতাআমতা মুখে বললাম, ‘মীর রুস্তম খান নামের আমার
পরিচিত একজন’।
- সে আবার কে? খুলনাতে থাকতো কি? বিরক্ত চোখে সে তাকায়।
- না, লখনউ। আমি দৃঢ়স্বরে বলি।
- লখনউ?? বাবা
লখনউতে কাউকে চিনতো বলে তো...
- আপনি গিরিজাবাবুর ছেলে?
- কোন টাকা-পয়েশার ব্যাপার থাকলে, দয়া করে চলে যান !!! আমি কোন কিচ্ছু
দিতে পারব না।
- টাকা?? না, সে সব কিছু তো নয়?? আমি
দ্বিধায় পড়ি।
- তাহলে আবার কি প্রয়োজন পড়লো? এতদিন বাদে কি জানতে এসেছেন শুনি???
‘কে এসেছে সাত-সকালে??’ এক প্রমিলা কণ্ঠ ভেসে এলো। এই
ব্যাক্তি নাক কুঁচকে বলল, ‘চিনি না!!’
- আর কি বলবেন বলুন, আমার বাজে বকার সময় নেই। আমার দিকে
ফিরে তাকায় লোকটি।
- আমার যা কিছু কথা বলার ছিল, সেটা আপনি বাদে কে আছেন না জেনে বলতে পারছি না। আমি ঘাড় শক্ত করি,
- বাবার ব্যাপারে এখানে কেউ
ইন্টারেস্ট নেবে না – উনি আমাদের শুধু অশান্তিই দিয়েছেন। তিনি দু বচ্ছর হল ...(আকাশের দিকে
তাকিয়ে ইশারা করে) এবার বলে ফেলুন, কি একটা নাম বললেন – সে কে আমি জানি না, কি চায়?
- আমার মনে হয় এখানে গিরিজা শঙ্কর
মুখার্জির ফ্যামিলির কেউ থাকেন না। অতএব আমি চলি –
- দাঁড়ান। আমি ওনার ছেলে –
আমি ঘুরে দাঁড়িয়ে তাকাই, ‘কণিকা বলে কাউকে চিনতেন কি? যদি বলেন যে তাকেও চেনেন না, তাহলে আর আমার এখানে কোন
প্রয়োজন নেই ধরে নিন...’
লোকটি অপলক দৃষ্টি ফেলে তাকিয়ে থাকে, ‘তার এখানে আর কোন স্থান
নেই। সে আমাদের কাছে মৃত –‘
- সেরকমই আশা করেছিলাম, তাই আর ভনিতা করার কারণ পাচ্ছি না, আমি তাঁরই ইচ্ছাতে এখানে
এসেছিলাম,
এখন সে প্রয়োজন ফুরিয়েছে। আচ্ছা চলি –
- দাঁড়ান !!! কি চায় সে?? লোকটি এগিয়ে আসে।
- কিচ্ছু না। পঞ্চাশ বছর পর কিই
বা আশা করতে পারেন তিনি? আমি মুচকি হাসি...
- এটা নাটক হচ্ছে নাকি? বাবাকে খুঁজছেন, কণিকার কাছ থেকে আসছেন বলছেন !! ... কি
কারণে এসেছেন,
সেটা শুনি?? ঘৃণা যেন ঠিকরে বেরোচ্ছে লোকটির সারা শরীর থেকে।
আমি শান্ত মুখে তাকাই, ফাতিমাবিবির কাতর মুখটা ভেসে
উঠলো চোখের সামনে, বিরক্তি চেপে বলি,
- তিনি মাসখানেক হল মারা গেছেন, আমাকে অনুরোধ করেছিলেন তাঁর বাবা বেঁচে থাকলে একবার দেখা করতে বলেছিলেন; এখানে এসে জানলাম তিনিও গত... আর তো খবর দেওয়ার কেউ নেই, তাই –
- অ ...তা, কি বলবেন বলে এসেছিলেন বাবাকে? যে, সেই
মাগী –
- একদম চুপ !!! একটা খারাপ কথা
শুনতে চাই না আমি !! চিৎকার করে উঠি
প্রমীলা স্বরধারিণী এবার বেরিয়ে এসে দাঁড়িয়েছেন, ‘কি
ব্যাপার ?’
লোকটি আমার আরও কাছে এগিয়ে এসে দাঁড়ায়, আমি এক
ধাক্কা দিয়ে তাকে সরিয়ে দিয়ে হনহন করে বেরিয়ে আসি, বাড়িটার
চাপা গন্ধটা যেন আমার শরীরকে পেয়ে বসেছিল – অনেক
শব্দ শোনা যাচ্ছে এখনো; ফাতিমাবিবির শেষ ইচ্ছাটা
অপূর্ণই থেকে গেল। গিরিজা শঙ্করবাবু বেঁচে থাকলে তাঁর মেয়ে কনিকার খোঁজ পেয়ে আমার
কাছে কি বলতেন সেটাও জানা হল না। আমার সংগ্রহে আরেকটি অসম্পূর্ণ গল্প যোগ হোল।
এখন আর মানুষের কথা শুনতে ইচ্ছা করে না, অভিজিৎ
মাসছয়েক আগে এসেছিল, একজন মালায়ালি মেয়ের সাথে বিয়ে করবে বলে
স্থির,
নীলা বাধ সেধেছিল, আমি বলি, ‘লাভ নেই,
না জানিয়ে বিয়ে করবে।‘
এক সপ্তাহ বাদে বিয়ে, আত্মীয়স্বজন-বন্ধু মিলিয়ে
দুশোলোকের ভূরিভোজন হবে, একটা ফিক্স ডিপোসীট ভাঙাতে
দিয়েছি। অভিজিৎ বলে রেখেছে সে চেষ্টা চালাচ্ছে, এ
বছরের মধ্যেই কানাডায় চাকরী নিয়ে সেটল করবে। নীলা আমার মুখের দিকে চায়, আমি মৃদু হাসি, ‘ছেলে তোমার বড় হয়ে গেছে...’
শুভব্রত
দাশগুপ্ত
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন