ছ'টা ছাপান্নর বনগাঁ লোকাল - মৈত্রেয়ী চক্রবর্তী



'টা ছাপান্নর বনগাঁ লোকাল
মৈত্রেয়ী চক্রবর্তী

হোটেলের জানলা দিয়ে উঁকি দেয় প্রেমা, ঘুমন্ত নগরী ধরা দেয় তার চোখে। আস্তে করে ব্লাইন্ড উঠিয়ে চেয়ে থাকে সূর্যোদয়ের দিকে। নিজের জন্মভূমিতে সূর্যোদয় শেষ কবে দেখেছে মনে করার চেষ্টা করে। কিছু সময়ের মধ্যেই কেমন অস্বস্তি হয়; দৌড় ঝাঁপ, ব্যস্ততাই যার জীবন, একটা ছুটির জন্য প্রাণ কাঁদে, কিন্তু ছুটি পেয়ে যেন আর নিতে পারে না। এক্ষুনি কোনো কিচ্ছু করার নেই, অথচ রোজের রুটিনে অভ্যস্ত বলে, ঘুম ভেঙ্গে গেছে। বিছানায় গা এলিয়ে সোশ্যাল মিডিয়াতে লগ-ইন করতে গিয়ে থেমে যায় আঙ্গুল, নিজেকে শাসন করে "না এখনি না।"

প্রেমা, মডেলিং জগতের এক বিখ্যাত নাম। আজ সারা বিশ্বে তার কদর, চাহিদা। এই যে এমন সাংঘাতিক দামী হোটেলের স্পেশ্যাল ঘরে সে রয়েছে, সেখানেও তাকে সম্মান জানাতে, তার পছন্দ মাফিক ঘর সাজিয়ে দিয়েছে হোটেল কর্তৃপক্ষ। সোশ্যাল মিডিয়াতে যদি ওর এই মুহূর্তের ছবি পোস্ট করে, ঘুম ভাঙ্গা ব্রাশ করাও হয়নি, এমন ছবিতেও কয়েক মিনিটে লাখো লাইক, কমেন্ট, শেয়ার হয়ে যাবে। শুধু, আজকের এই জায়গায় আসতে প্রেমার কতো দিন কতো রাত আর কতো কতো কিছু ইনভেস্ট করতে হয়েছে সে খবর প্রেমা ছাড়া আর বোধহয় শুধু ঈশ্বরই জানেন। হোটেলের বিছানায় অলস শরীর ছেড়ে দেয় প্রেমা। চোখ বন্ধ করলে আজও যেন শুনতে পায়,

"অনুগ্রহ করে শুনবেন, 'টা ছাপান্নর বনগাঁ লোকাল চারের এ প্ল্যাটফর্ম থেকে ছাড়বে। বনগাঁ লোকাল চারের এ থেকে ছাড়বে। তিন নম্বরের গাড়ি কারশেড যাবে, যাত্রীরা তিন নম্বরের গাড়িতে উঠবেন না" গমগমে আওয়াজে ট্রেনের সময় ঘোষনা হচ্ছে, ভিড় ঠাসা প্ল্যাটফর্মে দৌড়াদৌড়ি, হাজারো আওয়াজ, বিশ্রী গন্ধ।

প্রমীলা, বনগাঁ লাইনের মছলন্দপুরের মেয়ে। বাবা মছলন্দপুরের সেই নামকরা চানাচুরের বিক্রেতা, থাকার মধ্যে একটা টিনের চাল ওলা দর্মার বেড়ার বাড়ি ছিল ওদের। কতো কষ্ট করে পড়াশোনা করেছে সে প্রমীলাই জানে। যখন উচ্চমাধ্যমিকের গণ্ডী পেরিয়ে শহরে এলো পড়তে, কি ভয় পেয়েছিল প্রথমদিন। ক্রমে ক্রমে বন্ধু বেড়েছে, যাতায়াতের সঙ্গীদের সাথে পরিচিত হয়েছে, পড়াশোনার চাপ বেড়েছে আর একটু একটু করে সাহসী হয়েছে প্রমীলা। নিত্যযাত্রীদের মধ্যে বেশ আদান প্রদানের চল ছিল, সে রান্নার রেসিপিই হোক, কি মহিলাদের ম্যাগাজিন। অনেক সময় শাড়ি গয়নাও ধার নেওয়া চলত। যদিও প্রমীলা সেটা কোনোদিন করতে চায়নি, তবু পরিস্থিতির চাপে সেটাও করতে হয়েছে। তবে মেয়েদের ম্যাগাজিন বেশ ক'বার ধার নিয়েছিল। সেই ম্যাগাজিনের বিজ্ঞাপণের সূত্র ধরেই তার মডেলিং জগতে পা রাখা। বাড়ির মানুষদের কতকটা লুকিয়েই অ্যাপ্লাই করে সে।

কথাটা বলা যতো সহজ কাজে করা ততোটাই কঠিন ছিল। তখন হাতে পয়সা তো তেমন থাকত না, তায় জেনারেল কাস্ট, কাজেই যে কোনো বিষয়ে কন্সিডারেশন পাবার জন্য জুতোর শুকতলা খইয়ে ফেলতে হত। নানান প্রতিকূলতার সাথে লড়াই করে, শুধু ভালো নম্বরের জোরে পড়াশোনা করে যেত। তার মধ্যে অমন দামী জামা কাপড়ে তোলা তস্য দামী ফটো, সেটা বাই পোস্ট পাঠানোর খরচ, সব মিলিয়ে ওই বনগাঁ লোকালের যাত্রীরা সাহায্য না করলে আজ প্রমীলা, প্রেমা হয়ে উঠত না।

দেখতে সুন্দর হলে সাথে বোধহয় পয়সার জোরও থাকা উচিত। একটা জিনিস প্রমীলা বুঝেছিল, জলে নামলে চুল ভিজবেই আর জলে নেমে কুমিরের সাথে বিবাদ করে লাভ নেই। এক ইঞ্চি জায়গা পেলেও সেটা আঁকড়ে পড়ে থাকতে হবে। নিজের টিকে থাকার জন্য, শাইন করার জন্য দরকারে পলিটিক্সও করতে হবে, না হলে অন্য মানুষ তাকে সিঁড়ি বানিয়ে ওপরে চড়ে যাবে। আর সে তলিয়ে যাবে এমনভাবে যে কেউ খুঁজেই পাবে না।

প্রথমবার যখন নামী মহিলাদের ম্যাগাজিন আয়োজিত বিউটি কনটেস্ট-এ সুযোগ পায়, তখন কি আজকের দিনটা কল্পনাও করতে পেরেছিল? তাদের প্রায় কুড়ি জনকে সিলেক্ট করে তাদের গ্রুমিং করা হয়। সেই জীবনে প্রথম প্রমীলা জানল, শুধু দেখতে সুন্দর হলেই সব নয়। হাঁটা চলা, কথা বলা, হাসি, খাওয়া, ঘুম সব কিছুরই বিশেষ পদ্ধতি আয়ত্তে আনতে হবে। তবে তাদের মতো গ্রাম্য মেয়েদের একটা সুবিধে আছে, তারা কাঁচা মাটির দলার মতো। যেহেতু কিচ্ছু জানে না কাজেই তাদের যা শেখানো হবে, সেটাই পুরোপুরি শিখে নেবে। প্রথবারেই অকল্পনীয় ভাবে প্রথমার মুকুট যেতে প্রমীলা। এক ধাক্কায় বদলে গেল তার ও তার ছোট্ট পরিবারের জীবন যাত্রার রকম। কম্পিটিশনের নিয়মানুযায়ী বিজয়িনী অনেকগুলো নামী দামী সংস্থার সাথে কাজ করবার সুযোগ পাবে। কতো বিজ্ঞাপণে তখন তার মুখ, কি টিভিতে কি বিলবোর্ডে। শহরে তখন অনেকেই তাকে চিনতে পারে। মছলন্দপুরের বাড়ি, জমি বেচে দিয়ে পাকাপাকি তারা চলে আসে শহরের বেশ অভিজাত এলাকায়, সেখানের ফ্ল্যাটটাও পুরষ্কারে পাওয়া।

কটা দিন, কটা মাস যেন উড়েছে প্রমীলা। নাম ছেঁটে ভার কমিয়েছিল, ভেবেছিল বুঝি তারকা হয়ে গেল। কিন্তু না, পরের বছরের বিজয়িনী এসে এক ফুঁয়ে সরিয়ে দিয়েছিল প্রেমাকে। সেই সময়ে আকাশ থেকে মাটিতে আছড়ে পরে প্রেমার যে শিক্ষা হয়েছিল সারা জীবনেও ভোলেনি। তার সমস্ত কাজ পেয়ে যাচ্ছিল নতুন মেয়েটি। এমনকি ফ্ল্যাটটাও ছেড়ে দিতে হয়েছিল, কারণ প্রেমা শর্তাবলী পড়েনি ঠিক করে। সেখানে পরিষ্কার লেখা ছিল যে, এই ফ্ল্যাট যদি এক বছরের মধ্যে কিনে নিতে পারে তবে এটা তার, নাহলে পরের বছরের বিজয়িনী কে ছেড়ে দিতে হবে।

প্রেমার প্রথম শিক্ষা, কোথাও সই করবার আগে, অবশ্যই খুঁটিয়ে সব পড়ে নেওয়া। আর দ্বিতীয় শিক্ষা, যতো নামডাকই হোক পা মাটিতেই রেখে চলা উচিত, নাহলে এমন আছাড়টাই খাবে বারে বারে। ফ্ল্যাট ছেড়ে একটা সাধারণ মধ্যবিত্ত পাড়ায় ঘর ভাড়া নিয়ে থাকতে বাধ্য হয়েছিল। একটা পুরষ্কারে পাওয়া তার ঝাঁ চকচকে বিদেশী ব্র্যান্ডের গাড়ি এই ধাক্কায় কোম্পানীকে ফেরৎ দিয়ে, পাবলিক ট্রান্সপোর্ট ব্যবহার শুরু করে। এবং তখন যেখানেই কাজ চাইত সবাই ই প্রায় 'তার উপযুক্ত কাজ নেই' বলে এড়িয়ে যেতে থাকে। দুনিয়া কতো নিষ্ঠুর নির্মম হতে পারে সেটা দেখতে থাকে প্রেমা। যাদের অসময়ে সে পাশে দাঁড়িয়েছিলো, তারাই প্রেমার দুঃসময়ে আরোও কোণঠাসা করতে থাকে তাকে।

হাতে কাজ নেই, বাড়ি জমি নেই যে আর কিছু বেচবে বা নিজেদের জায়গায় ফিরে যাবে। এদিকে ঠাট বাট এমন করে ফেলেছে যে সেগুলো বজায় না রাখলেই নয়। কিছুই যখন বুঝতে পারছে না কি করা উচিত, মা বাবাও যথেষ্ট রাগ করে রোজ কথা শোনাচ্ছে, সেই সময়ে পাশে দাঁড়িয়েছিল রজত। এইসব ইভেন্টগুলোর স্টেজ ডিজাইনার। সেই সূত্রেই পরিচয় হয়ছিল প্রেমার সাথে। প্রেমার অনুরোধে রজত নিজের টিমে সামান্য একটা কাজ দেয় প্রেমাকে। তবে, এতোটুকু ছাড় দিত না, পূর্বপরিচিত বা প্রেমা বিউটি কনটেস্টের উইনার ছিল বলে। বাকিদের মতোই খাটাত তাকেও। ভুল করলে একঘর মানুষের সামনে গালি দিতে ছাড়ত না। তবু, প্রেমা বর্তে গেছিল একটা কাজ পেয়ে। মাইনে পত্র যা পেত তাতে সাধারণ ভাবে থাকলে বেশ চালিয়ে নেওয়া যেত। না হলে তার তো পড়াশোনাও শেষ করতে পারেনি। তখন তো ভেবেছিল আর কিসে লাগবে পড়াশোনা? কিন্তু এই সময়ে হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিল পেটে বিদ্যে না থাকলে কি হাল হয়।

রজতের গ্রুপে কাজ করবার একটা প্লাস পয়েন্ট ছিল যে, প্রেমার মোটামুটি নিজের জগতের সংস্পর্শেই থাকল, খবরাখবর সব রাখার সুবিধে ছিল। প্রায় বছরখানেক এই কাজের পর হঠাৎই একজন প্রোডিউসারের নজর পরে তার ওপর। বাড়িতে খবর পাঠিয়ে দেখা করতে চায়। এই 'দেখা করতে চাওয়ার' আসল মানেটা যখন বুঝল প্রেমা, ততোক্ষণে অনেকটা দেরী হয়ে গেছে। সেই প্রথম টের পায়, সে আসলে শুধুই একজন সুন্দরী মেয়ে, কিছু মানুষ তাকে মানুষের মর্যাদা দিতে নারাজ। তাদের কাছে প্রেমার শরীরের মূল্য অনেক। কাজ দেবার নাম করে যখন শুধুই তাকে দিনের পর দিন, রাতের পর রাত ভোগ করা শুরু করে সেই প্রোডিউসার এবং তার প্যায়ারের লোকজন তখন, ডুবে যাবার আগে বাঁচার শেষ চেষ্টা করে সবাই, প্রেমাও করেছিল। ব্ল্যাকমেলিংএর ভয় দেখিয়ে, দুএক জনকে ফাঁসিয়ে দিয়ে, কাজ আদায় করেছিল। তা নিয়ে অবশ্য প্রেমার কোনো গিল্টি ফিলিং নেই, কারণ তার মতে 'শঠে শাঠ্যং সমাচরেত' টুকুই অনুসরণ করেছে সে।

কাজ পেতে শুরু করেই প্রেমা দিনরাত এক করে এমন ভাবে কাজে ডুবে গেল, তার বিরুদ্ধে কেউ যাতে অভিযোগ করবার সুযোগ না পায়। পয়সা কম, চ্যারিটি শো, বিখ্যাত ডিজাইনার থেকে অখ্যাত ডিজাইনার সবার সব রকমের কাজ সে করেছে। প্রেমা শুধু জানত ওপরে উঠতে হবে। তার নিজের জায়গা করে নিতে হবে। কেউ এক ইঞ্চি জমিও ছাড়বে না, কেউ হাতে ধরে সুযোগ এনে দেবে না। বরং সুযোগ নেবে তার থেকে, কারণ ততোদিনে প্রেমা যে সহজলভ্য তেমনটাই ছড়িয়ে গেছে বাজারে। কাজেই নিজের সেই দুর্নাম ঘোচাতে উঠে পড়ে লাগে প্রেমা। সহকর্মীদের মধ্যে সবাই যে তার শুভাকাঙ্খী ছিল মোটেই তা' নয়। বরং যারা বেশি বন্ধুত্ব দেখাত, সামনে হেসে কথা বলত, দেখা হলেই ফটো তুলে ফেসবুকে পোস্ট করত যেন কতো খুশির সংবাদ; তারাই প্রেমার সবথেকে বেশি ক্ষতি চাইত। শুধু চাইতই না, বেশ কবার ক্ষতি করবার চেষ্টাও করেছে।



কখনও র্যাম্পে নামার আগে রেডি হতে গিয়ে নিজের পোশাক খুঁজে পায়নি, কখনও হয়ত অকারণ ঝগড়া করে কসেন্ট্রেশন নষ্ট করে দিয়েছে। একবার তো, সপ্তাহব্যাপী বিখ্যাত ফ্যাশন শোএর  র্যাম্পের ওপর প্রেমাকে ফেলেও দিয়েছিল একদল। প্রেমার যে স্টিলেটো পরে হাঁটার কথা ছিল, তার হিলটা কেমন করে জানি লুজ করে রাখে। বাইরে থেকে দেখলে কিছুই টের পাওয়া যাবে না, কিন্তু কয়েক পা হাঁটার পরেই অঘটন টা ঘটবে। গ্রিনরুম থেকে স্টেজ অবধি কোনো সমস্যা ছিল না। কিন্তু স্টেজের ওপর হাঁটতে গিয়েই হিল আল্গা হয়ে, পা মচকে মুখ থুবড়ে পড়ে প্রেমা। কাজটা কাদের করা প্রেমা আন্দাজ করলেও যথেষ্ট সাক্ষ্য প্রমান না থাকায় কিছুই করতে পারেনি প্রেমা তাদের বিরুদ্ধে। অবশ্য পারেনি বললে বোধহয় ভুল বলা হয়, প্রেমা তার নিজের কাজ দিয়ে তাদের যোগ্য জবাব দেয়। মচকানো, ব্যান্ডেজ করা পা নিয়েও পরদিনও কাজে যোগ দেয়। তার মনের জোর, সাহসীকতাকে কুর্নিশ জানায় সকলে। ফলে অভাবনীয়ভাবে লাইমলাইটে চলে আসে প্রেমা। এইসব ঘটনার থেকে প্রচুর অভিজ্ঞতা পেয়েছিলো। আর পেয়েছিলো এক দু'জন সত্যিকারের বন্ধু। যারা প্রেমাকে সঠিক পরামর্শ দিয়েছে, বেশ কিছু কানেকশন দিয়েছে যার ফলে দেশী বিদেশী বিভিন্ন কোম্পানিতে মডেলিংএর সুযোগ পায় প্রেমা। মা বাবাকে দেখিয়ে দিয়েছিলো সে কিচ্ছু ভুল করেনি। তাদের সব রকম আরামের বন্দোবস্ত করে প্রেমা। জীবনের শুরুতে তাদের যে যুদ্ধ করতে হয়েছে, বাকি জীবনটুকুতে তার কণামাত্র ছায়াও যাতে না পড়ে।

ডিগ্রী অর্জন না করতে পারলেও প্রেমা পড়াশোনা করেছে প্রচুর। ট্রাভেল করবার সময়টাকে দারুণ ভাবে কাজে লাগাত সে। ফলে, নিজের পছন্দসই বিভিন্ন বিষয়ে বা কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স নিয়ে অনায়াসে তাবড় তাবড় জ্ঞাণী মানুষদের সাথে আলোচনায় যোগ দিয়ে তাক লাগিয়ে দিয়েছে বহু বার। আর সেই সুবাদেই তার নিজের জীবন নিয়ে বই লেখার কথা মাথায় আসে। যেখানে শুধু তার কথাই থাকবে না। থাকবে তাকে ধ্বংস করার চেষ্টা যারা করেছিল তাদের নামও। কিচ্ছু লুকোবে না প্রেমা। এমনকি মনে মনে সে যে মানুষটিকে কামনা করত সেটাও অকপটে স্বীকার করবে। যদিও সেই মানুষটিকে কেন, কাউকেই তার দুর্বলতার কথা টের পেতে দেয়নি এতো যুগ। তার লেখা সেই বই আজ প্রকাশিত হবে। তার উন্মোচন উপলক্ষ্যেই শহরে আসা প্রেমার। সে বই লিখেছে, তাতে অকপট স্বীকারোক্তি আছে, বহু মানুষের চরিত্রের আসল রূপ ধরা আছে, এই কথাগুলো কেমন করে জানি পাবলিকের কানে পৌঁছে গেছে। আর তাই তারা মুখিয়ে আছে বইটা হাতে পাবার জন্য। এখন যদি প্রেমা সোশ্যাল মিডিয়াতে জানান দেয়, সে কোথায় রয়েছে বা এমনিই 'সুপ্রভাত' বলে শুভেচ্ছা জানায় লোকের প্রশ্নের ঢল নামবে, আর অতো উত্তর দেবার সময় বা ইচ্ছে কোনোটাই আজ তার নেই। বই উদ্বোধন হবার সময় থেকে সে সোশ্যাল মিডিয়াতে অ্যাক্টিভ হবে, মনেমনে সেটাই স্থির করে।

বিঁপ বিঁপ শব্দে ফোন তোলে প্রেমা, ইন্টারকমে রিসেপশনিস্টের গলা "গুড মর্নিং ম্যাম। ম্যাম, সাম মিস্টার আর.এস, ওয়ান্টস টু মিট ইউ। হি ইস সেয়িং হি নোজ ইউ। ওকে ম্যাম সেন্ডিং হিম, থ্যাঙ্ক ইউ"

নিজেকে আয়নায় দেখে নেয় প্রেমা, প্রেজেন্টেবল লাগছে কি না। আর.এস, কে হতে পারে? তার পরিচিত মহলে এই নাম তো মনে করতে পারছে না। দেখাই যাক, ভাবতে ভাবতে দরজায় টোকা।

দরজা খুলে মিনিট খানেক সময় গেল, মানুষটাকে চিনতে। রজত শুভ্র, সেই অসাধারণ রূপবান মানুষটা যাকে তার টিমের সব মেয়েরাই বোধহয় স্বপ্নে দেখত। প্রেমাও তার ব্যতিক্রম ছিল না। কিন্তু কঠিন কঠোর রজত কাউকে পাত্তা দিত না, নিজের কাজ ছাড়া। আর তাই অত অল্প বয়সেও রজত বেশ নামজাদা একজন হয়ে উঠেছিল। প্রেমার দুঃসময়ে তাকে কাজ দিয়েছিল সে, প্রেমা রজতের প্রতি কৃতজ্ঞ, ফলে মনের কথা কোনোদিন মুখে আনবার সাহস করেনি। কিন্তু এখন সামনে যে দাঁড়ানো সে শুধুই আর.এস। রজত শুভ্রর সাথে তার মিল খুঁজে বের করতে হয়। অমন লম্বা, পেটানো চেহারার মানুষ কেমন নুব্জ ক্যুব্জ হয়ে গেছে। যা বয়েস তার তিন গুণ বেশি দেখাচ্ছে যেন। হাত পা স্ব-বশে থাকছে না। একটা সিগারেট বিড়ি মদ যে কোনোদিন ছুঁতো না সেই মানুষ ড্রাগ অ্যাডিক্টেড, দেখে চোখে জল আসছে প্রেমার। হাত ধরে ধীরে ধীরে সোফায় নিয়ে গিয়ে বসায়, তাকিয়ে থাকে এক দৃষ্টে। এই তার সেই স্বপ্নের পুরুষ, তাকে বাঘের মতো ভয় পেলেও আজও তার জায়গায় কাউকে বসাতে পারেনি প্রেমা। গলা ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছে করছে, কি করে নিজেকে এমন করে ফেলল রজত? এখন জিজ্ঞেস করেও কি সদুত্তর পাবে? আচ্ছা, আজ সে প্রেমার কাছেই এলো কেন? সব্বোনাশ, এ কি এখন প্রেমার নাম জড়িয়ে দেবে নাকি? তাহলে তো প্রেমার সব শেষ। নাকি সাহায্য চায় প্রেমার কাছে, সে ও তো একদিন প্রেমাকে সাহায্য করেছিল? কাউচের পাশে মাটিতে বসেই সাত পাঁচ ভেবে চলে প্রেমা। ভয় লাগলেও, মোহাবিষ্টের মতো রজতের দিকে তাকিয়ে বসে থাকে।

"আ আ আ আমায় কিছু খ্খেতে দ্দেবে? খ্খিদে পাচ্ছে খুউব" রজতের অসংলগ্ন কথায় চমকে গিয়ে প্রেমা, উঠে দাঁড়ায় কান্না মুছে। কি খেতে দেবে? রজতের দিকে পিছন ফিরে, ফোন তুলে খাবারের অর্ডার করে। আজও মনে আছে রজতকে শেষ যখন দেখেছিল সেই সময়ে ওর ব্রেকফাস্টে কি থাকত। অর্ডার করে বেশ খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে কান্না মুছল। ভাবে, উপরওয়ালার কি খেল, সারাজীবন ধরে যাকে মনের মণিকোঠায় ভরে রেখে নিজেকে ইন্সপায়ার করেছে, সবার অলক্ষ্যে তাকে প্রেম নিবেদন করেছে, আর কয়েক ঘন্টা পর প্রেমা নিজের বই উদ্বোধনের সাথে সাথে নিজের অবসরের কথাও অ্যানাউন্স করতে চলেছে, তার আগের মুহূর্তে নিয়ে এলেন সেই রজতকেই; কিন্তু এমন অবস্থায়, যে প্রেমার বাকি জীবনটা রজতের সঙ্গে কাটলেও হয়ত এর চিকিৎসা করাতে করাতেই কেটে যাবে। কি হবে কি হতে চলেছে কিচ্ছু মাথায় কুলোচ্ছে না প্রেমার। রজতের খাবার এলে ওকে খাইয়ে, নিজের বাকি কাজ সারতে হবে। নাহলে বিকেলের অনুষ্ঠানে দেরী হয়ে যাবে। নিয়মানুবর্তিতা তো এই মানুষটার থেকেই শেখা। কিন্তু একা রজতকে রেখে যাওয়া কি উচিত হবে? ভাবতে ভাবতে ঘোরে প্রেমা।

যে দৃশ্যটার জন্য একেবারেই প্রস্তুত ছিল না, রজত সুস্থ স্বাভাবিক, তার ঠিক পিছনেই দাঁড়িয়ে হাসছে। চমকে গিয়ে, বিষম খেয়ে একাকার প্রেমা। উল্টে রজত তাকে জল খাওয়ায়, মাথায় থাবড়া দেয়, 

"এটা কি হল? কোন দেশি রসিকতা এটা?"

"তুমি ভুলে গেছ? অ্যাক্টিংএর কেমন সখ ছিল আমার? মিমিক্রিতে সবাইকে টেক্কা দিতাম? তাই ভাবলাম___ দেখি, এখনও পারি কি না"

"খুব খারাপ ধরণের চিন্তা ভাবনা" বলে গম্ভীর মুখে কাউচে গিয়ে বসে প্রেমা। প্রায় পায়ের কাছে মান ভাঙাতে বসে রজত। কাউচের সামনে হাঁটু গেড়ে, দুই হাতে ধরে প্রেমার মুখটা নিজের দিকে ঘোরায়,

"আমি, এইভাবে যদি অন্য কারোর কাছে যেতাম, সে দরজার বাইরে থেকেই হয় তাড়িয়ে দিত, আর নাহয় ঘরে আনার পর সিকিউরিটি ডাকত, খাবার অর্ডার করার অছিলায়। কেন তেমন করলে না প্রো? আমায় এমন অবস্থায় দেখে বুক ফাটা কান্না কেন এলো তোমার,ঘেন্নার বদলে? এতো বছর পরেও, আমার ব্রেকফাস্ট ঠিকঠাক বলে দিতে পারলে, কি করে? ভাবছ তো, আমি তোমার কাছেই কেন এলাম? তোমার বই, যে লিক হয়ে গেছে প্রো সে খবর রাখো?" হতবাক প্রেমা কি বলবে কিছুই বুঝতে পারে না। রাগে অভিমানে মারতে ইচ্ছে করছে রজতকে, আবার এই প্রথম তার স্পর্শ পেয়ে গলে যেতে ইচ্ছে করছে আইসক্রিমের মতো। প্রমীলাকে প্রেমা করলেও রজত কিন্তু বরাবর 'প্রো' ই বলত। আবার বই পাবলিশের আগে লিক হয়ে গেছে তার মানেটা কি বোঝার চেষ্টা করে।

"তোমাকে আমার কুচি কুচি করে দিতে ইচ্ছে করছে, ছাড়ো আমায়" রাগ দেখিয়ে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা চালায় প্রেমা। ছাড়ানোর চেষ্টা করতেই মুখ ছেড়ে দুই হাতে জড়িয়ে ধরেছে তাকে।

"কি ভেবেছ? তুমি এইসব করবে, আর আমি আপ্লুত হয়ে যাব, তাই না? আমার যা রাগ হচ্ছে তোমায় কি বলব" রাগত স্বরে বলতে থাকে প্রেমা।  ভাগ্যিস ব্রেকফাস্ট দিতে এলো, তাই তখনের মতো ছাড়ান পেল প্রেমা। দুজনে খেতে বসে একসাথে, রজত কন্টিনিউ করে কথা,

"কিচ্ছু বলতে হবে না, তোমার কি ইচ্ছে করছে তোমার চোখ সব বলে দিচ্ছে। বলব কি ইচ্ছে করছে তোমার?" হাসতে হাসতে বলে রজত, ধরা পড়ে মুখ লাল করে মাথা নাড়ে প্রেমা।

"তুমি জানো না, বইটা ওখানে যে প্রেসে ছাপতে দিয়েছিলে সেই প্রেসে আমার খুব পরিচিত একজন কাজ করে। বাকিরা বাংলা না জানলেও ও জানত, আর তোমায় তো চিনতই। ও বইটা পড়ে, আর আমায় জানায় তোমার স্বীকারক্তি, আমি অবশ্য পড়বার সুযোগ নেইনি। তবে, তোমার মনের কথাগুলো জানবার পর কি করে চুপ করে থাকি বলতো? তুমি কোনোদিন বোঝোনি, তোমায় কেন আমার টিমে কাজ দিয়েছিলাম আর কেন প্রমীলাকে প্রো বলতাম। তুমি আমার প্রাইয়রিটি ছিলে, তোমায় নিজের কাছে যাতে রাখতে পারি সে ব্যবস্থা করেছিলাম। তুমি তবু চলে গেলে, আর এতো ব্যস্ত হয়ে গেলে যে, যোগাযোগ রাখাই দায়। তখন কাজ করে ক্যারিয়ার গুছিয়ে নেবার সময় ছিল বলে তোমায় টের পেতে দেইনি, তাহলে শেষে প্রেমে হাবুডুবু হয়ে সবার সব কাজ পণ্ড হত। যাইহোক, এখন তুমি রেডি হও, আমি বিকেলে সময় মতো এসে তোমায় নিয়ে যাব। আমি এখন ইভেন্ট ম্যানেজার আর.এস" উঠে পড়ে রজত তখনকার মতো।

"তোমায় আরেকটা কথা তো বলাই হয়নি। তোমার বইএর নামটা দারুণ হয়েছে। জানো আমিও এক কালে ওই ছ'টা ছাপ্পান্নর বনগাঁ লোকাল করে যাতায়াত করতাম, সে দিনগুলোও ফিরে পাবো তোমার বইএর হাত ধরে। আর, সহযাত্রীদের উপকারের প্রতিদান দেবার এর থেকে ভালো উপায় আর কি হতে পারে?"

"আমায় নিয়ে যাবে আবার একদিন, বনগাঁ লোকালে?" কাছে ঘেঁষে এসে বলে প্রেমা।

মৈত্রেয়ী চক্রবর্তী

৩টি মন্তব্য: