সুবীর সরকার - সাক্ষাৎকার

স্বাধীনতা! সে আবার এলো কই? একটা বিশাল উপমহাদেশকে টুকরো টুকরো করে,রক্তের স্রোতে ভেষে, অবিশ্বাস ও সন্দেহের আবহে ৪৭ এর স্বাধীনতা আসলে স্বপ্নভঙ্গের এক বেদনামাত্রই বলে আমার মনে হয়। তাই ৭০ বছর পেরিয়েও বৈষম্য, দারিদ্র,দাঙ্গা, কুসংস্কার, ঝা-চকচকে আধুনিকতার পাশে বস্তীর তীব্র অন্ধকার, শোষণ বঞ্চনার এক ভাঙ্গা দালানে বসে থাকা পাখিদল। উন্নয়ণ হয়েছে। তবে সেই উন্নয়ন ১০ ভাগ মানুষের, আমজনতার নয়। আমজনতা কেবল পিছু হটেছে,উচ্ছেদ হয়েছে।পিড়িত হয়েছে। আত্মপরিচয় হারিয়েছে। ভারতীয় রাজনীতিতে ধর্মনিরপেক্ষতা কখনই শক্তপোক্তভাবে দাঁড়াতে পারেনি। ভারতবর্ষের কোন রাজনৈতিক দলই ধর্মনিরপেক্ষতাকে মান্যতা দিতে পারে নি, বা চায় নি। আসলে সবাই চেয়েছে ভোটব্যাঙ্কের রাজনীতি করতে। তবে ভারতবর্ষের সাধারন জনসমাজ কিন্তু শান্তি চেয়েছে, সম্প্রিতী চেয়েছে সবসময়। তাই সেভাবে প্রকট হতে পারে নি ভারতে সাম্প্রদায়িকতা, এটাও কিন্তু বাস্তব। লোকসমাজই লালন করবে আবহমানকাল ধরে ধর্মনিরপেক্ষতাকে। এটাই চিরায়ত ভারতের ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকার। ~~~~~~~~~~

সুবীর সরকারের
সাথে মুখোমুখি আলাপচারিতায় রংরুট

রংরুট: কখনো কি মনে হয়েছে ১৯৪৭-এর স্বাধীনতা রংরুট ধরেই এগিয়ে চলেছে? অন্তত বিগত সাত দশকের নিরিখে। বিশেষ করে এই প্রশ্নটি দিয়েই আপনার সাথে আলাপটুকু শুরু করার কারণ আর কিছুই নয়, সাত দশকের স্বাধীনতার প্রাপ্তি আর অভিজ্ঞতার বাটখারায় মানুষের সার্বিক উন্নতির রেখাচিত্রটি কি অনেকটাই বেঢপ দেখায় না? আপনার মতামত

সুবীর সরকার: স্বাধীনতা! সে আবার এলো কই? একটা বিশাল উপমহাদেশকে টুকরো টুকরো করে,রক্তের স্রোতে ভেষে, অবিশ্বাস ও সন্দেহের আবহে ৪৭ এর স্বাধীনতা আসলে স্বপ্নভঙ্গের এক বেদনামাত্রই বলে আমার মনে হয়। তাই ৭০ বছর পেরিয়েও বৈষম্য, দারিদ্র,দাঙ্গা, কুসংস্কার, ঝা-চকচকে আধুনিকতার পাশে বস্তীর তীব্র অন্ধকার, শোষণ বঞ্চনার এক ভাঙ্গা দালানে বসে থাকা পাখিদল। উন্নয়ণ হয়েছে। তবে সেই উন্নয়ন ১০ ভাগ মানুষের, আমজনতার নয়। আমজনতা কেবল পিছু হটেছে,উচ্ছেদ হয়েছে।পিড়িত হয়েছে। আত্মপরিচয় হারিয়েছে।


রংরুট: ভারতবর্ষের রাজনীতিতে একটি ধর্মনিরপেক্ষতার বাতাবরণ, যেটি বৃটিশ আমল থেকেই কংগ্রেসি নেতৃত্ব দ্বারা সুপরিকল্পিতভাবে গড়ে তোলা হয়েছিল, স্বাধীনতার সাত দশক পেড়িয়ে এসে সেই বাতাবরণের ফানুশটিকে কি দিনে দিনে চুপসে যেতে দেখছেন না? না কি ভারতীয় জনমানসের মূল আবেগ সেই বাতাবরণটিকে আরও বহুদিনের জন্যে রক্ষা করতে পারবে। পারবে ভারতীয় ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকারের বলেই? আপনার মতামত।

সুবীর সরকার: ভারতীয় রাজনীতিতে ধর্মনিরপেক্ষতা কখনই শক্তপোক্তভাবে দাঁড়াতে পারেনি। ভারতবর্ষের কোন রাজনৈতিক দলই ধর্মনিরপেক্ষতাকে মান্যতা দিতে পারে নি, বা চায় নি। আসলে সবাই চেয়েছে ভোটব্যাঙ্কের রাজনীতি করতে। তবে ভারতবর্ষের সাধারন জনসমাজ কিন্তু শান্তি চেয়েছে, সম্প্রিতী চেয়েছে সবসময়।তাই সেভাবে প্রকট হতে পারে নি ভারতে সাম্প্রদায়িকতা, এটাও কিন্তু বাস্তব। লোকসমাজই লালন করবে আবহমানকাল ধরে ধর্মনিরপেক্ষতাকে। এটাই চিরায়ত ভারতের ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকার।  


রংরুট: আমাদের পশ্চিমবঙ্গে সুদীর্ঘ বাম আন্দোলনের ঐতিহ্য বাঙালির আত্মপরিচয়কে কতটা বিশেষত্ব দিতে পেরেছিল বলে আপনার ধারণা। এবং একই সাথে ক্ষমতা কেন্দ্রিক মানুষের ভোট কুক্ষিগত করে রাখার যে রাজনীতি তা কিভাবে বাম ঐতিহ্যকে ধুলিসাৎ করল শেষমেষ? আজকের দিনে দাঁড়িয়ে এই রাজ্যে বাম আন্দোলনের পূনরাভ্যুত্থান কি আর সম্ভব আদৌ?

সুবীর সরকার: বামপন্থা পেরেছিল মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে, প্রান্তিক জনগণকে নিজের স্বাতন্ত্র ও কথা বলার স্বাধীনতা দিতে। নৈতিকতার শিক্ষা দিতে। আদর্শের বাতাবরণ নির্মাণ করতে। কিন্তু সিপিএম ক্ষমতা কেন্দ্রিকররণের মোহে প্রবেশ করলো, মানুষের সাথে দূরত্ব তৈরী হল বিস্তর একসময়। ঘুণ ধরলো বামপন্থায় বামেরা হয়ে গেলো ফ্যাসিষ্ট, রক্ষণশীল, অত্যাচারী, অহংসর্বস্ব।এ বং ২০১১ তে তাদের ক্ষমতাচ্যুতি। আপাতত আর এই রাজ্যে বাম আন্দোলনের পূনরাভ্যুত্থান আর সম্ভব বলে আমার মনে হয় না।


রংরুট: সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ও পূর্বইউরোপের পটপরিবর্তনের হাত ধরে বর্তমানের একমেরু বিশ্ব মানুষের মৌলিক অধিকারগুলির পক্ষে কতটা বিপদসংকুল বলে আপনি মনে করেন? নাকি সমাজতন্ত্রের লৌহযবনিকার আড়াল উঠে যাওয়াতেই মানুষের মৌলিক অধিকার অধিকতর সুরক্ষিত এখন? আপানার অভিমত।

সুবীর সরকার: না, মানুষের মৌলিক অধিকার একেবারেই সুরক্ষিত নয় এখন।সারা বিশ্বে লোকসাধারণের তিল তিল মরণ হচ্ছে প্রতিদিন। আমেরিকা ও পূজির দাপটে সাবঅলর্টান জনমানুষের এখন অস্তিত্বের তুমুল সংকট। আঞ্চলিক ভাষা, সংস্কৃতি,সাহিত্য ,এথনিক ইতিহাস পিছু হটছে ক্রমে ক্রমে। এক অদ্ভূত আঁধার চারদিকে।


রংরুট: সারা বিশ্বের রাজনৈতিক গতিপ্রকৃতির মধ্যে দিয়েই অনেকেই ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতি চর্চার মধ্যে সুকৌশলী স্বৈরতন্ত্রের ক্রমবিকাশের অশনি সংকেত দেখছেন। এর পিছনে কি ধনতান্ত্রিক পুঁজিবাদেরই বলিষ্ঠ হাত রয়েছে? এই প্রসঙ্গে মুসোলিনির একটি উক্তি মনে পড়ছে,Fascism should more appropriately be called corporatism because it is a merger of state and corporate power.’ -- Benito Mussoliniআপনার অভিমত।

সুবীর সরকার: ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতি চর্চার মধ্যে সুকৌশলী স্বৈরতন্ত্রের ক্রমবিকাশের অশনি সংকেত তো অবশ্যই এর পেছনে অবশ্যই ধনতান্ত্রিক পুঁজিবাদেরই বলিষ্ঠ হাত রয়েছে। আগামী দিনে তা আরো বাড়বে বই কমবে না। নিও ফ্যাসিবাদ ছড়িয়ে পড়ছে তো সবদিকে


রংরুট: আজকে একদিকে বিশ্বায়ন ও আর একদিকে ইনটারনেট বিপ্লবে মানুষের সাথে মানুষের যোগাযোগ ব্যবস্থার যুগান্তকারী উন্নতিতে আপনার কি মনে হয়, দেশীয় ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকার যে গণ্ডীবদ্ধতা তৈরী করে- যাতে মানুষে মানুষে অন্তত সাংস্কৃতিক ও মানসিক একটি বিভাজন রেখার দূরত্ব রয়েই যায়; অদূর ভবিষ্যতে মানুষ সেই দূরত্বের বিভাজন রেখা মুছে ফেলে বিশ্বমানবতায় পৌঁছাতে পারবে কি অনেক সহজেই?

সুবীর সরকার: হ্যাঁ, আমি আশাবাদী। সোশাল মিডিয়া অনেককিছু পারে। মানুষকে অরগানাইজ করতে পারে। মিশরের রাষ্ট্রক্ষমতা বদলে গেলো। যাবতীয় পীড়ন ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে একদিন রুখে দাঁড়াবে মানুষ। আর সোসাল মিডিয়াই হবে মুখ্য হাতিয়ার। উন্নত বিশ্বের স্বপ্ন দেখবে মানুষ।


রংরুট: আধুনিক জীবনে ভোগবাদ মানবিক মূল্যবোধের ভিত্তিভুমিকেই টলিয়ে দিয়েছে –এমানটাই যদি কেউ ভাবেন, সেই ভাবনাকে আপনি কি ভাবে দেখেন? ভোগবাদের বিস্তারের সাথে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির যে সমানুপাতিক সম্পর্ক সেকথা মাথায় রেখেও মানবিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ে ভোগবাদের ভুমিকাকে কি কোন ভাবে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব বলে মনে করেন আপনি?

সুবীর সরকার: প্রযুক্তির উন্নয়নের ছোঁয়া আমাদেরকে তো ছুঁয়ে যাবেই। ভোগবাদকে গ্রহন করেই আমাদেরকে মানবতাবাদের কাছে যেতে হবে। ভোগবাদ মানবিক মূল্যবোধের ভিত্তিভুমিকেই টলিয়ে দিয়েছে- আমি সেটা মনে করি না। মানবতাবাদ এমন ঠুনকো নয় যে ভোগবাদ তাকে নিশ্চিহ্ন করে দেবে। মানুষ নিজেই একদিন ক্লান্তি বোধ করবে, আর পরিমিত ভোগবাদকেই অনুসরণ করবে। ভোগেরও তো একটা সীমানা থাকে।


রংরুট: আধুনিক বিশ্বব্যবস্থায় নাগরিকের মৌলিক অধিকার, তার স্বাধীনতার পরিসর ও নাগরিক জীবনে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ এই দুইয়ের মধ্যে ফারাকই বা কতটা ও সামঞ্জস্য বিধানই বা কি ভাবে সম্ভব? অবশ্যই এই ফারাক ও সামঞ্জস্য বিধান এক এক অঞ্চলে এক এক সমাজ ও রাষ্ট্রে এক এক রকম হওয়ারই কথা। কিন্তু বিশ্বায়ন কি এই বিষয়ে সঠিক কোন দিশা দিতে পারবে বলে মনে হয়?

সুবীর সরকার: বিশ্বায়ন একদিন এইসব মুছে দেবে। আর দেশ বলে কিছু থাকবে না। দেশ  হয়ে যাবে একটা বাড়ির মতন। আর কি বলি, এসবকে আগাম বিশ্লেষণ করা যায় না। সময়ের হাতে, সময়ের চলাচলের ভিতরেই হয়তো এর জবাব মানুষ একদিন খুঁজে পাবেন।


রংরুট: সাহিত্য দর্শন বিজ্ঞান প্রযুক্তির বিবর্তনের পথে আমরা যে অনেক দূর এগিয়ে এসেছি, সে কথা হয়তো বলাই যায়। কিন্তু সমাজ সংসার বিবর্তনের পথে বিগত দুই হাজার বছরের হিসাবটুকুই যদি ধরি খৃষ্টাব্দের সূত্রে- তাহলে সত্যই কতটুকু এগোলো মানুষের সমাজ সংসার সভ্যতা? আপনার মূল্যায়ন।

সুবীর সরকার: আসলে এর সার্থক উত্তর আমার জানা নেই। এটুকু বলি, সবটাই আদতে সংশোধন আর কাটাকুটির মধ্য দিয়ে এক আদিঅন্ত চলাচলের মতন। এক অদ্ভূত জায়মানতা যেন! অথচ কোথাও জায়মানতা থাকে কি!


রংরুট: সবশেষে এসে শুরুর সেই সূত্রটুকুর স্মরণে জানতে চাইবো; রংরুটই বলুন আর অগ্রগতিই বলুন সাধারণ মানুষের জন্যে এই বিশ্ব কতটা নিরাপদ আজ, কারণ সেইখানেই বিশ্বমানবতার নোঙরটি ফেলতে হবে না কি আমাদের?

সুবীর সরকার: নিরাপত্তা আসলে আপেক্ষিক ও পরিবর্তনশীল। তবে আমি নিশ্চিত মানবতার বিজয় হবেই, কেউ রুখতে পারে না মানুষ ও মানবতাকে; ইতিহাস তো তাই বলেছে অদ্যাবধি।

সুবীর সরকার: জন্মঃ-১৯৭০। বসবাস পশ্চিমবাংলার উত্তরাঞ্চলের প্রান্তিক শহর কোচবিহারে। পেশাঃ শিক্ষকতা। কবিতা ও গদ্য লিখে থাকেন। হাটগঞ্জে ঘুরে বেড়ান লোকগান বিশেষ প্রিয়। স্বপ্ন দেখেন সাদা ঘোড়া, হলুদ খামার ও কবিতাগ্রাম। নিজের মতন থাকেন, মঞ্চ মাইক সভাসমিতি থেকে সচেতন দূরত্বে। প্রচুর পড়েন, সাবঅল্টার্ণ ইতিহাসে প্রবল আগ্রহী।
রংরুট সম্পাদকমণ্ডলীর পক্ষে থেকে আপনার সহযোগিতার জন্যে আন্তরিক ধন্যবাদ।