অলভ্য ঘোষ - বিভাজন ও ভারতের ইতিহাস


জমিদারি এবং মধ্যস্বত্ব প্রথা বিলোপ করে প্রকৃত কৃষক স্বত্ব লাভ করবে এই ছিল প্রজাস্বত্ব সংস্কারের ঘোষিত কর্মসূচী। কিন্তু বাস্তবে অবস্থা ঘটল ঠিক এর  উল্টো; প্রথাকে স্বত্ববান করে কৃষকের হাতে জমি তুলে দেবার নীতির সাথে সাথে পুরাতন ভূস্বামী জমিদারদের ব্যক্তিগত চাষের অজুহাতে জমি পুনরুদ্ধার করবার সুযোগ দেওয়া হোল; অর্থাৎ ভূস্বামী জমিদারেরা ব্যক্তিগত চাষের কারণে জমি নিজেদের নামে নিয়ে আসতে পারবে। ব্যক্তিগত চাষের আওতায় আনার অছিলায় জমি কেন্দ্রীভবন; প্রকৃত চাষিদের উচ্ছেদ তো ছিলই; অন্যদিকে এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ভাগ চাষির অধিকারকেও খর্ব করা হতে লাগল। একজন ভাগচাষীকে একাদিক্রমে চাষ করতে দেওয়া হলও না। কেউ ভাগচাষ করলে তার কোন ভাবে একটা অধিকার জন্মে যায় এবং সে প্রজাস্বত্বের একজন দাবিদার হতে পারে এই আশঙ্কায় প্রতি বছর ভাগচাষী বদল হতে শুরু করল। এতে একদিকে যেমন প্রচলিত আইন রক্ষা হল অন্যদিকে ভাগচাষীদের মধ্যে পারস্পরিক দ্বন্দ্ব তৈরি হবারও একটা ক্ষেত্রে তৈরি হয়ে গেল। ~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~


বিভাজন ও ভারতের ইতিহাস
অলভ্য ঘোষ

(গত পর্বের পর)

মানুষের মানুষ হওয়ার ক্ষেত্রে তিনটে বিষয় গুরুত্ব দাবী করে; হাত মস্তিষ্ক এবং ভাষা। আজ হাত কর্মহীন অসাড়। মস্তিষ্ক চেতনাহীন অবশ। আর ভাষা ক্রমশ লোপাট হয়ে চলেছে। ভিন ভাষার আগ্রাসন। আইনস্টাইন যেখানে তাঁর গবেষণা পত্র লিখেছেন স্বচ্ছন্দে মাতৃভাষায় জার্মানিতে আমাদের ইংরেজি না ফুটলে চলবে না। বিবর্তনের হাতিয়ারগুলোকে ক্রমশ ভোঁতা করে ফেলা হয়েছে ইচ্ছাকৃতভাবে সাম্রাজ্যবাদী রাজনৈতিক অভিসন্ধিতে। শ্রমই চাবিকাঠি। সুতরাং মানব সভ্যতার বিকাশে বা উন্নয়নে শ্রম দানকারী শ্রমজীবী মানুষেরা অর্থাৎ শ্রমিকের দলই অগ্রগামী ভূমিকা পালন করে। যাদের পরাধীন ও স্বাধীন ভারতে নির্দ্বিধায় নিয়ন্ত্রণ করে চলেছেন পরশ্রম আত্মসাৎকারী শ্রম বিমুখ শাসকেরা।

সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপগুলি স্বাধীন ভারতবর্ষের ভূমি ব্যবস্থার ক্ষেত্রে অন্যতম ছিল মধ্যস্বত্বাধিকারীর বিলোপসাধন। বিভিন্ন আইন প্রয়োগের মাধ্যমে এই ব্যবস্থার বিলোপ কাগজে কলমে হলেও ব্যবহারিকভাবে সামন্ত তন্ত্রের অবসান হয়নি। উল্টে জমিদার শ্রেণীর ভূস্বামীরা বেশ কায়দা করে সমাজের গভীরে সমাজের সর্বস্তরে নিজেদের প্রভাব বিস্তার করে নিয়েছিল। কংগ্রেসের অভ্যন্তরেই জমিদারি শ্রেণীর প্রভাব ছিল সুগভীর। স্বাধীন ভারতের রাজনৈতিক নেতৃত্বে একটা বড় অংশ জমিদার ভূস্বামীরা অংশগ্রহণ করে তাদের শ্রেণী স্বার্থ বজায় রেখে চলেছে।

উল্টোদিকে ভারতবর্ষ স্বাধীন হবার পর বা পঞ্চাশের দশকে একমাত্র তেলেঙ্গানার কৃষক বিদ্রোহ ছাড়া উল্লেখযোগ্য কোন কৃষক বিদ্রোহ গড়ে ওঠেনি। যাও বা গড়ে উঠেছে তা স্থানিক ভিত্তিতে এবং সেগুলোর  প্রভাব দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। তেলেঙ্গানা আন্দোলন ও ক্রমশ স্তিমিত হয়ে এসেছিল। তার উপরে তেলেঙ্গানা আন্দোলনের গতি প্রকৃতি নিয়ে কমিউনিস্ট পার্টির অভ্যন্তরেই যথেষ্ট মতাদর্শগত বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছিল। শুধু তেলেঙ্গানা আন্দোলন কেন; ভারতবর্ষের স্বাধীনতা কে কী চোখে দেখা হবে। ভারতীয় বিপ্লবের ক্ষেত্রে রাজনীতি এবং রণকৌশলগত পথ কী হবে; সে সম্পর্কে ও যথেষ্ট মতাদর্শগত পার্থক্য  ছিল।

এই দোদুল্যমানতা মতাদর্শগত বিভেদ। বিতর্ক। ভারতীয় কৃষকদের একটা সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী ঐতিহ্য এবং উত্তরাধিকার থাকা সত্ত্বেও বৃহৎ আন্দোলনের ভূমিকা পালনে সামগ্রিকভাবে সফল হতে পারেনি। অন্যভাবে বলা যায়; তাদের হাত থেকে আন্দোলনের হাতিয়ার জন্মাতে পারেনি তাই বিবর্তনের পরিবর্তনের ইতিহাস থমকে গিয়েছে।

কংগ্রেস দলটি শাসন ক্ষমতায় এসে শুধু জমিদার ভূস্বামীদের শ্রেণী স্বার্থ রক্ষা করে তা নয় বরং এদের সামাজিক প্রতিপত্তি বৃদ্ধি করতেও যথেষ্ট সাহায্য করল। ব্রিটিশ আমলে জমিদার; সামন্ত প্রভুরা ছিলেন সাম্রাজ্যবাদের অনুচর। প্রশাসনে তাদের প্রভাব থাকলেও তার মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করত ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী রাই। স্বাধীন ভারতবর্ষে ভোল পাল্টে তারাই হয়ে দাঁড়াল দেশপ্রেমিক।

কালক্রমে এরা বিভিন্ন রাজ্য ও কেন্দ্রের মন্ত্রীসভাগুলিতে গুরুত্বপূর্ণ স্থান লাভ করতে লাগল। প্রশাসনের অভ্যন্তরে এদের লোকজন। এদের শ্রেণী স্বার্থ রক্ষার্থে ক্রমশ বেশী বেশী করে জায়গা দখল করতে লাগলো। গ্রামীণ সমাজের বিভিন্ন স্থানীয় পঞ্চায়েত গুলো এরা নিজেদের দখলে রাখল। অর্থাৎ এদেশের সমাজ জীবনে জমিদার শ্রেণী; সামন্ত প্রভুরা বেশ ভাল মতই জাঁকিয়ে বসলো; কার্যত রাষ্ট্র যন্ত্রের নিয়ন্ত্রক শক্তি হয়ে দাঁড়াল।

ব্রিটিশেরা ভূমি ব্যবস্থাকে যেভাবে পর্যুদস্ত করে গিয়েছিল; স্বাধীন ভারতে অবস্থার দিক দিয়ে তার কোনরকম ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটল না। ১৯৫৭ সালে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির নির্বাচনী ইস্তাহারে বলা হয়েছিল; ভূমি সংস্কার সম্পর্কে তারা দ্বিধাগ্রস্ত । এই কর্মপন্থায় ব্যক্তিগত চাষের নামে জমিদারদের হাতে বিরাট এলাকা সমূহ রাখতে দেওয়া হয় এবং তাহাদের প্রচুর ক্ষতিপূরণ দেওয়ার ও প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। এই সংস্কার কৃষকের খাজনা ট্যাক্স ও ঋণের দু:সহ বোঝা হতে মুক্তি দেবার জন্য কিছুই করেনি। উপরন্তু কৃষকের এই বোঝা অবিচলভাবে বৃদ্ধি পায়। দেশের সর্বত্র কৃষক উচ্ছেদের জন্য জমিদারদের আক্রমণ বেড়ে যায়। জমিদারি এবং মধ্যস্বত্ব প্রথা বিলোপ করে প্রকৃত কৃষক স্বত্ব লাভ করবে এই ছিল প্রজাস্বত্ব সংস্কারের ঘোষিত কর্মসূচী। কিন্তু বাস্তবে অবস্থা ঘটল ঠিক এর  উল্টো; প্রথাকে স্বত্ববান করে কৃষকের হাতে জমি তুলে দেবার নীতির সাথে সাথে পুরাতন ভূস্বামী জমিদারদের ব্যক্তিগত চাষের অজুহাতে জমি পুনরুদ্ধার করবার সুযোগ দেওয়া হোল; অর্থাৎ ভূস্বামী জমিদারেরা ব্যক্তিগত চাষের কারণে জমি নিজেদের নামে নিয়ে আসতে পারবে। ব্যক্তিগত চাষের আওতায় আনার অছিলায় জমি কেন্দ্রীভবন; প্রকৃত চাষিদের উচ্ছেদ তো ছিলই; অন্যদিকে এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ভাগ চাষির অধিকারকেও খর্ব করা হতে লাগল। একজন ভাগচাষীকে একাদিক্রমে চাষ করতে দেওয়া হলও না। কেউ ভাগচাষ করলে তার কোন ভাবে একটা অধিকার জন্মে যায় এবং সে প্রজাস্বত্বের একজন দাবিদার হতে পারে এই আশঙ্কায় প্রতি বছর ভাগচাষী বদল হতে শুরু করল। এতে একদিকে যেমন প্রচলিত আইন রক্ষা হল অন্যদিকে ভাগচাষীদের মধ্যে পারস্পরিক দ্বন্দ্ব তৈরি হবারও একটা ক্ষেত্রে তৈরি হয়ে গেল।

ফলে; সামগ্রিকভাবে বলা যায় যে বিভিন্ন রাজ্যে প্রজা স্বত্ব রক্ষার উদ্দেশ্য নিয়ে যে আইনগুলো প্রণীত হয় তার মধ্যেও যথেষ্ট ভিন্নতা ছিল অর্থাৎ এক একটা রাজ্যে এর রূপরেখা হয়ে এল একেক রকম। কিন্তু প্রায় সর্বত্রই এই আইনগুলোর সুবিধাটুকু নিল জমির মালিক শ্রেণি বা আরও বেশি করে বলতে গেলে জমিদার জোতদার। কারণ ব্যক্তিগত চাষের আওতার নামে জমির কেন্দ্রীভবন কিন্তু বেশ ভালোভাবেই রয়ে গেল বা আর একটু আগ বাড়িয়ে বলা যায় যে জমির কেন্দ্রীভবন বেশ সংহত রূপ ধারণ করল।

পরবর্তীকালে ১৯৭৩ সালে পিএস আপ্লুর নেতৃত্বের পরিকল্পনা কমিশনের কৃষি সম্পর্ক বিষয়ক কর্মীদল লক্ষ্য করেছিলেন; যে ছোট মালিকদের রক্ষা করবার জন্য যে সমস্ত বিধিব্যবস্থা করা হয়; বিভিন্ন রাজ্যে রাজস্ব বিভাগের কর্মীদের সক্রিয় যোগসাজশে বড় বড় জমিদারেরা তার  অপব্যবহার করেছিল।

তৃতীয় পরিকল্পনাতেও ওই একই চিত্রের কথা উল্লেখ করা হয়েছিল। সেখানেও দেখানো হয়েছিল কিভাবে বড় বড় জমির মালিকেরা আইনের ওইসব বিধি ব্যবস্থার অপব্যবহার করে তাদের আত্মীয় স্বজন; পরিবারের লোকও অন্যান্য ঘনিষ্ঠদের নামে জমি লিখিয়ে দেয় এবং তারপর ছোট মালিকদের জমি পুনরাধিকারের আইন প্রয়োগ করে প্রজাদের উৎখাত করে। ১৯৫৫ সালের ১৬ আগস্ট পশ্চিমবঙ্গে যে ভূমি সংস্কার বিল প্রণীত হয় সেখানে "নিজ চাষের" নামে অবস্থাটা কি রকম দাঁড়াল সে ব্যাপারে হরেকৃষ্ণ কোঙার এর বক্তব্য উদ্ধৃত করা যাক।(উল্লেখ করা যেতে পারে হরেকৃষ্ণ কোঙার সিপিএম এর একজন প্রথম সারির নেতা এবং যুক্তফ্রন্ট আমলের ভূমি মন্ত্রী ছিলেন।)"আগের খসড়ার প্রথম অধ্যায়ে "প্রকৃত চাষী" কথার সংজ্ঞা ছিল। তাহার পরিবর্তে এখন "নিজ চাষী" কথা বসানো হয়েছে এবং বলা হইয়াছে যে নিজের জমি নিজের স্বার্থে নিজের বা পরিবারের লোকেরা শ্রম দ্বারা অথবা নগদে বা ফসলে বা উভয়ত দেয় মজুরিতে নিযুক্ত চাকর বা মজুর দ্বারা চাষ করাইলে "নিজ চাষ" বুঝাইবে। এইরূপ "নিজ চাষের" নামে অবাধে বর্গাদার উচ্ছেদ চলিবে। শুধু এইটুকু ব্যবস্থা করা হইয়াছে যে দুই বৎসরের মধ্যে "নিজ চাষে" না আনিলে সরকার সেই জমি লইয়া বিক্রয় করিয়া দিবেন। বর্তমানে প্রকৃতই চাষের কাজে অংশগ্রহণ করে না এমন অনেকের জমি আছে সত্য এবং দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক অবস্থায় তাহা হইতে তাদের বঞ্চিত করার প্রশ্ন উঠিতেছে না।

স্বাধীন ভারতবর্ষে ভূমি ব্যবস্থার যে ভিত রচনা করা হয়েছিল যে প্রজাস্বত্ব বিধি বা বিধিগুলি তৈরি হয়েছিল তা কৃষকদের জীবনকে মুক্তির স্বাদ এনে দেয়নি বরং অনেক ক্ষেত্রেই এদের আরও যন্ত্রণার দিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছিল।

ঐতিহাসিক বিপন চন্দ্র, মৃদুলা মুখার্জী ও আদিত্য মুর্খাজী তাঁদের "ভারতবর্ষ স্বাধীনতার পরে ১৯৪৭-২০০০'তে লিখেছেন: প্রজাস্বত্ব আইন অচিরেই চালু হতে চলেছে; এটা বুঝতে পারা মাত্রই আগে থেকেই এই উচ্ছেদের প্রক্রিয়া চালু হয়ে গিয়েছিল । সে আইনের প্রণয়ন আর প্রয়োগে যে অস্বাভাবিক দেরি হল তার পেছনে ছিল কায়েমী স্বার্থের কলকাঠি। এই দেরির সুযোগ নিয়ে তারা আইন চালু হবার আগেই ওই আইনের সম্ভাব্য সুবিধাভোগীদের উচ্ছেদ করে দেয়।

আসলে কংগ্রেস পার্টি টাই দখল করে নিয়েছিল বুর্জোয়া জমিদার  শ্রেণী। ফলে তারা তাদের শ্রেণী স্বার্থ রক্ষা করতে চাইবে এটাই স্বাভাবিককি আইন আনা হবে। কবে এবং কেন হবে এটা তাদের পক্ষে আগে থেকে অবহিত হওয়াটা একেবারেই বিচিত্র নয়। ফলে স্বাধীন ভারতবর্ষেও সেই জমিদারেরা যে কর্মচারীদের ভারতবর্ষের প্রায় সব অঞ্চলই এই রোগে প্রভাবিত।

তাছাড়া একবার আইন প্রণীত হলেও প্রয়োগের অভাবে আইনের ইতিবাচক ধারাগুলোও কার্যত প্রহসনে পরিণত হতো। প্রয়োগের অভাব যে নিছক উদাসীনতাই নয়। আসলে প্রয়োগ যাদের করার কথা সেই আমলাতান্ত্রিক প্রশাসনও রাষ্ট্রের শ্রেণি চরিত্র অনুযায়ী তারই বাহক মাত্র। প্রশাসনের উচ্চ পদস্থ আমলারা বেশিরভাগই এসেছেন অভিজাত বুর্জোয়া জমিদারের পরিবার থেকে এবং তারাই প্রশাসন পরিচালনার দায়িত্বে থাকতেন। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ তাদের ঔপনিবেশিক কাঠামোর যে অবশেষটুকু রেখে গিয়েছিল তাতে জনকল্যাণ মুখী তার জায়গা ছিল খুবই অল্প। প্রায় সমস্তটাই জুড়ে ছিল রাষ্ট্রের শ্রেণী চরিত্র রক্ষা করা। এই যে আইনের ইতিবাচক দিকগুলো প্রয়োগের অনিচ্ছা অথবা ইচ্ছাকৃত উদাসীনতাও শ্রেণী স্বার্থেরই প্রতিফলন। অনেক সময় দেখা গিয়েছে যে রাজস্ব বিভাগের কর্মচারীদের যোগসাজশে জমিদারেরা তাদের সুবিধা মতই নথি নষ্ট করেছেন অথবা নিজেদের অনুকূলে নথি তৈরি করেছেন। কর্মচারীরা অনেকেই ছিলেন বিট্রিশ যুগের জমিদারদের সেরেস্তার অধীনে। তাদের স্বার্থে কাজে লাগাবেন সেটা বলাই বাহুল্য। এ আনুগত্য শুধু আঞ্চলিক নয়।

আইনগুলিতে জেনে বুঝেই বিভিন্ন ফাঁক ফোকর রেখে দেওয়া হয়েছিল; যাতে জমিদারেরা প্রজা উচ্ছেদ করতে পারে। ঘোষিত উদ্দেশ্য যাই থাকুক না কেন; প্রজাস্বত্ব আইন গুলোর ফাঁকফোকরের কারণে মনে করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে যে ওগুলো রাখা হয়েছিল ইচ্ছাকৃত ভাবেই।

প্রকৃতপক্ষে দেশবাসী স্বাধীনতার পরে পরেই বিট্রিশ সাম্রাজ্যবাদের কবল মুক্ত একটি প্রকৃত স্বাধীন, গণতান্ত্রিক এবং অর্থনৈতিক শোষণ মুক্ত ভারতবর্ষ দেখতে চেয়েছিল এবং ওই পুনর্গঠনের কাজে তারা জাতীয় কংগ্রেস পরিচালিত কেন্দ্রীয় এবং রাজ্য সরকারকে যথেষ্ট সময় দিতে প্রস্তুত ছিল এবং এর জন্য ভারতবর্ষের শ্রমজীবী মানুষ যথেষ্ট ত্যাগ, তিতিক্ষা এবং সংযমের পরীক্ষা দিয়েছে। কিন্তু উল্টো দিকে; রাষ্ট্রক্ষমতার আস্বাদ যারা পেয়েছেন তারা এই তিতিক্ষা, ত্যাগের কোনরকম মূল্য দেয়নি বরং রাষ্ট্র ক্ষমতায় থাকার সুযোগ নিয়ে শোষণ-শাসনের যন্ত্রণাকে তীব্রতর করেছে। ফলে সামন্ততন্ত্রের জোয়াল কৃষক এর ঘাড় থেকে নামেনি বরং আর ও শক্ত ভাবে জাঁকিয়ে বসেছে।

গ্রামাঞ্চলের মেহনতকারী জনগণের নেতৃত্বে কৃষক সভার সংগ্রাম ও সংগঠনের মধ্যে আনতে না পারলে এই দুর্বলতা কাটিয়ে ওঠা যাবে না। জমিদারি ও জায়গীরদারি উচ্ছেদ আইনের ফলে জমি হীন বা প্রায় জমি হীন চাষিদের জমি পাবার কোন সুরাহাই হয়নি; বরং গরিব চাষিরা অনেকেই আইনি বা বে আইনি ভাবে জমি থেকে উচ্ছেদ হয়ে যাচ্ছে। তার পরিবর্তে নতুন একশ্রেণীর বড় বড় জমির মালিক ভাগচাষী এবং মজুর দিয়ে নিজেদের জমি চাষ করিয়ে এবং ধান কার্য করিয়ে আরও ধনী হচ্ছে। এই ভাবে সামন্তবাদী শোষণ কেও আরও জিইয়ে রাখছে এবং ক্ষেত মজুরের সংখ্যাকে বাড়িয়ে তুলছে।

জমির কেন্দ্রীভবন বিট্রিশ ভূমি নীতির অবশ্যম্ভাবী ফল। স্বাধীন ভারতবর্ষের শাসকেরাও কেন্দ্রীভবনের নীতিকেই অটুট রাখল। কৃষক যে তিমিরে সেই তিমিরেই রইল।

(চলবে)
© অলভ্য ঘোষ
অনুলিখন: নিবেদিতা পাল

তথ্য সূত্র:-
ক)সমাজ বিঞ্জান ও প্রকৃতি পরিচয়( বিশেষ সংখ্যা)তৃতীয় বর্ষ,তৃতীয় সংখ্যা,অক্টোবর ২০১৬
1)বাস্তার-অঘোষিত যুদ্ধ চলছে- শুভ দীপ
2)মাদার টেরিজা ও বিক্ষোভ দমনের রাজনীতি-কণিষ্ক চৌধুরী
3)রিভিউঃ মুসলিম এগেইন্সট পার্টিশন-শামসুল ইসলাম এবং জাতীয়তাবাদ প্রসঙ্গে কিছু কথা-সুজয় মল্লিক
4)শিবাজি ও ধর্ম শিবাজির দৃষ্টিভঙ্গী(শহীদ গোবিন্দ পানসারের "কে ছিলেন বাজি"অবলম্বনে)অনুবাদ: ড:সুব্রত রায়
5)প্রকৃতির গভীরে পাড়ি কিংবা বিঞ্জানে ইশ্বরের অন্তর্ধান- অমিতাভ চক্রবর্তী
6)ভারতবর্ষের ভূমি ব্যবস্থা-সংস্কার ও বিবর্তন-বৈদ্যনাথ সেনগুপ্ত
7)পশ্চিমবঙ্গ ভূমি সংস্কার আইন,১৯৫৫(পঞ্চম অধ্যায়ের পঞ্চত্ব প্রাপ্তি) গৌতম তালুকদার

খ)আমরা বলছি শোন  জুলাই-অগস্ট ২০০৮, বর্ষঃ ২
1)ভারত-মার্কিন পরমাণু চুক্তি মার্কিন স্বার্থেই রচিত(উন্নায়ন না অন্তরঘাত )গুরুপ্রসাদ কর

অলভ্য ঘোষ