সৌমিত্র চক্রবর্তী - সাক্ষাৎকার

দেশীয় ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকার কোনো কালেই গন্ডীবদ্ধতার সৃষ্টি করে নি। প্রাচীনকালেও এক দেশের সঙ্গে দূর প্রান্তের আরেক দেশের বাণিজ্যিক, সাংস্কৃতিক আদানপ্রদান ছিল। দেশজ সংস্কৃতি তাতে কোনো বাধা সৃষ্টি করে নি। বরং আদানপ্রদান উন্নতির সহায়ক হয়েছিল। গোলকোন্ডার প্রাচীন দুর্গে বা আগ্রার লালকেল্লায় ব্যবহৃত প্রযুক্তি এই সাংস্কৃতিক আদানপ্রদানের ফলেই সম্ভব হয়েছিল। অথচ আজকের সাইবার এজে সেই দেশজ সংস্কৃতি হারিয়ে যাচ্ছে। মিশ্র কালচার বিশ্বমানবতার দিকে মানুষকে এগিয়ে তো দিচ্ছেই না, পরন্তু আরও বেশী করে গোঁড়া ও মৌলবাদী করে তুলছে। এই ভাবনার মূলে আছে পুঁজিবাদের ইন্ধন। দুটি দেশকে উগ্র করে তুলতে পারলে দুই দেশেই তাদের বিক্রির পরিসর বেড়ে যাবে এই কূট নীতি থেকেই অকারণ জাতীয়তাবাদের তুঙ্গ প্রচার চলছে স্যোসাল মিডিয়ায়। ফলে বিশ্বমানবতা দূরে থাক বিদ্বেষ বাড়ছে। পাশাপাশি দুই দেশের খেলার সময়ে যদি লক্ষ্য করেন, তাহলে দেখবেন এই বিদ্বেষের প্রকাশ পারদ গরলের মত কেমন ফুটে উঠছে ক্রমশই। আমি এতে আহত হই।~~~~~~~~~~


সৌমিত্র চক্রবর্তীর সাথে
মুখোমুখি আলাপচারিতায় রংরুট

রংরুট: কখনো কি মনে হয়েছে ১৯৪৭-এর স্বাধীনতা রংরুট ধরেই এগিয়ে চলেছে? অন্তত বিগত সাত দশকের নিরিখে। বিশেষ করে এই প্রশ্নটি দিয়েই আপনার সাথে আলাপটুকু শুরু করার কারণ আর কিছুই নয়, সাত দশকের স্বাধীনতার প্রাপ্তি আর অভিজ্ঞতার বাটখারায় মানুষের সার্বিক উন্নতির রেখাচিত্রটি কি অনেকটাই বেঢপ দেখায় না? আপনার মতামত

সৌমিত্র চক্রবর্তী:  প্রশ্নটির সঙ্গে প্রথমেই দ্বিমত হই। আমি প্রায়শই এক বিভ্রান্তির মাঝে ঘুরপাক খাই, আমরা কি আদৌ স্বাধীনতা পেয়েছি? যে সামন্ততন্ত্রের বেড়াজাল ভেদ করে ব্রিটিশ শাসনব্যবস্থা আমাদের দেশে কায়েম হয়েছিল, সে তো নিজেও সামন্ততন্ত্রের মায়া মুক্ত হতে পারে নি। তারই ধারক ও বাহক রা তথাকথিত স্বাধীনতার পরে দেশের ক্ষমতা অধিগ্রহণ করল। আর দেখা গেল, তাদের মধ্যেই প্রবিষ্ট রয়েছে রাজতন্ত্রের অবশেষ মালিকানা। অতএব যা ঘটার তাই ঘটল। সাধারণ মানুষের উন্নতি সম্পর্কিত বারফট্টাই শুধুমাত্র ফুলঝুরির আতশ বিস্ফোরণ হয়েই রয়ে গেল। যে স্বাধীনতা আসার কথা ছিল তা রুট থেকে বিচ্যুত হয়ে গেল। অথচ আমাদের চেয়ে দু বছর পরে স্বাধীনতা পেয়ে আজ শুধুমাত্র সঠিক রাস্তায় হেঁটে গেল বলে চীন কয়েকগুণ বেশী শক্তিশালী দেশ হিসাবে নিজের জায়গা তৈরী করে নিতে সক্ষম হল।


রংরুট: ভারতবর্ষের রাজনীতিতে একটি ধর্মনিরপেক্ষতার বাতাবরণ, যেটি বৃটিশ আমল থেকেই কংগ্রেসি নেতৃত্ব দ্বারা সুপরিকল্পিতভাবে গড়ে তোলা হয়েছিল, স্বাধীনতার সাত দশক পেড়িয়ে এসে সেই বাতাবরণের ফানুশটিকে কি দিনে দিনে চুপসে যেতে দেখছেন না? না কি ভারতীয় জনমানসের মূল আবেগ সেই বাতাবরণটিকে আরও বহুদিনের জন্যে রক্ষা করতে পারবে। পারবে ভারতীয় ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকারের বলেই? আপনার মতামত।

সৌমিত্র চক্রবর্তী: গতকালই একটা বই সম্পর্কে পড়ছিলাম। অযোধ্যার শেষ নবাব ওয়াজেদ আলি শাহ কে উৎখাত করতে ব্রিটিশরা আমদানী করেছিল সাম্প্রদায়িক বিভেদের। তাদের উত্তরসূরী যে দল নেতৃত্বে এল, তারা তো প্রথমেই সাম্প্রদায়িক বিকট হানাহানির মাধ্যমে ক্ষমতা ভাগ করে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করল। যে সংবিধানে লেখা হল ‘ভারত এক ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র’ তা শুধু কথার কথাই রয়ে গেল। কিন্তু স্বস্তির ব্যাপার হল ভারতের সাধারণ মানুষ শান্তিপ্রিয়। নেহাত তাদের কোনো ইস্যুতে ক্ষেপিয়ে না তুললে তারা এসব দাঙ্গা হাঙ্গামায় জড়াতে চায় না। এবং সেই আশাতেই যতই রাজনৈতিক ভন্ডামি থাক আমরা আশা রাখতেই পারি যে বড় ধরণের কোনো ঘটনা নিশ্চিত ঘটবে না যাতে ধর্মনিরপেক্ষতার বাতাবরণ ছিঁড়েখুঁড়ে যেতে পারে।


রংরুট: আমাদের পশ্চিমবঙ্গে সুদীর্ঘ বাম আন্দোলনের ঐতিহ্য বাঙালির আত্মপরিচয়কে কতটা বিশেষত্ব দিতে পেরেছিল বলে আপনার ধারণা। এবং একই সাথে ক্ষমতা কেন্দ্রিক মানুষের ভোট কুক্ষিগত করে রাখার যে রাজনীতি তা কিভাবে বাম ঐতিহ্যকে ধুলিসাৎ করল শেষমেষ? আজকের দিনে দাঁড়িয়ে এই রাজ্যে বাম আন্দোলনের পূনরাভ্যুত্থান কি আর সম্ভব আদৌ?

সৌমিত্র চক্রবর্তী: বাম আন্দোলনের শুরু তো সেই ১৯২০ সালে। সেদিনকার প্রোথিত বীজ ধীরে ধীরে অঙ্কুরিত হয়ে মহীরূহ হয়েছিল। মাঝে বহুবার মতাদর্শগত পার্থক্যের জন্য বাম আন্দোলন ভাগ হয়েছে, ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মূলত বাংলা থেকেই এই ঐতিহাসিক আন্দোলন শুরু হয়েছিল বলে অবশ্যই বাংলা উপমহাদেশে নিজস্ব পরিচয় তৈরী করতে পেরেছিল। কিন্তু যে কোনো শাসনব্যবস্থার কুফলগুলো নিয়ন্ত্রকের ওপরে প্রভাব বিস্তার করে ছড়িয়ে পড়ে। সেই পথেই বাম নেতৃত্ব তথা কর্মীদের মধ্যে বিভিন্ন পুঁজিবাদী লোভের হাতছানি জাল বিস্তার করে সাধারণ মানুষের থেকে তাদের দূরে সরিয়ে দিল। এই মুহূর্তে বাংলা তথা ভারতের মানুষ আদর্শগত ভাবে বহুধাবিভক্ত। ক্রমশই বাম মত সঠিক পথ খুঁজে বার করতে না পারার জন্য পিছিয়ে পড়ছে। তবুও পুঁজিবাদ তার আগ্রাসনের হাত যতই লম্বা করবে, ততই প্রকৃত বাম মতাদর্শ প্রাসঙ্গিক হবে। মানুষের দেওয়ালে পিঠ ঠেকার ওয়াস্তা।


রংরুট: সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ও পূর্বইউরোপের পটপরিবর্তনের হাত ধরে বর্তমানের একমেরু বিশ্ব মানুষের মৌলিক অধিকারগুলির পক্ষে কতটা বিপদসংকুল বলে আপনি মনে করেন? নাকি সমাজতন্ত্রের লৌহযবনিকার আড়াল উঠে যাওয়াতেই মানুষের মৌলিক অধিকার অধিকতর সুরক্ষিত এখন? আপানার অভিমত।

সৌমিত্র চক্রবর্তী: সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন দুই শ্রেনীর মেরুকরণের দেওয়ালটাকেই ভেঙে দিয়েছিল, আর এর বীজ নিহিত ছিল স্তালিনের শেষ সময়ের নেতৃত্বের মধ্যেই। বলা যায় সেই সময় থেকেই সোভিয়েতের নেতৃত্বের মধ্যে পুঁজিবাদ তার এজেন্ট ঢুকিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিল। অথচ খেটে খাওয়া মানুষের, গরীব মানুষের সুরক্ষার বল ছিল ওই নামটা – সোভিয়েত ইউনিয়ন। গরবাচেভ নয়, ক্রুশ্চেভ এর সময়েই পতনের ঘন্টা বেজেছিল।ধীরে ধীরে সেই অবক্ষয় ছড়িয়ে শেষে পতন। এর ফলে অবশ্যই গরিষ্ঠ অংশের মানুষের সহায়তার দেওয়াল ধ্বংস হয়ে যায়। আপনার মনে আছে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকে পিষে ফেলতে তৎকালীন আমেরিকা সরকার সপ্তম নৌবহর পাঠিয়েছিল। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়নের সামরিক হুমকিতে ভয় পেয়ে তারা পিছিয়ে যায়। পরের ঘটনা তো ইতিহাস। যে শ্বাপদ গরীব মানুষের মৌলিক অধিকারগুলিকে মুনাফায় পরিণত করে ফুলেফেঁপে উঠতে চাইছিল, আজ সে দানব। প্রতিদিন বিভিন্ন শর্ত চাপিয়ে সে সাধারণের অধিকার হরণ করেই চলেছে। সর্বশেষ উদাহরণ সম্ভবত জিএসটি রূপায়ণ।


রংরুট: সারা বিশ্বের রাজনৈতিক গতিপ্রকৃতির মধ্যে দিয়েই অনেকেই ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতি চর্চার মধ্যে সুকৌশলী স্বৈরতন্ত্রের ক্রমবিকাশের অশনি সংকেত দেখছেন। এর পিছনে কি ধনতান্ত্রিক পুঁজিবাদেরই বলিষ্ঠ হাত রয়েছে? এই প্রসঙ্গে মুসোলিনির একটি উক্তি মনে পড়ছে,Fascism should more appropriately be called corporatism because it is a merger of state and corporate power.’ -- Benito Mussoliniআপনার অভিমত।

সৌমিত্র চক্রবর্তী: ১০০% সত্যি কথা। পুঁজি তাঁর ঈপ্সিত মুনাফা অর্জন করতে পারবে না স্বৈরতান্ত্রিক হতে না পারলে। একদিন হে মার্কেটে ৮ ঘন্টা কাজের সময়ের দাবীতে যে আন্দোলন হয়েছিল, আজ তা ইতিহাসের পাতায় একটা ঘটনা মাত্র। অধিকতর বাজার দখলকারী বেসরকারী ক্ষেত্রে ১২/১৪ ঘন্টা বাধ্যতামূলক কাজ এখন খুব স্বাভাবিক ঘটনা। অতএব, পুঁজিতন্ত্র ও ফ্যাসিজম একই মুদ্রার দুই পিঠ।


রংরুট: আজকে একদিকে বিশ্বায়ন ও আর একদিকে ইনটারনেট বিপ্লবে মানুষের সাথে মানুষের যোগাযোগ ব্যবস্থার যুগান্তকারী উন্নতিতে আপনার কি মনে হয়, দেশীয় ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকার যে গণ্ডীবদ্ধতা তৈরী করে- যাতে মানুষে মানুষে অন্তত সাংস্কৃতিক ও মানসিক একটি বিভাজন রেখার দূরত্ব রয়েই যায়; অদূর ভবিষ্যতে মানুষ সেই দূরত্বের বিভাজন রেখা মুছে ফেলে বিশ্বমানবতায় পৌঁছাতে পারবে কি অনেক সহজেই?

সৌমিত্র চক্রবর্তী: যোগাযোগ ব্যবস্থার সমূহ উন্নতি হয়েছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু এর শিকড়ে সাধারণের উন্নতির আকাংখ্যার কোনো গল্প নেই। ইনফ্রাস্ট্রাকচার উন্নত না হলে পুঁজির বিকাশ সম্ভব নয়। আজকের আন্তর্জাল মারফৎ উন্নয়নের জোয়ারের পেছনে মূলতত্ব এটাই। দেশীয় ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকার কোনো কালেই গন্ডীবদ্ধতার সৃষ্টি করে নি। প্রাচীনকালেও এক দেশের সঙ্গে দূর প্রান্তের আরেক দেশের বাণিজ্যিক, সাংস্কৃতিক আদানপ্রদান ছিল। দেশজ সংস্কৃতি তাতে কোনো বাধা সৃষ্টি করে নি। বরং আদানপ্রদান উন্নতির সহায়ক হয়েছিল। গোলকোন্ডার প্রাচীন দুর্গে বা আগ্রার লালকেল্লায় ব্যবহৃত প্রযুক্তি এই সাংস্কৃতিক আদানপ্রদানের ফলেই সম্ভব হয়েছিল। অথচ আজকের সাইবার এজে সেই দেশজ সংস্কৃতি হারিয়ে যাচ্ছে। মিশ্র কালচার বিশ্বমানবতার দিকে মানুষকে এগিয়ে তো দিচ্ছেই না, পরন্তু আরও বেশী করে গোঁড়া ও মৌলবাদী করে তুলছে। এই ভাবনার মূলে আছে পুঁজিবাদের ইন্ধন। দুটি দেশকে উগ্র করে তুলতে পারলে দুই দেশেই তাদের বিক্রির পরিসর বেড়ে যাবে এই কূট নীতি থেকেই অকারণ জাতীয়তাবাদের তুঙ্গ প্রচার চলছে স্যোসাল মিডিয়ায়। ফলে বিশ্বমানবতা দূরে থাক বিদ্বেষ বাড়ছে। পাশাপাশি দুই দেশের খেলার সময়ে যদি লক্ষ্য করেন, তাহলে দেখবেন এই বিদ্বেষের প্রকাশ পারদ গরলের মত কেমন ফুটে উঠছে ক্রমশই। আমি এতে আহত হই।


রংরুট: আধুনিক জীবনে ভোগবাদ মানবিক মূল্যবোধের ভিত্তিভুমিকেই টলিয়ে দিয়েছে –এমনটাই যদি কেউ ভাবেন, সেই ভাবনাকে আপনি কি ভাবে দেখেন? ভোগবাদের বিস্তারের সাথে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির যে সমানুপাতিক সম্পর্ক সেকথা মাথায় রেখেও মানবিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ে ভোগবাদের ভুমিকাকে কি কোন ভাবে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব বলে মনে করেন আপনি?

সৌমিত্র চক্রবর্তী: না, দ্রুততার এই সময়ে দুই বিপরীত মেরুতে আছে ভোগবাদ ও মানবিক মূল্যবোধ। ভোগবাদের মূল কথা হলো পুঁজির বিকাশ। কারখানায় তৈরী সামগ্রী বিক্রি না হলে মুনাফা আসবে না। নিত্য নতুন জিনিস তৈরী ও বিক্রি না করতে পারলে ব্যবসার প্রসার ঘটবে না। অতএব পুরুষের সাবান, সুগন্ধী, নারীর সাবান বা সুগন্ধী থেকে আলাদা এই প্রচার করতেই হবে। এরকম বহু উদাহরণ দেওয়া যায়। সত্যি বলতে কি ভোগবাদ তার নিজের স্বার্থেই অর্থনীতিকে এগিয়ে নিয়ে চলে। কিন্তু পাশাপাশি সৃষ্টি করে পারস্পরিক বিভাজন। একই সংসারে বাবা, মা, স্বামী, স্ত্রী, ছেলে, মেয়ে সবার ভোগ্যবস্তু আলাদা হতে হতে তাদের মধ্যে যে মানসিক বিভাজন তৈরী হয়ে যায়, তাতে শেষ পর্যন্ত তাদের এই সিদ্ধান্তে পৌঁছায় যে আপনি বাঁচলে বাপের নাম। লোভ বড় ভয়ংকর রিপু। সেই লোভের তাড়নায় এত অনলাইন, মলে শপিং। তাকে এই মুহূর্তে নিয়ন্ত্রণ প্রায় অসম্ভব। একমাত্র মানুষের চেতনা যেদিন তীব্র আঘাতপ্রাপ্ত হবে সেদিনই সে পাশের জনের হাত সত্যিকারের ভালোবাসায় ধরতে পারবে। আমাদের অপেক্ষা ছাড়া গত্যন্তর নেই।


রংরুট: আধুনিক বিশ্বব্যবস্থায় নাগরিকের মৌলিক অধিকার, তার স্বাধীনতার পরিসর ও নাগরিক জীবনে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ এই দুইয়ের মধ্যে ফারাকই বা কতটা ও সামঞ্জস্য বিধানই বা কি ভাবে সম্ভব? অবশ্যই এই ফারাক ও সামঞ্জস্য বিধান এক এক অঞ্চলে এক এক সমাজ ও রাষ্ট্রে এক এক রকম হওয়ারই কথা। কিন্তু বিশ্বায়ন কি এই বিষয়ে সঠিক কোন দিশা দিতে পারবে বলে মনে হয়?

সৌমিত্র চক্রবর্তী: আপাতত এটুকুই বলা যায় যে, প্রত্যেক রাষ্ট্রের নিজস্ব সংবিধানে যে মৌলিক অধিকারের কথা উল্লিখিত থাকে, তা কেবলমাত্র আক্ষরিক। প্রকৃত অবস্থা হল রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রকেরা তাদের নিজ ক্ষমতা করায়ত্ব করে রাখার স্বার্থে নাগরিকদের মৌলিক অধিকার দিতে চায় না। রাষ্ট্রশক্তিকে কাজে লাগিয়ে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ এমনভাবে বজায় রাখে যে নাগরিকেরা তাদের ইচ্ছানুযায়ী আচরণ করতে বাধ্য হয়। স্বাধীন ও মৌলিক অধিকার সম্পন্ন রাষ্ট্র আজ এক কষ্টকল্পিত রূপক মাত্র। বিশ্বায়নের এটুকু সুফল হল যে আজ প্রত্যেক দেশের নাগরিক বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে নিজের দেশের এইসব গোপন সন্ত্রাসের ব্যাপারে মত বিনিময় করতে পারছেন এবং উপলব্ধি করতে পারছেন এর চেহারা, আঙ্গিক। এটা রাষ্ট্র সত্বার নিয়ন্ত্রকেদের কাছে বিপজ্জনক। হয়তো আগামীতে এ ব্যাপারে কোনো সম্মিলিত প্রতিবাদ আমরা দেখতে পাব। ইতিমধ্যেই বাংলাদেশে, মায়ানমারে, চীনে, পাকিস্তানে, গাজা স্ট্রীপে, আইএস অধিকৃত ভূমিখন্ডে, আমেরিকায় বিভিন্ন ঘটনাবলীতে রাষ্ট্রের বিচ্যুতির সম্মিলিত প্রতিবাদ আমরা দেখেছি।


রংরুট: সাহিত্য দর্শন বিজ্ঞান প্রযুক্তির বিবর্তনের পথে আমরা যে অনেক দূর এগিয়ে এসেছি, সে কথা হয়তো বলাই যায়। কিন্তু সমাজ সংসার বিবর্তনের পথে বিগত দুই হাজার বছরের হিসাবটুকুই যদি ধরি খৃষ্টাব্দের সূত্রে- তাহলে সত্যই কতটুকু এগোলো মানুষের সমাজ সংসার সভ্যতা? আপনার মূল্যায়ন।

সৌমিত্র চক্রবর্তী: বারবার একটা কথা বলি, আমরা কি সত্যিই সভ্য হয়েছি। ইংল্যান্ডে যন্ত্রের উদ্ভবের সময়কে আধুনিক যুগের শুরু ধরা হয়। কিন্তু শুধুমাত্র যান্ত্রিক উন্নতিই কি মানুষের ভেতরের পশুসত্বাকে বিনষ্ট করতে পেরেছে? আজও ছোট পোষাক পরা মেয়েকে ধর্ষণ করাই যায় এরকম বিবৃতি পাওয়া যায়। প্রাচীন নিদর্শন ধ্বংস করছি, দাঙ্গা করছি অন্ধ মৌলবাদের শিকার হয়ে। সাহিত্য, দর্শন, বিজ্ঞান এগিয়েছে নিশ্চিত। কিন্তু মানুষের মনের ভেতরের অন্ধকার দূর না হলে আমরা সেই বর্বর মধ্যযুগেই থেকে যাব। আধুনিক কখনোই হব না।


রংরুট: সবশেষে এসে শুরুর সেই সূত্রটুকুর স্মরণে জানতে চাইবো; রংরুটই বলুন আর অগ্রগতিই বলুন সাধারণ মানুষের জন্যে এই বিশ্ব কতটা নিরাপদ আজ, কারণ সেইখানেই বিশ্বমানবতার নোঙরটি ফেলতে হবে না কি আমাদের?

সৌমিত্র চক্রবর্তী: আশ্বস্ততার কারন হল এখনো পর্যন্ত ভালো মানুষের সংখ্যাই বেশী। আর তাই বিশ্বাস রাখতে হবেই আমাদের। হতাশা মানেই মৃত্যু। বিশ্ব এই মুহূর্তে সত্যিই নিরাপদ নয়। কিন্তু “এ বিশ্বকে শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি...” এই শপথ আমাদের উজ্জীবিত করে প্রতিনিয়ত। সামাজিক উন্নতি, সাংস্কৃতিক উন্নতি, বৈজ্ঞানিক উন্নতি এবং অথনৈতিক উন্নতি যখন হাত ধরে সমান্তরাল রেখায় এগিয়ে যাবে তখনই উন্নত মানুষ বিশ্বমানবতার প্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে ভালোবাসতে শিখবে। পৃথিবী নিরাপদ হবে।


রংরুট সম্পাদকমণ্ডলীর পক্ষে থেকে আপনার সহযোগিতার জন্যে আন্তরিক ধন্যবাদ।