হাসিদা মুন - শিক্ষা ও সমকাল

একদা ব্রিটিশ আমলে সেকেলে কেরানি বানানোর উপযোগী শিক্ষার প্রচলন ছিল ব্রিটিশ কোম্পানির স্বার্থে। বর্তমানেও দেখা যায়, শিক্ষার বাজারীকরণের ফলে এই ধরনের কোর্সের কদর বেড়েছে। ভালো চাকরির আশায় ছাত্রছাত্রীরা এসব পড়ে ও ডিগ্রি পায়। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়েও এসব কোর্স আছে। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে মৌলিক বিজ্ঞান, যথা পদার্থবিদ্যা, গণিত অথবা বাংলা ভাষা, ইতিহাস, দর্শন ইত্যাদি জ্ঞানের গুরুত্বপূর্ণ শাখা অনুপস্থিত থাকে। এককালে ব্রিটিশরা চেয়েছিল কেরানি। এখন আন্তর্জাতিক করপোরেট পুঁজিও চায় উঁচু দরের কেরানি। সে জন্য শিক্ষা কোর্স এভাবেই তৈরি হচ্ছে যে, প্রকৃত শিক্ষা তার আদর্শ থেকে লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে যাচ্ছে কোন জাতি যদি এভাবে প্রকৃত শিক্ষা থেকে দীর্ঘ সময় দূরে সরে থাকে, তবে সে জাতির ভবিষ্যৎ সত্যিই অন্ধকার। শিক্ষাবিদ, দেশপ্রেমিক রাজনীতিবিদ ও দেশ নিয়ে ভাবেন এমন সৎ মানুষদের এখনই সোচ্চার হওয়া দরকার। আমরা প্রকৃত শিক্ষা চাই, যা জ্ঞানের আলো ছড়াবে। শিক্ষাক্ষেত্রে বৈষম্য, শিক্ষার সাম্প্রদায়িকীকরণ ও বাজারীকরণের নীতি এখনই পরিত্যাগ করতে হবে। শিক্ষা হোক অধিকার। শিক্ষা হোক বিজ্ঞানভিত্তিক এবং প্রকৃত মানুষ গড়ার উপায়।~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~

শিক্ষা ও সমকাল
হাসিদা মুন


যে কোনো বিষয়ের উপর জ্ঞান বা দক্ষতা অর্জনই শিক্ষা। ব্যাপক অর্থে পদ্ধতিগতভাবে জ্ঞানলাভের প্রক্রিয়াকেই শিক্ষা বলে। তবে শিক্ষা হল সম্ভাবনার পরিপূর্ণ বিকাশ সাধনের অব্যাহত অনুশীলন। বাংলা ভাষায় শিক্ষা শব্দটি এসেছে ‍'শাস' ধাতু থেকে। যার অর্থ শাসন করা বা উপদেশ দান করা। শিক্ষা অবশ্যই এমন হওয়া উচিত যা শুধুই জীবন ধারনের প্রয়োজনীয় বিষয়ের উপর জ্ঞান দিবেনা- জীবন জগত, বাস্তব পরাবাস্তব সম্পর্কে সার্বিক জ্ঞান লাভ করা চাই, কাজেই শিক্ষার সংজ্ঞা আরো কিছুটা ব্যাপক হওয়া দরকার
জন ডিউই বলেছেন, ‌শিক্ষার উদ্দেশ্য আত্ম উপলদ্ধি।
প্লেটোর মত হলো - 'শরীর ও আত্মার পরিপূর্ণ বিকাশ ও উন্নতির জন্য যা কিছু প্রয়োজন, তা সবই শিক্ষার উদ্দেশ্য অন্তর্ভূক্ত।'
প্লেটোর শিক্ষক সক্রেটিসের মতে - 'শিক্ষার উদ্দেশ্য হলো মিথ্যার বিনাশ আর সত্যের আবিষ্কার।
এরিস্টোটল বলেছেন - শিক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্যে হলো ধর্মীয় অনুশাসনের অনুমোদিত পবিত্র কার্যক্রমের মাধ্যমে সুখ লাভ করা।'
এরিস্টটল এও বলেন - সুস্থ দেহে সুস্থ মন তৈরি করাই হলো শিক্ষা
শিক্ষাবিদ জন লকের মতে- শিক্ষার উদ্দেশ্য হবে সুস্থ দেহে সুস্থ মন প্রতিপালনের নীতিমালা আয়ত্বকরণ।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায় শিক্ষা হল তাই যা আমাদের কেবল তথ্য পরিবেশনই করে না বিশ্বসত্তার সাথে সামঞ্জস্য রেখে আমাদের জীবনকে গড়ে তোলে।
বিখ্যাত শিক্ষাবিদ হার্বার্ট বলেছেন - শিক্ষার উদ্দেশ্য হবে শিশুর সম্ভবনা ও অনুরাগের পূর্ণ বিকাশ ও তার নৈতিক চরিত্রের প্রকাশ।'
অন্যদিকে শিক্ষার ইংরেজি প্রতিশব্দ এডুকেশন এসেছে ল্যাটিন শব্দ 'এডুকেয়ার' বা 'এডুকাতুম' থেকে। ইংরেজি ভাষায় শিক্ষার প্রতিশব্দ হলো - Education
এই Education শব্দের সাধারণ আভিধানিক অর্থ হলো; শিক্ষাদান ও প্রতিপালন Educate মানে 'to bring up and instruct, to teach, to train' অর্থাৎ প্রতিপালন করা ও শিক্ষিত করিয়া তোলা, শিক্ষা দেওয়া, অভ্যাস করানো। জীবন বাচাঁনোর তাগিদে অর্জিত কিছু জ্ঞান যার অর্থ বের করে আনা অর্থাৎ ভেতরের সম্ভাবনাকে বাইরে বের করে নিয়ে আসা বা বিকশিত করা।
Education শব্দের বুৎপত্তি অনুযায়ী শিক্ষা হলো শিক্ষার্থীর মধ্যকার ঘুমন্ত প্রতিভা বা সম্ভবনার পথ নির্দেশক।
Joseph T. Shipley তাঁর Dictionary of word Origins এ লিখেছেন, Education শব্দটি এসেছে ল্যাটিন Edex এবং Ducer-Duc শব্দগুলো থেকে। এ শব্দগুলোর শাব্দিক অর্থ হলো, যথাক্রমে বের করা, 'পথ প্রদর্শন করা'আরেকটু ব্যাপক অর্থে তথ্য সংগ্রহ করে দেয়া এবং সুপ্ত প্রতিভা বিকশিত করে দেওয়া।

প্রধানতঃ তিন ধরনের শিক্ষাব্যবস্থা আমাদের সমাজে চালু আছে। এর মধ্যে কিছু উপবিভাগও আছে।
ক) সাধারণ শিক্ষা:
----------------------
সাধারণ স্কুলে (সরকারি বা এমপিওভুক্ত বেসরকারি) বা কলেজে (জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন) যা পড়ানো হয়, এখানে পড়ে মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলেমেয়েরা।
খ ) ইংলিশ মিডিয়াম শিক্ষা:
---------------------------------------
যার অনেকগুলোই আমাদের জাতীয় শিক্ষা কোর্সের অন্তর্ভুক্ত নয়। ও লেভেল, এ লেভেল ইত্যাদি। এখানে পড়ে ধনী ঘরের ছেলেমেয়েরা। তা ছাড়া একই শিক্ষা কোর্সের ইংলিশ ভার্সন নামে আরেক ধরনের স্কুল আছে, যার প্রয়োজনীয়তা ও যৌক্তিকতা সরকার কখনো বোঝাতে সক্ষম হয়নি।
গ) মাদ্রাসা শিক্ষা:
--------------------------------
এখানে পড়ে আর্থ সামাজিকভাবে নিম্নবৃত্তের ছেলেমেয়েরা। যাদের শিক্ষার মান ও যোগ্যতা ঠিকমতো হয়না তার মধ্যে আবার কওমি মাদ্রাসায় পড়ে সবচেয়ে গরিব ঘরের শিশুরা।
ইংলিশ মিডিয়ামে যারা পড়ে, সত্যিকার অর্থে দেশ, দেশের কৃষ্টি, নিজস্ব সংস্কার সম্বন্ধে কতটুকু শিক্ষা লাভ করে, তা বলা কঠিন। তবে এ কথা নিশ্চিতভাবে বলা যায়, তারা সাধারণত বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিকে বেশ অবজ্ঞা করে।
অন্যদিকে মাদ্রাসাগুলোতেও বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিকে তুচ্ছজ্ঞান করা হয়। বিশেষ করে, কওমি মাদ্রাসার শিক্ষাক্রমে পঞ্চম শ্রেণির ওপরে আরবি, ফারসি, উর্দু ভাষা শেখানো হলেও বাংলা ভাষা শেখানো হয় না। ইংলিশ মিডিয়াম আর মাদ্রাসা উভয় ক্ষেত্রেই ছাত্রছাত্রীদের দেশাত্মবোধ জাগ্রত করার কোনো ব্যবস্থা এখানে নেই। অধিকাংশ মাদ্রাসায় জাতীয় সংগীত শেখানো হয় না। এ লেভেল, ও লেভেল যেসব বিদ্যালয়ে পড়ানো হয়, সেখানেও জাতীয় সংগীত ঠিকমত শেখানো হয় না।
আজ থেকে অর্ধশতাব্দীরও আগে পাকিস্তান আমলেই শিক্ষাবিদ ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ যা বলেছিলেন, তা আজও প্রাসঙ্গিক বলে বিবেচিত হতে পারে। তিনি বলেছিলেন, ‘সাবেক প্রথায় বাংলাদেশে এখনও তিনটি শিক্ষাপ্রণালী আছে এবং তাহা সরকারের অনুমোদিত নিউ স্কীম মাদ্রাসা, ওল্ড স্কীম মাদ্রাসা ও সাধারণ শিক্ষা। ইহা শিক্ষাক্ষেত্রে শুধু গন্ডগোলই সৃষ্টি করিয়াছে এবং মুসলিম সমাজে অনৈক্য আনয়ন করিয়াছে।...আযাদ পাকিস্তানে ইহাদের অস্তিত্ব নিষ্প্রয়োজন বরং হাস্যকর ও লজ্জাকরও বটে, পৃথিবীর কোন সভ্য দেশে সরকার একাধিক শিক্ষাপ্রণালী কখনও মঞ্জুর করে না।’- (‘সাধারণ শিক্ষা ও মাদ্রাসা শিক্ষা সংস্কার-আমাদের সমস্যাশীর্ষক প্রবন্ধ )
শিক্ষাক্ষেত্রে বিভিন্ন রকমের প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে। একদিকে যেমন আছে দরিদ্র সন্তানদের জন্য প্রাথমিক বিদ্যালয়, অন্যদিকে তেমনি আছে ইন্টারন্যাশনাল স্কুল, যার প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি ফি ১০ লাখ টাকা। বার্ষিক টিউশন ফি ও অন্যান্য ফি বাবদ লাগে ১৭ লাখ ২৫ হাজার টাকা। অনুরূপ আরো স্কুলে প্রথম শ্রেণির ভর্তি ফি ৪ লাখ ৩৫ হাজার টাকা এবং বছরে বেতন ও অন্যান্য ফি বাবদ লাগে ৯ লাখ ৫৪ হাজার টাকা। এই পরিসংখ্যানের চাইতে এখন সম্ভবত বেতন ফি আরো বেড়ে গিয়েছে
শিক্ষাক্ষেত্রে এই বৈষম্য পরিপূর্ণরূপে সংবিধান পরিপন্থী। সমাজতন্ত্রের ধারণার পরিপন্থী এবং অবশ্যই সামাজিকীকরণ চেতনার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়।
শিক্ষা এখন বাণিজ্যিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে। যাঁর যত টাকা তাঁর সন্তানেরা তত বেশি নামীদামি স্কুলে পড়বে। অবশ্য নামীদামি স্কুলে পড়লেই যে ভালো শিক্ষা লাভ করবে, এমন নিশ্চয়তা দেওয়া যায় না। ভালো সার্টিফিকেট পাওয়া যেতে পারে, যা চাকরির বাজারে কাজে লাগবে। কিন্তু সেটাই কি সত্যিকারের শিক্ষার উদ্দেশ্য হতে পারে কি?
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শিক্ষার হেরফেরশীর্ষক প্রবন্ধে বলেছিলেন,- ‘আমাদের সমস্ত জীবনের শিকড় যেখানে, সেখান থেকে সাত হস্ত দূরে আমাদের শিক্ষার ধারা বর্ষিত হইতেছে...।' আমরা যে শিক্ষায় আজন্মকাল যাপন করি, সে শিক্ষা কেবল যে আমাদিগকে কেরানীগিরি অথবা কোনো একটি ব্যবসায়ের উপযোগী করে মাত্র।তিনি আরও বলেন, এই শিক্ষা কেবল ধনোপার্জন এবং বৈষয়িক উন্নতির সাধনে ব্যস্ত।রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যে দিকটির সমালোচনা করেছিলেন, এখন সেই প্রবণতা বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে।
একদা ব্রিটিশ আমলে সেকেলে কেরানি বানানোর উপযোগী শিক্ষার প্রচলন ছিল ব্রিটিশ কোম্পানির স্বার্থে। বর্তমানেও দেখা যায়, শিক্ষার বাজারীকরণের ফলে এই ধরনের কোর্সের কদর বেড়েছে। ভালো চাকরির আশায় ছাত্রছাত্রীরা এসব পড়ে ও ডিগ্রি পায়। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়েও এসব কোর্স আছে। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে মৌলিক বিজ্ঞান, যথা পদার্থবিদ্যা, গণিত অথবা বাংলা ভাষা, ইতিহাস, দর্শন ইত্যাদি জ্ঞানের গুরুত্বপূর্ণ শাখা অনুপস্থিত থাকে। এককালে ব্রিটিশরা চেয়েছিল কেরানি। এখন আন্তর্জাতিক করপোরেট পুঁজিও চায় উঁচু দরের কেরানি। সে জন্য শিক্ষা কোর্স এভাবেই তৈরি হচ্ছে যে, প্রকৃত শিক্ষা তার আদর্শ থেকে লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে যাচ্ছে
কোন জাতি যদি এভাবে প্রকৃত শিক্ষা থেকে দীর্ঘ সময় দূরে সরে থাকে, তবে সে জাতির ভবিষ্যৎ সত্যিই অন্ধকার। শিক্ষাবিদ, দেশপ্রেমিক রাজনীতিবিদ ও দেশ নিয়ে ভাবেন এমন সৎ মানুষদের এখনই সোচ্চার হওয়া দরকার। আমরা প্রকৃত শিক্ষা চাই, যা জ্ঞানের আলো ছড়াবে। শিক্ষাক্ষেত্রে বৈষম্য, শিক্ষার সাম্প্রদায়িকীকরণ ও বাজারীকরণের নীতি এখনই পরিত্যাগ করতে হবে। শিক্ষা হোক অধিকার। শিক্ষা হোক বিজ্ঞানভিত্তিক এবং প্রকৃত মানুষ গড়ার উপায়।
মোট কথা শিক্ষা হলো - ব্যক্তিত্বের পরিপূর্ণ বিকাশ
মেধার পরিপূর্ণ বিকাশ
মানসিক শক্তির পরিপূর্ণ বিকাশ
শারীরিক সামর্থের পরিপূর্ণ বিকাশ
মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাবোধের বিকাশ
মৌলিক অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাবোধের বিকাশ
জাতিসংঘ ঘোষণার বর্ণিত নীতিমালার প্রতি শ্রদ্ধাবোধের বিকাশ
পিতা-মাতার প্রতি শ্রদ্ধাবোধের বিকাশ
নিজস্ব সাংস্কৃতিক সত্তার প্রতি শ্রদ্ধাবোধের বিকাশ
. নিজস্ব ভাষার প্রতি শ্রদ্ধাবোধের বিকাশ
নিজস্ব মূল্যবোধের প্রতি শ্রদ্ধাবোধের বিকাশ
মাতৃভূমির প্রতি শ্রদ্ধাবোধের বিকাশ
অপরাপর সভ্যতার প্রতি শ্রদ্ধাবোধের বিকাশ
সমঝোতা, শান্তি, সহিষ্ণুতা, নারী-পুরুষের সমানাধিকার এবং সকল মানুষ. নৃ-গোষ্ঠী, জাতীয় ও ধর্মীয় গোষ্ঠ এবং আদিবাসী লোকজনের মধ্যে মৈত্রীর চেতনার আলোকে মুক্ত সমাজে দায়িত্বশীল জীবনের জন্য প্রস্তুতির বিকাশ
প্রাকৃতিক পরিবেশের প্রতি শ্রদ্ধাবোধের বিকাশ
মানুষকে মানবিক করে তোলা, নৈতিক করে তোলা, বিবেক বুদ্ধির বিকাশ - ক্রমান্বয়ে ঘটানোই শিক্ষার উদ্দেশ্য
দার্শনিক ও শিক্ষাবিদ শিক্ষাকে বিভিন্নভাবে সংজ্ঞায়িত করেছেন। শিক্ষার উদ্দেশ্যে বর্ণনা করে গেছেন। প্রাচীন দার্শনিক এরিস্টোটল, সক্রেটিস ও প্লেটো শিক্ষার তাৎপর্য বর্ণনা করে গেছেন। সেই থেকে পরবর্তী সকল যুগের চিন্তাবিদরাই শিক্ষা সম্পর্কে কথা বলেছেন। শিক্ষার পরিচয় এবং সংজ্ঞা দেবার চেষ্টা করেছেনশিক্ষা প্রক্রিয়ায় কোন ব্যক্তির অন্তর্নিহিত গুণাবলীর পূর্ণ বিকাশের জন্য উৎসাহ দেয়া হয় এবং সমাজের একজন উৎপাদনশীল সদস্য হিসেবে প্রতিষ্ঠালাভের জন্য যে সকল দক্ষতা প্রয়োজন সেগুলো অর্জনে সহায়তা করা হয়।
পর্যালোচনা করে দেখা যায়, নবীগণ পয়গম্বর, দেব দেবীদের আবির্ভাব ঘটেছিলো সমাজে শিক্ষা প্রচারের উদ্দেশ্যেই তাঁরা শিক্ষার তাৎপর্য এবং লক্ষ্য উদ্দেশ্য সুস্পষ্টভাবে নিজ নিজ জাতির সামনে পেশ করেছেন। তাঁরা প্রধানত শিক্ষক হিসেবেই প্রেরিত হয়েছিলেন।

আমাদের শিক্ষার উদ্দেশ্য কি? এই প্রশ্নের উত্তরে ৯৯% জনই বলবেন শিক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্য একটা ভালো চাকুরী, অর্থাৎ কিনা বড় চাকর তৈরী হওয়া এবং এদেশের মানুষের ধারণা বড় ডিগ্রী মানেই বেশি শিক্ষিত। কিন্তু এদেশে যাদের বড় ডিগ্রী থাকে তাদের ভিতরে শিক্ষার আলো খুব কম দেখতে পাই বরং যাদের ডিগ্রী নেই এমন অনেক মানুষের মধ্যে শিক্ষার আলো দেখতে পাই। একজন বড় ডিগ্রী প্রাপ্ত মানুষ অন্যের থেকে অবৈধভাবে অর্থ নিয়ে নিজের রোজগার বাড়ান, অন্যদের গবেষনাপত্র চুরি করে নিজের নামে প্রকাশ করেন, প্রাথমিক স্কুলের বাচ্চাদের মত অন্যের সাথে ঝগড়াঝাটি করে ট্রেনে -বাসে জায়গা দখল করেন। এমন শিক্ষিত মানুষও দেখা যায় যিনি পান খেয়ে স্কুলের দেওয়াল নোংরা করেন কিংবা বাস থেকে থুতু ফেলেন যেটা রাস্তায় চলমান মানুষের গায়ে গিয়ে পড়ে। পিতামাতার সম্পত্তি নিজের করায়ত্ত্ব করে পিতামাতাকে বৃদ্ধাশ্রমে চালান করেন ডাক্তাররা রোগীদের থেকে বেশি অর্থ রোজগারের চেষ্টা করেন। এগুলোই কি প্রকৃত শিক্ষার নমুনা? আজ পর্যন্ত কোন দার্শনিক কোথাও বলেন নি যে শিক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্য চাকুরী অর্জন বা এইসব পাশবিক আচরণ লাভ করা আসলে বহু বছর ভারত বর্ষের মানুষেরা অন্যের গোলামী করতে করতে গোলামী করাটা তাদের জন্মগত অধিকার বলে ধরে নিয়েছেন এবং গোলামী করতে করতে তাদের নীতি-আদর্শ সব জলাঞ্জলি গেছে।
শিক্ষা- স্কুল, কলেজ, বই এসব থেকে পাওয়া যায় না, শিক্ষা মানুষের ভিতর থেকে আসে। প্রকৃত শিক্ষার জন্য স্কুলে যেতে হয় না বা ডিগ্রী লাগে না। প্রকৃত শিক্ষা মানুষের ব্যক্তিত্ত্বকে বিকশিত করে এবং সঠিক আচরণ করতে শেখায়। যে মানুষের ডিগ্রী থাকা সত্ত্বেও আচরণ ঠিক নেই সে মানুষই নয়। সুতরাং ডিগ্রী থাকুক বা নাই থাকুক নিজেকে প্রকৃত মানুষ তৈরী করাটাই হল শিক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্য যাতে করে সে সমাজের জন্য কল্যানকর হয়ে উঠতে পারে নাহলে সারাজীবনের সব পরিশ্রম জলে যাবে।
শিক্ষা জাতির মেরুদন্ড যদি হয় - শিক্ষার মেরুদন্ড তবে কি?
মানুষকে মানুষ হতে শেখায় আর এক প্রকার শিক্ষা অমানুষ হতে শেখায়। আপনি কোন শিক্ষায় শিক্ষিত হবেন, তা পুরোটাই নির্ভর করে আপনার বিবেকের উপর। তাই, শিক্ষা জাতির মেরুদন্ড হলে শিক্ষার মেরুদন্ড হলো বিবেক বুদ্ধি
কারন বিবেক ছাড়া শিক্ষিত মানুষকে শিক্ষিত বলা যায়, কিন্তু সুশিক্ষিত বলা যায় না
শিক্ষার মান নিয়েও আজকাল যে প্রশ্ন উঠছে তার দায় শিক্ষকরা এড়াতে পারে না। কারণ প্রশ্ন ফাঁস নামক একটি অসৎ কাজের পেছনে গুটিকতক শিক্ষক নামের কুলাঙ্গার জড়িয়ে রয়েছে। প্রশ্ন ফাঁসের কারণে ছাত্রছাত্রীদের ভাল রেজাল্ট হয়তো হচ্ছে কিন্তু মেধার বারোটা বেজে যাচ্ছে যা সে বুঝতে বুঝতে অনেক দেরি হয়ে যাবে। এভাবে শুধু সে পিছিয়ে পড়ছে তা না দেশটাকেও পিছিয়ে দিচ্ছে, কারণ দেশে হাজার হাজার মেধাহীন জনশক্তির চেয়ে অল্পসংখ্যক মেধাবী থাকা উত্তম। তাই শিক্ষার মেরুদণ্ড ভেঙে যারা দেশটার অপূরণীয় ক্ষতিসাধন করছে তাদের কঠোর শাস্তির আওতায় আনা জরুরি।
শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে দেশে সামগ্রিকভাবে একটা সমালোচনা চলছে। অনেক দিন আগে থেকেই মেধাবীদের মূল্যায়ন ও শিক্ষা পদ্ধতিতে মেধার সঠিক মূল্যায়ন করা হচ্ছে না বলে অভিযোগ রয়েছে। পাসের হার বৃদ্ধির সাথে সাথে কতটা মেধাবী শিক্ষার্থী বের করতে পারছি তা নিয়েই মূলত প্রশ্ন রয়েছে। কারণ ভাল ফলাফল করা ছাত্র-ছাত্রীরা বিভিন্ন মেধা পরীক্ষায় হতাশ করার মত ফলাফল করছে। দেশে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। শিক্ষিত বেকার বৃদ্ধি দেশের জন্য কোন সুখকর খবর না। কিন্তু সেটাই ঘটে চলেছে। কয়েক বছর আগে থেকেই অনেকেই দেশের মেধাবীদের সংখ্যা কমে যাচ্ছে বলে আসছেন। মেধা মূল্যায়নের সাথে সাথে কয়েকটা বিষয় নিয়ে মূলত শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে সমালোচনা হচ্ছে। সৃজনশীল প্রশ্নপদ্ধতির প্রয়োগে দক্ষতার অভাব, পাঠ্যসূচিতে পরিবর্তন, আনাচে কানাচে ব্যঙের ছাতার মত গড়ে ওঠা কিন্ডারগার্টেন এবং অধিকাংশ পরীক্ষার আগে প্রশ্নফাঁস এসব এখন শিক্ষার সাথে যেন আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে গেছে।
কোন মতেই যেন এর থেকে বের হতে পারছি না। কথায় আছে সর্ষের ভেতরই যদি ভূত থাকে তাহলে ওঝা ঝাড়বে কোথায়। প্রশ্ন ফাঁসের সাথে জড়িয়ে আছে নীতিহীন শিক্ষক যাদের কাছে প্রশ্ন না, বিবেক না, মেধা না মূল লক্ষ্য হলো পকেট ভারী করা। জড়িয়ে আছে বড় বড় সাইনবোর্ডের আড়ালে শিক্ষা ও মেধা নিয়ে ব্যবসা করা কোচিং সেন্টার আর আছে যে কোন মূল্যে সন্তানের ভাল রেজাল্ট নিশ্চিত করা কিছু অভিভাবক ও অনেক ক্ষেত্রে শিক্ষার্থী নিজেই।

ছাত্র-ছাত্রীরা সত্যি সত্যি পরীক্ষার প্রস্তুতি বাদ রেখে কোথায় প্রশ্ন পাওয়া যাচ্ছে তা খুঁজতে সময় নষ্ট করছে। শুধু ছাত্র-ছাত্রী নয় অনেক অভিভাবকও সন্তানের ভাল ফলাফলের আশায় সেসব ফাঁস হওয়া প্রশ্নের খোঁজে ছুটছে কি অদ্ভুত ব্যাপার !
নিজের পকেট ভারী করে দেশের মেধা বিসর্জন দিতে কার্পণ্য করছে না এসব অকাল কুষ্মান্ডরা। মেধা দিয়ে তো আর তাদের বাড়ি গাড়ি হবে না। তা টাকা দিয়েই কিনতে হবে। আর প্রশ্ন ফাঁসকারীরাও এই সুযোগের অপেক্ষায় থাকে। টাকা তো তাদের চাই-ই। তাই তো প্রশ্ন বিক্রি করে টাকা কামাচ্ছে। বাজারে যারা ব্যবসা করে তাদেরও একটা নীতি আছে বলে মনে হয়। কিন্তু যারা আগেই প্রশ্ন বিক্রি করে তাদের নীতির বালাই আছে বলে মনে হয় না।
কর্তৃপক্ষ অবশ্য প্রশ্ন ফাঁস রোধ করার জন্য কম চেষ্টা করেনি। আগামীতে স্থানীয়ভাবে ডিজিটাল পদ্ধতিতে প্রশ্ন ছাপানোর বিষয়টি স্পষ্ট করেছেন।
দেশের মূল সম্পদ কোনটি? এক কথায় উত্তর মেধাবীরা।
একমাত্র মেধাবীরাই পারে দেশের বাকী সম্পদের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে জাতির মেধাকে ধ্বংস করে কোনদিন উন্নয়ন আশা করা যায় না। মুক্তিযুদ্ধের একেবারে শেষভাগে এসে যখন পাকিস্তানীরা যখন দেখলো যে তাদের পরাজয় নিশ্চিত তখন বেছে বেছে তারা দেশের বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করলো। তাদের উদ্দেশ্য ছিল যাতে স্বাধীন হলেও যেন মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারি।
যাদের হত্যা করা হয়েছে তারা যদি আজ বেঁচে থাকতো তাহলে আমরা আরো এগিয়ে যেতাম নিশ্চিত। প্রশ্ন ফাঁস করে জাতির মেধাবী সন্তানদের মেধা বিকশিত হওয়ার আগেই মেরে ফেলাটাও সেরকম জঘন্য কোন অপরাধ বলে মনে হয়। ক্ষেত্রবিশেষে এটা তার থেকেও বড়। কারণ যাদের মেধা বিকাশের সুযোগ না দিয়ে চৌর্য বৃত্তি করে পরীক্ষার ফলাফল কেনা হলো তার মেধা আর কোনদিন বিকশিত না হবারই কথা। সে সারাজীবন এই অবস্থা থেকে বের হতে পারবে কি না সন্দেহ থেকেই যায়
এই বাঙালিরাই বিভিন্ন সময়ে পৃথিবীর বুকে মেধা, দক্ষতা আর গৌরবের সাক্ষর রেখেছেন। সাহিত্য, সংস্কৃতি, বিজ্ঞান, খেলাধূলা সর্বপরি প্রতিটি ক্ষেত্রেই বাঙালি এবং বাংলার কথা জ্বলজ্বল করছে। বিজ্ঞানী জগদীশ চন্দ্র বসু, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, বেগম রোকেয়া সহ কত নাম মেধার এক উৎকৃষ্ট উদাহরণ হয়ে আছে।

আজকের শিক্ষার্থীদের পূর্বের তুলনায় অনেক বেশি পরিশ্রম করতে হয়। এবেলা ওবেলা তাদের প্রাইভেট কোচিং নিয়ে ব্যস্ত থাকতে দেখা যায়।
প্রাইভেট ব্যবসা অনেক পুরাতন এবং এটি বহাল তবিয়তেই চলছে। এখন যারা যে শিক্ষকের কাছে প্রাইভেট পড়ে পরীক্ষার আগে সেইসব শিক্ষার্থীকে প্রশ্ন অনেকেই আগে থেকেই বলে দেন। আজ যে প্রশ্ন ফাঁস হচ্ছে তার একমাত্র উদ্দেশ্যই হচ্ছে টাকা। কোচিং সেন্টারগুলো এবেলা-ওবেলা পরীক্ষা নিয়ে এ প্লাস পাওয়ানোর শর্তে ছাত্রছাত্রীদের কোচিং সেন্টারে টেনে আনে। এখানে দায় শুধুমাত্র কোচিং সেন্টারকে দিলেই হবে না। খানিকটা অভিভাবকের ওপরও পড়ে। যারা দিনরাত লেখাপড়া, বেশি বেশি পরীক্ষা আর পরীক্ষায় অন্তত গোল্ডেন এ প্লাসকে সামাজিক মর্যাদা বলে মনে করেন। তাতে তার সন্তানের যাই হোক না কেন। মাঝে মাঝে পরীক্ষায় অকৃতকার্র্য ছাত্র-ছাত্রীদের আত্মহননের খবর আসে। তাদের আসলে বোঝানো হয় যে ফেল করা মানে সব কিছু শেষ হওয়া।
আসলে কি তাই? পাস ফেল হচ্ছে স্বাভাবিক বিষয়। যে পরিশ্রম করবে সে ভাল ফল করবে আর যে তা করবে না তার ফল খারাপ হবে। কিন্তু প্রশ্ন ফাঁস করে ভাল ফলাফল করার কোন বীরত্ব নেই। প্রশ্ন ফাঁস হওয়াতে মেধাবী জাতি নিয়ে আমরা শংকিত। মেধাবী জাতি গঠনে তাই শিক্ষার সার্বিক উন্নয়ন আবশ্যক।
দেশের উন্নয়ন, অগ্রগতিতে দক্ষ, মেধাবী এবং কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন জনশক্তির বিকল্প নেই। যদি এভাবে দেশের সকল কর্মক্ষম মানুষকে দক্ষ করে গড়ে তোলা যায় তাহলে উন্নত সমৃদ্ধ দেশ প্রতিষ্ঠা কঠিন কোনো কাজ নয়। কিন্তু তরুণ, যুবকসহ যারা চাকরি বাজারে প্রবেশ করছে তাদের ৮০ থেকে ৮৫ ভাগই অদক্ষ হিসেবে আসছে। সরকারের নানা প্রচেষ্টা সত্ত্বেও দেশে কারিগরি শিক্ষা এখনো রয়েছে উপেক্ষিত। যে স্বল্পসংখ্যক তরুণ কারিগরি শিক্ষা নিয়ে কর্মবাজারে প্রবেশ করেছে তাদের যথাযথ মূল্যায়ন হয় না। এমনি অবস্থায় সরকারের সামনে কারিগরি শিক্ষার প্রসার, এ শিক্ষার গুণগত মানোন্নয়ন, কর্মক্ষেত্রে বৈষম্যের অবসান অপরিহার্য। যথাযথভাবে এসব কাজ করা গেলে দেশের বর্ধিত জনসংখ্যা সমস্যা না হয়ে পরিণত হবে সম্পদে।
বিশ্বে এখন মানুষের জন্য প্রযুক্তি অপরিহার্য হয়ে ওঠছে। আগামীদিনে প্রযুক্তির প্রায়োগে দক্ষতাই অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তিতে পরিণত হবে। এ গুরুত্ব বিবেচনায় বিশ্বের ভবিষ্যৎ কর্মবাজারের চাহিদা অনুযায়ী দেশে মানবসম্পদের দক্ষতা উন্নয়নে পরিকল্পনা গ্রহণের কার্যক্রম গ্রহণ করা হচ্ছে, বিশ্বে প্রযুক্তির নানামুখী চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা সামনে অনেক সুযোগ এনে দিয়েছে। এ সুযোগকে কাজে লাগানোর জন্য বৈশ্বিক কর্মবৈচিত্র্যতার নিরিখে দেশের কর্মক্ষম মানুষকে অধিকতর সৃজনশীল ও দক্ষ করে গড়ে তোলা দরকার।
বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় সাফল্যের সঙ্গে টিকে থাকতে হলে শিক্ষার্থীদের করণীয় কী?
প্রথমত কারিকুলাম অনুসারে পাঠ্যবইটি বুঝে পড়তে হবে। এক্ষেত্রে ফাঁকি দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। তবে শুধু টেক্সবইয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলে চলবে না। বর্তমান প্রতিযোগিতার বাজারে টিকে থাকার জন্য সমসাময়িক বিষয়াবলীর দিকেও সমান দৃষ্টি রাখতে হবে। নজর রাখতে হবে বহির্বিশ্বের বিভিন্ন ঘটনাবলির দিকেও। পাশাপাশি নিজেকে দক্ষ এবং যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তি হিসেবে গড়ে তুলতে জীবন ও কর্মমুখী শিক্ষার প্রতিও জোর দিতে হবে।
শিক্ষার্থীদের মাঝে মানবিক মূল্যবোধের বিকাশ ঘটাতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, অভিভাবক ও সংশ্লিষ্টদের করণীয় কী?
শিক্ষার্থীদের সৃজনশীল করে গড়ে তোলার সুযোগ দিতে হবে। তাদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশের জন্য ক্ষেত্র তৈরি করতে হবে। বিভিন্ন দর্শনীয় জায়গায় নিয়ে তাদের উৎসাহিত করতে হবে। তবে তাদের একেবারে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার সুযোগ দেওয়া যাবে না। সমাজের আচার-আচরণ, রীতি-নীতির শিক্ষা দিতে হবে।
এই শিক্ষা শুধুই যে শিক্ষক দেবেন এমন ভাবার যেমন অবকাশ নেই, তেমনি পিতা-মাতা দেবেন এমনও ভাবা যাবে না। স্ব স্ব অবস্থান থেকে মানবিক মূল্যবোধের বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। তবেই একজন শিক্ষার্থী মানবিক মূল্যবোধের গুণে গুণান্বিত হবে।
দেশে কর্মমুখী শিক্ষার সম্প্রসারণের প্রয়োজন
সার্বিকভাবে কর্মমুখী শিক্ষা যদি পরিচালনা করা যায় তবে দেশে বেকারের সংখ্যা অনেক কমে আসবে। তবে শুধু উদ্যোগ নিলেই চলবে না, এক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের দক্ষ ও কর্মোপযোগী করে তোলার জন্য শিক্ষকদেরও অবশ্যই প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এবং গবেষণায় পারদর্শী হতে হবে। একইসঙ্গে শিক্ষা দেওয়ার জন্য ক্লাস রুমে সেসব সরঞ্জামের প্রয়োজন তারও যথেষ্ট সরবরাহ থাকতে হবে। শহরাঞ্চলের শিক্ষাঙ্গনে খেলার মাঠ নেই। ফলে পাঠ্যক্রম বহির্ভূত কার্যক্রমে অংশ নিতে পারছে না শিক্ষার্থীরা। এতে মেধাবিকাশের ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীরা পরিবেশ পাচ্ছেনা শিক্ষা এমন একটি বিষয় যেখানে মনোযোগের জন্য আনন্দমুখর পরিবেশের প্রয়োজন হয়। কিন্তু শহরাঞ্চলের অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে খেলাধুলার জন্য মাঠ, বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজনের জন্য কোনো মাঠ বা অডিটোরিয়াম নেই। এটা দুঃখজনক। ফলে এই সব প্রতিষ্ঠানে পাঠ্যক্রম বহির্ভূত কার্যক্রমের অভাবে শিক্ষার্থীরা তাদের মেধাকে সঠিকভাবে বিকশিত করতে পারছে না। এতে করে তারা পাঠ্যক্রমবহির্ভূত কার্যক্রম চালু আছে এমন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের থেকে অনেক পিছিয়ে পড়ছে। তাই শিশুদের বিদ্যালয়ে ভর্তির পূর্বে এই বিষয়টি নিয়ে অভিভাবকদের অন্তত একবার চিন্তা করা উচিত।
আজকাল পাসের হার শতকরা হারে বাড়লেও আসলে শিক্ষার সামগ্রিক গুণগত মান সেভাবে বাড়েনি। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা পাবলিক পরীক্ষার খাতা মূল্যায়নে সময়ের স্বল্পতা। কারণ পরীক্ষা শেষে পরীক্ষক খাতা মূল্যায়নের জন্য যে সময় পান সার্বিকভাবে তা মোটেও যথেষ্ট নয়। ফলে দায় এড়াতে দ্রুত খাতা মূল্যায়নে ওভারমার্কিংয়ের কৌশল অবলম্বন করেন অনেক শিক্ষক। এতে করে পাসের হার বৃদ্ধি পায় কিন্তু শিক্ষার মান যে হারে বাড়ার কথা ছিল তা হয় না। ফলে ওই শিক্ষার্থীদের ফলাফল দেখে তাদের যতটা মেধাবী মনে হয় আসলে তারা কিন্তু ততটা নয়। ফলে পরবর্তী জীবনে তারা বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হন। এছাড়া সৃজনশীলের মতো নতুন পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীরা এখনো তাদের দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে পারেনি। একইসঙ্গে শিক্ষকরা এ বিষয়ে ততটা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নয়। ফলে উভয়ের জ্ঞানের ঘাটতি এ ক্ষেত্রে বড় প্রতিবন্ধকতা হিসেবে কাজ করছে।
শিক্ষার মান বাড়াতে শিক্ষকদের ছাত্র-ছাত্রীদের ওপর অভীক্ষা, পরীক্ষা, যাচাই, পরিমাপ ও মূল্যায়নে মনোযোগী হতে হবে। এক্ষেত্রে তাদের দায় এড়ানোর কোনো সুযোগ নেই। শ্রেণিকক্ষে কোনো বিষয়ে পাঠদানের পূর্বে ওই বিষয়ে তিনি ভালোমতো জ্ঞানার্জন করবেন। একজন শিক্ষক তার বিশ্লেষণ থেকে শিক্ষাক্রম বিশেষ করে শিক্ষণের বিষয়, শিক্ষণ পদ্ধতি, শিক্ষা উপকরণের কার্যকারিতা মূল্যায়ন করে পাঠের বিষয়বস্তু পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও উত্কর্ষ সাধন করতে পারেন। এক্ষেত্রে শিক্ষার্থীরা পাঠ্যবইয়ের বাইরের অনেক কিছু জানার সুযোগ পাবে।
আধুনিক শিক্ষা-পরিকল্পনা প্রাচ্যে পাশ্চাত্য সাম্রাজ্যবাদের সহায়ক হিসেবে কাজ করছে। এ শিক্ষা নির্বিচারে পাশ্চাত্যের আচার-আচরণ, রীতি-নীতি ও ভাবাদর্শ অনুকরণের প্রেরণা যোগায়, সাথে সাথে উপনিবেশবাদের পথকে প্রশস্ত করে
প্রাচ্যের জনসাধারণের উপর চাপিয়ে দেয় পাশ্চাত্যের দৃষ্টিভঙ্গি, আর সামাজিক ও অর্থনৈতিক অগ্রগতির ছদ্মাবরণে সৃষ্টি করে নতুন নতুন সমস্যা। যুগ-যুগ ধরে প্রচলিত প্রাচ্যের মূল্যবোধ আর ঐতিহ্যকে অবমূল্যায়ণের মাধ্যমে এমন এক সমাজ সৃষ্টি করার প্রয়াস পাচ্ছে যে সমাজ ভাষায়, নামে আর জন্মগতভাবে প্রাচ্যের কিন্তু অন্তরবস্তুতে ও বাস্তবে দেখায় পাশ্চাত্যের।
শিক্ষা ব্যবস্থায় সময়োপযোগী শিক্ষা নিশ্চিত হচ্ছে না এই বক্তব্যের সঙ্গে একমত নই। এক্ষেত্রে সরকারের প্রচেষ্টারও ঘাটতি নেই। তবে শিক্ষা ব্যবস্থাকে আরও বেগবান করার জন্য যথেষ্ট মনিটরিং ও তত্ত্বাবধানের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। এছাড়া, শিক্ষকদের আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে গবেষণামুখী হতে হবে এবং সমসাময়িক বিষয়ে প্রচুর ধারণা থাকতে হবে। একই সঙ্গে সেসব কিছুই শিক্ষার্থীদের সঙ্গে শেয়ার করতে হবে।
যে কোনো জাতির মৌলিক চাহিদার মধ্যে শিক্ষা অন্যতম। তা কোনোক্রমেই গোঁজামিল দিয়ে চলে না। শিক্ষা সেবার মোড়কে রাজনীতির আশ্রয় নিয়ে জাতিকে যে শিক্ষাশূন্যতার দিকে নিক্ষেপ করা হচ্ছে প্রতিনিয়ত। এই দুরারোগ্য মহামারি রোধ করা না গেলে আর যাই হোক বাঙালি জাতি 'শিক্ষিত' নাম ধারণ করেই আর যাই হোক কেউ মহিমান্বিত    হতে পারবেন না .....

হাসিদা মুন