রাহাত মুস্তাফিজ - সাম্প্রতিক বাংলাদেশ

বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে বলা হয় অসাম্প্রদায়িক, সেক্যুলার, জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক দল। এই দলটি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছে। বাহাত্তরে একটি সেক্যুলার সংবিধান প্রণয়ন করতে সক্ষম হয়েছে। ২০০৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে দলটি দেশের মানুষের প্রত্যাশা বাড়িয়ে দেয়। অতঃপর ৭১র মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত প্রভাবশালী চিহ্নিত রাজাকারদের গ্রেফতার করে বিচারের মুখোমুখি করা হলে মানুষের প্রত্যাশা আকাশচুম্বি হয়। ২০১৩ সালে রাজাকার কাদের মোল্লার রায়কে কেন্দ্র করে আশাভঙ্গের সূচনা হয়।ফলশ্রুতিতে রাজধানীর শাহাবাগে সৃষ্টি হয় সতঃস্ফূর্ত জনতার  ঐতিহাসিক গণজাগরণ! যুদ্ধাপরাধের সর্বোচ্চ শাস্তি ফাঁসির দাবীতে শিক্ষিত, সচেতন, মধ্যবিত্ত শ্রেণি ফেটে পড়ে। শাহাবাগের আগুন ছড়িয়ে পড়ে সারাদেশে। এমন একটা পরিস্থিতিতে শাহাবাগের সেক্যুলার স্পিরিটের একদম বিপরীতে অবস্থানকারী শক্তির উত্থান ঘটানো হয় দেশে। ~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~

সাম্প্রতিক বাংলাদেশ
রাহাত মুস্তাফিজ
 
অর্থনীতিসহ অনেক ক্ষেত্রে বাংলাদেশ উন্নতি করেছে। অতি দারিদ্র্য বিমোচন, মাতৃ মৃত্যু, শিশু মৃত্যু হার কমেছে, মানুষের গড় আয়ু বেড়েছে, জেন্ডার বৈষম্য কমেছে, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরে এসেছে, সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীতে উন্নতি, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ছিল, মাথা পিছু আয় বেড়েছে, প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশ থেকে বেড়ে ৭ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর চূড়ান্ত হিসাবে গত অর্থবছর জিডিপি প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৭ দশমিক ১১ শতাংশ। আর গত অর্থবছরে বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু আয় ছিল ১ হাজার ৪৬৫ ডলার। চলতি অর্থবছর শেষে বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু আয় বেড়ে ১ হাজার ৬০২ ডলার হবে বলে প্রাক্কলন করেছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো। সেই সঙ্গে এবার জিডিপি প্রবৃদ্ধি বাজেটের প্রত্যাশা ছাড়িয়ে ৭ দশমিক ২৪ শতাংশ হবে বলে সরকার আশা করছে।

এসবই আশান্বিত হওয়ার মতো খবর। তবে এর পাশাপাশি বেড়েছে খুন, ধর্ষণ, গুম, নারী ও শিশু নির্যাতন। এরমধ্যে দুর্নীতি, লুটপাট, চুরি বরাবরের মতোই বিশেষ স্থান দখল করে আছে। বাংলাদেশের সাম্প্রতিক চিত্র তুলে ধরতে হলে কয়েকটি বিষয়ের অবতারণা করতেই হবে। দুর্নীতি, বাকস্বাধীনতাহরণ, উগ্র সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদী উত্থান বাংলাদেশের অগ্রযাত্রার পথে প্রধান অন্তরায় হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। মাথাপিছু আয়বৃদ্ধি কিংবা প্রবৃদ্ধি শ্রেণিবিভক্ত সমাজের বৈষম্য নিরসনে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না। মোট সম্পদ জমা হচ্ছে গুটিকয় মানুষের হাতে। ধনী গরীবের বিভাজন সর্বোচ্চসীমায় অবস্থান করছে। এই লেখায় মোটাদাগে কয়েকটি বিষয়ে আলোচনা করবো।  

দুর্নীতিঃ

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি)তথ্যমতে  ১৫তম 'দুর্নীতিগ্রস্ত' দেশ হিসেবে বাংলাদেশের নাম উঠে এসেছে। ২০১৬ সালে সূচকের এই তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ১৪৫ তম। বাংলাদেশের পয়েন্ট হচ্ছে ২৬। সূচকের হিসেবে বিশ্বের ১৭৬ দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ১৫ তম 'দুর্নীতিগ্রস্ত' দেশ।  শীর্ষ দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় রয়েছে আফ্রিকান দেশ সোমালিয়া। তাদের পয়েন্ট হচ্ছে ১০।

(সূচকে শূন্য থেকে ১০০ পয়েন্ট ধরে দেশগুলোর অবস্থান নির্ণয় করা হয়েছে। কোনো দেশের পয়েন্ট শূন্য হলে সে দেশটি হবে চূড়ান্ত দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ। আর কোনো দেশের পয়েন্ট ১০০ হলে ওই দেশটি সর্বোচ্চ পরিচ্ছন্ন দেশ হিসেবে স্বীকৃতি পাবে টিআই থেকে।)

দুর্নীতি-লুটপাট অতীতের রেকর্ড অতিক্রম করে গেছে। নির্মাণাধীন বিভিন্ন প্রকল্পব্যয় বিশ্বের যেকোনো দেশের চেয়ে বেশি ধরা হয়েছে। রাস্তাঘাট, ফ্লাইওভার, ব্রিজ, সেতু, রেললাইন নির্মাণ ব্যয়ের দিকে তাকালে চোখ কপালে উঠে যাবার জোগাড়। 

নির্মাণাধীন ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা ৫৫ কিলোমিটারের এই সড়কের নির্মাণ ব্যয় ধরা হয়েছে ৫ হাজার ৯৬২ কোটি ৬০ লাখ টাকা। অর্থাৎ প্রতি কিলোমিটারে ব্যয় হবে ১০৮ কোটি ৪১ লাখ টাকা। যেখানে ইউরোপে একেবারে নতুন চার লেনের মহাসড়ক নির্মাণে খরচ পড়ে কিলোমিটার প্রতি ২৮ কোটি টাকা। অর্থাৎ, বাংলাদেশে সড়কটি উল্লিখিত নির্মাণে কিলোমিটার প্রতি খরচ হবে ইউরোপের তুলনায় প্রায় চারগুণ বেশি টাকা। চীনে কিলোমিটার প্রতি খরচ পড়ে ১৩ কোটি টাকা, বাংলাদেশে যেখানে কিনা খরচ হবে তার থেকে ৮ গুণ বেশি টাকা। ভারতে অনুরূপ সড়ক নির্মাণে খরচ পড়ে ১০ কোটি টাকা, যার চেয়ে প্রায় ১১ গুণ বেশি খরচ করা হবে বাংলাদেশের ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা মহাসড়ক নির্মাণে।

চার লেনের এক কিলোমিটার ফ্লাইওভার নির্মাণ করতে বাংলাদেশে খরচ হচ্ছে গড়ে ১২৩-২৫০ কোটি টাকা। প্রতিবেশী দেশ ভারতে এ দূরত্বের ফ্লাইওভার নির্মাণ করতে খরচ হচ্ছে ৯০ থেকে ১৫০ কোটি টাকা। আর পাকিস্তানে ৬০ থেকে ১১০ কোটি টাকা, মালয়েশিয়ায় ৬০ থেকে ১৩০ কোটি টাকা এবং চীনে ৯০ থেকে ১৩০ কোটি টাকা।

 রেলপথ নির্মাণেও বিশ্বে সবচেয়ে বেশি ব্যয় হচ্ছে বাংলাদেশেই। বিভিন্ন দেশের রেলপথ নির্মাণ ব্যয়ের তথ্য বিশ্লেষণে জানা গেছে, উন্নত দেশগুলোতে প্রতি কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণে গড় ব্যয় হচ্ছে ৩১ কোটি টাকা। বাংলাদেশে সর্বশেষ ঢাকা-পায়রা বন্দর রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পেই প্রতি কিলোমিটারে ব্যয় ধরা হয়েছে ২৫০ কোটি টাকা। ঢাকা থেকে পদ্মা সেতু হয়ে যশোর পর্যন্ত ১৭২ কিলোমিটার রেলপথের প্রতি কিলোমিটারে ব্যয় ধরা হয়েছে ২০৩ কোটি টাকা। চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে বান্দরবানের ঘুনধুম পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণে প্রতি কিলোমিটারে খরচ পড়ছে ১৩৯ কোটি টাকারও বেশি। অথচ ভারতে সাধারণ সিঙ্গেল লাইনের রেলপথ নির্মাণে কিলোমিটারে গড়ে ব্যয় হয় ১২ কোটি টাকা। পাকিস্তানে এই ব্যয় কিলোমিটারে ১৫ কোটি টাকা। চীনে ট্রেন চলাচলের জন্য ঘণ্টায় ২০০ কিলোমিটার গতিবেগের রেলপথ নির্মাণে কিলোমিটারে খরচ হচ্ছে সর্বোচ্চ ৭৫ কোটি  টাকা। আর সাধারণ সিঙ্গেল রেলপথ নির্মাণে কিলোমিটারে খরচ হচ্ছে ১২ কোটি ৫০ লাখ টাকা।

এসব বিষয়ে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের গাফিলতি, ভুল পরিকল্পনা, সময়মতো কাজ শুরু ও শেষ করতে না পারা, দীর্ঘসূত্রতা এবং কার্যকর জবাবদিহিতা না থাকায় খরচ অস্বাভাবিক রকমের বেশি হচ্ছে। এ ছাড়া জমি অধিগ্রহণ, পুনর্বাসন, আইনি ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে প্রকল্প বিলম্বিত হয়, যার ফলে দুর্নীতি হচ্ছে। আর এসব সামগ্রিক অব্যবস্থাপনার কারণে প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে যায়। অর্থাৎ সংশ্লিষ্টদের ভাষ্যমতেই দুর্নীতির বিষয়টি কবুল করে নেওয়া হচ্ছে।

বাকস্বাধীনতাহরণঃ

মানুষের মৌলিক অধিকারগুলোর মধ্যে বাকস্বাধীনতা অন্যতম। পৃথিবীর গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলো নাগরিকের এই অধিকারকে সাংবিধানিকভাবে স্বীকার করে নেয় এবং সে অনুযায়ী রাষ্ট্রকে পরিচালনা করে থাকে।বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদে চিন্তা ও বাকস্বাধীনতার সুস্পষ্ট স্বীকৃতি রয়েছে। সংবিধানের ৩৯ নম্বর অনুচ্ছেদে প্রথমে বলা আছে- চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দান করা হলো।দ্বিতীয়ত বলা আছে, ‘রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, বিদেশী রাষ্ট্রসমূহের সহিত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, জনশৃঙ্খলা, শালীনতা ও নৈতিকতার স্বার্থে কিংবা আদালত অবমাননা, মানহানি বা অপরাধ সংঘটনে প্ররোচনা সম্পর্কে আইনের দ্বারা যুক্তিসঙ্গত বিধি-নিষেধ সাপেক্ষে (ক) প্রত্যেক নাগরিকের বাক ও তার প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকারের এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দান করা হইল।

অথচ পরিতাপের বিষয় হলো দেশে স্বাধীনভাবে কথা বলার অধিকার প্রতি পদে পদে লঙ্ঘিত হচ্ছে।এবং এটা হচ্ছে আইনের বলেই। চিন্তা ও মত প্রকাশের অধিকারহরণকারী এই আইনটি সাম্প্রতিককালে ৫৭ ধারাহিসেবে কুখ্যাতি অর্জন করেছে। কী আছে এই আইনে? আইনটি তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন, যা সংক্ষেপে আইসিটি অ্যাক্টনামে পরিচিত। এটি বিএনপি সরকারের আমলে ২০০৬ সালে প্রণীত হয়। আর এটি ২০১৩ সালে সংশোধিত হলে কার্যত এর ৫৭ নম্বর ধারাটি আরো জোরালো বিতর্কের কেন্দ্রে পরিণত হয়।

কী আছে বিতর্কিত এই ধারাটিতে : ৫৭। ইলেকট্রনিক ফর্মে মিথ্যা, অশ্লীল অথবা মানহানিকর তথ্য প্রকাশ-সংক্রান্ত অপরাধ ও উহার দণ্ড- (১) কোনো ব্যক্তি যদি ইচ্ছাকৃতভাবে ওয়েবসাইট বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক বিন্যাসে এমন কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচার করেন, যাহা মিথ্যা ও অশ্লীল বা সংশ্লিষ্ট অবস্থা বিবেচনায় কেহ পড়িলে, দেখিলে বা শুনিলে নীতিভ্রষ্ট বা অসৎ হইতে উদ্বুদ্ধ হইতে পারেন অথবা যাহার দ্বারা মানহানি ঘটে, আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটে বা ঘটবার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়, রাষ্ট্র বা ব্যক্তির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয় বা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে বা করিতে পারে বা এ ধরনের তথ্যের মাধ্যমে কোনো ব্যক্তি বা সংগঠনের বিরুদ্ধে উসকানি প্রদান করা হয়, তাহা হইলে এই কার্য হইবে একটি অপরাধ।

(২) কোনো ব্যক্তি উপধারা (১) এর অধীন অপরাধ করিলে তিনি অনধিক চৌদ্দ বৎসর এবং অন্যূন সাত বৎসর কারাদণ্ডে দণ্ডিত হইবেন।

২০১৩ সালে আওয়ামী লীগ সরকার এই আইসিটি আইন সংশোধন করে আইনটিকে আরো বিতর্কিত করে তোলে। এ সংশোধনীর মাধ্যমে পুলিশকে আরো ক্ষমতাধর করে সন্দেহভাজন যে কাউকে বিনা পরোয়ানায় গ্রেফতার ও মামলা দায়েরের ক্ষমতা দেয়া হয়। সেই সাথে এই আইনের আওতায় অপরাধকে জামিনের অযোগ্য অপরাধ করা হয়। এর মাধ্যমে আইনটির অপব্যবহারের সুযোগ আরো অবারিত করা হয়। শুধু তাই নয়, এ সংশোধনীর মাধ্যমে ২০০৬ সালে প্রণীত মূল আইনে যেখানে ৫৭ ধারার অধীন অপরাধের জন্য সর্বোচ্চ ১০ বছর কারাদণ্ডের শাস্তির ব্যবস্থা ছিল, সংশোধনীর মাধ্যমে তা করা হয়েছে সর্বোচ্চ ১৪ বছর ও সর্বনিম্ন সাত বছর। একই সাথে এক কোটি টাকার অর্থদণ্ড দেয়ার বিধানও আছে। বললে ভুল হবে না, এই আইনে যেকোনো নাগরিক বা সরকারবিরোধী ভিন্ন মতাবলম্বী ব্যক্তিকে লঘুপাপে গুরুদণ্ডে দণ্ডিত হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে এবং কার্যত এই আইনের যথেচ্ছ চর্চা নিরীহ মানুষের কাছে আতঙ্কে পরিণত হয়েছে।  

৫৭ ধারার একটি বড় সমালোচনা হচ্ছে, এটি সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক। ভারতের আইসিটি আইনে অনুরূপ একটি ধারা ছিল, আইনের ৬৬ নম্বর ধারা। ভারতের সুপ্রিম কোর্ট এই ৬৬ নম্বর ধারাকে অসাংবিধানিক আখ্যায়িত করে বাতিল করে দিয়েছেন। কিন্তু আমাদের সরকার আইসিটি আইনের ৫৭ ধারার ব্যাপারে এতোকাল  লা-জওয়াব থাকলেও ইদানিং মুখ খুলতে শুরু করেছে। অবশ্য এর পেছনে কারণ রয়েছে।এ সম্পর্কে পরে বলছি।

সিনিয়র আইনজীবী ড. কামাল হোসেন ৫৭ ধারা প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘আমাদের সংবিধান যেসব মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করেছে, এর মধ্যে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা অন্যতম। সংবাদপত্রের অধিকারসহ অনেকগুলো ব্যাপারে আইসিটি আইনের ৫৭ ধারা চরম হুমকি হিসেবে কাজ করছে। আশা করি, সরকার জনমতের চাপে আইনটি এবার সংশোধন করবে। আর আমাদের আইনি লড়াইও চলবে।

আইসিটি আইনের একটি বড় সমালোচনা হচ্ছে, এটি বাকস্বাধীনতার পরিপন্থী।এ প্রসঙ্গে সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক বলেছেন- আমি মনে করি আইসিটি আইনের ৫৭ ধারাটি পুরোপুরি অসাংবিধানিক। অসাংবিধানিক দুটি কারণে। একটি হলো, সংবিধানের ৩১, ৩৩ ও ৩৫ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী একটি অপরাধ স্বচ্ছ ও স্পষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এ ক্ষেত্রে এই বাধ্যবাধকতার বরখেলাপ হয়েছে। আর দ্বিতীয়টি হলো, ধারাটি সংবিধানের ৩৯ নম্বর অনুচ্ছেদে বর্ণিত বাকস্বাধীনতা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে অযৌক্তিকভাবে বাধাগ্রস্ত করছে। এ দুটো কারণে ৫৭ ধারা অসাংবিধানিক।

ইতোমধ্যে ৫৭ ধারার কোপে পড়ে সামাজিকভাবে হয়রাণীর শিকার হয়েছে দেশের প্রথিতযশা বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, আইনজীবী, অধ্যাপক, লেখক-ব্লগার, রাজনৈতিক কর্মীসহ সাধারণ মানুষ। অবস্থা এমন মহামারি আকার ধারণ করেছে যে, যে কেউ যখন ইচ্ছে তখন প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার উদ্দেশ্যে এই ধারায় মামলা ঠুকে দিচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শুরু থেকেই এই আইনের অপপ্রয়োগের আশঙ্কা করে বিস্তর লেখালেখি হয়েছে। কলাম লেখকদের পাশাপাশি ব্লগাররা আইনটির চুলচেরা বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছে আইনটি আসলে মত প্রকাশের স্বাধীনতার পথে অন্তরায়।আইনটিকে অবিলম্বে বাতিল করার দাবী জানানো হচ্ছে সেই ২০১৩ সাল থেকেই। পরবর্তীতে দেখা গেলো সত্যি সত্যি আইনটি বাকস্বাধীনতার টুঁটি চেপে ধরার কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে। ধর্মান্ধ মৌলবাদীদের দাবীর মুখে তাঁদেরকে ম্যানেইজ করার স্বার্থে ধর্মানুভূতিতে আঘাত এর ঠুনকো অভিযোগে একের পর এক ব্লগারদের গ্রেফতার করে জেল-হাজতে ঢুকানো শুরু হলো। তখনো অধিকাংশ মানুষ ধারণা করতে পারেনি ৫৭ ধারার ছোবল কী বিষময় হতে পারে। ধর্মানুভূতির কথিত অভিযোগের পর্ব পেরিয়ে এই ধারা প্রয়োগের লক্ষ্যে কায়েমী স্বার্থবাদীদের মানহানী’  হওয়া শুরু হলো, সাম্প্রদায়িক উসকানির অভিযোগ আনা হলো। ফলে ভিন্নমতের লোকদের দমন করার অভিপ্রায়ে একের পর এক মামলায় ফাঁসানো শুরু হলো। এই ধারাটি বর্তমানে চরম নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। অবশেষে জনমতের চাপে পড়ে বর্তমানে সরকারের সুর কিছুটা নরম হতে দেখা যাচ্ছে।কতিপয় মন্ত্রী আইনটি সংশোধন,বাতিল করার কথা বলছেন। তবে আশঙ্কার কথা নতুন বোতলে পুরনো মদের মতো ভিন্ন নামে, ভিন্ন আইনে উল্লেখিত কুখ্যাত ৫৭ ধারাকে বহাল রাখার চক্রান্ত চলছে। এ ব্যাপারে সবার সতর্ক থাকা প্রয়োজন। 
      
উগ্র সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদী উত্থানঃ 

বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে বলা হয় অসাম্প্রদায়িক, সেক্যুলার, জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক দল। এই বলাতে আপাতদৃষ্টিতে কোনো ভুল চোখে পড়ে না। কারণ এই দলটি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছে। বাহাত্তরে একটি সেক্যুলার সংবিধান প্রণয়ন করতে সক্ষম হয়েছে। ধর্মভিত্তিক রাজনীতির পথ সাংবিধানিকভাবে বন্ধ করেছে।২০০৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে দলটি দেশের মানুষের প্রত্যাশা বাড়িয়ে দেয়। অতঃপর ৭১র মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত প্রভাবশালী চিহ্নিত রাজাকারদের গ্রেফতার করে বিচারের মুখোমুখি করা হলে মানুষের প্রত্যাশা আকাশচুম্বি হয়। তবে প্রত্যাশার বেলুন ফুটো হয়ে যেতেও সময় লাগেনি। ২০১৩ সালে রাজাকার কাদের মোল্লার রায়কে কেন্দ্র করে আশাভঙ্গের সূচনা হয়।ফলশ্রুতিতে রাজধানীর শাহাবাগে সৃষ্টি হয় সতঃস্ফূর্ত জনতার  ঐতিহাসিক গণজাগরণ! যুদ্ধাপরাধের (মানবতাবিরোধী অপরাধের) সর্বোচ্চ শাস্তি ফাঁসির দাবীতে শিক্ষিত, সচেতন, মধ্যবিত্ত শ্রেণি ফেটে পড়ে। শাহাবাগের আগুন ছড়িয়ে পড়ে সারাদেশে। এমন একটা পরিস্থিতিতে শাহাবাগের সেক্যুলার স্পিরিটের একদম বিপরীতে অবস্থানকারী শক্তির উত্থান ঘটানো হয় দেশে। এই শক্তি ইসলামকে হেফাজত করার কথা বলে। এর নাম হেফাজতে ইসলাম। রাজনীতির নতুন খেলায় দাবার ঘুটি হিসেবে এঁরা রাজধানীর মতিঝিলের শাপলা চত্বরে এসে জড়ো হয়। শুরু হয় এদেশের কুৎসিত রাজনীতির নতুন অধ্যায়। ধর্মান্ধ, সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী হেফাজতের দৃশ্যমান জনভিত্তিদেখে ক্ষমতালিপ্সু প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর লালায়িত জিভ লোভে চকচক করে ওঠে।যেকোনো মূল্যে এঁদেরকে পাশে পাওয়া ও বশে রাখা প্রধান কর্তব্য হিসেবে স্থির হয়। ক্ষমতাসীনেরা এঁদের সাথে আপসরফা করতে মনস্থির করে। এরকম প্রেক্ষাপটে হেফাজতে ইসলাম তাঁদের বহুল আলোচিত সমালোচিত ১৩ দফা দাবী জনসম্মুখে হাজির করে। কী আছে হেফাজতের ১৩ দফায়?       

হেফাজতের ১৩ দাবি

দাবিগুলো হলো:
১. সংবিধানে আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাসপুনঃস্থাপন এবং কোরআন-সুন্নাহবিরোধী সব আইন বাতিল করা।
২. আল্লাহ্, রাসুল (সা.) ও ইসলাম ধর্মের অবমাননা এবং মুসলমানদের বিরুদ্ধে কুৎসা রোধে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান রেখে জাতীয় সংসদে আইন পাস।
৩. কথিত শাহবাগি আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী স্বঘোষিত নাস্তিক-মুরতাদ এবং প্রিয় নবী (সা.)-এর শানে জঘন্য কুৎসা রটনাকারী ব্লগার ও ইসলামবিদ্বেষীদের সব অপপ্রচার বন্ধসহ কঠোর শাস্তিদানের ব্যবস্থা করা।
৪. ব্যক্তি ও বাকস্বাধীনতার নামে সব বেহায়াপনা, অনাচার, ব্যভিচার, প্রকাশ্যে নারী-পুরুষের অবাধ বিচরণ, মোমবাতি প্রজ্বালনসহ সব বিজাতীয় সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ বন্ধ করা।
৫. ইসলামবিরোধী নারীনীতি, ধর্মহীন শিক্ষানীতি বাতিল করে শিক্ষার প্রাথমিক স্তর থেকে উচ্চমাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত ইসলাম ধর্মীয় শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করা।
৬. সরকারিভাবে কাদিয়ানিদের অমুসলিম ঘোষণা এবং তাদের প্রচারণা ও ষড়যন্ত্রমূলক সব অপতৎপরতা বন্ধ করা।
৭. মসজিদের নগর ঢাকাকে মূর্তির নগরে রূপান্তর এবং দেশব্যাপী রাস্তার মোড়ে ও কলেজ-ভার্সিটিতে ভাস্কর্যের নামে মূর্তি স্থাপন বন্ধ করা।
৮. জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমসহ দেশের সব মসজিদে মুসল্লিদের নির্বিঘ্নে নামাজ আদায়ে বাধাবিপত্তি ও প্রতিবন্ধকতা অপসারণ এবং ওয়াজ-নসিহত ও ধর্মীয় কার্যকলাপে বাধাদান বন্ধ করা।
৯. রেডিও-টেলিভিশনসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে দাড়ি-টুপি ও ইসলামি কৃষ্টি-কালচার নিয়ে হাসিঠাট্টা এবং নাটক-সিনেমায় নেতিবাচক চরিত্রে ধর্মীয় লেবাস-পোশাক পরিয়ে অভিনয়ের মাধ্যমে তরুণ প্রজন্মের মনে ইসলামের প্রতি বিদ্বেষমূলক মনোভাব সৃষ্টির অপপ্রয়াস বন্ধ করা।
১০. পার্বত্য চট্টগ্রামসহ দেশব্যাপী ইসলামবিরোধী কর্মকাণ্ডে জড়িত এনজিও এবং খ্রিস্টান মিশনারিগুলোর ধর্মান্তকরণসহ সব অপতৎপরতা বন্ধ করা।
১১. রাসুলপ্রেমিক প্রতিবাদী আলেম-ওলামা, মাদ্রাসার ছাত্র ও তৌহিদি জনতার ওপর হামলা, দমন-পীড়ন, নির্বিচার গুলিবর্ষণ এবং গণহত্যা বন্ধ করা।
১২. সারা দেশের কওমি মাদ্রাসার ছাত্র-শিক্ষক, ওলামা-মাশায়েখ ও মসজিদের ইমাম-খতিবকে হুমকি-ধমকি, ভয়ভীতি দানসহ তাদের বিরুদ্ধে সব ষড়যন্ত্র বন্ধ করা।
১৩. অবিলম্বে গ্রেপ্তারকৃত সব আলেম-ওলামা, মাদ্রাসাছাত্র ও তৌহিদি জনতাকে মুক্তিদান, দায়ের করা সব মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার এবং আহত ও নিহত ব্যক্তিদের ক্ষতিপূরণসহ দুষ্কৃতকারীদের বিচারের আওতায় এনে কঠোর শাস্তি দিতে হবে।

হেফাজতের উপরোক্ত দাবীগুলো পাঠ করলে আমরা অনুধাবন করতে পারি তাঁরা কেমন বাংলাদেশ দেখতে চায়। তাঁদের কাঙ্ক্ষিত বাংলাদেশের সাথে সেক্যুলার বাংলাদেশের অবস্থান সর্বৈব সাংঘর্ষিক। অরাজনৈতিক তকমাধারী সংগঠনটি উক্ত ১৩ দফা নিছক দেওয়ার জন্য দেয়নি। ইতোমধ্যে ক্ষমতাসীন সরকারের কাছ থেকে দাবী পূরণের সবুজ সংকেত তাঁরা পেয়েছে। পরবর্তীতে আমরা বিস্ময়ের সাথে লক্ষ্য করেছি ধর্মানুভূতিতে আঘাতের অভিযোগ তুলে ব্লগারদের গ্রেফতার করা হয়েছে যা কী না ছিল হেফাজতের ১৩ দফা দাবীর অংশ। কেবল তা-ই নয়, সবিস্ময়ে আমরা আরো লক্ষ্য করেছি রেলের ৩২ কোটি টাকা মূল্যের খাস জমি সরকারের তরফ থেকে হেফাজতকে দান করা হয়েছে। সরকারের সাথে হেফাজতের বোঝাপড়া এখানেই থেমে থাকেনি, এর বিস্তার ঘটে চলেছে অদ্যাবধি। সবচেয়ে ভয়ংকর ও বিপর্যয়কর মৌলিক ঘটনাটি ঘটেছে এ বছর পাঠ্যপুস্তক পরিবর্তনের মধ্যদিয়ে। বলাবাহুল্য হেফাজতে ইসলামের প্রেসক্রিপশন অনুসারেই পাঠ্যপুস্তক পরিবর্তিত হয়েছে।

প্রথম শ্রেণি থেকে নবম শ্রেণি পর্যন্ত বাংলা বই থেকে কয়েকজন প্রখ্যাত লেখকের লেখা বাদ দেয়া হয়েছে।যার মধ্যে পঞ্চম শ্রেণির বাংলা বইয়ে গোলাম মোস্তফার 'প্রার্থনা', একই শ্রেণির বাংলা বইয়ে হুমায়ুন আজাদের 'বই' কবিতা, ষষ্ঠ শ্রেণির বাংলা চারুপাঠ থেকে এস ওয়াজেদ আলীর 'রাঁচি ভ্রমণ', সানাউল হকের কবিতা 'সভা', আনন্দপাঠ থেকে বাদ পড়েছে সত্যেন সেনের গল্প 'লাল গরুটা', একই বই থেকে শরৎচন্দ্রের গল্প 'লালুএবং উপেন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরীর 'রামায়ন কাহিনী' বাদ দেয়া হয়েছে।আর অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে দ্বিতীয় শ্রেণির পাঠ্য বইয়ে 'সবাই মিলে করি কাজ', তৃতীয় শ্রেণিতে 'খলিফা হযরত আবু বকর (রা.)', চতুর্থ শ্রেণিতে 'খলিফা হযরত ওমর (রা.)', পঞ্চম শ্রেণিতে 'বিদায় হজ' 'শহীদ তিতুমীর', ষষ্ঠ শ্রেণিতে সৈয়দ মুজতবা আলীর 'নীল নদ ও পিরামিডের দেশ', জসিম উদ্দিনের 'আসমানী' কবিতা, মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর 'সততার পুরস্কার', সপ্তম শ্রেণির বাংলা বইতে হাবিবুল্লাহ বাহারের 'মরুভাস্কর', কায়কোবাদের 'প্রার্থনা', কালিদাস রায়ের 'বাবরের মহত্ব' এবং শাহ মুহাম্মদ সগীরের 'বন্দনা'

হেফাজতে ইসলামের সুপারিশক্রমে পাঠ্যপুস্তকে এসব অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে অথচ নতুনভাবে অন্তর্ভুক্ত অধিকাংশ বিষয়ই ধর্মশিক্ষা বইতে রয়েছে।সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিস্ট গোষ্ঠীকে দেওয়া এজাতীয় প্রণোদনা ও আশকারা মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত বাংলাদেশ রাষ্ট্রের মৌলিক ভিত্তি ধ্বংসের ষড়যন্ত্র বৈ কিছু নয়।  
রাহাত মুস্তাফিজ