প্রাবন্ধিক রবির রশ্মিছটায় * শুভ্র ভট্টাচার্য্য

আলোকিত রবির অনালোকিত তত্ত্বকথায় শিবানী দেখিয়েছেন রবীন্দ্রনাথের মতে মূলধন ও মজুরীর মধ্যে অতিরিক্ত প্রভেদ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে ব্যর্থ করতে বাধ্য। এবং সমবায় প্রণালীতে অধিকাংশই যখন তাঁদের সম্মিলিত শক্তিকে ধনে পরিণত করতে সফল হবে তখনই সার্বিক উন্নতি সম্ভব। সম্ভব সর্বমানবের স্বাধীনতার ভিত্তিকে প্রতিষ্ঠিত করা। আর সমাজের অভ্যন্তরের ধন বৈষম্যের মধ্যে এই সামঞ্জস্য প্রতিষ্ঠা করাই নতুন যুগের বাণী। রবীন্দ্র চেতনায় ও কর্ম প্রয়াসে সমবায়ের নীতির বিভিন্ন দিকগুলকিকে ছুঁয়ে গিয়েছেন শিবানী তাঁর সমবায়ের আলো আঁধারে রবীন্দ্রনাথশীর্ষক নিবন্ধে। তবুও বলতে হয়, রবীন্দ্রনাথের পরে দেশীয় অর্থনীতিতে সমবায় প্রথার সাফল্য কতটা এবং এই বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের কর্ম প্রয়াসের সুফল সামাজিক অর্থনীতিতে আজও কি আদৌ কার্যকরী আছে, বা থাকলে তা কতটুকু ও কি রকম; সেই বিষয়টিও যদি শিবানী তাঁর আলোচনায় অন্তর্ভুকক্ত করতেন তাহলে আরও ভালো হতো।~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~

প্রাবন্ধিক রবির রশ্মিছটায়
শুভ্র ভট্টাচার্য্য

বাংলা সাহিত্যপ্রেমীদের মধ্যে প্রবন্ধ সাহিত্যের প্রতি অনুরাগ ও আগ্রহ বড়ো একটা দেখা যায় না। বাঙালি গল্প উপন্যাস যত পড়ে, কবিতা নাটকের বই সেই তুলনায় কম পড়ে। কিন্তু আরও কম পড়ে প্রবন্ধ সাহিত্য। তাই বাংলা সাহিত্যধারায় প্রবন্ধ সাহিত্য আজও অনাদরে অবহেলায় কালাতিপাত করে। বাংলাসাহিত্যের পঠন পাঠনে যুক্ত ছাত্রছাত্রী অধ্যাপকমণ্ডলীর বাইরে এই সাহিত্যের চলাচল খুব বেশি  নয়। এই সীমিত পরিসরে কোন সাহিত্যই বিশেষ সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে না। তাই বিশ্বসাহিত্যের অঙ্গনে বাংলা প্রবন্ধ সাহিত্য খুব যে একটা বিশেষ স্থান করে নিতে পেরেছে নিজ বৈশিষ্টের জোরে, একথা খুব একটা জোর দিয়ে বলা যায় না। তবু সেই প্রবন্ধ সাহিত্যকে যাঁরা নিজ উদ্যোগে নিজ প্রতিভায় পুষ্ট করে সাবালক করে তোলার জন্যে নিরলস সাধনা করে গিয়েছেন, তাঁদের মধ্যে পুরোধা স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথের সার্ধজন্মশতবর্ষ অতিক্রান্ত কালপ্রবাহেও তাঁর প্রতিভার অন্যান্য দিক নিয়ে আলাপ আলোচনা যত, রবীন্দ্র প্রবন্ধ সাহিত্য নিয়ে ব্যস্ততা ততটা নয়। তার কারণ নিহিত আমাদের মানসিকতার সীমাবদ্ধতায়। প্রবন্ধসাহিত্যকে আমরা পড়াশুনা সংক্রান্ত ডিগ্রী অর্জনের প্রয়োজনের বাইরে খুব একটা গ্রহণ করিনি। তাই রবীন্দ্র প্রবন্ধসাহিত্যের অতলাম্ত দিগন্ত বেশিরভাগ সময়েই দুই মলাটের মধ্যেই অবরুদ্ধ থেকে যায়।

তবু এই পরিস্থিতিতেও কিছু মানুষ ঠিকই নিজ নিজ উদ্যোগে প্রবন্ধ সাহিত্যের চর্চা করে চলেছেন। চলেছেন বাংলা সাহিত্যের এই স্বল্পালোকিত অঞ্চলে নিরলস সাধনা করে। ডঃ শিবানী পাণ্ডে সেই রকমই একজন ব্যতিক্রমী ব্যক্তিত্ব, যিনি রবীন্দ্র প্রবন্ধ সাহিত্যে কবি প্রতিভার দিগন্ত ও তার প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে বিভিন্ন সময়ে ভাবনা চিন্তা করে চলেছেন। সেই সকল ভাবনা চিন্তার ক্রমিক ফসল সইপ্রকাশিত তাঁর নবতম উদ্যোগ আলোকিত রবির অনালোকিত তত্ত্বকথাসইএর সর্বাঙ্গ সুশোভিত এই নিবেদনে ডঃ পাণ্ডে রবীন্দ্র প্রবন্ধ সাহিত্যের কয়েকটি বিশেষ বিষয় নিয়ে তার উপর আলোকপাতে প্রয়াসী হয়েছেন। শ্রীমতি পাণ্ডে বলেছেন তাঁর ধারণার কথা, রবীন্দ্র প্রবন্ধ বিষয়ক আলোচনা খুব বেশি একটা বাংলা সাহিত্যে হয়ে ওঠেনি। আর তাই সেই অসাধ্য সাধনে ব্রতী হয়েছেন তিনি নিজেই। বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী রবীন্দ্রনাথের প্রাসঙ্গিকতা শুধু যে কেবলমাত্র সাহিত্য সংস্কৃতির ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ নয়, বর্তমানের এই আধুনিক জগৎ জীবনের পক্ষেও তিনি তাঁর চিন্তা ভাবনা দূরদৃষ্টি নিয়ে আজও যে কতটা প্রাসঙ্গিক সেই বিষয়টি রবীন্দ্র প্রবন্ধ সাহিত্যে কিভাবে আধারিত হয়েছে, সেই সত্যই নতুনভাবে পাঠক মহলে অবগত করতে প্রয়াসী হয়েছেন শিবানী।

নাতিদীর্ঘ মোট ছয়টি নিবন্ধে তাঁর এই প্রচেষ্টাকে বিধৃত করেছেন শ্রীমতি পাণ্ডে। প্রথমেই রবীন্দ্র প্রতিভার প্রেক্ষাপটটিকে বড়ো মনগ্রাহী করে পাঠকের বোধের আঙ্গিনায় হাজির করেছেন তাঁর প্রথম নিবন্ধ ঠাকুরবাড়ির আঙিনায় আধুনিকতার সূ্র্যশীর্ষক লেখাটিতে।

মূলত প্রিন্স দ্বারকানাথ ও মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের হাত ধরে বাঙালি সমাজে ঠাকুর বাড়ি যেন একটি সাংস্কৃতিক বিপ্লবকেই মূ্র্ত করে তুলেছিল বঙ্গ সংস্কৃতির নবজাগরণের সেই ঊষালগ্নেই। সেই প্রেক্ষাপটেই বেড়ে ওঠেন রবীন্দ্রনাথ। গড়ে উঠতে থাকে রবীন্দ্র প্রতিভার কৈশোর যৌবন। শিবানী পাণ্ডে তাঁর লেখায় জোর দিয়েছেন মূলত ঠাকুরবাড়ির পারিবারিক সংস্কৃতির কেন্দ্রভূমিতে আধুনিকতার যে শিকড়টি অস্থিমজ্জায় জড়িয়ে ছিল সেইটির ওপরই। যে আধুনিকতার আলোয় তৎকালীন বঙ্গসংস্কৃতিতে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠেছিল নতুন ভোরের আলোর উদ্ভাসন। সমস্ত রকম সমাজিক বিরুদ্ধতার জড়বাদী তামসিকতার মধ্যেও। আর তারই সুফল ফলে চলেছে আজকের বঙ্গসংস্কৃতির সজীবতায়। বিশেষ করে রবীন্দ্র প্রতিভার বিকাশের পক্ষে আধুনিকতার সেই প্রেক্ষাপট কতটা জরুরী ছিল, শিবানী তার লেখায় সেই দিকটিই বিশেষ করে বিধৃত করতে প্রয়াসী হয়েছেন।

ঠাকুরবাড়ির আধুনিকতার আর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল স্ত্রী শিক্ষার বিস্তার। নারী প্রতিভার স্বাভাবিক প্রকাশ এবং জড়বাদী কুসংস্কারগুলি থেকে মুক্তির প্রতিভাস। শিবানী তাঁর লেখায় এই দিকগুলি নিয়ে সংক্ষেপে অথচ অব্যর্থ আলোকপাত করেছেন তাঁর সুললিত গদ্যে।

সমবায় নীতি পুস্তিকার ভূমিকায় রবীন্দ্রনাথ বলেন, “আজ যাঁহারা জীবধাত্রী পল্লিভূমির রিক্তস্তনে স্তন্যসঞ্চার করিবার ব্রত লইয়াছেন, তাঁহার নিরানন্দ অন্ধকার ঘরে আলো আনিবার জন্যে প্রদীপ জ্বালিতেছেন, মঙ্গলদাতা বিধাতা তাঁহাদের প্রতি প্রসন্ন হউন, ত্যাগের দ্বারা, তপস্যার দ্বারা, পরস্পর মৈত্রী বন্ধন দ্বারা, বিক্ষিপ্ত শক্তির একত্র সমবায় দ্বারা ভারতবাসীর বহুদিন সঞ্চিত মূঢ়তা ও ঔদাসীন্য জনিত অপরাধরাশির সঙ্গে সঙ্গে রুষ্ট দেবতার অভিশাপকে সেই সাধকের দেশ হইতে তিরস্কৃত করুন এই আমি একান্ত মনে কামনা করি।“ (১৯২৮) রবীন্দ্র প্রতিভার বিস্ময়কর আলোকেও তাঁর কর্ম সাধনার এই একান্ত মৌলিক দিকটি এ যাবৎ বিশেষ আলোচিত হয়নি সাধারণ পাঠকের দরবারে। দেশের অর্থনীতিতে সমবায় প্রথার গুরুত্ব এবং সেই প্রথার সুষ্ঠ ও বৈজ্ঞানিক প্রয়োগের সার্থকতায় সমাজ জীবনে এক ক্রমিক বৈপ্লবিক যুগান্তর আনা যে সম্ভব সে কথা রবীন্দ্রনাথ শুধু যে আজীবন বিশ্বাসই করে এসেছিলেন কিংবা প্রচার করে গিয়েছেন তা নয়। সুরুলের শ্রীনিকেতনের কর্ম প্রয়াসের মধ্যেও তাঁর সেই বিশ্বাসগুলিকেই রূপ দিতে প্রয়াসী হয়েছিলেন। সেই দিকগুলিকেই তুলে ধরে শিবানী বলেছেন, ‘প্রকৃতপক্ষে রবীন্দ্রনাথ এমনভাবে ভারতবর্ষকে দেখতে চেয়েছিলেন, অর্থনীতির ক্ষেত্রে যাতে ভারতবর্ষের গ্রামগুলিই হবে উৎপাদনের কেন্দ্র। লিওনার্ড ইলম হার্স্টকে নিয়ে এসে গড়ে তুলেছিলেন ইনস্টিটিউট ফর রুরাল রিকনস্ট্রাকশান। শান্তিনিকেতনের অদূরে সুরুলে।

শিবানী দেখিয়েছেন রবীন্দ্রনাথের মতে মূলধন ও মজুরীর মধ্যে অতিরিক্ত প্রভেদ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে ব্যর্থ করতে বাধ্য। এবং সমবায় প্রণালীতে অধিকাংশই যখন তাঁদের সম্মিলিত শক্তিকে ধনে পরিণত করতে সফল হবে তখনই সার্বিক উন্নতি সম্ভব। সম্ভব সর্বমানবের স্বাধীনতার ভিত্তিকে প্রতিষ্ঠিত করা। আর সমাজের অভ্যন্তরের ধন বৈষম্যের মধ্যে এই সামঞ্জস্য প্রতিষ্ঠা করাই নতুন যুগের বাণী। রবীন্দ্র চেতনায় ও কর্ম প্রয়াসে সমবায়ের নীতির বিভিন্ন দিকগুলকিকে ছুঁয়ে গিয়েছেন শিবানী তাঁর সমবায়ের আলো আঁধারে রবীন্দ্রনাথশীর্ষক নিবন্ধে। তবুও বলতে হয়, রবীন্দ্রনাথের পরে দেশীয় অর্থনীতিতে সমবায় প্রথার সাফল্য কতটা এবং এই বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের কর্ম প্রয়াসের সুফল সামাজিক অর্থনীতিতে আজও কি আদৌ কার্যকরী আছে, বা থাকলে তা কতটুকু ও কি রকম; সেই বিষয়টিও যদি শিবানী তাঁর আলোচনায় অন্তর্ভুকক্ত করতেন তাহলে আরও ভালো হতো।

শিক্ষা সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথের সুবিস্তৃত ভাবনা চিন্তার এবং জীবনব্যাপি কর্ম সাধনার মূল সুরটি পাওয়া যায় তাঁর শিক্ষার সাঙ্গীকরণপ্রবন্ধে। সেখানে তিনি স্পষ্ট করে বলেছেন, “শিক্ষা সম্বন্ধে সবচেয়ে সীকৃত এবং সবচেয়ে উপেক্ষিত কথাটা এই যে, শিক্ষা জিনিসটা জৈব ওটা যান্ত্রিক নয়। এর সম্বন্ধে কার্য প্রণালীর প্রসঙ্গ পরে আসতে পারে, কিন্তু প্রাণক্রিয়ার প্রসঙ্গ সর্বাগ্রেতাঁর রবি চেতনায় শিক্ষার নবীকরণনিবন্ধে শিবানী রবি ঠাকুরের শিক্ষা বিষয়ক প্রবন্ধগুলির সারাৎসার এবং বিশ্বভারতীর কর্মদ্যোগের ভিতর দিয়ে রবীন্দ্রমানসের শিক্ষা বিষয়ক ব্যাপ্তির দিগন্তকে তুলে ধরতে প্রয়াসী হয়েছেন।

রবীন্দ্রনাথ বুঝেছিলেন ইংরেজ প্রবর্তিত শিক্ষা ব্যবস্থার উদ্দেশ্য উন্নত পরিপূর্ণ স্বাধীন মনুষ্যত্বে উদ্বোধিত মানুষ গড়া নয়। সে উদ্দেশ্য সাম্রাজ্য পরিচালনে প্রশাসনিক কর্মদক্ষ কিছু কার্যকরী রাজসেবক তৈরীর। চাকুরির উমেদারিতে নিয়োজিত থেকে যাঁরা দেশের হিতসাধন ও উন্নতির দিকে পিছন ফিরে থাকবে এবং রাজশক্তির গোলামীতে সততার সাথে জীবন অতিবাহিত করবে। এই শিক্ষা ব্যবস্থার বিরুদ্ধে তাঁর সমগ্র জীবনের সাধনা। রবীন্দ্র প্রতিভার এই দিকটি শিবানী তাঁর নিবন্ধে বিশেষ করে আলোকিত করতে প্রয়াসী হয়েছেন। তাই তাঁর ধন্যবাদ প্রাপ্য। প্রকৃতির সঙ্গে জীবনের সঙ্গে পূর্ণ যোগাযোগের আনন্দে পরিপূর্ণ মনুষ্যত্বের শিক্ষার ওপর জোর দিয়ে গিয়েছেন তিনি আজীবন। শিবানী তাঁর লেখায় সেই ইতিহাসই ছুঁয়ে গিয়েছেন।

সকল প্রকার মূঢ়তার বিরুদ্ধে শিক্ষাই হলো একমাত্র অস্ত্র। একমাত্র পথ। যা মানুষকে সকল প্রকার ভেদাভেদ থেকে সংকীর্ণতা থেকে ক্ষুদ্রতা থেকে মুক্তি দিতে পারে। যে আলোতে সর্ব দেশের সর্ব ধর্মের মানুষ পরস্পরের সঙ্গে আপন আপন সংস্কৃতির আদান প্রদানে বিশ্ব মানবতায় পৌঁছাতে পারে। বিশ্বমানবতার পূজারী রবীন্দ্রনাথের শিক্ষা চিন্তার এই দিকটিও তুলে ধরেছেন শিবানী। যথেষ্ট অব্যর্থ ভাবে।

রবীন্দ্রনীতিতে রাজনীতিপ্রবন্ধে শিবানী দেখিয়েছেন রবীন্দ্রনাথের রাজনৈতিক চিন্তাভাবনার স্বরূপ। সন্ধান করেছেন তাঁর রাজনৈতিক প্রজ্ঞার মূল সুরটিকে। রবীন্দ্রসাহিত্যের বিস্তৃত অঙ্গনে তাঁর গল্প উপন্যাস বিশেষত নাটকগুলিতে এবং প্রবন্ধ সহিত্যের বিশাল ভান্ডারে রবীন্দ্রনাথের রাজনৈতিক প্রজ্ঞার চিত্রগুলি সুস্পষ্ট করে অনুভূত হয়। শিবানীর সন্ধান মূলত প্রবন্ধগুলির মধ্যে রবীন্দ্রনাথের রাজনৈতিক চেতনার ক্রম উদ্ভাসন। তবুও তিনি সাহিত্যের অন্যান্য দিকগুলকিও ছুঁযে গিয়েছেন সংক্ষেপে। তুলে ধরেছেন রবীন্দ্র চিন্তায় স্বদেশী সমাজ গঠনের গুরুত্বের বিষয়টিও।

মানবপ্রেমী বিশ্বমানবতার কবি রবীন্দ্রনাথের রাজনৈতিক মতাদর্শ, সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদের গণ্ডীতে আটকে থাকেনি কোনদিনই। এবং আজীবন তিনি দ্ব্যর্থহীনভাবে এই সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে নিজের মত প্রচার করে গিয়েছেন। উদ্বুদ্ধ করতে প্রয়াসী হয়েছিলেন সারা বিশ্বের মানবকে। তাঁর ন্যাশানালিজম প্রবন্ধমালা এই প্রসঙ্গে স্মরণযোগ্য। আবার ঠিক এই মতবাদের কারণেই তাঁকে আমেরিকা ও জাপানের সাম্রাজ্যবাদী জাতীয়তাবাদের রোষানলেও পড়তে হয়। শিবানী তাঁর প্রবন্ধে এই দিকটি আলোচনা করলে বিষয়টি পাঠকের কাছে স্পষ্টতর হয়ে উঠতো। তাছাড়া সভ্যতার সঙ্কটএ রবীন্দ্রনাথের চেতনা ও অভিজ্ঞতার দ্বান্দ্বিক ক্রমপরিণতির চিত্রটি বাদ দিয়ে কবির  রাজনৈতিক প্রজ্ঞার চিত্র সম্পূর্ণ হয়ও না হয়তো।

সর্বদেশেই সর্বকালেই সাহিত্যের যে সার্বভৌমিক ফুল ফোটে, সে ফুল রস সঞ্চয় করে তার স্থানীয় লোকসাহিত্যের শিকড় থেকেই। তাই যে কোন সাহিত্যই মূলত দাঁড়িয়ে থাকে তার লোকসাহিত্যের সমৃদ্ধ ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকারের উপরেই। লোকসাহিত্যে মানব জীবনের সাধারণ কান্না হাসির দোল দোলানো গল্পকথাগুলি জীবনের রসে সরস হয়ে ধরা দেয় প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের ধারাবাহিকতায়। যে কোন দেশের সাহিত্যেই তাই লোকসাহিত্যের প্রভাব অপরিসীম। রবীন্দ্রসৃষ্টিও তার ব্যতিক্রম নয়। শিবানী তাঁর নিবন্ধে রবীন্দ্র চেতনায় লোকসাহিত্যের গুরুত্বের দিকটি তাই তুলে ধরেছেন গুরুত্ব দিয়েই। পাশ্চাত্য সভ্যতা সংস্কৃতির পূর্ণগ্রাস থেকে বাংলার লোকসাহিত্য সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখার প্রয়াসে রবীন্দ্রনাথের অন্তহীন উদ্যোগকে শিবানী তাঁর নিবন্ধে পরিস্ফূট করেছেন সাবলীল ভাষায়।

রবিমানসে শিল্পকলানিবন্ধে শিবানীর লেখায় পাঠকের প্রাপ্তি রবীন্দ্র প্রতিভার প্রান্তিক উদ্ভাসন চিত্রশিল্পের গতি প্রকৃতি। খুবই স্বল্প পরিসরে এই বৃহৎ বিষয়টিকে ছুঁয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন শিবানী। তবুও এই অল্প পরিসরেও পাঠক রবীন্দ্র শিল্পমানসের একটা চিত্র খুঁজে পাবেন।

নাতিদীর্ঘ এই নিবন্ধমালার গ্রন্থিত প্রয়াসে শিবানী যে উদ্যোগের সূত্রপাত করলেন আশা করতে সাধ হয় পরবর্তীতে তা আরও বিস্তৃতভাবে পল্লবিত হবে।
আলোকিত রবির অনালোকিত তত্ত্বকথা
ডঃ শিবানী পাণ্ডে
সই
৭২, হিন্দুস্থান পার্ক
কলকতা ২৯
মূল্য আশি টাকা

শ্রীশুভ্র