নদীমাতৃক * সোমস্নিগ্ধ মুখোপাধ্যায়

স্যারের কথায় ধীর গতিতে এগোতে থাকে গাড়ি। কাছাকাছি আসতেই বেশ কিছু লোক হুমড়ি খেয়ে পড়ে বনেটের উপর। সহজাত দ্রুততায় পেছনের দরজা খুলে নিমেষের মধ্যে নেমে আসে সে। পেছন থেকে বেশ কয়েকজন তাকে বলে চলে.. অ্যাকিসিডেন্ট.....দাদা অ্যাকিসিডেন্ট... আর ভীড় ঠেলে এগোতেই কিছুটা সামনে রাস্তার উপর সেই হাড়হিম করা দৃশ্য দেখে স্তব্ধ হয়ে যায় বীতিহোত্র! বছর পঁচিশ তিরিশের এক মহিলার দেহ। রক্তে ভেসে যাচ্ছে । স্পট ডেড, দেখেই স্পষ্ট। কোমর থেকে পা এর দিক পুরো মিশে গেছে কালো পিচের রাস্তায়। খানিক দুরে একটা মোটরবাইক। আর সেখানে এক মাঝবয়সীর কোলে একনাগাড়ে কেঁদে চলেছে একটা বছর দুয়েকের শিশু! আর সেই ভদ্রলোক বাচ্চাটার কান্না না থামিয়েই পাগলের মত ফোনে কাউকে কিছু বলতে বলতে ছুটে চলেছে রাস্তার এদিক থেকে ওদিকে।~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~


নদীমাতৃক
সোমস্নিগ্ধ মুখোপাধ্যায়

“এক”

রাস্তার উপরে দাঁড়িয়ে স্ট্রীট লাইট গুলোর একসাথে জ্বলে ওঠা দেখছিল বীতিহোত্র। এই ছোট শহরে, চরাচর যখন আঁধারে দু চোখ বুজে শ্রান্তির পেলব পরশ গায়ে মাখতে চায়, প্রকৃতির সেই একান্ত ব্যাক্তিগত মুহূর্তে নাগরিক আলোর এই উদ্ভাস একদম ভাল লাগেনা তার । আজ তিন মাস হল তারা দীঘলগ্রামে এসেছে। নামে গ্রাম হলেও, এই ব্লক কিন্তু আসলে আধা গ্রাম আধা শহর। সরকারী খাতায় মিউন্যাসিপ্যালিটি না হলেও, বেশ কিছু নাগরিক সুবিধা, যেমন ট্যাপের জল, স্ট্রীট লাইট, ঢালাই রাস্তা, এ ব্লকের বাসিন্দারা ভোগ করে। জয়েন করার আগে ব্লক দেখতে এসে, ব্যাপারটা চোখে পড়েছিল বীতিহোত্রর। প্রথম প্রথম এই মফস্বল শহরে এসে নিজেকে একলা মনে হলেও, আস্তে আস্তে অভিযোজনের নির্দিষ্ট নিয়মে তাকেও ধরা দিতে হয়েছে। তবু প্রতিটি দিনের এই সমাপন ক্ষণে কিছুই যেন ভাল লাগেনা তার। এক তীব্র বিষাদরোগ গ্রাস করতে থাকে তাকে। এক এক দিন যেমন  মনে হয়, সমস্ত সফলতার শেষে , সকল পেশাদারিত্বের শেষে যে মুহুর্তগুলো অপেক্ষা করে থাকে, সেগুলো কি একটু আড়াল আশা করে না, পৃথিবীর কাছ থেকে? সেগুলোতে আলো পড়লে জীবন যে বড় উদোম আর বেআব্রু হয়ে ওঠে, হারিয়ে ফেলে তার সলাজ সৌন্দর্য, ঠিক দিনশেষের মতই।

কালচিনির অফিসে ট্রান্সফারের চিঠিটা আসার পরেই, দীঘলগ্রাম নাম টা শুনে; তৃণা নিজের মনে সমুদ্দু্রের ঢেউ গুণতে শুরু করলেও, জায়গাটার সাথে যে দীঘার শুধুই নেমশেক, সমুদ্র যে তার ধারেকাছেও নেই তা অবশ্য হাসতে হাসতে তৃনাকে জানাতে কসুর করেনি বীতিহোত্র। তবে, বছর তিরিশের তৃনার, এই দীঘলগ্রামকে অকারণে দীঘার আশেপাশের কোন জায়গা ভেবে নিয়ে হঠাৎ খুশিতে অষ্টাদশী বালিকা হয়ে ওঠা, বেশ উপভোগই করেছিল সে। তবে তৃণাকে জায়গাটা বাঁকুড়ার এক মফঃস্বল জানানোর পর হঠাৎ সেই ঢেউকে ভেঙ্গে যেতে দেখে মনে হয়েছিল , দীঘলগ্রাম না হয়ে, ট্রান্সফারটা তো দীঘাতেও হতে পারত, শুধু তৃণার জন্যই। আর তৃণারই বা দোষ কি! একে মেয়েটা আজ বিয়ের চার চারটে বছর পরেও একা, একেবারে একা, যে মেয়ে কিনা সব'চে ভালবাসে বাচ্চাদের। আর তার উপর, সে মেয়ে ক্লান্ত, এই ক বছর পাহাড় আর পাহাড় দেখে দেখে। হোক না সে ছবির মত কালচিনি। যতই হোক, বেড়ে ওঠা তো সে মেয়ের কলকাতাতেই। কাঁহাতক আর ভাল লাগে পাহাড় ?
আর বীতিহোত্র? সে নিজেই কি বুঝতে পেরেছিল , যে সেই প্রোবেশন পিরিয়ড থেকেই তাকে থেকে যেতে হবে উত্তরে ! অরুনাংশুদা তো এই সেদিনেও বলছিল,
-‘বীতি, তোর নেক্সট পোস্টিং হয় পশ্চিম না হয় পূর্ব মেদিনীপুর।
কোথায় বা কি! হয়ত পাশের জেলা। কিন্তু সেও তো সেই বাঁকুড়া, কলকাতা থেকে বহু দূর।

আজ অফিস থেকে একটু তাড়াতাড়িই উঠে পড়েছে সে। অন্যদিন হলে এতক্ষণ বড়বাবু রাজ্যের ফাইল এনে জড়ো করত টেবিলে। তার উপর সামারি রিভিশনের কাজ চলছে। সেই সাথে জুটেছে আধার! বি ডি ওর লাইফে আঁধার ঘনানোর পক্ষে যথেষ্ট। কিন্তু আজ একটু বর্ধমানে যেতে হবে। ডঃ খাস্তগীরের সাথে রাতে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করা আছে। তৃনা কোয়ার্টার থেকে অফিস আসার সময় সকালেই মনে করিয়ে দিয়েছিল। দুপুরে লাঞ্চে আরো একবার মনে করিয়েছে। নন্দকে গাড়িটা কোয়ার্টারে আধা ঘণ্টার মধ্যে লাগাতে বলেই তাই চেয়ার ছেড়েছে সে। কোয়ার্টার চৌরাস্তার কাছেই। অফিস থেকে মিনিট দশেক। হাঁটতে হাঁটতেই তার মনে পড়ল, অরুনাংশুদা অ্যাপয়েন্টমেন্ট করানোর পর বলে দিয়েছিল,

-“বীতি, যাবার আগে ওনার চেম্বারের ছেলেটির সাথে দুপুরের দিকে ওভার ফোনে কন্ট্যাক্ট করে নিবি, নিজের পরিচয় দিয়ে। অ্যাকচুয়ালি ভদ্রলোকের পশার তো বেশই, বর্ধমান শহরে । ভাল গাইনো বলতে এক ডাকে সবাই চেনে। ফলে চেম্বারে সবসময়েই ভীড় থাকে।
-ইশশ...দুপুরে মিটিং এর ব্যস্ততায় একদম ভুলে গেছি! স্বগতোক্তি করে সে।
কিন্ত পরক্ষণেই মনে হয়,
-নাহ, ভালই হয়েছে ভুলে গিয়ে। দুপুরে অফিস থেকে ফোন করলে কেউ না কেউ শুনতে পেত ঠিকই । আর আবার শুরু হত আলোচনা।
শুরুধুৎ, থামল আর কোথায়! যে আবার শুরু হবে। জয়েন করে সেই হপ্তা দুয়েক হয়েছে, একদিন লাঞ্চ থেকে তাড়াতাড়িই ফিরে এসেছে চেম্বারে। কানে এল , ক্যাশিয়ারের ঘরে চলছে জমজমাট আলোচনা,
-ও বড়বাবু, সাহেব তো শুনেছি চাকরি পাবার আগেই বিয়ে করেছে । তা নয় নয় করে বছর চার পাঁচ তো হবেই। তা, গন্ডগোল না থাকলে বিয়ের এত বছরের মধ্যে কারও ছেলেপিলে না হয়।
কথাটা কানে মেখে চেয়ারে বসতে বসতে সে ভেবেছিল,
- সত্যিই তো, কথাটা তো আর মিথ্যে নয়। কোনও সমস্যা না থাকলে....বিয়ের বছর চারেক পরেও....। নাহ, সমস্যা নিশ্চয় আছে। শিলিগুড়ির ক্লিনিকে হয়ত সেটা ধরতেই পারেনি।
শিলিগুড়ির যে ক্লিনিকে এতদিন দেখাল, তৃণার শরীরে তেমন কোন সমস্যা না পেয়ে একদিন সেখানের এক জুনিয়ার ডাক্তার হঠাৎ করে বীতিহোত্রকে বলে বসল,

- আজ আপনিও একটু টেস্টটা করিয়ে নিন না। অলিগোজুস্পার্মিয়াও তো হতে পারে।

অথচ কয়েকদিন পরেই রিপোর্ট। দেখা গেল নর্ম্যাল। বীতিহোত্রর মনে হয়েছিল এরা ডাক্তার! টেস্ট না করিয়েই দুমদাম মন্তব্য করে বসে! তার পরে সেই ক্লিনিকে আর পা রাখেনি সে।
শুধু একটা কথা সে কিছুতেই বুঝতে পারেনা,

- সমস্যাই যদি না থাকবে, তবে তৃণা এই ক'বছরে একবারও কনসিভ করবে না কেন? এমন তো নয় যে মিসক্যারেজ হয়ে যাচ্ছে। কতবার কতজন বলেছে, তৃণার মা তো ক্রমাগত বলেই চলেছেন,
- চলে আয় কলকাতায়। দেখা ভালো কোথাও। কি শুধু শুধু চিন্তা করছিস তোরা?
কিন্তু গত কবছরে কাজের চাপে কালচিনি থেকে আর কলকাতা আসা আর হয়ে ওঠেনি তাদের । এখানে বদলি হবার পর অরুনাংশুদা একরকম নিজেই ডঃ খাস্তগির এর সাথে যোগাযোগ করে অ্যাপো নিয়ে নিয়েছে। বীতিহোত্র কে দিন চার আগে একরকম নির্দেশই দিয়েছে, অগ্রজের অধিকারে,
- বেস্পতিবার রাতে তৃণাকে নিয়ে চলে যাবি। সাড়ে সাতটায়।

চাকরিসূত্রে সিনিয়রের কথা ফেলতে পারেনা বীতিহোত্র। কারণ সে জানে, মানুষটা তাকে একটু বেশিই স্নেহ করে। শুধু কোয়ার্টারে ঢোকার মুখে মনে হয়, সব গ্যাপ গুলো সঠিক সময়ে সঠিক ভাবে ভরে ওঠেনা কেন সবার জীবনে? সেটাই বোধহয় জীবনের সব'চে বড় পাওয়া। না হলে, সেই ফাঁক দিয়েই জীবন ঝুরো মাটির মত ঝরে যেতে থাকে অবিরল।

“দুই”

- এত দেরী করলে?
- আর দেরী! তুমি রেডি? বীতিহোত্র জানতে চায়।
- হ্যাঁ, সেতো কখন থেকে। তুমি ফ্রেশ হবেনা?
- এরপর ফ্রেশ হতে গেলে দেরী হয়ে যাবে। আমায় অ্যাসট্রেটা দাও তো।
- উফফ, আবার সিগ্রেট! ওটা না খেয়ে শার্ট টা চেঞ্জ করে নাও না। সেই সকাল থেকে গায়ে চড়িয়ে আছো।
- ওখানকার রিপোর্ট, প্রেশকিপসন গুলো নিয়েছ? তৃণার কথায় আমল না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করে সে।
- হ্যাঁ, তবে ওগুলোর কি খুব প্রয়োজন আছে?
- প্রয়োজন থাক, বা না থাক, যদি দেখতে চায়, সামান্য হলেও রুক্ষ শোনায় বীতিহোত্রর  গলা। বলতে বলতে গাড়ী আসার আওয়াজ পায় তারা।
- চলো, নন্দ বোধহয় চলে এসেছে।
- ও গাড়ী এসে গেছে ? চলো চলো,সোওয়া  ছটা তো বেজেও গেল। তৃণার কথায় আধখাওয়া সিগারেট টা অ্যাসট্রেতে গুঁজে উঠে পড়ে সে।

দীঘলগ্রাম থেকে বর্ধমান প্রায় পঁচিশ কিমি। রাস্তার অবস্থাও তথৈবচ। ফিরতে রাত হবে বলে তৃণা আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছে, ডিনার বাইরেই সেরে নেবে। সেইমত রান্নার মাসীকেও আসতে বারণ করে দিয়েছে। ডঃ খাস্তগিরের চেম্বার খোশবাগান বলে একটা জায়গায়। বর্ধমান শহরে ওটাকে নাকি লোকে ডাক্তারপাড়া বলে।
- নন্দ, একটু তাড়া আছে, সোওয়া সাতের ভেতর বর্ধমান ঢুকতে পারবে তো?
- হ্যাঁ স্যার, পৌঁছে যাব, নন্দ আশ্বাস দেয়।
ব্লক কম্পাউন্ড পেরিয়ে গাড়ি এখন পিচ রাস্তায়। তবু অপরিসর রাস্তায় গতি বাড়াবার উপায় নেই। তাই গাড়ী ছুটে চলেছে মধ্যম গতিতে। নভেম্বরের প্রথমের এই সন্ধে গুলো বড় মনোরম লাগে বীতিহোত্রর। সেই কলেজের দিনগুলো থেকে। যখন হেমন্তের প্রথম শিশিরকে বরণ করার প্রস্তুতি নেয় ধরিত্রী, পুজোর ছুটির ঠিক পরেই, এই সময়টাতে। জানলা দিয়ে আসা ঠান্ডা বাতাসের হিমেল স্পর্শে তার মনে পড়ে,
- উফফ, কি আড্ডায় না বসত এই সময় টাতে হস্টেলের ছাতে, বড়দিনের ছুটিতে বেড়াতে যাবার প্ল্যান নিয়ে। সুমন বলত, অত কাব্যি না করে, বল সেক্সি ঠান্ডা। বলেই, দুঠোঁট চুমু ভাসিয়ে দিত হাওয়ায়, গার্লস হস্টেলের উদ্দেশে। আর এরকমই নভেম্বরে যে বছর এডুকেশনাল ট্যুরে দীঘা যাওয়া হল কলেজ থেকে, সেই প্রথম তো তৃণা ওর বাবার কাছে পারমিশন আদায় করেছিল, বন্ধুদের সাথে বাইরে যাবার। সম্পর্কটা নিয়ে সিরিয়াসলি ভাবতে শুরু করাও তো তখন থেকেই।
হঠাৎ সে সব মনে পড়ে, পিছনের সীটের ভালোলাগা অন্ধকারে তৃণার হাতের উপর হাত রাখে সে। ইন্দাস পেরিয়ে গাড়ী এখন বড় রাস্তায়।
- স্যার, বলছিলাম কি, ফিরতে কি বেশ রাত হবে? নন্দ জানতে চায়।
- কেন?
- না, মানে, স্যার, ওরা আজ একা আছে, ঘরে। মা একটু আশ্রম গেছে, গুরুদেবের কাছে। উৎসব আছে।
- ওহ, তাই? আশা করছি দশটার ভেতরেই ফিরে যাব, বীতিহোত্র উত্তর দেয়।
- নন্দ, তোমার একটিই মেয়ে, তাই না?
- হ্যাঁ, ম্যাডাম। সামনের আষাঢ়ে তিন পূর্ণ হবে।
-নাহ, খেয়াল রাখে বলতে হবে বৌ মেয়ের,
নন্দর কথা ভাল লাগে তৃণার। কিন্তু পরক্ষণেই মনে হয়, আহা, ওইরকম একটা একরত্তি যদি আজ বসে থাকত তাদের মাঝে। গাড়ির ঝাঁকুনিতে গা এলিয়ে দিত তৃণার কোলে, বা কিছুক্ষণ চলার পরেই জড়িয়ে ধরত মায়ের গলা, তার কচি হাত আর আঙ্গুলে।
- নন্দ, একটু টেনে চালাও, প্রায় পৌনে সাত হতে চলল,
বীতিহোত্রর কথায় ঘোর কাটে তৃণার। সাহেবের কথায় অ্যাক্সিলেটরে চাপ বাড়ে।
সময় যত এগোচ্ছে, রাস্তার দুধারের অন্ধকার তত জমাট বাঁধছে। সাথে ঝাঁকড়া গাছগুলো কেমন ভূতুড়ে পরিবেশ রচনা করছে চারপাশে। তৃণা বেশ বুঝতে পারে, অ্যাপয়েন্টমেন্ট এর সময় যত এগিয়ে আসছে তত ভেতরে ভেতরে অস্থির হয়ে পড়ছে বীতিহোত্র। মানুষটা প্রকৃতিগত ভাবেই ওরকম।
- যদি পৌঁছতে দেরী হয়ে যায়! যদি অন্য কিছু শোনায় এ ডাক্তার।
কেশবপুর পেরিয়ে গাড়ি যখন কৃষকসেতুর কাছাকাছি, হঠাৎ হেডলাইটের আলোয় দূরে সেতুর উপর একটা জটলা চোখে পড়ে নন্দর। গাড়ীর গতি কমায় সে।
-আবার কি হল নন্দ? থামছ কেন? পেছনের সীট থেকে বীতিহোত্র চঞ্চল হয়ে ওঠে।
- স্যার, সামনে কিছু একটা হয়েছে মনে হচ্ছে।
- কোথায়?
- ওই তো স্যার সামনে।
সীটে সোজা হয়ে বসতেই তার চোখে পড়ে একটা ভীড়, বেশকিছু লোকের। খানিক দূরে। বেশ হৈ হট্টগোলও হচ্ছে মনে হচ্ছে।
- কিসের গন্ডগোল বলোতো? অ্যাকসিডেন্ট নাকি? কয়েকটা লোক একটা পিক আপ ভ্যান কে থামিয়ে কি যেন বলছে না?
- হ্যাঁ স্যার, তাইতো।
- কিন্তু তুমি সামনে তো এগোও, চলো, দেখতে তো হবে কি হল, বীতিহোত্র বিরক্ত হয়।
স্যারের কথায় ধীর গতিতে এগোতে থাকে গাড়ি। কাছাকাছি আসতেই বেশ কিছু লোক হুমড়ি খেয়ে পড়ে বনেটের উপর। সহজাত দ্রুততায় পেছনের দরজা খুলে নিমেষের মধ্যে নেমে আসে সে। পেছন থেকে বেশ কয়েকজন তাকে বলে চলে.. অ্যাকিসিডেন্ট.....দাদা অ্যাকিসিডেন্ট... আর ভীড় ঠেলে এগোতেই কিছুটা সামনে রাস্তার উপর সেই হাড়হিম করা দৃশ্য দেখে স্তব্ধ হয়ে যায় বীতিহোত্র!
বছর পঁচিশ তিরিশের এক মহিলার দেহ। রক্তে ভেসে যাচ্ছে । স্পট ডেড, দেখেই স্পষ্ট। কোমর থেকে পা এর দিক পুরো মিশে গেছে কালো পিচের রাস্তায়। খানিক দুরে একটা মোটরবাইক। আর সেখানে এক মাঝবয়সীর কোলে একনাগাড়ে কেঁদে চলেছে একটা বছর দুয়েকের শিশু! আর সেই ভদ্রলোক বাচ্চাটার কান্না না থামিয়েই পাগলের মত ফোনে কাউকে কিছু বলতে বলতে ছুটে চলেছে রাস্তার এদিক থেকে ওদিকে।
- কি করে ঘটল, এসব? মূহুর্তের মধ্যে নিজেকে সামলে নিয়ে ভীড় করা লোকগুলোর দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয় বীতিহোত্র।
- আর বলবেন না, আমরা তো শব্দ শুনে ছুটে আসছি! ওই ভদ্রলোক বাইকে যাচ্ছিলেন। এই সবেমাত্র যে লরীটা গেল ওটাকে পাশ দিতে গিয়ে ভদ্রমহিলা কোনওভাবে লরীর পেছনে ধাক্কা লেগে মনে হয় চাকায় ঢুকে যানআমরা শব্দ শুনে ছুটে আসতে না আসতেই দেখি সব শেষ! স্পট ডেড ভদ্রমহিলা, ওই লোকটার স্ত্রী। বাচ্চাটা মাঝে ছিল। ধাক্কা লাগার পর পড়ে গেলেও আশ্চর্যজনক ভাবে কিন্তু বেঁচে গেছে দুজনেই। সামান্য কাটা ছেঁড়া গেছে! লরিটা পালিয়ে গেছে! আমরা ফোন করে দিয়েছি, সামনে লরিটাকে ঠিক আটকাবে, একনিঃশ্বাসে বলে যায় একটা লোক।
- আরে দাদা, রাখে হরি তো মারে কে! ভীড়ের মধ্যে থেকে ফুট কাটে কেউ।
- ঠিক আছে, ঠিক আছে। আমি বি ডি ও দীঘলগ্রাম। আপনারা একটা কাজ করুন, যে করে হোক কোনো গাড়ী থামান। ওই ভদ্রলোক আর বাচ্চাটাকে আগে হসপিটাল পাঠাতে হবে। আমি ফোন করছি সদর থানায়। পুলিশ এক্ষুনি এসে পড়বে, মুহুর্তের মধ্যে পাল্টে যায় বীতিহোত্রর বডি ল্যাঙ্গোয়েজ , প্রশাসনিক আধিকারিকের তৎপরতায় নির্দেশ দিতে থাকে সে।
ঝানু এক্সিকিউটিভের কান চট করে ধরে ফেলে বি ডি ও শব্দটা শুনতেই কেমন একটা সমীহ ভাব ফুটে উঠেছে লোকগুলোর মধ্যে। সম্বোধন ও রাতারাতি পাল্টে গেছে দাদা থেকে স্যার এ। ফোনটা পকেট থেকে বের করে সদর থানার নম্বর নেবার জন্য ব্যাচমেট রুদ্রকে ডায়াল করে সে।

 “তিন”

এই গন্ডগোলের মধ্যে কখন যে বাচ্চাটার কান্না শুনে তৃণা গাড়ী থেকে নেমে গিয়ে বাচ্চাটাকে তার বাবার কাছ থেকে তুলে নিয়েছে নিজের কোলে, বীতিহোত্র খেয়ালই করেনি সেটা। যখন চোখে পড়ল, মাঝে কেটে গেছে প্রায় মিনিট দশেক। দেখে, নন্দও দাঁড়িয়ে তৃণারই কাছাকাছি, যেন তৃণাকে গার্ড করছে হঠাৎ করে এসে পড়া এই উটকো ঝামেলা থেকে। আর তৃণা, তার স্ত্রী,

- তার স্ত্রী? না না এ তো তার স্ত্রী নয়! তবে এ কাকে দেখছে সে? এক নারী..? না, না, তাওতো না! তার সামনে যে দাঁড়িয়ে সে তো এক মা, যে পরম মমতায় তার বুকের মধ্যে আঁকড়ে ধরে রয়েছে এক একরত্তি সদ্য মাতৃহারা শিশুকে! যে শিশুর কান্নাও যেন থেমে গেছে মায়ের বুকের ওম পেয়ে! বীতিহোত্র অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে সেদিকে, দাঁড়িয়ে থাকে স্থানুবৎ। এরমধ্যে ভীড়ও বেড়ে যায় বেশ, এসব ক্ষেত্রে যেমন হয় সচরাচর। হঠাৎ সে খেয়াল করে,

- আরে! ঘড়ির কাঁটা তো প্রায় সাত ছুঁই ছুঁই। এখনই এখান থেকে না বেরোলে তো আর কোনোভাবেই পৌঁছতে পারবে না তারা, ডঃ খাস্তগিরের চেম্বারে,

- তৃণা, তৃণা, দৌড়ে তৃণার কাছে যায় সে,

- চলো চলো, এবার এখান থেকে না বেরোলে অ্যাপয়েন্টমেন্ট ক্যানসেল করতে হবে, বীতিহোত্রর গলায় উদ্বেগ ঝরে পড়ে।

- না বীতি, এই বাচ্চাটাকে ফেলে এখন আমি কোথাও যেতে পারব না। আজ ক্যানসেল কর অ্যাপয়েন্টমেন্ট।

- মানে?

- মানে, এই শিশুটার চিকিৎসা এখন মোর ইম্পর্ট্যান্ট আমাদের অ্যাপয়েন্টমেন্টএর চেয়ে। আর কার কাছে এখন ছেড়ে পালাব একে?

- কেন? ওর বাবা রয়েছে তো?

- কিন্তু ভদ্রলোক ভালোরকম ইনিজিওর্ড! তাছাড়া দেখছ না, কেমন পাগলের মত আচরণ করছেন উনি! আগে হাসপাতাল চলো, বাচ্চাটার আগে চেকআপের দরকার।

- কিন্তু আমি তো রুদ্রকে বলে দিয়েছি, ও এতক্ষন হয়ত থানাতে খবরও দিয়ে দিয়েছে এক্ষুনি পুলিশও এসে পড়বে, সব ব্যবস্থা হয়ে যাবে।

- না বীতি সেটা হয়না। আমি একে নিয়ে আগে ডাক্তারের কাছে যাব।

- কি পাগলের মত বকছ, তৃণা ! অরুণাংশুদা কি ভাববে জানো? জাস্ট একটা রোড অ্যাকসিডেন্ট, আর তার জন্য তুমি একটা জরুরী অ্যাপয়েন্টমেন্ট ক্যানসেল করছ?

- তুমি তো জান বীতি, আমি যেটা করা উচিৎ বলে মনে করি, সেটাই করি।

- পাগলামি কোর না তৃণা...বীতিহোত্র ধমকে উঠে!

আর সেই জোরালো আওয়াজে বাচ্চাটা আবার কাঁদতে শুরু করে। বীতিহোত্রর কথার উত্তর দেবার কোন প্রয়োজন অনুভব করে না তৃণা। বরং বাচ্চাটার কান্না থামাতে ফের তাকে বুকে আঁকড়ে নেয়, ওড়না দিয়ে জড়িয়ে ধরে তাকে। আহা, নদীর বুক থেকে উঠে আসা ঠান্ডা বাতাস যাতে কামড় না বসাতে পারে সেই ছোট্ট শরীরে। নিজের স্ত্রীর এই জেদের কাছে খানিক হলেও অসহায় বোধ করতে থাকে, বীতিহোত্র , সেই মুহুর্তে। এক অব্যক্ত ক্রোধে নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে সে, সেতুর রেলিঙে ভর দিয়ে। নীচে তাকিয়ে সে অনুভব করে, ঘন আঁধারেও সেতুর বহু নিচে কেমন বয়ে চলেছে দামোদর, তার আপন খেয়ালে! কোনোদিকে দৃষ্টি নেই তার। দূরে বর্ধমান শহরের অজস্র আলো। আলো, না সভ্যতাদীপ! যাকে লালন করে চলেছে এই নদী। যুগ যুগ ধরে, তার বিস্তীর্ণ দুই পারে, বছরের পর বছর। হঠাৎ করে মনে পড়ে তার ছোটবেলার ভূগোল। নদীর পাড়েই তো গড়ে উঠত না, সভ্যতা? জেগে উঠত মহা সমারোহে, জল পেয়ে তার বুক থেকে! এসব সাতপাঁচ ভাবনায় এফোঁড়ওফোঁড় হতে হতে হঠাৎ এক অলৌকিক বোধে পরিপূর্ণ হয়ে উঠে বীতিহোত্র! আর পেছন ফিরে সে আবিষ্কার করে, নীচের মত সেতুর উপরেও বয়ে চলেছে এক নদী, কোনোদিকে দৃষ্টি না দিয়ে, তার আপন খেয়ালে।

সোমস্নিগ্ধ মুখোপাধ্যায়