গণনাটকের ভগীরথ * ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়

পূর্ববর্তী একশবছরের সনাতনী নাট্য ও মঞ্চের প্রয়োগভাবনার ওলট পালট ঘটিয়ে নবান্নহয়ে গেল বাংলা নাটক ও মঞ্চের এক মাইলফলক আজও অসংখ্য গ্রুপ থিয়েটার সেই ধারারই উত্তরাধিকার বহন করে যার প্রথম পুরোহিত বিজন ভট্টাচার্য তাঁর নাট্যনির্মাণ দিয়েছিল নতুনতর নাট্যভাষা সনাতনী শিল্পের জন্য শিল্প’-অনুগত সাহিত্যভাবনা পরিবর্তিত হয়ে গেল নতুনতর স্লোগানে – ‘শিল্প হবে মানুষের জন্য গণনাট্য সঙ্ঘ থেকেই বিজন অট্টাচার্যের পাশাপাশি উঠে এসেছিলেন এক অসামান্য প্রয়োগশিল্পী ও অভিনেতা শম্ভূ মিত্র গণনাট্যের আদর্শে দিক্ষিত হয়ে উঠে এসেছিলেন আরো দুই অসামান্য প্রয়োগশিল্পী ও অভিনেতা উৎপল দত্ত ও কিছু পরে অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়। তিন জনের কেউই গণনাট্যসঙ্ঘের সাংগঠনিক বন্ধনে আবদ্ধ থাকেননি শেষ পর্যন্ত শম্ভূমিত্র ১৯৫০এ গঠন করলেন বহুরূপী’, উৎপল দত্ত লিটল থিয়েটার গ্রুপ’ (১৯৫০) ও অজিতেশ গঠন করলেন নান্দিকার’(১৯৬০)
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~


গণনাটকের ভগীরথ ও বাংলা মঞ্চের চার দিকপাল
ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়


পুরাণ কথা, ভগীরথ তপস্যাবলে মহাদেবের জটায় আবদ্ধ গঙ্গার শ্রোতধারা নিয়ে এসেছিলেন মর্ত্যে আর আধুনিক যুগে যিনি শুষ্কপ্রায় বাংলা নাট্যমঞ্চে গণমুখী নাট্যশ্রোতধারা বইয়ে বাংলা নাট্যমঞ্চে নতুন প্রাণসঞ্চার করলেন তিনিও তো আর এক ভগীরথ তিনি বিজন ভট্টাচার্য বাংলা মঞ্চে গণনাটকের ভগীরথ
     
১৯৪০এর দশকটা ছিল এক উত্তাল সময় দ্বিতীয় সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ শুরু হয়েছে ১৯৩৯এ যুদ্ধের অনিবার্য পরোক্ষ ফল নিষ্প্রদীপ বাংলায় কালোবাজারি, মজুতদারি আর সাধারণ মানুষের হতাশা,বেকারি, দারিদ্র, মনুষ্যত্বের লাঞ্ছনা বিয়াল্লিশে স্বাধীনতা সংগ্রামের চূড়ান্ত পর্যায় ভারত ছাড়ো আন্দোলন শুরু হয়েছে ১৯৪৩এ দেখা দিল মানুষের তৈরি ভয়ঙ্করতম মন্বন্তর কলকাতার রাস্তায় একটু ফ্যানের জন্য মৃত্যুমুখী মানুষের হাহাকার পঁয়ত্রিশ লক্ষ্য মানুষের মৃত্যু ঘটেছিল এই ভয়ঙ্করতম মন্বন্তরে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রের এই সমস্ত সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কার্যকারণে গড়ে উঠেছিল গণনাট্য সঙ্ঘ লক্ষ লক্ষ মৃত্যু আর সামাজিক অবক্ষয়ের যন্ত্রণার গভীর থেকে জন্ম নিল এক  সৃজনশীল সংস্কৃতি রচিত হল দুটি নাটক জবানবন্দীনবান্ন’, যা বাংলা নাটক রচনা ও নাট্যাভিনয়ের ধারায় এনে দিল যুগান্তকারী দিকবদল পূর্ববর্তী একশবছরের সনাতনী নাট্য ও মঞ্চের প্রয়োগভাবনার ওলট পালট ঘটিয়ে নবান্নহয়ে গেল বাংলা নাটক ও মঞ্চের এক মাইলফলক আজও অসংখ্য গ্রুপ থিয়েটার সেই ধারারই উত্তরাধিকার বহন করে যার প্রথম পুরোহিত বিজন ভট্টাচার্য তাঁর নাট্যনির্মাণ দিয়েছিল নতুনতর নাট্যভাষা সনাতনী শিল্পের জন্য শিল্প’-অনুগত সাহিত্যভাবনা পরিবর্তিত হয়ে গেল নতুনতর স্লোগানে – ‘শিল্প হবে মানুষের জন্য গণনাট্য সঙ্ঘ থেকেই বিজন অট্টাচার্যের পাশাপাশি উঠে এসেছিলেন এক অসামান্য প্রয়োগশিল্পী ও অভিনেতা শম্ভূ মিত্র গণনাট্যের আদর্শে দিক্ষিত হয়ে উঠে এসেছিলেন আরো দুই অসামান্য প্রয়োগশিল্পী ও অভিনেতা উৎপল দত্ত ও কিছু পরে অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায় তিন জনের কেউই গণনাট্যসঙ্ঘের সাংগঠনিক বন্ধনে আবদ্ধ থাকেননি শেষ পর্যন্ত শম্ভূমিত্র ১৯৫০এ গঠন করলেন বহুরূপী’, উৎপল দত্ত লিটল থিয়েটার গ্রুপ’ (১৯৫০) ও অজিতেশ গঠন করলেন নান্দিকার’(১৯৬০) শম্ভূ উৎপল অজিতেশ এই তিনজনের নাট্যকর্ম রচনা করেছিল বাংলা মঞ্চের স্বর্ণসময় অজিতেশ চলে গেছেন ৩৪ বছর আগে, উৎপল দত্ত ২৪ বছর আগে আর শম্ভু মিত্র ২০ বছর আগে আমাদের আক্ষেপ বাংলার নাট্যমঞ্চ আর একজন শম্ভূ মিত্র কিংবা আর একজন উৎপল দত্ত বা আর একজন অজিতেশ পেলো না এই নিবন্ধে আমি গণনাট্যের প্রথম পুরোহিত বিজন ভট্টাচার্য আর বাংলা মঞ্চের তিন দিকপাল শম্ভূ মিত্র, উৎপল দত্ত ও অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের জীবন ও সৃষ্টিকে বুঝতে চেয়েছি



বিজন ভট্টাচার্য জীবন ও সৃষ্টি


বিজন ভট্টাচার্যর জীবন ও সৃষ্টিকে বুঝতে চাইলে তার সময়টাকেও ফিরে দেখতে হবে বিজনের জন্মের এক বছর আগে শুরু হয়েছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধ আর জন্মের দুবছর পরে ঘটে গিয়েছিল বলশেভিক বিপ্লব ও সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত রাশিয়ার আবির্ভাব বদলে গিয়েছিল বিশ্বের মানচিত্র এদেশে তখন স্বাধীনতা আন্দোলন গতি পেয়েছে গান্ধিজি্র নেতৃত্বে ১৯২০ থেকে ৩০ সময়কালে ভারতের কম্যুনিস্ট পার্টির গঠন, সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন, তরুণ শিল্প-সাহিত্য কর্মীরা সমবেত হতে শুরু করেছেন সমাজতান্ত্রিক ভাবনায় এই আবহে কেটেছে বিজনের শৈশব ও তারুণ্য

জন্ম ফরিদপুর জেলার খানখানাপুর গ্রামে পিতা ক্ষীরোদবিহারী ভট্টাচার্য ছিলেন স্কুল শিক্ষক মাতা সুবর্ণপ্রভা তাঁদের জ্যেষ্ঠ সন্তান বিজন গ্রামীণ পরিবেশ ও শিক্ষক পিতার জীবনাদর্শে নিজেকে গড়ে তুলেছিলেন ১৯৩০এ ১৫বছরের তরুণ বিজন চলে এলেন কলকাতায়, ভর্তি হলেন আশুতোষ কলেজে ছাত্র অবস্থাতেই সক্রিয়ভাবে অংশ নিলেন স্বাধীনতা আন্দোলনে ফলে অসম্পূর্ণ থেকে গেলো কলেজ শিক্ষা আনন্দবাজার পত্রিকার  প্রখ্যাত সাংবাদিক সত্যেন্দ্রনাথ মজুমদার ছিলেন বিজনের মামা বিজন চাকরি পেলেন আনন্দবাজারে ১৯৩৮-৩৯এ ছোট ফিচার লেখা দিয়ে শুরু হল তাঁর লেখক জীবন ১৯৪০এ মুজঃফর আহমেদের সান্নিধ্যে আসেন ও আকর্ষিত হন কম্যুনিস্ট পার্টির প্রতি কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ পেলেন ১৯৪২এ ১৯৪৪এ আনন্দবাজারের চাকুরি ছেড়ে হলেন কমিউনিস্ট পার্টির সর্বক্ষণের কর্মী বা হোলটাইমার

১৯৪০এর দশকটা ছিল এক উত্তাল সময় দ্বিতীয় সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ শুরু হয়েছে ১৯৩৯এ যুদ্ধের অনিবার্য পরোক্ষ ফল নিষ্প্রদীপ বাংলায় কালোবাজারি, মজুতদারি আর সাধারণ মানুষের হতাশা,বেকারি, দারিদ্র, মনুষ্যত্বের লাঞ্ছনা বিয়াল্লিশে স্বাধীনতা সংগ্রামের চূড়ান্ত পর্যায় ভারত ছাড়ো আন্দোলন শুরু হয়েছে ১৯৪৩এ দেখা দিল মানুষের তৈরি ভয়ঙ্করতম মন্বন্তর কলকাতার রাস্তায় একটু ফ্যানের জন্য মৃত্যুমুখী মানুষের হাহাকার পঁয়ত্রিশ লক্ষ্য মানুষের মৃত্যু ঘটেছিল এই ভয়ঙ্করতম মন্বন্তরে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রের এই সমস্ত সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কার্যকারণে গড়ে উঠেছিল গণনাট্য সঙ্ঘ লক্ষ লক্ষ মৃত্যু আর সামাজিক অবক্ষয়ের যন্ত্রণার গভীর থেকে জন্ম নিল এক  সৃজনশীল - সাংস্কৃতিক সংগ্রাম আর সেই সংগ্রামের অভিঘাতে জন্ম নিলেন নাট্যকার বিজন ভট্টাচার্য১৯৪৩-এ অরণিপত্রিকায় প্রকাশিত আগুননাটকের মধ্য দিয়ে গণনাট্য সঙ্ঘের প্রযোজনায়, তাঁরই নির্দেশনায় নাটকটি অভিনীত হয় ১৯৪৩এর মে মাসে ১৯৪৩এই অরণিপত্রিকায় প্রকাশিত হল তাঁর দ্বিতীয় নাটক মাত্র চারটি দৃশ্যের ছোট নাটক জবানবন্দী এটিও অভিনীত হয় বিজনের নির্দেশনায় এবং মূখ্য চরিত্রে্র অভিনয়ে কমিউনিষ্ট পার্টির তৎকালীন সম্পাদক পূরণচাঁদ যোশীর আগ্রহে জবানবন্দীর হিন্দি ভাষান্তর অন্তিম অভিলাষগণনাট্যের কেন্দ্রীয় দল অভিনয় করে মুম্বাইতে শম্ভূ মিত্র নির্দেশনায় শম্ভূ মিত্র তখন গণনাট্যের সেন্ট্রাল স্কোয়াডের দায়িত্বে ছিলেন অন্তিম অভিলাষই ঐ সময় চলচ্চিত্রায়িত হয় খাজাআহমেদ আব্বাসের পরিচালনায় ধরতী কে লালনামে

জবানবন্দীর পর একই সময়ে ১৯৪৩এ বিজন ভট্টাচার্য রচনা করেন তাঁর যুগান্তকারী নাট্যসৃজন নবান্ন গণনাট্য সঙ্ঘের প্রযোজনায় তাঁর ও শম্ভূ মিত্রর যৌথ পরিচালনায় নাটকটি শ্রীরঙ্গম মঞ্চে অভিনীত হয় ১৯৪৪এর ২৪শে সেপ্টেম্বরপ্রধান চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন বিজন জবানবন্দীনবান্নবাংলা নাটক রচনা ও নাট্যাভিনয়ের ধারায় এনে দিল যুগান্তকারী দিকবদল পূর্ববর্তী একশবছরের সনাতনী নাট্য ও মঞ্চের প্রয়োগভাবনার ওলট পালট ঘটিয়ে নবান্নহয়ে গেল বাংলা নাটক ও মঞ্চের এক মাইলফলক আজও অসংখ্য গ্রুপ থিয়েটার সেই ধারারই উত্তরাধিকার বহন করে যার প্রথম পুরোহিত বিজন ভট্টাচার্য তাঁর নাট্যনির্মাণ দিয়েছিল নতুনতর নাট্যভাষা সনাতনী শিল্পের জন্য শিল্প’-অনুগত সাহিত্যভাবনা পরিবর্তিত হয়ে গেল নতুনতর স্লোগানে – ‘শিল্প হবে মানুষের জন্য বিজন ভট্টাচার্যর নাট্যজীবন শুরু হয়েছিল এই পরিবেশে ও এক সংগঠিত মতাদর্শের পরিমন্ডলে

মহাজনের শোষণ ও আকালকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল নবান্নর নাট্যভাবনা সেই সময়কালের সমগ্র বাংলার কৃষক সমাজের চালচিত্র এঁকেছিলেন নবান্ননাটকে বিদেশী শাসনের পীড়ন, যুদ্ধের ভয়ঙ্কর পরিণামে মন্বন্তর আর সেইসঙ্গে দালাল, মজুতদার,মহাজনদের লোভ-লালসা আর মানবতার সেই সংকট সময়ে মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত শহরবাসীর ব্যক্তিস্বার্থ ও আত্মসুখ-সন্ধানের সংকীর্ণতা ফুটে উঠেছে নবান্ন নাটকে পীড়িত অসহায় মানুষের হাহাকারের পাশাপাশি জীবনের অভিজ্ঞতায় সঙ্ঘবদ্ধ প্রতিরোধের মধ্য দিয়ে মানুষ কিভাবে তার সোনাবরন ধানের স্বপ্নকে সত্য করে তুলতে পারে তারও ইঙ্গিত দিয়েছেন নবান্ননাটকে নতুন করে বাঁচার আশায় জবানবন্দীর পরান মন্ডল শহরের ফুটপাতে পড়ে মারা গিয়েছিল শহরের ফুটপাতে মৃতপ্রায় পরান মন্ডল তার শেষ কথাটি উচ্চারণ করেছিল আমার, আমার সেই মরচে পড়া লাঙ্গল কখানা আবার শক্ত করে চেপে ধরগে মাটিতি সোনা, সোনা ফলবে

নবান্নসম্পর্কে নাট্যকার বিজন ভট্টাচার্য নিজেই বলেছেন - আবেগ না হলে বোধহয় কবিতার জন্ম হয় না - অনুভূতি না থাকলে জীবনযন্ত্রণা না থাকলে কোনো সৃষ্টিই বোধহয় সম্ভব নয়।নবান্নের কাহিনী-ভাবনা সম্পর্কে তিনি নিজেই বলেছেন  - একদিন ফেরার পথে কানে এলো, পার্কের রেলিঙের ধারে বসে এক পুরুষ আর এক নারী তাদের ছেড়ে আসা গ্রামের গল্প করছে, নবান্নের গল্প, পুজো-পার্বণের গল্প। ভাববার চেষ্টা করছে তাদের অবর্তমানে গ্রামে তখন কি হচ্ছে?’ সেই অভিজ্ঞতার ভেতর থেকেই নবান্নর নাট্যরূপ উঠে এসেছিল। যে মানুষেরা রাস্তায় দুর্ভিক্ষের মড়া দেখে মুখ ফিরিয়ে গেছে নবান্ননাটক দেখিয়ে সেই মানুষদের চোখে আমরা জল ঝরাতে পেরেছি - এটা ছিল আমাদের কৃতিত্ব।

এ জিনিস বাংলা নাট্যমঞ্চে আগে কখনও হয়নি সেই উত্তাল সময়েও পেশাদারী থিয়েটারে বেশিরভাগ নাটকের কাহিনী ছিল প্রধানত পুরাণ, ইতিহাস, দেব-দেবী নির্ভর কাহিনী কিংবা মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্ত মানুষের মোটা দাগের গল্প মাটির কাছাকাছি থাকা জনজীবনের কাহিনী প্রতিফলিত হত না কোন নাটকেই পীড়িত মানুষ যখন খাদ্যের জন্য হাহাকার করছে তখন পেশাদারী থিয়েটারে অভিনীত হচ্ছে সীতা’, ‘আলমগীর’, ‘মিশরকুমারীর মত নাটক এই নাট্যভাবনাকে চূরমার করে বিজন ভট্টাচার্য মঞ্চে নিয়ে এলেন শ্রমজীবি মানুষদের

স্বাধীনতার পর গণনাট্য সঙ্ঘে ভাঙণ শুরু হয় বিজন সঙ্ঘের সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ করলেন ১৯৪৮এ কিন্তু গণনাট্যের আদর্শ থেকে সরে গেলেন এমন নয় কিছু সাংগঠনিক মতান্তর, দোদুল্যমানতা ছিলই অনেক পরে ১৯৬৭তে শারদীয়া কালান্তর পত্রিকায় গণনাট্য আন্দোলনের সেকাল একালরচনায় লিখেছিলেন – “ইতোমধ্যে রাজনীতির মোড় ঘুরতে আরম্ভ করেছে, মহামন্বন্তর ও অগস্ট আন্দোলনের পর মাউন্টব্যাটন সাহেবের হাতে স্বাধীনতার রুটিভাগের পালা চলছে মহা অনর্থ ঘনায়মান হয়ে উঠেছে দেশে ভাতৃঘাতী আত্মহননের পালা সমসন্ন হ;ল সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্তে গান্ধীজি তখন কলকাতায় এসে বেলেঘাটায় আস্তানা ফেলেছেন মহাপাপ প্রতিরোধ করতে দাঙ্গার তীব্রতা সাময়িক প্রশমিত হ গান্ধীজি নোয়াখালি যাবেন আমার তখন মনে হয়েছিল গণনাট্য সঙ্ঘেরও কর্তব্য আছে আমি তখন আমাদের উচ্চতর কার্যকরী সভায় গান্ধীজির সঙ্গে গণনাট্যের দল নিয়ে নোয়াখালি সফরের প্রস্তাব করেছিলাম সেই সভায় ঐ প্রস্তাব আনায় আমাকে সেদিন অপদস্থ হতে হয়েছিল হঠকারিতার জন্য ... নাট্য আন্দোলনকে মর্যাদা দেওয়া ছাড়া ঐ প্রস্তাবে আমার অন্য কোন কথা ছিল না ...

১৯৪৮এ জিবিকার তাগিদে মুম্বাই চলে গেলেন চচ্চিত্রে কাজ করার জন্য মুম্বাইয়ে নাগিনএর মত হালকা জনমনোরঞ্জনী ছায়াছবির চিত্রনাট্য লিখলেন কলকাতাতেও সাড়ে চুয়াত্তর’, ‘বসু পরিবার’, ‘ডাক্তারবাবুপ্রভৃতি কয়েকটি চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্যও রচনা করেছিলেন বিজন মুম্বাইএর চিত্রজগৎ তাঁর জন্য নয় বুঝে দুবছর পরে ১৯৫০এ কলকাতায় ফিরে নিজের নাট্যদল ক্যালকাটা থিয়েটারগঠন করলেন ১৯৫১তে  ইতিমধ্যে কবি মণীষ ঘটকের কন্যা মহাশ্বেতাকে বিবাহ করলেন ১৯৪৭এ, পুত্র নবারুণের  জন্ম ১৯৪৮এ . ১৯৫৯এ মহাশ্বেতার সঙ্গে বিবাহ বিচ্ছেদ ক্যালকাটা থিয়েটারও ত্যাগ করলেন ১৯৭০এ, গঠন করলেন নিজের নাট্যদল কবচকুন্ডল আমৃত্যু কবচ কুন্ডলএর সঙ্গেই যুক্ত ছিলেন

১৯৪৩এ আগুনরচনা থেকে ১৯৭৮এর ১৯শে জানুয়ারি মৃত্যুর আগের দিনে মরচাঁদনাটকে শেষ অভিনয় পর্যন্ত পঁয়ত্রিশ বছরের নাট্যসফরে লিখেছেন ২৫টি নাটক অভিনয়ও করেছেন প্রায় সবকটি নাটকে নিজের নাটক ছাড়াও উৎপল দত্তের তিতাস একটি নদীর নামনাটকেও অসামান্য অভিনয় করেছেন জনমনোরঞ্জনী সিনেমার বাইরে যে প্যারালাল সিনেমা সেখানে ঋত্বিক ঘটকের বাড়ি থেকে পালিয়ে’, ‘সুবর্ণরেখা’, ‘মেঘে ঢাকা তারা’, ‘যুক্ত তক্ক গল্পমৃণাল সেনের পদাতিক’,বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের দূরত্ব’, ‘ভোলা ময়রা’, ‘অর্জুনপ্রভৃতি চলচ্চিত্রে তাঁর অসামান্য অভিনয়ের সাক্ষর আছে

তাঁর এই পঁয়ত্রিশ বছরের নাট্য-সফরে বিজন ভট্টাচার্য মুখোমুখি হয়েছেন নিজের বিষন্নতার সঙ্গে, সাংগঠনিক মতান্তর, নানান দ্বিধাদ্বন্দ্বের সঙ্গে দল ছেড়েছেন, দল গড়েছেন সস্তা জনপ্রিয়তার মোহ তাঁকে স্পর্শ করতে পারেনি, সরে যাননি গণনাট্যের আদর্শ থেকে শত দ্বিধা-দ্বন্দ্বের মধ্যেও তিনি মানুষের জীবনযন্ত্রণা খুঁজতে গিয়ে শোষণের স্বরূপ শোষক ও শোষিতের সম্পর্ক খুঁজেছেন এবং সঙ্ঘবদ্ধ জনশক্তির ওপর আস্থা রেখেছেন, নাট্য রচনায় জীবন-ভাবনার গভীরতর অন্বেষণ থেকে বিরত হননি কখনও আমৃত্যু মার্ক্সীয় জীবনদর্শনে আস্থাশীল বিজন বলেছেন নিছক রাজনীতি প্রভাবিত কোন শিল্পকর্মই কিন্তু শিল্পের পর্যায়ে ওতরাবে না ইমোশন ও ভাবরাজ্যে যার আনাগোনা, সেখানে সবসময় লাঠিবাজি চলে না মিষ্ঠিবদ্ধ আস্ফালননেক সময়েই জলো বলে মনে হয়, আবেদন নিবেদন সাধারণ মানুষের অন্তরে পৌছয় না... শিল্পীকে জনদুঃখের সঙ্গে জড়িয়ে থেকে বহু আয়াসে আয়ত্ত করতে হয় ...... জনসাধারণের সঙ্গে থেকে তাদের চোখ দিয়ে দেখা, আবার শিল্প সৃষ্টির সময় এ জনজীবনের বাইরে এসে শিল্পীর চোখে দেখা, যুগপৎ এই দর্শন-প্রকরণের ভেতর দিয়েই সত্য নিরুপন করা সম্ভব একথা বলতেও তাঁর কোন দ্বিধা ছিলনা কমিউনিস্ট পার্টিই আমাকে নাট্যকার করেছে

আমৃত্যু এই বিশ্বাস নিয়ে বিজন ভট্টাচার্য তাঁর মৌলিক সৃষ্টিকে কালের চাকা হিসেবে গড়িয়ে দিয়েছিলেন  আগামী, দেশকাল ও সময়ের দিকে বিজন ভট্টাচার্যের অবদান তাঁর এই মৌলিক রচনার মধ্যে  নবান্ন-পরবর্তীকালে আমরা দেখেছি, বিদেশি নাটকের অনুবাদ, ভাবানুবাদ, ছায়ানুসরণ বঙ্গীয় নাট্য-আন্দোলনের বড়মাপের একটি জায়গা দখল করে রেখেছিল তিনি কিন্তু মৌলিক নাটকই রচনা করেছেন এবং সেইসব নাটকের কথাবস্তু, চরিত্র,দ্বন্দ্ব,সংলাপ,সবই এই বাংলার মাটি থেকে উঠে এসেছে  বিশ্বাস করতেন মানুষের কল্যাণে রুটির লড়াইয়ের সঙ্গে প্রাণের লড়াইকে একসূত্রে বেঁধে নাট্য-আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়াই গণনাট্যের মর্মকথা। মানুষের প্রতি বিশ্বাস ও শিল্পকর্মের প্রতি একনিষ্ঠ শ্রদ্ধাই গণনাট্য শিল্পীকে স্ব-মহিমায় প্রতিষ্ঠা দিতে পারেএই প্রত্যয়-ই জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তাঁর শিল্পীজীবনকে নিয়ন্ত্রিত করেছিল প্রয়াত ঋত্বিক ঘটক বিজন ভট্টাচার্যর মূল্যায়ন করেছিলেন এইভাবে – “ আমি উত্তরোত্তর মঞ্চজগৎ থেকে সরে গেছি কিন্তু এটা আমি জানি যে তিনি কখনও থেমে থাকেননি তার একটাই মাত্র পুঁজি, সেটা হচ্ছে শুভ্র সততা কাজেই যখন যে সমস্যা তাঁকে আলোড়িত করে তার মধ্যে তিনি গভীরভাবে ডুবে যান  সবই যে উৎরোয়, একথা বলা সত্যের অপলাপ হবে কিন্তু তাঁর মত এমন মুক্ত মন নিয়ে সারাজীবন ধরে নাট্যচর্চা করতে বাংলাদেশে আমি অন্তত কাউকে দেখিনি ... ভদ্রলোক চালাকি শেখেননি” (‘বিজন ভট্টাচার্য : জীবনের সূত্রধর’ – ঋত্বিক ঘটক (নাট্যদর্পণ’/ দিল্লি মে ১৯৭৫)জীবনের উপান্তে পৌঁছে ১৯৬৭তে, তখনও তিখে চলেছেন, অভিনয় করছেন লিখেছেন আজও স্বপ্ন দেখি খরা পোড়া ঊষর প্রান্তরে এক কোণে চুপ করে বসে সমুদ্যত সহস্র কাস্তের মুখে ধান কাটার কান শুনি লে-অফ আর লকআউট অভিশপ্ত ফ্যাক্টরি গেটের সামনে দাঁড়িয়ে যন্ত্রমন্ত্রে চৌদুনি উৎপাদনের অর্কেস্ট্রা বাজাই চারণের আর কি কাজ থাকতে পারে”!

১৯৭৮এর ১৮ই জানুয়ারি কলকাতার মুক্তাঙ্গণ মঞ্চে মরাচাঁদনাটকের প্রধান চরিত্রে আর পরের দিন ১৯শে জানুয়ারি চিরদিনের জন্য বিদায় নিলেন জীবনের মঞ্চ থেকে প্রগতিনাট্যের প্রথম পুরোহিত বিজন ভট্টাচার্য সেই চারণের ফেরি করা স্বপ্ন আজও দেখে চলেছেন প্রগতি নাট্যের দায়বদ্ধ কর্মীরা




শম্ভূ মিত্র যিনি নির্মাণ করলেন আধুনিক ভারতীয় থিয়েটারের রূপরেখা
     
থিয়েটার দলগত শিল্প আমরা জানি তবুও ব্যক্তি তার অনন্য প্রতিভার গুনে থিয়েটারে যুগচিহ্ন হয়ে যান কখনো কখনো, তাও আমরা জানি বাংলা থিয়েটারের আড়াইশবছরের পরম্পরায় একটা দীর্ঘ সময়কে গিরিশ যুগএবং তার পরের সময়কালটিকে শিশির যুগবলে চিহ্নিত করি শিশির যুগের শেষ লগ্নে এলেন আধুনিক ভারতীয় থিয়েটারের অনন্য প্রতীভা শম্ভু মিত্রতবুও অসামান্য নাট্য ব্যক্তিত্ব শম্ভু মিত্র বাংলা থিয়েটারে যুগচিহ্ন হয়ে ওঠেন নি , হওয়ার কথাও ছিল না বরং বলা যায় এবং সঠিক ভাবেই আমরা বলি গত শতকের চল্লিশের দশকটিকে গণনাট্যের যুগ ব্যক্তি-অভিনেতা কেন্দ্রিক পেশাদারী থিয়েটারের তখন ক্ষয়-কাল ১৯৫০এ বহুরূপী প্রতিষ্ঠা উত্তর সময়কে নবনাট্যের যুগ বলেও অনেকেই চালাতে চেয়েছিলেন তা ছিল নিতান্তই সাময়িক, তেমনই গণনাট্যের মোর্চাও ভেঙে যায় বটে পঞ্চাশের শুরুতেই কিন্তু শিশির ভাদুড়ি পরবর্তী সময়কালটি বাংলা থিয়েটারে শম্ভুমিত্র যুগহয়ে ওঠেনি বরং শম্ভুমিত্রই তাঁর বহুরূপী প্রতিষ্ঠা এবং বহুরূপীর পথ ধরেই অনেক নাট্যগোষ্ঠীর আবির্ভাবের মধ্যদিয়ে যে নাট্যপ্রবাহের সূচনা হয়েছিল, তাকে নবনাট্য আন্দোলনঅভিধা দিয়েছিলেন

ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষা প্রথম বিভাগে পাশ করার পর ভর্তি হয়েছিলেন সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে  ছেড়ে দিলেন মনে করেছিলেন কলেজে পড়া সময়ের অপচয়, মনে হয়েছিল এর চেয়ে কম সময়ে অনেক বেশি পড়া যায় অর্থাৎ ডিগ্রি অর্জন নয় জ্ঞানার্জন হয়ে উঠলো তাঁর অভীষ্ট পিতা শরতকুমারকে একথা বলেছিলেন বলেছিলেন পড়াশোনা করে কিছু হয় না পিতা শরৎকুমার তাঁর দুই পুত্রকেই  বলেছিলেন তোমাদের জীবন তোমাদের নিজেদের, পড়াশোনা করবে কি করবে না, কেমন করে বাঁচবে, সে তোমরা নিজেরা ঠিক কোর

শিশির কুমার ভাদুড়ীর নাট্যজীবন নিয়ে লেখা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর উপন্যাসের নামকরণ করেছিলেন নিঃসঙ্গ সম্রাট বাংলা থিয়েটারের অসামান্য ব্যক্তিত্ব শম্ভু মিত্রও তো তাইই, আর এক নিঃসঙ্গ সম্রাট পেশাদারি থিয়েটারের অবক্ষয়ের শেষ পর্যায়ে শম্ভু মিত্র থিয়েটারে এসেছিলেন ১৯৩৯এ, শিশির কুমারের দলে যোগ দিলেন শিশির কুমার ভাদুড়ীর থিয়েটার তাকে ছুঁতে পারলো না, চলে এলেন চল্লিশের দশকে এলো শিল্প-সাহিত্য সৃজনের এক ক্রান্তিকাল, গণনাট্য সঙ্ঘের নেতৃত্বে রচিত হল  থিয়েটারের উর্বর সৃজনভুমি, আকর্ষণ করলো শম্ভু মিত্রকে পাঁচ বছর পরে, তিনি মনে করলেন শিল্প-সাহিত্য সৃষ্টিতে কোন মতাদর্শের নিয়ন্ত্রণ শিল্পীর স্বাধীনতার পরিপন্থী অতয়েব সরে গেলেন গণনাট্য আন্দোলনের প্রবল বিরোধিতা করে চলচ্চিত্র পরিচালনা ও অভিনয় করেছিলেন কিন্তু সেখানেও থাকেননি নিজের সন্তানতুল্য বহুরূপীযা আগের আশি বছরের প্রবহমান পেশাদারী থিয়েয়েটারের ধ্যান ধারণাকে দুমড়ে মুচড়ে নবতর থিয়েটার ভাবনার দিকদর্শন ঘটিয়েছিল সেই বহুরূপীতেও থাকতে পারেন নি, সরে এসেছিলেন এমনকি বহুরূপীতে অনভিপ্রেতবলে চিহ্নিত হয়ে ছিলেন সহধর্মিনী তৃপ্তির সঙ্গেও দূরত্ব তৈরী হয়েছিল, একে অপরের কাছ থেকে সরে গিয়েছিলেন জাতীয় নাট্যশালা চেয়েছিলেন, পান নি কিছু প্রতিষ্ঠিত নাট্য দলকে একত্রিত করে নিজেদের নাট্যশালার নির্মাণ করতে চেয়েছিলেন তাও পারেন নি যে থিয়েটারের কল্পনা শম্ভু মিত্র করেছিলেন তা অধরাই থেকে গিয়েছিল সেই অধরা স্বপ্ন বুকে নিয়ে, একরাশ অভিমান নিয়ে তিনমাস আগে লেখা আপন ইচ্ছাপত্র অনুযায়ী, অগণিত অনুরাগীদের শেষ শ্রদ্ধা জানানোর সুযোগ না দিয়ে নীরবে চলে গিয়েছিলেন আধুনিক বাংলা থিয়েটারের নিঃসঙ্গ সম্রাট

কি চেয়েছিলেন শম্ভু মিত্র? চেয়েছিলেন জাতীর জন্য একটা নাট্যশালা , অন্যধারার থিয়েটারের কাজের জন্য একটা  নিজস্ব স্থান শিশির কুমার ভাদুড়ীও চেয়েছিলেন জাতীয় নাট্যশালা রাষ্ট্রের কাছে শম্ভু মিত্র চাননি রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে জাতীয় নাট্যশালা হোক সন্মার্গ সপার্যাগ্রন্থে তাঁর স্বপ্নের কথা লিখে রেখেছেন এইভাবে বাংলার নাট্যকর্মীদের এখন অনেক কিছু করার বাকি আছে তুচ্ছ দলাদলির উর্ধে উঠে তাকে বাংলা নাট্যের মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করতে হবে এমন একটা নাট্যভঙ্গি আয়তেও করতে হবে যা একেবারে ভারতের, একেবারে বাঙালীর বিশ্বাস করেছিলেন জাতি তার নিজের নৈতিক জোরে জাতীয় রঙ্গমঞ্চ তৈরি করে নেবেবাঙালি শম্ভু মিত্রকে বিশ্বাস করে নি কেন করেনি সে অন্য প্রসঙ্গ শুধু একটা নাট্যমঞ্চের নির্মাণই তো তাঁর অভিপ্রায় ছিলনা, সমস্ত রকম শিল্পের চর্চা হতে পারে এমন একটা সংস্কৃতি কেন্দ্র নির্মাণই ছিল তাঁর স্বপ্ন আর সেই স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করার জন্য ১৯৬৮ থেকে ১৯৭৮, দশটা বছর অক্লান্ত প্রয়াস চালিয়েছিলেন, এই প্রয়াস বহুরূপীর সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক আলগা হয়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ হয়ে ওঠা সত্বেও ১৯৬৮তে শম্ভু মিত্র প্রতিষ্ঠা করেন বাংলা নাটমঞ্চ প্রতিষ্ঠা সমিতি বহুরূপী ছাড়াও সেই সময়ের অনেক প্রতিষ্ঠিত নাট্যদল অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের নান্দীকার’, সবিতাব্রত দত্তর রূপকার’, ‘গান্ধার’, বিভাষ চক্রবর্তী অশোক মুখোপাধ্যায়ের থিয়েটার ওয়ার্কশপপ্রদা, শ্যামানন্দ জালানএর অনামিকা সম্মিলিত অভিনয়, নাট্যোৎসব ও চাঁদা তুলে প্রায় তিনলক্ষ টাকাও সংগৃহীত হয়েছিল শম্ভু মিত্রর জাতীয় নাট্যশালানির্মাণের স্বপ্ন সার্থক হয় নি সরকারের কাছ থেকে এক খন্ড জমি না পাওয়াই একমাত্র কারণ ছিল না থিয়েটার ছাড়া আর কিছুই চাননি রাষ্ট্রীয় সম্মান, বিশ্বভারতীর দেশিকোত্তম’ ‘পদ্মভূষণকিংবা ম্যাগসেসাই পুরস্কারতাঁর কাছে গুরুত্বহীন ছিল তিনি চেয়েছিলেন থিয়েটার পাননি পেয়েছেন একদা কাছের মানুষদের আছ থেকে অসন্মান, অবিশ্বাস তাঁর থিয়েটারের স্বপ্নচুরমার হয়ে যেতে দেখেছেন জানা যাবেনা, কোন অভিমানে মৃত্যুর তিনমাস আগে অন্তিম ইচ্ছাপত্রে লিখে গিয়েছিলেন তাঁর শবদেহ যেন সাধারণের জন্য প্রদর্শিত না হয় , কারো কাঁধে চেপে নয়, শবদেহ যেন  মৃত্যুর অব্যবহিত পরে কোন আড়ম্বর বা প্রথা না মেনে সোজা স্মশান ঘাটে নিয়ে যাওয়া হয় তাঁর অগনিত অনুরাগী বাংলা থিয়েটারের একলা রাজার মৃত্যু সংবাদ জেনেছিল একদিন পরে সংবাদ পত্র পাঠ করে

কিন্তু অভিনেতা, নাট্যপরিচালক শম্ভু মিত্রকে অস্বীকার করবে কে? কেই বা স্পর্শ করতে পারবে নাট্যসংলাপ প্রক্ষেপন কিংবা বাংলা কবিতা পাঠের উচ্চারণে শম্ভু মিত্রর উচ্চতা? আমাদের কৈশোরের ১৯৫০এর দশক বাঙালি মননের সে এক আশ্চর্য সৃজনকাল ১৯৫১তে চার অধ্যায়এর পর ১৯৫৩তে শম্ভু মিত্র করলেন রক্তকরবী’, ১৯৫৪তে মুক্তি পেল পথের পাঁচালী’, ১৯৫৯এ মিনার্ভায় উৎপল দত্তর অঙ্গার’, ১৯৬০এ অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রতিষ্ঠিত নান্দীকারের নাট্যকারের সন্ধানে ছটি চরিত্র শিল্প-সাহিত্যের সেই ঊর্বর মননভুমিতে রক্তকরবীর রাজার অভিনয় দেখা কিংবা সামনে বসে মধুবংশীর গলিআবৃত্তি শোনার সেদিনের উত্তেজনা ষাট বছর পরে কিভাবেই বা ভাগ করে নেবো? শম্ভু মিত্রই আমাদের চেনালেন নাটকের রবীন্দ্রনাথকে বাংলা মঞ্চে ব্রাত্য হয়ে থাকা রবীন্দ্র-নাট্য প্রযোজনার পথ উন্মোচন করলেন শম্ভু মিত্র তারপর একে একে চার অধ্যায়’, ‘ডাকঘর’, ‘মুক্তধারা নিয়ে এলেন ইবসেনের পুতুল খেলা’, সোফোক্লেশের রাজা ওয়াদিপাঊস’, বিজয় তেন্ডুলকারের চুপ আদালত চলছেইত্যাদি

শম্ভু মিত্রর কথা বলতে গেলে তাঁর বহুরূপীআর বহুরূপীর প্রথম নাট্য প্রযোজনা রক্ত করবীর কথা আসবেই অবধারিত ভাবে রবীন্দ্রনাথের জীবদ্দশায় রক্তকরবীর কোন মঞ্চায়ন হয়নি তাঁর মৃত্যুর ১৩ বছর পরে শম্ভু মিত্র রক্তকরবী নিয়ে বাংলা মঞ্চে অভিনয়, দৃশ্য রচনা নাট্য আবহ রচনা ও প্রয়োগ ভাবনায় নবতর দিগন্তের উন্মোচন ঘটালেন আর উত্তরসুরিদের বলে গেলেন মঞ্চে রবীন্দ্রনাট্যও করা যায়আজও কোন নাট্যজন রক্তকরবীরকথা ভাবলে শম্ভু মিত্রর কথা তাঁর মনে আসবেই, এমনই কিংবদন্তী হয়ে আছে শম্ভু মিত্র আর রক্তকরবী রক্তকরবীপড়ার সুবাদে আমরা জানি এতে সাধারণ মঞ্চ নাটকের মত কোন ঘণবদ্ধ নাট্য-কাহিনীক্রম নেই, নেই কোন নাট্য ও মঞ্চ নির্দেশ, মঞ্চ নাটকে যেমন থাকে সমস্ত নাটকটি, যেন এক অমোঘ কবিত্বের আকর্ষণে বাঁধা সেই রক্তকরবী শম্ভু মিত্রর অসামান্য নাট্যপ্রয়োগ গুনে বাংলা থিয়েটারের মাইল ফলক হয়ে গেল তারই সমকালীন নাট্য ব্যক্তিত্ব উৎপল দত্ত বলেছেন আসলে শম্ভুবাবুর সূক্ষ্ম রসবোধ ও প্রয়োগ কৌশলের অভিনবত্ব এমন এক নাটক সৃষ্টি করেছে যা বাংলা রঙ্গমঞ্চের প্রকৃত ঐতিহ্যকে ধরে, তাকে কয়েক ধাপ এগিয়ে নিয়েছে বিগত পঁচিশ বছরে বাংলা দেশে কোন নাটক এ করতে পেরেছে বলে আমার জানা নেই উৎপল দত্ত এ মন্তব্য করেছিলেন ১৯৫৬তে নিশ্চতভাবেই শম্ভূ মিত্র হয়ে উঠলেন আধুনিক ভারতীয় থিয়েটারের রূপরেখার নির্মাতা

তিনি ছিলেন পরিপূর্ণ থিয়েটারের মানুষ জীবনের উপান্তে পৌছে এক সাক্ষাৎকারে, শম্ভু মিত্র বলেছিলেন আমি যা কিছু করেছি, যা কিছু ভেবেছি, যা কিছু পড়েছি, সবই থিয়েটারের জন্যে চলচ্চিত্রের অভিনয় তাঁকে টানেনি মোটেই যদিও বিয়াল্লিশ’,’পথিক’ ‘শুভ বিবাহ’, ‘মাণিক’, ‘বঊ ঠাকুরানীর হাট’, ‘কাঞ্চন রঙ্গএই ছটি বাংলা চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছিলেন রাজ কাপুর তাকে বলে ছিলেনআমি পরিচালনা করবো, আমার ছবিতে আপনি অভিনয় করুনশম্ভু মিত্র বলেছিলেন না আপনি অভিনয় করুন, আমি পরিচালনা করবো তাই হয়েছিল, নির্মিত হয়েছিল দারুণ সফল সিনেমা জাগতে রহো

অথচ, সেই শম্ভু মিত্র থিয়েটার থেকেই সরে এলেন ১৯৬৭র পর থেকেই তাঁর সঙ্গে বহুরূপীর সম্পর্ক আলগা হয়ে পড়ে ১৯৬৭তে বাদল সরকারের বাকি ইতিহাসএর পর বহু্রূপীতে তাঁর পরিচালনায় কোন সাড়া জাগান প্রযোজনাই হয় নি  বিশিষ্ট নাট্য গবেষক ও প্রাবন্ধিক শমীক বন্দ্যোপাধ্যায় সম্প্রতি একটি নিবন্ধে মন্তব্য করেছেন শম্ভুবাবু প্রবল অভিমানে নিজেকে আক্রান্তবিবেচনা করে নিজেকে থিয়েটার থেকে ক্রমেই দূরে সরে যেতে থাকলেন ক্রমে তাঁর নাট্যদলও পালটে গেল, ... শম্ভুবাবুর থিয়েটার পনেরো বছরের মধ্যেই শেষ কার্যত শেষ বহুরুপীর পরিচালক হিসাবেও নিজেকে সরিয়ে নিলেন এই সময় থেকে, যদিও ১৯৭১ পর্যন্ত কাগজে-কলমে তিনিই ছিলেন বহুরূপীর নাট্য পরিচালক ১৯৭১এ তাঁর নির্দেশনায় অভিনীত হয়য় চুপ আদালত চলছে’ !  ১৯৬৮র পরের প্রায় দশ বছর শম্ভু মিত্র প্রাণপাত করেছিলেন জাতীয় রঙ্গমঞ্চস্থাপনের লক্ষ্যে নাটমঞ্চ প্রতিষ্ঠা সমিতির ব্যানারে অভিনয় করেছেন রাজা ওয়াদিপাউস’ ‘দশ চক্র’, ‘গ্যালিলিওর জীবনঅজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরিচালনায় মুদ্রা রাক্ষস কিন্তু বহুরূপীর সঙ্গে তাঁর প্রতিষ্ঠাতার সম্পর্ক স্বাভাবিক হয়নি ১৯৭৮এর জুন মাসে বহুরূপীর সঙ্গে তাঁর বিচ্ছেদ সম্পূর্ণ হয় বলা ভালো, ‘বহুরূপীই তাঁর প্রতিষ্ঠাতাকে বিসর্জন দিয়েছিল দলটির কার্যকরী সমিতি সিদ্ধান্ত নিয়েছিল শম্ভু মিত্র বহুরূপীতে অনভিপ্রেত’, তাঁকে আর ফিরিয়ে আনার প্রয়াস করা হবে না (তথ্য সূত্র- শম্ভু মিত্রঃবিচিত্র জীবন পরিক্রমা / শাঁওলী মিত্র) ১৯৭৯র সেপ্টেম্বরে বহুরূপী মৃচ্ছকটিকপ্রযোজনা করে শম্ভু মিত্র তখন বহুরূপীর নতুন প্রজন্মের কাছে অনভিপ্রেত তাঁর পরম প্রিয় শিষ্য কুমার রায় গোপনে একটা টিকিট কেটে তখন প্রায় দৃষ্টি শক্তিহীন শম্ভু মিত্রকে প্রেক্ষাগৃহে বসিয়ে দিয়েছিলেন সংগঠন তাঁকে আমন্ত্রণ জানায় নি (তথ্যসূত্রঃঐ) তথ্যটি উল্লেখ করা এই জন্য যে, আমরা জানতে পারি কি অনাদর, অসম্মান অপেক্ষা করছিল এই প্রবল আত্মমর্যাদা সম্পন্ন নাট্যপুরুষটির প্রতি নিজ উত্তরসুরীদের কাছ থেকে !

নিজেকে আক্রান্ত মনে করা অতয়েব অমূলক ছিল না হয়তো, সঙ্গত অভিমানেই মৃত্যুর তিনমাস আগে অন্তিম ইচ্ছাপত্রেলিখে গিয়েছিলেন “......মৃত্যুর পর  যত দ্রুত সম্ভব যেন আমাকে সোজা পোড়ানোর যায়গায় নিয়ে যাওয়ার বন্দোবস্ত করা হয় দেহটা যেন রবীন্দ্রসদন ইত্যাদির মত কোন সাধারণ স্থানে প্রদর্শিত না হয়, পথে ঘোরানোও যেন  না হয় .... কারোর কাঁধে চড়ে যেতে চাই না কোন গাড়ীতে নিয়ে যাওয়াই ভালো ... আমি সামান্য মানুষ, জীবনে অনেক জিনিস এড়িয়ে চলেছি তাই মরবার পরেও আমার দেহটা যেন তেমনি নীরবে, একটু ভদ্রতার সঙ্গে, সামান্য বেশে, বেশ একটু নির্লিপ্তির পুড়ে যেতে পারে ......

১৮ই মে রাত্রি ২টা ১৫ মিনিটে শেষ নিঃশ্বাস ফেললেন আর সেই রাত্রেই কন্যা শাওলী আর গুটিকয় নিকট জনের উপস্থিতিতে নীরবে অগণিত অনুরাগী ও গুনমুগ্ধদের শেষ শ্রদ্ধার সুযোগ না দিয়ে স্মশানের বৈদ্যুতিক চুল্লিতে ঢুকে গেলেন শম্ভু মিত্র আধুনিক বাংলা থিয়েটারের একলা রাজা



উৎপল দত্ত রাজনৈতিক থিয়েটারের পথিকৃত ও শিক্ষক
     

অমি শিল্পী নই নাট্যকার বা অন্য যে কোন আখ্যা লোকে আমাকে দিতে পারে তবে আমি মনে করি আমি প্রোপাগান্ডিস্ট এটাই আমার মূল পরিচয় এমন স্পষ্ট ঘোষণায় যিনি তাঁর চরিত্রের বিনয় ও বিদ্যা, প্রত্যয় ও প্রতিজ্ঞাকে সারা জীবন সর্বত্র পরিচিত করেছেন, তিনি গত শতাব্দীর এবং এখনও এই ভূখন্ডের বাংলা তথা ভারতীয় থিয়েটারের বলিষ্ঠ ও বরিষ্ঠতম রূপকার নাটকে শেকসপিয়ার, দর্শনে মার্কসবাদ এবং নাটকে জনগণ তাঁর কাছে ছিল ধ্রুব নক্ষত্র সম তিনি উৎপল দত্ত, আধুনিক ভারতীয় থিয়েটারের আকাশচুম্বী নাট্য ব্যক্তিত্ব

জন্ম ২৯শে মার্চ ১৯২৯ বরিশালে উৎপল নিজে নাকি বলতেন তাঁর জন্ম শিলং শিলং ছিল তাঁর মাতুলালয় পুরো নাম- উৎপলরঞ্জন দত্ত, প্রসিদ্ধি উৎপল দত্ত নামে পিতা গিরিজারঞ্জন দত্ত ছিলেন বঙ্গবাসী কলেজের ইংরাজির অধ্যাপক, মাতা শৈলবালা বিবাহ ১৯৬০এর মার্চে, একমাত্র কন্যা বিষ্ণুপ্রিয়ার জন্ম ১৯৬১তে

শৈশবে পড়াশোনা শুরু শিলংএর সেন্ট এডমন্ডস স্কুলে, তারপর সেন্ট জেভিয়ার্স স্কুল ও কলেজে নাটক সম্পর্কে আগ্রহের জন্ম স্কুল জীবনেই  সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে পড়ার সময় গড়েন নিজের নাট্যদল শেক্সপিরিয়ানস’, প্রযোজনা করতেন শেক্সপিয়ারের ইংরাজি নাটক কলকাতার পেশাদারি থিয়েটারে তখন ক্ষয়ের কাল শিশিরকুমার ভাদুড়ী, অহীন্দ্র চৌধুরী, নরেশ মিত্র, ভুমেন রায়, প্রভা দেবীদের সেই থিয়েটার কখনোই প্রভাবিত করতে পারেনি উৎপল দত্তকে ভালো নাটক প্রযোজনা ও অভিনয়ের  আকর্ষণে এবং নাট্য-প্রয়োগরীতির অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের তাগিদে যোগ দিলেন জিওফ্রে কেন্ডালের ভ্রাম্যমান বৃটিশ নাট্যদল ইন্টারন্যাশনাল শেক্সপিরিয়ান

শেক্সপিয়ার চর্চার মধ্য দিয়ে উৎপল দত্তর নাট্যজীবনের শুরু হলেও  কলেজ জীবন থেকেই মার্কসবাদী রজনৈতিক বিশ্বাসে অনুপ্রাণিত হন সলিল চৌধুরী তাঁকে নিয়ে এলেন গণনাট্য সঙ্ঘে সেখানে অবশ্য তিনি বেশিদিন থাকেননি ১৯৫৩-৫৪তে আবার কেন্ডালের দলের সঙ্গে ভারতের নানা শহরে ঘোরেন ইতিমধ্যে নিজের দলের নাম পরিবর্তন করে লিটল থিয়েটার গ্রুপবা এল টি জি রাখেন এল টি জিও প্রথমের দিকে ইংরাজী নাটকের প্রযোজনা করতো কিন্তু তাতে তো আর বৃহত্তর জনমন্ডলীর কাছে নাটককে পৌছানো যেত না এই উপলব্ধি থেকে তারা বাংলা নাটক প্রযোজনার কথা ভাবলেন শেকসপিয়ার, ইবসেন, চেকভ প্রমুখের নাটকের ভাষান্তরের সঙ্গে গিরিশচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, মধুসূদনের নাটকও প্রযোজনা করতে থাকলেন

এই পর্যন্ত উৎপল দত্তর প্রধান পরিচয় দক্ষ অভিনেতা ও সুযোগ্য পরিচালক ১৯৫৯এ বাংলা থিয়েটার পেলো অন্য এক উৎপলকে নাট্যকার উৎপল দত্ত ১৯৫৯এর জুনে লিজ নিলেন মিনার্ভা থিয়েটার তখনকার থিয়েটারের পেশাদারী বন্দোবস্তে বিরাট ঝুঁকি নিয়েছিলেন উৎপলপ্রথম নাটক ছায়ানট দ্বিতীয় নাটক অঙ্গারপ্রযোজনার মধ্য দিয়ে বাংলা মঞ্চে নাট্যপ্রয়োগের সমস্ত ধ্যান-ধারণা যেন ওলোট-পালট করে দিল নাট্যপ্রয়োগ, আলো, মঞ্চস্থাপত্য, অভিনয় সব মিলিয়ে কলকাতার নাট্যমহল পেল এক অনাস্বাদিত অভিজ্ঞতা তারপর একে একে বিপুল সব প্রযোজনা ফেরারী ফৌজ’, ‘তিতাস একটি নদীর নাম’, ‘কল্লোল’, ‘মানুষের অধিকারে’, ‘তীর’, ‘অজেয় ভিয়েতনাম মিনার্ভা পর্বে  দুবার ভারতরক্ষা আইনে গ্রেপ্তার বরণ করেন (১৯৬৫ ও ১৯৬৭) ১৯৬৭তে মিনার্ভা ছেড়ে দিতে হয়, ৭১এ দলের নামকরণ করেন পি এল টি বা পিপলস লিটল থিয়েটার এই পর্বের অসাধারণ প্রযোজনাগুলির মধ্যে রয়েছে টিনের তলোয়ার', ‘সূর্যশিকার’, ‘ব্যারিকেড’, ‘দুঃস্বপ্নের নগরী’, ‘এবার রাজার পালা’, ‘তিতুমীরপ্রভৃতি

কি ছিলেন উৎপল দত্ত? নাট্যকার-পরিচালক-অভিনেতা? না, কোন একটি পরিচয়ে উৎপল দত্তকে ধরা যায় না নাট্যকার-নাট্য পরিচালনা ও অভিনয় জীবনে উৎপল দত্ত যা কাজ করেছেন তার বিশালতা অতলান্ত সমুদ্রের মত মঞ্চে ওথেলোথেকে একলা চলো রে’, বাংলা চলচ্চিত্রে মাইকেল মধুসূদনথেকে আগন্তুক’, হিন্দি চলচ্চিত্রের দাপুটে অভিনেতা, যাত্রা পালার মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া নির্দেশক, কিংবা বিশ্বনাট্য সাহিত্যে অগাধ পান্ডিত্য যার সেই মানুষটি বিশ শতকের বাংলার নাট্যক্ষেত্রের সর্বাধিক প্রভাবশালী নাট্যব্যক্তিত্ব রূপে স্মরণীয় থাকবেন চিরকাল

উৎপল দত্তর মত অতলান্ত পান্ডিত্য ও প্রতিভার মানুষের বহুমাতৃক সৃজনশীলতা একটি মাত্র লেখায় ছুঁয়ে যাওয়াও বাতুলতা সত্য তবুও তাঁর সৃজনশীলতার একটি দিককে ছুঁয়ে যেতেই হবে, তা হল এদেশে উৎপল দত্তই ছিলেন রাজনৈতিক পথনাটকের সার্থক পথপ্রদর্শক মার্কসবাদী দর্শনে দীক্ষিত উৎপল দত্তর কাছে পথনাটক ছিল সরাসরি জনতাকে রাজনৈতিক চেতনার শিক্ষিত করার মাধ্যম তিনি বিশ্বাস করতেন পথনাটিকা হচ্ছে সেই মাধ্যম যেখানে লক্ষ মেহনতি মানুষের রাজনোইতিক চেতনা ও অভিনেতার রাজনৈতিক উপলব্ধি এক হয়ে বিস্ফোরিত হয় মঞ্চে”(‘উৎপল দত্ত-জীবন ও সৃষ্টি’ / অরূপ মুখোপাধ্যায়) এই বিশ্বাসে বলীয়ান উৎপল তাঁর চল্লিশ বছরের রাজনৈতিক থিয়েটারে পরিক্রমায় পঁচিশটি পথনাটক রচনা ও অভিনয় করেছেন ১৯৫১তে লিখেছিলেন পাশপোর্ট দেশবিভাগের সাম্প্রদায়িক চক্রান্ত  ও ও দুই বাংলার মানুষের তীব্র বেদনা ও যন্ত্রণা প্রকাশ পেয়েছিল পাশপোর্টপথ নাটিকায় পরিবেশন করেছিলেন উৎপল দত্ত ও সম্প্রদায়এই নামে রাজনৈতিক প্রচার ও শিক্ষার জন্যই তিনে পথনাটককে হাতিয়ার বানিয়েছিলেন তাতে কোন রাখঢাক ছিলনা তাঁর তাই সোচ্চারে বলেও ছিলেন আমি মনে করি আমি প্রোপাগান্ডিস্ট এটাই আমার মূল পরিচয়তিনি মনে করতেন আদর্শের প্রচার ছাড়া শিল্পের আর কিছু করণীয় নেই

১৯৬১তে উত্তরপাড়ায় বিড়লার হিন্দমোটর কারখায় শ্রমিক ধর্মঘট ভাংতে সরকারের সাহায্য নিয়ে বিড়লারা বিশেষ ট্রেনে পুলিশ ধর্মঘট ভাঙ্গার জন্য গুন্ডাবাহিনী নিয়ে উৎপল দত্ত লিখলেন স্পেশাল ট্রেনমিনার্ভায় তখন অঙ্গারচললে তুমুল লোকপ্রিয়তায় সেই ব্যস্ততার মধ্যেও উৎপল দত্ত মাঠে-ময়দানে স্পেশাল ট্রেনপরিবেশন করতেন আমার কৈশোরে দেখা সেই স্মৃতি আজও অমলিন ১৯৫১তে যখন প্রথম পথনাটিকা পাশপোর্টতখনও তিনি গণনাট্য সঙ্ঘে যোগ দেননি তারপর নয়া তুঘলক’ (১৯৫৫),গেরিলা’(১৯৬৪),সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব’((১৯৬৪),সমাজতান্ত্রিক চাল’(১৯৬৪,নাটকটি বাজেয়াপ্ত হয় এবং উৎপল দত্ত ও নাটকটির প্রকাশক জ্যোছন দস্তিদার ভারতরক্ষা আইনে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন ), ‘দিন বদলের পালা’(১৯৬৭), ‘বর্গী এলো দেশে’(১৯৭২),কালো হাত (১৯৭৯), মালোপাড়ার মা(১৯৮৩),সত্তর দশক(১৯৯১) প্রভৃতি পথনাটিকা বাংলা রাজনৈতিক নাটকের ভান্ডারে সম্পদ হয়ে আছে

মাত্র ৬৪ বছরের আয়ুকাল ছিল তাঁর ১৯শে আগস্ট ১৯৯৩এ মৃত্যুর কয়েকদিন আগে পর্যন্ত সক্রিয় ছিল তাঁর নাট্যভাবনা  ১৯৮৮ থেকেই তাঁর স্বাস্থ্য ভেঙ্গে যায় কিন্তু ভগ্ন স্বাস্থ্য নিয়েও মঞ্চে ও সিনেমায় অভিনয় করে গেছেন অসুস্থ্য অবস্থাতেও ১৯৯২এ আগুন্তুকচলচ্চিত্রে জীবনের অন্যতম সেরা অভিনয়ের স্বাক্ষর রেখে গিয়েছেন ১৯৯৩এর গোড়া থেকে যখন কিডনির অসুখে সপ্তাহে তিনদিন ডায়ালিসিস করাতে হত তখনও মঞ্চে ও সিনেমায় অভিনয় করেছেন, গ্রন্থ রচনা করেছেন শেষ নাট্যাভিনয় ৯৩এর ২রা আগস্ট রবীন্দ্রসদন মঞ্চে একলা চলো রেনাটকে

উৎপল দত্তের মত অনন্য প্রতিভাকে কোন পুরস্কারের ক্ষুদ্রতায় পরিমাপ করা যায় না, তিনি তা বিশ্বাসও করতেন না ১৯৬৬র পর দুবার আকাডেমি পুরস্কার প্রত্যাখ্যান ঙ্করেন, ১৯৯০এ কেন্দ্রীয় সরকারের পদ্মবিভূষণ খেতাব প্রত্যাখ্যান করেন ১৯৯৩এ নাসিকে গোদাবরী গৌরবপুরস্কার গ্রহণের জন্য আমন্ত্রিত হয়েছিলেন কিন্তু অসুস্থতার কারণে পুরস্কার গ্রহণের অক্ষমতা জানিয়ে দেন গ্রহণ করেন রাজ্য সঙ্গীত নাটক আকাডেমি প্রদত্ত দীনবন্ধু পুরস্কার’, ‘ভুবন সোমচলচ্চিত্রের জন্য রাষ্ট্রপতি প্রদত্ত ভরত পুরস্কারও বেশ কয়েকবার বি এফ যে এ ও ফিল্মফেয়ার পুরস্কার নাটকের জন্য প্রায়  সারা বিশ্ব ভ্রমণ করেছেন ১৯৭২এ টিভি অনুষ্ঠানের জন্য ঢাকা গিয়েছিলেন, ৭৩এর ২৫শে  জানুয়ারি আবার ১৯৮৬তে বাংলাদেশ ভ্রমণ করেন

উৎপল দত্ত চলে গেছেন চব্বিশ বছর অতিক্রান্ত হ তাঁর মৃত্যুর সঙ্গেসঙ্গে বাংলা মঞ্চের রাজনৈতিক থিয়েটার বলতে যা কিছু, তার সবটাই রিক্ত হয়ে গিয়েছে অতলান্ত সমুদ্রসম বিশালতা নিয়ে বাংলা থিয়েটারে যে স্থান দখল করেছিলেন উৎপল দত্ত তার ভগ্নাংশও কোনদিন ভরাট হবে কিনা সংশয় আছে



ভালো-মন্দয় অজিতেশ
     
আধুনিক বাংলা থিয়েটারের যে তিন দিকপাল নাট্যব্যক্তিত্বের নাম আমরা এক বন্ধনিতে উচ্চারণ করি তাঁদের একজন অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায় (১৯৩৩ ১৯৮৩) অন্য দুই নাট্যরথী শম্ভু মিত্র (১৯১৫ ১৯৯৭) ও উৎপল দত্ত (১৯২৯ ১৯৯৩) অপেক্ষা বয়সে কনিষ্ঠ, কিন্তু থিয়েটার ও আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন সবার আগে পঞ্চাশ বছরের জীবনবৃত্তে, অজিতেশের নাট্য-পরিক্রমা মাত্র ২৮ বছরের, ১৯৫৫তে গণনাট্য সঙ্ঘে যুক্ত হওয়ার সময়কে ধরে আর গণনাট্যউত্তর কালে তাঁর সিরিয়াস নাট্যচর্চার বয়স মাত্র ২৩ বছর, যদি ১৯৬০এ নান্দীকারএর প্রতিষ্ঠা ও এবং দলের প্রথম নাটক নাট্যকারের সন্ধানে ছটি চরিত্রকে হিসাবে রাখি গণনাট্য সঙ্ঘের প্রতিষ্ঠা এবং ]নবান্নঅভিনয়ের মধ্য দিয়ে যখন বাংলা অপেশাদার থিয়েটারের নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হল, অজিতেশ তখন মানভূমের রোপো গ্রামের দশ বছরের বালক নাটকের আকর্ষণে অজিতেশ গণনাট্যসঙ্ঘে যোগ দিয়েছিলেন আবার আরো নাটক করবো, নিজের মত করে নাট্যশিল্পের বিস্তৃত দিগন্তকে হাতের মুঠোয় ধরবো এই অমোঘ আকর্ষণে গণনাট্য সঙ্ঘ থেকে সরেও এসেছিলেন অজিতেশ নান্দীকারপ্রতিষ্ঠা করেছিলেন গণনাট্য সঙ্ঘের শাখাসংগঠন রূপেই সঙ্ঘাতের শুরু নাট্যকারের সন্ধানে...প্রযোজনাকে ঘিরে কারণ শিল্পীর সৃজনসত্তার সঙ্গে কম্যুনিস্ট পার্টির সাংস্কৃতিক ভাবনার সঙ্ঘাত

জন্ম ১৯৩৩এর ৩০শে সেপ্টেম্বর আসানসোলের শিল্পাঞ্চল রামনগরে পিতা ভুবনমোহন, মাতা লক্ষিরানি পিতা ভুবনমোহন কাজ করতেন কোলিয়ারিতে রামনগর থেকে পিতা বদলি হয়ে চলে যান ঝরিয়ায় সেখানেই অজিতেশের নাট্যাভিনয়ের প্রথম পাঠ টিপু সুলতাননাটকে অজিতেশ ছিলেন গ্রামের মানুষ তখনকার মানভুম জেলার রোপা গ্রামে শৈশব কেটেছে কুলটি হাইস্কুল থেকে স্কুল শিক্ষা শেষ করে কিছুদিন আসানশোল কলেজ ও পরে কলকাতার মনীন্দ্রচন্দ্র কলেজ থেকে স্নাতক পরীক্ষা সম্পন্ন করেন

অজিতেশ যখন কলকাতায় এলেন তখন সেই পঞ্চাশের দশকটা ছিল এক উত্তাল সময় তীব্র প্রতিষ্ঠান বিরোধী জনমত, কল-কারখানায়, স্কুল-কলেজে হরতাল, ট্রামভাড়া বৃদ্ধি আন্দোলন, শিক্ষক ধর্মঘট,আর ৫৯এর খাদ্য আন্দোলন, রক্তাক্ত কলকাতার রাজপথ এই প্রতিষ্ঠান বিরোধী বামপন্থী আন্দোলনের আবহে অজিতেশ কলকাতায় এলেন গত শতাব্দীর চল্লিশের দশক সেকালীন পেশাদারী থিয়েটারের স্থবিরতাকে চূর্ণ করে গণনাট্য আন্দোলন আমাদের থিয়েটারের ধারনাটাকেই প্রবল ভাবে নাড়া দিয়েছিল জীবনের প্রতি মানুষের আশা-আকাঙ্খা, তার জিজ্ঞাসা, সমাজের হৃদয়হীনতার প্রতি তার কান্না, ঘৃণা, ক্রোধ, এবং দ্বন্দ্ব এসবের নান্দনিক মঞ্চভাষ্য নির্মাণ করাই যে থিয়েটারের কাজ এই শিক্ষাটাই দিয়েছিল গণনাট্য আন্দোলন অজিতেশ আসানশোল থেকে কলকাতায় এসে যোগ দিলেন গণনাট্য সঙ্ঘে সেখানে নাটক করলেন সাঁওতাল বিদ্রোহতাঁরই রচনা ও পরিচালনায়, এবং আরো কয়েকটি নাটক পরের বছর গণনাট্যর কলকাতা শাখার সভাপতি নির্বাচিত হলেন অজিতেশ তখন কম্যুনিষ্ট পার্টির সদস্য আর বাগুইআটির মতিলাল বিদ্যালয়ের স্বল্প বেতনের শিক্ষক

১৯৬০এ গণনাট্য সঙ্ঘের শাখা সংগঠন হিসাবেই প্রতিষ্ঠা করলেন নান্দিকারএর, চাইলেন গণনাট্য সঙ্ঘের প্রযোজনায় ইতালীয় নাট্যকার পিরানদেল্লোর সিক্স ক্যারেক্টার ইন সার্চ অফ এন অথরএর ভাষান্তর নাট্যকারের সন্ধানে ছটি চরিত্রমঞ্চস্থ করতে কিন্তু গণনাট্য সঙ্ঘ সে নাটকের মঞ্চায়ন অনুমোদন করলো না গণনাট্যের মঞ্চ থেকে ফ্যাসিবাদের প্রবক্তা বেনিত্তো মুশোলিনির সমর্থক ল্যুইজি পিরানদেলোর এ নাটকের অনুমোদন করা তাদের পক্ষে সম্ভবও ছিলনা তাছাড়া সেই সময়ের বিচারে নাটকের কিছু অমার্জিত সংলাপ ও কিছু খন্ড-দৃশ্য অশালীন মনে হয়েছিল তাদের কাছে

অজিতেশ যখন নাট্যকারের সন্ধানে...মঞ্চস্থ করলেন, মিনার্ভা মঞ্ছে উৎপল দত্তর অঙ্গারতখন ১০০ রজনী পার করে ফেলেছে ষাটের দশকের উত্তাল সময়ে অজিতেশ নাট্যকারের সন্ধানের মত নাটক করলেন কেন ? দারুণ অভিনয় সমৃদ্ধ ও প্রয়োগনৈপুন্যের চমক সত্তেও সেই সময়ের বিচারে নাটকটি হতাশাব্যঞ্জক ছিল ষাটের দশকে নাট্যবিষয় ও প্রয়োগে পরীক্ষা নীরিক্ষার নামে একটা প্রবণতা এসেছিল, যাকে আমরা এবসার্ডবা কিমিতিবাদীনাট্যধারা বলে জানি গত শতকের ত্রিশের দশকে ইউরোপে চরম অর্থনৈতিক বিপর্যয়, দ্বিতীয়ি বিশ্বযুদ্ধের পদধ্বনী মানুষের ময়ল্যবোধগুলির রূপান্তর ঘটিয়েছিল সমাজতান্ত্রিক রাশিয়া ব্যতিত সমগ্র ইউরোপে মানুষের মনকে করে তুলেছিল বিপর্যস্ত ও উদভ্রান্ত সেই উদভ্রান্তি আর হতাশার ছায়াপাত ঘটেছিল কিমিতিবাদী নাট্যধারায়, যার আশ্রয় ছিল অস্তিত্ববাদ অস্তিত্ববাদের প্রবল প্রবক্তা সার্ত্রের কথায়এই মহাবিশ্বে মানুষ সম্পূর্ণ একক, নিঃসঙ্গ সোভিয়েত রাশিয়ার নবলব্ধ সমাজতন্ত্রের ছবি থাকা সত্বেও এক অন্ধকারের চিত্রকল্প নির্মাণই ছিল কিমিতিবাদী দর্শনের আশ্রয় অজিতেশ বাংলা থিয়েটারে এই কিমিতিবাদী নাট্যধারার পথপ্রদর্শক কিমিতিবাদী নাট্যধারাটি অবশ্য বাংলা থিয়েতারে দীর্ঘস্থায়ী বা প্রভাবশালী হয়নি অজিতেশও নাট্যকারের সন্ধানের পর আর কোন এবসার্ড ধারার নাটক করেননি এ নাটকের মধ্যেও অজিতেশের অন্বেষণ ছিল মানুষের অন্তর্লোকের সন্ধান ১৯৭৩এ লেখা একটি নাতিদীর্ঘ প্রবন্ধে (বৈপ্লবিক থিয়েটার ও আমাদের কাজ’  রঙ্গমঞ্চ, জুলাই ৭৩) তিনি লিখেছিলেন আমরা স্পষ্ট করে হতাশার কথা বলতে পারি না, কেননা এই হতাশাও আমাদের রক্ত সম্পর্কিত অনুভব নয় প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থায় এবং থিয়েটারে এর যে চলন আছে তাই আমাদের প্রকাশের ধরণ যে তীব্র জীবনবোধ থাকলে মানুষ যথার্থ আশাবাদী অথবা নৈরাজ্যবাদী হতে পারে, তা আমাদের থাকলে তীব্র নৈরাজ্যবাদী নাটক লেখা হতো আসলে আমরা খুবই সাবধানী শিল্পীমাত্র আশাবাদী নাটকের জোর জনপ্রিয়তা ইত্যাদির বিরুদ্ধে আমাদের সংকোচের শেষ নেই ...। অর্থাৎ আশাবাদ কিংবা হতাশাবাদ প্রকাশের প্রচলিত ধরণ অজিতেশের পছন্দ ছিল না ষাট-সত্তরের সেই উত্তাল সময় দাবি করতো প্রচলিত সমাজ বন্দোবস্তের বিরুদ্ধে পীড়িত মানুষের ক্রোধের মঞ্চভাষ্য অজিতেশের নাট্যভাবনা অনুমোদন করতো না একই নিবন্ধে অজিতেশ লিখেছিলে ক্রুদ্ধ হওয়ার ব্যাপারেও আমরা সাবধানী, আমাদের ক্রোধেরও একতা প্যাটার্ন তৈরি হয়ে গেছে আসলে এ ক্রোধ আমাদের অনুভব সঞ্জাত না প্রচলিত ক্রুদ্ধ থিয়েটারের সংস্কার থেকে এদের জন্ম, তাই এগুলির স্বকীয়তা নেই সুতরাং অজিতেশ আশ্রয় খুঁজেছিলেন বিদেশী নাটকের ভাষান্তর বা ভারতীয় করণে তিনি যে শিল্পীর স্বাধীনতার পক্ষে এবং নাটকে তীব্র রাজনৈতিক বক্তব্য তুলে ধরায় যে তাঁর অনীহা ছিল তাতে কোন সংশয় নেই উৎপল দত্ত নিজেকে প্রপাগান্ডিস্ট বলতে গর্ববোধ করতেন আর অজিতেশ মনে করতেন শিল্পী কখনও প্রোপাগান্ডিস্ট হতে পারেন না তিনি বিশ্বাস করতেন পীড়িত মানুষের ক্রোধ শিল্পের মাধ্যমে প্রকাশ করাই শিল্পীর দায় বক্তৃতার আগে মাঠে ভিড় জমানোর দায় শিল্পীর নয় গণনাট্য-উররর কালে আমাদের নাট্যচাহিদার যে প্যাটার্ণ তৈরি হয়েছিল বাংলা থিয়েটারকে সেই প্যাটার্ণের বাইরে দেখতে চেয়েছিলেন অজিতেশ তাই বিদেশী নাটকই ছিল অজিতেশের মূল আশ্রয় মৌলিক বাংলা নাটক যে তিনি করেননি তা নয় সেতুবন্ধ, চারুধ্যায়, হে সময়, উত্তাল সময়, পাপপূন্য, নটী বিনোদিনী, শাহী সংবাদ এরকম কয়েকটি মৌলিক নাটক তিনি করেছিলেন, যদিও নটী বিনোদিনী ও পাপপূন্য ছড়া কোনটিই দর্শক আনুকুল্য তেমনভাবে পায়নি

অজিতেশের নাটকে শ্রমিক, কৃষক বা তাদের সংগ্রাম তেমনভাবে আসেনি তাঁর নাটক যেন মানুষের অন্তর্লোকের গভীরে দেখামধ্যবিত্ত মানুষের দোদুল্যমানতা, দ্বিচারিতা, স্ববিরোধ তাঁর নাটকে উন্মোচিত হয়েছে অনুপন নাট্যবিন্যাস ও প্রয়োগ অনন্যতায় বাংলা নাট্যমঞ্চে অজিতেশের দীর্ঘ ছায়া অস্বীকার করবে কে? তাঁর নাটকে আঙ্গিকের চমক থাকতো না নিরাভরণ মঞ্চে নাট্যবিন্যাস ও বিস্ময়কর দলগত অভিনয়ই ছিল অজিতেশের থিয়েটারের চমৎকারিত্ব আরো একটি কারণে অজিতেশকে আমরা মনে রাখি তা হল তিনি আমাদের বিশ্ব নাট্যাঙ্গণের সঙ্গে আমাদের পরিচিতি ঘ্টালেন, বলা ভালো যে বিশ্ব নাট্যাঙ্গণকেই নিয়ে এলেন বাংলার থিয়েটার পরম্পরায় ভাষান্তরিত বিদেশী নাটক করেছেন অনেকেই কিন্তু তাঁর মত বিদেশী কাহিনী চরিত্রকে বাংলার দেশজ ভূমিতে মিলিয়ে দিতে কেই বা পেরেছে ?

নাট্যকারের সন্ধানের পর আন্তন চেকভ অনুপ্রাণিত মঞ্জরী আমের মঞ্জরী, ‘নানা রঙের দিনরবীন্দ্রনাথের চার অধ্যায়’, বারটল্ড ব্রেখটের ভাষান্তর ভালো মানুষ’, ‘তিন পয়সার পালা’,পিরানদেল্লো অবলম্বনে শের আফগান,আর্নল্ড ওয়েসকার অনুপ্রাণিত যখন একা,‘সওদাগরের নৌকা,‘নটী বিনোদিনী,‘পাপ-পূণ্যপ্রভৃতি একটার পর একটা প্রযোজনায় অসামান্য সাফল্য পেলেন অজিতেশের অধিকাংশ প্রযোজনাই বিদেশী নাটকের ভাষান্তর ভাষান্তর নয়, বলা ভালো বঙ্গীকরণ ভাষান্তরিত বিদেশী নাটকগুলিকে তিনি প্রতিস্থাপিত করেছিলেন দেশ, মাটি, মানুষ তার রীতি-নীতি, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের চেনা পরিসরে যে জমির ওপর দাঁড়িয়ে থিয়েটার, সেই জমির ভাবসত্যটিকেই স্পষ্ট করতে চেয়েছিলেন তাঁর নাটকে

শম্ভু মিত্রর মত অজিতেশও তাঁর নিজ হাতে গড়া নান্দীকারথেকে সরে এসেছিলেন বা আসতে হয়েছিল ১৯৭২এ,গড়ে ছিলেন নান্দীমুখনাট্য সংস্থা,প্রযোজনা করেছিলেন নিজের অন্যতম সেরা নাটক টলস্টয় অনুপ্রাণিত পাপ-পূণ্য এই সময়কালেই অজিতেশ কিছু দিন যাত্রায় অভিনয় করেছিলেন অভিনয় করেছিলেন বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্রেও। চলচ্চিত্রে প্রথম অভিনয় করেন ১৯৬৫তে

মোট ৬০টি সিনেমাতে অভিনয় অভিনয় করলেও অজিতেশ জানতেন চলচ্চিত্র বা যাত্রা তাঁর যায়গা নয়, তাঁর যায়গা থিয়েটার

আমাদের দুর্ভাগ্য,এদেশে মঞ্চের অভিনয়কে ধরে রাখ্র প্রযুক্তি ছিল না, এখনো নেই ফলে এই প্রজন্মের নাট্যকর্মীদের কাছে অজিতেশের নাট্য উপস্থাপনা রীতি, তাঁর বাচিক অভিনয়ের ব্যাপ্তি অজানাই থেকে গেছে তাঁর কন্ঠস্বর বা শিহরণ জাগানো বাচনভঙ্গী, অভিনয় গণদেবতা, হাটেবাজারে প্রমুখ ছায়াছবি দেখে দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানো যায়, নাটকের অজিতেশকে পাওয়া যায় না

অজিতেশ বিশ্বাস করতেন, শিল্পী এমন একটা জাত যাকে সবসময় সৎ হতেই হবে, কারণ তার জীবনের প্রতিফলনই তার শিল্প, অসৎ মানুষের শিল্পে অধিকার নেই নিশ্চিত ভাবেই থিয়েটারের প্রতি তাঁর সততা ও দায়বদ্ধতা ছিল প্রশ্নাতীত অজিতেশ তাঁর উদ্দাম মেঘমন্দ্র কন্ঠস্বরে সংলাপ প্রক্ষেপনে ও চরিত্র সৃষ্টির দামাল পৌরুষে বাংলার পৌরুষদীপ্ত মিথিকাল ফর্মের কাব্য সৃষ্টি করে গেছেন তাঁর নাটকে


ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়