এই সময়ের রবীন্দ্রনাথ * সুস্মিতা কৌশিকী



এই সময়ের
রবীন্দ্রনাথ

সত্তরের দশকের  এক হিন্দি ছবির ডায়ালগের অনুকরণে  বাঙালি অনায়াসে বলতে পারে ' মেরে পাস  রবি ঠাকুর হ্যায় '  জোকস্ আপার্ট তবে কথা তো মিথ্যে নয় এই একটি নামেই বাঙালির বিশ্বজয় বাঙালি  অযুত নিযুত খেদের মধ্যেও  বলে --- ' ভাগ্যিস আমাদের রবীন্দ্রনাথ ছিল, না হলে যে কী হতো এই জাতির! '  এই জাতি ইংলিশ চ্যানেল পেরিয়েছে, এভারেস্ট এ উঠেছেলর্ডস জয়েও উচ্চারিত হয় তার নাম  অর্থাৎ জলে- স্থলে - অন্তরীক্ষে বাঙালির বিচরণ অবাধ কিন্তু তার জীবনবীক্ষার সঙ্গে ওতপ্রোত জড়িয়ে, মিশে  একাকার হয়েছে  যে নামটি, সেটি বাঙালির প্রাণের মানুষ  রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের

উনিশ শতকের বাংলায় ও বাঙালির জীবনে যে কয়জন যুগপুরুষের আবির্ভাব হয়েছিল রবীন্দ্রনাথ নি:সন্দেহে তাঁদের মধ্যে অগ্রগন্য।   তাঁর প্রতিভা ছিল সহস্রমুখী, শান্ত ও স্থিতধী  তবে বাঙালির মননে কবিতা আর রবীন্দ্রনাথ যে প্রায় সমার্থক রূপ নিয়েছে তা বুঝি কবির বিপুল ব্যাপক কাব্যসম্ভারের জন্যই  মানুষের মনপ্রাণের কোন অনুভূতিই তাঁর ইন্দ্রিয়ের অগোচর থেকে যায় নি বা এমন কোন মানবিক অনুভূতিই হয়তো বাকি নেই যা তাঁর ইন্দ্রিয়ের সূক্ষ্মতার কাছে ধরা দেয়নি, তাঁর ভাষার সঙ্গে সন্ধিসূত্র রচনা করেনি। তাই রবীন্দ্রনাথকে আমরা মূলত কবি, কবিশ্রেষ্ঠ, বিশ্বকবি বলে মান্যতা দিয়েছি। কিন্তু এই পরিচয়ের বাইরেও রবীন্দ্রনাথ আছেন তিনি আছেন অনেক কিছুতে, তিনি আছেন অনেক কিছু হয়ে তিনি অসামান্য গদ্যকার, সংগীত স্রষ্টা সুরকার,চিত্রকর,  সুচিন্তক, শিক্ষাবিদ, সমাজসেবী -- তিনি 'নিভৃতে প্রাণের দেবতা '

বাংলা ও ইংরেজি ভাষায়  অসংখ্য  রচনায়   রবীন্দ্রনাথ সমাজ, রাষ্ট্রনীতি,  জাতীয়তাবাদ, ধর্ম, সাহিত্যতত্ত্ব, ইতিহাস, ভাষাতত্ত্ব, ছন্দ, সংগীত, চিত্রকলা ইত্যাদি নানা বিষয়ে নিজস্ব মতামত প্রকাশ করেছেন। এই বিপুলসংখ্যক গুণমন্ত রচনার পেছনে রয়েছে তাঁর কঠোর  পরিশ্রম ও অপার ধৈর্য্যশীল মন, তার অধ্যবসায় সম্পর্কে জানা যায় রানী চন্দ, মুজতবা আলী ও রাজশেখর বসুর  লেখা বইগুলি থেকে রানী চন্দ তাঁর ' গুরুদেব ' বই তে লিখেছেন : " দূরদূরান্ত দেশদেশান্ত হতেও কতশত জন আসতেন সময় নেই অসময় নেই হাসিমুখে সবাইকে অভ্যর্থনা করেছেন, চলে গেলে পর আবার লিখেছেন। এমনি ভাবেই লেখা  চলত সারাদিন। দুপুরে বিশ্রাম নিতেও রাজি থাকতেন না এক -এক সময়ে ভেবে অবাক হতাম, এখনো হই যে কি করে একজন মানুষ সকাল  হতে সন্ধ্যে অবধি   এমনতরো একটানা একটা পিঠ-সোজা চেয়ারে বসে লিখে যেতে পারেন" সৈয়দ মুজতবা আলী তাঁর ' গুরুদেব ও শান্তিনিকেতন ' ব‌ইতে লিখেছেন "আমাদের দেশের লেখকরা কিন্তু বিদেশী লেখকদের চেয়ে প্রতিভার দিক দিয়ে কেউ কম নন। তবে আমাদের দেশের লেখকরা খাটতে রাজি নন। কিন্তু একটা কথা মনে রাখবে পরিশ্রমের কোন বিকল্প নেই। আমি তো মনে করি আমাদের রবি ঠাকুর বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে পরিশ্রমী লেখক। তোমরা কল্পনাই করতে পারবেনা রবি ঠাকুর কী রকম পরিশ্রম করতেন। রবি ঠাকুর কখনই আকাশের দিকে তাকিয়ে কবিতা লিখেন নি।........

আমার মনে হয় এইটিই ছিল রবীন্দ্রনাথের জীবনের মূল সুর। চিরজীবন তিনি বহুর ভেতর একের সন্ধান করেছিলেন। তার সে সাধনা আমি প্রত্যক্ষ দেখেছি। সৌভাগ্যক্রমে প্রায় এক বৎসর শান্তি নিকেতনে আমি ছিলুম এক ঘর নিচের তালায়। সেখান থেকে জানালা দিয়ে মুখ বাড়ালেই দেখতে পেতুম, গুরুদেব তাঁর জানালার পাশে বসে লেখাপড়া করছেন। সকাল চারটের সময় দুই ঘণ্টা উপাসনা করতেন। তারপর ছয়টার সময় স্কুলের ছেলেদের মত লেখাপড়া করতেন। সাতটা, আটটা, নয়টা, তারপর দশ মিনিটের ফাঁকে জলখাবার। আবার কাজ- দশটা, এগারোটা, বারোটা। তারপর খেয়েদেয়ে আধা ঘণ্টা বিশ্রাম। আবার কাজ-লেখাপড়া একটা, দুটো, তিনতে, চারটে, পাঁচটা, কাজ কাজ। পাঁচটা থেকে সাতটা ছেলেমেয়েদের গান শেখাতেন বা দিনুবাবুর আসরে বসে গান শুনতেন, অথবা গল্প-সল্প করতেন। তারপর খাওয়া-দাওয়া সেরে আবার লেখাপড়া, মাঝে মাঝে গুন গুন করে গান, আটটা থেকে এগারোটা পর্যন্ত। কী অমানুষিক কাজ করার ক্ষমতা! আর কী অসীম জ্ঞানতৃষ্ণা!"

রবীন্দ্রনাথ যখন বাংলা ভাষায় লিখতে শুরু করেন তখন ভাষা হিসেবে বাংলা তেমন কোন সমৃদ্ধ ভাষা নয়। ঝুলি ভর্তি   তৎসম, অর্ধতৎসম শব্দ  নিজস্ব  শব্দ ভান্ডার সংকীর্ণ এবং আঞ্চলিকতা দোষে দুষ্ট। মঙ্গলকাব্য, রামায়ণ, মহাভারতের  অনুবাদ, ময়মনসিংহ গীতিকা প্রভৃতির সজলভূমিতে  কাব্যপথ মোটামুটি ভাবে তৈরি থাকলেও গদ্যভাষা ছিল অপরিনত রামমোহন, বিদ্যাসাগর ও বঙ্কিমচন্দ্রের হাত ধরে বাংলা গদ্য প্রতিষ্ঠিত হলেও তা মূলত ছিল সাধু ভাষায় লেখা, ফলে আমজনতার দরবারে তার ব্যাপ্তি ও গ্ৰহনযোগ্যতা অনেকটাই কম ছিল রবীন্দ্রনাথ‌ও তাঁর রচনায় সাধু ভাষার এই রীতি প্রথমে গ্রহন করলে‌ও,  ১৯১৪ সালের  প্রমথ চৌধুরীর সবুজপত্র পত্রিকা গোষ্ঠীর আন্দোলনের মধ্য দিয়ে চলিত গদ্যের জয়যাত্রা সূচিত হলে তিনি দক্ষ নাবিকের মতো দিক নির্দেশনার সমস্ত ইশারা রেখে গেছেন তাঁর সৃষ্টি সম্ভারে। বিদ্যাসাগরমশাই  যদি হন বাংলা গদ্যভাষার প্রথম পুরুষ, রবীন্দ্রনাথ নিঃসন্দেহে এই ভাষার প্রাণপুরুষ নিরলস পরিশ্রম ও প্রচেষ্টায় রবীন্দ্রনাথ বাংলা ভাষাকে এক সম্মান জনক মর্যাদায় এনে উপস্থাপন করেছেন। সর্বজনগ্রাহ্য  প্রমিত বাংলা ভাষাও তাঁরই অবদান শুধু সাহিত্যের ভাষা হিসেবেই বাংলাকে সম্মানজনক স্থান দিয়ে নিজের দায়িত্ব শেষ করেন নি, সমাজজীবনের উপযোগী ভাষা হিসেবেও এই ভাষাকে নমনীয় করে তোলেন। তার অনুসৃত বানান প্রনালী এই সাক্ষ্য বহন করে।

ইংরেজি 1861সালের 7মে কলকাতার  জোড়াসাঁকোর বিখ্যাত ঠাকুর পরিবারে  দেবেন্দ্রনাথের ও সারদা দেবীর তেরোতম সন্তান রূপে জন্মলাভ, ওরিয়েন্টাল সেমিনারী, নর্মাল স্কুল, বেঙ্গল অ্যাকাডেমি, সেন্টজেভিয়ার্স কলেজিয়েট স্কুলে কিছু কাল পড়াশোনা, গৃহশিক্ষকের কাছে অধ্যয়ন, 1878-এ ব্যারিস্টারি পড়তে বিলেত যাওয়া এবং   1883 সালে মৃণালিনী দেবী সাথে বিবাহ,  রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিগত জীবন বলতে হয়তো  এতটুকুই, আশি বছর তিনমাস আয়ুর দীর্ঘ  জীবনপ্রবাহে  বাকি সবটুকুই দশের এবং দেশের প্রসঙ্গত উল্লেখ্য রবীন্দ্রনাথ বিশ্বনাগরিক, তার দেশ ভৌগলিক সীমারেখায় বাঁধিত নয়।
               
১৯০১ সালে কলকাতা থেকে দূরে বোলপুরের গ্রামীণ পরিবেশে  পিতা দেবেন্দ্র নাথের ঠাকুর সম্মতিক্রমে যে  ব্রহ্ম বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন যা ১৯২১ সালে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের রূপ নেয় তার প্রধানপুরুষও স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় প্রথাগত শিক্ষার বাইরে প্রকৃতির সংস্পর্শে উন্মুক্ত শিক্ষা ও  শ্রীনিকেতন   বৃত্তিমূলক শিক্ষার দিগন্ত প্রসারিত করে। মুক্তির চিন্তা ও চিন্তার মুক্তি এই দুই ই ছিল রবীন্দ্রনাথের শিক্ষার মূল  উদ্দেশ্য। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ  বিরোধী আন্দোলনের সময় রাখী বন্ধন,  অরন্ধন  প্রভৃতি সামাজিক কাজের মধ্য দিয়ে শুষ্কং কাষ্ঠং স্বদেশীয়ানার পরিবর্তে  হিন্দু মুসলিম সামাজিক ঐক্যের চেষ্টায় সচেষ্ট হন। এটা তাঁর দূরদৃষ্টির পরিচয়বাহক। বাঙালির শক্তি ও অস্তিত্ব যে হিন্দু মুসলিম দুটি সম্প্রদায়ের যৌথতায় নিবদ্ধ তা আর তাঁর মতো করে কে বুঝেছিলেন? ১৯১৩ সালে তার রচিত গীতাঞ্জলির ইংরেজি অনুবাদটি নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হলে, পাশ্চাত্যের দরবারে বাঙালির শিল্প -সাহিত্য-সংস্কৃতির জয়ধ্বজা   উড্ডীন হয়। ১৯১৯  এ জালিওয়ানাবাগের হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে ১৯১৫ সালে পাওয়া নাইট উপাধি ত্যাগের মধ্যদিয়ে রবীন্দ্রনাথ তাঁর মানসিক দৃঢ়তারই পরিচয় জ্ঞাপন করেছেন।
       
রবীন্দ্রনাথ রচিত দুটি গান দুটি দেশের জাতীয় সংগীত  হিসেবে  দুটি দেশের সমস্ত নাগরিকদের সঙ্গেই মনেপ্রাণে জড়িয়ে আছে রবীন্দ্রনাথের জীবনদর্শন মূলত ব্রাহ্মসমাজ প্রনীত বেদ বেদান্ত উপনিষদের শিক্ষার  উপর প্রতিষ্ঠিত  ভাববাদী দর্শন দ্বারা প্রভাবিত   হলেও তা বাস্তবজ্ঞান রহিত ছিলনা তিনি উপযোগীতা উপর জোর দিয়ে প্রয়োগবাদের কথাই বলেছেন। কারণ বাঙালি জীবনের জড়তা ও মূঢ়তার সাথে যৌথ লড়াইয়ের পথ সুগম করা তাঁর  শিল্প ভাবনার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে ছিল অস্পৃশ্যতা, বর্ণভেদ,  সংকীর্ণতা, আচার বিচারের নামে মূলত ব্যভিচারের পঙ্কিলতায় আবদ্ধ ছিল হিন্দু সমাজ ধর্মের সংকীর্ণতা কিংবা শাস্ত্রবিষয়ক  অকারণ নির্ভরশীলতা দূর করে যুক্তি,বুদ্ধি, প্রজ্ঞা  দ্বারা বিচার বিবেচনা করে প্রকৃত মানবধর্মে উন্মেষের লক্ষ্যে দেবেন্দ্র নাথ ঠাকুর, রাজনারায়ণ বসু, অক্ষয় দত্ত, কেশব সেন, শিবনাথ শাস্ত্রী ব্রাহ্মধর্ম আন্দোলনকে সমৃদ্ধ করে তুললেন।১৮৪০ খ্রীষ্টাব্দে তত্ত্ববোধিনী পাঠশালা প্রবর্তনের মধ্য দিয়ে দেশের ঐতিহ্যের প্রতি দেশবাসীর মনোযোগ আকর্ষণ ও জাতীয়তাবোধ প্রসারের লক্ষ্য স্থিরীকৃত হয় এই উর্বর ভূমিরই সুযোগ্য ফসল রবীন্দ্রনাথ। তাই তার চিন্তায়, চেতনায়, চৈতন্যে মধ্যযুগীয় সংকীর্ণতা ও কুসংস্কারের পরিবর্তে ছিল বিশ্বভাতৃত্ব, উদারতা ও উন্মুক্ত আধ্যাত্মিকতা। তাঁর সকল সৃজন কর্মে তিনি এই ছাপ রেখে গেছেন‌ -- যা বাঙালির নিজস্ব সম্পদ এইভাবে বাঙালি নিজের ভাষা, সাহিত্যে, দর্শন,জীবনবোধ ও বৃত্তান্ত.... সকল বিষয়েই একান্তভাবে রবীন্দ্রনাথের কাছে ঋণী। এই ঋণ যুগধর্মী নয়, এই ঋণ বহমান --- তা উত্তরকালেরও।

এখন প্রশ্ন হলো এই ঋণ পরিশোধের ব্যাপারে বাঙালি কতটা সচেষ্ট?  কিন্তু তারও  আগে যে প্রশ্নটি মনের শাখায় উঁকি দিয়ে যায় তা হলো বাঙালি কি আদৌ এই ঋণের বিষয়ে সচেতন?    আজকের  শিক্ষিত বাঙালি রবীন্দ্রনাথকে কতটা অনুধাবন  অনুকরণ, অনুসরণ করে নিজের মধ্যে প্রতিফলিত করতে পেরেছেন তা নিয়ে সন্দেহের যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে। কিন্তু তারও আগে আমাদের জেনে নিতে হবে বাঙালি বলতে আমরা ঠিক কাদের বুঝবো,কোন জন জনগোষ্ঠী, কোন সম্প্রদায়কে বুঝতে চাইছি। একটু পিছিয়ে দেখি গিয়ে দেখে নিই বাঙালির উৎপত্তি ও উৎকর্ষের ইতিহাস --
          "আজি ভুসু বঙ্গালী ভইলী
            নিজ ঘরনী চন্ডালী লেলীয় "

প্রাচীন চর্যা গীতিতে ভুসুকপাদের পদাবলীতে প্রথম বাঙালী শব্দের সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। তবে তখনকার বঙ্গাল বা বঙ্গ নামে অভিহিত জনপদ আজকের বাংলা নয় বাংলা বলতে এখন যা বোঝায় তখন তার অস্তিত্ব ছিল না। এই দেশ তখন গৌড়, সমতট, হরিকেলা, রাঢ়, পৌন্ড্র, বরেন্দ্র, তাম্রলিপ্ত, সুবর্ণবীথি, বঙ্গাল, বর্ধমানভুক্তি ইত্যাদি ছোট ছোট জনপদে বিভক্ত ছিল।শশাঙ্ক (৫৯০ - ৬২৫ শতক), পাল রাজারা (৮ - ১১ শতক), সেন রাজারাও ( ১১ শতকের অন্তিমলগ্ন থেকে ১৩ শতক পর্যন্ত )রাজত্ব করেও   এই অঞ্চলকে সমগ্রে বাঁধতে সক্ষম হননি।

বাংলা প্রদেশ হিসেবে সংগঠিত রূপ নেয় মুসলমান শাসকদের আমলে। বাঙালি পন্ডিতরা চর্যাপদ কে বাংলা ভাষার আদি নমুনা বলে মনে করলেও উত্তর ভারতীয় অবাঙালী পন্ডিতরা এ কথা মানেন না। ভাষাবিদ সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় চর্যাগীতিকে বাংলা পুঁথি হিসেবে গ্ৰহন করেছেন বটে কিন্তু হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর মতই সুনীতিবাবুও মেনে নিয়েছেন চর্যাগীতির ভাষা বাংলা ভাষা নয়। বরং তাকে প্রাক বাংলা ভাষা বলে স্বীকৃতি দিয়েছেন তিনি। বাংলা সর্বদেশব্যাপী একটি সাহিত্য ভাষার রূপ নেয় সুলতানি আমলে সেই সদ্য জাত বাংলাভাষার মস্ত পৃষ্টপোষক ছিলেন মুসলিম সুলতানরা। একটি ভাষা একটি জাতির আত্মা স্বরূপ। সেই ভাষাকে কেন্দ্র করেই গড়ে ওঠে জনপদ। বাংলা ভাষাকে কেন্দ্র করেও এমনই এক জনপদ গড়ে উঠলো। পরে এই অঞ্চলকে সাময়িক ভাবে  সর্বভারতীয় এক শাসনব্যবস্থার অধীনে করে তার সাধারণ নাম 'সুবাবাংলা ' দেন মোগলরা। এই সময় এক ভাষা এক শাসনব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা র ফলে বাঙালি জনগোষ্ঠী ঐক্যবদ্ধ হন। কিন্তু তাদের ঐক্যে চৈতন‌্যের উন্মেষ উনবিংশ শতাব্দীতে ইংরেজ শাসনকালের পরিস্ফুট হয়  ইংরেজ শাসনের প্রথম একশো বছরের অন্ধকার অবসানে কিছু টা আলোক অধ্যায় শুরু হয় রানী ভিক্টোরিয়া শাসিত ভারতে। ইংরেজ আমলে যেহেতু ভারতবর্ষের রাজধানী ছিল কলকাতা তাই নিজের কাজকর্মে সহায়তার জন্য ইংরেজদের প্রয়োজন ছিল ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত বাঙালি এইভাবে বাঙালি বিশেষ করে উচ্চ ও মধ্যবিত্ত বাঙালি ইংরেজদের ভাষা ও সংস্কৃতির সংস্পর্শে আসে এবং 'জাতীয়তাবাদ ' আমদানি করে। কিন্তু বড়  দুঃখের বিষয় এই সময় থেকেই বাঙালি হিন্দু ও মুসলিম দুটি ধর্মীয় শিবিরে ভাগ হয়ে যায় যার ফলশ্রুতিতে  পরে দেশভাগ, দাঙ্গা,  মনমালিন্য, অনুপ্রবেশ, ঘৃণা, বিদ্বেষ ইত্যাদি সকল অনিষ্টকারক সময় ও সমস্যার মধ্য দিয়ে যেতে হয় এবং হচ্ছে গোটা বাঙালি জাতিকে। ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ কে রদ করে ১৯১১ সালে দুই বাংলাকে জোড়া গেলেও, স্বাধীনতা প্রাপ্তির সঙ্গে সঙ্গে বাঙালির ঐক্য ধূলোয় লুটিয়ে যায়, যে বিষ আজও বহন করে চলছে দুই বাংলা। তবু এই দুই বাংলার সংযোগ সূত্র হিসেবে আজও অভিভাবকের মতো যিনি দাঁড়িয়ে আছেন, তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

রবীন্দ্রনাথ  কোনো নির্দিষ্ট দশকের নয়। তিনি বাঙালির মননে  আবহমান কালের আজকের বাংলায়  বাঙালির সমাজ ও জীবনে রবীন্দ্রনাথের প্রভাব আলোচনা কালে একটু তলিয়ে ভেবে নিতে হবে বাঙালি বলতে আমরা মূলত সমাজের কোন অংশটির কথা ধরবো। যারা বাংলায় কথা বলে, অর্থাৎ বাংলা যাদের মাতৃভাষা তারা প্রত্যেকেই কি আমাদের বিচার্য? মনে হয় না। চাষী,মজুর, জেলে, মাঝি কলকারখানার শ্রমিক মুটে মজু্র, অর্থাৎ সমাজের  খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষদের আমরা ধর্তব্যের মধ্যে রাখি না না রাখার কারণও খুব স্পষ্ট রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে, তাঁর সাহিত্য শিল্প কলার সঙ্গে এই শ্রেণীর মানুষের কোনো প্রত্যক্ষ যোগাযোগ নেই। সমাজে রবীন্দ্রনাথের প্রভাবে বা প্রভাবহীনতায় এদের কিছু যায় আসেনা। দুবেলা ভরপেট খাবার, থাকবার জায়গা, পরণের কাপড়,রোগব্যাধিতে ওষুধ পথ্যাদী, সন্তানের জন্য নুন্যতম লেখাপড়ার ব্যবস্থা এই করে উঠতেই তাঁদের নাভিশ্বাস। রবীন্দ্রনাথ এঁদের কাছে অনেক দূরের মানুষ। তাঁর সাথে প্রাণের যোগ নেই

আরো এক শ্রেণীর বাঙালি আছে যাদের যাপিত জীবন বিলাসব্যসন প্রাচুর্য্যে  কেটে যায়, বর্তমান পুঁজিবাদের বিশ্বে রবীন্দ্রনাথও এদের কাছে আর কয়েকটা পণ্যের বেশি কিছু না। মাঝে পড়ে রইলো মধ্যবিত্ত বাঙালি যাদের মধ্যে রয়েছেন শিক্ষক, ডাক্তার, উকিল, প্রযুক্তিবিদ, সমাজসেবী, লেখক, কবি ও পাঠক গবেষক ইত্যাদি। এদের কাছেই রবীন্দ্রনাথ মূলত চর্চার বিষয়। কিন্তু হা হতোস্মি  এই শ্রেণীর বাঙালি তার আত্মমগ্ন, আত্মজিজ্ঞাসু,আত্মদীপ চরিত্রটি দ্রুত ঝেড়ে ফেলে ফটকাবাজী, ফরেফবাজি করে দুপয়সা বেশি রোজগারের ধান্দায় মশগুল বিশুদ্ধ রবীন্দ্রচর্চা এখন তাদের কাছে দূরকল্প
                           
বাঙালি সমাজ আগাগোড়াই বহুভাগে বিভক্ত ছিল ---আঞ্চলিক, ধর্মীয়, জাতপাতের বিভেদ ইত্যাদিতে কিন্তু উনিশ শতকে ইংরেজ শাসনের সূত্রে এদের ভিতর থেকে একটি বিশেষ শ্রেণী উদ্ভূত হয়, যাদের প্রচলিত নাম মধ্যবিত্ত বঙ্গীয় হিন্দু সমাজের উচ্চ বর্ণীয়রা অর্থাৎ ব্রাহ্মন, কায়স্থ, বৈদ্য ছিল এদের অন্তর্ভুক্ত। পাশ্চাত্যের বুর্জোয়াদের সঙ্গে বাঙালি মধ্যবিত্তের তফাতটা ছিল এ জায়গাতেই যে তারা ব্যবসাবানিজ্যে লক্ষ্মীর সন্ধান না করে সারস্বত চর্চার ব্রত নিয়েছিলেন। ফলে বাঙালি লেখক,কবি, চিন্তাবিদ শিক্ষাবিদদের পেয়েছি আমরা। এঁরা সকলেই প্রায় ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত হলেও, এঁরা যে কেবল ইংরেজদের তল্পিবাহকই হয়ে রয়ে গেছিলেন তা নয়, রেনেসাঁর  নতুন আলোকে আলোকিত করেছিলেন বাঙালির জ্ঞানের ভুবনকে  বাঙলার রেঁনেসা পশ্চাত্যের বস্তুবাদীতার অনুকরণ মাত্র ছিল না, তা ছিল প্রাচীন ভারতীয় সভ্যতার জ্ঞান ও প্রজ্ঞার উজ্জ্বল কিরণ। যদিও  উনবিংশ শতাব্দীর মধ্যবিত্তের মধ্যে মুসলমানের সংখ্যা ছিল নগন্য মুসলিম ধর্ম- নেতারা ছিলেন ইংরেজি শিক্ষার বিরোধী।  আর মুসলিমদের মধ্যে যারা ছিলেন অভিজাত তাঁরাও অভিমান বশত ইংরেজদের থেকে মুখ ফিরিয়ে ছিলেন উপরন্তু চল্লিশের দশকে প্রথম মহাযুদ্ধে বোমাতঙ্ক ও যুদ্ধোত্তর বাংলার দুর্ভিক্ষ এই দুটি ঘটনাই বাঙালি  মধ্যবিত্তের জীবনের ভীত সর্বাত্মক ভাবে নড়িয়ে দিয়েছিল আর বর্তমানে পুঁজিবাদের সর্বগ্রাসী প্রভাব এই শ্রেণীর মন ও মননে ধ্বংসের   শেষ পেরেকটি পুঁতে দিয়েছে।  তাই বর্তমানে রবীন্দ্রনাথ বাঙালির বিবেকচ্যুত হয়ে ড্রয়িং রুমে স্থান লাভ করেছেন।
           
বাঙালির 'রবি- ঋণ ' ব্যক্তি রবীন্দ্রনাথের থেকে রবীন্দ্র সাহিত্যের কাছে অনেক বেশি এবং সুদূর প্রসারী। সাহিত্য সমাজ নিরপেক্ষ বস্তুহীন শূন্যগর্ভ কল্পনা নয় আবার সাহিত্য সমাজের অনুপুঙ্খ ফটোশপও নয়। রবীন্দ্রসাহিত্য সমকালীন সামাজিক ঐতিহাসিক রাষ্ট্র নীতিক জীবনচর্চার সামগ্রিক মানসিকতার সৃষ্টিমূলক ফসল তাঁর সাহিত্য মানব জীবনের সমস্ত দিকের ছবি আছে। শতাব্দীব্যাপী সাম্রাজ্যবাদী শোষন বিধস্ত জীবনচর্চা যেমন আছে তার প্রতি অসন্তোষ, বিদ্বেষ, ঘৃণার সামাজিক রূপের বিকাশের প্রতিফলনও আছে। জীবনের ভালোলাগা, ভালোবাসা, ক্রোধ, স্নেহ, ধিক্কার, কল্পনা, সৌন্দর্যের প্রতি মানুষের   আকাঙ্ক্ষা এমন বিচিত্র ভাবে উঠে এসেছে তার সাহিত্যে যে একদিকে তা সমাজের সামগ্রিকতার অভিব্যক্তি অন্য দিকে মানুষের চিরন্তনী অভীপ্সা ও উৎকর্ষের প্রতীক স্বরূপ।

রবীন্দ্রসাহিত্যের   বিপুল অংশ রবীন্দ্রনাথের কল্পলোকের সৃষ্টি কিন্তু সে কল্পলোক কোন অবাস্তব জীবনচর্চার, জীবন সংঘাত চাঞ্চল্যহীন, বস্তু নিরপেক্ষ গজদন্ত মিনারের অলীক সামগ্রী নয়। তার সৃষ্ট কল্পলোক বাস্তবের নর্ম ও ঘর্মের ভূমি, জীবনের যাপনের সংগ্রামের সংঘাতের উৎকর্ষের উৎকৃষ্টে আবাসভূমি। তাই রবীন্দ্রসাহিত্য কালত্তীর্ণ। আজও জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে রবীন্দ্র সাহিত্যের অনুসঙ্গ জুড়ে দেওয়া যায় অবলীলায়। অর্থাৎ তার সৃষ্টির প্রত্যয়ের মধ্যে, বস্তুভিত্তিক অস্তিত্বের মধ্যে আমরা সমকালীন জীবনধারাকে যেমন খুঁজে পাই, ঠিক তেমনি বাঙলার শাশ্বত জীবনবোধের‌ উচ্চকিত প্রতীকও তাঁর সৃজনের মধ্যেই নিহিত। রবীন্দ্রনাথ তাঁর সৃষ্টির প্রবাহমানতায় যে বোধ, চেতনার ধারাকে মূর্ত করেছেন তার দীপ্তি আবহমান বাঙালি কোনদিনই অস্বীকার করতে পারবে না পারা উচিতও নয়।

রবীন্দ্রনাথের উপন্যাস ও গল্প  বাঙালিকে বঙ্কিমী বহির্মুখীনতা থেকে অন্তঃপুরবাসী করেছে,  রবীন্দ্রনাথের গান বাঙালি পুরুষকে তার ফিউডাল চরিত্রটি ঝেরে ফেলে 'প্রেমিক 'করে তুলেছে। আর বঙ্গ নারী তো তার  সমস্ত   অন্তর- অনুভূতি,  সমস্ত জিজ্ঞাসা ও জিজ্ঞাসার সার্থক জবাবের জন্য রবীন্দ্রনাথের উপন্যাসের কাছে, ছোটগল্পের কাছে, গানের কাছে আমৃত্যু ঋণী রবীন্দ্রনাথের পত্রাবলি কল্পবিলাসীর ব্যক্তিগত আলাপচারিতা নয়,  তা ভাষাইতিহাসের নির্ভরযোগ্য দলিল।
              
প্রকৃতপক্ষে  সকল কিছুর মধ্যে তিনি দেহধারী মানুষের উর্ধ্বে এক পরম সত্যের জন্ম দিতে চেয়েছেন তাই তাঁর রচনার মধ্যে প্রবেশ করতে হলে তাঁকে আমাদের উপার্জন করতে হবে, হেলায় পাবার যো নেই, আবার তাঁকে ছাড়াও আমাদের  একদন্ড  চলে না। রবীন্দ্রনাথের জন্ম,  বেড়ে ওঠা ও সৃজনাত্মক যাবতীয় কর্মের মূল ভিত্তি ভূমি দুই বাংলা মিলেই।তাই দুইবাংলার আকাশ বাতাস নদী ফুল ফল যোজন যাজন পুজা পার্বন সবেরই দেখা মেলে তার রচনায়। তবু শুনতে পাই, ওপার বাংলায় পাঠ্যসূচি থেকে রবীন্দ্র- সৃষ্টিকে বাদ দেওয়ার প্রয়াস চলে, তিনি নিছকই 'হিন্দুত্ববাদী লেখক 'এই অজুহাতে! 'রবীন্দ্রনাথ বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িকতা ' ব‌ইতে ফাহমিদ-উর-রহমান দাবী রেখেছেন ----- রবীন্দ্রনাথ অখণ্ড ভারতীয় জাতীয়তাবাদী হওয়া সত্ত্বেও কেন তিনি এ দেশের (বাংলাদেশের) বাঙালি জাতীয়তাবাদীদের সাংস্কৃতিক পুরোহিত হওয়ার গৌরব অর্জন করেছেন তার বিচার জরুরি এইসব আলোচনার মুক্তাঙ্গন গড়ে ওঠাও সমাজে রবীন্দ্রনাথের প্রভাব‌‌ই নামান্তরে।
        
আজও বাঙালির ঘরের শিশুটি প্রথম যে বইটির সঙ্গে স্কুলে পরিচিত হয় ---' সহজপাঠ', সেটির রচনা এত নিখুঁত ভাবে তিনি করেছেন যে আজ পর্যন্ত তার কোন বিকল্প নেই। কিন্তু বড় দুঃখের বিষয় বাঙালির জীবনের এই মহান সম্পদকে বাঙালি হেলায় হারানোর বন্দোবস্ত করে ফেলেছে।  একদা  মেকেল সাহেব কর্তৃক প্রচারিত ও ইংরেজ শাসকের দ্বারা পরিবেশিত কেরানী তৈরির শিক্ষাকে বাঙালি এমন  নিবিষ্ট চিত্তে  অনুসরণ করবার পণ করেছেন যে তাঁর মাতৃভাষার এখন নাভিশ্বাস। আর কে না জানে ভাষা মরে গেলে একটা জাতির মৃত্যু হয়। রবীন্দ্র- ভাবধারা প্রচারের মহৎ  উদ্দেশ্য নিয়েই বিশ্বভারতী রবীন্দ্রসৃষ্টির উপর থেকে সমস্ত রকম বিধি নিষেধ তুলে নেয়   ২০০২ ইং  সালে কিন্তু তার কোন সুফল বাঙালি আজ পর্যন্ত ঘরে তুলতে পারে নি একদিকে রবীন্দ্রনাথকে কুক্ষিগত করে রাখবার তাড়নায় বিশ্বের দরবারে তাঁর সৃষ্টিকে ছড়িয়ে দিতেও ব্যর্থ হয় বুদ্ধদেব বসু এক সময় আক্ষেপ করে বলেছিলেন, 'গীতাঞ্জলি 'র কারনে রবীন্দ্রনাথ প্রতীচ্যে কেবল হিন্দু কবি হয়ে রয়ে গেলেন তার সার্বিক শিল্পীতার রূপ তুলে ধরতে আমরা ব্যর্থ এই ট্র্যাডিশনের কোন বড় রকম পরিবর্তন আনতে পারিনিনি আজও উপরন্তু  নিজেরাও তাঁর সৃষ্টির যথাযোগ্য সম্মান করতে ব্যর্থ হয়েছি। সম্প্রতি 'সেদিন দুজনে দুলেছিনু বনে 'গানটি নিয়ে নেটিজেনরা যে নোংরামী তে মেতেছিল  তা কেবল অশ্লীলই নয়, বাংলার কৃষ্টি কালচারের দৈনতার নগ্নরূপ। বিশ্বভারতীর পড়ুয়াদের মধ্যেও আজকাল রবীন্দ্র -সৃষ্টির প্রতি উদাসীনতা চরম ভাবে পরিলক্ষিত। মৌলিক সৃজনের সন্ধানে এগিয়ে না এসে রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টিকেই কলুষিত করার যে ঘৃণ্য প্রবৃত্তি আজ অনুসৃত হচ্ছে তা রবীন্দ্রনাথকে কখন‌ও স্পর্শ করবে না ঠিক‌ই কিন্তু বাঙালির পতন সুনিশ্চিত করতে এক পদক্ষেপ এগিয়ে রাখবে।
       
রবীন্দ্রনাথের নোবেল পুরস্কারটিকে পর্যন্ত আমরা আগলে রাখতে পারিনি। এর থেকে লজ্জাজনক উদাসীনতা আর কী হতে পারে? আসলে রবীন্দ্রনাথের জীবনদর্শন ই আমরা উপলব্ধি করতে পারিনি, তাকে অনুসরণ করা তো অনেক দূরের কথা। নীরদ সি চৌধুরী বলেছিলেন :" ১৯০৫ - ১৯১১ সনের স্বদেশী আন্দোলন জাতি হিসাবে বাঙালির শেষ উদ্যম, ভারতবর্ষকে শেষ দান। " নীরদ সি  আরো আক্ষেপ করে বলেছেন "জাতীয় স্বাধীনতা পাইবার উন্মাদনায় বাঙালি তাহার অন্য সৃষ্টি প্রায় বন্ধ করিয়া আনিল। বাঙালি জাতির মানসিক শক্তির এত প্রাচুর্য ছিল না যে তাহারা পাঁচটা কাজ সমানভাবে চালাইতে পারে। " তাই বুঝি বাঙালি বিশ্ববাঙালি হতে গিয়ে নিজের ঘরটিই উজাড় করতে বসেছে নিজের সবচেয়ে সমৃদ্ধ আশ্রয়টিকে ভুলতে বসেছে।
               
"ওরে অকাল-জরা - জর্জরিত, আত্ম - অবিশ্বাসী ভীরু, অসত্য ভারাবনত মূঢ়, আজ ঘরের লোকদের ল‌ইয়া ক্ষুদ্র ঈর্ষার ক্ষুদ্র বিদ্বেষে কলহ করিবার দিন নয়, আজ তুচ্ছ আশা, তুচ্ছ পদমানের জন্য কাঙালের মত কাড়াকাড়ি করিবার সময় গেছে, আজ সেই মিথ্যা অহংকার দিয়া নিজেকে ভুলাইয়া রাখিব না,যে অহংকার কেবল আপনার অন্ধকারেই লালিত হ‌ইয়া স্পর্ধা করে, বিরাট বিশ্ব সভার সম্মুখে যাহা উপহাসিত লজ্জিত অন্যকে অপবাদ দিয়া আত্মপ্রসাদ লাভের চেষ্টা আজকে অক্ষমের চিত্ত - বিনোদন, তাহাতে আমাদের কাজ নাই।" অনেক ক্ষোভে, গভীর বেদনায় রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন কথাগুলি,  যার প্রাসঙ্গিকতা এতটুকু ধূসর হয়নি আজও
                   
বুদ্ধদেব বসুর কথা দিয়েই শেষ করবো --- রবীন্দ্রনাথ বাঙালির জীবনে এমনভাবে ব্যাপ্ত হ'য়ে আছেন, এত বিভিন্ন দিক থেকে তাঁর দ্বারা আমরা অনবরত  সংক্রান্ত, যে তাঁর শ্রেষ্ঠতা মেনে নিতে হলে তাঁর কবিতা বা কোনো কবিতা প'ড়ে দেখার আর প্রয়োজন হয় না চিন্তাহীন মালাচন্দনে আজ আবৃত তিনি এক বিগ্রহ, তার মাতৃভূমির নব্যতম অবতার " এই নির্বোধ ঠাকুর পুজার থেকে রথীন্দ্রনাথকে মুক্ত করতে না পারলেও আমাদের‌ মুক্তি নেই। রবীন্দ্রনাথ এখন আমাদের দেশের একটি বিশেষ শ্রেণীর মধ্যে প্রবল ও প্রমত্তভাবে গৃহীত তাঁর সম্পর্কে আমজনতার প্রতিক্রিয়া যাই হোক না কেন তিনি আবার একটু বেশি গৃহীত হয়েছেন আমাদের রাষ্ট্র ও সমাজে প্রাধান্য বিস্তারকারী একটি শ্রেণীর মধ্যে এরা সামাজিক-রাষ্ট্রিকভাবে খুবই শক্তিশালীতেমন‌ই বাংলায় বর্তমান সরকার ক্ষমতায় এসে রবীন্দ্রনাথ ভাবধারা প্রচারের লক্ষ্যে পার্কে, বাগানে, রাস্তায়,  লেভেল ক্রসিং এ রবীন্দ্রসঙ্গীত শোনানোর ব্যবস্থা করেছিলেন। এই ব্যবস্থা নিন্দার্হ নয় ঠিকই, তবে রবীন্দ্রনাথকে বোঝার জন্য পথেঘাটে বাহ্যিক আড়ম্বড়ের প্রয়োজন নেই, তিনি শুধু পঁচিশে বৈশাখ ও বাইশে শ্রাবনের নন তিনি আমাদের সর্বান্তকরণের, সমস্ত মুহূর্তের -- তা অন্তর দিয়ে  একান্ত অনুভবের প্রয়োজন আছে সর্বাগ্রে
     
কপিরাইট সুস্মিতা কৌশিকী কর্তৃক সংরক্ষিত
 

কথা ঋণ:
বাঙালিত্বের খোঁজে এবং অন্যান্য আলোচনা: শিবনারায়ণ রায় নির্বাচিত প্রবন্ধ: নীরদচন্দ্র চৌধুরী প্রবন্ধ সংকলন: বুদ্ধদেব বসু)

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন