অসীম সে চাহে সীমার নিবিড় সঙ্গ * হাসিদা মুন



অসীম সে চাহে
সীমার নিবিড় সঙ্গ

রবীন্দ্রনাথের অখন্ড ব্যক্তিসত্তা সত্যদর্শী ব্রহ্মজ ঋষিগনের শাশ্বত কল্যাণবানীর দ্বারা অনুপ্রানিত।  তাঁর সমাজচিন্তা, ইতিহাস চিন্তা, শিক্ষা চিন্তায় বৌদ্ধধর্মের মৈত্রী ভাবনা, বাউলের মানবতাবাদ, গৌড়ীয় বৈষ্ণবগনের রসসাধনা, মরমিয়াবাদের প্রেমধর্ম, হিন্দুধর্মের ভক্তিবাদ ও ইসলামের অদৃশ্য ভাতৃত্ববোধে তাঁর ধর্মচেতনা পরিপুষ্ট। তারঁ রচনাবলীতে এমনই  মুল-সুর নানাভাবে ধ্বনিত হয়েছে।

অসীম সে চাহে সীমার নিবিড় সঙ্গ, সীমা চায় অসীমের মাঝে হারাতে ।

রবীন্দ্রনাথের ধর্মচেতনার বৈচিত্র্য ও বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারনা 'নৈবেদ্য', 'গীতাঞ্জলী ' 'গোরা', 'শান্তি-নিকেতন ',  'ধর্ম' , ' মানুষের ধর্ম 'রচনাবলীতে গভীর  ভাবে আলোচনা  হয়েছে । ঋষি ও মহির্ষদের মতো তিমি শান্তরসের উপাসক। ভাবোন্মত্ততাকে ভক্তি  বলে আমরা  ভ্রম  করি। প্রেমের যে সর্বোচ্চ স্তরে আরোহণ করলে প্রেমিকের দেহে অষ্ট সাত্ত্বিকের বিকারের প্রকাশ পায়, সে স্তরটি অনেকের কাছে অনধিগম্য। সেকারনে অতি ভাবপ্রবণ ও দূর্বল মানুষের ভেতরও অশ্রু, স্বেদ ও রোমাঞ্চ প্রকাশ হতে পারে। তাই কবিগুরু বলেন,  "যে ভক্তি  তোমাদের লয়ে ধৈর্য  নাহি মানে, / মুহূর্তে  বিহ্বল হয় নৃত্য -গীত-গানে /ভাবোন্মাদমত্ততায়, সেই জ্ঞানহারা / উদ্ভ্রান্ত উচ্ছলফেন ভক্তিমদধারা /নাহি চাহি নাথ।... (নৈবেদ্য)। পদে পদে ভয়কে প্রশ্রয় দেওয়াই যে এদেশের দুর্গতির একটি প্রধান কারণ , তাও তিনি উপলব্ধি করেছেন নৈবেদ্য বলেন.... অস্ত্রে দীক্ষা দেহো / রণগুরু। তোমার প্রবল পিতৃস্নেহ / ধ্বনিয়া উঠুক আজি কঠিন আদেশে। পুনশ্চঃ এ দুর্ভাগ্য দেশ হতে হে মঙ্গলময়,/ দূর করে দাও তুমি সর্ব তুচ্ছ ভয় -/ লোকভয়,  রাজভয়, মৃত্যুভয় আর। ঋষিদের উদাত্ত কন্ঠে মানুষকে অমৃতের পুত্র বলে সম্বোধন করেছেন, তারা বলেছেন 'আমি সেই আদিত্যবর্ণ মহান পুরুষকে জেনেছি। আর একমাত্র তাঁকে জেনেই মানুষ  অমৃতত্ব লাভ করতে পারে'  ঋষির এই দিব্যচেতনা ও দিব্যানুভূতি রবীন্দ্রনাথ বিশেষভাবে আকৃষ্ট। 

তিনি লিখেন -

একদা এ ভারতের কোন্ বনতলে, /কে তুমি মহান প্রাণ, কী আনন্দবলে /উচ্চারি উঠিলে উচ্চে,  ' শোনো বিশ্বজন, / শোনো অমৃতের পুত্র যত দেবগণ / দিব্যধামবাসী, আমি জেনেছি তাঁহারে, / মহান্ত পুরুষ যিনি আঁধারের পারে / জ্যোতির্ময়। তাঁরে জেনে, তাঁর পানে চাহি /মৃত্যুরে লঙ্ঘিতে পার, অন্য পথ নাহি '

রবীন্দ্রনাথ ঋষিদের হৃদয়কন্দর থেকে নিঃসৃত বাণীর উপর নতুন আলোকপাত করেছেন। তারা দেখেছেন প্রকৃতির রাজ্যে আছে নিয়মের রাজত্ব বা ঋত ; মানুষের জীবন কিন্তু এক দিকে নিয়মের অধীন, অপর দিকে স্বাধীন। ব্রহ্ম একদিকে সত্যস্বরূপ ও জ্ঞানস্বরূপ, অপরদিকে আনন্দস্বরূপ ও অমৃতস্বরূপ। প্রকৃতিতে যিনি নিয়মরূপে প্রকাশিত তিনিই  মানুষের আত্নায় আনন্দরূপে উদ্ভাসিত। রবীন্দ্রনাথ তাই বলেন ঈশ্বরের ইচ্ছা যে দিকে নিয়মরূপে প্রকাশ পায়, সেই দিকে প্রকৃতি আর ঈশ্বরের ইচ্ছা যে দিকে আনন্দরূপে প্রকাশ পায় সেদিকে আত্না। এই প্রকৃতির ধর্মবন্ধন আর আত্মার  ধর্মমুক্তি। এই সত্য এবং আনন্দ, বন্ধন এবং মুক্তি তাঁর  বাম এবং দক্ষিণ বাহু। এই দুই বাহু দিয়েই তিনি মানুষকে ধরে রেখেছেন। 'ছিন্ন পত্রাবলী'তে তিনি বলেন 'প্রকৃতির মধ্যে, মানুষের মধ্যে, আমরা আনন্দ কেন পাই (সে আনন্দ যতই ক্ষুদ্র যতই চঞ্চল হোক) তার একটিমাত্র সদুত্তর হচ্ছে - এ কথা নিজে না বুঝলে কাউকে  বোঝাবার জো নেই '। বাস্তবিক ব্রক্ষ যে আনন্দরূপমমৃতম',  এ উপলব্ধির বস্তু।  এই সত্য উপলব্ধি করেই 'গীতাঞ্জলি'তে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন " জগতে আনন্দ -যজ্ঞে আমার নিমন্ত্রণ, / ধন্য হল,  ধন্য হল মানব-জীবন। " এই আনন্দবাদ ঋষিগনের চিন্তাধারার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। এই আনন্দের মন্ত্রে যিনি দীক্ষিত, যিনি আনন্দস্বরূপকে জেনেছেন, তিনি অভয় ও অশোক হয়েছেন। রবীন্দ্রনাথের নানা রচনায় বারংবার তা প্রকাশিত।

সভ্যতার ইতিহাসে যখনি কোন নতুন পথের আবিষ্কার হয়েছে তখন অল্প কয়েকজনই সে পথে পা বাড়িয়েছে, তারাই শুধু বলেছে এই পথেই রয়েছে বহু দূর গতি। কিন্তু অধিকাংশ লোক কেবল পা গুটিয়েই বসেনি পিছন ফিরে বসেছে। এর পরিনামে দূর গতি নয় দুর্গতি, তাই হচ্ছে সহজ ও স্বাভাবিক মনোবৃত্তি। মানুষের একলা হবার প্রবৃত্তিই হচ্ছে তার রিপু, সত্যভাবে মিলিত হবার সাধনাই কল্যাণ। এই দুই এর বিরোধ নিয়ে কুরুক্ষেত্র লড়াই মানুষের ইতিহাসে চলে আসছে, এখনো মানুষ শান্তিপর্বে এসে পৌঁছায়নি। রবীন্দ্রনাথ তাই বিবর্তন নিয়ে বলেন - সংহতির মূল প্রবর্তনার ভিন্নতা অনুসারে তার প্রকাশের ভিন্নতা ঘটে, এই মূল প্রবর্তনা যদি পলিটিক্স হয়, পররাষ্ট্রের প্রতিযোগীতায় স্বরাষ্ট্রকে শক্তিমান ও সম্পদশালী করে তুলবার চেষ্টা হয় তবে তার দ্বারা যে সংহতি ঘটে সে হয় অহমিকার সংহতি। তার বাহ্যরূপে একটা মিলনের চেহারা দেখা যায় কিন্তু তার মূলতত্ত্ব মিলনতত্ত্ব নয়, প্রধানত সে হচ্ছে দ্বন্দ্ব। সেই বিরাট অহমিকার মেদস্ফীত আত্মম্ভরিতাকে অস্ত্রেশস্ত্রে রত্নালংকারে ভুষিত দেখে লুব্ধ মানুষ তার পূজায় প্রবৃত্ত হয়। এই পূজার প্রধান আয়োজন নরবলি। সে বলির মানুষ যে কেবলমাত্র পররাষ্ট্রের মানুষ তা নয়, আপনদেশের বিপুল সংখ্যক মানুষকে যন্ত্রের মধ্যে ফেলে খর্ব না করলে এই পলিটিক্সের পুষ্টি হয় না। তার শক্তিমূর্তি লক্ষ লক্ষ মানুষকে কেটে ছেঁটে, জুড়ে -তেড়ে সৈনিকরূপে নিজের জয়রথ তৈরী করে। যে পর্যন্ত না এই রথে করেই তার শ্মশানযাত্রা ঘটে। তার ধনমূর্তি লক্ষ কোটি মানুষকে পঙ্গু করে তাদের পিন্ড পাকিয়ে নিজের জয়স্তম্ভকে অভ্রভেদী করে তুলতে থাকে,  যে পর্যন্ত না এই স্তম্ভ বিদীর্ণ করে নৃসিংহ বেরিয়ে আসে। মানুষের ইতিহাসে এর আগে অনেক দুঃখ দূর্ঘটনা ঘটেছে। শক্তির লোভ চিরদিনই নররক্ত পিপাসার পরিচয় দেয়। তার স্বর্নলঙ্কার চিরদিনই দেবতাদের হাতে হাতকড়ি পড়েছে। তার দশ মুন্ড বিশ হাত দশ দিকে ধর্মকে উপেক্ষা করবার জন্য উদ্যত। তাই চিরদিনই তার স্বর্নালঙ্কার কোন না কোন সময়ে আগুন লেগেছে। কিন্তু বর্তমান যুগে বিজ্ঞানের সহায়তায় এই রিপু যে রকম কঠিন উপকরনে বিরাট আকারে গড় বেঁধেছে। এমন কোনদিন করেনি। এর তারকা রাক্ষুসীর দল জগৎসুদ্ধ লোককে তাড়না করে অতিষ্ট করে তুলল। অবশেযে আজ এই সংহতির চেলাদের মধ্যে কেউ কেউ কেঁদে বলছে শান্তি চাই, শান্তি চাই,  কেননা এবারকার লঙ্কাকান্ড ত্রেতাযুগকে হারিয়ে দিয়েছে।

কিন্তু রিপুও পুষবো শান্তিও পাবো - বিধাতার সঙ্গে এমনতর চাতুরীতো চলে না।  চোরাই মালে ঘর বোঝাই করে বিচারকের কাছে মাপ চাইবো এমন দরবারতো মন্জ্ঞুর হবে না। আগুনের পর আগুন লাগবে যুদ্ধের পর যুদ্ধ বাধবে। ইতোমধ্যেও মানুষের  ইতিহাসে অন্ধকার গুহার মধ্যে একটি উপেক্ষিত শক্তি গোপনে আপনার বেগ  সঞ্চয়  করেছিল। পরোপজাতি হয়ে যে ব্যবস্হা আপনাকে পোষন করে,  একদিন তার উপজীবিকাই তার পরম শত্রু হয়ে দাঁড়াচ্ছে বর্তমান যুগের সভ্যতার মতো এমন দাসতন্ত্র সভ্যতার আর নেই। এই সভ্যতা উপকরনে বায়ুগ্রস্হ। এই উপকরণের অধিকাংশই তার পক্ষে বাহুল্য। অথচ একে তৈরী করতে এর ভার বহন করতে একে রক্ষা করতে বহু দাসের দরকার। তাদের না হলে এ সভ্যতার একদিনও চলে না। তার মানে হচ্ছে,এই খানেই এর সকলের চেয়ে দূর্বলতা। তার বিপুল ঐশ্বর্যের দ্বারাতেই এতদিন তার এই দূর্বলতা ঢাকা পড়ে ছিল। ক্রমেক্রমে এইটি প্রকাশ হয়ে পড়ছে। যারা অত্যাবশ্যক, তাদের আবশ্যকতাই তাদের ঐশ্বর্য। যতদিন এ কথা তারা না জানে ততদিন নিজের মূল্য বোঝে না বলেই তারা এত সস্তায় বিকিয়ে যায়। বর্বরদেশে শোনা যায় গজদন্ত পুঁতির মালার দরে বিকিয়ে গেছে। যখন তারা বাজার দরের খবর পেয়েছে তখনই দাম চড়ে গেছে। তেমনি একদিন ইউরোপের পলিটিক্সের প্রতাপ দাসের কাঁধে চড়ে জগৎ জয় করে বেড়িয়েছে। দাসের দল ভেবেছিল যারা তাদের চালাচ্ছিল তারাই চালাক। অতএব কাঁধ পেতে দিতেই হবে। ইদানীং তারা এই সহজ কথাটা আবিষ্কার করেছে যে তারা না চালালে উপরওয়ালারা অচল। তারা অত্যাবশ্যক অতএব বর্তমানের ঐশ্বর্য তাদের হাতেই। এই আবিষ্কারের জোরে বর্তমান সভ্যতার বাহনের দল মাঝে মাঝে কাঁধ ঝারা দিতে আরম্ভ করেছে - তার উপরে যারা বসে আছে, তারা অত্যান্ত বিচলিত হয়ে উঠেছে, শক্তির যে উপলব্ধি উপরে চড়ে বসে ছিল সেই উপলব্ধিটা নিচে বাহনের মধ্যে প্রকাশ করছে। এই বাহনদের সংহতিই যে মানুষের সকল সংহতির চেয়ে বড় তা আমি মনে করি না। কেননা এখনো দ্বন্দ্বের প্রভাব। শক্তি উপরে বসেও নখদন্ত চালনা করে, নিচে নেমে সে বৈষ্ণব হয়ে উঠে না। পাশ্চাত্যের সঙ্গে যে অন্যায় বিরোধ  বিশ্বজুড়ে তার মধ্যে যে কেবল ধনীদের হাত আছে তা নয়, ধনের বাহনদেরও হাত আছে। কিন্তু ইউরোপে কর্মজীবিদের যে দল বেঁধে উঠছে তার মধ্যে একটি বড় কথা আছে। এই দল নেশনের বেড়াকে একদিন সম্পূর্ণ অতিক্রম করবে,  এমন আশা দেখা যাচ্ছে। কারন ধনের রথযাত্রায় যে দড়িটা ধরে টান দিতে হচ্ছে সে দড়িটা সমস্ত পৃথিবীর উপর দিয়ে চলে গেছে, যারা টানছে তারা সকল দেশেরই মানুষ । এই দড়িটার ঐক্যে তারা এক। তাই এই ঐক্যটাকে অবলম্বন করেই তারা সম্পূর্ণ আটঁ বাধতে পারবে। যদি এই আটঁ বাধা সম্পূর্ন হয় তা হলে পৃথিবীতে একদিন একটা অতি প্রচন্ড শক্তির উদ্ভব হবে। এই দুঃসহ শক্তির প্রলোভনই সোভিয়েত সম্প্রদায়কে বিচলিত করেছিল। তারা তাড়াতাড়িতে এটিকে জাগ্রত করতে লোলুপ হয়ে উঠেছিল।সকল লোলুপতারই যে লক্ষন, নিষ্ঠুরতা ও জবরদস্তি তা সেখানেও দেখা দিয়ে ছিল। শক্তির লীলা সমাজের উপরের স্তরে আপনার ভাঙ্গাগড়ার কাজ অনেকদিন ধরে করে আসছে।

এই শক্তি এবার নিচের স্তরে আপনার কাজ করবে বলে উদ্যোগ করেছে। কেউ ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না। এই স্তরে যখন তার আধিপত্য দেখা দেবে তখনই যে মানুষের সকল পাপ মোচন হবে, আর শক্তি তার শৃঙ্খলা রচনার চিরকাল ব্যবসা ছেড়ে দিয়ে রাতারাতি মানুষের মুক্তি সাধনায় প্রবৃত্ত হবে। এ কথা আমি বিশ্বাস করি না। তবে এ কথা সত্য যে সুখ-দুঃখ, ভাল-মন্দের প্রবল সংঘাতের দ্বারাতেই শক্তি সৃষ্টিকাজের প্রয়োজন সাধন করে -ভূমিকম্প দৈত্যদের হাতুড়ি পিটুনির চোটেই আজকের দিনের এই পৃথিবী তৈরী হয়ে উঠেছে। সমাজের নিচের তলায় যে উপকরণ ভান্ডারে এতদিন শক্তির কারখানাঘর বসেনি, আজ সেখানে যদি বসে, তা হলে মানুষ তাতে করে নিছক সুখ পাবে না, তাকে অনেক নতুন নতুন ব্যাথা সইতে হবে। সৃষ্টিকার্যে এই ব্যাথার দরকার আছে। অতএব তার জন্য প্রস্তুত থাকাই ভালো। পৃথিবীর সর্বত্রই মানুষের ইতিহাসের যে চেষ্টা দেখতে পাচ্ছি, ভারত তার থেকে স্বতন্ত্র হয়ে থাকলে বঞ্চিত হবে। নতুন শক্তির যে বিশ্বব্যাপী মন্দির তৈরী হচ্ছে তার একটা সিংহদ্বার রচনার ভার ভারতকেও নিতে হবে বৈকি।

রবীন্দ্রনাথের সত্যকারের প্রকাশ তার কর্মে নয় তার সাহিত্যে। রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য সম্পূর্ণতার সাহিত্য। তার সাহিত্য স্রোতস্বতী যখন পাঠকের মনের উপর দিয়ে বয়ে যায় তখনই সে নিজের মনে মনে হয়ে যায়। তখনই অলক্ষ্যে তাঁর নিজের অগোচরে ভাব, চিন্তা ও প্রেরণার পলি পড়তে থাকে, পলে পলে যা হয়ে যায় -তার চিত্তলোকে তার অবচেতনার আরেক উপাদান জমায় -নতুন ফসল ফলাবার জন্যই যে জমি। তলে তলে তার জীবনের রূপান্তর ঘটে, যার ফলে তার কর্মধারায় ও লোকযাত্রায় অপরূপায়ন ঘটতে থাকে ;যে সম্পূর্ণ হয়ে উঠতে থাকে। মানসিক বাধা দূর করায়। শুধু বাঁধা দূর করাই নয়, পূর্নতার পথনির্দেশও দেয়। রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য সম্পূর্ণতার সাহিত্য বিশেষ করে এজন্যে অনন্ত নিজ গুনে এই সাহিত্যে এসে ধরা দিয়েছে। এর ঐশ্বর্য, এর প্রাচুর্য, এর প্রকাশ বৈচিত্র্য এর ঋদ্ধি সমৃদ্ধি আর রূপ রসের বিস্তার -সকল বিচারে এ অনন্ত বিকাশ। জীবনের যে কোন জরুরী অবস্থায় যে কোন সমাজের যে কোন যুগের যে কোন বয়সী রবীন্দ্রনাথের কাছে সাহায্য পেতে পারে, কোন মনোবিজ্ঞানীর এতটুকু গভীরে যেয়ে নর-নারীর আবেগ ও চিন্তার মৌলিক কাঠামোর গঠন নিয়ে জানা নেই, প্রতিষেধক নেই, প্রতিরোধকও নেই যা রবীন্দ্র সাহিত্যে রয়েছে। চরিত্রের মৌলিকত্ব বিবর্তনের স্তরে স্তরে স্বরূপ পায়, জীবনের মোটা সুর মুলধারা থেকে নিত্য আনন্দের শেষ স্তর সাহাস্রা চক্র পর্যন্ত সবটুকু খুলে দাড় করিয়েছেন।

অবিভক্ত  ভারতবর্ষের প্রতিটি অধিবাসী নিজের অস্তিত্ব খুঁজে নিতে, ধর্মের ব্যাকরন বুঝতে, ভারততত্ত্ব নিজের করে জেনে নিতে, সংস্কৃতির আন্ডার কারেন্ট অনুভব করতে, সম্পর্ক ও সংযোগে অতীন্দ্রিয়তার ওভারটোন ধরতে, হিন্দু তত্ত্ব- তথ্য আচারের রূপ-প্রকৃতি বুদ্ধি আর হৃদয়ের  বিকাশে পরিচয় পেতে, ব্রাক্ষসমাজের স্বচ্ছ কাঠামো কাছ থেকে দেখতে  সব পড়ার দরকার হবে না শুধু "গোরা" উপন্যাসই যথেষ্ট হবে। বিনয়, গোরা, পরেশবাবু, হারানবাবু ও সুচরিতা চরিত্র সম্পর্কিত সকলে মিলে সরল সহজ নানা ঘটনায় উল্লেখিত বিষয়গুলো মূর্ত করে তুলবে।

মানুষের আইডিয়া ও প্রবৃত্তির আকার-প্রকৃতি, সত্যের জন্যে মিথ্যার আবাদ, সত্য মানুষের লক্ষ্য না লক্ষ্য ফললাভ।  সত্যের  এক ও অনন্ত রূপ,সত্যের উপর মোহের স্হাপন, সত্যকে লজ্জা, ইচ্ছার সংস্কার,  পুরুষে রাজার রূপ, খাজনা নেবে দাবী করবে অন্যায়ের তপস্যাকে প্রচার করে সভ্যতা গড়বে - পৃথিবীতে এসেছে কর্তৃত্ব করতে সন্দীপ চরিত্রের মত। আর নিখিল নামে যে খাঁটি মাল, চাঁদ সওদাগরের মত ওঁ অবাস্তবের শিবমন্ত্র নিয়েছে, বাস্তবের সাপের দংশনকে ওঁ মরেও মানতে চায় না, মুশকিল এই এদের কাছে মরাটা শেষ প্রমান নয়। ওরা চক্ষু বুজে ঠিক করে রেখেছে তার উপরেও কিছু আছে। দাম্পত্যে জীবনের বিকাশ মানা, সুকঠিন ভালোর ছাঁচে নিখুত করে ভালোকে জড়বস্তু মনে করে  জবরদস্তি করা, সহধর্মিণীকে গড়তে গিয়ে স্ত্রীকে বিকৃতি, স্ত্রী কথাটির মধ্যে আস্ত মানুষকে আগাগোড়া পুরে ফেলা, এই কথাটিতেই জীবনের যা কিছু মধুর, যা কিছু পবিত্র সব দিয়ে বুকে রাখা একদিনও ধুলোতে না নামানো ঐ নামে পূজার ধুপ সাহানার বাঁশি বসন্তের ফুল শরতের শেফালী নর্দমার খোলা জলে হঠাৎ কাগজের নৌকার মত ডুবে যাওয়া,স্পষ্ট বুঝে বিশেষ সাজগোজ পথ হারানো তাকানোর গতি দিতে, সমুদ্রের ডমরুর তালে তালে নিজের স্রোতের কলতান আপনি বেজে উঠা,  স্ত্রীপুরুষের পরষ্পরের যে মিলনের টান সে বাস্তবতা, বাস্তবকে যখন অবাস্তবের সাথে সঙ্গে মিলতে হয় তখন একমাত্র প্রধান অস্ত্র ছলনার পরিচয় পেতে, মধুকথার ভিজে গামছায় জড়িয়ে ঠান্ডা রাখা, স্বভাবের চেয়ে বড় হতে চাওয়া, খাদ্যের চেয়ে মদের দিকেই স্বভাব মাতাল পুরুষজাতটার ঝোক আর নানা কৌশলে নানা ভাবে ভঙ্গীতে নারী নিজেকে মদ বলেই চালাতে চায়, তারা বস্তুতন্ত্র। প্রবৃত্তিকে নিবৃত্তির সাথে বুঝতে, যারা কাড়তে জানে না, ধরতে পারে না, একটুতেই যাদের মুঠো আলগা হয়ে যায়, পৃথিবীতে সেই আধমরা এক দল লোক আছে নিতী সেই বেচারাদের সান্ত্বনা দিক, কিন্তু যারা সমস্ত মন দিয়ে চাইতে পারে সমস্ত প্রাণ  দিয়ে ভোগ করতে জানে, যাদের দ্বিধা সংকোচ নেই, তারাই প্রকৃতির বরপুত্র।

তাদের জন্যেই প্রকৃতি যা কিছু সুন্দর, যা কিছু দামি সাজিয়ে রেখেছে। তারাই নদী সাতরে আসবে, পাচিল ডিঙ্গিয়ে পড়বে, দরজা লাফিয়ে ভাঙ্গবে, পাবার যোগ্য জিনিস ছিনিয়ে নিয়ে কেড়ে নিয়ে আসবে, এতেই যথার্থ আনন্দ, তর্কটা এখানেই আমিও বলি আপনাকে জানো, সেও বলে আপনাকে জানো। কিন্তু সে যা বলে তাতে দাড়ায় এই আপনাকে না জানাটাই হচ্ছে জানা।  বিমলা, নিখিলেশ আর সন্দীপকে নিয়ে "ঘরে-বাইরে" নর-নারীর প্রকৃত মানসিক গঠন যেমন করে বিবৃত হয়েছে সিগমন্ড ফ্রয়েড ততটুকুু জেনে যেতে পারেননি। রবীন্দ্র কাব্য দাম্পত্যের ব্লু প্রিন্টের নকশা তুলে ধরে,  যা  থেকে  পাঠক সহজাতভাবেই তার সংগ্রহ তুলে নেবে অবচেতন মনেই।

সমাজে কর্তৃত্ব করে সে ঘরে কেবল উত্তরাধিকারী হয়ে জন্মায় সন্তান হয়ে নয়, ছেলেবেলা থেকেই পিতা প্রতি মুহূর্তে পরখ করে উপার্জিত যশমান বজায় রাখতে পারবে কিনা, বংশের মুখ উজ্জ্বল করতে পারবে কিনা। প্রতি কর্ম অঙ্গভঙ্গি পরীক্ষার চক্ষে দেখা হয় স্নেহের চক্ষে নয়, আত্মীয়স্বজন, সভাসদ, অধীনস্থরা প্রতি কথা কাজে খুঁটে খুঁটে ভবিষ্যত গণনা করে।তলোয়ারে শত্রুকে জয় করা যায় কিন্তু সংগীতে শত্রুকে মিত্র করা যায় এমন স্পষ্ট চিত্র "বউ-ঠাকুরানীর হাট " উপন্যাসে রাজপথের ন্যায় সরল সমতল প্রশস্ত করে উপস্হাপন হয়েছে সামাজিক এই স্তরের জটিল পরিস্থিতির আবর্তে মানুষগুলোর দিক নির্দেশনা পেতে।

"গোবিন্দমাণিক” কে দেখিয়া বোধ হইল তিনি যেন সমস্ত ত্যাগ করিয়াছেন, তবু যেন সমস্তই তাহারই। তিনি কিছুই চান না বলিয়াই যেন হারাইয়াছেন তিনি আপনাকে দিয়েছেন বলিয়া পাইয়াছেন। তিনি যেমন আত্মসমর্পণ করিয়াছেন, তেমনি সমস্ত জগৎ আপন ইচ্ছায় তাঁহার নিকটে ধরা দিয়েছে। কোন প্রকার আড়ম্বর নাই বলিয়া তিনি রাজা এবং সমস্ত সংসারের নিতান্ত নিকটবর্তী হইয়াছেন বলিয়া তিনি সন্নাসী। এই জন্য তাহাকে রাজাও সাজিতে হয় নাই সন্ন্যাসীও সাজিতে হয় নাই। দুঃখ যে পাপেরই ফল তা কে বলে পুন্যের ফলওতো হতে পারে, কত ধর্মাত্না আজীবন দুঃখে কাটিয়ে গেছেন এমন প্রেরনা ইতিহাস নির্ভর " রাজর্ষি" উপন্যাসে সন্তুষ্টি দেবে।

রবীন্দ্রনাথের গান-কবিতা  শ্রোতারা উপলব্ধিতে নিয়ে নেয় কোন ধরনের ইন্টারপ্রিটিশান ছাড়াই, উপন্যাসগুলো কগনিশনে নিতে কেবল সামাজিক স্তরের সৃষ্টি হয়েছে যেখানে বাঙালী অথবা বিশ্বের যে কোন সভ্য সমাজের নরনারী তাঁর কাব্যগ্রন্হ থেকে উপকৃত হতে পারে যেটা কোন মনোবিজ্ঞানীর পক্ষে সম্ভব নয়, তাঁর নানা চরিত্রের অনুভবগুলো নিয়ন সাইনের মতো দৈনন্দিন জীবনে নিয়তই পরিচিত ও শ্বাশত, জানান দিয়ে যায়, নিউরনে অনুরণন তুলে সত্য উপলব্ধি করায়, তিনি লিখছেনআমার আর দুঃখ নেই আমি শান্তি পাইয়াছি। শান্তি সুখ আপনার মধ্যেই আছে, কেবল জানিতে পাই না। ভগবান এ যেন মাটির হাঁড়িতে অমৃত রাখিয়াছেন, অমৃত আছে বলিয়া কাহারও বিশ্বাস হয় না। আঘাত লাগিয়া হাঁড়ি ভাঙিলে তবে অনেক সময়ে সুধার আস্বাদ পাই। হায় হায় এমন জিনিসও এমন জায়গায় থাকে! সকলেই অতি সহজেই ভাইয়ের মতো ব্যবহার করে কেবল নিজের ভাই করে না।

সংসারে কঠিন কর্তব্য হইতে প্রেমকে ফুলের মতো ছিঁড়িয়া স্বতন্ত্র করিয়া লইলে তাহা কেবল আপনার রসে আপনাকে সজীব রাখিতে পারে না, তাহা ক্রমেই বিমর্ষ ও বিকৃত হইয়া আসে। সেও মনে মনে দেখিতে লাগিল তাহাদের অবিশ্রাম মিলনের মধ্যে একটা শ্রান্তি ও দূর্বলতা আছে। সে মিলন যেন থাকিয়া থাকিয়া কেবলই মুষড়িয়া পড়ে -সংসারের দৃঢ় ও প্রশস্ত আশ্রয়ের অভাবে তাহাকে টানিয়া খাড়া রাখাই কঠিন হয়। কাজের মধ্যেই প্রেমের মূল না থাকিলে ভোগের বিকাশ পরিপূর্ণ এবং স্হায়ী হয় না, "চোখের বালি " তেমন মাইলস্টোন যেখানে পারিবারিক সংযোগ চোখে পড়ে, এতে সর্বকালের মনুষ্য প্রবৃত্তির নাগকে জাপটি মেরে ধরা হয়েছে, বিবাহের অল্পকালের মধ্যেই স্বামীস্ত্রী পরষ্পরের কাছে নিজেকে নিঃশেষ করিবার উপক্রম করে - প্রেমের সংগীত একেবারেই তার স্বরের নিখাঁদ  হইতে শুরু হয়েছিলসুদ ভাঙ্গিয়া না খাইয়া তাহারা একেবারেই মূলধন উজার করিবার চেষ্টায় ছিল। এই খেপামির বন্যাকে তাহারা প্রত্যেহিক সংসারের সহজ স্রোতে কেমন করিয়া পরিনত করিবে। নেশার পরেই মাঝখানে যে অবসাদ আসে সেটা দূর করতে মানুষ আবার যে নেশা চায় সে নেশা স্ত্রী কোথা হইতে জোগাইবে। এমন সময় বিনোদিনী নবীন রঙিন পাত্র ভরিয়া আশার হাতে আনিয়া দিল। আশা স্বামীকে প্রফুল্ল দেখিয়া আরাম পাইল। এখানে কোন কল্পনাবৃত্তি নেই, নিখাঁদ সত্যটি রবীঠাকুর তুলে এনেছেন। তৃতীয়পক্ষের ঘা খেয়ে, বাহির থেকে নাড়া পেয়ে ছাই চাপা আগুন কেমন করে জ্বলে উঠে তা নিয়ে এখনকার প্রজন্ম অনুভব করছে, এ উপন্যাসের উপজীব্যতা কখনো হারাবে না। রবীন্দ্রনাথের হাতে আছে রঙের তুলি, সমাজে যে কোন ক্ষেত্রে  সেই তুলি বুলিয়ে সেই চিত্রকে রঙিন করে তুলছেন বিভিন্ন অবয়বে। ভিন্ন প্রক্রিয়ায় তিনি অস্তিত্বের সাথে নিজের সংযোগ ঘটিয়েছেন অনন্ত অনুরাগে -কাজেই তিনি অনন্তের কবি, উপন্যাসিক। রবীঠাকুর লিখছেন, যে সব কথা মুখে বলা হয়নাই তারই পরিনাম বেশী। পাগল হইলে অনেক কঠিন কথা অতি সহজে মীমাংসা করিবার শক্তি জন্ম নেয় । পাগলামি আরব্য উপন্যাসের সেই জুতা যা পায়ে দিলে সংসারের হাজার হাজার বাজে কথাগুলো একেবারে ডিঙাইয়া যাওয়া যায়।

যে মুখে তিনি আমার দিকে আসিতেছেন আমি যদি সেই মুখেই চলিতে থাকি তবে তাঁর কাছ থেকে কেবল সারতে থাকবো, আমি ঠিক উল্টা মুখে চলিলে তবেই তো মিলন হইবে। সে যা বলিল রেখাগনিত হিসাবে তা ঠিক কিন্তু ব্যাপারটা কি? তিনি রূপ ভালবাসেন তাই কেবলই রূপের দিকে নামিয়া আসিতেছেন। আমরা তো শুধু রূপ লইয়া বাঁচি না আমাদের তাই অরূপের দিকে ছুটিতে হয়। তিনি মুক্ত তাই তাঁর লীলা বন্ধনে। আমরা বন্ধ সেজন্য আমাদের আনন্দ মুক্তিতে। এ কথাটা বুঝি না বলিয়া আমাদের যত দুঃখ। বুঝিতে পারিতেছ না। গান যে গায় সে আনন্দের দিক হইতে রাগিনীর দিকে যায়। গান যে শোনে সে রাগিনীর দিক হইতে আনন্দের দিকে যায়। একজন আসে মুক্তি হতে বন্ধনে আর একজন যায় বন্ধন হইতে মুক্তিতে, তবেতে দুই পক্ষের মিল হয়। "চতুরঙ্গ" উপন্যাসটি যে কোন সময়ে মুর্শিদ ভিত্তিক আইডোলজীর সম্পূর্ন সুরতহাল প্রতিবেদন। যেখানে বলা হয় আমার অন্তর্যামী কেবল আমার পথ দিয়েই আনাগোনা করেন গুরুর পথ গুরুর আঙিনাতেই যাওয়ার পথ। স্বধর্মে নিধনং শ্রয়ঃ পরধর্মো ভয়াবহ ঃ কথাটার অর্থ হলো আর সব জিনিষ পরের হাত হতে লওয়া যায় কিন্তু ধর্ম যদি নিজের না হয় তবে তা মারে বাঁচায় না।

অমিত অনেক সুন্দরী মেয়ে দেখেছে, তাদের সৌন্দর্য পূর্নিমারাত্রির মতো উজ্জ্বল অথচ আচ্ছন্ন ; লাবন্যের সৌন্দর্য সকালবেলার মতো, তাতে অস্পষ্টতার মোহ নেই, তার সমস্তটা বুদ্ধিতে পরিব্যাপ্ত। তাকে মেয়ে করে পড়বার সময় বিধাতা তার মধ্যে পুরুষের একটা ভাগ মিশিয়ে দিয়েছেন ;তাকে দেখলেই বোঝা যায় তার মধ্যে কেবল বেদনার শক্তি নয় বুদ্ধি আছে ক্ষমা নেই, বিচার আছে ধৈর্য্য নেই, অনেক জেনে শিখেছে -শান্তি নেই। "শেষের কবিতা " এর মধ্যে নতুন যেটা এসেছে সেটাই অনাদিকালপর পুরোনো, ভোরবেলাকার আলোর মতই সে পুরানো, নতুন -ফোটা ভূই চাঁপা ফুলেরই মতো চিরকালের জিনিস নতুন করে আবিস্কার। রবীন্দ্র সাহিত্য পড়তে এক এক সময়ে এমন অবস্থা আসে, মনের ভিতরটা শংকরাচার্য হয়ে উঠে বলতে থাকে আমি লিখেছি কি আর কেউ লিখেছে এই ভেদজ্ঞানটা মায়া।

রবীন্দ্রনাথের উপন্যাস সংসারকে স্বচ্ছ  দেখতে অত্যান্ত ভারসাম্য কোন থেকে দৃষ্টি ফেলা হয়েছে। একজন বাঙালির হৃদয়কে বিবর্তনে সত্যের সাথে সামনা করতে রবীন্দ্রনাথ ছাড়া প্রশস্ত প্ল্যাটফর্ম নেই তাই বাঙালির হৃদয়ে রবীন্দ্রনাথ রয়ে যাবে অনন্তকাল জুড়ে, কারো  স্বীকারের প্রয়োজন হবে না সে হয়ত জ্ঞাত নয় অবচেতন মনেই তার সংস্কৃতিকে খুঁজে পায় রবীন্দ্রনাথকে দিয়েই, তাই তিনি কবিগুরু।

বাঙ্গালী রেনেসাঁ বিশ্বের যে কোন রেনেসাঁ থেকে বিরল ও স্পষ্ট কাঠামো, পশ্চিমাদের হাজার বছর লড়াই করে যে গতি প্রাপ্ত হয়েছে তা ভারতীয় সংস্কৃতিতে ঋষিগনের আত্ম জিজ্ঞাসার উপলব্ধিগুলো হাজার হাজার বছর ধরে ব্যবহারিক জীবনের সাথে মিলিয়ে বার বার যখন একই উত্তর পেয়েছে সেগুলো তখন লিপিবদ্ধ আকারে উপনিষদে তুলে এনেছে। য়ুরোপীয়দের যা শিখতে হচ্ছে রিফর্ম করে করে, চার্চের নিয়ন্ত্রন তুলে নিয়ে, নতুন বিশ্বাস আবিষ্কার করে, ইউটোপিয়ান চিন্তার দ্রুত পতনে, মিষ্টিকদের কাছ থেকে, নিউক্লিয়ার ফিউশন করে, ব্যাক্তির স্বাধীনতা দিয়ে অতঃপর ইওগা'  ধাচে অতীন্দ্রিয় রপ্ত করতে ব্যক্তিকে নিজের গভীরের অভিজ্ঞতা নিতে বলা হচ্ছে, সেখানে বাঙ্গালী রেনেসাঁর মুল গাঁথুনিই ছিলো আত্মপলব্ধিতে,  উপনিষদে। যা রাজা রামমোহন শুরু করেছেন শেষ হয়েছে রবীন্দ্রনাথের হাতে, এটি ছিল বুদ্ধিমত্তার বিপ্লব।

রবীন্দ্র সাহিত্যকে বোঝা এবং ক্ষুদ্র হয়ে খর্ব হয়ে থাকা এ দুটো এক সঙ্গে সম্ভব নয়। রবীন্দ্রনাথকে যে বরণ করেছে, সে কোনো কারনেই জীবনকে ক্ষুদ্র করতে পারে না। কোনো বন্ধনকেই স্বীকার করতে পারে না। অপরকে বাঁধবার ও নিজেকে বাঁধা রাখবার প্রাত্যহিক আত্মহত্যায় সে অক্ষম। সহজকে সহজ রাখতে হলে শক্ত হতে হয় ছন্দকে সহজ করতে চাইলে যতিকে ঠিক জায়গায় কষে আটতে হবে। লোভ বেশী তাই জীবনের কাব্যে কোথাও যতি দিতে মনে সরে না, ছন্দ ভেঙে দিলে জীবনটা হয় গতিশীল বন্ধন। লোক ভুলে যায় দাম্পত্য একটা আর্ট, প্রতিদিন ওকে নতুন করে সৃষ্টি করা চাই। অধিকাংশ বর্বর বিয়েটাকেই মনে করে মিলন, সেই জন্য তারপর থেকে মিলনটাকে এত অবহেলা। ইচ্ছাকৃত বাঁধা  দিয়েই কবি ছন্দের সৃষ্টি করে। মিলনকেও সুন্দর করতে হয় ইচ্ছাকৃত বাধায়। চাইলেই পাওয়া যায়, দামি জিনিসকে এতো সস্তা করা নিজেকেই ঠকানো। কেননা শক্ত করে দাম দেওয়ার আনন্দটা বড় কম নয়। রবীন্দ্রনাথ আমাদের এমন করেই পথ দেখান।

কপিরাইট হাসিদা মুন কর্তৃক সংরক্ষিত

২টি মন্তব্য:

  1. রবীন্দ্রনাথঠাকুর এর লেখা নিয়ে খুব চিন্তাকরুন ভাবুন তাঁর পর তার লেখা নিয়ে মন্তব্যকরুন

    উত্তরমুছুন
  2. লেখাটা খুব ভাল লাগলো মুন আপা।

    উত্তরমুছুন