একটি দুর্মুখ গদ্য : তৈমুর খান



একটি দুর্মুখ গদ্য
তৈমুর খান
 যৌবনের ভাষা
সাহিত্যে পুরস্কার পাওয়ার ক্ষেত্রে এবং যশস্বী হওয়ার ক্ষেত্রে কি বড়ো বড়ো কবি-সাহিত্যিকদের তোষণ করার দরকার আছে ?

     প্রশ্নটি বহুদিন থেকেই মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। শুনেছি প্রতিটি পুরস্কারের পেছনেই একজন বড়ো সাহিত্যিকের কলকাঠি থাকে। তিনি সেটা না নাড়ালে খুব ভালো লিখেও নাকি কপালে পুরস্কার জোটে না। ওপার বাংলার একজন সুন্দরী সাহিত্যিক কতজন কবি-সাহিত্যিকের নামের সঙ্গে তাঁর শারীরিক সম্পর্কের কথা স্বীকার করে বিবৃতি দিয়েছেন তার হিসেব আমাদের জানা নেই। তবু সেইদিন অর্থাৎ সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মৃত্যুর কিছু আগেই তাঁর নামেও নিজের সম্পর্কের কথা জানিয়েছেন। যদি তাঁর কথা সত্যি বলে মেনে নিই –— তাহলে মনে প্রশ্ন জাগে, এত লোকের সঙ্গে তিনি সম্পর্ক কেন গড়েছিলেন ?

        উত্তর খুঁজলে নিশ্চয়ই বুঝব তাঁর মূল অভিসন্ধি ছিল শরীরের বিনিময়ে বিখ্যাত হওয়ার প্রলোভন। অতি অল্প সময়ে তিনি যাতে বিতর্কিত একজন বুদ্ধিজীবী ও সাহিত্যিক হয়ে উঠতে পারেন। তাঁকে নিয়ে সমগ্র বিশ্ব যাতে তোলপাড় হয় 

          এই উদ্দেশ্য হয়তো কিছুটা সফল হয়েছে। নারী স্বাধীনতার নামে নারীর যৌন স্বাধীনতার প্রবক্তা হিসেবে আমরা অনেককেই দেখেছি। তিনিও যে সেই দলেরই একজন তা বলাই বাহুল্য। তাঁর অনেক পুরস্কার টুরস্কারও পাওয়া হয়েছে। এখনও তিনি স্মৃতির সমুদ্র থেকে নানা রত্ন তুলে বিবৃতি দিতে পারেন। নিজের জীবনের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগাতে পারেন। যতদিন যৌবন ও শরীর থাকে, হয়তো ততদিন সেটাই হয় ভাষা। যখন যৌবনের ভাষা শেষ হয়, তখন মনের ভাষা তথা অভিজ্ঞতার ভাষাই হয়ে ওঠে হাতিয়ার।




পুরস্কারের চাবি

বেশ কিছুদিন আগে এক তরুণ কবিবন্ধু হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসে ঝোড়ো কাকের মতো বলে বসল ——

 শ্রীমতী অমুক কবি এবার সাহিত্য পুরস্কার পাচ্ছেন !

  আমি তৎক্ষণাৎ বললাম, কী করে তা বুঝলে ?

উত্তরে বন্ধুটি একটি চমকপ্রদ কথা বলল, এই মাত্র শ্রীমতী কবিকে অমুক কবির বেডরুম থেকে বের হতে দেখলাম !

        এটাই কি পুরস্কার পাওয়ার পূর্ব লক্ষণ নাকি ? ধ্যাত্! যা-তা বললে হবে? তোমার উপর আমি হলে মানহানির মামলা করতুম  !

             বন্ধুটি বুকে হাত দিয়ে আবার বলল, ঠিক আছে, দেখে নিও !

                 ওর কথাটা ভুলিনি । পরের বছর সেই নির্দিষ্ট দিনেটিতে কাগজ খুলেই দেখলাম শ্রীমতীর নাম উজ্জ্বল অক্ষরে ঘোষিত হয়েছে। কাগজখানা আমার হাত থেকে পড়ে গেল। উদাস হয়ে অনেকক্ষণ কী সব আকাশ পাতাল ভাবলাম। আর হ্যাঁ বন্ধুটির মুখে উচ্চারিত বেডরুম  কথাটি মনে পড়ল।


        বন্ধুটি বেশ কিছুদিন বড়ো কাগজের সাংবাদিক ছিল। সাহিত্যের ব্যাপারে আগ্রহী ছিল। ভালো লিখত। কিন্তু সেইসব ভেতরের অনেক কথা সে নাকি জানার পর আর এগোবার চেষ্টা করেনি। মানসিকতার পরিবর্তন হয়েছে তার। প্রতিভা থাকলে কেউ আটকাতে পারে না। কিন্তু ও বিশ্বাস করত, যৌবন থাকলে কেউ আটকাতে পারে না। প্রতিভা যখন ফল প্রদান করবে, তখন কবির ভবলীলা সাঙ্গ হতেও পারে। সুতরাং ফেল কড়ি মাখো তেল নিয়মই সাধু নিয়ম। ধৈর্যের কি কোনও মূল্য আছে ?



জলপরির জাদু

সেদিন একটি লিটিল ম্যাগাজিনে সদ্য লিখতে আসা এক কবিকে নিয়ে এক বরেণ্য কবি দীর্ঘ প্রশস্তি লিখেছেন নিজের নাম দিয়েই। লেখাটি পড়ে চমকে উঠলাম। মূলত কৃত্তিবাসকবিসম্মেলনপত্রিকায় উক্ত কবির দুটি মাত্র লেখা প্রকাশিত হয়েছে। এর মধ্যেই কবিকে নিয়ে এত বিশেষণ প্রয়োগ কেন? কবিকে তো আমি চিনি। আমার কাছাকাছি তার বসতও। কিছুদিন আগে কবিতা প্রকাশের জন্য বেশ কয়েকবার কলকাতায় এসেছে। বরেণ্য কবির গৃহেও পদার্পণ করেছে। এর মধ্যেই বরেণ্য কবিকে কোন্ জাদু বলে এরকম বশীভূত করে লিখিয়ে নিয়েছে বিষয়টি ভেবে পাইনি। একদিন বরেণ্য কবি কী করে শুনেছেন আমারই কাছাকাছি সে থাকে। তখন কথায় কথায় বললেন, আমাকে ফোন্ না করে কোনও প্রকাশককে যেন ফোন্ করে। তাতে ওর উপকার হবে।

        প্রকাশককে শুধু ফোন্ করলে যে উপকার হবে না, অন্য কিছুও করতে হয় সেকথা অল্পবিস্তর সবারই জানা। বরেণ্য কবি হয়তো তার প্রকৃত উপকার করতে পারেননি, শুধু তার সম্পর্কে লিখে সর্বনামে চন্দ্রবিন্দু যোগ করতে চেয়েছিলেন। সেই কবি কি এখন কোনও প্রকাশককে ফোন্ করে? আমার জানা নেই। অদূর ভবিষ্যতে হয়তো করবেও। সে ও যে শ্রীমতী রূপসাগরের জলপরি তা বলাই বাহুল্য। আকাশে আমরা মেঘ দেখলেই ভয় পাই। বজ্র-বিদ্যুৎ তো আছেই। তাই অভিমানে ফাঁকা মাঠে ভিজতে যাওয়া তো আত্মহত্যারই সামিল। জলপরিদের অনেক ক্রিয়া, অনেক কর্ম। আকাশে হাসতে হাসতে চাঁদ ওঠে। কেশবতী কন্যার চুলে ফুলও গুঁজে দেয়। জ্যোৎস্নারা হাততালি দিতে থাকে। ভারি সুন্দর সেইসব হাততালি।


 
কৌশলী কবি

——এ লেখা কি তোমার ?

——কেন বিশ্বাস হচ্ছে না?

——তা ঠিক নয়, অবাক হচ্ছি। হঠাৎ করে কবিতায় এরকম যৌনতা এবং শব্দ ব্যবহারের প্রাচীনত্ব…. ভাবতে পারছি না।

——না ভাববার কিছু নেই। আরও কত লেখা দেখতে পাবে!


হ্যাঁ সত্যিই দেখতে পাই। অনেক অনেক লেখা প্রকাশিত হয়ে চলেছে আমাদেরই সঙ্গের এক কবির। কবি শ্রীমতী নয়, শ্রীমান। ইংরেজি সাহিত্যে এম এ। রিসার্চার। শিক্ষকও ।  বহু বড়ো বড়ো পুস্তক ব্যবসায়ী তাঁর বই প্রকাশ করে চলেছেন। কিন্তু সত্যি কথা বলতে কী তাঁর কবিতায় কোনও নতুনত্ব নেই। সেই গতানুগতিক ধারা। তথ্য তত্ত্ব বিবৃতি গল্প। তবে হ্যাঁ ভালো প্রকাশনা থেকে বইও বের হয় বলে নাকি এক শ্রেণির পাঠকও লুফে নেয়। এক সময় এই কবি হন্যে হয়ে ঘুরেছে। বাণিজ্যিক পত্রিকার দফতরে গিয়ে হন্যে হয়ে পড়ে থেকেছে। সম্পাদকের বাড়িতে গিয়েও উপস্থিত হয়েছে। কখনও মদ মাংস, কখনও অন্যান্য উপঢৌকনও নিয়ে গেছে। সেসব কিছু নিয়ে যাবার কোনও ছবি আমরা তুলে রাখিনি। তাই প্রমাণ পেশ করাও যায় না। তারপর প্রকাশনার ব্যাপারেও যে অর্থ কড়ির লেনদেন নেই তাও বলা কঠিন। দীর্ঘদিন ধরে শুধু তৈল মর্দন ও নগ্ন তোষামোদের দ্বারাও যে কাজ হয় ——সে দৃষ্টান্তও হয়তো তৈরি করেছে। একদিন তাঁকে রসিকতার ছলে জানতে চাইলাম, এসব কি তুমি টাকা দিয়ে করো  ?


     উত্তরে আমাকে বললে, প্রমাণ দিতে পারবে ? তোমরা কারও ভালো দেখতে পারো না!


         আসলে ভালোমন্দের বোধই আমাদের হারিয়ে গেছে। কোন্-টা সৎ সাহিত্য, কোন্-টা অসৎ তা ঘুলিয়ে যায়। কবিকে দেখেও চিনতে পারি না। সবাইকেই এক একটা কৌশলী মনে হয়।



পুরস্কার

——হ্যালো!

——কী স্যার! বলুন !

——খুব গোপন একটি কথা। শোনো। এবছর তোমাকে পুরস্কার দেওয়া হচ্ছে। জানো তো কত লাখ ?

——আমি কিছুই বুঝতে পারছি না, স্পষ্ট করে বলুন।

——এই সাহিত্যের সবচেয়ে বড়ো পুরস্কার। বর্তমানে কত লাখ জানো ? না, থাক্, জানতে হবে না । শুধু একটা শর্ত আছে তোমার সঙ্গে।

——কী শর্ত স্যার ?

——পুরস্কারের টাকাটা তোমাকে সিকি ভাগ দেওয়া হবে। বাকিটা আমাদের কমিটির।

——তাতে আমার লাভ ?

——লাভ তো বিশাল। তোমার নাম খবরের কাগজের প্রথম পৃষ্ঠায় ছবিসহ বের হবে। রাতারাতি তুমি বিখ্যাত হয়ে যাবে। হু হু করে তোমার বই বিক্রি হবে। বই বিক্রির যে রয়্যালিটি পাবে তা তো পুরস্কারের টাকার কয়ক গুণ। জানো ?

——আমি তো আনন্দে শিউরে উঠছি।

——হ্যাঁ, কেউকে প্রকাশ কোরো না। প্রেমিকাদেরও না।

——ঠিক আছে, কথা রইলো। শুভ রাত্রি 

    কবির রাত্রি শুভ  হয়ে গেল। কথা কটি শুনিয়ে দিলেন বন্ধুবর। যথারীতি পুরস্কার পেলেন। সিকিভাগ টাকাও পেলেন। পুরস্কৃত বইটির বহু সংস্করণ হল। সবাই পড়ে দেখল, না! একখানা বই লিখেছে বটে !

আমার পঁচাত্তর বছরের মাস্টার মশাই বইটি পড়ে বললেন, ছিঃ! শুধু রগরগে যৌন সুড়সুড়ি। এ বই পুরস্কার পায় কী করে ?





সুযোগ

এক.

আমাকে নিয়ে একটা পত্রিকার সংখ্যা করো। দীর্ঘদিন থেকে লিখছি। তোমাদের পত্রিকার বেশ নামডাক আছে। হ্যাঁ, আমি খরচ বাবদ ২৫ হাজার টাকা দেবো। পত্রিকা বিক্রি করেও তোমরা অনেকটা তুলে নিতে পারবে।


দুই.

আমাকে কবি বলে মনে করো না তোমরা ? আজ অবধি আমাকে নিয়ে একটাও কিছু লেখোনি। তোমাদের এত লেখা প্রকাশ করলাম! এ টুকু আশা করতে পারি না?


তিন.

হ্যালো, এই সংখ্যা স্ট্রিটে  তোমার কবিতা থাকছে। একটা কাজ কোরো, আমার এই মোবাইল নম্বরে ২৫০ টাকা রিচার্জ করে দিও। কথাটি কেউকে বোলো না কিন্তু।


চার.

কবি! আমি খুব বিপদে পড়েছি, হাজার খানেক টাকা আমার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে দিও। খুব তাড়াতাড়ি। কলকাতায় থাকি। বুঝতেই পারছ শরীরটা ভালো নেই। পত্রিকা করাও বেশ ঝক্কি।


পাঁচ.

——আমি আয়ুদপত্রিকায় কি লেখা পাঠাতে পারি ?

——অবশ্যই পাঠাবেন ।  আমরা তো লেখা চেয়ে বিজ্ঞাপন দিয়েছি।


লেখা পাঠানোর দুই মাস পর…..


——হ্যালো, আপনার প্রবন্ধটি মনোনীত হয়েছে। আমাদের সম্পাদক গোষ্ঠীর ভালো লেগেছে। তবে প্রবন্ধটা অনেকটা বড়ো, প্রকাশ করতে খরচ আছে। আপনি আমাদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে দু হাজার টাকা খুব শিগগিরই পাঠান।


ছয়.

আমাদের প্রকাশনা থেকে বই করুন। পনেরো হাজার টাকায় ৩০০ কপি। আমরা লেখককে ২০০ কপি দেবো। ৬৪ পৃষ্ঠার বই । এখান থেকে বই করলে আমাদের ম্যাগাজিনেও আপনার লেখা ছাপানোর অগ্রাধিকার দেওয়া হবে।



তথ্যসূত্রবিহীন

এইসব নিয়ে কি প্রবন্ধ লেখা চলে? যত সব কাল্পনিক মনগড়া কথা! কোনওটার কি কোনও তথ্য প্রমাণ আছে ? তথ্যসূত্র উল্লেখ না থাকলে প্রবন্ধ হয় না। কী সব আজেবাজে লিখলেন মশাই ? বাংলা সাহিত্য সাফ সুতরো, সুন্দর। সাহিত্যিকগণ মহান ব্যক্তিত্বের অধিকারী। এঁদেরকে নিয়ে ঠাট্টা রসিকতা ? জীবনানন্দ দাশ তাঁর সময়কালে কবি বলে খুব একটা সম্মান পাননি। তাঁর লেখা প্রবাসী দফতর থেকে কতদ ফিরে এসেছে। অন্যান্য পত্রিকাতেও তেমনভাবে ছাপা হয়নি। মৃত্যুর পরই তাঁর সঙ্গে কবিদের পরিচয় হল। তাঁর সময়কালে যাঁরা বেশি সম্মানিত হয়েছিলেন, মানুষ ক্রমশ তাঁদের ভুলে গেল। আজ যাঁরা সম্মানের জন্য, যশের জন্য, খ্যাতির জন্য এবং অর্থের জন্য বিখ্যাত ——আগামী দিনে তাঁদের পরিণতি কী তা কি কেউ বলতে পারে ?


   এসব কথা ঠিক, কিন্তু এত পঙ্গপালের ভিড়ে প্রকৃত প্রতিভা কি মারা যাচ্ছে না ? কলকাতায় বসবাস না করলে, টাকা না থাকলে, বই ছাপাতে না পারলে, সম্পাদককে শরীর বা টাকা না দিতে পারলে ——সেই কবি যে এই সমাজে মানসম্মান পাবেন একথা বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়। কষ্ট হয় তখনই, যখন রবীন্দ্রসদনে দাঁড়িয়ে সত্তর দশকের বহুল প্রসবা এক কবি আমাকে বললেন, নিজের পত্রিকায় কার লেখা ছাপব, কার ছাপব না সেসব আমার ব্যাপার। নিজের পাঁঠা আগায় কাটব না গোড়ায় কাটব তা আমিই ঠিক করব।

  তখন সেই কবির উপর একজন গ্রামীণ কিশোর কবির কি কোনও সমীহ থাকবে ? অবাক হয়ে কথাটি বহুদিন ভেবেছি। দুই চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়েছে। তারপর বহুপথ অতিক্রম করে এই তথ্যসূত্রবিহীন প্রবন্ধটি লিখলাম। পাঠককে বিশ্বাস করার জন্য মাথার দিব্যি দিচ্ছি না।


তৈমুর খান


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন