কবিতা মায়া হরিণ : নাসির ওয়াদেন



কবিতা মায়া হরিণ
নাসির ওয়াদেন

       কবিতায় জীবনের সুখ দুঃখ, আনন্দ বেদনার শিল্পময় প্রতিধ্বনি খুঁজে পায়,অথবা মায়া হরিণের মতো মায়ামুগ্ধ মন নিয়ে কবি কবিতার ভেতর অনুভব করে এক চিরন্তনী শ্বাশত সৌন্দর্য, যা তার মানসপ্রতিমা রূপে আকর্ষন করে তাকে।

      '' মহিমের ঘোড়াগুলি ঘাস খায়
       কার্তিকের জ্যোৎস্নার প্রান্তরে
       প্রস্তর যুগের সব ঘোড়া
       এখনও ঘাসের লোভে চরে
       পৃথিবীর কিনাকার ভারবামোর পরে ''

কবিতার চিত্রকল্প,রূপ নানান আকৃতির মধ্যেও ফভিজম, এক্সপ্রেশানিজম এবং ক্যুরিয়ালিজমের তত্ত্বকে খুঁজে বের করা যায় সহজে এবং সাবলীল ভাবে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কিছু ছবিও  তেমনি আমাদের কবিতার ক্ষেত্রে স্পষ্ট প্রতীয়মান। জীবনানন্দ দাশ যে পিকটোরিয়াল ছবি এঁকে বাংলা সাহিত্যের গতানুগতিক চলন স্রোতকে এক ধাক্কায় পাল্টে দিয়ে নতুনভাবে নব অবয়বে,চিত্রকল্পের মাঝে স্যুরিয়ালিজমের চমকপ্রদ বৈচিত্র্য আনেন,তাতেই বাংলা কবিতার মান ও আঙ্গিক অনেকটা পাল্টে যায় ও মাঝ দরিয়ার বুক থেকে নদীর কিনারার দিকে চলে আসে।

       ' অন্ধকারের ঝোপের থেকে
        ঝাঁপিয়ে পড়ছে স্কন্ধকাটা দুঃস্বপ্ন,
        পাগলা জন্তুর মতো
        গোঁ গোঁ  শব্দে ধরেছে তার টুঁটি চেপে ।'

রবীন্দ্র কবিতার পথ থেকে সরে আসতে চেয়েছে কল্লোল যুগের কবিগণ। কবিতা জীবনের সুখ-দুঃখ, হর্ষ-বিষাদ,শোক-তুষ্টি, হতাশা-প্রত্যাশার শব্দময় প্রতিধ্বনি, প্রতিচ্ছবি হয়ে সংগ্রামের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে অনন্তকাল থেকেই। কেউ কেউ কবিতাকে নিছক বর্ণনার আবরণে,মোড়কে বেঁধে রাখতে চায়, কিংবা কল্পনার সীমাহীন দূরত্বে অবলোকন করতে চায়, কিছু মায়াবী শব্দের চাঞ্চল্যকর তরঙ্গের ভেতর বন্দি করে রাখতে চায়, তারা ভুলে যায় যে, কবিতা লাস্যময়ী হরিণীর মতোই গতিশীল।কবির যাত্রাপথে বিরাজ করে নেই মানুষের আস্তানা। মায়াবী হরিণ চিত্তকে সবসময়ই তাড়িয়ে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়, কবিও সেই সোনালী  হরিণের পেছনে পেছনে দৌড়ায় বনে বাদাড়ে, জীবন বিপন্ন করেই। সুখের পেছনে অ-সুখ ধাবিত হয়ে চলেছে, তাকে উপেক্ষা করেই  কবিও ছুটে চলেছে যশ,খ্যাতি, সম্মাননার অভিলাষে। প্রশ্ন আসে কবি কি যশপ্রার্থী? কবির উত্তর নেগেটিভ হওয়া স্বাভাবিক । কিন্তু বাস্তবে উল্টো, সবাই খ্যাতির প্রত্যাশী, মনের মধ্যে প্রতিষ্ঠা লাভের ইচ্ছা সকলের থাকে। শয়নে, স্বপনে,জীবনের প্রতি পলে পলে কবি নতুন চিন্তার, ভাবের পেছনে ধাবমান -শব্দ -শব্দবন্ধ  সৃষ্টি করে অপ্রচলিত শব্দের ব্যঞ্জনা তৈরি করে কবিতার হৃদয়ে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করেন। কবি চান তাঁর মানসপ্রতিমা সর্বাঙ্গ সুন্দরতম হোক। কবিতা মুলত ভাবের আদান প্রদান করে থাকে। রবীন্দ্র সাহিত্য যে ভাব,ভাবনা, ধ্যান ধারনা, চিন্তার পরিবেশ তৈরি করেছিল, আজকে তার অনেক উত্তরণ ঘটে গেছে। ফলে পুরাতনী স্বাদকে নতুন মোড়কে জীবনানন্দ দাশ যেভাবে পাঠকদের হাতে তুলে দিয়ে কবিতার বহুরূপতা ও মাত্রাকে ছড়িয়ে দিয়েছেন, বর্তমানে তারই বিশ্লেষণ চলছে।

    কবিতার ভালমন্দ বিচার করতে গিয়ে নানা কথা এসে যায়,কবির স্বার্থ হচ্ছে মানব মনের সহজাত মানবিক বোধ ও অনিবার্য সত্যকে মনের ভেতরে এক অনুভূতির রেখায় নিয়ে যাওয়া এবং পাঠককে তৃপ্তি প্রদান করা। তাই কবির ভাবনা সহজাত, সাধনা ভিত্তিক। মহত্বের পরিচয় নিয়ে সুখ দুঃখ, আশা হতাশা, আনন্দ বেদনার মাঝে মানবচরিত্রকে নতুন করে গড়ে তোলা, উপমা, অলংকার,কৌশলী শব্দ প্রয়োগ করে সময়,সীমানা, ধর্ম, বর্ণ, জাতিভেদ উপেক্ষা করে অনিন্দ্যসুন্দর শৈল্পিক কারুকার্যের প্রকাশে নিরপেক্ষ মননের উদ্ভাসন ঘটানো। তাই কবিতায় নতুনতর স্বাদের আমদানি করে বোধের জগতে, মগ্ন চৈতন্য সত্তার প্রকাশ ঘটে।

      আধুনিক কবিতায় নানা উপাদান সন্নিবেশিত হয়ে আছে, বিশেষত প্রতীচ্যের ভাবধারা, তাদের চিন্তন,ভাবনা ও রূপরেখাকে বাংলা সাহিত্যে টেনে এনে নতুন স্বাদের সৃজন চলছে। রোমান্টিকতা কবিতার ক্ষেত্রে যে সঞ্জীবনী সুধার সৃষ্টি করেছিল, কালের নিয়মে তা বাস্তববাদে চলে আসে এবং থেমে না থেকে ক্রমোত্তর পথে পরাবাস্তববাদের দিকে ধাবিত হতে থাকে। জাদু বাস্তবতাবাদ এসে নতুন করে ভাবতে শেখায়,চলাপথকে আলোকিত করে, উত্তর আধুনিকতা ,পুনরাধুনিকতা,জিরো বাউন্ডারি কনসেপ্ট ইত্যাদি ইজমের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হতে থাকে কবিতার স্রোতধারা। হ্যাংরি জেনারেশন,শ্রুতি আন্দোলনও যে একসময়ে প্রভাব বিস্তার করেনি তা বলা যাবে না, তবে তা ক্ষণস্থায়ী,কিন্তু ডাডাইজম কিছুটা প্রভাব ফেলে, এবং তা থেকেই স্যুরিয়ালিজমের আবির্ভাব ঘটে। কবিতার গতিধারা সামনের দিকে অগ্রসরমান হলেও কবিতার গদ্যরূপ ছন্দহীন হতে পারে না ।ছন্দ জানা কবির প্রথম ও প্রধান শর্ত, পরবর্তীতে তিনি ছন্দকে কীভাবে ভাঙবেন,কীভাবে গড়বেন তা তাঁর মুন্সিয়ানার পরিচয় বহন করে।

    কবিতার ক্ষেত্রে দেখি,প্রতি-কবিতার রূপ রূপান্তর বা অ্যান্টি-পোয়েট্রিরও কবিতার ক্ষেত্রে ভূমিকা আছে, বিখ্যাত কবিদের যে সকল কবিতা জনতার দরবারে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে, মানুষ সাদরে গ্রহণ করেছে, তাকেই সিগনেচার পোয়েম বলা হয়ে থাকে।

     সদ্য প্রয়াত কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর 'অমল কান্তি' এক সিগনেচার পোয়েম। অমলকান্তি রোদ্দুর হতে চেয়েছিল, সেই রোদ্দুর মেখে জীব ও জগতের মধ্যে বেঁচে থাকতে চেয়েছিল। কবি চলে গেলেন কিন্তু অমলকান্তি সেই রোদ্দুর গায়ে জড়িয়ে চিরকাল বেঁচে থাকবে।তাঁর অনন্য সৃষ্টি 'কলকাতার যীশু ' চির অম্লান,চিরভাস্বর,চলে গেলেন যীশুর জন্মদিনে। সেই মাহেন্দ্রক্ষন জনজীবনে স্মৃতি হয়ে থাকবে ।কবিতার ক্ষেত্রে best words of the best order ,কবিতা সৌন্দর্যের ছন্দিত অভিব্যক্তি।বিজ্ঞান আর কবিতা কি পরস্পর বিরোধী, না সম্পর্কের মোড়কে আবদ্ধ ? তা ব্যাখ্যা, বিশ্লেষণ করে দেখা যেতে পারে, তবে কবিতা বিজ্ঞানধর্মী নিঃসন্দেহে বলা যেতে পারে। বিজ্ঞান পরীক্ষা নিরীক্ষা দ্বারা স্বতঃসিদ্ধভাবে প্রমাণিত, কবিতাও বিশ্লেষিত হয়ে থাকে,তাতেও সত্য আছে, সততার পরম ধর্ম নিয়ে এগিয়ে চলে, তাই কবিতাও অমর হয়ে আছে, থাকবে অনন্তকাল।

   একবিংশ শতকের শূন্য দশকের এক বিখ্যাত পত্রিকায় একজন কবি লিখেছেন, -" কবিরা খারাপ হয়,কবিরাই ভাল,বাকিরা কিছু না ।/কারা কবি, কারা কবি নয় -- কী করে চিনবে?,,,

কবি যদি জুতা খায়, দুঃখ খায়, ঘৃণা খায়,,,,"এই হচ্ছে কবিদের চরম চিহ্ন, পরম আপ্যায়ন -- কবি ল্যাং খেয়ে ঢুকে যায় মফস্বলে কেঁচোর মতন,তখন পাড়ার ছেলেরা রাতে কবিকে টিটকারি মারে, গালি দেয়, তবুও কবি নীরবে লিখে যায়, ঝরে কলমের ডগায় পদ্যের ঝরনাধারা।তবুও কবি উপেক্ষিত, নিষ্পেষিত ও অবহেলিত। বিচ্ছেদের শূন্যতা যখন ভরে ওঠে ফুলে-ফলে-গন্ধে-বর্ণে, দিগন্ত জুড়ে কালমেঘ, চারদিকে ঝড়ের উন্মাদনা, ঘোর অনাসৃষ্টি,তখন কবি চুপ থাকতে পারে না, শব্দতরবারি দিয়ে সেই উল্লাসস্মৃতি মোচনে,নিষ্পাপ কৈশোরত্বকে জাগরিত করতে নেমে আসে মল্লভূমিতে।কবিতার স্বচ্ছ কাচের প্রতিবিম্বে দেখা যায় জানালার ওপারে জেগে ওঠা মানবতার মুখ,কালোচুলের রাত্রির বাতাস, কবির নীরব যুদ্ধ শুরু হয় হাসপাতালে কমলালেবুর কোয়ায়, গোলাপী ঠোঁটের চুমুতে। মরসুমি ফুল ফোটে, সময়ান্তরে ঝরেও যায় পথের উপর,পথশিশুদের সযত্নে গেঁথে তোলা মালা উপহার দেয়, তখনই কবির কবিতা জীবন্ত হয়ে হেসে ওঠে। কবিতা জীবনসঙ্গী,রাত্রির বুকে কুসুমের ডানা মেলে ওড়া ঈশ্বর, তার দু'চোখ চুইয়ে নামে বেদনাসিক্ত আনন্দাশ্রু,হেসে ওঠে রুমাল জোৎস্নার মুঠো মুঠো সান্ত্বনার স্পর্শ পেয়ে। কবিতা কী ফিসফিস করে পড়তে হয়, কেউ কেউ নীরবে পড়তে চায়, তবে কবিতা হচ্ছে মনের আকর,ভালবাসার সন্তান। অপ্রচলিত কবিতার যন্ত্রণা সন্তানধারী জননীর যন্ত্রণার চেয়ে কম নয়, যখন প্রসবিত হয়, আকাশের গন্ধ শোঁকে, নীল বাতাসে শ্বাস নেয়, একটু নিরিবিলি জায়গার খোঁজে হাঁটতে থাকে, তখন ফিসফিস থাকে না, গর্জনে নেমে আসে, " কত মণি মুক্তো ছড়ালাম বেনাবনের হারামজাদারা সব গাপ করে বসে রইল, "আর কবিতার দেহ  খণ্ড খণ্ড হয়ে /জগতব্যাপী তৈরি করে দিল বাহান্ন--চুয়ান্ন--ছাপান্ন রকম জলাশয় ও ঝর্ণার মহোৎসব --"এখানেই কবিতার সার্থকতা, পরিপূর্ণতা। কবিতা শব্দের, বর্ণের, রূপের, আঙ্গিকের আমদানি করে, স্বপ্নের ঘোরে, শব্দের মায়াজালে পাঠকের মনকে বিতংসবিদ্ধ করে তোলে। নারীনিগ্রহ,নির্যাতন নিত্য দিনের ঘটনা, ধর্ষণ শব্দটা এখন ডালভাতের মতো অনায়াসে গিলে ফেলি,কোন বিকার নেই, অথচ নারী সম্ভ্রম নিয়ে সেমিনার হচ্ছে, প্রতিবাদী সংগঠনের প্রতিবাদ দেখতে পাচ্ছি, কিন্তু নারীর কোমল দেহের স্বাদ নিতে ভুলি না, অর্ধাবৃত মহিলাদের রাস্তায় হেঁটে যেতে দেখলে ভ্রষ্টাচার মনে করা হয়। কবিতা প্রতিবাদ করে, কবি দ্বিজেন্দ্রলাল রায় পণ করেছিলেন যে মায়ের দৈন্য ঘোচাব,'মানুষ আমরা নহি তো মেষ 'রেনেসঁস কালের ইতালির সার্বিক নৈরাজ্য বিপ্রতীপে কবি, শিল্প ভাবুক মানুষেরা ক্ষুদ্রতার উর্ধ্বে মানবতা তুলে ধরে ।

    পল্লীগীতিও কবিতার সুরে বাঁধা। মাঠে মাঠে, বনে-বাদাড়ে,স্বল্প শিক্ষিত ব্যক্তির কণ্ঠে যে ছন্দ বেজে ওঠে তাকে কী বলব?  কবিতা,না পাগলামি -এটা দেখুন, --
         'বন পোড়া যায় সবাই দেখ
          আমার মন পোড়ে কেউ দেখে না
          বন গেল, আগুন গেল --
          আমার মনের আগুন জ্বলে দ্বিগুণ
          তারে আর নিভানো যায় না ।'

লক্ষ তারার মতো ছড়িয়ে থাকা এমন উদাহরণ আরও দেওয়া যায়। ফলে কবিতার ভেতর প্রাণ আছে, মন আছে, জীবন্ত ধারণার ফোয়ারা আছে, যাকে মুছে দেওয়া যায় না ।মানুষ যে চেষ্টা করে অন্য মানুষ তা মেনেও নেয়, আবার কোনরকমভাবে বেঁচে থেকে এক সময়ে তা ভেঙেও যায়। কবিতার উত্থান পতন ঘটে নিত্য নৈমিত্তিক কার্যকারণের ভেতর,কবিকে চিনতে গেলে কবিতার মধ্যে ডুবে যেতে হবে, 

   " কে কাকে ফিরিয়ে দিলে?
     আলো চলে এলে কিন্তু তোমার নিজের
     আয়না তোমাকে তাড়াবে ।"

ভাবনা, অভিজ্ঞতা,দর্শন কবিতার মূল অন্তর্ভেদী, শব্দের বন্ধনমাত্র যা চির সুন্দর, শ্বাশত করে তোলে।

     " সমস্ত চলুক /কাকে যে কবিতা বলে /তা কি আমরা স্পষ্টভাবে জানি? /সবাই যে যার মতো কবিকে সংগ্রহ করে /বাড়ি চলে যাক।" ঠিক তাই, সবাই কবি না হলেও কবি মানেই পাঠক, পাঠকই কবি হতে পারে ।যারা পাঠক নয়, তারা কবি হতে পারে না ।এই চিরন্তনী পদবাচ্যের কাছে আমরা ধরাশায়ী। সুতরাং আপনি যতবড় কবিই হোন না কেন ,কিংবা প্রসিদ্ধি, বিগ ম্যাগাজিনে লিখুন না কেন, আপনাকে অন্যের কবিতা পড়তেই হবে ।তবেই আপনার কবিতা বাঁচতে পারবে, যদি তাতে হৃদয়ের ছোঁয়া লেগে থাকে।তাই কবির কথা দিয়েই বলছি যে, ' তুমি লিখে যাও,তুমি শব্দ লিখে যাও।'


নাসির ওয়াদেন


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন