ফিরিয়ে
দেওয়া
কেকা সেন
সকাল সকাল রীতা ক্যানিং
লোকালটা ধরে ফেলল। অনেক দূরের গন্তব্য তার। " দয়াপুর "। নামের মধ্যেই এক
মায়া মাখানো আদর। ট্রেনে উঠেই একটা জানালার সিটে বসে পড়ে সে। যদিও দুটো স্টেশন পরই
এক আকস্মিক ধাক্কায় তাকে জানালার সিটটা ছাড়তে হয়।
" এটা কি হল?"
" আপনি যদি না দেখে বসেন
তো এরকমই হবে!" " ওটা আমার
জায়গা, আশেপাশে সবাইকে জিজ্ঞাসা
করে দেখুন। "
" এ আবার কি! জায়গা কারও কেনা হয় নাকি!"
" আলবাত হয়।" রীতা
চারপাশে তাকিয়ে দেখে কয়েক জোড়া ডেইলি প্যাসেঞ্জারি চোখ তার দিকে কটমট করে তাকিয়ে
আছে।
আর কথা বাড়ায়নি রীতা,
সরে বসেছিল ভালোভাবে। আজ তার ডাক্তার হিসাবে
প্রথম সরকারি চাকরীতে জয়েনিং, বিশেষ জায়গার
বিশেষ দিন। আজকের দিনটা সে কিছুতেই কোন ঝামেলায় জরাবে না। ট্রেনের লোকজন, বাইরের টুকিটাকি দৃশ্য দেখতে দেখতে কখন যেন সে ক্যানিং পৌছে
গেল।
ট্রেন থেকে নেমে বাসের পথে
গেল সে। তারপর নদী পার, আর শেষে কিছুটা
হাঁটা। দয়াপুর পৌছতে দুপুর ১২টা বেজে
যাবে। কবজি ঘুরিয়ে ঘড়ি দেখল রীতা। ন'টা বেজে পনের। বাসের পথে সবুজের দৃশ্যে পুরানো কিছু কথা খাতার পাতার মত দুলতে
লাগলো চোখের সামনে। দয়াপুর তার ছোটবেলার গ্রাম। এখানকার কাদামাটিতেই তার কৈশোর
যাপন। বাবা ছিলেন এখানকার প্রাইমারী
স্কুলের হেড মাস্টার। নিজস্ব পৈতৃক জমিতে ফসল ফলত। যদিও লোক দিয়ে চাষের কাজ চলত
তবুও বাবাও হাত লাগাত সে কাজে। বাবার হাতে কি সুন্দর ফসল হত! বাবা সবসময় বলত--
" গাছ হচ্ছে সব থেকে ভাল বন্ধু, একে ভালোবাসা দিলে, এও তোমাকে উজার
করে ভালোবাসা দেবে। " কথাগুলো যেন আজও স্পষ্ট শুনতে পায় রীতা। হঠাত মাঠে কাজ করার সময় বজ্রপাতে বাবার মৃত্যু
হলে মা পুরোপুরি অসহায় হয়ে পড়ে।
এই সময় বাবার চির
বাউন্ডুলে ভাই এসে সবকিছুর হাল ধরে। প্রথম কয়েকদিন ঠিকঠাকই চলে সবকিছু। আজও সেই
রাত আর তারপরের ঘটনা রীতার মনে দগদগে ঘা এর মত জেগে আছে। সেই রাত সবকিছু ওলোটপালোট
করে দেয় রীতা আর তার মায়ের জীবন।
" ঠাকুরপো সন্ধ্যেবেলা শুয়ে
আছ? শরীর খারাপ নাকি? "
" না, এমনি, একটু বস না
বৌদি!"
" এখন কি বসার উপায় আছে,
রান্না আছে তো!"
" বসই না একটু!" হঠাত
করে এক ঝটকায় টেনে শুইয়ে দেয় কাকু মাকে বিছানায়। ঠিক তখনই পাশের বাড়ির বিকাশ খুড়ো
এসে পড়ে আর মাকে যা নয় তাই বলতে থাকে। "ডাইনি" অপবাদে মা'কে ঘর থেকে বাইরে এনে দাওয়ায় বেঁধে রাখা হয়। সেদিন দাওয়ায়
পড়তে বসা ছোট্ট রীতার ক্রুদ্ধ আগুন ভরা চোখ, আজ এই বাসে বসা প্রাপ্তবয়স্ক
রীতার চোখের সামনে ইতিহাসের ছবি আঁকে।
গন্তব্যে পৌছতে বেলা ১টা
বেজে গেল। স্বাস্থ্যকেন্দ্রটা ছোটখাটো হলেও বেশ গাছ-গাছালিতে ঘেরা।
স্বাস্থ্যকেন্দ্রের যাবতীয় কাজ সেরে যখন সে নিজস্ব এক চিলতে কোয়ার্টারে পা রাখল,
তখন ক্লান্তি তাকে ঘিরে ধরল। একপাশে পাতা কাঠের
চৌকিতে চোখ বন্ধ করল সে।
বিকালে ঘুম থেকে উঠে ঘর
গোছাতে আর ভালো লাগলো না রীতার, বেরিয়ে পড়ল চেনা
জায়গার চেনা গন্ধের খোঁজে। একটি ছোট্ট মেয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে চাঁপা ফুল পারার চেষ্টা
করছে কিন্তু পারছে না। রীতা এগিয়ে যায়। একটা ফুল পেরে দেয় ছোট্ট মেয়েটাকে। সারা
মুখে সোনাহাসি ফুটিয়ে মেয়েটি বলে--" আর ক'টা দাও না গো, আমার বন্ধু দাদুকে দেব।"
" তোমার দাদু বুঝি তোমার
বন্ধু? "
" হ্যা" বলেই মেয়েটা
একছুটে পালিয়ে গেল।
পরদিন সকাল সকাল স্নান
সেরে স্বাস্থ্যকেন্দ্রের দিকে পা বাড়িয়েই হঠাত সুমনের সংগে দেখা। সুমন রীতার
প্রাইমারী স্কুলের বন্ধু। কথায় কথায় জানা যায়, সুমন এখানকার এসডিও। কি একটা সরকারি কাজে এসেছে এখানে।
" কেমন আছিস? কতদিন পরে
দেখা!"
" তুই কেমন আছিস সুমন?
একটু যেন বুড়োটে লাগছে তোকে!"
" রোদে রোদে ঘুরে শরীরটা
কয়লা হয়ে যাচ্ছে রে!"
" ইস! বিয়ে করেছিস? না করলে করে নে, তোর হয়ে সেই তোর শরীরের খেয়াল রাখবে।"
" হ্যা, সেই আর কি! এক বিপদে আছি, আর এক বিপদ ডেকে আনি!" " কাকীমা কেমন আছেন রে!
সংগে এনেছিস তো!"
" মা ভালই আছে এখন। তবে
আমার সংগে আনিনি, মামার কাছেই রেখে
এসেছি"।
" ভালো করেছিস আনিসনি। এই
পরিবেশে এসে আবার পুরোনো কথা মনে পড়ে যেতে পারে, কি ভীষণ অন্যায় অত্যাচারই না হয়েছিল কাকীমার উপর!"
" সত্যি বলছিস, তোরা এটাই বিশ্বাস করিস মা নির্দোষ! আমরা যখন রাতের অন্ধকারে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে
এলাম মামার সাথে, তখন মা কেবল বলে চলেছিল, অন্যায় ত করিনি
তবে পালাব কেন? "
" সত্যিই ত!"
" মা, কেমন যেন মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছিল। একা থাকতে ভয়
পেত। মামা না থাকলে সত্যিই আজ যে আমরা কোথায় থাকতাম কে জানে!"
" ঠিক কথা। থাক, বাদ দে এবার এসব কথা। আমার গাড়ি এনেছি, যাবি? নিজের পুরোনো
জায়গায়? চল না ঘুরে আসবি
একটু!"
সুমনের কথায় মনের
ইচ্ছাটাকে আর তা না দিয়ে থাকতে পারলো না রীতা। বেরিয়ে পড়ল ওরা নিজের নিজের কাজ
সেরে গনগনে দুপুরে। নিজের স্কুল, নিজের মাঠঘাট সবই
একইরকম আছে এখনও। শুধু কাঁচা রাস্তাগুলো পাকা হয়েছে কিছু কিছু। একটু পরপর গভীর
নলকূপ। জমিতেও ফসল আগের তুলনায়
স্বাস্থ্যবান।
" আমাদের জমিটা এখন আর
চিনতে পারব না সুমন। শুনেছি কাকু আর বিকাশ খুড়ো মিলে বাড়ি জমিগুলো ভাগাভাগি করে
নিয়েছে!"
" হ্যা, ঠিকই শুনেছিস। এত লোভ ওদের ভাবা যায় না! সবসময় কারও না কারও
সংগে জমি নিয়ে ঝামেলা করেই চলেছে!"
যেতে যেতে একটা বিলের
কাছে কিছু মানুষের জটলা দেখে ওরা নেমে পড়ে। ভিড়ের ফাঁক দিয়ে ওরা একটা ছোট্ট মেয়েকে
মাটিতে শুয়ে থাকতে দেখে। আর একটা মোটা মধ্যবয়স্ক লোক পালকের ঝাঁটা দিয়ে অনবরত
মেরেই চলেছে তাকে। দুজনের একটুও বুঝতে অসুবিধা হয় না, কি হতে চলেছে এখানে। রীতা মূহুর্তের মধ্যে মেয়েটার কাছে
গিয়ে তাকে পরীক্ষা করতে থাকে।
" সুমন, তোর হেল্প চাই, মেয়েটাকে এক্ষুনি ব্লক হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে, ওকে সাপে কামড়িয়েছে।"
" কি বলছিস তুই
জানিস!"
" আমার কিচ্ছু জানার দরকার
নেই, তুই যাবি কিনা বল! আর দেরী করলে ওকে বাঁচানো
অসম্ভব। "
কারও দিকে কোনরকম
ভ্রুক্ষেপ না করে রীতা মেয়েটিকে পাঁজাকোলা করে দ্রুততার সংগে গাড়িতে তুললো। কিছু
লোক হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। আর কিছু গাড়ির পিছনে ছুটতে লাগলো।
গাড়ি চালাতে চালাতে
সুমনের প্রশ্ন-- "তুই জানিস মেয়েটা কে?"
মেয়েটা একটা বাচ্চা মেয়ে,
আর তাকে আমি কাল থেকে চিনি!"
" চিনিস! মেয়েটা বিকাশ
খুড়োর নাতনি, জানিস তুই?"
" না, এটা এখন জানলাম।"
সকালবেলা পেশেন্ট দেখতে
দেখতেই বাইরে গোলমালের আওয়াজ পেল রীতা। বাইরে বেরিয়ে দেখে একদল লোক নিয়ে বিকাশ
খুড়ো এখানে উপস্থিত। সংগে তার কাকুও আছে।
রীতাকে দেখে প্রায় পড়িমরি
করে ছুটে এসে বলতে থাকে---
" তুমি কি ভেবেছ? তোমাকে আমরা
চিনতে পারিনি! তুমি ত প্রশান্ত সদ্দারের মেয়ে, ঠিক ত?"
" হ্যা বিলক্ষণ! খুড়ো।"
" তা এখানে কি মতলবে?"
" কোন মতলব নেই আমার তবে
উদ্দেশ্য আছে"
" ওই একই হল, প্রতিশোধ নিতে এসেছ তুমি! সেটি হচ্ছে না। এখনও আমার হাড়ে যা
শক্তি আছে তোমাকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে এই গ্রাম থেকে বের করে দিতে পারি।"
" খুড়ো আমিও বড় হয়েছি,
মেয়ে বলে শক্তিহীন ভেব না! অত সহজে যাবও না
আমি।"
" আর মাপ করবেন, আমার মানসিক ভারসাম্যহীন মা, আমায় এখানে আলো জ্বালতে বলেছেন, অন্ধ মনে আলো। প্রতিশোধের আগুন জ্বালতে বলেননি। মায়ের কাজ ত
আমায় করতেই হবে।"
এই কথার মাঝেই ছোট্ট সেই
মেয়েটা কতগুলো চাঁপা ফুল হাতে রীতার পাশটাতে এসে দাঁড়ায়।
" মিষ্টি দিদি, আমি ভালো হয়ে গেছি গো, তুমি আমায় ভালো করলে তাই এই ফুলগুলো তোমায় দিতে এলুম।"
" তাই! দাও ফুল, কে পেরে দিল আজ?"
" মা, ওই যে দূরে দাঁড়িয়ে রয়েছে।"
বেশ কয়েকজন মহিলার মাঝে
একজন রীতাকে দেখে হাত নাড়ল।
রীতাও হাত নেড়ে বলল- " ওই যারা ওখানে দাঁড়িয়ে আছে তারা
প্রত্যেকে একদিন আমার পাশে এসে দাঁড়াবে। কথা দিলাম খুড়ো, সময় পাল্টাবেই। " মেয়েটাকে কোলে নিয়ে রীতা ভিতরে চলে
গেল।
তার উজ্জ্বল দৃষ্টি
স্তব্ধ করে দিল বিরুদ্ধ বাতাস।
সমাপ্ত
কেকা সেন
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন