পালু
শুভেন্দু বিকাশ চৌধুরী
পালু – কোন আদরের ডাক নয়, আমার পদবির অপভ্রংশ। ভেবে দেখলে, আমার পুরো জীবনটাই একটা বিরাট অপভ্রংশ। আমার মাথাটা গোল - বোধহয় একটু বেশী
রকমের, চুলগুলো ছোট করে ছাঁটা,
কপালের মাঝখানটায় চুল কিছুটা এগিয়ে এসেছে সামনে,
তার দুপাশে চুলের সীমানা শেষ হয়েছে অনেক ভিতরে।
মুণ্ডু আর ধড়ের মধ্যবর্তী দূরত্বটাও যথাযথ নয়, যেন হঠাৎ করে একটা মুণ্ডু বসিয়ে দেওয়া হয়েছে, গলার নির্মাণকাজটা শেষ না করেই। হাত-পা গুলো মোটা মোটা।
হাতের প্রকৃত ব্যাবহার আমি করতাম ছোটবেলায় ঘুসি মেরে, আর পা গুলো থপথপ করে হাঁটার জন্য। ইচ্ছে থাকলেও ইদানীং আর
ঘুসিটা মারা হয়ে ওঠে না অবশ্য। এইসব দেখেশুনেই বোধ হয় ওরা প্রাণীজগতে ভালুকের
সঙ্গে আমার একটা সাদৃশ্য আবিষ্কার করেছিল। তাছাড়া ভালুর সঙ্গে অন্ত্যমিলেরও একটা
প্রয়োজনীয়তা ছিল – অস্বীকার করা যায় না।
ইদানীং আমি আর রাগি না।
আগে পালু ডাক শুনলেই পেছন ফিরে দেখতাম, কে ডাকল। পেছনের সবার ভাবলেশহীন মুখ দেখে কিছু বোঝার যো ছিল না, শব্দের উৎস কোথায়। আবার সামনে ফিরতেই সেই ডাক। এবার আর আমি
পেছন ফিরে তাকাতাম না, হনহনিয়ে, থপথপিয়ে এগিয়ে যেতাম সামনে। পেছনে তখন খুক খুক, হা হা, হি হি র গণসংগীত।
স্কুল শেষ করে যাদবপুর
ইউনিভার্সিটিতে আসার পর সেই হাসি কিছুটা কমল, কিন্তু একেবারে মিলিয়ে গেল না। কলকাতারই অন্যান্য স্কুল,
দুর্গাপুর-মেদিনীপুর-বহরমপুর এবং অন্য জেলার
স্কুলের ভিড়ে, আমাদের স্কুলই তখন কিছুটা
সংখ্যালঘু। তাদের নিজস্ব- খোরাক, আরও অনেকের কাছে
খোরাক হয়ে উঠুক – এ রকম বাসনা একটা ছিল,
কিন্তু কোন অজানা কারণে আমার এই খোরাকি
ডাকনামের বেশী প্রচার হল না। তবু সেই সংক্রামক হাসি হাওয়ায় ভেসে রইল - আমিই শুধু
অনুভব করতে পারতাম। আজ ভাবলে মনে হয়, ইউনিভার্সিটির সেই চারটে বছরের সময়কালই বোধহয় ছিল জীবন খাতায় শ্রেষ্ঠ গল্প –
সাহচর্যে, সহমর্মিতায়।
কিছুদিন আগে অফিস থেকে
গাড়িতে করে ওরা পৌঁছে দিয়ে গেল বাড়িতে। সঙ্গে একটা চিঠিও ছিল – টার্মিনেশন লেটার। মাথাটা নাকি আমার একেবারেই গেছে। আমি
নাকি শূন্যদৃষ্টিতে কম্পিউটার স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকতাম, ঘণ্টার পর ঘণ্টা আর মাঝে মাঝে বিড়বিড় করতাম। এসব কথা অবশ্য
চিঠিতে লেখা ছিল না, লেখা সম্ভবও নয়। কারণ
হিসেবে বলা হল, কোম্পানির প্রধান বিজনেস
অর্থাৎ স্টীল-প্ল্যান্টের কনসালটেন্সির বাজার খুব মন্দা। সরকারি স্টীল-প্ল্যান্টের
কাজ কোনকালেই খুব বেশী ছিল না আমাদের। আমদের ভরসা ছিল প্রাইভেট স্টীল উৎপাদকরা।
তাদেরও প্ল্যান্ট এক্সপ্যানসন বন্ধ। বাজারে চৈনিক প্রতিযোগিতা। নতুন কোন কারখানা
শুরু করতে কেউ সাহস পাচ্ছে না। সুতরাং কর্মী-সঙ্কোচন ই একমাত্র পথ। তা সেই পথে
চলতে গিয়ে প্রথম খাঁড়াটা নেমে এল আমারই উপর। এভাবেই কোম্পানি থেকে অনাড়ম্বর বিদায়
ঘটল প্রাক্তন ডিরেক্টর পি কে পালের পুত্রসম ভাইপোর। তবু সেই কারণে আমি যদি
কর্তৃপক্ষ কে দায়ী করি, সেটা অন্যায় হবে।
সত্যি, আমি কিছুই করছিলাম না
ইদানীং।
মাস ছয়েক আগে মা চলে
গেলেন, তার একমাসের মাথায় কাকু।
বোন তো বিয়ের পর থেকেই বিদেশে। আত্মীয়-স্বজন বলতে কারও সঙ্গে যোগাযোগ ছিল না
কোনকালেই। সুতরাং, ম্যায় আউর মেরি তনহাই।
রান্নার মাসী সকালে এসে দুবেলার রান্না করে দিয়ে যায়। আমি অফিস যাই, কাজে মনসংযোগ করার চেষ্টা করি। কিন্তু কেবলই মনে হয়,
এ জগতে আমি বড় একা, এ জীবন লইয়া আমি কি করিব... এখানে ওখানে পড়া বা শোনা এইসব
গভীর বাণী। এমন সময়েই আমার সেই যুগান্তকারী আবিষ্কার!
স্ট্রেংথ অফ মেটিরিয়ালস,
থিয়োরি অফ স্ট্রাকচারস, ডিজাইন অফ কংক্রিট স্ট্রাকচারস, ডিজাইন অফ মেটাল স্ট্রাকচারস – এইসব সাবজেক্ট পড়া ছিল ইউনিভার্সিটিতে। এসব বিষয় যে
মানবজীবনে অ্যাপ্লাই করা যায়, সেটাই কেউ ধরতে
পারে নি আজ অব্দি। আমার গবেষণা সেটা নিয়েই। ধরা যাক - স্ট্রেংথ অফ মেটিরিয়ালস,
মানে কোন মেটিরিয়াল কতটা লোড নিতে পারবে?
তার নির্দিষ্ট কিছু নিয়ম আছে। কোন্ মেটিরিয়াল
কতটা লোড নিতে পারবে, তা নির্ভর করে সেই
মেটিরিয়ালের ইলাস্টিক প্রপার্টি এবং আকৃতির উপর। যেমন, লোহার ইলাস্টিক প্রপার্টি এবং কাঠের বা কংক্রিটের ইলাস্টিক
প্রপার্টি আলাদা, তাদের চাপ নেওয়ার ক্ষমতাও
আলাদা। আবার একই মেটিরিয়ালের আলাদা আকৃতি - যেমন চৌকো, আয়তাকার বা গোল সেকশন – তাদের চাপ নেওয়ার ক্ষমতা আলাদা। কিন্তু সবকিছুই একটা নিয়মের
নিগড়ে বাঁধা আছে, এতটূকু ব্যত্যয় হওয়ার জো
নেই। কিন্তু মানুষের বেলায়? ওখানেই ফেল মেরে
গেলেন থমাস ইয়ং, অয়লার এবং তার
উত্তসুরিরা। কতটা চাপে, কতটা বাপ বলে
মানুষ – তার উত্তর কারও বাপের
জানা নেই। কে বলবে, কত হয় মানুষের ইয়ং’স মডিউলাস? মানুষ তো আর শুধু
হাড় মাংসের সমাবেশ নয়, তার মন বলে একটি
বস্তু আছে, এবং সেটি বেশ গোলমেলে। এত
সব কিছু কনসিডার করে বানাতে হবে এক নতুন ইলাস্টিক কোএফিসিয়েন্ট, তার নাম হবে পালু’স মডিউলাস অথবা পালু’স ইলাস্টিক
কোএফিসিয়েন্ট। সেটাও হবে স্ট্রেস বাই স্ট্রেন, কিন্তু স্ট্রেস এবং স্ট্রেনের পরিমাপ পদ্ধতি পাল্টে যাবে।
স্ট্রেস হল ফোর্স পার ইউনিট এরিয়া অর্থাৎ একক ক্ষেত্রফলে কত বল প্রযুক্ত হল তার
পরিমাপ, কিন্তু মানুষের স্ট্রেস
মাপা অত সহজ কাজ নয়। হাজার রকমের স্ট্রেস হয় মানুষের। অনেক সার্ভে করতে হবে –
প্রথমে কলকাতায়, তারপর জেলায়, অন্য রাজ্যে, দেশের বাইরে। সব স্ট্রেস
আলাদা – ছাত্রের স্ট্রেস, শিক্ষকের স্ট্রেস, সন্তানের স্ট্রেস, পিতা-মাতার
স্ট্রেস, স্বামীর স্ট্রেস, স্ত্রীর স্ট্রেস, স্বামী-স্ত্রীর যৌথ স্ট্রেস, বিবাহিত/
বিবাহিতার স্ট্রেস, অবিবাহিত/অবিবাহিতার
স্ট্রেস, বৌয়ের সঙ্গে না জমলে
স্ট্রেস, জমে গেলে ডবল স্ট্রেস,
নেতার স্ট্রেস, পাবলিকের স্ট্রেস, বসের স্ট্রেস, কর্মীর স্ট্রেস, মালিকের স্ট্রেস, ইউনিয়নের স্ট্রেস, চাকুরী বজায়
রাখার স্ট্রেস, চাকুরী চলে যাওয়ার
স্ট্রেস, ব্যাবসায় লাভ হলে স্ট্রেস,
ক্ষতি হলে স্ট্রেস, ভক্তের স্ট্রেস, ভগবান-প্রতিনিধির স্ট্রেস, জনতার ভিড়ে
স্ট্রেস, নির্জনতায় স্ট্রেস,
ভরন্ত সংসারের স্ট্রেস, একাকীত্বের স্ট্রেস ইত্যাদি, ইত্যাদি প্রায় অন্তহীন লিস্টি। এইসব স্ট্রেসের আরও অনেক
উপস্ট্রেস থাকবে। সব নথিভুক্ত করতে হবে বাড়ি বাড়ি ঘুরে। তার জন্য প্রথমেই খেটে
খুটে একটা প্রশ্নাবলী তৈরি করতে হবে। মানুষের ক্রস-সেকশন কিছু গুরুত্বপূর্ণ নয়,
স্ট্রেস নেওয়ার ক্ষেত্রে। যাদের মাথা মোটা,
তারা যে প্রকৃতই মাথামোটা হবে না – এমন গ্যারান্টি কেউ দিতে পারে নি এখনো। ইতিহাস সাক্ষী –
অনেক রোগাপাতলা মানুষ ব্যাপক স্ট্রেস নিয়েছেন
জীবনে। সুতরাং সিদ্ধান্ত করা যায়, মানুষের স্ট্রেস
নেওয়ার ক্ষমতা শুধুমাত্র তার মনের জোরের উপরই নির্ভর করে, শারীরিক আকৃতির উপর নয়।
স্ট্রেন হল স্ট্রেসের ফল।
মানুষ হোক বা পদার্থ, ক্ষমতা অনুযায়ী সবাই
স্ট্রেস সহ্য করে। অল্প স্ট্রেসে কোন রকম বাহ্যিক বিকৃতি খালি চোখে ধরা পড়ে না।
স্ট্রেস চলে গেলে পদার্থ আবার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে। মানুষও তাই – যখন ইলাস্টিক - প্রতিদিনের ক্ষত মুছে ফেলে স্বাভাবিকতায়,
এগিয়ে চলে ছোট ছোট অপমানকে ডজ করে। তারও পরে,
সহনশীলতার সীমা ছাড়িয়ে গেলে দেখা দেয় স্থায়ী
বিকৃতি – পদার্থ দুমড়ে মুচড়ে যায় -
ভেঙে পড়ে মানুষ। মানুষের স্ট্রেন মাপতে হবে সে কত মিলিলিটার চোখের জল ফেলল তার
পরিমাণে। মুশকিল হল - সবাই আবার কাঁদে না, কেউ কম কাঁদে, কেউ বেশী কাঁদে, কেউ কেউ কারণ ছাড়াই কাঁদে, কেউ দাবি আদায়ের জন্য কাঁদে, কারও চোখে কুম্ভীরাশ্রু। দেখা যাচ্ছে কান্নারও শ্রেণী
বিভাজন বহুৎ জরুরী। তাছাড়া, কত চোখের জল বরফ
হয়ে জমে থাকে বুকের গভীরে, বাস্প হয়ে মিশে
যায় দীর্ঘশ্বাসে – সে-হিসেবও বড় সহজ কাজ নয়।
এটারও একটা প্রশ্নপত্র তৈরি করতে হবে – কান্নার ইতিহাস আর পরিমাপ লিখে রাখার জন্য। কাজটি বিশাল, কিন্তু এমন মহৎ কাজেই তো মানুষের নিজেকে নিয়োজিত করা উচিৎ,
তা লোকে যতই বলুক, আমি নাকি সারাক্ষণ বিড়বিড় করি। জীবনানন্দের মত ‘সে অনেক শতাব্দীর মনীষীর কাজ’ বলে ফেলে রাখলে তো চলবে না।
ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপ
যাদবপুর ইউনিভার্সিটির মেন হোস্টেলে, অর্ক আর সপ্তর্ষির রুমে। তার আগে অব্দি আমার বাংলা বই পড়ার বিশেষ উৎসাহ ছিল
না। আমি পড়তাম ও হেনরি, মোপাসাঁর ছোট
গল্প। আমার অবস্থা যেন সেই ঘোড়ার কোচোয়ানের মত। তার ছেলে মারা গেছে, সে যতবারই সওয়ারিদের শোনাতে যাচ্ছে, কেউ শুনছে না – সবাই ব্যস্ত, সবারই তাড়া আছে। ক্লান্ত
দিনের শেষে, সে ঘোড়াকেই শোনায় নিজের
ছেলের মৃত্যু কাহিনী। আমি হৃদয়ের কথা বলিতে ব্যাকুল। সেই সময় অর্ক বইমেলা থেকে
কিনে এনেছিল ‘জীবনানন্দ দাশের শ্রেষ্ঠ
কবিতা’। পাতা ওলটাতে ওলটাতে হঠাৎ ‘বোধ’ বলে একটা কবিতায়
চোখটা আটকে গেল – ‘সকল লোকের মাঝে ব’সে/ আমার নিজের মুদ্রাদোষে/ আমি একা হতেছি আলাদা?’ অসাধারণ! অসাধারণ! আমার সারা জীবনের অভিজ্ঞতা যেন ধরা আছে
মাত্র তিনটি লাইনে। কবিকে বড় আপনার জন মনে হল সেই মুহূর্তে। আচ্ছা, আমার মত, কবিকেও কি লোকে
হ্যাটা করত? উল্টে পাল্টে দেখলাম,
আরও বেশ কয়েকটা কবিতা। প্রথমে একটু খটোমটো
লাগলেও আস্তে আস্তে বেশ ভাল লাগতে শুরু করল। এখন তো মাঝে মাঝেই পড়ি, জীবন ও জগৎকে পুনরাবিষ্কার করি।
কলেজে অর্ক আর সপ্তর্ষির
সঙ্গে খুব দোস্তি হয়ে গেল। ওরাও ইয়ার্কি, ফাজলামি করত আমার সঙ্গে, কিন্তু হ্যা্টা
করত না। আমার অতীত নিয়ে কখনও খোঁচাখুঁচি করে নি। তখন আমি একটা টিউশনি ধরেছি। যতটা
সম্ভব স্বাবলম্বী হবার চেষ্টা করছি। আমার নিজস্ব খরচাপাতি ছিল যৎসামান্য। কলেজ
যাওয়ার জন্য ট্রেনে, বাসে যাওয়ার প্রয়োজন ছিল
না। গলি দিয়ে হাঁটাপথে দশ মিনিটে এইট-বি বাসস্ট্যান্ড। রাস্তা পেরিয়ে গেলেই
ইউনিভার্সিটির গেট। বইপত্র পাওয়া যেত ডি এল এবং সি এল অর্থাৎ ডিপার্টমেন্টাল
লাইব্রেরি এবং সেন্ট্রাল লাইব্রেরি থেকে। ফার্স্ট এবং সেকেন্ড ইয়ারে তো বইপত্রের
খরচ খুব কমই ছিল। তবু আমি টিউশনি ধরলাম। মা আর কাকু অনেক নিষেধ করেছিল যাতে আমি
টিউশনি না করে, ওই সময়টায় পড়াশোনায় মন
দিই। টাকা পয়সার চিন্তা করতে নিষেধ করেছিল। কিন্তু আমি কেন শুনব ওদের কথা? পরে যখন চাকরি পেলাম, ইচ্ছে করলেই কাকুর সঙ্গে আরামে অফিসের গাড়িতে যেতে পারতাম
রোজ। কিন্তু আমি ভিড় বাসে গুঁতোগুঁতি করে অফিস যেতাম। এই সবই ছিল ওদের বিরুদ্ধে
আমার খুচরো বিদ্রোহ। প্রথম মাসের টিউশনির মাইনে পাওয়ার পর অর্ক আর সপ্তর্ষিকে নিয়ে
গেলাম ট্রিট দিতে, ঢাকুরিয়া ব্রিজের ধারে
একটা সরু-লম্বা রেস্টুরেন্টে। রেস্টুরেন্ট বলা যায় কিনা, সেটা অবশ্য ভাববার কথা। মশালা ধোসা খাওয়া গেল। খাইয়ে খূব
খুশী হলাম, পেটূক দুটোও খেয়ে খূব
খুশী। টিউশনি চলতে থাকলে খাওয়া দাওয়াও চলতে থাকবে – আমাদের ভবিষ্যৎ খুব স্বাস্থ্যোজ্জল হবে, এরকম একটা মত প্রকাশ করল অর্ক আর সপ্তর্ষি।
ক্লাস টেস্ট আর সেমেস্টার
পরীক্ষার ফল ভালই হচ্ছিল। প্রথম দশ জনের মধ্যেই থাকতাম। জানতাম, প্রথম দশ জনের মধ্যে না থাকলে, ক্যাম্পাস ইন্টার্ভিউয়ে ভাল কোম্পানিগুলোর ইন্টার্ভিউয়ে
বসার সুযোগ থাকবে না। চাইতাম না, কেউ বলুক তোর
চাকরিটাও কাকার বদান্যতায়। কিন্তু চাইলেই কি সব হয়? সেই ফার্স্ট ইয়ার থেকেই সবাই বলাবলি করত, তোর তো কাকা আছে। যেন জগতে আর কারও কাকা নেই, তারা ভাইপোদের জন্য কিছু করে না? শালা, যাদেরই বাবার ভাই
আছে, তাদেরই কাকা থাকে...এই সামান্য বোধটুকুও তোদের
নেই? তোদের কারুর কাকা নেই? বুঝতে পারতাম, এই কাকা আছে মানে আসলে এর অন্য ব্যঞ্জনা আছে।
একদিন কলেজ ছুটির পর মিষ্টি
নিয়ে গেলাম হোস্টেলে। ওদের রুমে গিয়ে বললাম, ‘আমার পিসতুতো দাদার মেয়ে হয়েছে, সেই উপলক্ষে’।
‘এতে তোর কিন্তু কোন
কৃতিত্ব নেই, যাই হোক, মিষ্টিটা এনে ভাল করেছিস’, সংক্ষেপে মতামত দিল অর্ক।
‘এই হারামজাদা, কি বলতে চাইছিস রে?’ হাসতে হাসতে আমি তেড়ে যাই অর্কর দিকে। সপ্তর্ষি একটা
ডায়রিতে কিছু লিখছিল। ওই ডায়রিতে নাকি সবার নামে একটা করে চ্যাপ্টার আছে। আমার খুব
কৌতূহল আছে, ওই ডায়রিতে আমার সম্পর্কে
কী লেখা আছে জানবার জন্য।
সপ্তর্ষি লেখা ছেড়ে উঠে
এল। বলল, ‘আসলে অর্ক বলতে চাইছে,
অনেকের তো বৌদির সঙ্গে খুব প্রীতির সম্পর্ক
থাকে, যাকে এককথায় বৌদিবাজি
বলে...সেরকম কিছু...’
ব্যাপারটা একটু অশ্লীল
দিকে গড়িয়ে যাচ্ছে দেখেই বোধ হয়, অর্ক তড়িঘড়ি বলে,
‘না রে, আমার ও রকম বলাটা ঠিক হয় নি। এমনি বলে ফেলেছিলাম, সরি। কিছু মনে করিস না’।
বিশ্বাস করলাম অর্কর কথা।
জানতাম, ওদের হোস্টেলে ওইরকম
নানাবিধ সম্পর্কের জট পাকানো নিত্য-নৈমিত্তিক ব্যাপার, ও নিয়ে সেন্টূ খেয়ে লাভ নেই। তবুও শব্দটা গেঁথে রইল মাথায়।
পরিবেশটা একটু হালকা করার জন্য সপ্তর্ষিকে বললাম, ‘ওই গানটা করত – এ পরবাসে রবে কে হায়’।
‘ও রকম ফ্রাস্টু খাওয়া গান
কেন শুনবি? তাছাড়া গানটা বেশ শক্ত’,
সপ্তর্ষি বলল।
‘তোর কাছে আবার শক্ত কি রে?
তুই সুবিনয় রায়ের ছাত্র। না গাইলে মিষ্টি পাবি
না’। গান গাওয়ানোর জন্য শেষ অস্ত্র প্রয়োগ করতে হয় আমাকে।
আজও মনে আছে, খালি গলায় সপ্তর্ষির সেই গান! এতদিনে চর্চার অভাবে, নিশ্চয় সে সব ভোগে গেছে। অনেকদিন ওদের কোন খবর পাই না। কলেজ
ছাড়ার পর অর্ক আর সপ্তর্ষির প্রথম চাকরি ছিল রাজস্থানে। তারপর থেকে আর কোন যোগাযোগ
নেই। আমার চাকরি হল ক্যাম্পাস ইন্টার্ভিউতেই – কাকুর কোম্পানিতে। কেউ বিশ্বাস করল না, নিজের যোগ্যতায় চাকরি হল বলে। কাকুর একটা গল্প শুনিয়েছিলাম
ওদের। কাকুর এক জুনিয়ার দশ পাতা জুড়ে অনেক হিসেব-নিকেশ করে এসে বলল, ‘স্যার এই স্ট্রাকচারটার ডিফ্লেকশন ৮ মিমি আসছে’। কাকু কাগজগুলোয়
একটু চোখ বুলিয়ে বলল, ‘ঠিক করে দেখো,
৩.৮ থেকে ৪.২ মিমি. র মধ্যে থাকবে’। পরে দেখা গেল
কাকুর কথাই ঠিক। গল্পটা শুনে সপ্তর্ষি বলল, ‘তোর কাকু তো খুব পণ্ডিত মানুষ। হয়ত অনেক অভিজ্ঞতা থেকেই এত
সহজে ভুলটা ধরতে পারলেন’। অর্ক বলেছিল, ‘তোর চাচা কি চাচা চৌধুরী নাকি রে?’
ওরা দুজন একটা ছোট
কোম্পানিতে জয়েন করল। চেষ্টা করলে ওদের রেজাল্ট আরও ভাল হতে পারত। কিন্তু ওরা ঘুম,
খাওয়া-দাওয়া, সিনেমা দেখা, ক্লাস কেটে সেন্ট্রাল লাইব্রেরির রিডিং-রুমে বসে বাংলা উপন্যাস পড়া – এইসব ব্যাপারগুলোকে বেশী প্রায়োরিটি দিয়েছিল। ওদের
সাহিত্য-প্রীতি নিয়ে সন্দেহ ছিল না কিন্তু যে সন্দেহটা রয়েই গেল তা হোলো – মুখ্য উদ্দেশ্যটা কি ছিল - বাংলা বই পড়া, না চোরা চোখে আর্টসের সুন্দরীদের মাপা।
শেষবার যখন গিয়েছিলাম
ওদের হোস্টেলে, সপ্তর্ষি বলেছিল ওর
ডায়রিতে কিছু লিখে দিতে। আমি লিখলাম, ‘সাদা ছাম ড্যাশ ড্যাশ’। কেন লিখেছিলাম জানি না। কী চেয়েছিলাম কোন সাদা ছামের কাছে –
সাহচর্য, প্রেম, যৌনতা? একই অর্ডারে, নাকি একটু এদিক ওদিক? জানা নেই। আরও তো
অনেক কিছুই অজানা রয়ে গেল। অবশিষ্ট পৃথিবী তো জিজ্ঞেস করত, তোর বাবা কোথায় থাকে? বাড়িতে বাবার কোন ছবি নেই কেন? তোর কাকু কেন বিয়ে করে নি? তোকে কেন তোর কাকুর মত দেখতে? এসব প্রশ্নের উত্তর যাদের জানা ছিল তাঁরা কেউ ইহজগতে নেই
আর। কিছুই ভাল লাগে না আর! নিজের মুদ্রাদোষে আলাদা হতে হতে আমি কি ট্রামের তলায়
চলে যাব? নাকি যে জীবন ফড়িঙের
দোয়েলের, তাকে বরণ করে নেব?
সহজে মরার ব্যাবস্থা হাতের কাছেই আছে, ঘুমের ট্যাবলেট। কাল সকালে রান্নার মাসী এসে দরজায় ধাক্কা
দেবে, দরজা খুলবে না। হয়ত কাগজে
খবর হবে, যাদবপুরের ইঞ্জিনিয়ারের
অস্বাভাবিক মৃত্যু। বেশ কিছুদিন ধরে তিনি মানসিক অবসাদে ভুগছিলেন। বাড়িতে একাই
থাকতেন। মৃত্যুই শুধু অস্বাভাবিক? কোথাও তো লেখে না,
তিনি অস্বাভাবিক ভাবে বেঁচে ছিলেন। খুচরো
বিদ্রোহ অনেক করেছি, এবার শেষ বিদ্রোহ। পড়ে
রইল পালু’স মডিউলাস। খাওয়া যাক
দু-চারটে ট্যাবলেট এবার!
শুভেন্দু
বিকাশ চৌধুরী
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন