মৈত্রেয়ী চক্রবর্তী
১
রিনি-- পোশাকী নাম অরুন্ধতী, বিয়ে ঠিক
হলো সপ্তর্ষির সাথে। জ্যেঠামশায় নাম দুটো দেখে বলেছিলেন রাজযোটক। বাবাকে প্রশ্ন
করে ছিলেন "কোথায় পেলে একে?" জ্যেঠামশায় যতোদিন
ছিলেন বশিষ্ঠমুনি বলেই ডাকতেন সপ্তর্ষিকে। রিনির ছোটবেলায়, গরমের
রাত্রে ছাদে শুয়ে বাবা তারা চেনাতেন, কতো সুন্দর সুন্দর
কাহিনী তারাদের ঘিরে, সে সবও শোনাতেন। সপ্তর্ষি মন্ডলের
সপ্তম তারা বশিষ্ঠ, আর তার ঠিক পাশেই ছোট্ট মিটমিটে একটা
তারা বশিষ্ঠর স্ত্রী অরুন্ধতী। বিয়ের অনুষ্ঠানে সপ্তপদীর সময়ে বা একদম শেষে বরকে
বলা হয় তার সদ্যবিবাহিত স্ত্রীর মুখ ধরে ওই অরুন্ধতীকে দেখাতে। বশিষ্ঠর পাশে
যেভাবে সবসময়ে উনি আছেন, কিন্তু এতো অনুজ্বল যে চট করে ঠাহর
হয় না; ঠিক সেই ভাবেই প্রত্যেক স্ত্রীর উচিত তার স্বামীর
পাশে থাকা। কাজেই অরুন্ধতীর স্বামী সপ্তর্ষি এ রাজযোটক ছাড়া কি? (যদিও আজকাল কার অনেক অজ্ঞ পুরোহিতরা কেউ বলেন 'স্ত্রীকে
ধ্রুবতারা দেখান' আবার কেউ বলেন 'তারা
দেখে ঘরে যান'।)
*****
সকালের অ্যালার্মটা একই সময়ে বাজছে; দুদিন আগেও অ্যালার্ম বাজার পর রিনি
আর এক মিনিটও শুয়ে থাকত না। সারদা মা কে প্রনাম করে উঠে পড়ে দ্রুত হাতে দিনের কাজ
শুরু করে দিতো। সকালের চা জলখাবার, দুপুরের রান্নাও; কারণ মেয়েকে স্কুলে আর স্বামীকে অফিসে দুপুরের জন্য খাবার গুছিয়ে দিয়ে
দিতে হবে তার। টুকিটুকি করে কতো কিছু দিতে হয় লাঞ্চ ছাড়াও, ঘরের
ব্রেকফাস্ট, অফিসের আরেকপ্রস্থ ব্রেকফাস্ট, ফল, স্যালাড,স্ম্যুদী, স্কুলের স্ন্যাক্স। একহাতে সব বানিয়ে গুছিয়ে দিতো আরেক হাতে চা খেতো,
মুহুর্ত সময়ও নষ্ট করার মত থাকতো না তার। এসবের পর মেয়ে তৈরী হলে
দৌড়তো তাকে বাসে ওঠানোর জন্য। ব্যাস, এরপর তার অখন্ড অবসর,
সিরিয়াল দেখো, ফোন করো, ফেসবুক
করো, গান গাও, বাসন ধোও, কাপড় কাচো, রান্না করো, রাস্তায়
হাঁটো, খাও, ঘুমাও যা খুশি করো কেউ
কিচ্ছু বলার নেই। আবার বিকেলে ফিরবে মেয়ে তার ফেরার আগে কিছু জলখাবার বানানো আর
তারও পরে স্বামী বাড়ি ফিরলে তাড়াতাড়ি ডিনার সেরে, আরেক
প্রস্থ বাসন ধুয়ে, রান্না ঘর সাফ করে সেদিনের মতো ছুটি।
রোজকার এই রুটিনে সে এবং তার ছোট্ট পরিবার অভ্যস্ত। তার স্বামীর ঘরের কাজ করার
অভ্যেস আজকাল প্রায় চলে গেছে। সদাহাস্যময়ী রিনি আনন্দে, গানে,
কথায় ভরিয়ে রেখেছিলো;
কিন্তু মারণ রোগ যে কখন রিনির শরীরে বাসা বেঁধেছে কেউ টের
পায়নি। হঠাতই একদিন ব্যথা অনুভব করলো, ডাক্তারের কাছে যেতেই
ধরা পড়ল, দ্রুত ছড়াচ্ছে তার শরীরে ক্যান্সার। স্ক্যান করে
দেখা গেলো বুকের থেকে আন্ডারআর্ম, কলার বোন অবধি। দেরী করার
সময় নেই, ধরা পড়ার সাত দিনের মধ্যেই শুরু হলো কেমোথেরাপি।
ঝড়ের পূর্বাভাস পাওয়ার সাথে সাথেই ঝড় তুফান শুরু হয়ে গেলো প্রস্তুতির সময় টুকুও
যেন পাওয়া গেল না। আর তাই আজ আধা ঘুমে টের পায় সপ্তর্ষি তার প্রক্সি দিচ্ছে,
অ্যালার্ম বাজার সাথে সাথেই উঠে শুরু করে দিচ্ছে সকালের চা জলখাবার।
কিচেন থেকে ভেসে আসে কাপ চামচের টুংটাং কিম্বা রান্নার সুগন্ধ।
*****
রিনি, যে কাজ করতে পারছে না, তাতে বোধহয় তার কিছু কিছু সুবিধে হচ্ছে; জানলার ধারে
তার বিছানা, ঘরের পাশেই বড়বড় গাছের জঙ্গল। ভোরের আলো ফোটা
থেকেই কতো রকমের পাখি কতো সুরে ডাকতে থাকে, আস্তে আস্তে জেগে
ওঠে ঘুমন্ত পৃথিবী; আকাশের রং কমলা থেকে লাল হয়ে সোনালী হয়।
জঙ্গলের গাছের মাথায় পড়ে ভোরের প্রথম আলো, মাটিতে তখনও চাপ
চাপ অন্ধকার। মৃদু হাওয়ায় ঝুরি ঝুরি করে কাঁপে গাছের পাতা, পাখিগুলো
তৎপর হয়ে খাবার খোঁজে, মিষ্টি মিষ্টি ডাকে। রিনির প্যাটিওতে
ঝোলানো বার্ড ফিডারে এসে খাবার খায় আর চিকির পিকির করে নিজেদের মধ্যে। কাঠবিড়ালির
ছোট্ট সংস্করণ ডোরাকাটা চিপমাঙ্কগুলো, একটা রোমশ কাঠির মতো
লেজ তুলে দৌড়য়, পুঞ্চুনি পুঞ্চুনি হাতে মাটিতে পড়া বার্ডফুড
কুড়িয়ে মুখে পুরে গাল ফুলিয়ে পালায়। সাথে পাল্লা দেয় কাঠবিড়ালিগুলোও; মোটু মোটু প্রানিগুলো বেজায় হেংলু; বার্ডফুড ওরাও
খাবে, এক্কেবারে 'কাঠবিড়ালি' কবিতার মতোই ওরা, যা পায়, সব
খায়। চোখের সামনে যদিও রোজই ঘটে এইসব দৃশ্য সিনেমার মতো; কিন্তু
এতোদিন যেন উপভোগ করার সুযোগ পেতো না আদ্যোপান্ত রোম্যান্টিক মানুষটা। আজকাল কেউ
কিছু বলে না তাকে, কাজের সময়ে শুয়ে থাকলেও না; কেউ আশাও করে না রিনি কিছু করবে, সে দ্রুত সুস্থ হয়ে
উঠুক শুধু এটাই কাম্য সকলের। কেমন এক লহমায় পাল্টে গেলো তার বা তাদের জীবন। শুয়ে
শুয়ে আলসেমি করতে বরাবর ভালবাসে রিনি, কিন্তু তাই বলে এই
ভাবে সে পেতে চায়নি কোনদিনও। এখন সে যেন সবার কাছে ইম্পর্ট্যান্ট কেমন অদ্ভুত একটা
নিজস্ব জগত হয়ে গেলো তার। কতো বন্ধুরা তাদের পরিবারকে সাহায্য করার জন্য এগিয়ে
আসছে, তাকে শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন চেনা অচেনা কতো মানুষ,
প্রার্থনা করছেন তার জন্য। মাঝে মাঝে রিনি ভাবে সে কি সত্যিই এতো
ভালোবাসা, এতো অহৈতুকী স্নেহ পাবার যোগ্য?
শুধু একটা ব্যাপার সে ক্রমশঃ বুঝছে
আত্মবিশ্বাস তার অনেক বেড়ে যাচ্ছে; প্রথমদিন থেকে সে এত টুকুনও ঘাবড়ে
যায়নি, নাঃ তার ক্যান্সার আছে জেনেও না। তার বক্তব্য 'এটাই যদি হাই ব্লাড সুগার কিম্বা হাই কোলেস্টেরল ধরা পড়ত তাহলেও তো খুবই
সাবধানে থাকতে হতো বাকি জীবনটা। ওষুধ খেয়ে, বা খাওয়া দাওয়ার
মাধ্যমে কিম্বা নিয়মিত শরীর চর্চ্চা করে সুস্থ হতে হতো, তাই
না?' তাহলে ক্যান্সার কেই বা এতো ভয় কেন পাবে সে? কোনো মতেই সে অসুখকে জিততে দিতে চায় না; যেমন তার
অন্তঃসত্বা অবস্থা তাকে কুপোকাত করতে পারেনি, মহিলাদের
সাধারণতঃ যেই ধরনের উপসর্গ হয় তার একটাও দেখা যায়নি রিনির ক্ষেত্রে। পুরোপুরি
উপভোগ করেছিল তার মাতৃত্ব। এবার অসুখের ক্ষেত্রেও তাই করবে সে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ;
না, কিছুতেই সবার ক্ষেত্রে যে সব সাইড এফেক্ট
হয় সে সব ঘটতে দেবে না রিনি তার ক্ষেত্রে, পাল্টে দেবে,
দেখিয়ে দেবে সে।
কেমো নিতে শুরু করার পরেও এর ব্যতিক্রম হলো না, সাধারনতঃ
যেই সাইড এফেক্ট অনেকের ক্ষেত্রেই আসে রিনির সেগুলো দেখা দিলো না। অঙ্কোলজিস্ট
প্রথম থেকেই খুব খুশি, রিনি এমন লজিকালি হ্যান্ডল করছে পুরো
ব্যাপারটাকে। যুক্তি দিয়ে বুঝেছে আবেগতাড়িত হয়ে যায়নি আর তাই চিকিৎসা করতেও সুবিধে
হচ্ছে ওঁর। কেমোথেরাপি নিলে চুল স্বাভাবিক নিয়মেই ঝরে যাবে, তাই
শুরুতেই রিনি তার কোমর ছাড়ানো চুলের বেণী ঘাড় অবধি ছেঁটে ডোনেট করে দিলো। কতো
অসুস্থ মানুষের চুলের দরকার হয়, তার চুল তো উঠেই যাবে,
মাটিতে ফেলে নষ্ট করে কি লাভ?
সপ্তর্ষি, বিয়ে হয়ে ইস্তক মা পাখির মতো আড়াল
করেছে রিনিকে। অন্যান্য স্বামীরা যেখানে বউদেরকেও অর্থকরী কিছু করবার বুদ্ধি দিতেন,
সেখানে সপ্তর্ষি বলত 'দরকার কি? আমি তো যথেষ্ট রোজগার করছি'। সাধারণ ভাবে অ্যামেরিকা প্রবাসী স্বামীরা,একা ছেড়ে দেন
হোমমেকার স্ত্রীদের। গাড়ি নিয়ে বাজার করো, মলে ঘোরো যেভাবে
পারো নিজের সময় কাটাও। নাঃ, সপ্তর্ষি ছাড়েনি কোনোদিন;
কারণ? 'যদি রাস্তায় কোনো বিপদ হয়, একা গাড়ি নিয়ে বেরোলে? থাক, তার
চেয়ে আমি নিশ্চিন্ত থাকব যে তুমি ঘরে আছো।' 'বাজারের মতো
বাজে জায়গা আর হয় না, সেখানে তোমায় একা যেতে বলবো?' শুনতে প্রথম প্রথম খুবই খারাপ লাগতো রিনির; মনে হতো
কি নিষ্ঠুর, কি ভীষণ পুরুষতান্ত্রিক মনোভাব। আর সেগুলো মনে
করানোর মানুষেরও অভাব ছিলো না। কিন্তু যতো দিন গেছে সপ্তর্ষির ভালবাসা ততো টের
পেয়েছে রিনি; আর আজ অসুস্থ হবার পর বলতে গেলে তার ভগবান
দর্শন হয়ে যাচ্ছে সপ্তর্ষি রূপে।
ফেসবুকে নিজের একটা একটা করে কেমো নেওয়া নিয়ে, নিজের
অসুস্থতাকে উপহাস করে মজার মজার স্টেটাস লেখে সে। প্রথম দিকে নিতান্ত পরিচিত
ভালবাসার কয়েকজনকে ছাড়া জানাতে চায়নি কাউকে। কি হবে মানুষকে খামোখা বিব্রত করে?
কিন্তু বয়ঃজেষ্ঠ ফেসবুক ফ্রেন্ড ডঃ.সাবিনার কথায় রিনি তার অসুস্থতার
কথা জানায় সবাইকে এবং সাবিনাদির নিদের্শানুযায়ী সে দোয়া চায় সবার থেকে। কারণ 'শুধু দাওয়া সব সময় কাজ করে না, দোয়ারও প্রয়োজন থাকে'
সাবিনাদির এটাই মত ছিলো। সে এতোটাই প্রাণবন্ত,হুল্লোরে
মানুষ যে তার স্টেটাস দেখে অবিশ্বাস করেছিলেন অনেকেই। ভেবেছিলেন 'এ কোন দেশী রসিকতা'। কেউ কেউ ভেবেছিল হয়ত লোক ঠকানো কোনো শেয়ার, যেমন
প্রায়শই আসে ফেসবুকে। ঘটনাটা এতোই আচমকা ঘটেছে, যে আত্মীয়
পরিজন অনেকেই স্তম্ভিত,যাঁরা খুবই নরম মনের বা যাঁরা অত্যন্ত
স্নেহ করে রিনিকে তাঁরা তুমুল কান্নাকাটি। এমনকি রিনির প্রাইমারী ডক্টরও হতবাক্,
কেঁদে ফেলেন তিনিও। এতো সব কান্নাকাটি রিনি সামলেছে। তার নিজের মা
কে সে নিজেই খবর দিয়েছে। অসীম মনের জোর যেন কোথা থেকে এসে গেলো তার। যদিও ভেতর
ভেতর চিন্তা তার ছিলোই। মৃত্যু ভয় নয়, মৃত্যু কোনো না কোনো
দিন, স্বাভাবিক ভাবেই আসবে সে জানে; বেঘোরে মরতে সে নারাজ। তবে
এক্ষেত্রে চিন্তা আট আট খানা কেমো নিয়ে হজম করতে পারবে কিনা।
নিজেই নিজেকে বোঝায় "ওকিরে? সারা জীবন
কপচে গেলি 'ভালো মন্দ যাহাই আসুক সত্যেরে লও সহজে' আর এখন সত্যের সামনে দাঁড়িয়ে ভয় পেলে চলবে? সহজে যদি
না নিতে পারিস তোর শিক্ষা বৃথা হয়ে যাবে তো!" সারদা মায়ের উগ্র ভক্ত সে,
বিশ্বাস করে তিনি সব সময়ে সাথে আছেন আর তাই ভাবে মনে মনে "বাঃ
রে! মেয়ে হবার সময়ে ঠিক যেমন মেয়ে চাইলি, পেলি; পুরস্কারের বেলায় মা তুমি ভালো আর শাস্তি দিলেই খারাপ? একদম না, সারদা মা ই শক্তি দেবেন। তুই সব ভার ওঁর
ওপরেই দিয়ে দে।" আর হলোও তাই, সব তাঁর ওপর ছেড়ে
নিশ্চিন্ত রিনি। ঠিক ভালো ভালো ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ হয়ে গেল। তাদের খুঁজতে
দৌড়তে হলো না। বন্ধু বান্ধবরা এক কথায় পাশে এসে দাঁড়ালেন। সবার শুভেচ্ছা সকলের
প্রয়াস তো বৃথা হয়ে যায় যদি রিনি যুঝতে না পারে, যদি ভয় পেয়ে
যায়, অতএব তাকে লড়তেই হবে এবং জিততেও হবে।
দুটো কেমো নেবার পর সেই ঘাড় ছাঁটা চুলও উঠে
যেতে থাকলো মুঠি মুঠি। নিষ্প্রাণ চুলে ভরে যেতে থাকে গার্বেজ বিন; ফলে চেঁছে
পরিষ্কার করে ফেলে মাথা রিনি। মুখে কিছু র্যাশ বেরিয়েছে, নখ
কালো হয়ে বিকৃত রূপ ধরছে, হাতের পাতা পায়ের পাতা কুচকুচে
কালো হয়ে গেলো; ঠিক মনেহয় যেন কয়লার দোকান ঘুরে এসেছে সে।
এগুলো হবে অবশ্য জানাই ছিলো আর তাই রিনির ওতে বিশেষ হেলদোল হয় না। মাথার সব চুল
পড়ে গেলে, সে নিয়েও মজা করে স্টেটাস লেখে রিনি। তার ছোট্ট
মেয়ে কমলা, যার ডাক নাম বুলবুলি, কেমন
মেনে নিলো মায়ের এমন অদ্ভুত রূপ। আসলে রিনি লুকোয়নি কিছুই; বায়োপ্সি
করতে যাবার দিন থেকে সে বুঝিয়েছে কমলাকে। ছোট্ট মানুষ, ক্যান্সার
যে কতো মারাত্মক অসুখ হতে পারে কোনো ধারনাই নেই তার। কেমো নিলে মায়ের সব চুল পড়ে
যাবে শুনে প্রথম সে খুব আপসেট, "নিতেই হবে?"
প্রশ্ন করে। রিনি শান্ত মাথায় তাকে বোঝালো "লম্বা চুলের মা যদি
ফটোতে থাকে সেটা ভালো, নাকি ফর দ্য টাইম বিং চুল ছাড়া মা,
সেটা?" "না না চুল ছাড়া মা"
উত্তর কমলার, এই একটা ধাক্কায় যেন বড়োই হয়ে গেলো মেয়েটা।
ছোট্ট মেয়ে রিনির, বড় সাধের
সন্তান। প্রথম যেদিন জানতে পারে মা হতে চলেছে সে, সেই দিন
থেকে, রামকৃষ্ণ মিশনের এক স্বামীজির নির্দেশে সারদা মায়ের
কাছে তাঁর অংশ সন্তান রূপে পেতে চেয়েছে। সত্যিই যখন মেয়ে হোলো এবং সে ঠিক যেমন
কল্পনা করতো তেমন মেয়ে, রিনির আনন্দের সীমা পরিসীমা ছিলো না।
সপ্তর্ষির অন্যতম প্রিয় রং কমলা। কাজেই বাবার প্রিয় মেয়ের নামও 'কমলা' রাখল তাই রিনি। সে আজকাল একাই চলে আসে স্কুল
বাস থেকে নেমে; পাড়ার কাকীমারা চোখ রাখেন ঠিকই। আসলে রিনির
এক দিনের জন্যও ব্যতিক্রম হয়েছিলো না, রোজ আর কোনো মা বাস স্ট্যান্ডে
থাকুন বা না থাকুন, রিনি থাকবেই। কমলা তাতেই অভ্যস্ত ছিলো।
ঘরে ফিরে নিজে খাবার নিয়ে খায়, সাথে মা কে ও জিজ্ঞেস করে
মায়ের কিছু চাই কিনা। অসুস্থ মা শুয়ে আছে কষ্টে ছটফট করছে, ছোট্টো
মানুষ তার সাধ্যানুযায়ী চেষ্টা করে মা কে একটু আরাম দিতে। বাবা যখন কাজ করেন তাকে
সাহায্যও করে সে।
প্রথম প্রথম ভুল ভ্রান্তিতে ভরে যাচ্ছিলো, চোখে মুখে
অন্ধকার দেখে সপ্তর্ষি। রান্না সে ভালোই জানে, কিন্তু এতোদিন
রান্না করতো শখে, আর রিনি হাতের কাছে সব কেটে বেটে গুছিয়ে
দিতো তারপর। এখন কি রাঁধবে ঠিক করার থেকে পুরোটা নিজের করতে হচ্ছে, সেটাও একটা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে। আর শুধু তো রান্না নয়, সাথে ঘর গেরস্থালীর যৎযাবতীয় কাজ; বাসন মাজা,
কাপড় ধোওয়া-শোকানো, মেয়ের স্কুলের খাবার
গুছিয়ে দেয়া, নিজের অফিসের খাবার গুছিয়ে নেওয়া, রিনির জন্য রেডি করে রাখা। সাথে অফিসের কাজ এবং মেয়ের পড়াশোনার দেখভাল;
এই দুটো তার বরাবরের কাজ তো আছেই।
এবং সংসারের বাজার কি লাগবে, না লাগবে হিসেব করা,
বাজার নিয়ে আসলে সেটা সুন্দর করে গুছিয়ে তোলা; সবই এখন 'কাজ'। কোনটা আগে করবে
কোনটা পরে সব গোলমাল হয়ে যাচ্ছে; রিনি তো সব নিজস্ব রুটিনে সেরে নিতো, এতো বছর তাই টের পায়নি কেউ। এমনকি ভুল
হলে খুঁত ধরতেও ছাড়ত না। সারাদিন বাড়িতেই তো থাকে....
🍃🍂🍃🍂 ২
এখন "ফল" বা অটাম। ফল বলে কারন
শীতের সময়ে পর্ণমোচীরা সব পাতা ঝরিয়ে দেবে, কিন্তু এই পাতা ঝরানোর ঠিক আগে,
যখনই গরম থেকে আবহাওয়া ঠাণ্ডা হতে শুরু করে গাছের পাতায় কিছু
কেমিক্যাল রিঅ্যাকশনের ফলে রঙ সবুজ থেকে বদলে বিভিন্ন রঙ নিয়ে নেয়। আর শুরু হয়
রঙের ছড়াছড়ি। লাল, হলুদ, কমলা, বেগুনী, গোলাপী,ব্রাউন কি রঙ
থাকে না? প্রতি বছর রিনির এই সময়টা যে কি অসম্ভব ভালো লাগে;
সে নিজেও ভাষায় ব্যক্ত করতে পারে না। রঙ বদলে যাওয়া গাছ গুলোকে দেখে
প্রতিবার ভাবে 'আর না'; তবু প্রতিবারই
ফটো তুলে তুলে ভরায়। পাতাগুলো শুকিয়ে কেমন অদ্ভুত সুন্দর করে নাচতে নাচতে ঘুরপাক
খেতে খেতে মাটিতে পড়ে; রিনি হাঁ করে দেখে আর ওই ঝরে পড়ার
সময়ে যেন মিষ্টি টিংলিং টিংলিং শব্দ শুনতে পায়। রাস্তায় ভর্তি হয়ে পড়ে থাকা শুকনো
পাতা গুলো, যতদিন না সাফ হচ্ছে, গাড়ী
চলার হাওয়াতে কেমন পাক খেয়ে খেয়ে গাড়ীর পিছে দৌড়য়। গাড়ীতে করে যাবার সময় সামনের
গাড়ীর পিছে ওদের পাগলামো দেখে রিনি; কিম্বা রাস্তার ধারে
দাঁড়িয়ে থাকার সময়। আফশোস করে ক্যামকর্ডর সব বারে সাথে থাকে না বলে। তার দৃষ্টিতে 'ফল' হলো সব থেকে রোম্যান্টিক সিজন।
অসুখের বা বলা ভালো চিকিৎসার এমন যন্ত্রনাও
দমিয়ে রাখতে পারল না রিনিকে। তার ডিএসএলআর ক্যামেরা কাঁধে বেড়িয়ে পড়ল সে; বেশিদূর
হাঁটার ক্ষমতা বা সাহস কোনোটাই নেই। এমনকি জাঁকিয়ে ঠাণ্ডা না পড়তেও, শীত লাগে বলে বেশ কটা ভারী ভারী গরম জামাকাপড় চড়াতে হয়। ওই সব মোটা গরম
জামাকাপড় পরে খানিকটা সময় হাঁপিয়ে নেয় রিনি। তবু তার বাসার আশেপাশে এতো গাছ এমন সব
ঝলমলে হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, রিনি ফটো না তুলে পারে কি করে?
তার স্বামী তো বরাবর তার ছবি তোলার ব্যাপারে আগ্রহী। সপ্তর্ষি নিজেও
খুবই ভালো ফটোগ্রাফার। বিয়ের আগেই তার জন্য এসএলআর ক্যামেরা কিনেছিল; পরে সেটা বেহাত হয়ে যাওয়ায় রিনির মন খারাপ দূর করতে এবারে ডিএসএলআর কিনে
দিয়েছে। রিনির বাবাও অবশ্য তাঁর সামর্থ্যানুযায়ী রিনির ফটোতোলা কে উৎসাহিত করতেন।
তখন অতি সাধারন ক্যামেরা দিয়েও অসাধারন সব ছবি তুলতো, এখন
বরং এতো ভালো ক্যামেরা পেয়ে সে ক্যামেরার অনুপযুক্ত হয়ে গেছে; তবুও দমে যায় না, ওই ভারী ক্যামেরা গলায় ঝুলিয়ে সে
বেড়িয়ে পড়ত বিভিন্ন সময়ে। পড়াশোনাও কিছু করেছে ক্যামেরার বিষয়ে, তবে আদতে ফাঁকিবাজ রিনির সব সময়েই চেষ্টা কি করে সহজে বাজিমাৎ করা যায়।
রিনি যথেষ্ট পাগলী, মর্নিংওয়াকে
যাবার সময়ে, তিনটে জিনিস তার সঙ্গে থাকবেই। ঘরের চাবি,
মোবাইল, আর ছোটো ক্যামেরা। প্রথম দুটো না হয়
মানা যায়, তা বলে ক্যামেরা? রিনির মতে,
অনেক সময়েই অনেক রেয়ার দৃশ্য হাঁটতে হাঁটতে চোখে পড়ে, সেগুলো ধরে রাখার প্রয়াস তার। তার চাবি আবার রূপোর চাবির গোছায় লাগানো,
সেটাকে সুন্দর করে জিন্সের পকেটে ঝোলায়। এককালে দারুন ফিগার ছিল,
ক্যারাটে শিখত,নাচ শিখত তাই; তখন ফ্যাশনও করতো। মোটা হয়ে, যথেষ্ট বয়েস বেড়ে যাওয়া
সত্ত্বেও রিনির অভ্যাস পাল্টায়নি। বিভিন্ন সাজগোজ নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা চালায়।
দুটো কেমো নেবার পরে সব চুল ঝরে গিয়ে যখন মুণ্ডিত মস্তক, শুরু
হোলো রিনির নতুন এক্সপেরিমেন্ট। হেজাব পরতে শুরু করলো সে, আবার
কখনও চেষ্টা করলো তার অতি প্রিয় স্বর্গীয় চিত্রপরিচালকের অনুকরনে পাগড়ি বাঁধার।
যদিও শরীর এতো দুর্বল যে ঠিক মতো দাঁড়াতে অবধি পারে না। বিছানা ছেড়ে কোনোও কারণে
উঠতে হলে ধরে ধরে হাঁটতে হয়। তবু খুশির যেন অফুরান ভাণ্ডার, এতো
প্রাণ দিয়েছে তাকে জীবন।
বাবা অনেক সাধ করে তার নাম রেখেছিলেন, সে-ও এতোকাল
নাম সার্থক করার চেষ্টা করেছে। স্বামীর সাথ দিয়ে সংসার সামিলেয়েছে, কিন্তু কোনোদিনও স্বামীর ঔজ্জ্বল্যকে ছাপিয়ে যাবার চেষ্টা করেনি। নিজের
নাচ গান বির্সজনই দিয়েছে এক রকম; কারণ,তার
শ্বশুরবাড়ীর অপছন্দ। গান গাইবার চেষ্টা আজও করে তবে যখন একা ঘরে থাকে তখন, নতুন নতুন পছন্দ সই গান তোলার চেষ্টাও চালায়। খালি গলায় গান গাওয়া তার
বরাবরের অভ্যেস; কিছু খ্যাতনামা ব্যাক্তিত্বের স্কুলে নাচ
গান শেখার সুযোগ পেয়েছিল সে, সেখান থেকেও বুঝেছে যে খালি
গলায় ঠিকঠাক সুর লাগাতে পারাটাই ক্রেডিট। যন্ত্রানুষঙ্গে গলা একটা সাপোর্ট পেয়ে
গেলে সুর ছুটতেই পারে, বা একটু আরাম প্রিয় হয়ে যেতে চায় গলা।
আসলে হয়ত আরাম প্রিয় সে নিজেই, নিজে বোঝে সে আদতে অগোছালো,
চূড়ান্ত অলস। আর তাই জায়গার জিনিস জায়গায় ফেরানোর চেষ্টা করে,
রুটিন ধরে সব কাজ সারার চেষ্টা করে। রিনি ভালোই জানে নিজেকে ঘাড়ে
ধরে যদি কাজ না করায় তবে সব কাজ পড়েই থাকবে। কিন্তু ঘাড়ে ধরে নাচটা আর প্র্যাক্টিস
করিয়ে উঠতে পারল না। তার অতো সাধের নাচ, অতো লড়াই করে শেখা।
বাবার সে সময়ে ক্ষমতা ছিল না নাচের স্কুলের মাইনে যোগানোর, কন্সিডারেশনের
জন্য আবেদন জানালে ওর নাচের গুরু জানান রিনির আগ্রহ দেখলে তবেই উনি মাইনে মকুব
করবেন। কিভাবে দেখাবে আগ্রহ? সকাল আটটা থেকে দুপুর একটা অবধি
যে কটা ক্লাস হয় সবগুলোতে যেন উনি রিনিকে প্র্যাক্টিস করতে দেখেন। শাপে বর হয়েছিল
রিনির, রোজ পাঁচ ঘন্টা করে প্র্যাক্টিস করত সাথে নিজের
রুটিনের ক্লাস তো ছিলই। সেই হেন নাচ হারিয়েই গেল তার। অবশ্য রিনি অসম্ভব পজিটিভ
মনের মেয়ে আর তাই সে এতে দুঃখিত নয়। কারন সপ্তর্ষি দারুন ভালো ক্রিকেট এবং
ব্যাডমিন্টন প্লেয়ার। স্টেট লেভেলেও খেলেছেন, তাঁর যদি সব হারিয়ে
গিয়ে থাকে তাহলে রিনি তো সেই তুলনায় চুনোপুঁটি। যদিও এতো কিছুর পরেও কোথায় যেন
একটা কষ্ট আছেই তার। মাঝে মাঝে ঝাড়া দিয়ে প্র্যাক্টিসের চেষ্টাও করেনি তা'নয়, শরীর ভারী হয়ে যাওয়ায় পেরে ওঠেনি।
তবে অসুস্থতাকে সে আলসেমিতে পরিণত হতে দিতে
নারাজ। তার না দেখা দিদিমার একটা কথা সে খুব মানে "জ্বরের ল্যাংড়া অভ্যাসে
যায়" কাজেই রিনি সচেতন, কিছুতেই এই দুবর্লতার সুযোগে আরাম প্রিয় না হয়ে
যায় সে। অঙ্কোলজিস্টের নির্দেশানুযায়ী সব কাজ করতেই পারে রিনি যতোদূর তার শরীরে
কুলায় আর হ্যাঁ কোনো মতেই যেন ইনফেকশন্ না হয়। কারণ, কেমো
নেবার পর তার রক্তের শ্বেতকণিকা এক্কেবারে তলানিতে পৌঁছে যায়। শ্বেতকণিকাই শরীরকে
রোগ প্রতিরোধ করতে সাহায্য করে, এবার, সেটা
শরীরে প্রায় না থাকার পরিমান থাকলে চট করে ইনফেকশন্ ধরে যেতে পারে। রিনিকে অবশ্য
সপ্তর্ষি তোলাতোলা করে রেখেছে, কাজ করতে দেওয়া তো দূর,
খাবার অবধি তার মুখের সামনে পৌঁছে দেয়। ওঠা হাঁটা করতে কষ্ট হচ্ছে
যে!! কোনো কোনো দিন রাতের খাবার একসাথে খাবে বলে ধুঁকতে ধুঁকতেও জোর করে উঠে খাবার
টেবিলে বসে, কিন্তু শেষ রক্ষা হয় না। পারে না বেশি সময়
সেখানে চেয়ারে পা ঝুলিয়ে বসতে। উঠে পাশে সোফায় বসে খায়; সে ও
দুই গ্রাস খাবার পর দম নেয়। হাতটা মুখ অবধি যে তুলতে হচ্ছে সেটাও এখন পরিশ্রম লাগে
তার। সপ্তর্ষি পারলে খাইয়েও দেয় তাকে। সারা ঘর বাড়ী এমনকি দরজার নব অবধি
ডিস্ইনফেক্টিং ওয়াইপস্ দিয়ে মুছে, ভ্যাকুয়াম করে করে
পরিষ্কার রাখে, কোনো মতেই যাতে রিনির ইনফেকশন্ না হয়। মেয়ে
বাড়ী ফিরলে দরজা খুলে দিয়ে রিনি সরে যায়। কমলা, জামাকাপড়
বদলে হাত মুখ ধুয়ে তবে মায়ের সামনে আসতে পারে।
রিনির হাতে যখন সংসার ছিল রাত আটটার মধ্যে
রাতের খাওয়া থেকে বাসন ধোওয়া কিচেন সাফ সব সারা হয়ে যেতো রিনির। সপ্তর্ষির পক্ষে
সেটা সম্ভব হচ্ছে না। অফিস থেকে ঘরে ফিরে রাতের রান্না করছে, সাথে সাথে
মেয়ের হোমওয়ার্ক করানো চলতে থাকে; পরে খাওয়া দাওয়া শেষ হলে
পর সারা দিনের বাসন ধোওয়া, কিচেন পরিষ্কার সব সারতে সারতে
রাত দশটা সাড়ে দশটা। সহ্য হয়না রিনির, লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদে
সে। কান্নার শক্তিও যেন নেই শরীরে। সাবিনাদি বারে বারে বলেছেন "তুমি এখন
দেখবাই না ওই দিকে। আগেও করছ আবারও করবা, কিন্তু বর্তমানে
তোমার কাজ সুস্থ হওয়া।" অতএব চোখ কান বন্ধ রাখা ছাড়া কিই বা করতে পারে রিনি?
তিন তিনটে কেমো হজম করে ফেলল। হজমই বটে, সাবিনাদি
বারে বারে সচেতন করেছেন "শরীর তোমার সাথ দেবে না অনেক সময়েই, কিন্তু সে সময়েও মনের জোর রাখবে। কোনো মতেই কোনো নেগেটিভ চিন্তা আনবে না
মনে; তুমি পজিটিভ ভাবলে ওষুধও কিন্তু পজিটিভ কাজ করবে। তোমার
চিন্তার ওপর অনেকটা নির্ভর করবে।" কি অদ্ভুত না? মনের
সাথে জড়িয়ে ওষুধের কাজ? শরীর সব সময় সাথ দিচ্ছেও না, কোনোদিন সারা শরীর জুড়ে কেমন অব্যক্ত অস্বস্তি টের পায়। তখন সাবিনাদির কথা
মন্ত্রের মতো জপ করে। কোনো রাত্রে কষ্ট এতোটাই বেড়ে যায়, রিনি
ভাবে 'কিছুক্ষন যদি দেহটাকে শুইয়ে রেখে বাইরে থাকতে পারতাম
বোধহয় স্বস্তি হতো।' কষ্ট ভোলার জন্য সে কল্পনা করার চেষ্টা
করে, তার দেহটা সব যন্ত্রনা সহ শোওয়ানো আর সে ঘুরে বেড়াচ্ছে
কোনো অনুভূতি ছাড়াই। নিঃশব্দে ছটফট করলেও
টের পেয়ে যায় সপ্তর্ষি। রিনি একাধিক দিন চোখ খুলে দেখে তার বিছানার পাশে নির্ঘুম
ব্যথিত মুখে দাঁড়িয়ে তার স্বামী। পারলে বোধহয় বুক পেতে রিনির কষ্ট শেয়ার করে। লজ্জিত
হয় রিনি তার সহ্য শক্তি আরোও বাড়াতে হবে, না হলে এই মানুষটার
রাতের ঘুমটুকু বড় প্রয়োজন। তবে রিনির পরম সৌভাগ্য, সে যে
দেশে রয়েছে সেখানে চিকিৎসা পদ্ধতি শুধু উন্নতই নয় চূড়ান্ত গোছানো। ডাক্তাররা টিমে
কাজ করেন, আবার কাউন্সিলারও আছেন যাঁরা ক্যান্সার এর রোগীদের
মনোবল অক্ষুণ্ণ রাখতে বা যাদের তেমন মনোবল থাকে না তাদের এই কঠিন সময়ের মধ্যে দিয়ে
অনায়াসে পার হতে সাহায্য করেন। ছোটোদের বোঝানোর উপযুক্ত ব্যাবস্থাও তাঁরাই করেন।
কমলাকে নিজের বুদ্ধি অনুযায়ী বুঝিয়েছে রিনি কিন্তু একজন প্রফেশনাল ঠিকঠাক জানেন
কিভাবে সহজ করে দেওয়া যায় ছোটোদের কাছে আর সেই সাহায্য টুকুন পেয়ে আস্বস্ত হয়,
নিশ্চিন্তও। কাউন্সিলাররা অবাক রিনির মনোবল দেখে, তবু সাহায্যের আশ্বাস দেন তাঁরা, যদি রিনি শেষ অবধি
এই মনোবল অক্ষুণ্ণ রাখতে না পারে।
তিন নম্বর কেমোর পরে খুবই দুর্বল হয়ে গেল সে, ডাক্তারদের
কথা অনুযায়ী এটা নর্ম্যাল। এতোই দুর্বল যে মাথা তুলতেও কষ্ট হয়। প্রতিটা কেমো
নেবার পরের সাতদিন সব থেকে সচেতন থাকতে হচ্ছে, ইনফেকশন্ না
হয়, সপ্তর্ষিও তাই
তো প্রাণপাত করছে। এই সময়েই তো তার ডব্লিউ বি সি বা রক্তের শ্বেতকণিকার পরিমান
অত্যন্ত কমে যায়। কেমো নেবার পরদিনই একটা ইঞ্জেকশন্ নিতে হয় তাকে যার সাহায্যে ওই
শ্বেতকণিকা আবার আগের মাত্রায় ফিরতে পারে।
রিনির এ যাত্রায় আরোও এক নতুন অভিজ্ঞতা হোলো,হঠাৎই একদিন
দুপুরের পর টের পেলো রিনি তার ধুম জ্বর। যেখানে ডাক্তার বারে বারে বলে দিয়েছেন যে
শরীরের তাপমাত্রা ১০০.১ ডিগ্রী হলেও তাঁকে খবর করতে, উনি
বুঝে ব্যবস্থা নেবেন, সেখানে রিনির থার্মোমিটারের পারা ১০৫
ছাড়িয়ে গেছে। সপ্তর্ষি তখন অফিসে, কমলা স্কুল থেকে ফিরবে। তার অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ
এক অবাঙ্গালী বান্ধবী বিষ্ণুপ্রিয়ার সহযোগীতায়, কমলা স্কুল থেকে ফিরলে তাকে
বিষ্ণুপ্রিয়ার স্বামীর জিম্মায় রেখে দৌড়দৌড়ি করে ভর্তি হোলো এমার্জেন্সিতে। ভর্তি
হবার আরোও কারন, তার অঙ্কোলজিস্ট ঠিক এই সময়েই শহরে নেই।
অতএব টিমের অন্যান্য ডাক্তাররা কোনো রিস্ক নিতে রাজি নন। জ্বর মানেই শরীরের ভিতরে
কোনো অসুবিধা রয়েছে, জ্বর তো আসলে রোগের উপসর্গ। সুতরাং
ভর্তি হতে বাধ্য রিনি; অনেক রকমের পরীক্ষা নিরীক্ষা করে দেখা
গেল যে কোনো কারনে তার হার্ট রেট বেড়ে গিয়েছে। শরীর এতোটাই দুর্বল যে ওই বেড়ে
যাওয়া হার্ট রেটকেও নিতে পারেনি, জ্বর এসে গিয়েছে। যদিও কোনো
ইনফেকশন্ নেই তবু অবজারভেশনে থাকতে হবে আর তাই দুই রাত কাটাতে হলো হাসপাতালে।
অভিজ্ঞতার শুরু এই বারে। সরকারি হাসপাতাল বললে সাধারন ভাবে যে চিত্র চোখের সামনে
ভেসে ওঠে তার সাথে এই হাসপাতালের বিন্দু মাত্র মিলও নেই। যে কেবিনে রিনিকে রাখলো
সেটা, এবং তার লাগোয়া বাথরুম, কোনো
পাঁচতারা হোটেলের ঘর বা বাথরুম বললে বোধহয় বেশি বলা হবে না। শুধু ওষুধের
ব্যবস্থাগুলো শরীরে লাগানো, এটাই যা। বিছানাটা, রিনির শোবার ধরনের ওপর নির্ভর করে আপনা আপনি অ্যাডজাস্ট হয়ে যায়। সারারাত
দফায় দফায় নার্স এসে জেনে যাচ্ছেন রিনির কোনো অসুবিধা হচ্ছে কিনা, কোনো ওষুধ দেবার বা কিছু চেক করবার দরকার থাকলে ঘড়ি ধরে করে যাচ্ছেন তা ও।
যেহেতু তার খাওয়া দাওয়ার কোনো রেস্ট্রিক্শন্ নেই কাজেই মেন্যু কার্ড ধরে যেটা খুশি
অর্ডার করো, খাও। ঘরের জন্য একটু চিন্তা হচ্ছিল ঠিকই;
তবু সপ্তর্ষি দশ হাত দিয়ে সামলে দিচ্ছেন আর সাথে কিছু বন্ধুরা আছেন
যেনে নিশ্চিন্ত রিনি। ল্যাপটপ দিয়ে গেছে সপ্তর্ষি কাজেই নিরবচ্ছিন্ন ফেসবুক আড্ডা,
সিরিয়াল দেখা, নিজের লেখা, সব করে নিলো দুটো দিনে।
তার কিছু ফেসবুক ফ্রেন্ড যারা না থাকলে হয়ত
রিনির পক্ষে এই কঠিন সময় পার করা এতো সহজ হোতো না। তাদের মধ্যে দুজন, রিনি যাদের
নাম দিয়েছে 'রাতের পাখি' আর 'রাত জাগা তারা', আজ রিনির আপন বোনের তুল্য। পৃথিবীর
উল্টো পিঠে থাকা এবং গভীর রাত জাগার অভ্যাস থাকায় তারা রিনিকে সঙ্গ দিয়ে গেছে,
প্রায় চব্বিশ ঘন্টা; সাথে থাকতো জোনাকী নামের
বন্ধুটিও। বয়সে ছোটো হলেও অনুস্মিতা নামের মেয়েটির একবার ও তারিখ ভুল হয়নি,
প্রতিটা কেমোর আগের দিন শুভেচ্ছা জানিয়েছে রিনিকে। আরো দুই বন্ধু
শুচিস্মিতা ,শ্রীপর্ণা, রিনির দেশের
দুপ্রান্তে থাকেন , নিয়মিত খোঁজ নেওয়া, বিভিন্ন ভাবে রিনির মনোবলকে দৃঢ় রাখতে দুজনেই প্রচুর সাহায্য করেন। ঘরে
থাকলে সপ্তর্ষির শাসন থাকেই; ঘুম বিশ্রাম যাতে ঠিক মতো করে
রিনি। হাসপাতালে তো কেউ বকবে না, উপরন্তু কোনো অসুবিধা হলেই
সেটার সারানোর ব্যবস্থা হয়ে যাবে, কাজেই ইচ্ছে মতো কাটালো
সে। তবে দু'রাত কাটানোর পর ঘরে ফেরার জন্য ছটফট শুরু করল সে।
শনিবার ঘরে ফিরে শান্তি।
৩
চতুর্থ কেমো নেওয়া হয়ে যায়,অর্ধেক
রাস্তা পার করেছে সে। এই চারটে নেওয়া হয়ে গেলে প্রথম পর্ব শেষ হয় তার। একটা সার সে
বুঝেছে, আর যাই হোক,কেমোকে নিয়ে কোনো
কেরামতি চলবেনা। শরীরে যে কেমিক্যাল তার ক্যান্সার সেলকে মারার জন্য পাঠানো হচ্ছে,
সেটা অন্যান্য অর্গানের জন্যই বিষময়। কাজেই শরীর থেকে যতো দ্রুত
সম্ভব সেগুলোকে বের করে দেওয়াই বাঞ্ছনীয়; অন্যথায় সারা শরীর
জুড়ে এমন অনুভুতি যা স্বপ্নেও ভাবতে পারা যায় না। ফলে জল বা জলীয় কিছু প্রচুর
পরিমানে খেতে হচ্ছে তাকে। সাবিনাদির পরামর্শ অনুযায়ী লেবুজল খায় সে। এবং রিনির
ধারনা যে সেটা খাবার ফলেই মুখের মধ্যে ঘা হবার কথা বারে বারে বলেছিলেন অঙ্কোলজিস্ট
বা নার্সরা, সেটা একটুও হলো না রিনির। যতো সময় শরীরে থাকে
কেমিক্যালগুলো, কেমন অব্যক্ত অস্বস্তি চলে রিনির; কখনও সে ভাবে এটা মানসিক, তবে কষ্ট যে তার হয় এটা
ঘটনা। নার্সদের নির্দেশ মতো কিছু সময় পর পরই বাথরুম যায়, ইউরিন
ধরে রাখলে ব্লাডারের মারাত্মক ক্ষতি হয়ে যাবে, তাই। আর যদি
ক্লান্তিতে বাথরুম যেতে দেরী করে, সারা শরীরে শুরু হয় অসহ্য
অস্বস্তি। কন্সটিপেশন ঠেকানর জন্য ইসবগুল
জাতীয় কিছু খায়, ডাক্তারের নির্দেশে। না হলে শরীর এতোই কোমোল
হয়ে গেছে যে, কন্সটিপেশনের কাঠিন্যে বা চাপে কেটেকুটে
রক্তাক্ত হয়ে যেতে পারে। আর শরীরে কোথাও
এতোটুকু কেটে গেলেও সেই ইনফেক্শনের ভয়। কেমোর অনেক ধরনের সাইড এফেক্টের মধ্যে একটা
হলো ডিপ্রেশন। সময়ে সময়ে কোনো কিছু ভালো লাগে না তার। খাওয়া, ঘুম, লেখা, ফেসবুক, ফোন করা কিচ্ছুটি না। চুপটি করে শুয়ে থাকতে ইচ্ছে হয় তার, ভাবনা আসে যে আধা খাচড়া হয়ে বেঁচে থাকার চেয়ে হয়ত এক ধাক্কায় মারা গেলে
বেশী ভালো হোতো। আবার নিজেই কাটায় এইসব অসংলগ্ন চিন্তাকে। ঘরে টের পেতে দিতে চায়
না তার কষ্ট, আবার পুরোটা নিজের মধ্যে রাখাটাও অসহ্য হয়ে
উঠছে, ভেবে পায় না কি করণীয়।
দেখতে দেখতে পাঁচটা কেমো নেওয়া হয়ে যায়। দু'সপ্তাহ অন্তর
নিতে হচ্ছে কেমো। যেখানে কেমো নিতে যায় সেই সেন্টারটা সৌভাগ্য ক্রমে রিনিদের
অ্যাপার্টমেন্ট থেকে পাঁচ মিনিটের ড্রাইভ। চাই কি রিনি নিজেই গাড়ী চালিয়ে যেতে
পারে, যেমন এদেশীয় অনেকেই করেন, কিন্তু
সপ্তর্ষি সুস্থ থাকতে সেটা হতে দেয় কি করে? সেন্টারের
বন্দোবস্ত দারুন আরামের, বিশাল বিশাল কাউচ পাতা, দুটোর মাঝে পার্টিশান দিয়ে স্টলের মতো করা আছে। কাউচগুলোতে পা ঝুলিয়ে বসতে
না চাইলে নীচের অংশটা সোজা করে পা উঠিয়েও বসা যায়। গরম করেও নেওয়া যায় চাইলে।
দরকার হলে ব্ল্যাঙ্কেট সাপ্লাই দেন নার্সরা। কোনোমতেই যাতে পেশেন্টদের কোনো
অসুবিধা না হয়, তাঁরা তো অলরেডি ক্যান্সারকে মোকাবিলা করছেন।
এক দঙ্গল নার্স যাঁরা প্রত্যেকে দারুন প্রাণবন্ত, প্রতিটা
পেশেন্টের খবর সবাই রাখেন যদিও প্রত্যেকের জন্য একজন করে নার্স বরাদ্দ। তবু,
যদি কেউ কোনোদিন না আসেন বা দেরী হয় আসতে তার পেশেন্টের যেন অবহেলা
না হয়। নার্সদের সাথে খুব ভাব হয়ে গেছে রিনির, প্রায় প্রথম
দিন থেকেই। দেখা হলে হেসে 'হাই' বলা
এদেশের রীতি, এমনকি অপরিচিতদের সাথে চোখাচোখি হলেও হাই বলাই
রেওয়াজ; কাজেই রিনির নার্সরা হাসিমুখে কথাতো বলেনই, রীতিমতো সুখ দুঃখের গল্পও জুড়ে দেন রিনির সাথে। কেউ নিত্য তার গয়না দেখিয়ে
যান, কারণ কোনো একদিন রিনি তাঁর গয়নার প্রশংসা করেছে,
কেউ আবার রিনির ছোট্ট প্রিন্সেসকে দেখে নিজের ছেলেমেয়ের এই বয়সটা
মনে করে বা তাদের এখনের গল্প করে রিনির কাছে। কিউবিকল্ ছাড়া আলাদা ঘরও আছে চাইলে
দরজা বন্ধ করে আলাদা করে বসেও কেমো নেওয়া যায়। কিউবিকল্ গুলোতে টিভির ব্যাবস্থা
আছে তবে হেডফোন লাগিয়ে দেখতে হবে, যাতে অন্যদের টিভির আওয়াজে
কোনো অসুবিধা সৃষ্টি না হয়। যেখানে খুশি বসো,আরাম করে কেমো
নাও। রিনি অবশ্য চেষ্টা করে নার্সদের টেবিলের সামনের স্টলটাতেই বসতে তাতে নার্সরাও
খুশি হন, রিনির সাথে কাজের ফাঁকে কথা বলতে তাদেরও সুবিধা হয়।
প্রতিবার নার্সরা ওষুধ পুশ করার সময়ে সুন্দর করে এক্সেপ্লেন করেন কি ওষুধ দেওয়া
হচ্ছে তার কি ধরনের সাইড এফেক্ট হতে পারে। একটা দেওয়া শেষ হলেই একবার যাতে বাথরুম
ঘুরে আসে পেশেন্ট। রিনি প্রথম এক দুটোর বেলায় ঘুমিয়ে সময় কাটাতো। পরে শুরু করল তার
বহুদিনের পুরোনো অভ্যাসকে ফিরিয়ে আনার। লেখার অভ্যাস ছিলো রিনির, এখন এতোটা লম্বা সময় চুপটি করে বসে না থেকে বা ঘুমিয়ে সময় না কাটিয়ে আবার
লিখতে শুরু করল রিনি। ঘরেও যেহেতু খাওয়া, বিশ্রাম, (সাথে ফেসবুক) ছাড়া আর কিছু করতে হচ্ছে না কাজেই ঘরেও লিখছে সমান তালে।
প্রায় ঘন্টা দু'তিন কিভাবে চলে যায় যেন টেরও পায় না সে।
প্রতিবার অমন লেখার সরঞ্জাম নিয়ে এসে ঘসঘস্ করে লিখতে থাকে দেখে নার্সদের অনেকেই
কৌতুহলী; শেষে একদিন জিজ্ঞেস করেই ফেলে রিনিকে
"আর ইউ আ রাইটার?"
"নট রিয়্যালি"
"হোয়াট আর ইউ রাইটিং দেন? আ লেটার?"
"নপ। দিস ইজ আ স্টোরি, আই হ্যাড
অ্যান আইডিয়া, সো ট্রাইং টু কনভার্ট ইট অ্যাজ স্টোরি"
"ওয়াও! দ্যাট্স গ্রেট, ইউ মে
পাবলিশ ইট। সো,হুইচ ল্যাঙ্গুয়েজ ইজ ইট?"
"ইটস্ বেঙ্গলী"
"লট্স অব কার্ভিং" সত্যিই তো রিনি
কোনোদিন ভেবেও দেখেনি বাংলায় তথা তার হাতের লেখার রকমে, কতো
কার্ভিং।
যেই দিন গুলোতে একটু সুস্থ লাগে ওমনি রিনি
চেষ্টা করে ঘরের কাজ কিছু করতে। হয় কিছু রান্না করে না হয় বাসন ধোয়, কাপড় ধুতে
বসায়। এগুলোতে যেমন সপ্তর্ষির কিছু উপকার হয় তেমন রিনিরও মনেহয় সে বেঁচে আছে। যদিও
রিনি তার সব অসুবিধাগুলোকেই চিন্তা দিয়ে, যুক্তি দিয়ে বিচার
করে; ঠিক কেন তার এতো দুর্বলতা বা গলার মধ্যে যে সব সময়ে
একটা তুলোর বল আটকে থাকার অনুভূতি, বোঝে এর জন্যই অনেক
পেশেন্টের বমি টমি হয়ে চিকিৎসা ব্যাহত হয়। এগুলো কি করে ওভারকাম করা যায় ভেবে বের
করে নিজেই। অন্য পেশেন্টদের কথা শুনেছে যে এইগুলোকে মোকাবিলা করতে না পেরে কি
দুর্গতি হয়েছে এক এক জনের। সব কিছুর পরেও দৈনন্দিন কাজগুলো করতে না পারলে মনেহয়
যেন সে আর বাঁচবে না। তাছাড়া আরোও একটা কারণ ছিলো তার কাজ করার, যদিও মেডিক্যাল ইন্স্যুরেন্স সিংহ ভাগ খরচ বহন করে, তবু
তারা তো আনকোরা, কোনোদিন কোনো বড় অসুস্থতা হ্যান্ডেল করতে
হয়নি, আজ যখন লম্বা চওড়া বিলগুলো আসে সপ্তর্ষির কপালে ভাঁজ
পড়ে। যদি এই বিল ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি না মেটায়? তার পক্ষে
মেটানো তো প্রায় অসম্ভব, তাহলে? সপ্তর্ষি
টের পেতে না দিলেও রিনি ঠিক টের পায় তার অমন সুদর্শন স্বামী এই সবের চিন্তায় কেমন
বয়স্ক রূপ নিয়েছে, চূড়ান্ত অসুস্থ দেখাচ্ছে তাকে। রিনি ভাবে,
এখন যদি সপ্তর্ষি কোনো কারনে সত্যিই অসুস্থ হয়ে পড়ে কোন দিক সামলাবে
রিনি? আর তাই কাজ করে কিছুটা বোঝা লাঘব করে সাথে সপ্তর্ষিকে
এই আশ্বাস দেয় যে সে অনেকটা সুস্থ। নিশ্চিন্ত হয় সপ্তর্ষি। তার এই অসম্ভব মনের জোর দেখে অবাক হয় মানুষে,
এতোটা স্বাভাবিক বা এতোটা স্পোর্টিং সে কি করে ভেবে পায় না তারা,
রিনির সামনেই বিস্ময় প্রকাশ করে।
রিনির হাতের পায়ের তালু এমনিতে খুব লাল, এই সময়ে এতো
কালো হয়ে গেছে যে,মনে হয় কয়লার দোকানে কাজ করে। নখ বিকৃত হয়ে
গেছে, সারাটা সময় গায়ের থেকে কেমিক্যালের গন্ধ আসে রিনি
পারফ্যুম প্রিয়া কিন্তু এখন তো ব্যবহার করতে পারবে না, ওষুধের
সাথে রিঅ্যাকশন হয়ে যাবে। মুখে কেমন মেটালিক স্বাদ পায়, ডাক্তারের
পরামর্শে মেটালের কাঁটা চামচের বদলে প্ল্যাস্টিকেরটা ব্যবহার করে। যে খাবার তার
ভীষন প্রিয় ছিলো সে সব খাবার খাওয়াতো দূর তার
নামেও কেমন গা গুলিয়ে উঠছে। বহু খাবার কোনটা খাওয়া উচিত কোনটা অনুচিত
ইন্টারনেটে এবং ডাক্তারদের কাছ থেকে পাওয়া বই ঘেঁটে ঘেঁটে নিজের জ্ঞানের পরিধি
বাড়াতে থাকল। রান্না চলাকালীন তার গন্ধেও কষ্ট হয় আবার খেতে গিয়ে স্বাদ পায়না অনেক
কিছুরই। সাথে একটু তেল, নুন বা সামান্য ঝাল থাকলে গলা থেকে
পেটের ভিতর অবধি জ্বলতে থাকে। আসলে শুধু তো বাইরে নয় ভেতরেও বড্ড নাজুক হয়ে রয়েছে
সব। রিনি প্রতিনিয়ত বুঝছে সুস্থ ভাবে বেঁচে থাকায় কি আনন্দ। চতুর্থ কেমোর পর
সারাক্ষণ হাত পা জ্বলে যেতো, স্কিন এতোই ভঙ্গুর হয়ে গেছিলো
যে, ব্যান্ডেড লাগালে ব্যান্ডেড খোলার সময়ে চামড়াও খুলে চলে
আসতো। নার্সরা জেনে গেছেন তাই অন্য ব্যবস্থা নেন তাঁরা। কোথাও কোনোভাবেই কেটে না
যায় তাহলেই ইনফেক্শনের চান্স বেড়ে যায়। আর এই সব খুচরো বিপদে আসল চিকিৎসা ব্যাহত
হবে; কাজেই সাবধানে থাকতে হচ্ছে। তবে পঞ্চম কেমোর থেকে
যেহেতু ওষুধ বদলে গেলো তার সাইড এফেক্ট ও বদলালো আর কিছু কিছু স্বস্তি এলো,
যেমন ইনফেক্শনের ভয় অনেক কমে গেলো।
৪
এবারে কেমো নিতে যাবার আগে রান্না করে গুছিয়ে
রাখল ফ্রিজে। যদিও বন্ধুরা অনেকেই বিশেষ করে সপ্তর্ষির পুরোনো বন্ধু রুমকি তো অনেক
বার দিয়েছে রান্না। রুমকির স্বামী ওই প্রবল ঠাণ্ডায় খাবার পৌঁছতে এসে ঘরেও ঢুকতো
না, পাছে রিনির ইনফেক্শন্ হয়। রিনি যে তার বোন,ফোঁটা
দিয়ে রাখী দিয়ে, দাদা পাতিয়েছে রিনি। আরোও অনেকেই সে সময়ে
সাহায্যের হাত বাড়িয়েছে নির্দ্বিধায়। প্রত্যেকের একটাই লক্ষ্য ছিল, সপ্তর্ষির বোঝা কিছুটা হলেও হাল্কা করা আর রিনির দ্রুত আরোগ্য কামনা।
এমনকি সম্পূর্ন অনাত্মীয়রা চূড়ান্ত আত্মীয়তে পরিনত হয়েছেন তাঁদের মনোভাবে।
রিনি যে সিরিয়াল দেখত তার বিভিন্ন চরিত্রে
অভিনয় করা কলাকুশলীরা ব্যক্তিগত ভাবে রিনিকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন, খোঁজ
নিয়েছেন রিনি কেমন আছে, প্রার্থণা করেছেন তার সুস্থ হয়ে ওঠার
জন্য। ওই সিরিয়ালের ফেসবুক পেজের অ্যাডমিন থেকে শুরু করে পরিচিত অপরিচিত সদস্যরা
এমনকি প্রতিপক্ষেরও কয়েকজন শুভেচ্ছা জানিয়ছেন স্বতস্ফুর্ত ভাবে। সপ্তর্ষিকে তাঁর
পরিচিত কিছু মানুষ, এমন ভরসাও দিয়েছেন যে টাকার অভাবে যেন
রিনির চিকিৎসা ব্যহত না হয়, তাঁরা আছেন পাশে। যে ভরসা
রিনি-সপ্তর্ষির রক্তের সম্পর্কের মানুষজনও দিতে পারেননি। তবে এযাত্রায় পঞ্চম কেমোর
আগে, রান্না গুছিয়ে রাখতে পেরে রিনি খুব খুশী বুঝতে পারছে সেও
লড়াই জিততে পারে। লড়াই ই বটে, তার ছোট্ট সুখের সংসারটার জন্য
বেঁচে থাকার লড়াই।
কেমো নিতে গিয়ে এতো ধরনের মহিলা দেখেছে সে, তাদের পোশাক,
সাজ, স্মার্টনেস উদ্বুদ্ধ করে রিনিকে। তারা
যদি এই একই অসুখকে গুলি মেরে উড়িয়ে দিতে পারে তবে রিনিই বা কেন পারবে না? তাদের কেউ কেউ তো নিজে গাড়ী চালিয়ে আসে, রিনির তো সে
সব করতে হচ্ছে না। পঞ্চম কেমো তে ওষুধ পুশ করার সময়েই কিছু সাইড এফেক্ট হতে পারত,
নার্সরা একটু চিন্তিত ছিলেন, কারণ ওই সাইড
এফেক্ট দেখা দিলেই ওষুধ দেওয়া বন্ধ রাখতে হবে, অথচ সেটা
বেশিদিন তো ওই ভাবে ফেলে রাখাও যাবে না। বহু পেশেন্টের ক্ষেত্রে হলেও, অদ্ভুত ভাবে রিনির ক্ষেত্রে কিচ্ছু হলো না, কারণ
রিনি ক্রমাগত নিজেকে বুঝিয়েছে 'কিছু হবে না, কিছু হবে না'; স্বস্তির নিঃশ্বাস সকলের।
দেখতে দেখতে শীতকাল, অনেক রকমের
ফেস্টিভ্যাল, কি ভারতীয় কি অভারতীয়। এই সময়ে দোকানে দোকানে
গিফ্টের ছড়াছড়ি, সবাই সবাইকে কিনে দিতে থাকে, রিনি বরাবর গিফ্ট দিতে ভালোবাসে। মানুষের জন্য ভেবে চিন্তে কিনতে পছন্দ
করে। এটা ওর বাবা মায়ের থেকে পাওয়া; বেশ নতুন ধরনের কিছু
দেবে অথচ বিশাল এক্সপেন্সিভ হয়ত নয়। মিস রোজ, মিস অ্যালেন,
মিস এমি, মিস লোরি যেসব নার্সরা রিনি এবং তার
মতো বাকিদের দেখভাল করেন সকলের জন্য গিফ্ট আনিয়েছে রিনি, এতো
যত্ন করছেন ওঁরা, কি করে রিনি তাঁদের ধন্যবাদ না জানায়?
সপ্তর্ষি অন্য সময়েও আপত্তি জানায় না, তবে সে
সব সময়ে রিনি নিজে দেখে কেনে, এবার সপ্তর্ষিই এনে দিয়েছে
যাতে রিনি খুশী হয়। অসুস্থতা কে হাসি মুখে নিয়েছে আর তাই সপ্তর্ষির দুর্বলতা আরোও
বেড়ে গেছে, কি করলে রিনি আনন্দ পাবে কি করলে সাময়িক যন্ত্রনা
ভুলে থাকবে তার প্রয়াস রোজ করে। আদতে পুজো আর্চ্চায় অবিশ্বাসী সপ্তর্ষি রোজ সকালে
শ্রীশ্রীমায়ের ছবির সামনে ঘি এর প্রদীপ জ্বালায়, ভোরবেলা ঘুম
ভেঙ্গেই ইউটিউব থেকে শিবস্তোত্র চালিয়ে দেয় মৃদু স্বরে সারা ঘরে ঘুরপাক খায় সে
গান। এগুলো রিনির সুস্বাস্থ্যের জন্য একজন প্রবল ঈশ্বর বিশ্বাসী করতে অনুরোধ
করেছেন। রিনির আপত্তি থাকলেও সপ্তর্ষির বক্তব্য যে, না হয়
তারা মানে না তবু এগুলো তো কোনো ক্ষতি করবে না। থাক না, রিনির
যাতে যাতে ভালো হয় সবটা করবে সে, কোনো মতেই সে এতোটুকুও
খামতি রাখতে চায় না।
রিনির ডানদিকের কলার বোনের ঠিক নীচেই স্কিনের
তলায় ছোট্টো একটা বক্সের মতো বসানো হয়েছে যাকে বলে IV পোর্ট। অর্থাৎ বারে বারে
হাতে ফুটিয়ে IV না লাগিয়ে, পোর্টের
মাধ্যমেই সব করা হবে বলে। কি ব্লাড নেওয়া কি কেমো দেওয়া। একটা অ্যানাস্থেটিক ক্রিম
আছে যেটা ঘন্টা খানেক লাগিয়ে রাখলে পোর্টে সূঁচ ফোটালেও ব্যথা লাগে না। মূল কেমো
চালু হবারও আগে কিছু ওষুধ যায় রিনির শরীরে, কেমোতে ও প্রথম
চারটেতে এক ধরনের ওষুধ পরের চারটেয় অন্য। ফলে প্রথম চারটের এক রকমের সাইড এফেক্ট
পরের চারটের অন্য। পঞ্চম কেমোর সময়ে অ্যান্টি অ্যালার্জিক হিসাবে স্টেরয়েড দেওয়ায়
কেমো নেবার পর, দু'দিন অবধি টের পায়নি
কি পরিমান গায়ে যন্ত্রনা হতে পারে । নার্স, ডাক্তার অবশ্য
সচেতন করে দিয়েছিলেন, কিন্তু মাথার তালু থেকে পায়ের নখ অবধি,
অসহনীয় যন্ত্রনা সারাদিন সারা রাত, এতোটা রিনি
সপ্তর্ষি কেউই আন্দাজ করতে পারেনি। কাটা পাঁঠার মতো ছটফট করল রিনি (যদিও সে
বস্তুটি নিজের চোখে দেখবার দুর্ভাগ্য রিনির হয়নি, তবু উদাহরণ
শুনে শুনে মনে হয়েছে কেমন হতে পারে ঘটনাটা)
রিনির যদিও ভয় পাবার মতো সাইড এফেক্টগুলো হয়নি
কিন্তু সাংঘাতিক দুর্বলতা,
ব্লার্ড ভিশন এমনকি এই গায়ের যন্ত্রনাতে ও রিনি ভাঙ্গেনি, ঠিক টুকটুক করে লিখতে থাকে। খাতায় লিখে আবার টাইপ করে করে কম্পিউটারে ভরে
রাখে। সেখানেও সপ্তর্ষি যতোটা পারে সাহায্য করে, উৎসাহ দেয়।
বন্ধুদের পড়তে দিলে তারাও এতো সুন্দর করে প্রশংসা করে; সুস্মি,
পর্না তো অপেক্ষা করতে থাকে কবে কখন রিনি নতুন গল্প দেবে।
ছোট্ট বুলবুলি কেমন বড় হয়ে গেল এই ধাক্কায়।
বরাবর শান্ত নির্বিরোধী কিন্তু এখন যেন টেরই পাওয়া যায় না ঘরে একটা শিশু রয়েছে।
বাবা রোজ যা বানিয়ে দিচ্ছেন লাঞ্চে, চুপচাপ নিয়ে যায় একদিনের জন্যও বলেনি
'আর এটা দিওনা।' তার দশ বছরের জন্মদিন
চলে গেলো রিনি দুঃখ করে কিছু করতে পারল না, ফার্স্ট ডবল
ডিজিট বার্থ ডে তে। বুলবুলি কিন্তু বলে 'থাক মা সুস্থ হোক।'
শুধু যেই দিনগুলোয় রিনিকে রান্না করতে দেখে, একটু
ফ্রেশ দেখে অদ্ভুত একটা আনন্দের হাসি ফোটে ছোট্ট মুখটায়। একদিন জিজ্ঞেস করেই ফেলে 'কেমো শেষ হলে কি তুমি আবার আগের মতো হয়ে যাবে মা?' কথাটায়
চোখে জল আসে রিনির, ছোট্ট মানুষ কেমন করে হজম করছে সব,
ভেতরে ভেতরে মিস্ করছে সেই হুল্লোরবাজ, বকুনিবাজ
মা কে। যে ওকে আদর করবে, খাবার বানাবে ওর পছন্দসই, ওর লম্বা চুল আঁচড়ে দেবে, অন্য অনেক কিছুতেই হেল্প
করবে, আবার বকবেও। এখন যে মা কিচ্ছু করে না, এমনকি মায়ের বেশী কাছে ও সে যেতে পারে না।
৫
ক্রমে ক্রমে সব কেমো শেষ হোলো শেষদিন নার্সদের
কাছ থেকে জন্মদিন সেলিব্রেশনের মতো ট্রিট পেলো রিনি আর একটা সার্টিফিকেট। নতুন
জন্মই তো হলো তার। একটা অদ্ভুত ব্যাপার লক্ষ্য করে রিনি, এইদেশে
কিন্তু পেশেন্টের সংখ্যা নেহাত মন্দ নয়, কিন্তু তা সত্ত্বেও
ডাক্তার বা নার্সরা, রিসেপশনিস্টরা, প্রত্যেক
পেশেন্টের সঙ্গে এতো সুন্দর ব্যববহার করেন যে রোগের যন্ত্রনা বুঝি তাতেই অনেকটা
লাঘব হয়ে যায়।
কেমো নেওয়া শেষ হবার পর মাস খানেকের গ্যাপ
দিয়ে সার্জারি করে নির্ম্মূল হল রিনির শরীর থেকে ক্যান্সার। এই সার্জারির আগে
একদিন দোকানে গেল রিনি,
নাঃ হাঁটতে পারেনি বেশি, কিছু সময় পরেই বসে
গেছিল, তবে এতোমাস পর পরিবারের সকলে বের হতে পেরে সবাই খুশি।
সার্জারির ঠিক আগে আরেক বার পেট-সিটি (PET-CT)স্ক্যান
করা হলো, কেমোথেরাপির আগে যেমন হয়েছিলো। এই পদ্ধতিতে রোগীর
শরীর থেকে কিছু পরিমান রক্ত নিয়ে তাতে
কিছু পরিমাণ রেডিও অ্যাক্টিভ ট্রেসার দিয়ে আবার পাঠানো হয় রোগীর শরীরে।
এরপর প্রায় ঘন্টা খানেক অপেক্ষা করে স্ক্যান করা হয়। ওই রেডিও অ্যাক্টিভট্রেসার
গুলি স্ক্যানের সময়ে সারা শরীর থেকে এক রকম সিগনাল দেয় আর আক্রান্ত কোষগুলি থেকে
অন্যরকম। ফলে ডাক্তাররা খুব সহজেই ধরতে পারেন ঠিক কোথায় কোথায় রয়েছে ক্যান্সার
আক্রান্ত সেল।
সার্জারি সুন্দর ভাবে সফল হ'ল, যেদিন সার্জেন তাকে জানালেন যে
রিনির শরীরের শেষ ক্যান্সার সেলটিকেও শনাক্ত করে তুলে ফেলতে সক্ষম হয়েছেন তিনি,
সেদিন প্রথমবার ভেঙেচুরে
কান্না এলো রিনির। বয়সে তার দিদিসম, এক ডাক্তার এইভাবে
বাঁচিয়ে দিলেন এ যাত্রা; যদিও সার্জারির পর নিজেকে ফেস করতে
অনেকটা মানসিক বল লেগেছে রিনির, কিছুতেই যেন মানতে পারছিল না,
তার বদলে যাওয়া চেহারা। সার্জেন আশঙ্কা করে ছিলেন যে, কেমোথেরাপির পরেও হয়ত কিছু জীবন্ত সেল রয়েছে রিনির শরীরে। যেই জায়গায় সেটা
থাকতে পারে বলে তিনি ভেবেছিলেন, শরীর থেকে সেই অংশ কেটে বাদ
দিয়ে পরীক্ষা করিয়ে দেখেন ওনার আশঙ্কাই সঠিক, হাতের নিচে
লুকিয়ে বসে ছিল। সার্জারির পর সাত সাতদিন সাহায্য করে রিনিদের অনেক পুরোনো বন্ধু
ঋতিকা। নিজের অফিস, স্বামীসহ দুই সন্তানের দেখভাল সব সামলে
সে রান্না পাঠাত যাতে রিনির আগুনের ধারে না যেতে হয়। সার্জেন গ্রিন সিগন্যাল দিয়ে
দিলেও পরে অঙ্কলজিস্টের পরামর্শে রেডিয়েশনও নিয়ে নিলো রিনি। কারন সত্যি বলতে কি
ক্যান্সারের তো ঠিক কোনো ওষুধ নেই, কয়েকটা চিকিৎসা পদ্ধতি
পরপর নিলে শরীর থেকে মারণ রোগকে সরিয়ে ফেলা যায়।
কেউ গ্যারান্টি দিতে পারে না যে এগুলো করলে পরেও আর কোনোদিন ফিরবে না
ক্যান্সার, তবু এটাও ঠিক যে বছর পাঁচেক পর যদি আবার ফিরে আসে
তখন মনে হবে যে ওই সময়ে চিকিৎসা পুরো করলে হয়ত ভালো হতো। তাই, কি দরকার, এতো দুর্ভোগ তো হাসি মুখেই মেনে নিলো,
না হয় আরো একটু, নিয়েই নিলো রেডিয়েশন। তাতে
জায়গাটা মোটামুটি পুড়িয়ে দেয় যাতে যদি কোনো একটাও জীবন্ত ক্যান্সার সেল থেকে গিয়ে
থাকে সেটাও নষ্ট হয়ে যায়। সার্জারির পরে আবার অপেক্ষা তিন মাসের, রেডিয়েশন শুরু। রেডিয়েশন হতে হতে প্রায় গরম কাল এসে গেল। প্রথম রে দেবার ও
আগে, রিনির শরীরের ঠিক যে জায়গায় রে টা পড়বে সেইটা হিসেব করে
মেশিনের কিছু অংশ তৈরী করা হ'ল। কতো হিসেব কতো মাপ জোপ করে।
যাতে কোনোমতেই অন্যত্র না লাগে রে।
রে দিতে শুরু করার পর, প্রথম কটা
দিন কিছুই বোঝেনি রিনি, কিন্তু যতো দিন এগিয়েছে ততো যন্ত্রনা
টের পেয়েছে। কারণ, রে দিয়ে শরীরের সংক্রমিত অংশকে পুড়িয়ে
দিয়ে শরীরকে পুরোপুরি সুরক্ষিত করা হলো, যে আর কোথাও কোনো
জীবন্ত ক্যান্সার সেল রইল না। এবারে শরীরের নরম অংশকে পুড়িয়ে দেবার ফলে শুরু হ'ল কষ্ট যন্ত্রনা, সাথে জামা কাপড়ের ঘষা লেগে পোড়া
চামড়া উঠে গিয়ে রস বের হয়ে, সেখানে জামাকাপড় আটকে গিয়ে আরোও
আরোও কষ্ট বাড়ায়। তবু এতো কিছু বাইরের কাউকে টের পেতে দেয় না রিনি, ফেসবুক, লেখা, রান্না, ঘরের কাজ সব করে আগের মতোই। "আর পারছি না" করে কাঁদতে থাকে
একদিন। সপ্তর্ষি মনোবল জোগায় "এতোদিন যুঝলে আর এই সাত দশটা দিন, পারবে না?"
ইতোমধ্যে চুল আবার গজাতে শুরু করেছে তার, এখন আর
হিজাব লাগাতে হয়না। উইগ এর কথা ডাক্তারের অফিস থেকে বললেও সে তো নেয়নি রিনি। কতো
বিচিত্র ধরনের মানুষের সান্নিধ্যে এলো এই কয়েক মাসে। সত্যিই বিপদে পড়লে একমাত্র
তখনই মানুষের আসল রূপ বুঝি ধরা পড়ে। এই কয়দিনে কতো সম্পূর্ন অপরিচিত মানুষ কাছে
এসেছেন বন্ধু হয়েছেন। তারাও সমব্যথী রিনির, তবে শুধু প্রাণ
খুলে হেসেও যে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করা যায় সেটাও শিখলো রিনি। তার সদাহাস্যময়ী রূপ
দেখে অনেকেই রোগের ভোগান্তিকে সাময়িক ভাবে হলেও ভুলেছে, সেটা
নির্দ্বিধায় স্বীকারও করেছে রিনির কাছে।
বয়সে ছোটো তার মাসতুতো জা, ঘরের সব কাজ,
দুই বাচ্চার দেখভাল সেরে, যেহেতু রিনি ফুল
ভালোবাসে তাই রোজ তাদের গাছের ফুলের ছবি পাঠাতেন রিনি কে। রিনির ক্যারাটের গুরু
ফোন করে আশিস দিতেন, মনের বল যোগাতেন। প্রত্যেকেই নিজের মতো
করে রিনির কষ্ট লাঘবের চেষ্টা করতেন।
রিনির আরও এক জা শুনিয়েছেন তাকে ঈগল / বাজ
পাখিদের সম্পর্কে সেই প্রচলিত কথা, তারা কেমন করে একটা বিশেষ বয়সের পর
উড়ে যায় পাহাড় চূড়ায়। যেখানে নিজেরাই নিজেদের নখ, ঠোঁট,
পালক ভেঙ্গে ছিঁড়ে ফেলে দেয়। তারপর অপেক্ষা করে নতুন সব গজানোর।
নতুন ভাবে পালক, নখ, ঠোঁট গজালে আবার
নতুন উদ্দ্যমে বাকি জীবনটুকু বাঁচে তারা। অথবা সেই মিথোলজিকাল পাখি ফিনিক্স যে
কিনা তার পূর্বপুরুষের ছাই থেকে আবার জন্ম নেয়, মৃত্যুহীন
সে। রিনিও মনেহয় তেমনি নতুন একটা জীবন পেল, কতো রকমের
অভিজ্ঞতা তার ঝুলিতে সংগৃহীত হোলো, সম্পূর্ন নতুন একটা
পরিচয়ে নতুন একটা পথে তার জীবনের নতুন অধ্যায়ের চলা শুরু। সে সম্মানিত রুমকী তাকে
নিয়ে কবিতা লেখায়, সকলের প্রচেষ্টায়, শুভেচ্ছায়
আবার সব ঝেড়ে উঠে দাঁড়ায় রিনি, ফিনিক্স পাখির মতোই নতুন
জন্মে।
🌹🌹🌹🌹
রুমকীর কবিতা
ওই দেখো... কি ভাবে সেজেছে শরতের ভোর
শুধু তোমার জন্য ...
হয়ত আজকের বাতাসে নেই শিউলি গন্ধ তবু ঝরে পড়ার
কাল ভুলে মেতেছে ওক ,মেতেছে মেপল ,রঙ বদলের আছিলায়
শুধু তোমায় ভোলাবে বলে ...
ওই দেখো অ্যাটল্যান্টিক সাক্ষী রেখে উড়ে যাওয়া
গাংচিল, রেখে গেলও শুভ সংকেত
শুধু তোমারি জন্যে ...
দুষ্টু চিপমঙ্ক পরিপাটী অবসরে তোমারি আঙিনায়
...বাদামের লোভে
শুধু তোমারি জন্যে ...
নিরুদ্দেশে যাক কপালের ভাঁজ ,ঝুলে থাকা
আশংকার মেঘ ,ফোল্ডার ভরা অগণিতও ছাইপাশ
ওসব তোমার জন্যে নয় ...
এখন ও লুকোনো কত মুক্তো সময়ের বুকে ...
দেখো ! বয়ে যাওয়া নদী , সমস্ত
বিপরীত স্রোত, সমস্ত ঘূর্ণি পেরিয়ে কি ভাবে ছুঁয়েছে সমুদ্র
...
ভেতরের সমস্ত বিষ উজাড় করে দাও গলিত আগুনের
বুকে ...আজ আর নিশ্চুপ ফেরা নয় ...ঘুরে দাঁড়াও ... নিরাময়ের সংকট পেরিয়ে সশব্দে
বেজে ওঠ মঙ্গল শঙ্খে ...
আত্মঘাতী হোক কর্কট সংক্রান্তি ।।
সমাপ্ত
মৈত্রেয়ী চক্রবর্তী
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন