নগর কলকাতার রাস্তার ইতিহাস
ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়
আজব
শহর কলকাতার পথঘাটের ইতিহাস, তার
জন্মের পেছনে রয়েছে আরো আজব আর রোমাঞ্চকর কথা। ঘাটের কথা থাক, বলা যাবে বারান্তরে। পথের
বা রাস্তার কথাই বলি। কথা কলকাতার
রাস্তার কথা। নগর কলকাতার
বেড়ে ওঠার সামাজিক ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে
আছে এর রাস্তার ইতিহাসও। পুরনো আমলের
মানচিত্রে রাস্তার নাম চিহ্নিত করার রেওয়াজ ছিল না। ১৭৮৪ সালের আগে কোন রাস্তার নাম দেওয়া হয়নি। ১৭৯২ সনে কর্নেল মার্ক উড কলকাতার যে মানচিত্র প্রকাশ
করেন তাতে নামাঙ্কিত রাস্তার সংখ্যা ছিল মাত্র ২৬টি। এরমধ্যে ২০টি ইংরাজ রাজপুরুষদের নামে আর ৬টি ছিল
বাঙালিদের নামে,
তারা হলেন মদন দত্ত,
প্রাণকৃষ্ণ বাবু, নীলু দালাল, নারায়ণ চ্যাটার্জী, মুক্তারাম বাবু ও বলরাম ঘোষ। (সূত্র – ঐতিহাসিক নিশীথরঞ্জন রায়/প্রাণতোষ
ঘটকের ‘কলকাতার পথ ঘাট’ গ্রন্থের
ভুমিকা) এখনও বলরাম ঘোষ স্ট্রীট ও মুক্তারাম বাবু স্ট্রীট আমাদের খুব পরিচিত
রাস্তা। বাকি
রাস্তাগুলির পরিচয় ছিল পাড়ার নামে, যেমন ‘আহমেদ
জমাদার স্ট্রীট’(এখন ইলিয়ট রোড), ‘গোরস্তান চৌরঙ্গী কা রাস্তা’
(এখন পার্ক স্ট্রীট), ‘ডুম টোলি’ (এখন এজরা স্ট্রীট), ‘পুরানা নাচঘরকা পূরব রাস্তা’ (এখন লর্ড সিনহা রোড),
‘পুরানা নাচঘর কা উধার
রাস্তা’(পরে থিয়েটার রোড, এখন
সেক্সপীয়ার সরণি), ‘হোগলকুড়িয়া
গলি’ (এখন সাহিত্য পরিষদ স্ট্রীট), ‘রানী মুদি গলি’ (পরে বৃটিশ ইন্ডিয়ান স্ট্রীট, এখন আবদুল হামিদ সরণি, এইরকম। এইসব রাস্তাগুলির ইতিহাস কলকাতার সামাজিক
ইতিহাসেরই অঙ্গ। এইসব নামের
মধ্যে লুকিয়ে আছে আদি কলকাতার বিন্যাস। বাদামতলা, বেলতলা, ঝামাপুকুর, পদ্মপুকুর,
নেবুতলা পটলডাঙ্গা ইত্যাদি
কলকাতার নানান মহল্লা বা এলাকার নামের পেছনে নিশ্চিতভাবেই লুকিয়ে আছে স্থানিক
ইতিহাস। মধ্য কলকাতায়
এন্টালি নামটি এসেছে ‘হেন্তালি’’ গাছের নাম থেকে। কলকাতার নগরায়ন হবার আগে আদি কলকাতায় ঐ অঞ্চলে
হেন্তাল বা হেঁতাল গাছ প্রচুর হত এটা সহজেই অনুমান করা যায় এই নাম থেকে। হেঁতাল গাছ জন্মায় জোয়ারের জলের প্রভাবে। এখন যেমন সুন্দরবনে হেঁতাল ঙ্গাছের জঙ্গল আছে। একইভাবে ‘ট্যাংরা’, ‘তপসিয়া’,
‘চিংড়িঘাটা’নামগুলি থেকে ঐতিহাসিকরা অনুমান
করেন আদিতে এলাকাগুলি ছিল লবণ হ্রদের মধ্যে।
এখন
অনেক স্ট্রীট ডাইরেকটরি পাওয়া যায় যাতে মহানগর কলকাতার রাস্তার নাম আছে যেখান দিয়ে
গাড়ি ছোটে যানবাহন চলাচল করে। কাজে
অকাজে ঘনঘন যাতায়াতের সুবাদে সেইসব রাস্তার নামগুলি পরিচিত। আবার অনেক গলিপথ, লেন-বাইলেন, দিনের বেলাতেও আলো না ঢোকা শরু গলি আজও আছে যেগুলোর নাম জানি না। সামাজিক ইতিহাস বা প্রেক্ষাপটের তোয়াক্কা না করে
সেইসব রাস্তার নাম পালটে যাচ্ছে আর সেইসঙ্গে মুছে যাচ্ছে ইতিহাস। ইতিহাস মুছে যাওয়ার একটা নমুনা দিই।
রাজভবনের প্রধান ফাটকের উলটো দিকে একটা গলি আছে আদিতে নাম ছিল ‘ফ্যান্সি লেন’। নাম বদলে এখন পান্নালাল ব্যানার্জী স্ট্রিট। ফ্যান্সি মানে সেখানে কোন বাহারী বা সৌখিন ব্যাপার ছিল না। বাংলা ‘ফাঁসি’ শব্দের ইংরাজি উচ্চারণ বিকৃতি ফানসি বা ফ্যান্সি। আঠেরো শতকের শেষদিকে ইংরাজের আইন চালুর আদি পর্বে অপরাধীদের ফাঁসিতে লটকানো হতো এখানে। যায়গাটা তখন জনপথ ছিল না, ছিল জঙ্গলঘেরা একটা মেঠো পথ। তার পাশ দিয়ে বয়ে যেত একটা নদী বা খাল, যেটা বুজিয়ে হয়েছিল হেস্টিংস স্ট্রিট, আর এখন তা পালটে হয়েছে কিরণশঙ্কর রায় রোড। ছিল কয়েকটা বড় গাছ, যার ডালে লটকে ফাঁসি দেওয়া হ’ত তুচ্ছাতিতুচ্ছ কারণে (অবশ্যই দেশীয় লোকেদের, সাহেবদের নয় )। ১৮০০ সনে কোন এক ব্রজকিশোরকে পঁচিশ টাকা দামের একটা ঘড়ি চুরির অপরাধে ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল এখানে। ফ্যান্সি লেনের গাছের ডালে কত ব্রজকিশোরকে ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল, কত বিভিষিকা, দীর্ঘশ্বাস আর কান্নার স্মৃতি বয়ে বেড়াত এই মেঠোপথের মাটি তার হিসাব কেইইবা রাখি! রাস্তার নাম বদলের সঙ্গে সঙ্গে মুছে গেছে সেই ইতিহাস। কিন্তু ইতিহাসকে কি আদৌ মোছা যায়?
ইস্ট
ইন্ডিয়া কোপানী যখন সাবর্ণ চৌধুরীদের কাছ থেকে ১৩০০ টাকার বিনিময়ে সুতানুটি, গোবিন্দপুর
ও কলকাতা এই তিনটি গ্রামের জমিদারী সত্ব দখল করে কুঠি বানালো তখন কলকাতা ছিল জলা
আর জঙ্গল ঘেরা এক গন্ডগ্রাম, জনমানবহীন কয়েকটা মেঠো পথ। মুঘল
আমলে ১৭০৬ সনে,
বাদশাহ ঔরঙ্গজেবের মৃত্যুর
আগের বছর সুতানুটি, গোবিন্দপুর
ও কলকাতা এই তিনটি গ্রাম – যা নিয়ে ‘নগর
কলকাতা’, তার মোট
জমির পরিমাপ ছিল ৫০৭৬ বিঘা। যার
মধ্যে ১৫২৫ বিঘা ছিল ধানক্ষেত, ৪৮৬
বিঘায় বাগান, ২৫০বিঘায়
কলাগাছ, ১৮৭ বিঘাতে তামাক চাষ ও ১৫০বিঘায় শাক-সবজির চাষ,
খাল পাতকূয়া ও পকুর আর ১৪৪
বিঘা ছিল পতিত। এই ছিল
পত্তনের সময়কার ‘নগর কলকাতা’র চেহারা। ছিল দুটি ‘স্ট্রীট’ আর
একটা ‘লেন’। রোড’ বা চওড়া
রাস্তা একটাও ছিলনা। চিৎপুর রোড বা স্ট্রীট ছিল কলকাতার প্রাচীনতম
রাস্তা। ইংরাজরা আসার
অনেক আগে থেকেই চিৎপুরের অস্তিত্ব ছিল। মুঘল
আমলে ১৭০৭ সনের জরীপে চিৎপুর থেকে চৌরঙ্গির জঙ্গল পেরিয়ে কালিঘাট পর্যন্ত একটি
রাস্তার উল্লেখ পাওয়া যায়। ইংরেজরা বলতো ‘রোড টু পিলগ্রিম’। পরে একটা অংশের নাম হয় চৌরঙ্গি রোড আর একটা অংশের
বেন্টিংক স্ট্রীট। চিৎপুর আর
চৌরঙ্গি সম্পর্কে অনেক লোকপ্রবাদ আছে। ওই
জঙ্গলে নাকি থাকতেন চৌরঙ্গি বাবা নামে এক সন্যাসী তাঁর নামানুসারেই অঞ্চলটির নাম
চৌরঙ্গি হয়েছে। আর একটি
প্রবাদ এই যে এই অঞ্চলে নাকি সতীর বাম পায়ের কড়ে আঙুলের অংশ পড়েছিল আর আর তা থেকেই অঞ্চলটির নাম ছিল ‘চেরাঙ্গি’
(চেরা অঙ্গ), চেরাঙ্গি থেকে চৌরঙ্গি। দ্বিতীয়টি – চিৎপুর
নামটা এসেছে অনেক কাল আগে মনোহর ঘোষ প্রতিষ্ঠিত ‘চিত্তেশ্বরী
মন্দির’ থেকেই অঞ্চলটির পরিচিতি চিৎপুর হয়েছে। কবিকঙ্কন
মুকুন্দরামের চন্ডীমঙ্গল কাব্যে চিৎপুরের উল্লেখ পাওয়া যায় এইভাবে -
ত্বরায় চলে তরী তিলেক না রহে।
ডাহিনে মহেশ বামে খড়দহ রহে। ।
কোন্নগর কোতরঙ্গ এড়াইয়া য...
সর্বমঙ্গলার দেঊল দেখিবারে পায়। ।
ছাগ মহিশ মেষে পূজিয়া পার্বতী।
কুচিবান এড়াইল সাধু শ্রীপতি। ।
ত্বরায় চলিল তরী তিলেক না রয়।
চিৎপুর শালিখা এড়াইয়া যায়...। ।
১৯৬১তে কলকাতার এই প্রাচীনতম রাস্তাটির নাম হয়
রবীন্দ্র সরণি।
১৭৫৬
সালে অর্থাৎ যে বছর সিরাজদৌল্লা কলকাতা আক্রমণ করেন, তখন কলকাতায় ছিল ২৭টি স্ট্রীট, ৫২টি লেন এবং ৭৪টি বাই লেন (
সেন্সাস রিপোর্ট ১৯০১)। পরের
দশ বছরে যে রাস্তাগুলি তৈরি হয় সেগুলি হল শ্যামবাজার রোড, মাণিকচরণ রোড (মাণিকতলা স্ট্রীট),
গোপালনগর রোড, দমদম রোড (বেলগাছিয়া রোড),
বারাসাত রোড এবং বেলিয়াঘাটা
রোড (সূত্র - পি থাঙ্কপ্পান নায়ার)। এখন
যে যায়গাটাকে ‘বিনয় বাদল দীনেশ বাগ’ নামে জানি সেটির আদি নাম
ট্যাঙ্ক স্কোয়ার তৈরি হয় ১৭৮৪তে পরে নাম হয় ড্যালহৌসি স্কোয়ার। এখন যে অঞ্চলটিকে সুবোধ মল্লিক স্কোয়ার বলি
সেটির পূর্ব নাম ‘ওয়েলিংডন স্কোয়ার’। এলাকাটির আদি পরিচয়
ছিল ‘ব্যাপারীটোলা’নামে। ১৮১৭ থেকে ১৮২০ সালের মধ্যে আদি ব্যাপারী টোলার
উন্নয়ন ঘটিয়ে ১৮২০র নভেম্বর থেকে নামকরণ হয় ওয়েলিংডন স্কোয়ার। পরে স্বাধীন ভারতে আবার নাম বদলে হয় ‘রাজা সুবোধ
মল্লিক স্কোয়ার’।
পলাশীর যুদ্ধের পর নগরায়ন শুরু হল বটে কিন্তু পরিকল্পিত ভাবে দেশীয়দের জন্য রাস্তাঘাট তৈরি করতে তাদের কোন মাথাব্যথা ছিল না। পলাশীর যুদ্ধের পর কলকাতার জমিদার হলওয়েল সাহেব স্থির করেন শহরে এক এক পেশার লোক এক এক পল্লিতে থাকবে। সেও অনুযায়ী সৃষ্টি হল – কলুটোলা, কুমোরটুলি, দর্জিপাড়া, যোগীপাড়া, আহিরিটোলা, খালাসিটোলা ইত্যাদি। ১৭৮৯ পর্যন্ত সমস্ত রাস্তা ছিল কাঁচা (মাটির) প্রথম বড় চওড়া খোয়া বাধান রাস্তা, সার্কুলার রোড তৈরী হয়েছিল ১৭৯৯ নাগাদ। অর্থাৎ পত্তনের পর একটা চওড়া রাস্তা বানাতে ইংরেজদের লেগে গিয়েছিল একশো বছরেরও বেশি সময়। তাও সরকারী অর্থে নয়, বাসিন্দাদের কাছ থেকে অর্থ আদায় করে। ১৯০১এর দ্বিতীয় জনগণনা রিপোর্ট থেকে জানা যায় যে, ১৮৬৭ পর্যন্ত নগর কলকাতার মাত্র দুটি পথ পাথর দিয়ে বাঁধানো ছিল। ঐ বছর ১৩টি নতুন পথ ম্যাকাডাম পদ্ধতিতে পাকা করা হয়। ঐ রিপোর্ট থেকে আরও জানা যায় যে, ১৮৭১সাল পর্যন্ত অতি সামান্য কয়েকটি পথ ব্যক্তির নামানুসারে ছিল। ১৮৭১এর পর বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নামে রাস্তার নামকরণের প্রবণতা বৃদ্ধি পায়। কোন কোন এলাকায় বিশিষ্ট মানুষের বসবাস না থাকায় দর্জি, মুদি, খানসামা, পাচক- বাবুর্চি ইত্যাদির নামে রাস্তার নামকরণ হয়। কলকাতার আদি যুগে অপরিচ্ছন্নতা ম্যালেরিয়া ইত্যাদি রোগের ভয়ে কোনকোন এলাকায় সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিরা বাস করতেন না যাদের নামে রাস্তার নামকরণ করা যায়। সেখানে বসবাস করতেন ওস্তাগর, খানসামা, দর্জি, মিস্ত্রি প্রভৃতি নগন্য বৃত্তির মানুষজন। সেইসব এলাকার রাস্তার নামকরণ অতয়েব হয়েছিল তাদের নামে যেমন ছিদাম মুদি লেন, শ্যামা বাঈ গলি, অখিল মিস্ত্রি, পাচি ধোবানির গলি, খইরু মেথর লেন, ধাঙ্গরপাড়া লেন ইত্যাদি ১৮৭৭ থেকে ১৮৯৬-৯৭ পর্যন্ত সময়ে এই রকম নগন্য ব্যক্তি নামধারী অনেক রাস্তার নাম পরিবর্তন করা হয়। ফক্স লেন হয় প্রতাপ চ্যাটাজ্জী স্ট্রীট, পটুয়াতোলা বাই লেন হয় চিন্তামণি দাস লেন, নানকু জমাদার লেনেন নাম হয় বেন্টিঙ্ক ফার্স্ট লেন, রমজান ওস্তাগর লেন হয় মদন দত্ত লেন, ধোবাপাড়া লেন হয় পন্ডিত লেন, গাজাওয়ালা গলি হয় মোহনলাল মিত্র লেন, চুনাম গলির নাম হয় ফিয়ার্স লেন, রতন মিস্ত্রি লেন হয় শ্যামাচরণ দে লেন। উত্তর কলকাতায় দুজন ওস্তাগরের নামে দুটি প্রাচীন রাস্তা ছিল লাল ওস্তাগর লেন ও গুলু ওস্তাগর লেন। ১৯১২ সনের ১৩ই নভেম্বর লালু ওস্তাগর লেনের নাম পালটে রাখা হয় ‘অবিনাশ মিত্র লেন’। অবিনাশ মিত্র ছিলেন দর্জিপাড়ার মিত্র পরিবারের সন্তান। তিনি ছিলেন শিয়ালদহ কোর্টের সাব-জজ। লাল ওস্তাগর লেনের নাম পালটে গেলেও ‘গুলু ওস্তাগর লেন’ আজও আছে সে দিনের স্মৃতি নিয়ে, আর আছে স্মৃতি বিজড়িত দর্জিপাড়া নামটি। ১৮৯৬-৯৭এর পর যে সব- -নতুন রাস্তার নির্মাণ হয় সেগুলো সবই নামাঙ্কিত হয় বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নামে।
কলকাতার
রাস্তা-ঘাট তৈরী করার জন্য ইংরেজরা একটা ‘লটারি কমিটি’করেছিল। প্রথম লটারি কমিটি হয়েছিল ১৭৯১তে। লটারির টাকায় শহরের নানান উন্নয়নের প্রস্তাব করা
হয়। ওয়েলসলি
তখন গভর্ণর জেনারেল। সেই
লটারি কমিটি রাস্তাঘাটের উন্নয়ন বিশেষ করেনি। তারা অবশ্য নির্মাণ করেছিল কলকাতা টাউন হল। সেই কমিটি ভেঙ্গে দিয়ে দ্বিতীয় লটারি কমিটি গঠিত
হয়, কাজ শুরু করে ১৮১৭ সাল থেকে। ১৮১৭ থেকে ১৮২১ পর্যন্ত চার বছরে তৈরি হয়
ওয়েলিংটন স্ট্রীট ও স্কোয়ার, হেস্টিংস
ও হেয়ার স্ট্রীট, ম্যাঙ্গো
লেন, বেন্টিঙ্ক
স্ত্রীট (তখন নাম ছিল কসাই টোলা), ফ্রী স্কুল স্ট্রীট, কিড স্ট্রীট, কলেজ স্কোয়ার, পার্ক স্ট্রীট, চৌরঙ্গি প্রভৃতি। ৪৫বছর
এরকম চলার পর সরকারের বোধোদয় হয় যে এইভাবে লটারিতে টাকা তুলে শহরের উনয়ন অনৈতিক। ১৮৩৬এ লটারি কমিটি বন্ধ হয়ে যায়।
১৮৩৬ পর্যন্ত লটারি কমিটি কলকাতায় যে চওড়া রাস্তাগুলির নির্মাণ করেছিল সেগুলি হ’ল – ইলিয়ট রোড, স্ট্র্যান্ড রোড, উড স্ট্রীট, ওয়েলেসলি স্ট্রীট, কর্ণওয়ালিস স্ট্রীট, কলেজ স্ট্রীট, ওয়েলিংডন স্ট্রীট, ময়রা স্ট্রীট, লাউডন স্ট্রীট, আমহার্স্ট স্ট্রীট, কলুটলা স্ট্রীট, মির্জাপুর স্ট্রীট, ক্যানাল স্ট্রীট, হ্যাঙ্গারফোর্ড স্ট্রীট, ও রডন স্ট্রীট। ইতিমধ্যে নগর কলকাতার আয়তন বেড়েছে, ১৮৮৮তে কলকাতার সঙ্গে সংযুক্ত হয়েছে এন্টালি, বেনেপুকুর, ট্যাংরা, তপসিয়া, বালিগঞ্জ, ভবানীপুর, কালিঘাট, চেতলা, আলিপুর ও খিদিরপুর। সেই সময় ল্যান্সডাউন রোড, হরিশ মুখার্জী রোড, হাজরা রোড, আপার সার্কুলার রোড, কালিটেম্পল রোড, গোপালনর রোড প্রভৃতি রাস্তাগুলি তৈরী হয়। ১৮৬৩ থেকে ১৮৮০ সনের মধ্যে তৈরী হ’ল ফ্রীস্কুল স্ট্রীট থেকে ধর্মতলা স্ট্রীট (১৮৬৪), ক্যানিং স্ট্রীট(১৮৬৫), বিডন স্ট্রীট (১৮৬৮), গ্রে স্ট্রীট (১৮৭৩)। ১৮৮৮ পর্যন্ত কলকাতার মোট রাস্তার পরিমান ছিল ১৮২ মাইল। ইতিমধ্যে ১৮৭৩এর ফেব্রুয়ারি থেকে ছোটা শুরু করেছে ঘোড়ার টানা ট্রাম। এর ২৯ বছর পরে চলতে শুরু করে বৈদ্যুতিক ট্রাম। ২৭শে মার্চ ১৯০২এ প্রথম বৈদ্যুতিক ট্রাম চলে ধর্মতলা থেকে খিদিরপুর। এটিই সবচেয়ে পুরাতন ট্রামপথ। এখনো এই পথে ট্রম চলে। মোটামুটি এই হল ১৮ ও ১৯ শতকের কলকাতার রাস্তার চালচিত্র। এই নিয়ে কলকাতা পৌছাল বিশ শতকে। নগর কলকাতার সেইসব রাস্তা এখনকার মত মসৃণ এসফল্ট বা পিচ বাঁধান ছিল না। ছিল খোয়া বাঁধান। কারণ তখন এসফল্ট বা বিটুমিন’এর ব্যবহার জানা ছিল না। পিচের রাস্তা এলো ১৯২৪ থেকে অর্থাৎ ‘নগর কলকাতা’র জন্মের দুশো চৌত্রিশ বছর পরে।
এই
সোয়া দুশো বছরে কলকাতা বাড়লো আকার ও গতিতে। পালকি, গোরুর গাড়ি, ঘোড়ার গাড়ি থেকে প্রবেশ করল
অটোমোবাইল যুগে। ১৮৮৬তে
জার্মানিতে মোটর গাড়ি আবিস্কারের দশ বছরের মধ্যে তা কলকাতায় চলে এলো। ১৯০৬ সনে চলে এলো ট্যাক্সি, ১৯২২এ চালু হ’ল গণপরিবহন ব্যবস্থার প্রধান অঙ্গ মোটর বাস। অতয়েব শহরের গতি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রাস্তারও
নির্মাণ হতে থাকল। ১৯১২তে জন্ম
হল ‘কলকাতা ইম্প্রুভমেন্ট ট্রাস্ট’এর। স্বাধীনতার আগে ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাস্ট অনেকগুলি
রাস্তার নির্মাণ করেছিল,
যেমন (১) এলগিন রোড থেকে
টালিগঞ্জ পর্যন্ত – রসা রোড (২) চৌরঙ্গি রোড হেকে শ্যামবাজার
পর্যন্ত – চিত্তরঞ্জন এভিনিউ, যতীন্দ্রমোহন এভিনিউ, গিরিশ এভিনিউ, ভুপেন বোস এভিনিউ (৩) সাদার্ণ
এভিনিউ, (৪)
রাসবিহারী এভিনিউ ও (৫) আমির আলি এভিনিউ। আর স্বাধীনতার পরে বটকৃষ্ণ পাল এভিনিউ ও
সুন্দরীমোহন এভিনিউ এই দুটি রাস্তা। এর অনেক আগেই ১৮৫৪’র ১৬ই এপ্রিল
হাওড়া থেকে ট্রেন চলাচল শুরু হয়েছে, কিন্তু টিকিটঘর ছিল আর্মেনিয়ান
ঘাটে। সেখান থেকে
টিকিট কেটে স্টীমারে গঙ্গা পেরোতে হত হাওড়ায় ট্রেনে চাপার জন্য। এখনকার হাওড়া ব্রিজ হয়েছে ১৯৪২এ। তার আগে গঙ্গা পার হওয়ার জন্য একটা পেন্টুন
ব্রিজ হয়েছিল ১৮৭৪এ। শিয়ালদহ
স্টেশন তৈরী হয়েছে ১৮৬৯এ কিন্তু শিয়ালদহ থেকে হাওড়া যাওয়ার কোন রাস্তা ছিল না। হ্যারিসন রোড (এখন মহাত্মা গান্ধী রোড) তৈরী হ’ল ১৮৮৯ সনে। এবং হ্যারিসন রোডই কলকাতার প্রথম রাস্তা যেখানে
বৈদ্যুতিক আলো লেগেছিল।
আদি কলকাতায় দু’রকম ভাবে রাস্তা তৈরি হয়েছিল। জঙ্গল, বাদা সাফ করে চওড়া রাস্তা আর নদী, খাল, নর্দমা বুজিয়ে গলি বা লেন। কলকাতায় রোড, রো, স্ট্রীট, লেন, বাইলেন – রাস্তার কত রকমফের! চওড়া রাস্তার পাশাপাশি অজস্র গলি বা লেন, বাইলেন। শরু তস্য শরু, দিনের বেলায় আলো পৌছায় না এমন আঁকাবাঁকা গলি। এখনও সেইসব গলির অস্তিত্ব আছে। বছর কুড়ি আগেকার ঘটনা মনে আছে? খিদিরপুরের গলির গোলক ধাঁধায় তাড়িয়ে নিয়ে এসে পুলিশ অফিসার বিনোদ মেহতাকে খুনের ঘটনা! সেইসব গলি, রাস্তার পেছনে রয়েছে কত চমকপ্রদ কাহিনী। কালের স্রোতে অনেক গলি বা লেনের নাম বদলে সেইসব চমকপ্রদ ইতিহাস মুছে গেছে। তবুও কিছু নাম এখনও আছে সেইসব স্মৃতি বুকে নিয়ে। ওয়েলিংটন স্কোয়ারের (এখন সুবোধ মল্লিক স্কোয়ার) পাশ দিয়ে চলা ক্রিক রো’র সঙ্গে জড়িয়ে আছে পত্তন সময়কার কলকাতার চেহারার একটুকরো স্মৃতি। তখন এটা ছিল পূর্ববঙ্গে যাওয়ার একটা নৌ-পথ। ১৯৩৯ সালে কলকাতা কর্পোরেশন ‘ক্রিক রো’ নাম বদলে রাজা সুবোধ মল্লিক রো করার সিদ্ধান্ত করেছিল। ঐ অঞ্চলের বাসিন্দাদের প্রতিবাদকে গুরুত্ব দিয়ে নাম বদলের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করে নেয়। গুরুত্ব পায় ইতিহাসের স্মৃতি। কি সেই স্মৃতি?
এখন
আমরা বিস্মিত হবো বৈকি,
যে এখনকার স্ট্র্যান্ড রোড
বা নেতাজি সুভাষ রোড ছিল হুগলী নদীর মধ্যে আর তারই একটা শাখা হেস্টিং স্ট্রীট (এখন
কিরণশঙ্কর রায় স্ট্রীট) ধরে বেন্টিঙ্ক স্ট্রীট পার হয়ে ধর্মতলা স্ট্রীটের উত্তর
দিক ধরে ওয়েলিংটন স্কোয়ারের মধ্য দিয়ে ক্রীক রো ও লোয়ার সার্কুলার রোড পেরিয়ে
পৌছাত বেলেঘাটার খালে আর সেখান থেকে ধাপা বা লবণহ্রদ (এখনকার সল্টলেক) হয়ে মিশে
যেতো বিদ্যাধরী নদীতে। সেই
পথে নৌ চলাচল করতো। পূর্ববঙ্গ
থেকে চাল ও শাক-সবজি বোঝাই নৌকা আসতো এই পথে। যে খাল বুজিয়ে হল ক্রীক রো তার নাম ছিল ‘ডিঙ্গাভাঙ্গা
খাল’। ১৭৩৭ সনের ৩০শে
সেপ্টেম্বরে এক প্রলয়ঙ্কর ঝড়ে এখানে ডুবে গিয়েছিল অনেক নৌকা। সেই থেকেই নাম ‘ডিঙ্গা ভাঙা খাল’। ‘সেই ডিঙ্গা ভাঙা’ খাল বুজিয়েই হয়েছিল ক্রিক রো, যা এখনও তিনশো বছর আগের মহা
দুর্যোগের স্মৃতি বুকে আগলে আছে।
কলকাতা
পত্তনের একশো বছর পরে প্রথম চওড়া রাস্তা বানিয়েছিল – সার্কুলার রোড (এখন আচার্য
প্রফুল্লচন্দ্র রায় ও জগদীশ বসু রোড) ১৭৯৯তে। এর পেছনেও আছে অনেক আতঙ্ক-প্রহর আর কান্নার
স্মৃতি, আজও যা ইতিহাসের পৃষ্ঠা আর
ঘুমপাড়ানি গান ও ছড়া আমাদের মনে করিয়ে দেয়।
“ছেলে ঘুমালো পাড়া জুড়ালো, বর্গী এলো দেশে
বুলবুলিতে ধান খেয়েছে খাজনা দেব কিসে”। ।
তখন নবাব আলিবর্দি খানের আমল। ইংরেজরা সবে পঞ্চাশ বছর হল কুঠি বানিয়েছে। ১৭৪২ থেকে ১৭৫১ - বাংলা দেখেছিল ভয়ঙ্কর নির্মম
মারাঠা আক্রমণ ও লুন্ঠন। সেই
দিনগুলিতে বাংলায় চলেছিল হত্যা, লুন্ঠন,
আগুন আর মৃত্যুর মহোৎসব। ভীত সন্ত্রস্ত মানুষ নিরাপত্তার আশায় ইংরাজ
অধিকারে থাকা কলকাতায় আশ্রয় নিল। ইংরাজের সেনা আছে, কামান বন্দুক আছে। আতঙ্কিত হল ইংরেজ ও কলকাতার শেঠ, বেনিয়া, মুৎসুদ্দিরাও। সেদিনের কলকাতার মানুষ নিজেরাই নিজেদের রক্ষা
করার জন্য স্থির করল শহর ঘিরে ৪২ গজ চওড়া আর ৭মাইল দীর্ঘ খাল কাটা হবে (মার্চ
১৭৪৩)। ৬মাসে ৩মাইল
খাল কাটার পর জানা গেল মারাঠাদের সঙ্গে আলিবর্দির সন্ধি হয়েছে, মারাঠারা ফিরে গেছে। বাগবাজার থেকে এখনকার বেকবাগান পর্যন্ত খাল কাটা
হয়েছিল যার নাম ‘মারাঠা ডিচ’। পরের ৬০ বছরে সেই ‘মারাঠা ডিচ’মজে গিয়েছিল। তারপর
সেই মজে যাওয়া ‘মারাঠা ডিচ’বুজিয়ে তৈরি হল বাগবাজারের মারাঠা ডিচ
লেন আর লোয়ার ও আপার সার্কুলার রোড ১৭৯৯তে।
কলকাতার বুকে রাস্তার বিচিত্র নামাবলি। ধনি বাবুরা নিজেদের খরচে অনেক রাস্তা বানিয়েছিলেন যেগুলি নামাঙ্কিত করেছিলেন নিজেদের নামে যা এখনো একই নামে আছে তার পুরান স্মৃতি নিয়ে যেমন রাজা নবকৃষ্ণ স্ট্রীট, অক্রুর দত্ত লেন, রতনবাবু রোড, এই রকম অনেক রাস্তা। ইংরেজরা রাস্তার নামকরণে বড় উদার হস্ত ছিলেন। রাজপুরুষদের নামে যেমন নামাঙ্কিত তো করলেনই, তাদের স্তাবক, বেনিয়া মুৎসুদ্দিদের নামেও অনেক রাস্তার নামকরণ হল। নামকরন হয়েছে ইংরেজদের কর্মচারী, খাজনা আদায়কারী এমনকি তাদের প্রিয় খানসামা, ভৃত্য ধোপা, নাপিত, দর্জি, মুদি, রক্ষিতাদের নামেও অনেক রাস্তা নামাঙ্কিত হয়েছিল। ছকু খানসামা লেন, নিমু খানসামা লেন, বুধু ওস্তাগর লেন, খৈরু মেতর লেন, রানীমুদির গলি এই রকম কত রাস্তা। কিছু কিছু এখনও আছে, কিছু নাম বদলেছে। নানান গল্পকথা জড়িয়ে আছে সেইসব নামের পেছনে।
শৈশবের
কলকাতার একটা প্রাচীনতম গলির নাম ছিল ‘রানী মুদির গলি’। রানী মুদির ছিল দোকান। দোকানদারির সঙ্গে চালাতো মদের ঠেক। আশে পাশে পতিতা পল্লীও ছিল। গিরিশচন্দ্রের বিখ্যাত প্রফুল্ল নাটকে মাতাল
দলের মুখের একটা গানে এই রানীমুদির পরিচয় বেশ জানা যায় –
‘রানী মুদিনীর গলি
সরাপের দোকান খালি
যত চাও তত পাবে
পয়সা নেবে না
ঠোঙা করে শালপাতাতে
চাট দেবে হাতে হাতে
তেল মাখা মটর ভাজা
মোলাম বেদানা’
১৮৫১ সালেও গ্রেট ইস্টার্ন হোটেলের ঠিকানা ছিল
রানী মুদির গলি। সেই রানী
মুদির গলির নাম বদল হয়ে ইংরেজ জমানাতে হয়েছিল বৃটিশ ইন্ডিয়ান স্ট্রীট। ১৮৫১র ২৯শে অক্টোবর বাঙালি জমিদারদের প্রথম
সংগঠন ‘বৃটিশ ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন’ স্থাপিত হওয়ার পর নাম
বদল হয় । এখন আবার নাম
বদল হয়ে সাবেক রানী মুদির গলি হয়েছে আবদুল হামিদ সরণি, প্রয়াত বীর সৈনিক আবদুল হামিদের স্মৃতিতে।
১৬৯৭সন, কলকাতার একদম শৈশব কাল। গার্ডেনরিচে জাহাজে ক্যাপ্টেন স্ট্যাফোর্ড নামে
এক সাহেব এলেন। স্থানীয়
মানুষের কাছে বললেন তাঁর একজন ‘দোবাস’চাই। স্থানীয় মানুষজন ভাবলেন সাহেব বুঝি একজন ধোপা
চাইছেন। তারা ধোয়া
রতন সরকারকে পাঠিয়ে দিলেন সাহেবের কাছে। সাহেব আসলে চাইছিলেন
একজন দোভাষী। যাইহোক রতন
ধোপা সাহেবের সংস্পর্শে এল আর তার আঙুল ফুলে কলাগাছ! প্রভুত সম্পত্তির মালিক হলেন রতন আর তার নামে হল
রতন সরকার গার্ডেন লেন।
ইংরেজরা যে সব বড় রাস্তা করেছিল সবই রাজপুরুষদের নামে
নামাঙ্কিত হয়েছিল। স্বাধীনতার
পরে সেই রাস্তাগুলির অধিকাংশেরই নাম বদল হয়ে গেছে। সেই আমলে বাঙালিদের নামে নামাঙ্কিত রাস্তাগুলি
মোটামুটি অপরিবর্তীত,
দু একটি ব্যতিক্রম ছাড়া । যাদের নামে এই সব স্ট্রীট, গলি, লেন তারা প্রায় সকলেই ১৮ ও
১৯শতকের ইংরেজ শাসনের ঘনিষ্ঠ সহযোগী, দালাল, বেনিয়ান মুৎসুদ্দি, অর্থলোভি কুশীদজীবি শ্রেনীর
প্রতিনিধি। এমনকি নবাবের
বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অংশীদার, নবাবের
কোষাগার লুন্ঠনের অর্থের ভাগ পেয়েছিলেন এমন লোকের নামেও রাস্তা রয়েছে। মির্জাফরের নামেও একটা রাস্তা ছিল, ইংরাজরা তার নাম বদল করে কলেজ রো
করেছিল কিন্তু মির্জাফরের হজুরনবিশ রাজবল্লভের নামে উত্তর-কলকাতায় জনাকীর্ণ রাস্তা
আছে। থাকুক, কেননা নাম বদলে দিলেও রাজবল্লভ বা
তার পিতা রায় দুর্লভের বিশ্বাসঘাতকতার ইতিহাস মুছবে কি করে?
বড়বাজার
থেকে শোভারাম বসাক স্ট্রিট নামে একটা রাস্তা বেরিয়েছে। বহু প্রাচীন রাস্তা। মেডিক্যাল কলেজের উলটো দিকে আরো দুটি গলি
শোভারাম বসাক লেন নামে পরিচিত ছিল। ১৯২৭এ
কলকাতা করপোরেশন সেই গলিদুটির নাম বদল করে দেবেন্দ্র মল্লিক স্ট্রীট করে। শোভারাম বসাকের নাম থেকেই শোভাবাজার আর পৃথক
শোভাবাজার স্ট্রিট হয়েছে কি না তা নিয়ে অবশ্য দ্বিমত আছে। কারণ ১৯০১এর আাদমসুমারি প্রতিবেদনে উল্লেখ আছে। চিৎপুর রোডের সংযোগস্থল হইতে ... অল্প দূরে
অবস্থিত সেকালের একমাত্র বাজারটির নাম ছিল “সুবাহ্ বাজার (পরবর্তীকালে বিকৃত হইয়া
দাঁড়ায় ‘শোভা’ বাজার”। ) কে ছিলেন এই দোর্দন্ডপ্রতাপ শোভারাম বসাক?
কলকাতার ইতিহাস নাড়াচাড়া করা সকলেই জানেন শেঠ ও বসাক – এই তন্তুবায় শ্রেণীটি হল কলকাতার আদি বাসিন্দা। ইংরাজরা এদেশে আসার অনেক আগে ১৫৩০ সন থেকে হুগলী নদী সংলগ্ন সপ্তগ্রাম তখন ছিল সমৃদ্ধ বানিজ্যকেন্দ্র। শেঠ ও বসাকদের কলকাতায় আসা সম্পর্কে ভারতকোষ-২য় খন্ডে এই তথ্য রয়েছে। “ সপ্তগ্রামের স্পমৃদ্ধশালী গোষ্ঠীর মধ্যে বসাক ও শেঠ উপাধিধারী চারটি তন্তুবায় পরিবার ছিল অন্যতম। তাহারা আদি নিবাস ত্যাগ করিয়া হুগলী দক্ষিণে চারিদিকের জঙ্গলের মধ্যে একটি অপেক্ষাকৃত পরিস্কার যায়গায় গোবিন্দপুর নামক এক নতুন গ্রামের পত্তন করিল এবং অপর কয়েকটি তন্তুবায় পরিবারকে আহ্বান করিয়া সেখানে এক বৃহৎ উপনিবেশ গড়িয়া তুলিল। কালক্রমে এই বসাক শেঠদের পৃষ্ঠপোষকতাতেই গড়িয়া ওঠে কলিকাতার উত্তরে সুতানুটি হাট নামে এক বৃহৎ বানিজ্যকেন্দ্র”। শোভারাম বসাক (জন্ম ১৬৯০) ইংরাজরা কলকাতায় কুঠি বানানোর পর গোবিন্দপুর অঞ্চলে চলে আসেন। পরে বড়বাজারে জমি কিনে বাড়ি বানান এবং বিরাট ধনবান হয়ে ওঠেন। শোভারাম সম্পর্কে নানান গল্পকথা, লোককথা ছড়িয়ে আছে। শোভারামের বংশধরদের কোন বধুর নামে একটা বাজার ছিল, তা থেকেই নাকি ‘বউবাজার’ নামের উৎপত্তি। এখনকার শ্যামবাজারে আদিতে একটা বাজার ছিল। কলকাতার জমিদার হলওএল সাহেব নাম দিয়েছিলেন চার্লস বাজার। শোভারামের অনুরোধে তার এক আত্মীয় শ্যামচাদ বসাকের নামে নাম হয় শ্যামবাজার আর শ্যামপুকুর স্ট্রিট। এখনকার শোভাবাজার রাজবাড়ির পূর্বদিকে ছিল শোভা্রামের বিরাট শাক-সবজির বাগান। সেটা পরিণত হয় বাজারে আর তা থেকেই অঞ্চলটির নাম হয় ‘শোভাবাজার’। শোভাবাজার স্ট্রিটও সেকালের ধুরন্ধর অর্থলোভী, জালিয়াৎ শোভারাম বসাকের স্মৃতি বহন করছে। (সূত্র – ‘কলিকাতা দর্পণ’ / রথীন্দ্রনাথ মিত্র)
‘হরি ঘোষের গোয়াল’ কথাটা আমাদের খুব চালু ও পরিচিত প্রবাদ। সেই হরি ঘোষের নামে উত্তর কলকাতার একটা খুব পুরাতন রাস্তা আছে ‘হরি ঘোষ
স্ট্রিট। তার পিতা
বলরাম ঘোষের নামেও একটা বহু পুরাতন রাস্তা আছে। হরি ঘোষ ছিলেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর মুঙ্গের
দূর্গের দেওয়ান। সেই সূত্রে
প্রচুর ধনশালী হয়ে কলকাতার বাসিন্দা হন। তাঁর
প্রচুর দান-ধ্যানের খ্যাতি ছিল। নিজের
বাড়িতে আশ্রয় দিতেন অনেক অসহায় মানুষকে। হরি
ঘোষের বাড়ি তাঁর আত্মীয় পরিজন, অনাহুত,
রবাহুত আশ্রিতদের কোলাহলে
মুখর থাকতো আর সেই থেকেই তার বাড়িটি ‘হরি ঘোষের গোয়াল’
আখ্যা পেয়েছিল। ১৮০৬
সালে তাঁর মৃত্যু হয়। হরি ঘোষরা
ছিলেন কলকাতার প্রাচীনতম কায়স্থ পরিবার। তাঁর
পিতা বলরাম ঘোষের নামেও কলতার অন্যতম প্রাচীন একটি রাস্তা - উত্তর কলকাতার
শ্যামবাজার সংলগ্ন বলরাম ঘোষ স্ট্রিট। ১৬১০
সনে বলরাম কাশীপুরে প্রতিষ্ঠা করেন চিত্রেশ্বরী মন্দির (কাশীপুরের গান আন্ড শেল
ফ্যাক্টরীর বিপরীতে)। এই
চিত্রেশ্বরী মন্দির থেকেই নাকি চিৎপুরের উৎপত্তি এরকম জনশ্রুতিও আছে।
রাস্তার
ইতিহাস মানে শুধু সেগুলির নির্মাণের সাল, তারিখ ও কার নামে রাস্তা তার বৃত্তান্ত মাত্র নয়, এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে সেকালীন
সমাজ-চিত্রের খন্ডাংশও। রাস্তা নির্মাণের মাল-মশলার বিবর্তন, সেই সময়ের জমির দাম, রাস্তা নির্মাণের কারণে যাদের
বাড়ি ভাঙ্গা পড়তো বা জমি দখল করা হত তাদের সরকারী ক্ষতিপুরণের হার, নির্মাণ কার্যে নিযুক্ত শ্রমিকের
মজুরী সর্বোপরি রাস্তাঘাট নির্মাণে সাধারণ মানুষের আগ্রহ ইত্যাদি বৃত্তান্তও
আমাদের কৌতুহলী করে।
ধানখেত
আর জলা-জঙ্গল ঘেরা,
পালকি, গোরুর গাড়ি সম্বল সেই শৈশবের
কলকাতায় রাস্তা নির্মাণের সংবাদে সাধারণ মানুষের আগ্রহতো থাকবেই। বাংলা পত্রিকাও তখন সবে তার পথচলা শুরু করেছে
(১৮১৮)। পত্রিকার
পৃষ্ঠায় কলকাতার রাস্তা তৈরির খবর থাকতো। ১৮২০
সনের ২৬শে ফেব্রুয়ারি তারিখের ‘সমাচার দর্পণ’পত্রিকার একটি
সংবাদ উদ্ধার করছি – “নূতন রাস্তা – মোং
কলিকাতাতে এক নূতন রাস্তা হইতেছে সে রাস্থা মোং চান্দনী বাজারের পূর্বে
ব্যাপারিটোলাতে আরম্ভ হইয়া দক্ষিণ হইতে উত্তর দিকে আসিতেছে এবং শহরের বড় রাস্থার
পূর্ব ও বাহির রাস্থার পশ্চিমে। ...
সে রাস্থার সন্মুখে যে২ লোকেদের বাটী ও বাগান ও পুষ্করিণী পড়িতেছে কোম্পানী
বাহাদুর তাহারদিগকে বাটী প্রভৃতির উপযুক্ত মূল্য দিয়া সে সকল ভাঙ্গিয়া শোজা রাস্থা
করিতেছেন ইহাতে অনেক বাড়ী ভাঙ্গা গিয়াছে এবং অনেক ভাঙ্গা যাইবে। ঐ রাস্থা মোং বহুবাজার পর্যন্ত আসিয়াছে অনুমান
দুই হাজার লোক সেই কর্মে প্রতিদিন নিযুক্ত আছে”। (বানান ও
বাক্যবিন্যাস অপরিবর্তীত। ধর্মতলা – ওয়েলিংটন
সংযোগস্থলের একাংশের প্রাচীন নাম ছিল ‘ব্যাপারিটোলা’
– লেখক )।
১৮৩৬
পর্যন্ত কলকাতার রাস্তাঘাট নির্মাণ করেছিল ওয়েলেসলির তৈরি করা লটারি কমিটি। তাদের রিপোর্ট থেকে সেই সময়ের জমির দাম, শ্রমিকদের মজুরী ইত্যাদি তথ্য
জানা যায়। ট্যাঙ্ক সহ
ওয়েলিংটন স্কোয়ার তৈরি করতে জমি অধিগ্রহণের ক্ষতিপুরণ সহ নির্মাণ ব্যয় ধরা হয়েছিল
১০৪০৯৫টাকা, ১৩ আনা, ৫ গন্ডা। ট্যাঙ্ক ও স্কোয়ার নির্মাণ হবার পর ঐ অঞ্চলে
জমির দাম ৩০০টাকা প্রতি কাঠা হবে বলে হিসাব করা হয়েছিল। সরকার জমি অধিগ্রহণের জন্য ক্ষতিপুরণ দিয়েছিল
কাঠা প্রতি ২০০ টাকা। মির্জাপুরে
জমির দাম ছিল ১৫০টাকা প্রতি কাঠা। আবার
চৌরঙ্গি অঞ্চলে ক্যামাক সাহেবের (যার নামে ক্যামাক স্ট্রীট ) জমির দাম ছিল
কাঠাপ্রতি ৫০টাকা।
১৯২৪এর
আগে খোয়া বাঁধানো রাস্তাই ছিল পাকা রাস্তা। তখনও
বিটুমিনের ব্যবহার জানা ছিল না। ১৯২৪
এ প্রথম পিচের রাস্তা করা শুরু হল, অর্থাৎ নগর কলকাতার পত্তনের দুশ’চৌত্রিশ বছর পর। লটারি কমিটির রিপোর্টে বলা হয়েছিল কলকাতার
রাস্তা তৈরী করতে প্রত্যেক বছরে প্রয়োজন ১২০লক্ষ ইটের। ইট ভাঙ্গা খোয়া দিয়েই রাস্তা পাকা করা হ’ত। খোয়া ভাঙ্গার খরচ চিল ৮০ লক্ষ ইটের জন্য ৪৪৪৫টাকা। সেই সময় একজন মজুর ৩৬০০ ইট ভেঙ্গে খোয়া তৈরী
করার মজুরি পেত ২টাকা মাত্র। অন্যদিকে কলকাতার বাবুরা লাখলাখ টাকা ওড়াত বাইজী
নাচ, রক্ষিতা আর গণিকা পোষার পেছনে। কি হৃদয়হীন বৈপরীত্য!
এভাবেই
সোয়া তিনশ’ বছরের কলকাতার বুকে জড়িয়ে আছে রাস্তার বিচিত্র নামাবলী, আর তার পেছনে রয়ে গেছে নানান
কৌতুহল জাগানো কাহিনী, জনশ্রুতি আর ইতিহাস-কথা। লুকিয়ে আছে শঠতা, পীড়ন, বঞ্চনা
আর কান্নার কথকতা। ছড়িয়ে থাকা
তথ্য ঘেঁটে আমি সামান্য কিছু উদ্ধার করলাম।
তথ্যসূত্র – (১) ‘কলিকাতার
সংক্ষিপ্ত ইতিহাস’ / অতুলকৃষ্ণ রায়, (২) ‘সংবাদপত্রে
সে কালের কথা’ / ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, (৩) কলকাতা শহরের ইতিবৃত্ত’,
/ বিনয় ঘোষ, (৪) ‘কলিকাতা দর্পণ’ / রথীন্দ্রনাথ
মিত্র, (৫) ‘কলকাতার পথঘাট’/ প্রাণতোষ ঘটক, (৬) (৭) ‘কলকাতার রাস্তার
ইতিহাস’/সমীর রায়চৌধুরী, (৮) ‘কলকাতা’/শ্রী পান্থ, (৯) ‘ভারত কোষ’ ২য় খন্ড /
বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ (১০) ‘কলকাতা আছে কলকাতাতেই’ / পি থঙ্কপ্পন নায়ার
ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়
অনেক কিছুই জানতে পারলাম দাদা। এত তথ্যসংগ্রহ,স্বাদু গদ্যে লেখা যে পড়তেও বেশ ভালো লাগল।
উত্তরমুছুনপড়তে পড়তে ভালো লাগছে খুব
উত্তরমুছুন