জলে কুমির
ডাঙায় বাঘ। জনগণ যখন সচেতন ভাবে রংরুট ধরেই এগোনোর সিদ্ধান্ত নেয় তখন এই পরিণতিই
যে অবধারিত তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। বৃহত্তর জনগোষ্ঠী নেতা নেত্রীর ভাষণে
বিশ্বাস করতেই ভালোবাস। এবং যে দেশে শিক্ষার হার যত কম, সে দেশে জনগণকে মিথ্যায়
বিশ্বাস করানো তত বেশি সহজ। বলাই বাহুল্য। আর চতুর এবং বুদ্ধিমান’রা তখন সেই
সুযোগেই শিবির বদলের লাইনে দাঁড়িয়ে পড়ে। বেমালুম নির্লজ্জের মতোনই। সাধারণ জনগণকে
বিভ্রান্ত করার এও আর এক সহজ উপায়। তাই বাঘ ও কুমির দুই পক্ষই সেই সুবিধাবাদী
সুযোগসন্ধানী চতুর ও বুদ্ধিমানদেরকে আদর আপ্যায়নে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। বৃহত্তর
জনসাধারণ তাই দেখেই নিশ্চিন্তে হয়ে ভোটের লাইনে দাঁড়িয়ে পড়ে। সেই লাইনে বুথ জ্যামই
হোক আর ছাপ্পার কারবারই জমে উঠুক। জনগণ নিশ্চিন্ত থাকে অচ্ছে দিন আর পরিবর্তন এলো বলে।
তাই যেখানেই ভোট দেওয়ার সুযোগ সেখানেই অচ্ছে দিন আর পরিবর্তনের স্লোগানে দাও ভোট।
তার পরিণতি যা হবার তা তো হবেই। সে নিয়ে আর শোক করে কি হবে?
সারদা
থেকে নারদা। নোট বাতিল থেকে ব্যাংক লুঠ। ক্লাবে ক্লাবে অনুদান থেকে হাজার হাজার
কোটি টাকার অচল মূর্তি। ডেলোর মিটিং থেকে রাফায়েল চুক্তি। তেলের দামের ম্যারাথন
দৌড় থেকে তোলাবাজির দৌড়াত্ম। মেলা খেলা মোচ্ছোব থেকে গোরক্ষা আন্দোলন। এন-আর-সি
করে বাঙালি খেদানো থেকে উন্নয়নের মশারী খাটিয়ে বিরোধী শূন্য রাজনীতি। হরেক রকমের
সার্কাস। সব রকম বিনোদনই মজুত। অচ্ছে দিন আর পরিবর্তনের যুগলবন্দীতে বিমুগ্ধ সময়।
হতবাক মানুষ। নির্বাক জনকন্ঠ। সত্যিই চমৎকার সময় এখন। প্রায় খোলা মাঠে রেফারিহীন
ম্যাচ।
প্রশ্ন
করো না। আওয়াজ তুলো না। শুধু গলা মেলাও। স্লোগানে বিরুদ্ধ স্লোগানে। প্রতিশ্রুতি
অনুযায়ী দাঁড়িয়ে যাও ভোটের লাইনে। নয়তো বাড়িতে বসে নিরাপদে থাকো। উৎসবে পার্বণে
আনন্দ করো। রথযাত্রা থেকে গোরক্ষায় সামিল হও। ধর্মকর্ম করো। বুদ্ধদেব বলেছিলেন
নিজেকে জানো। যথার্থ কথা। তুমিও জেনে নাও তুমি হিন্দু না মুসলমান। উন্নয়নশীল
বিশ্বে উন্নয়নই শেষ কথা। শুধু জেনে নিতে হবে উন্নয়নের সঠিক রঙ কোনটি। সেইমত রাঙিয়ে
নাও বাড়িঘর স্কুল কলেজ অফিস কাছারী। উন্নয়নের ঝলমল রঙের ঔজ্জ্বলে তাকিয়ে দেখ, মনের
ভিতর কেমন পুলক জাগে। জাগবেই। আর জাগলেই তুমিও পরিবর্তনের কাছে ঋণী। হতেই হবে। এমন
অচ্ছে দিন আর কবেই বা ছিল? চোখ মেললেই বিশ্বের উচ্চতম মূ্র্তি। গর্বিত তুমি। এমন
দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে না। শুধু থেকে থেকে গলা ছেড়ে জয়ধ্বনি দিতে হবে দেশমাতৃকার
নামে। তবেই না প্রমাণ হবে তুমি দেশপ্রেমী। অনুপ্রবেশকারী নও।
সত্যিই
এ এক আজব শতকে অনুপ্রবেশ করে ফেলেছেন আপনি। ওদিকে বিশ্বের অধিপতি শতকের শুরুতেই
বলে দিয়েছেন, হয় আমার পক্ষে থাকো নয় আমার গুলি খাও’। এমন মহামন্ত্র দিয়ে যেতে
পারেন নি স্বয়ং হিটলারও। আপনার পাড়া থেকে পার্লামেন্ট, সর্বত্রই এই এক মহামন্ত্রের
রাজত্ব আজ। যার ভোটে যার টিকিটেই ভোট বৈতরণী পার করুন না কেন, উন্নয়নের পক্ষে না
থাকলে ভিটে মাটি সবই ভোগে। ঠিক যেমন হিন্দি হিন্দু হিন্দুস্তানে টিকে থাকতে গেলে
আপনাকেও দেশমাতৃকার নামে মুহুর্মুহু জয়ধ্বনি দিতে হবে। হবেই।
জয়ধ্বনি
দিতে হবে অচ্ছে দিন আর পরিবর্তনের পক্ষেও। কাকে ছেড়ে কাকে সন্তুষ্ট করবেন? সেখানেই
তো আপনার কেরামতি। দক্ষ ফরোয়ার্ডের মতো ড্রিবল করে এগিয়ে যেতে হবে নিজের লক্ষ্যে। যখন
যে দেবতাকে দরকার, ঠিকমত মন্ত্রে সন্তুষ্ট করে নিরাপদে থাকুন। গুছিয়ে নিন, নিজেকে।
সত্যিই গুছিয়ে নেওয়ার মতো এমন সুসময় আর আসেনি এদেশে। সে আপনি সারদা নারদাই করুন আর
ব্যাংক লুঠ করে দেশই ছাড়ুন। অনেকেই বলবেন, সেই সুযোগ আর কজনের ভাগ্যেই বা জোটে?
ঠিক কথা। কিন্তু তাতেই বা কি? ক্লাবে ক্লাবে অনুদানের ঢালাও বাজেট। চুন বালি
সিমেন্ট ইট পাথরের তোলা। ঘুষ থেকে ঘুষি, সবরকমের সুবন্দবস্তই তো মজুত। আর শিল্পী
থেকে বুদ্ধিজীবী হলে তো আপনারই পৌষমাস।
যেভাবেই
হোক, জনগণের টাকা জমা হবে গিয়ে হাতে গোনা কয়েকজনের হাতেই। না তাই বলে তাই নিয়ে
কোলাহল করা যাবে না। তাকিয়ে থাকতে হবে অন্যদিকে। একদিকে ডিজিট্যাল ইণ্ডিয়া। এক
দিকে উন্নয়ন। এক দিকে হিন্দুত্ব রক্ষার লড়াই। একদিকে বিদেশী অনুপ্রবেশকারীদের হাত
থেকে দেশ বাঁচানো। এক দিকে উন্নয়নের জোয়ারকে বিরোধী পক্ষের সকল কুৎসা থেকে রক্ষা
করা। এক দিকে সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের সাফল্য। একদিকে উৎসব পার্বণের আনন্দ। সবটাই
উইন উইন সিচ্যুয়েশন। ফলে আপনি জলেই থাকুন আর ডাঙাতেই থাকুন, শিখে নিতে হবে
আত্মরক্ষার সঠিক উপায়টুকু। সেখানেই আপনার কেরামতি। সেখানেই বাজিমাৎ।
সার্কাসের
ট্রাপিজের খেলার মতোই তাই আমাদের সকাল সন্ধ্যা। যে যার দক্ষতার মতোই টিকে থাকা। আর
খেলে যাওয়া, বাঘ কুমিরের হাঁ’কে ডজ ডজ করে করে। পেলে মারাদোনা মেসিদের মতোই। কোন
অংশে কম নয়। সেখানে, কোথায় শত শত কৃষক ঋণের জালে আত্মহত্যা করছে, আর কোথায় বা
বাঙালি হওয়ার অপরাধে হাজার হাজার মানুষ ডি-ভোটার হয়ে যাচ্ছে নিয়ম করে, সে খোঁজে
আমাদের কি দরকার। সারদায় টাকা রেখে কত পরিবার গাছতলায় গিয়ে পৌঁছালো আর
জাতিবিদ্বেষের শিকার হয়ে কজন বাঙালি গণহত্যায় শেষ হয়ে গেল, সেই খোঁজেই বা আমাদের
কি এসে যায়? আমরা বরং বিশ্বের সর্বচ্চো মূর্তির দিকে সগর্বে তাকিয়ে থাকবো আর ভাবতে
চেষ্টা করবো ৩০০০ কোটি টাকা আসলেই বা কত টাকা। হিন্দুত্বের পুনরুত্থানে রামচন্দ্রে
নামে মুহুর্মুহ হুঙ্কার দেবো। পথের দুই ধারে নীলসাদা রঙের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে
উন্নয়নের সুফল ভোগ করে আহ্লাদে আটখানা হতে থাকবো। টিভিতে রেড রোডের কার্নিভ্যাল
দেখে বিশ্ববাংলার রাজপথে আন্তর্জাতিক হয়ে ওঠার আনন্দে উৎসব করবো।
উৎসবের
এই সার্বিক পরিবেশেই রংরুটের কার্তিক সংখ্যার প্রকাশ। সে পরিবেশ রং না রাইট, সেই
বিতর্ক চলতেই থাকবে। সুবিধার প্রসাদভোগীদের কাছে যেমন রংরুটের অস্তিত্বই থাকতে
পারে না। ঠিক তেমনই উল্টোদিকের জনমানসে রাইটরুটের অস্তিত্ব খোঁজার অন্তর্লীন
প্রয়াসও জারি থাকবেই। যেভাবেই হোক না কেন। কারণ সেটাই ইতিহাসের বিধান।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন