আঁধারের অবলম্বন
মৌসুমী ঘোষ দাস
হেমন্ত গুটিগুটি পায়ে শীতের
দোরগোড়ায় এসে দাঁড়িয়েছে। এখন দুপুরের খানিক পরেই কোন আগাম খবর না দিয়েই ঝুপ করে
অন্ধকার নামে। সন্ধ্যে হতেই কলোনির রাস্তাঘাট শুনশান হয়ে যায়। চাঁপামারি কলোনির
দক্ষিণে পাকুড়তলার পাশ দিয়ে যে রাস্তাটা ডানে বেঁকে নদীর দিকে গেছে, সেই রাস্তার পাশে নদীমুখো একটা টিনের চালা দেওয়া এক কামরার
ঘরে শাশুড়ি শিউলিকে নিয়ে থাকে মিতুন। মা বল, কি বাবা বল, আপনজন বলতে এখন একমাত্র ভরসা
শাশুড়ি। কিছুক্ষণ আগেই বাড়ি ফিরেছে মিতুন। ফিরেই বাথরুমে ঢুকে শাড়ি ছেড়ে, গা ধুয়ে রান্নাঘরে গিয়ে স্টোভ জ্বেলে শাশুড়ির জন্য একটু চা
করে নিয়ে এসেছে।
ঘরে একটা তক্তপোষের
ওপর শিউলি একটা কাঁথা মুড়ি দিয়ে, শুধু
মাথাটুকু বের করে শুয়ে আছে। ক’দিনের জ্বরে দুর্বল শরীর। মুখে রুচি নেই। সকালে রান্না
সেরে শিউলিকে দুটো ভাত খাইয়ে নিজে দুটো
ভাত মুখে গুঁজে সাড়ে বারোটা নাগাদ বেড়িয়েছিল মিতুন। এই ফিরল। শিউলিকে উঠিয়ে পিঠের
দিকে দুটো নেতানো বালিশে ঠেস দিয়ে বসিয়ে দিল। বাটিতে অল্প মুড়ি আর চা সামনে দিয়ে
বলল,
-“নাও
একটু মুড়ি দিয়ে চা খাও দেখি। ডাক্তার বলেছে অল্প করে বারেবারে খেতে।”
মাস তিনেক হল শিউলির
শরীরটা ভাল যাচ্ছে না। ঘুষঘুষে জ্বর লেগেই
থাকে। কাজে যেতে পারে না। একটা নার্সিংহোমে পার্ট টাইম আয়ার কাজ করে। তাদের কি আর আজ এই ডাক্তার কাল সেই ডাক্তার, আজ এই টেস্ট কাল ওই টেস্ট করানোর মত বিলাসিতা সাজে? তবুও নার্সিং হোম অনেক সাহায্য করেছে। বিনে পয়সায় টেস্টগুলো
করতে পেরেছে শিউলি। কিন্তু বাকি যেগুলো
টেস্ট করতে দিয়েছে সেগুলো তো এই নার্সিংহোমে হবে না। আর টাকাও লাগবে প্রচুর।
কোনমতে পেট চলে যাদের তাদের কাছে টেস্ট করাবার অতিরিক্ত টাকা কোথায়? পাশের বাড়ির মিনু বৌদির কথামত আজ এক জায়গায় টাকার জন্য
গিয়েছিল মিতুন।
বিছানায় উঠে শাশুড়ির
মাথার দিকের জানলাটা বন্ধ করে দিল। সন্ধ্যের পর থেকে একটু একটু হিম ঢোকে ঘরে।
দুপুরে রোদ আসছিল বিছানায়, তাই
জানলাটা খুলে বেড়িয়েছিল। জানলার ওপারে মিনু বৌদিদের সুদৃশ্য পাকা বাড়ি দেখা
যায়। দুবছর হল পুরনো বাড়িটা ভেঙ্গে এই
বাড়িটা করেছে। তা নিয়ে পাড়ার লোক হিংসে করে আজেবাজে কথা বলে। শাশুড়ি বিছানায় পড়ার
পর থেকে এই মিনু বৌদি অনেক করছে। টুকটাক
হাটবাজার থেকে শুরু করে রিপোর্ট নিয়ে ডাক্তারকে দেখানো, পাশে থেকে সর্বক্ষণ সাহস যোগানো, প্রতিনিয়ত খোঁজ নেওয়া ইত্যাদি। নইলে মিতুন চোখে অন্ধকার দেখত। কতই বা বয়স
মিতুনের? যে বয়সের পর মেয়েদের বিবাহ
যোগ্যা বলে সরকারী স্বীকৃতি দেওয়া হয়ে থাকে, সেই বয়সেই সে স্বামীহারা। মাত্র ষোল
বছরেই সুমনের হাত ধরে একটু আলো, একটু
ভালবাসার আশায় ঘর ছেড়েছিল। এত অল্প বয়সে ঘর ছাড়ার কারণ অবশ্য আছে। এ বয়সে এসে সে
অকস্মাৎ জানতে পারে, এতদিন
যাদের মা,বাবা বলে জেনে এসেছে, তাঁরা নাকি তার আসল মা-বাবা নয়। এ বাড়ির কেউ তার আপন নয়।
এখনো মনে পড়ে ঠাকুমার সেই কথাগুলো,
-“আমার
বটাইয়ের নামে মিছা বদনাম দেয় ওই মেয়ে। ওই মেয়েই নষ্টা। না জানি কোন মা-বাপের রক্ত বইছে শরীরে”।
বটাই সম্পর্কে মিতুনের কাকা।
একটু বড় হতেই, আদরের অছিলায় গায়ে হাত দিত।
প্রথম প্রথম কিছু বুঝত না। পরে একদিন আদরটা অন্যরকম বুঝে চেঁচিয়ে উঠেছিল। আর তখনই
ঠাকুমা একথাটা বলেছিল। সেদিনই মিতুন জেনেছিল, তাকে নাকি ওদের গ্রামের এক গাছতলায় ন্যাকড়া প্যাঁচানো অবস্থায় পেয়ে ওর পালিত
মা বাড়িতে এনে মানুষ করেছিল। যদিও সেই পালিত মাও বেশীদিন পৃথিবীতে থাকেনি। এসব কথা
জানার পর থেকে ওই বাড়িতে নিজেকে অবাঞ্ছিত মনে হত। দম বন্ধ হয়ে আসত। তখনই পড়ার
ব্যাচে সুমনের সঙ্গে আলাপ, প্রেম।
তারপর একদিন ওবাড়ির সম্পর্ক চুকিয়ে মন্দিরে বিয়ে করে সোজা এবাড়িতে।
তবে শিউলি প্রথমে মিতুনকে
মেনে নেয়নি। বলেছিল, যে
মেয়ের মা-বাবার ঠিক নেই, তাকে
আমি কিছুতেই একমাত্র ছেলের বউ করে ঘরে তুলব না।
শেষে পাড়ার লোকের অনেক অনুরোধে বরণ করে ঘরে তুলেছিল। কিন্তু ওই প্রথম দিনই।
তারপর থেকে একদিনের জন্যও অবহেলা করেনি মিতুনকে। নিজের মেয়ের মত
ভালবেসে বুকে টেনে নিয়েছিল। মিতুনও এই মাকে পেয়ে সব ভুলেছিল।
-“চায়ে
আদা দিয়েছিস বেটি? ভালো
গন্ধ বেরিয়েছে”।
উঠোন থেকে তুলে আনা কাপড়জামাগুলো আলনায় ভাঁজ করতে করতে আনমনা হয়ে গিয়েছিল
মিতুন। শাশুড়ির ডাকে সম্বিৎ ফিরল।
-“হ্যাঁ দিইছি তো একটু। খাও, মুখে স্বাদ পাবা”
-“যে
কামে গেছিলি, সেইটা হল বেটি”?
-“হু হল
কিছুটা”।
নিজের কাজে মন দিল মিতুন। মিনু
বৌদি বলেছে, চিন্তা নেই। টাকার ব্যবস্থা হয়ে যাবে। আই,সি,ডি,এস না কি যেন কাজ করে সেই সুবাদে বড় বড় লোকের সাথে নাকি
চেনাজানা আছে তার। আজ তেমন এক জনের কাছেই নিয়ে গিয়েছিল মিতুনকে। দুপুর থেকেই
শরীরটা ভাল লাগছে না। হঠাৎ গাটা গুলিয়ে উঠল। দৌড়ে কলতলায় গেল মিতুন। চোখেমুখে ঘাড়ে
ভালো করে জল দিল খানিকটা।
-“তুই
কিছু মুখে দিলি বেটি? সেই
কোন দুপুরে দুটা মুখে গুঁজে বেরাইছিস। মুখটা যে শুকায় গেছে তোর”।
-“খাবো
পরে, এখন খিদা নাই। তুমি খাও।”
-‘খিদা
নাই? তা বললে হবে? আমার অসুখ হবার পর থেকে তোর খাটনি বেড়েছে। ঠিকমত খাস কিনা
উঠে দেখতেও পারিনা। দুজনে একসাথে বিছানায় পড়লে চলবে? কে দেখবে আমাদের?”
ঠিকই বলেছে, বিপদে পড়লে কেউ কাউকে দেখে না। কারো অত সময় নেই। সবাই তো আর
মিনু বৌদি নয়। তাছাড়া ভগবানই যাকে পৃথিবীতে পাঠিয়ে আর খোঁজ নেয়নি, দুর্ভাগ্যকেই জীবনসঙ্গী করে দিয়েছে, তাঁকে অন্য কেউ এসে দেখবে, এ আশা
করাও হাস্যকর! মিতুন এখন কিছুতেই বিছানায় পড়তে চায়ও না। ওর অনেক কাজ করতে হবে, অনেক লড়াই লড়তে হবে নিজের ভাগ্যের সঙ্গে। ডাক্তার বলেছে, বাড়াবাড়ি খুব একটা হয় নি। কয়েকটা কেমো না কি যেন দিলে ভাল
হয়ে যাবে শাশুড়ি। ওই কেমোর জন্য অনেক টাকা লাগে।
কদিন ধরেই সুমনের কথা খুব মনে
পড়ছে। সংসারে অভাব থাকলেও ভালোবাসায় কোন অভাব ছিল না। সেই সুমন একদিন গ্রামের
নিতাইদাদার সঙ্গে মুম্বাই চলে গেল। নিতাইদাদা নাকি বলেছে মুম্বাইতে অনেক কাজ, অনেক টাকা। সেই যে গেল আর এল না। কিছুদিন টাকা পাঠিয়েছিল।
তারপর সব বন্ধ। খোঁজ নেই, খবর
নেই। নিতাইদাদাকেও আর দেখা যায় না গ্রামে। যাদের ছেলেরা মুম্বাই গেছিল নিতাইয়ের
সাথে তাঁরা পুলিশে অভিযোগ করেছে। কিন্তু ওই পর্যন্তই।
-“কিছু
মুখে দে বেটি। আমি ভাল হয়ে যাব। আমাকে নিয়ে ভেবে ভেবে তোর শরীরটাও ভেঙ্গে গেছে।
চোখে কালি পড়েছে”।
-“হ্যাঁ, এই তো এখন খাবো। তুমি অত ভেবো না”।
দুম করে লাইন চলে গেল। কিছুই
দেখা যায় না। চোখটা একটু সয়ে নিয়ে মোমবাতি জালাতে রান্নাঘরে গেল মিতুন। অন্ধকারটাই
বড় ভাল লাগছে আজ। দুপুরের কথা মনে পড়ে গেল। লোকটা ঘরের সব কয়টা আলো জ্বেলে
দিয়েছিল। শাশুড়ি মিতুনের শরীরের শীর্ণতা নিয়ে উদ্বিগ্ন হলেও মিতুন আজ প্রশংসাই
শুনেছে এই শরীরের। “তুমার ফিগার বহুত আচ্ছা
আছে। হামে খুবসুরত ফিগার দেখনা আচ্ছা লাগে”। কথাগুলো মনে পড়তেই
কানটা ঝাঁঝাঁ করে উঠল। সত্যি মানুষ কত রকমের হয়!
দাদুর বয়সী, অথচ কি বিকৃত রুচি! মিনু বৌদি
বলেছে,
-“আপত্তি
করার কি আছে শুনি? উনি তো
পর্শ করেও দেখেন না! শুধু গায়ে একটাও সুতা রাখা চলবে নি এইটাই শর্ত। এত অল্প সময়ে
এত টাকা আর কোথায় পাবি? আমাদের
মত গরীব মানুষের অত সতীপনা করা সাজে না বুঝলি!”
সে তো সাজেই না। শাশুড়ির কিছু
একটা হয়ে গেলে শেয়াল কুকুরেরা যে এবাড়িতে লাইন দেবে সেটা বেশ বোঝে মিতুন। মোমবাতি
জ্বেলে ঘরে আনল। ধীরেধীরে শাশুড়ির বিছানায় এসে বসল।
-“মনটা
ভালা নাই তোর বুঝি রে। কিন্তু তোকে যে শক্ত হতেই হবে বেটি। আমার একটা মন্দ কিছু হয়ে গেলে- মালিককে বলে
আমার কাজটা- ”
-“কিছু
হবে না তোমার। তুমি তাড়াতাড়ি ভাল হয়ে উঠবাই।” বলে মিতুন শাশুড়ির বুকের কাছে মাথাটা নামিয়ে আনল। শীর্ণ হাতটা মিতুনের মাথায়
রাখল শিউলি। চোখের কোণ বেয়ে দু ফোঁটা নোনতা জল গড়িয়ে পড়ল মিতুনের।
যে মানুষটা নিজের সন্তানের মত স্নেহ দিয়েছে, নিজে অর্ধেক খেয়ে মিতুনকে খাইয়েছে, ভালোমন্দ যখন যা পেয়েছে মিতুনের হাতে তুলে দিয়েছে, সেই মানুষটাকে কিছুতেই তিলে তিলে শেষ হতে দেবে না মিতুন। যে কোন মূল্যে
বাঁচাতেই হবে তাঁকে!
মৌসুমী ঘোষ দাস
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন