নজরুল ও রবীন্দ্রনাথ
পারমিতা চক্রবর্ত্তী
বৈশাখ মাস মানে ঈশ্বরীয় মাস৷ এই মাসেই রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের মত উজ্জ্বল
নক্ষত্রদের সমাবেশ ঘটে৷ কবিপক্ষে নজরুল ও রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে লেখার লোভ সামলাতে
পারলাম না।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যখন ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দে ‘নোবেল পুরস্কার’ পান
তখন কাজী নজরুল ইসলামের বয়স মাত্র ১৪ বছর। বাংলা সাহিত্যের এই দুই মহান কবির মধ্যে
যে গভীর সুসম্পর্ক ছিল তা আমাদের অনেকেরই জানা।
জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি বাংলা সাহিত্য ও শিল্প সংস্কৃতির ক্ষেত্রে একটি উল্লেখযোগ্য স্থানের অধিকারী ছিল সে সময়৷ ঠাকুরবাড়িকে কেন্দ্র করেই শিক্ষিত সমাজে জোয়ার এসেছিল উনবিংশ শতাব্দীতে৷ বিংশ শতাব্দীর প্রথমদিকে বাংলাদেশে শিক্ষিত সমাজের মনে যে জাতীয়তাবোধ ও স্বদেশীকতা হিুল্লোল উঠেছিল তার মূলেও ঠাকুর পরিবারের দান কম ছিল না৷ বাংলা তথা ভারতবর্ষের শিল্প, সংগীত ও সাহিত্যের নবজাগরণে ঠাকুর পরিবারভুক্ত একাধিক লোকায়ত্ত প্রতিভার ঋণ অপরিশোধনীয়।নজরুলের সাথে ঠাকুর পরিবারের নিবিড় সৌহার্দের যোগাযোগ স্থাপিত হয়েছিল৷ সাবিত্রীপ্রসন্ন চট্টোপাধ্যায় এ সম্পর্কে একজায় গায় লিখেছিলেন, "জোঁড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যাবার সময় যেমন - তেমন বড়লোককে সমীহ করে যেতে দেখেছি৷ অতি বাকপটুকেও ঢোঁক গিলে কথা বলতে শুনেছি -- কিন্তু নজরুলের প্রথম ঠাকুরবাড়িতে আবির্ভাব সে যেন ঝড়ের মত৷ অনেকে বলত, তোর এসব দাপাদাপি চলবে না। জোড়াসাঁকোর বাড়িতে, সাহসই হবে না তোর এমনিভাবে কথা কইতে৷ নজরুল প্রমাণ করে দিল যে সে তা পারে৷ তাই একদিন সকালবেলা - 'দে গরুর গা ধুইয়ে' এই রব তুলতে তুলতে কবির ঘরে গিয়ে উঠল৷- কিন্তু তাকে জানতেন বলে কবি বিন্দুমাত্র অসন্তুষ্ট হলেন না৷ শুনেছি অনেক কথাবার্তার পর কবি নাকি বলেছিলেন, "তুমি নাকি তরোয়াল দিয়ে আজকাল দাড়ি কামাচ্ছ -- ক্ষুরই ও কার্যের জন্য প্রশস্ত ৷
( তথ্যসূত্র - সাবিত্রীপ্রসন্ন চট্টোপাধ্যায় : আমাদের নজরুল,
কবিতা,, কার্তিক
- পৌষ, ১৩৫১ :
পৃ ৩৮)
নজরুলের উদার কন্ঠ, কবিতার
মাধুর্যকে বেশী পছন্দ করতেন রবীন্দ্রনাথ ৷ কিন্তু এত উজ্জ্বল নক্ষত্রদের মধ্যে
রবীন্দ্রনাথ নজরুলকে বেছে নিয়েছিলেন৷ তিনি বিশ্বাস করতেন এই মানুষটির দ্বারা অনেক
কিছু কার্য সম্ভব৷ নজরুল অবলীলায় 'গুরু' শব্দটিকে 'গরু তে
রূপান্তর করেছিলেন৷ গরু হিন্দু ধর্মের পবিত্র জীব৷ সেই পবিত্র স্থানে উপনীত
করেছিলেন নজরুল রবীন্দ্রনাথকে। এমন বাক্য অনেক বিদ্বজন
বিরূপ মন্তব্য করলেও এই উক্তি তাৎপর্যপূর্ণ৷' গরুর পা ধুইয়ে দে' গুরু পথ দেখান ভগবানের সংস্পর্শ পাবার৷ নজরুলের জীবনে সেই গুরুর স্থানে ছিলেন
কবি রবীন্দ্রনাথ৷ তাঁর প্রতি নজরুলের ছিল অপার ভালোবাসা, নির্ভরতা, শ্রদ্ধা
এবং সমর্পণl ঠাকুরবাড়িতে
আসা যাওয়ার ফলে সেই বাড়ির লোকজনের কাছের মানুষ হয়েছিলেন তিনি৷ অবনীন্দ্রনাথ
ঠাকুর নজরুলের 'অগ্নিবীণা' প্রচ্ছদপটের পরিকল্পনা করে দিয়ে তাঁকে উৎসাহিত করেছিলেন
এবং সেই সঙ্গে কবির প্রতি তাঁর আন্তরিকতা প্রমাণ দিয়েছিলেন।
রবীন্দ্রনাথ যেমন অনুজ নজরুলের প্রতি আশীর্বাণী প্রদান করে প্রীত হয়েছেন, তেমনি নজরুলও অগ্রজের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করতে কুণ্ঠিত
হননি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর রচিত ‘বসন্ত’ গীতিনাট্যটি কাজী নজরুলকে
উৎসর্গ করেছিলেন। সেটি ছিল রবীন্দ্র পরিবারের বাইরে প্রথম কাউকে একটি বই উৎসর্গ
করার ঘটনা। নজরুলকে উৎসর্গীকৃত "বসন্ত" গীতিনাট্যটি কবিগুরুর কথায়
পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায় আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে বন্দী নজরুলের কাছে নিয়ে যান। এই সূত্রে পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়কে লিখেছেন _
"নজরুল তখন আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে কারারুদ্ধ৷ আমি প্রতি সপ্তাহেই
তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করি৷ আমার সঙ্গে নজরুল নিয়মিত যোগাযোগের খবর নিশ্চয়ই
রবীন্দ্রনাথের কাছে পৌছেছিল, নইলে মধু রায়ের গলির মেসে স্নেহভাজন বুলা মহালানবীশকে পাঠিয়ে আমাকে জোড়াসাঁকোয়
ডাকিয়ে নিতেন না গুরুদেব।
- বললেন, 'জাতির জীবনে বসন্ত এনেছে নজরুল। তাই আমার সদ্য প্রকাশিত 'বসন্ত' গীতিনাট্যখানি
ওকেই উৎসর্গ করেছি৷ সেখানে নিজের হাতে তাকে দিতে পারলে আমি খুশি হতাম, কিন্তু আমি যখন নিজে গিয়ে
দিয়ে আসতে পারিছি না, আমার
হয়েই তুমি বইখানা দিত্ত ৷ ...
নজরুলকে আমি "বসন্ত"গীতিনাট্য উৎসর্গ করেছি এবং উৎসর্গ পত্রে তাকে 'কবি' বলে
অভিহিত করেছি৷ জানি তোমাদের মধ্যে কেউ কেউ এটা অনুমোদন করতে পারনি৷ আমার বিশ্বাস
তারা নজরুলের কবিতা না পড়েই এই মনোভাব পোষণ করেছে৷ আর পড়ে থাকলেও তার মধ্যে রূপ
ও রসের সন্ধান করেনি, অবজ্ঞা ভরে চোখ বুলিয়েছে মাত্র৷.... কাব্যে অসির ঝনঝনা থাকতে পারে না, এও তোমাদের আবদার বটে৷ সমগ্র
জাতির অন্তর যখন সে সুরে বাঁধা, অসির ঝন্ঝঝনায় যখন সেখানে ঝংকার তোলে, ঐকতান সৃষ্টি হয়, তখন কাব্যে তাকে প্রকাশ করবে বৈকি৷ আমি যদি আজ তরুণ হতাম
তাহলে আমার কলমে ওই সুর বাজত৷...
কে যেন দুকপি "বসন্ত" এনে দিল কবির হাতে৷ তিনি একখানায় নিজের নাম
দস্তখত করে আমার হাতে তুলে দিয়ে বললেন, "তাকে বলো,আমি
নিজের হাতে তাকে দিতে পারলাম না বলে সে যেন দুঃখ না করে৷ আমি তাকে সমগ্র অন্তর
দিয়ে অকুণ্ঠ আশীর্বাদ জানাচ্ছি। আর বলো, কবিতা লেখা যেন কোন কারণেই সে
বন্ধ না করে। সৈনিক অনেক মিলবে, কিন্তু যুদ্ধে প্রেরণা যোগাবার কবিও তো চাই |"
(সূত্র পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায় : কবি স্বীকৃতি (নজরুল একাডেমি
পত্রিকা, শীতসংখ্যা
১৯৭৬)
রবীন্দ্র - নজরুল সম্পর্ক নিয়ে বহু আলোচনা প্রচলিত থাকলেও রবীন্দ্র-নজরুল
সম্পর্ক বরাবর ছিল ভালো। রবীন্দ্রনাথ নজরুলকে যে কী স্নেহ করতেন তার আরেকটি
উদাহরণ- রবীন্দ্রনাথ রচিত ‘গোরা’ উপন্যাস অবলম্বনে তৈরি ছায়াছবিতে নজরুল ছিলেন সঙ্গীত
পরিচালক। বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষ এতে বাধ সাধলেও রবীন্দ্রনাথ তা প্রত্যাখ্যান করেন
এবং নজরুলকে সঙ্গীত পরিচালনার স্বীকৃতি প্রদান করেন।
কবি নজরুল ইসলাম সৈনিক হিসাবে চাকুরি করে ২১ বছর বয়সে কলকাতায় ফিরে আসেন
১৯২০-এর মার্চ মাসে। কলকাতার ৩২, কলেজ
স্ট্রিটে ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতি’র অফিসে ওঠেন নজরুল। তখন তাঁর বাক্স-পেটরার মধ্যে ছিল
কবিতার খাতা, গল্পের খাতা, পুঁথি-পুস্তক, মাসিক পত্রিকা এবং রবীন্দ্রনাথের গানের স্বরলিপি। কমরেড মোজাফ্ফর আহমেদ তাঁর
স্মৃতি কথায় লিখেছেন, ‘নজরুল
ইসলাম বহু রবীন্দ্র সঙ্গীত গাইতেন। তিনি কি করে যে রবীন্দ্র সঙ্গীতগুলো মুখস্ত
করেছিলেন তা ভেবে অবাক হই।’
নজরুল ইসলাম ৩২, কলেজ
স্ট্রিটের যে বড়িটিতে দীর্ঘদিন ছিলেন, সেটি এখন শ্রীশ্রী ঠাকুর অনুকূল চন্দ্রের ট্রাস্টভূক্ত সম্পত্তি। বাড়িটি এখন
ব্যবহৃত হয় ঠাকুরের ভক্তদের পান্থশালা হিসেবে। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে নজরুলের সরাসরি
দেখা হয়েছিল ১৯২১ খ্রিস্টাব্দের অক্টোবর মাসে শান্তিনিকেতনে। তখন নজরুলের বয়স মাত্র ২২ বছর। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ তাঁকে
শান্তিনিকেতনে নিয়ে গিয়েছিলেন। বোলপুর স্টেশনে কাজী নজরুল ইসলাম এবং ড.
শহীদুল্লাহকে অভ্যর্থনা জানান রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একান্ত সচিব কবি সুধাকান্ত রায়
চৌধুরী। নজরুল সেদিন রবীন্দ্রনাথের কাছে একটি কবিতার আবৃত্তি শুনতে চেয়েছিলেন।
কবিগুরু বললেন, ‘সে কি? আমি যে তোমার গান ও আবৃত্তি শোনবার জন্যে প্রতীক্ষা করে আছি, তাড়াতাড়ি শুরু করে দাও।’
নজরুল আবৃত্তি করেছিলেন, অগ্নি-বীণা’র ‘আগমনী’ কবিতাটি। এছাড়াও তিনি কয়েকটি রবীন্দ্রসঙ্গীত গেয়ে শোনান।
নজরুলের অনুরোধে সেদিন রবীন্দ্রনাথ আবৃত্তি করে শোনান, ‘মাধবী হঠাৎ কোথা হতে, এল
ফাগুন দিনের স্রোতে, এসে
হেসেই বলে যাই যাই।’...এরপর
বেশ কয়েকবার রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে নজরুলের সাক্ষাৎ হয়।
১৯২২-এর ২৫ জুন কলকাতার রামমোহন লাইব্রেরিতে রবীন্দ্রনাথের সভাপতিত্বে কবি
সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত স্মরণে শোকসভা অনুষ্ঠিত হয়। রবীন্দ্রনাথ ঐ স্মরণসভায় নজরুলকে
ডেকে পাশে বসিয়েছিলেন। নজরুল আবৃত্তি করেছিলেন ‘সত্যকবি’ কবিতাটি। রবীন্দ্রনাথ এভাবে
নজরুলকে স্নেহ বন্ধনে আবদ্ধ করায় তখনও কবি-সাহিত্যিকরা ঈর্ষান্বিত হয়েছিলেন।
রবীন্দ্র-নজরুল সম্পর্ক পরে নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়েছে
কিন্তু দুই কবির শ্রদ্ধা ও স্নেহের মৌলিক সম্পর্ক কখনও বিচলিত হয়নি।
নজরুলের ‘ধূমকেতু’ প্রকাশিত হয় ১৯২২-এর ১১ আগস্ট (১৩২৯ বঙ্গাব্দের ২৪ শ্রাবণ)।
রবীন্দ্রনাথ এই পত্রিকার আশীর্বাণী লিখে দেন। রবীন্দ্রনাথের হস্তলিপিতে প্রথম ৬টি
সংখ্যায় প্রথম পৃষ্ঠায় ৭ম সংখ্যা থেকে ৩য় পৃষ্ঠায় সম্পাদকীয় স্তম্ভের উপর তা ছাপা
হয়।
"আয় চলে আয়, রে, ধূমকেতু,
আধারে
বাঁধ অগ্নিসেতু,
দুর্দিনের
এই দুর্গশিরে
উড়িয়ে
দে তোর বিজয় কেতন।
অলক্ষণের
তিলক রেখা
রাতের
ভালে হোক না লেখা,
জাগিয়ে
দেরে চমক মেরে’
আছে
যারা অর্ধচেতন"
যাবে I
পারমিতা
চক্রবর্ত্তী
বাঃ খুব ভালো লাগল
উত্তরমুছুন