বিন্যাস
আইভি চট্টোপাধ্যায়
সকাল সকাল ফোন । তপন বন্দ্যোপাধ্যায় । ‘কোন
কমিটিতে নিল তোমায়?’
গুপ্তাসাহেব তখন রীতিমতো ব্যস্ত । গুপ্তা এন্টারপ্রাইজের মালিক বিনোদ গুপ্তা ।
রোজকার মতো আজও বিজনেস স্যুট পরে ফেলেছিলেন ।
লীলাবতী মনে করিয়ে দিয়েছেন, বিকেলে বস্তি উন্নয়ন কমিটির
মিটিং আছে । বলেছিলেন, একপ্রস্থ ধুতি-পাঞ্জাবী গাড়িতে রেখে দেবেন ।
অফিস থেকে বেরোবার আগে বদলে নিলেই হবে । সাতপাঁচ ভেবে গুপ্তাসাহেব আইডিয়াটা বাদ
দিয়েছেন ।
এমনিতে লীলাবতীর মতই গুপ্তাসাহেবও ‘পহলে দর্শনধারী, পিছে গুণ বিচারি’ আপ্তবাক্যে মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন । খাদির
পাঞ্জাবী,
কাঁথাকাজের পাঞ্জাবী, সাদা
ধুতি-পাঞ্জাবী.. খদ্দরের হাফ-পাঞ্জাবীর সঙ্গে খাটো ধুতির সেট.. বিশেষ পরবের জন্যে
শেরওয়ানী-চুড়িদার আর চৌকো টুপি । শুঁড়তোলা নাগড়াই জুতো, কানপুরী
চটি,
নীল-সাদা হাওয়াই চপ্পল.. সবই কালেকশনে আছে । যখন যেটা লাগে
।
কিন্তু আজ সকাল থেকে অফিসে তিনটে মিটিং । লাঞ্চের পর চেম্বার অফ কমার্সের
মিটিং । বিকেলে শকুন্তলা ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে মিসেস দত্ত আসবেন । পশুপ্রেমী
মিসেস দত্ত রাস্তা থেকে তুলে আনা সারমেয়কুলের জন্যে নিউ আলিপুর এলাকায় একটা বাড়ি
নিয়েছেন । বাড়ির পাশেই বিনোদ গুপ্তার শেয়ার অফিস । সেই জায়গাটা চাইছেন মিসেস দত্ত
।
শকুন্তলা ফাউন্ডেশনের জন্যে বেশ কিছুদিন ধরে ডোনেশন দিলেও গুপ্তাসাহেব
অফিসঘরটা ছাড়তে নারাজ । তবে আপাতত একটা বিনিময় মূল্যের হিসেব মাথায় এসেছে । মিসেস
দত্ত সাত-আটটা কমিটিতে আছেন । সিএম-এর খুবই কাছের লোক । এই সুযোগটা যদি নেওয়া যায়
। অফিসঘরটার জন্যেই মিসেস দত্ত এত কাছাকাছি এসেছেন । নইলে এইসব নক্ষত্রদের নাগাল
পাওয়া প্রায় অসম্ভব ব্যাপার ।
কমিটির কথাটা আলগোছে পেড়েও ফেলেছেন বিনোদ গুপ্তা । তারপরই এই বিকেলে ওঁর সঙ্গে
বস্তি উন্নয়ন কমিটির মিটিং-এ যাওয়া ঠিক হয়েছে ।
‘আপনি আমার সঙ্গে চলুন বিনোদভাই, সবাই খুব খুশি হবে ।‘
কেউ খুশি হোক বা না হোক, গুপ্তাসাহেব যাবেন । একটা
কমিটির মাথা হয়ে না বসলে আজকাল কেউ পাত্তা দেয় না । কমিটির লোক, সমাজের এক নতুন ক্লাস । এই বিশেষ শ্রেণীর সম্মান না পেলে চলে?
এত তাড়াহুড়োর মধ্যে ড্রেস চেঞ্জ করার সময় হবে না । ভাবনাচিন্তা করে সাদা
সাফারি স্যুট পরে নেওয়া ঠিক করলেন । অফিস বলো অফিস, মিটিং
বলো মিটিং। সব জায়গায় চলবে ।
এই ব্যস্ততার সময়ই ফোনটা এল । ‘কোন কমিটিতে নিল?’
শুনেই ভেতরটা চিড়বিড়িয়ে উঠল । কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে । কিন্তু ব্যাটা বহুত সেয়ানা
। বেফাঁস কিছু বলে ফেললে মুশকিল । গলার স্বরটা মাখনের মতো মোলায়েম করে ফেললেন, ‘নমস্কার তপনবাবু । সকাল সকাল আপনার ফোন পেলাম । লাগছে যে দিনটা ভালো কাটবে ।‘
‘আরে কি যে বলো । তোমার সঙ্গে কথা হওয়া মানে আমারই সৌভাগ্য । যাকগে যা বলছিলাম
। খবর পেয়েছ?
নতুন পাঁচটা কমিটির কোন কমিটিতে নিল তোমায়? সবগুলো কমিটির জন্যেই তোমার নাম ঢুকিয়ে দিয়েছিলাম ।’
ভাবখানা দ্যাখো ! ভাজা মাছখানা উল্টে খাওয়া দূরে থাক, সোজা
করেও খেতে জানে না । কোন কমিটিতে কাকে নিল, সে তো
তোমারই জানার কথা ।
‘আমি এখনো কোনো খবর পাই না’, অসন্তোষটা গলার স্বরে ফুটে
বেরোতে চাইল,
‘আমি আপনাকে বলেছিলাম কমিটির চেয়ারম্যান হবার কথা । তিনমাসে
আটচল্লিশটা কমিটি বনল । সবাই অন্তত তিনটে কমিটির মেম্বার । আমি তো তা চাই নি ।
জাস্ট একটা কমিটি । সেই কমিটির চেয়ারম্যানশিপ । ব্যস ।‘
‘আরে বাবা,
বনল বললেই হবে? এই নতুন কমিটি বানাবার
জন্যে কত খাটাখাটুনি হল, সেটার কথা বুঝবে না? আমি তো চেষ্টা চালিয়েই যাচ্ছি । গতমাসে বস্ত্রবিপণী রক্ষা কমিটির চেয়ারম্যান
হিসেবে তোমার নাম উঠেই গেছিল । শেষ মূহুর্তে বিলাসবাবুকে নিতে হল । সবই তো জানো ।
ওদের পার্টিকে এসব কিছু জায়গায় না নিলে চলবে না ।‘
চেষ্টা করেও উষ্মাটা ঢাকা হল না আর, ‘সে কি আর জানি না? বছরের পর বছর বাসুবাবু একটা অমন ইম্পর্ট্যান্ট কমিটির মাথা হয়ে আছেন । যে
পার্টিই পাওয়ারে আসুক, ওনার জায়গা বদল হয় না । এত করে বললাম, এই সময় রেলওয়েতে ঢুকিয়ে দিন । এত কমিটি হল..যাত্রী সুরক্ষা, যাত্রী স্বাচ্ছন্দ, যাত্রী পরিষেবা.. একটাতেও আমাকে
নিলেন না ।‘
মুখে চলে আসছিল, মাসের পর মাস টাকা দিয়ে কি লাভ হল! শেষ
মূহুর্তে কথাটা গিলে নিলেন ।
না-বলা কথাটা বুঝেও নিলেন ও পক্ষ, মোলায়েম গলাটা ভেসে এল, ‘এত ভাবছ কেন? আমি তো আছি । তোমার অবদান ভুলে যাবেন, উনি তেমন মানুষ নন । ক’দিন আগেও আমি মনে করিয়ে দিয়েছি, বড় আন্দোলনের সময় দিনের পর দিন ক্যাডারদের খিচুড়ি খাওয়ানোর কাজটা তোমার জন্যেই
সম্ভব হয়েছিল ।‘
‘তা ঠিক । উনি কাউকে ভোলেন না । সেটাই ভরসা । কিন্তু সত্যি সত্যি উনি আমার কথা
জানছেন কিনা,
সেটাই ভাবি । এখন তো এত লোকের ভিড় ওনাকে ঘিরে সব সময়.. একটা
পার্সোনাল মিটিং-ও ব্যবস্থা করে দিলেন না আপনি ।‘
‘আরে না না । তুমি ভেবো না । যে কোনো ইম্পর্ট্যান্ট সময়ে সেইজন্যেই তো তোমায়
মনে করি আমি । এখন যেমন । তুমি এবারের নর্থবেঙ্গল ট্যুরটা অ্যারেঞ্জ করে দাও ।
গতবারের দিল্লী ট্যুরে তোমার অ্যারেঞ্জমেণ্টে সবাই খুশি । এই সুযোগটা নাও । এই
সুযোগে তোমার সঙ্গে পার্সোনালি দেখা হয়ে যাবে ওঁর ।‘
শ-কারান্ত গালাগালিটা মুখে চলে এল । আবার টাকা! খেয়ে খেয়ে আশ মিটছে না ।
গলাটা ঝেড়ে নিলেন বিনোদ গুপ্তা, ‘আমার একটা ভালো কমিটি চাই ।
রেলওয়ে,
কিংবা ল্যান্ড নিয়ে কোনো কমিটি । শিল্পায়ন নিয়ে কোর কমিটিতে
আমাকে রাখলেন না আপনারা । অথচ মোহনকে রাখলেন । প্রেমজিকে রাখলেন । ওদের চেয়ে আমার
অবদান কম কিসে?’
বলতে বলতে গলাটা ধরে এল । বস্ত্রবিপণী রক্ষা কমিটি! তপনবাবু এই কমিটিতে নাম
তুলবেন বলে আশ্বাস দিচ্ছেন । মিসেস দত্ত আশ্বাস দিচ্ছেন বস্তি-উন্নয়ন কমিটির জন্যে
। একটা ভাল কমিটির জন্যে কেউ তাঁর নাম মনে আনে না! বাজারে বিনোদ গুপ্তার একটা ইমেজ
নেই!
চোয়াল শক্ত হল । যা করার নিজেই করবেন এবার ।
‘কি হল?
চুপ কেন? এত ভেবো না । কোনো কমিটিই
অপ্রয়োজনীয় নয় । আমি দায়িত্ব নিয়ে বলছি । কাজ আছে । অনেক কাজ । ঢেলে সাজাতে হবে সব
।‘
এই একটা স্টাইল হয়েছে এখন । ‘দায়িত্ব নিয়ে বলছি ।‘ মন্ত্রী থেকে আমলা, টিভিতে আলোচনা করতে আসা বিজ্ঞজন
থেকে মতামত জানতে চাওয়া অজ্ঞ জনতা, অফিসার থেকে ক্লার্ক, সব্জীবাজারের দোকানী থেকে রিক্সাচালক.. সবাই একবার করে বলছে, ‘দায়িত্ব নিয়ে বলছি ।‘ তাহলে বাকি সব কথাগুলো, যা সারাদিন ধরে বলে তারা, সেগুলো কি দায়িত্ব নিয়ে বলা নয়!
নিছক বাগাড়ম্বড়!
***
প্রথমে সেইরকমই মনে হয়েছিল । কর্পোরেশনের উপদেষ্টা কমিটিতে সদস্য হলেন । পরে
অবশ্য জেনেছিলেন মোহনের তাগিদে সুপ্রীমো এই সদস্যপদ অ্যাপ্রুভ করেছিলেন । এই
তপনবাবুরা কিছুই করে নি ।
বেশ ভালো লেগেছিল । মোহনের কাজিনের শ্বশুরবাড়ির দিকের একটা ছেলেকে গুপ্তা
এন্টারপ্রাইজে ঢুকিয়ে ঋণশোধও করেছিলেন । শুধু হাতে বিনোদ গুপ্তা লোকের উপকার নেন
না । কমিটির মিটিং-এ যোগও দিতেন । হ্যাঁ, দু’ চারটে মিটিং হয়েছি বৈকি । কিন্তু কি থেকে কি হল, গাদাখানেক
লেখক-শিল্পী-গায়ক ঢুকে এল কমিটিতে । শেষ পর্যন্ত দেখা গেল, এই
একটা কমিটিতে পঁচাশিজন লোক । মাথাভারি কমিটি । এ বলে আমায় দ্যাখ, ও বলে আমায় ।
আর যেমন হয় । তিনজন বাঙালি এক হলেই দুটো দল ।
টাউনহলের সভায় ঠিক হয়েছিল, দু’মাসে
একবার মিটিং হবে । এতদিনে আর একবারও ডাকে নি তাঁকে । কখন যে কমিটি থেকে বাদ দিয়ে
দিল,
কে জানে ।
মোহন সান্ত্বনা দিয়েছিল, ‘ভালো ভালো কমিটিতে কাছের লোকেরা
তো থাকবেই । তবে ভাবনা কোরো না, এবার আমাদের আর পেছনে থাকতে হবে
না । ডীল তো সেইরকমই । ভুলে যাচ্ছ কেন?’
সেই বিশ্বাসেই এতদিন ধরে টাকা ঢেলেছেন বিনোদ গুপ্তাও । মনে হয়েছিল, এবার বদল একটা হবেই ।
মোহনের সেক্রেটারি এক বাঙালি ছোকরা.. কি যেন নাম.. বলেছিল, ‘বিজ্ঞাপন দিন, ওনার ফেভারিট চ্যানেল কোনগুলো সে তো জানেন ।
একটা রিয়ালিটি শো স্পনসর করুন । মাঝে মাঝে প্রেস কনফারেন্স করুন । চাইলে একবার
সিঙ্গাপুরে কনফারেন্স করিয়ে আনুন । পার্টি দিন, ছোকরা
রিপোর্টারগুলোকে মালটাল খাওয়ান, সিনেমার লোকগুলোকে পার্টিতে
আনুন,
নজরে এসে যাবেন ।‘
মোহন বলল,
‘নতুন কিছু বলতে হবে । নতুন একটা লেবেল চাই । বুঝলে?‘
প্রাইভেট পার্টি ছিল মোহনের বাড়িতে । ঘনশ্যামজি এসেছিলেন । বিশেষ প্রয়োজনে সব
সময়ই অ্যাডভাইস করেন । ঘনশ্যামজিও বলেছিলেন, ‘সবসময়
প্রেসের সামনে বিজনেস, ফিনান্স, হায়ার
ইকোনমিক্স,
ইন্ডাস্ট্রি বিষয়ে কথা বলার চান্স নিতে হবে । মাসে অন্তত
একবার টিভিতে মুখ দেখাতে হবে ।‘
দেবেনবাবু,
ইউনিভার্সিটিতে পড়ান, বাধা
দিয়ে বলেছিলেন,
‘মাসে একবার না, সপ্তাহে একবার । পাবলিক
মেমারি অতদিনের গ্যাপ ধরবে না । পাবলিক মেমারি গভীর গবেষণার বিষয় ।‘
নীলেশবাবু,
ভালো সিনেমা বানান, তিনিও
ছিলেন পার্টিতে । বলেছিলেন, ‘পাবলিক সাইকোলজি নিয়ে কাজ করি
মশাই । আমি বলছি শুনুন । দায়িত্ব নিয়ে বলছি । দেবেনদা ঠিক বলেছেন । মানুষের স্মৃতি
কোনো খবর বেশিদিন ধরে রাখে না । পাবলিকের মগজে বারবার হাতুড়ি মারতে হয় ।‘
‘দায়িত্ব নিয়ে বলছি‘ শুনে হাসি পাচ্ছিল, ‘হাতুড়ি’
শুনে গুপ্তাসাহেব জোরেই হেসে ফেলেছিলেন ।
তবু যে যা বলেছে, করেছেন । বেশ কিছুদিন ধরে লেগে আছেন বিনোদ
গুপ্তা । প্রাইম টাইমে বিজ্ঞাপন চলছে । সব কটা চ্যানেলে । কোনো রিস্ক নেওয়া নয় ।
প্রায়ই ‘পক্ষ বিপক্ষ’, ‘আপনার মত’, ‘জনতার
দরবার’
নানা অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকছেন । বাঙালীরা অবশ্য মাইক হাতে
পেলে ছাড়ে না,
তাই বেশ মজবুত করে নিজের কথা বলা হচ্ছে না । তবে কায়দা করে
নিজের কথাটা টিভি ক্যামেরার সামনে বলেও নিয়েছেন ।
বিনয়ী ভাব করে বলেছেন, এই বিনয় ব্যাপারটা বাঙালি ভালো
খায়,
‘এ রাজ্যে উন্নত মানের কমার্স-ইণ্ডাস্ট্রি গড়ে তুলতে চাইছি
আমি । আমার উদ্দেশ্য হল, সার্ভিস টু দা কমিউনিটি ।
এখানের লোকদের চাকরি, এখানের ছেলেদের নানা ট্রেনিং, উন্নতির সুযোগ করে দেওয়া আমার কর্তব্য ।‘
সুযোগ বুঝে আবেগের মোচড়ও দিয়েছেন, ‘কেন এ রাজ্যের ছেলেরা
দলে দলে বাইরে চাকরি করতে যায়? এখানে কমার্স-ইণ্ডাস্ট্রি থাকলে
কাউকে বাইরে যেতেই হবে না।‘
ছবি এগজিবিশন থেকে শুরু করে এঁচড়েপাকা ইউনিয়ন করা লোকগুলোর খিদমতে পয়সা
ঢেলেছেন,
চারটে গাড়ি ইলেকশনে খেটেছে । হাজার লোকের খিচুড়ি খাওয়ানোর
খরচ গেছে ।
তপনবাবুরা সদয় হয়েছেন । কাঁধে হাত রেখে বলেছেন, ‘ভেবো
না । সব খরচ উঠে আসবে ।‘
এখন ঘুরিয়ে নাক দেখালেই হবে! এবার রেজাল্ট চাই ।
***
অন্য মোবাইলটা বেজে উঠল । বিজয়প্রসাদ । ঘনশ্যামজির প্রাইভেট সেক্রেটারি । জরুরী
কল । বেঙ্গল পাইপের টেণ্ডার খুলবে আজ । প্রেমজির জামাই রাহুল সিংঘানিয়াও আছে ।
ঘনশ্যামজি অবশ্য বলেছেন, টেণ্ডার গুপ্তাসাহেবই পাবেন ।
তবু যতক্ষণ না হচ্ছে, টেনশন তো আছেই ।
‘আআচ্ছাআ । এখন রাখছি তপনবাবু । কল মিলেঙ্গে । হায়দারসাবের বাড়িতে দেখা তো
হচ্ছে ।‘
ফোন সুইচ অফ করে দিলেন । এখন ও ফোনে কেউ আর পাবে না তাঁকে । গাড়িতে উঠে পড়লেন
। এ গাড়িটা নতুন । ড্রাইভার অবশ্য পুরোনো । সাহেবের মেজাজ বুঝেছে । আজ আর গান
চালিয়ে দিল না ।
নইলে অফিস যাবার রাস্তাটায় আজকাল রোজ রবীন্দ্রসঙ্গীত শোনেন । সময়মতো
রবিঠাকুরের গানের লাইন লাগিয়ে দেওয়া এখন দারুণভাবে ‘ইন’ ।
অনেকক্ষণ ধরে একটা অস্বস্তি হচ্ছে । হঠাত্ ধরতে পারলেন । ওই তপন বন্দোপাধ্যায়
নামের চামচাটা তাঁকে সমানে ‘তুমি’ ‘তুমি’ করে কথা বলে গেল । শাগরেদি করে করে এখন সুপ্রীমোর ঢঙে কথা বলাও
অভ্যেস করে ফেলেছে !
বাঙালিদের এই দোষ । ওরা মনে করে, সারা দেশে ওদের মতো
বুদ্ধিমান আর কেউ নেই । ত্রিভুবনের শ্রেষ্ঠ জাতি । সুযোগ পেলেই নিজেদের উচ্চবর্ণ
প্রমাণ করতে লেগে পড়ে । বোঝেই না যে, এটা একধরণের কমপ্লেক্স ।
আরেক দোষ,
নিজেদের সম্মান নিয়ে যত সচেতন, অন্যের
আত্মসম্মান নিয়ে ততটাই অবজ্ঞা । সেকালের ব্রিটেন আর একালের আমেরিকার মতো । নিজেদের
স্বাধীনতা বিষয়ে তারা যেমন সচেতন, অন্যের স্বাধীনতা হরণেও তেমন
পোক্ত ।
নাহ,
দেরি হয়ে যাচ্ছে । লোকটাকে আর মাথায় চড়তে দেওয়া ঠিক হবে না
। এত তাচ্ছিল্য আর অবজ্ঞা সহ্য হয় না ।
***
অফিসে ঢুকে মন ভালো হয়ে গেল । দেবব্রতবাবুর লোক এসেছে । এ লোকটা ছবি-আঁকিয়ে ।
কি ছবি আঁকে কে জানে । প্রতিমাসে তোলা তুলতে আসে । মনে মনে জিভ কেটে নিলেন । মনের
ভাব মুখে না প্রকাশ পায় ।
‘কেমন আছেন দাদা? খবোর সোব ভালো তো?’
দাদা মৃদু হাসলেন । সুদৃশ্য পেয়ালায় দামী চা । অফিসের দেয়ালে বিমূর্ত রমণী, বাঙালি শিল্পীর আঁকা, ছবিতে শিল্পীর নাম স্পষ্ট পড়া
যাচ্ছে । একদিকের দেয়াল ফাঁকা । গতমাস পর্যন্ত ওখানে মার্ক্সের একখানা ছবি ছিল ।
এখন রবীন্দ্রনাথ নাকি বিবেকানন্দ, সে নিয়ে ডিসিশন হয়নি বলে আপাতত
ফাঁকা আছে ।
পাশের দেয়াল আলমারীতে দেশ-বিদেশের নানা ম্যাগাজিন । ব্যবসা-সংক্রান্ত বই । সেই
সঙ্গে ম্যানেজমেণ্টের বই, আধ্যাত্মিক দর্শনের বই ।
সাহিত্য,
সমাজ, ইতিহাস, বিজ্ঞানের
বই । রবিঠাকুরের গীতাঞ্জলি । জয় গোস্বামীও আছেন । এমনকি তিন-চারখানা লিটল ম্যাগ
পর্যন্ত ।
দাদা সেদিকে তাকিয়ে দেখছেন, গুপ্তাসাহেবের মুখে তৃপ্তির
হাসি । শিল্প ও সংস্কৃতির মেলবন্ধন কাকে বলে দেখুক ।
বাঙালি কৃষ্টি, বাঙালি সংস্কৃতি এখন ফ্যাশন ।
প্রতিদ্বন্দ্বী দলেরা যখন শিল্পী সাহিত্যিক গায়কদের দলীয় অ্যাম্বাসাডর হিসেবে খাড়া
করছিল,
তখন তিনি রবিঠাকুরকে দলে টেনে নিয়ে কিস্তিমাত দিয়েছেন ।
লীলাবতী বলেছিল, ‘তুমি বরং নতুন কাউকে সাজেষ্ট করো । উনি নতুন
আইডিয়া ভালবাসেন । বাঙালি নেতাজি নিয়ে খুব সেন্টিমেন্টাল । আঠেরোশ’ সাতানব্বইয়ে জন্ম, এ বছর নেতাজীর একশ’ কুড়ি
জন্মদিন । এখনো তেমন মাতামাতি নেই ।‘
এই আর্টিস্ট ছোকরা ছিল সেদিন । আঁতকে উঠেছিল, ‘ভুলেও
ওকাজ করবেন না । নেতাজি অন্যদলের প্রপার্টি । ও দলের সঙ্গে আমাদের খোলাখুলি সদ্ভাব
রাখা চলবে না ।‘
দেবেনবাবু বলেছেন, ‘ইউনিক একটা কথা ভেবে রাখুন । এমন কথা যা
চৌত্রিশ বছরে কেউ ভাবে নি । কমিটির চেয়ারম্যান তো হবেনই, রাজ্যসভার
মেম্বারশিপও পেয়ে যেতে পারেন ।‘
তোলা তুলতে আসা এই আঁকিয়ে ছোকরা একটা কমিটির মাথা । কি ইউনিক আইডিয়া দিয়েছে কে
জানে ।
কথা না বাড়িয়ে হাসিমুখে চেকবই বার করে সই করলেন । মাসিক দক্ষিণা । শিল্পী একটা
সুন্দর কার্ড এগিয়ে দিলেন । ‘আমার ছবির এগজিবিশন । আসবেন ঠিক
। মিসেসকে নিয়ে আসবেন । দেবুদা বলেছেন, সেদিন আপনার সঙ্গে ওঁর
কথা বলিয়ে দেবেন । একবার নহয় দেবুদাকে ফোন করে নেবেন ।‘
নিশ্চয় ফোন করবেন । দেবুবাবুকে ধরে থাকতে হবে ।
চেকটা এগিয়ে ধরলেন, ‘দেখবেন দাদা । অনেকদিন ধরে লেগে
আছি । দেবুবাবুই ভরসা ।‘
‘একদম চিন্তা করবেন না । একবার দেখা হলেই সব হয়ে যাবে । এ তো আর ওই রেজিমেণ্টেড়
দলের কার্যকলাপ নয় । হাসব কিনা, হাঁচব কিনা, তাও পার্টি ঠিক করে দেবে ! এখানে উনি একবার বললেই হয়ে যাবে । দেবুদা আপনার
জন্যে বিশেষ করে বলে রেখেছেন । আমরা সবাই চাই, আপনি
আমাদের সঙ্গে থাকুন । সবাই মিলে এই রাজ্যটার হাল ফেরাতে হবে । জগদ্দল পাথরের
বোঝাটা সরানো হয়েছে, এবার..‘ কথা
শেষ না করে হাঁফাতে লাগলেন ।
কপালে ঘাম । মুষ্টিবদ্ধ হাত । শিল্পীর আবেগ জেগেছে ।
***
আজ সেই দিন । সানন্দা বুটিকের হালকা নীল কাঁথা-স্টিচের পাঞ্জাবী । লীলাবতী অফ-হোয়াইট
আড়িকাজের শাড়ি । সবাই হৈহৈ করে উঠল । অভিজিত্বাাবু চশমার কাঁচ মুছতে মুছতে হাসলেন
। অর্থনীতির প্রফেসর । আটটা কমিটিতে আছেন ।
সাদা দাড়িতে হাত বুলিয়ে হাসলেন নাট্যকার, ‘নয়ন
ভুলানো এলে ।‘
ইনিও আট-দশটা কমিটিতে আছেন । জামার হাত গুটিয়ে এগিয়ে এলেন
নামী গায়ক,
সাতটা কমিটিতে আছেন, ‘আসুন
বিনোদভাই ।‘
বেশ লাগছে । আগে এই আন্তরিক খোলামেলা ভাবটা ছিল না । দেবব্রতবাবু এগিয়ে এলেন, ‘আলাদা করে পাঁচ মিনিট সময় পাওয়া গেছে । গুছিয়ে বলবেন কিন্তু ।‘
তিনি এলেন । প্রথম দিনই শিল্পীর সব ছবি বিক্রী হয়ে গেল । পরিবেশটা আহলাদে
টইটম্বুর । ঘিরে থাকা ভিড় । তার মধ্যেই লীলাবতীকে এগিয়ে দিলেন গুপ্তাসাহেব ।
দেবব্রতবাবু আলাপ করালেন, ‘মিসেস গুপ্তা । আপনাকে তো বলেছি
।‘
তিনি লীলাবতীর হাত জড়িয়ে ধরলেন, ‘আপনারা আমার আপন । আমার পরিবার
। আমি মানুষকে ভালবাসি । সব মানুষ আমার আপনজন ।‘
গুপ্তাসাহেবের আবেগ এসে গেল হঠাত্, ‘আমরাও তো আপনাদের আপন
ভাবি । আমাদের সবই বাঙালির মতো । খাওয়া দাওয়া অবশ্য ভেজিটেরিয়ানই আছে, কিন্তু সাজপোশাক রুচি ভাষা.. বাড়িতে রবীন্দ্রনাথ, রামকিষন, বিবেকানন্দ.. বাঙালিদের সব দেবতা আমাদের ঘিরে আছেন । তবু বাঙালি আমাদের মেড়ো
বলে । সারনেম নিয়ে ঝামেলা ছিল। আগরওয়ালা বললেই লোকে বুঝে ফেলত। সেটাকে গুপ্তা করে
নিলাম । বাঙালির গুপ্ত । বন্ধুবান্ধব সবই বাঙালি । তবু কেউ আমাকে আপন ভাবল না ।‘ একটানা বলে ফেললেন ।
কেউ দু:খ পেলেই তিনি মনে ব্যথা পান । বললেন, ‘কি
হয়েছে ?
বাঙালি মারোয়াড়ি ভাই ভাই । এই মেড়ো শব্দটা ওরা আমদানি
করেছিল । ওরা ভগবান মানে না, দেবতা মানে না, মানুষকে সম্মান দিতে জানে না । আমি আপনাদের লোক । আপনাদের বন্ধু । সব ঠিক হয়ে
যাবে । সব অপমান, সব বঞ্চনা, সব
লাঞ্ছনা,
কান্না আমি মুছে দেব ।‘
দেবব্রতবাবু ইশারা করালেন । সময় হয়েছে ।
প্রত্যয়ের হাসি ফুটল গুপ্তাসাহেবের মুখে, ‘এত
বছরে সুযোগ পাই নি । এবার ভরসা হচ্ছে সব ঠিক হয়ে যাবে । বাঙালি চিন্তাশীল, প্রগতিশীল,
প্রতিবাদী । আর আমরা মারোয়াড়িরা ব্যবসাটা বুঝি । একটা
কমন-ফ্রন্ট দরকার, যেখানে বাঙালি-মারোয়াড়ি একসঙ্গে কাজ করবে ।
এত বড় পোর্ট রয়েছে । কমার্স-ইণ্ডাস্ট্রি করার সব সুবিধে আছে । আপনি যদি বলেন..‘
তিনি নড়ে বসলেন । ঠিক জায়গায় লেগেছে । ‘খুব
ভাল কথা । ইউনিক আইডিয়া । একটা কমন ফ্রন্ট হোক । তার জন্যে একটা কমিটি । আপনি
চেয়ারম্যান । আমরা ‘আমরা-ওরা’-য় বিশ্বাস করি না । দেখিয়ে দেব, কিভাবে দুই বুদ্ধিকে এক করে শিল্প গড়ে তোলা যায় । জগত্ শেঠের আমল থেকেই
মারোয়াড়িরা আমাদের বন্ধু । বাঙালি মারোয়াড়ি ভাই ভাই ।‘
হেসে মাথা নাড়লেন বারবার, ‘কমার্স-ইণ্ডাস্ট্রি । ভেরী গুড
। মৃণাল কই?
মৃণাল? কমার্স-ইণ্ডাস্ট্রি শব্দটা নোট
করে নাও । কাল সকাল থেকে বারবার টিভিতে দেখানো হয় যেন । না না, কাল কেন,
আজ রাত থেকেই দেখাও । আমরা কাজ ফেলে রাখি না । রাজ্যের
কর্ম-সংস্কৃতি আমরা ফেরাবই ।‘
পরিতৃপ্তির শ্বাস । বাঙালির আবেগ.. যাবে কোথায়! ইগো আর আত্মতৃপ্তি, এই দুই দুর্বলতা বাঙালির । সময়মত খেলিয়ে তুলতে পারলেই কেল্লা ফতে ।
‘কনগ্র্যাচুলেশনস’, মোহন এসে হাত জড়িয়ে ধরল ।
***
কমন ফ্রন্ট-এর সুপারিশে কাজ হচ্ছে । বেঙ্গল পাইপ, বেঙ্গল
ইস্পাত,
বেঙ্গল টী, বেঙ্গল পাবলিসিটি কোম্পানি..
এসব কোম্পানির ডিরেক্টর-বোর্ডে কোনো বাঙালির নাম নেই আর । অবশ্য বিনোদ গুপ্তা, ঘনশ্যাম আগরওয়ালা বা মোহন বিড়লাদের নাম থাকা মানেই বাঙালির নাম থাকা । ওঁরা তো আদ্যপান্ত
বাঙালি ।
সালিসিটর,
অডিটর, এজেন্ট.. কেউ বাঙালি নয় ।
লেবাররা তো বাঙালি নয়ই । বিহার, ইউপি-র খাটিয়ে লোকেদের নেওয়ার
সুপারিশ করেছে কমিটিই । ওরা বাঙালিদের মতো
কর্মবিমুখ নয়,
কথায় কথায় ‘মানছি না, মানব না’-ও করে না ।
রাধেশ্যাম দাস, গোপাল মোদী, বিনীত
অগ্রবাল এ রাজ্যে নতুন নতুন ব্যবসা খুলেছে । মারোয়াড়ি যুবামঞ্চের অনুষ্ঠানে প্রধান
অতিথির জায়গাটা পাকা করেছেন গুপ্তা । আফটার অল, মারোয়াড়ি
ব্যবসাটা বোঝে ।
আর একটা সুবিধে হয়েছে । কমিটির চেয়ারম্যান হবার সুবাদে লীলাবতীকেও একটা
কমিটিতে ঢোকানো গেছে । ‘সংস্কৃতি প্রসার কমিটি’ । একটু মুশকিল হয়েছিল ।
এত বাঙালি থাকতে লীলাবতী কেন, সে প্রশ্ন উঠেছিল ।
বাঙালি-মারোয়াড়ি কমন-ফ্রন্টের হস্তক্ষেপে সমস্যা মিটেছে ।
শ্রেণী-বিন্যাসের সময়ে নিজেকে সুচারু বিন্যস্ত করে নেওয়াটাই উচিত ।
বিজনেস-ম্যাগাজিনগুলোর ইন্টারভিউ-এ পরিষ্কার করে বলেছেন গুপ্তাসাহেব ।
***
গল্পটা এখানেই শেষ হলে বেশ হত ।
কিন্তু আজ সকালে একটা ব্যাপার হয়েছে । লীলাবতী বললেন, ড্রাইভার
ছেলেটা তিনদিনের ছুটি চাইছে । আদিবাসী কল্যাণ কমিটির কাজে ভদ্রবাবুদের সঙ্গে
জঙ্গলের গ্রামে যাবে ।
‘আদিবাসী কল্যাণ কমিটি ! তাতে ওর কি? ডাকো দেখি ।’
‘আমি জিজ্ঞেস করে জেনে নিয়েছি । প্রাইম মিনিস্টার আবাস যোজনায় গ্রামে ঘর তৈরি
হচ্ছে । গ্রামের লোকেদের সব ব্যাঙ্ক অ্যাকাউণ্ট খোলা হবে । ওসব জঙ্গলের গ্রামে কাজ
করানো কত মুশকিল, সে তো জানো । তাই সিএম আদিবাসী কল্যাণ
কমিটির ছেলেদের যেতে বলেছেন ।‘
ড্রাইভার ছেলেটা যে আদিবাসী, তাই মনে ছিল না । মুর্মু । পুরো
নামটাও জানা হয় নি কোনোদিন ।
লীলাবতীর কথায় জেগে উঠলেন, ‘মুর্মু যে একটা কমিটির মেম্বার, তুমি জানতে?’
না,
জানতেন না । মুর্মু কাকে ধরে, কোন
ইউনিক আইডিয়া দিয়ে কমিটি-মেম্বার হয়েছে কে জানে। তবে ‘আদিবাসী’ এখন একটি আবেগের শব্দ । বিনোদ গুপ্তার কপালে ভাঁজ পড়ল । ভাবনা হচ্ছে । নানা
আড্ডায় এ নিয়ে কত আলোচনা হয়েছে ।
মুচি মেথর রিক্সাওয়ালা চাষা মজদুর ক্লাসের লোকদের মাথায় তোলাটা যে খারাপ কাজ
হয়েছিল,
ভদ্র সমাজে অভিজাত ক্লাসে সে কথা বারবার আলোচনা হয়েছে । সমাজতন্ত্র
বনাম স্টেট-ক্যাপিটালিজম নিয়ে কত লেখা, কত সেমিনার ।
শ্রেণী-বিন্যাস থাকবেই । এই পৃথিবীর নিয়ম ।
তবে আজ কেন?
কমিটির কল্যাণে শ্রেণী-বিভেদ ঘুচল কেন? কমিটি নিয়ে এত মাথা খাটানো, এত পরিকল্পনা.. পুরোটাই
পন্ডশ্রম হল?
নিজেকে নামিয়ে এনে সবার সঙ্গে একাসনে বসা? ‘ক্লাস’
বলে সত্যিই আর কিছু থাকবে না? শুধুই ‘মাস’?
জনতার একজন?
বিনোদ গুপ্তা আগরওয়ালা আর ড্রাইভার মুর্মু । দুই কমিটির সদস্য । এ এক নতুন
পরিচয় । নতুন সামাজিক বিন্যাস । ভাবনা হচ্ছে । ভয় হচ্ছে । সব আনন্দ মুছে গিয়ে নতুন
ভয় ।
আইভি
চট্টোপাধ্যায়
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন