ধন্বন্তরী কথা - মৌ দাশগুপ্ত



ধন্বন্তরী কথা
মৌ দাশগুপ্ত

মনসামঙ্গল পড়ছিলাম। কবি বিজয়গুপ্তের মনসা মঙ্গল বা পদ্মাপুরাণ মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে এক প্রসিদ্ধ গ্রন্থ। পদ্মপুরান বা মনসামঙ্গল গ্রন্থাকারে প্রকাশের পূর্বে কবি বিজয়গুপ্তের এই মঙ্গল কাব্যটি পালাকারে চারশো বছর টিকিয়ে রেখেছিলেন বরিশালের রায়ান বা মহিলা গায়েনেরা । কবি বিজয়গুপ্তু জম্মগ্রহন করেছিলেন আজ থেকে পাঁচশো বছর আগে । পঞ্চদশ শতকে । তার জম্মস্থান বরিশাল জেলার আগৈলঝাড়া উপজেলাধীন ফূলশ্রী গ্রামে।আশুতোষ ভট্টাচার্য বিজয়গুপ্তের যথার্থ মূল্যায়ণ করেছেন এই বলে, “বিজয়গুপ্ত দেবতার মাহাত্ম্য রচনা করেন নাই, মানবেরই মঙ্গলগান গাহিয়াছেন।এইজন্যে পদ্মাপুরাণের গল্প অপরাপর মনসামঙ্গলের মত হলেও অনেক বেশি মানবীয়।এখানে এক সহায়ক চরিত্র ধন্বন্তরি। মজার কথা ধন্বন্তরি নাম বিভিন্ন পুরাণ উপনিষদে বারবার উঠে এসেছে। তারা সবাই বাহ্মণ বা বড়জোড় ক্ষত্রিয় কিন্তু এই ধন্বন্তরির পরিচয় বড় গন্ডগোলের অথচ মজার কথা সব ধন্বন্তরিই কিন্তু জড়ি বুটি গুল্ম লতাপাতা দিয়ে ভেষজ চিকিৎসায় পারদর্শী।

এবার আমার প্রশ্ন, কে এই ধন্বন্তরি? অভিধান বলছে, ধন্বন্তরি - [ বিশেষ্য পদ] দেব-চিকিৎসক, অতি সু-চিকিৎসক। অথবা, অতিশয় সুচিকিৎসক, যে চিকিৎসক রোগ নিরাময়ে কখনো ব্যর্থ হন না।.. পুরাণমতে সমুদ্রমন্থনের সময় প্রথমেই ধনসম্পদের দেবী লক্ষ্মী,ধবল ক্ষীর ও পারিজাত পুষ্পের পাশাপাশি ধন্বন্তরি উঠে আসেন।হাতে ছিল শ্বেত কমন্ডলু পুর্ণ অমৃত। [সূত্র: মহাভারত। আদিপর্ব। সপ্তদশ-অষ্টাদশ অধ্যায়] বিষ্ণুধর্মোত্তরো গ্রন্থমতে এই ধন্বন্তরি ছিলেন চতুর্ভুজ সুদর্শন পুরুষ,শ্যামবর্ণ, পীতাম্বর, সুবর্ণখচিত মুকুটধারী। চারহাতে শঙ্খ, অমৃতভান্ড, অথর্ববেদ, জোঁক এবং সবুজ গুল্মলতা।আজও দক্ষিণভারতের কিছু মন্দিরে ধন্বন্তরির মূর্তিপুজো হয়।সেখানে তঁার চার হাতে শঙ্খ চক্র অমৃতভান্ড ও গুল্মলতা থাকে। তিনি উদ্ভব হয়েই সৃষ্টি পালনকর্তা দেব নারায়ণের স্তব করেন, ভগবান নারায়ণ তাকে অব্জদেব ( জলসম্ভুত) নাম দিয়ে পুত্ররূপে স্বীকার করেন।তিনি দেবতাদের পরে জাত হয়েছিলেন বলে যজ্ঞভাগের অধিকারী ছিলেন না।কিন্তু দেব নারায়ণ তাকে বর দিয়েছিলেন হে পুত্র, তুমি দেবগণের পশ্চাৎ জন্মিয়াছ; অতএব যজ্ঞ ভাগ গ্রহণে সমর্থ হইবে না। কিন্তু দ্বিতীয় জন্মে লোক মধ্যে থ্যাতি লাভ করিবে। গর্ভস্থ অবস্থাতেই তোমার অনিমাদি সিদ্ধি হইৰে । আর সেই শরীরেই তুমি দেবত্ব লাভ করিৰে। দ্বিজগণ চক্রমন্ত্র, ব্রত ও জল দ্বারা তোমায় পূজা করিবেন। তুমি অষ্টবিধ অঙ্গ সমন্বিত আয়ুৰ্ব্বেদ বিধান করিবে। দ্বিতীয় দ্বাপর যুগ উপস্থিত হইলে তুমি জন্ম পরিগ্রহ করিৰে । অতঃপর দ্বাপরে সোম বংশীয় নরপতি দীর্ঘতপার প্রার্থনা অনুসারে অব্জদেব তাঁর পুত্ররূপে জন্মগ্রহণ করেন । তিনিই পরে সৰ্ব্বরোগ বিনাশক কাশীরাজ ধন্বন্তরী নামে খ্যাত হন । Chapter 67 Section 3 Upodhghaatapaada of Brahmanda Purana (Pg 851- 852). “মহর্ষি ভরদ্বাজের থেকে সমুদয় আয়ুৰ্ব্বেদশাস্ত্রে জ্ঞান প্রাপ্ত হয়ে, তিনিই প্রথম আয়ুর্বেদশাস্ত্রকে অষ্ট প্রকারে বিভাগ করে শিষ্যগণকে দান করলেন ।“(চরক সংহিতা)। সেই হিসাবে ধন্বন্তরি যথার্থ বৈদ্য ছিলেন।এই জন্মে কেতুমান নামে তাঁর এক পুত্র জন্মে। শোনা কথা এই যে, বৈদ্যদের মধ্যে ধন্বন্তরি গোত্রের যারা আছেন, তারা নাকি এই ধন্বন্তরির উত্তরসূরি।প্রসঙ্গত বলি, আদি ধন্বন্তরি নিজে বলেছেন—“আমি আদিদেব ধন্বন্তরি, অন্তান্ত রোগ এবং বিশেষ শল্যতন্ত্র শিক্ষা দিতে ভূতলে অবতীর্ণ হইয়াছি।

জগৎপতি বিষ্ণুর এক স্তবে পাওয়া যায়,” নমো ধন্বন্তরি কায় অমৃতধারক। নমো যড়কায় হিরণ্যাক্ষবিদারক । নমস্তে মোহিনীরূপ অসুরমোহন। নমস্তে নৃসিংহ মহাদৈত্য বিনাশন। নমো রামকৃষ্ণ রূপ গোকুল বিহার । নমো নমো নমো জয় বুদ্ধ অবতার ভবিষ্যত অবতার নমঃ কলিকরূপ । নমো হরি অবতার নমো বিশ্বরূপ সচ্চিদানন্দ নমো বিশ্বপরায়ণ । নমো নমো জগৎপতি ব্রহ্ম সনাতন।এখানে ধন্বন্তরি ত্রিলোক পালনকর্তা বিষ্ণুর দ্বাদশ অবতারেরও নাম।ধন্বন্তরি মহামন্ত্রেও তারই ছায়া পাই:

।।ওম নম ভগবতে মহা সুদর্শনায় বাসুদেবায় ধন্বন্তরে অমৃত কলস হস্তায়, সর্বভয় বিনাশায় সর্বরোগ নিবারণায় ত্রিলোক্য পতায়ে, ত্রিলোক্য নিধায়ে শ্রী মহা বিষ্ণু স্বরূপা, শ্রী ধনবত্রী স্বরূপা শ্রী শ্রী শ্রী ঔষধ চক্র নারায়ণ স্বহা।

সংকলিত বাংলা শ্রীমদ ভাগবত পুরাণএর প্রথম স্কন্দের তৃতীয় অধ্যায়ে সংখ্যাক্রম অনুসারে বিষ্ণুর যে বাইশ অবতারের বর্ণনা দেওয়া হয়েছে, তা নিম্নরূপ:-

১. চতুর্সন [ভাগবত ১।৩।৬] (ব্রহ্মার চার পুত্র)

২. বরাহ [ভাগবত ১।৩।৭] (বন্য শূকর)

৩. নারদ [ভাগবত ১।৩।৮] (ভ্রাম্যমান ঋষি)

৪. নর-নারায়ণ [ভাগবত ১।৩।৯] (যমজ)

৫. কপিল [ভাগবত ১।৩।১০] (দার্শনিক)

৬. দত্তাত্রেয় [ভাগবত ১।৩।১১] (ত্রিমূর্তির যুগ্ম অবতার)

৭. যজ্ঞ [ভাগবত ১।৩।১২ (সাময়িকভাবে ইন্দ্রেরভূমিকা গ্রহণ করা বিষ্ণু)

৮. ঋষভ [ভাগবত ১।৩।১৩] (রাজা ভরত ও বাহুবলীর পিতা)

৯. পৃথু [ভাগবত ১।৩।১৪] (যে রাজা পৃথিবীকে সুন্দর ও আকর্ষণীয় করে তুলেছিলেন)

১০. মৎস্য [ভাগবত ১।৩।১৫] (মাছ)

১১. কূর্ম [ভাগবত পুরাণ ১।৩।১৬] (কচ্ছপ)

১২. ধন্বন্তরী [ভাগবত ১।৩।১৭] (আয়ুর্বেদেরজনক)

১৩. মোহিনী [ভাগবত ১।৩।১৭] (সুন্দরী নারী)

১৪. নৃসিংহ [ভাগবত ১।৩।১৮] (নর-সিংহ)

১৫. বামন [ভাগবত ১।৩।১৯] (খর্বকায়)

১৬. পরশুরাম [ভাগবত ১।৩।২০] (পরশু অর্থাৎ কুঠার সহ রাম)

১৭. ব্যাসদেব [ভাগবত ১।৩।২১] (বেদ ও সনাতনী গ্রন্থ সংকলক)

১৮. রাম [ভাগবত ১।৩।২২] (অযোধ্যার রাজা)

১৯. বলরাম [ভাগবত ১।৩।২৩] (কৃষ্ণের জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা)

২০. কৃষ্ণ [ভাগবত ১।৩।২৩] (রাখাল বা স্বয়ং ভগবান)

২১. বুদ্ধ [ভাগবত ১।৩।২৪] (জ্ঞানী)

২২. কল্কি [ভাগবত ১।৩।২৫] (ধ্বংসকারী)

ধন্বন্তরি অমৃতাচার্য্য । স্কন্দ, গণকর ও মার্কণ্ডেয় পুরাণমুসারে ভগবান ধন্বন্তরি ত্রেভtযুগের প্রারম্ভে আভির্ভুত হয়েছিলেন। স্কন্দপুরাণ মতে– “তপোবলসম্পন্ন গালব ঋষি তীর্থভ্রমণ কালে একদা তৃষ্ণা-কাতর হইয়া দর্শন করিলেন যে, এক অসামান্য রূপবতী নারী বারিপূরিত কুম্ভ কক্ষে মরালগমনে যাইতেছে। মহর্ষি সে সুধাংশুবদনা সদনে বারি প্রার্থনা করিলেন ও তদত্ত সলিলপানে পিপাসা-শান্তিতে সন্তোষ সহকারে বর দিলেন পুত্রবতী হওসে রমণীর নাম বীরভদ্রা। তিনি তৎ শ্রবণে মধুর-বাক্যে উত্তর করিলেন,– “আপনার অব্যৰ্থ বাক্য বিবাহিতা নারীর চিত্তহারী হইলেও কুমারীর পক্ষে লজ্জাকর, আমি অবিবাহিতা কুমারীগালব ঋষি তখন বীরভদ্রার পিতৃসকাশে এই বিবরণ বর্ণন করিলে, তিনি র্তাহাকেই কন্যা প্রদান করিলেন। কিন্তু বীরভদ্রা তাহাকে জলদানে প্রাণরক্ষা করিয়াছে এই কারণে প্রাণদাত্রীকে তিনি পত্নীত্বে গ্রহণ করিতে অস্বীকৃত হইলেন। অন্যান্য ঋষি গালবের এই ধৰ্ম্ম সঙ্গত ব্যবহারে তুষ্ট হইলেন। তাহারা বীরভদ্রার ও ঋষিবাক্য রক্ষার এক উপায় করিলেন। বীরভদ্রা হইতে ত্রিলোকের হিতার্থে অমৃতাচায্য ধন্বন্তরির উদ্ভিব হইবে, তপঃপ্রভাবে ঋষিগণ পূৰ্ব্বেই ইহা জ্ঞাত ছিলেন। তাহারা তখন কুশনিৰ্ম্মিত এক কুমারের বেদমন্ত্রে প্রাণ প্রতিষ্ঠা পূৰ্ব্বক বীরভদ্রার ক্রোড়ে স্থাপন করিলেন। মাতৃক্রোড় স্পর্শমাত্র বেদ-মন্ত্র-প্রভাবে সে কুশ-কুমার জীবন প্রাপ্ত হইয়া মানবাকার ধারণ করিল। তখন হষ্টচিত্তে সেই সম্মিলিত ঋষিবর্গ উক্ত শিশুর ধন্বন্তরি এই নাম রাখিয়া তপোবন গমন করিলেন। লোকশ্রুতি, এই ধন্বন্তরি হইতে বৈদ্যগণের উৎপত্তি।“--

বইপত্র ঘেঁটে একাধিক ধন্বন্তরির কথা পাওয়া যায়। যেমন, এই কাশীরাজের আসল নাম নাকি রাজা দিবোদাস। দিবোদাস ছিলেন আচার্য সুশ্রুতের গুরু এবং আয়ুর্বেদ ঐতিহ্য অনুযায়ী শল্যবিদ্যার জনক। তাঁকে ধন্বন্তরির অবতার বলে মনে করা হত বলে তিনি ধন্বন্তরি উপাধি নেন।অতি প্রাচীন কাল হইতে বেদজ্ঞ ঋষিগণ ভেষজের গুণাগুণ-সন্ধে. বিশেষ অভিজ্ঞ ছিলেন। অথর্ববেদ উহার একটা জাজ্বল্যমান প্রমাণ।স্বয়ং ব্রহ্মাদেব এই অথর্ববেদ রচনা করেন এবং তাঁর পুত্র প্রজাপতিকে অথর্ববেদজ্ঞান দান করেন।প্রজাপতি সে জ্ঞান দেন তাঁর শিষ্য সুর্য্যদেবকে। যিনি তা দেন তাঁর শিষ্য দেব চিকিৎসক অশ্বিনীকুমারদ্বয়কে।তাঁরা সেই জ্ঞান দান করেন দেবরাজ ইন্দ্রকে। উপকথা বলে এই অথর্ববেদজ্ঞানকে জনকল্যাণের কাজে মর্ত্যলোকে প্রচার ও প্রসার জরুরী হয়ে পড়লে স্বয়ং প্রজাপালক বিষ্ণু ধন্ব্তরি রূপে পৃথিবীতে জন্মগ্রহন করেন।দেবরাজ ইন্দ্রের থেকে অথর্ববদকে শ্রুতিতে ধারণ করেন মহামুনি ভরদ্বাজ।এই ভরদ্বাজের শিষ্যত্ব নেন কাশীরাজ দীর্ঘতমাপুত্র দিবোদাস।আনুমানিকভাবে বুদ্ধদেবের চারশো বছর আগে এই ধন্বন্তরি বা দিবোদাস আভির্ভুত হয়েছিলেন ।অগ্নিপুরাণমতে অথর্ববেদ শিখে তিনি তার সরলসার আয়ুর্বেদে লিপিবদ্ধ করেন। অর্থাৎ এই অথর্ববেদ. হইতেই আয়ুর্বেদের উদ্ভব। ভাবপ্রকাশ গ্রন্থমতেও, আয়ুৰ্ব্বেদ গ্রন্থ ধন্বন্তরি প্রণীত । চরণব্যুহমতে ইহা ঋগ্বেদের উপবেদ মাত্র। এই আয়ুর্বএদজ্ঞান তিনি দন করেন তার শিষ্য সুশ্রুত, পৌষকল্যায়েত, অরৌভা, উপ্যধানেভ্য, কার্য্যবীর্য, গোপুরারক্ষিত বৈতরণ্য, প্রমুখ ঋষিবালকদের।পরবর্তী সময়ে মহর্ষি আত্রেয়, ভরদ্বাজ ও. অগ্নিবেশ প্রভৃতি ঋষিগণ আয়ুর্বেদীয় অধ্যাপকরূপে কয়েকখানি চিকিৎসা-গ্রন্থ প্রণয়ন করেন। তাহাদের গ্রন্থসমূহ হইতে মহর্ষি চরক ব্যাধিপীড়িত জনগণের হিতার্থে চরকসংহিতা নামক. অমূল্য গ্রন্থ রচনা করেন। কথিত আছে যে দেববৈদ্য ধন্বন্তরি কাশীরাজ-গৃহে দিবাদাস বা দিবোদাস নামে জন্মগ্রহণ করায় মহর্ষি. বিশ্বামিত্র তার পুত্র সুশ্রুতকে ধন্ন্তরি দেবোদাসের নিকট আয়ুর্বেদ-শিক্ষার জন্য প্রেরণ করেন। মহর্ষি. সুত শিক্ষালাভের পর যে গ্রন্থ রচনা করেন তাহারই নাম সুশ্রুত-সংহিতা। বিষ্ণুপুরাণে এই ক্ষত্রিয় ধন্বন্তরিকে বৈদ্য ধন্বন্তরি ধরলে কয়েকটি প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়। যেমন, ব্রহ্মবৈবৰ্ত্ত পুরাণান্তর্গত ব্রহ্মখণ্ডের ১৬ অধ্যায়ে লেখা আছে, মহামুনি অত্রেয়, ভরদ্বাজ ও চরক ঐ ধন্বন্তরির পূর্বজ। সুতরাং এই ধন্বন্তরি, ক্ষত্রিয়রাজা ধন্বন্তরি হলে চরক কোন মতেই অগ্নিবেশসংহিতাতে ধন্বন্তরির উত্তরসূরী হতে পারেননা। সময়ের বিস্তর তফাৎ চলে আসে।আবার যদি বিষ্ণুপুরাণেন্ত বংশাবলী গ্রহণ করা যায়, তবে ধন্বন্তরির দিবোদাস নাম অসঙ্গত হয়ে ওঠে । বিষ্ণুপুরাণেই কাশীরাজের পৌত্র ধম্বস্তুরি নামে এক রাজা ছিলেন বটে কিন্তু তিনি দিবোদাস নন। বিষ্ণুপুরাণে আছে, “ কাশ্যের পুত্র কাশীরাজ, কাশীরাজের পুত্র রাষ্ট্র, রাষ্ট্রের পুত্র দীর্ঘতমা, দীর্ঘতমার পুত্র ধন্বন্তরি । ভগবান নারায়ণ র্তাহাকে এই বর দেন যে, “ তুমি কাশীরাজ গোত্রে অবতীর্ণ হইয়া অষ্টাঙ্গ আয়ুৰ্ব্বেদ স্বষ্টি করিবে এবং যজ্ঞাংশভাগী হইবে।সেই ধন্বন্তরির পুত্র কেতুমান, কেতুমানের পুত্র ভীমরথ, ভীমরথের পুত্র দিবোদাস । সুতরাং সুশ্ৰুতগুরু ধন্বন্তরি দিবোদাসকে ক্ষত্রিয় ধম্বন্তরি ধরলে সোশ্রতাযুৰ্ব্বেদে তাকে ভূমিপ বলাটা অসঙ্গত লাগে।কেননা কাশীরাজের পৌত্র একাধারে ক্ষত্রিয় ও রাজা অর্থাৎ ভুপতি, ভুমিপ নন।তাহলে কাশ্যের পুত্রের শুধু নামই কি কাশীরাজ? অর্থৎ কাশীরাজ কাশীর রাজা নন, শুধুই নামমাত্র? আরো ঘোরালো লাগছে না? আরেকটি ভগবতপুরাণোক্ত ধন্বন্তরি কাশীরাজ বা আদি ধন্বন্তরিকেই বিষ্ণুর অংশাবতার বলা হয়েছে যিনি অর্থর্ববেদ থেকে সরলসার আয়ুর্বেদের জনকই শুধু নন, তিনি পঠনপাঠন ও প্রয়োগের সুবিধাহেতু আয়ুর্বেদকে আটটি বিশেষ বিভাগে লিপিবদ্ধ করেন।

1. *জেনারেল মেডিসিন বা কায়াচিকিত্সা তন্ত্র।

2. *সার্জারী বা শল্য তন্ত্র।

3. *নাক-কান-গলা,চক্ষু ও দন্তরোগ-শালক্য তন্ত্র

4. *পেডিয়াট্রিকস বা শিশুরোগ-কৌমারভৃত্য তন্ত্র

5. *ফরেনসিক টক্সিকোলজি* বিষতন্ত্র

6. *রিপ্রোডাক্টিভ বা .যৌনরোগ বাজিকরণতন্ত্র..

7. *এন্টি এজিং সায়েন্স বা রসায়নতন্ত্র

8. *সাইকিয়াট্রি বা ভুতবিদ্যা

এবার আসি আদি ধন্বন্তরির বংশধর দিবোদাসের কথায়। তিনি আন্দাজ খ্রীষ্টজন্মের ৩০০০ সাল আগে জীবিত ছিলেন।অনুমান করা হয় এই দিবোদাস ধন্বন্তরিই ছিলেন সুশ্রুতসংহিতা উল্লেখিত সুশ্রুতের শিক্ষাগুরু।অগ্নিবেশসংহিতাতেও এই ধন্বন্তরির কথাই বলা হয়েছে বলে অনুমান করা হয়। হরিবংশপুরাণ, বায়ুপুরাণ ও ব্রহ্মান্ডপুরাণে আবার বলা হয়েছে দেব নারায়ণের অংশাবতার ধন্বন্তরি কাশীর ভুপতি ধণ্বাপুত্র ধন্বন্তরিরূপে জন্মগ্রহণ করেছিলেন।এই ধণ্বার পিতা হিসাবে মহারাজ দীর্ঘতপার নাম নেওয়া হয়েছে। ব্রহ্মবৈবর্ত্যপুরাণে আরেক ধন্বন্তরির ঊল্লেখ পাওয়া যায় যিনি স্বয়ং সুর্য্যদেবের থেকে আরো পঞ্চদশ শিষ্যের সাথে অথর্ববেদজ্ঞানলাভ করেন।

ধন্বন্তরি প্রণেত যে আয়ুর্বেদ গ্রন্থগুলি পাওয়া যায়, সেগুলি হল,

1.       চিকিৎসাতত্ত্ব বিজ্ঞান

2.       বৈদ্য চিন্তামণি

3.       ধন্বন্তরি নিঘন্টু

4.       বৈদ্য ভাস্করোদয়

5.       চিকিৎসা সার সংগ্রহ

কাশীরাজ প্রণেত যে আয়ুর্বেদ গ্রন্থগুলি পাওয়া যায়, সেগুলি হল,

1.       চিকিৎসা কোমৌদি

2.       অজীর্ণামৃতা মঞ্জরী

ধন্বন্তরি দিবোদাস প্রণেত একটি আয়ুর্বেদ গ্রন্থই পাওয়া যায়,

1.       চিকিৎসা দর্পণ

ইতিহাস বলে মৌর্য্যসম্রাট অশোকের পিতামহ চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য ও পিতা বিন্দুসারের চিকিৎসক ছিলেন জনৈক ধন্বন্তরি- .. (১৯৫১-১৯৫৫ সালের মধ্যে কে পি যশোয়াল কর্তৃক পাটলীপুত্র নগরের খননকার্য সম্পাদনকালে চিকিৎসক ধনন্তরীর প্রতিষ্ঠিত একটি আরোগ্য বিহারের অস্তিত্বও পাওয়া গিয়েছে যা প্রাচীন ভারতীয় আয়ুর্বেদ চর্চার সূত্রের সন্ধান দেয়।) ধন্বন্তরি কিন্তু আবার সম্রাট বিক্রমাদিত্যের নবরত্ন সভাতেও ছিলেন। বিক্রমাদিত্য ছিলেন উজ্জয়িনীর শাসক। তার রাজদরবারের নবরত্নগণ হলেন যথাক্রমে, অমরসিংহ, কালিদাস, ক্ষপণক,ঘটকর্পর, ধন্বন্তরি, বরাহমিহির, বররুচি, বেতালভট্ট, ও শঙ্কু। গুপ্তযুগে সেরা চিকিৎসক ধন্বন্তরি ছিলেন একজন আয়ুর্বেদ ও শল্য চিকিৎসক। আবার মনসামঙ্গল কাব্যেও দেখি আবার সেই ধন্বন্তরি! তবে একই ধন্বন্তরি এত দীর্ঘসময় বেঁচে ছিলেন নাকি রাজবৈদ্যকেই ধন্বন্তরি উপাধি দেওয়া হত, তা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। এককথায় পরবর্তীকালে ধন্বন্তরি নাম নয়, এক উপাধি হিসাবে ব্যাবহার হত।

ফেরত আসি মনসামঙ্গলের ধন্বন্তরির কথায়। তিনি বিজয়গুপ্তের মনসামঙ্গল বা পদ্মপুরাণের অন্যতম সহায়ক চরিত্র। নেতা ধোপানীর এই পালিত পুত্রটি কিন্তু বদ্যি কম, ‘গাড়ুর বা গাড়ুরী ওঝাবেশি ছিলেন। লক্ষ্যনীয় ওঝা যদিও ব্রাহ্মণ উপাধি উপাধ্যায় এর অপভ্রংশ তবু ওঝাদের কিন্তু অন্ত্যজ সমাজের প্রতিনিধি মানা হয়। আর এই গাড়ুরী শব্দটি এসেছে গড়ুর শব্দ থেকে। গড়ুর হলো সাপের শত্রু। যিনি গরুড় মন্ত্র জানেন, তিনি গাড়ুরী। দ্বিজবংশী দাসের পদ্ম পুরানে ধনান্তরিকে দেখি:

ঝুলি ভরি নিল চারি ঔষধের মূল। গারুড়ি মন্ত্রের পুথি লইল বহুল। হড়পি ভরিয়া সর্প নিল ভারে ভারে। সত্ত্বরে চলিয়া যায় রাজা রাখি বারে।

ধনান্তরি ওঝা তার নিজের পরিচয় দেন:

ছয়কুড়ি শিষ্য মোর অনুচর সঙ্গে। সর্পমারি বিষ খাই ঢাক বাজাই রেঙ্গ।

ধন্বন্তরি ওঝা যে বেদে তার প্রমাণ পাই ছদ্মবেশী ব্রাহ্মণের প্রশ্নে, ‘কোথাকার বেদে তুমি গাড়ুরী বিদ্যার।

পদ্মাপুরাণ ছেড়ে ফিরে আসি পুরাণের কথায়,কালীপুজোর ঠিক আগের ত্রয়োদশী তিথিকে চিকিৎসকদের ঈশ্বর বা ঈশ্বরদের চিকিৎসক ধন্বন্তরির জন্মদিন হিসাবেও মনে করা হয়৷ সমু্দ্র মন্থনের পর এই দিনেই অমৃতের ভাণ্ড হাতে ধন্বন্তরি উঠে এসেছিলেন বলে মনে করা হয়৷ ধন্বন্তরি যেদিন প্রকট হয়েছিলেন সেই ধন্বন্তরি ত্রয়োদশীতে বা "ধন্তেরাস" এর দিন উত্তরভারতের ভক্তরা,বিশেষত আয়ুর্বেদীয় চিকিৎসকগণ হোমযজ্ঞ সহ ধন্বন্তরি উপাসনা করে থাকেন।
মৌ দাশগুপ্ত

তথ্যসূত্রঃ
1. M. Srinivasachariar (1974). History of Classical Sanskrit Literature. Motilal Banarsidass. pp. 94–111. আইএসবিএন ৯৭৮৮১২০৮০২৮৪১
2. V. Venkatachalam. Fresh light on Kalidasa's historical perspective, Kalidasa Special Number (X), The Vikram, 1967, pp. 130–140
3. বৃহজ্জাতক, বরাহমিহির, অনুবাদক. ভি. সুব্রাহ্মন্য শাস্ত্রী, ১৯৫৬ খৃ., পৃ. ৫৪৭।
4. http://www.ayurtechkerala.com/the-ayurveda-god-dhanvantari
5. https://easyayurveda.com/2016/09/12/lord-dhanwantari-the-god-of-ayurveda/
6. Myth of the Aryan Invasion of India by David Frawley
7. Indian Gods and Kings, the story of a living past by Emma Hawkridge, Houghton Miffin Company 1935
8. বাংলা সাহিত্যের রূপরেখা। গোপাল হালদার। [মুক্তধারা, আগষ্ট ১৯৮০]
9. বাংলা সাহিত্যের সমগ্র ইতিহাস। ক্ষেত্র গুপ্ত। [জাতীয় গ্রন্থ প্রকাশন, ফেব্রুয়ারি ২০০০।
10. ভারতের ইতিহাস । অতুলচন্দ্র রায়, প্রণবকুমার চট্টোপাধ্যায়। [মৌলিক লাইব্রেরি, কলকাতা, জুন ২০০০]


২টি মন্তব্য: