সব গাছ ছাড়িয়ে ~ শুভেন্দু বিকাশ চৌধুরী


সব গাছ ছাড়িয়ে
শুভেন্দু বিকাশ চৌধুরী


সুভাষের পুরো নাম, নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বোস গৌড়। আশ্চর্য হবেন না, মহাপুরুষ আরও আছেন এই অঞ্চলে। খুঁজলে দু-চারজন বিদ্যাসাগরও পাওয়া যাবে যেমন বিদ্যাসাগর রাও কিম্বা রেড্ডি। নামটি দিয়েছিলেন সুভাষের তাতা মানে ঠাকুরদা। তো সব নামকরণের পেছনেই কিছু আশা-আকাঙ্খা-স্বপ্ন-আদর্শ ইত্যাদি ট্রান্সফার  করার ব্যাপার থাকে। সুভাষের তাতারও নিশ্চয়ই ছিল। কিন্তু সেই সব ফাইল তাতার মাথা থেকে সুভাষের মাথায় ট্রান্সফার করার সময় তাতে কিছু ভাইরাস ঢুকে যায়, ফলে ফাইলগুলো ঠিকঠাক ট্রান্সফার হয় না।

সুভাষ একটি প্রাইভেট কোম্পানিতে অফিসবয়ের কাজ করে। বয়স বোধ হয় বাইশ-তেইশ হবে। চেহারা দেখে অবশ্য বোঝার যো নেই, ছোটখাটো চেহারায় মনে হয় যেন পনের-ষোল। সুভাষকে আজ সকাল সাতটার মধ্যে অফিস ঢুকতে হয়েছে। কোনরকমে হন্তদন্ত হয়ে সুভাষ অফিসে পৌঁছায়। মাল্লাপুর থেকে বেগমপেট আসার সরাসরি বাস পায় নি। হাবসিগুডা থেকে বাস পাল্টে আসতে হয়েছে। যাই হোক, সময়মত অফিস পৌঁছতে পেরে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। পুরো অফিস খালি, শুধু মার্কেটিং ডিপার্টমেন্টের পাঁচজন এসেছে। কোথায় নাকি জরুরী কোটেশন জমা দিতে হবে। ওদের জন্যই সুভাষকেও আসতে হোলো। সুভাষ তাড়াতাড়ি মার্কেটিং ডিপার্টমেন্টে ঢুকে পড়ে। অভ্যস্ত হাতে ভেজা কাপড় দিয়ে চটপট সবার টেবিল, চেয়ার সাফ করে দেয়। জলের বোতল ভরে এনে সবার টেবিলে টেবিলে দিয়ে দেয়। তারপর বিরুপাক্ষাইয়া সাহেবের টেবিলের সামনে গিয়ে বলে, ‘সারু, টিফিনে কী কী আনতে হবে?’

বিরুসাব সবাইকে একবার জিজ্ঞেস করে বলে দেন, ‘দুটো মশালা ধোসা, এক প্লেট ইডলি বড়া প্লেট ইডলি সিঙ্গল বড়া, এক প্লেট বড়া, এক প্লেট মাইসোর ভাজি

সুভাষ জিজ্ঞেস করে, ‘ফুটপাথের বান্ডি থেকে আনব না নন্দিনী থেকে?’

বিরুসাব বলেন, ‘না, না বান্ডি থেকে নয়, নন্দিনী থেকেসুভাষ রেন্ডু মাশালা, ওক্ক ইডলি-বড়া আওড়াতে আওড়াতে অফিস থেকে বেরিয়ে আসে। অফিস থেকে বেরিয়ে এলেই বাঁদিকে একটি বড় মসজিদ। মসজিদের বিশেষত্ব হল গম্বুজগুলো গোল গোল রকমের নয়, বরং অনেকটা চার্চের মত লম্বা এবং ছুঁচলো। স্প্যানিশ মসজিদও বলে অনেক লোকে। একটু এগিয়ে এলেই মেন রাস্তা, সর্দার প্যাটেল রোড। তারপর শুরু হচ্ছে বেগমপেট ফ্লাইওভার। ডানদিকে হোটেল মনোহর। এয়ারপোর্ট বেগমপেট থেকে শামশাবাদে স্থানান্তরিত হবার পর, জায়গাটা আর অত মনোহর নয়, বিশেষত যারা নানাভাবে বিভিন্ন পর্যটন ব্যবসার সাথে যুক্ত ছিলেন, তাদের পক্ষে। জায়গাটার জৌলুস কমেছে অনেকটা। ওই মেন রাস্তা দিয়ে মিনিট দশেক হাঁটলেই পৌঁছনো যাবে নন্দিনী টিফিন সেন্টারে। 

অফিসের কাজের থেকে অফিসের বাইরের কাজই সুভাষের ভাল লাগে, বিশেষত সেই কাজে যদি টাকা পয়সার আদান প্রদানের ব্যাপার থাকে। অফিসের কাজ সুভাষ অন্য অফিসবয়দের দিয়ে করায়। তবে ব্যতিক্রমও আছে, যেমন অফিসের ষ্টেশনারী জিনিসপত্র ফটোকপির কাগজের বান্ডিল, পেন, পেন্সিল, ইরেজার, স্কেল, নানা প্রকারের ফাইল ইত্যাদির হিসেব রাখা সুভাষই করে। কাউকে কোন আইটেম ইস্যু করার পর সেটা একটা রেজিস্টারে লিখে, সেই ব্যক্তির সই নেওয়ার নিয়ম আছে। কিন্তু সুভাষকে কারুর সই নিতে বড় একটা দেখা যায় না। সে-সব কাজ সুভাষ নিজে নিজেই করে নেয়। শুধু নিজের ওভারটাইমের জন্য একটা রেজিস্টারে সই নেয়। কাঁচা বিল, পাকা বিল, ভুয়ো বিল এসব সুভাষ জানে। সুভাষ জানে, স্বপ্ন সফল করতে হলে, নিজের লক্ষ্যে অবিচল থেকে, সব বাধা বিপত্তি তুচ্ছ করে সামনে এগিয়ে যেতে হয় ক্রমাগত।

সুভাষ স্বপ্ন দেখে। নানারকম স্বপ্ন কখনো জেগে জেগে, কখনো ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে। কখনো এইসব সীমারেখা মুছে যায়, শুধু স্বপ্ন জেগে থাকে। সেই স্বপ্নে মাছরাঙা পাখি আছে, তালগাছ আছে, ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি আছে, সমুদ্র আছে, বিকিনি পরা সুন্দরীরা আছে। কিন্তু ঠাকুমার মুখে শোনা গল্পের বীর নায়ক সর্দার পাপান্না কোথাও নেই। 

বস্তুত তালগাছের সঙ্গে সুভাষদের সম্পর্ক অত্যন্ত গভীর। সুভাষের বাড়ি মেহবুবনগর জেলার জাডচেরলা মণ্ডলে। তার স্বপ্নই তাকে টেনে এনেছে হায়দ্রাবাদে। তারা গৌড় সম্প্রদায়ের। তাদের জাত ব্যাবসা হল খেজুর এবং তালগাছ থেকে রস নিষ্কাশন করে তা বিক্রি করা। তাছাড়া কবিরাজি, চাষবাস, মদের ব্যবসা এসবও করে থাকে অনেক লোকে। শিক্ষিত লোকজন অনান্য সম্প্রদায়ের মতোই, তাদের আদি ব্যবসা ছেড়ে চাকরি-বাকরি অথবা অন্য ব্যবসা করে। বিক্রি করার আগে সেই রস নিজগুণেই তাড়িতে পরিণত হয়। তাড়ির শক্তিবৃদ্ধির জন্য তাতে ডায়াজেপাম এবং অ্যাল্প্রাজোলাম গোত্রের কিছু কেমিক্যাল মেশানো হয়ে থাকে, তাতে নেশাটা জমে ভাল। তাড়ি দুই প্রকার ইথা কাল্লু এবং থাটি কাল্লু। খেজুর রস থেকে বানানো তাড়ি হল ইথা কাল্লু, ওটি মানে থাটি কাল্লু হল তালরস থেকে বানানো তাড়ি। তাড়ি হয়ে উঠবার আগে রসেরও একটা শৈশবের পবিত্রতা থাকে, সেই রসকে নীরা বলা হয়। তবে নীরা পাওয়া সহজ নয়, ‘হঠাৎ নীরার জন্যমন কেমন করে উঠলেও - কারণ কাল্লুতেই মাল্লু (মালকড়ি) লাভ হয় বেশি।

সরকার অনুমোদিত দোকানে কাল্লু পাওয়া যায়, যাকে বলা হয় প্রভুত্ব কাল্লু দুকানমতার জন্য সরকারকে লাইসেন্স ফি দিতে হয়। গৌড় সম্প্রদায়ের লোকেরা সমবায় পদ্ধতিতে এইসব দোকান চালায়। কয়েকজন মিলে নিলামে কিনে নেয় কাল্লু দোকান চালাবার অধিকার। বিনিয়োগকারী হিসেবে লভ্যাংশের সিংহভাগ তারাই পায়। বাকী যারা গৌড় সমিতির সাধারণ সদস্য তারাও দোকানের আয় থেকে প্রত্যেক মাসে নিয়মিত লভ্যাংশের টাকা পেয়ে থাকে। কোন সদস্য মারা গেলে উত্তরাধিকার সূত্রে তাঁর পুত্র অথবা বিধবা স্ত্রী সেই টাকা পায়। কন্যাসন্তান টাকা পায় না।       

সুভাষ প্রতি শনিবারে হায়দ্রাবাদ থেকে জাডচেরলা চলে আসে। ঘণ্টা দুয়েক লাগে বাসে। আবার সোমবার সকালে ফিরে যায়। ওখানে আম্মা বয়েজ হোস্টেলে থাকে। নামে বয়েজ হোস্টেলে হলেও সেখানে যারা থাকে তাদের ঠিক বয় বলা যায় না। প্রায় সকলেই ছোটখাটো চাকরি করে। একজন আছে ছাত্র। এম কম পাশ করার পর এখন নানারকম কম্পিটিটিভ পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছে।


এই শনিবারে বাড়ি ফেরার পর সুভাষের ঠাকুমা আবার ঘ্যানঘ্যান শুরু করেছে, ‘সুভাষ, তুই আবার লেখাপড়াটা চালু কর। এখনই তোর চাকরি করার কি দরকার? তোর বাপ আর আমি যতদিন বেঁচে আছি, তোকে আমাদের খাওয়া-পরা নিয়ে ভাবতে হবে না

সুভাষের ছোটবেলাতেই তার মা মারা যায়। মাকে তার ভাল করে মনেও পড়ে না। সে ঠাকুমার কাছেই মানুষ। ঠাকুরদা ছিলেন কবিরাজ, এই অঞ্চলে তার যথেষ্ট সুখ্যাতি ছিল। তিনি মারা গেছেন বছর তিনেক আগে। এখনও বাড়ির এক কোণে রাখা আছে তার ব্যাবহৃত ছোট শিলনোড়া, হামানদিস্তা, কয়েকটি চাটু, ঘটি, বাটি। ঝোপে-জঙ্গলে ঘুরে ঘুরে সংগ্রহ করতেন গাছের ছাল, পাতা, ফুল, মূল এইসব। তাই দিয়ে নানারকম রস, পাঁচন এসব বানিয়ে দিতেন এলাকার লোকজনকে। কাজও হত নিশ্চয়ই, নাহলে এত লোক কেন ভিড় জমাবে তাঁর দাওয়ায়?
সুভাষ বলে, ‘নানাম্মা, বেশি লেখাপড়া শিখে হবেটা কী? ঠাকুরদা তো চেষ্টা করেছিলো, জাতব্যবসা ছেড়ে কবিরাজি ধরেছিল। কিছু লাভ হয়েছে? সারাজীবন তো দেশ, আজাদি, সুভাষ বোস এসব কথাই শুনে গেলাম তার মুখে। গৌড় ঘরে জন্মেছি। তাড়ি ব্যবসাটা যদি ফলাও করে করতে পারি...তুমি দেখতে থাক শুধু, কোথা থেকে কোথায় গিয়ে পৌঁছোই

তোর ঠাকুরদা আর বেশি পড়তে পারল কোথায়? অভাবের সংসার, ছোট থেকেই রোজগারের ধান্দায় নামতে হল। তাই লোকের জমিতে মজুর খাটা। চাষবাসও খুব ভাল হয় না ওই পাথুরে জমিগুলোতে। খুব কষ্টেসৃষ্টে সংসার চলত। মানুষটা তাও লোকের জন্য ভাবত। সন্ধেবেলায় পাড়ার ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের পড়াত। বিপদে আপদে লোকের পাশে থাকত। কত অসুখ সারিয়েছে কবিরাজি করে। এখনও লোকে নাম করে তার। তুই যে বলছিস গৌড়দের জাতব্যাবসা - ওরে কবিরাজিও গৌড়দের জাতব্যাবসা।  

কবিরাজিতে আজকাল আর কারুর ভরসা নেই। ভরসা নেই বলে পয়সাও নেই। তাই আজকাল আর কেউ ওই লাইনে যায় না। এখন টাকাপয়সা সব অ্যালোপ্যাথিতে। কত বড় বড় রোগ সব অ্যালোপ্যাথিতে ঠিক হয়ে যাচ্ছে। তুমি হায়দ্রাবাদ গেলে, একেকটা হাসপাতাল দেখে ভিরমি খাবে। হাসপাতাল, না ফাইভ স্টার হোটেল, না শপিং মল বোঝা মুশকিল

হ্যাঁরে ওইসব ফাইব ইস্টার হোটেল, মল-টল কী জিনিস? আমাকে দেখাবি?’

তাহলে একবার আমার সঙ্গে চলো হায়দ্রাবাদে। শপিং মলে ঘুরিয়ে দেখাব। বিশাল বড় বড় বিল্ডিং, চার-পাঁচ তলা। অটোমেটিক সিঁড়ি উঠছে, নামছে। ঝাঁ চকচকে মেঝে, তেমনই লাইটিং এর কাজ। কোথাও কোন অন্ধকার নেই, নোংরা নেই। গরম নেই, ঘাম নেই, ফুল এসি। জামাকাপড়, মশলাপাতি, সব্জি, ফল, ঘড়ি, ফার্নিচার, ইলেক্ট্রনিক জিনিস, লেডিজ কসমেটিক্স, সুটকেস, বই, ষ্টেশনারী জিনিস - তোমার যা চাই সবই পেয়ে যাবে একজায়গায়, দশটা দোকান ঘোরার দরকার নেই। ট্রলি ঠেলে ঠেলে লোকে বাজার করে। কাচের দেওয়াল দিয়ে ঘেরা আলাদা আলাদা দোকান। কাচের পেছনে সাদা সাদা নকল মেয়ে মানে পুতুল, শাড়ি-স্কার্ট-প্যান্ট পরে একেবারে টিপটপ। ট্রলি ঠেলে ঠেলে লোকে বাজার করেকাচের সামনে যারা হেঁটে বেড়ায়, সেইসব টিপটপ আসলি পুতুলদের কথা একবার মনে মনে স্মরণ করে নেয় সুভাষ।

আমরা কি কিছু কিনতে পারব ওইসব জায়গায়? দামও হবে নিশ্চয়ই গলাকাটা

না গো নানাম্মা, দাম বেশি নয়। আমাদের এখানের বাজারে যেরকম দাম তেমনই। তাছাড়া এক জায়গাতেই পাওয়াও যায় সবকিছুসেইজন্যই ত এখন যত ভিড় সব মলে। ছোটখাটো দোকানদারদের অবস্থা খুব খারাপ

কত কী দেখবো কালে কালে? এত পয়সা মানুষের হাতে আসে কী করে? আমাদের তো দুবেলার ভাত জোগাড় করতেই জান বেরিয়ে যাচ্ছে। যত ভাবি তত চিন্তা বাড়ে। শুধু ইয়েল্লাম্মা দেবীকে ডেকে বেঁচে আছি। মায়ের পেসাদই ভুলিয়ে দেয় সব জ্বালা যন্তন্না

এমন দিন চিরকাল থাকবে না গো নানাম্মা। আমাদের বড় বাড়ী হবে হায়দ্রাবাদে। বড় ব্যাবসা হবে। ব্যাবসা মানে শুধু কাল্লু দুকানম নয়, একেবার রেস্টুরেন্ট যাকে বলে রেস্টুরেন্ট অ্যান্ড বার। সাইনবোর্ডে বারলেখা থাকবে বিশাল বড় আকারে, লাইট দিয়ে জ্বলজ্বল করবে। রেস্টুরেন্ট কোথায় লেখা আছে, লোকে খুঁজে পাবে না। সব রেড্ডি ওয়াইনস, যাদব ওয়াইনস, দেবদেবীদের নাম দেওয়া ওয়াইন শপের জায়গায় হবে গৌড় ওয়াইন্স, ব্র্যাকেটে ওনলি কাল্লু সোল্ড হিয়ার। তাড়ি ব্যাবসা করেই একদিন আমি কত বড়লোক হব, তুমি দেখে নিও। আমাদের পাঁচ একর জায়গার পুরোটাতেই তালগাছের চারা লাগিয়ে দেব। কয়েক বছরের মধ্যে সেই সব গাছ বড় হয়ে যাবে। তারপর হাঁড়ি হাঁড়ি রস আর কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা

পুরো জমিতে তাল গাছের চারা বসিয়ে দিলে, অন্য চাষবাস হবে কী করে? ধান না হলে, সব্জি না হলে আমরা খাব কী? আর শোন বাবা, পুরো জমিতে কেউ তালগাছ বসিয়েছে বলে বাপের জম্মে শুনিনি। তালগাছ হল ভগবানের দান, গৌড়দের জন্য ভগবান সৃষ্টি করেছেন। জমির ধারে ধারে, ঝোপে-ঝাড়ে যেখানে অন্য চাষ হয় না, সেখানে আপনা থেকেই হয়, তাকে আলাদা করে পুরো জমি জুড়ে চাষ করতে হয় না। মাথাটা ঠাণ্ডা রাখ বাবানানাম্মার গলায় ভয় ও সংশয় দুইই মিশে থাকে।

সুভাষ নাছোড়। পুরো ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ছকে ফেলেছে। এরকম বাধা-বিপত্তিকে পাত্তা দেওয়া মানে নিজের স্বপ্নের সঙ্গে সমঝোতা করা, সেটা সুভাষ জানে। বাবাকে নিয়ে তার বিশেষ চিন্তা নেই, তাকে সহজেই বোঝানো যাবে। সুভাষের ইচ্ছেয় বাধা দেওয়ার মানুষ তিনি নন, কিন্তু ঠাকুমাকে বোঝাতে না পারলে, পুরো ব্যাপারটাই কেঁচে যাবে। তখন ঠাকুমার কথা শুনে, বাবাও বেঁকে বসবে।

সুভাষ বলে, ‘আচ্ছা নানাম্মা, একটা কথা বলো, আমাদের যে রকম দিন কাটছে, তুমি কি তাতে খুব খুশী? একে কি মানুষের মত বাঁচা বলে? একটু আগে তুমিই বললে ইয়েলাম্মা দেবীর প্রসাদ খেয়ে সব ভুলে থাকি। তা প্রসাদটা কী? না থাটি কাল্লু তালগাছের তাড়ি। তুমি যদি সেই প্রসাদ খেয়ে সব ভুলে থাকতে পারো, অন্যদেরও সেভাবেই সব ভুলে থাকার ব্যাবস্থা করে দাও হয়তো এমনটিই দেবীর ইচ্ছে। তুমি আর আমার কাজে বাগড়া দিও না

ঠাকূমা চুপ করে থাকে। সুভাষের কথা শুনে বুঝতে পারে, সে যা করবে ঠিক করে ফেলেছে, তা থেকে পিছু হটার কোন সম্ভাবনা নেই। সুভাষের তাতাগারু (ঠাকুরদা) থাকলে হয়তো যুক্তি দিয়ে বুঝিয়ে, ধমকে-চমকে, সুভাষকে নিরস্ত করতে পারত। নানাম্মা আঁচলের খুঁট দিয়ে চোখের জল মোছে।

সুভাষ আবার বোঝাতে থাকে। বলে, ‘শোনো, আমি পুরো ব্যাপারটা একেবারে মহেশবাবুর সিনেমার মত চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি। ক্ষেত জুড়ে শুধু সারি সারি তালগাছ। লম্বা, সোজা, আকাশে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে কারও তোয়াক্কা না করে। কী রোয়াব! আহা! তালগাছ বেয়ে শুঁয়োপোকার মত উপরে উঠে যাচ্ছে আমারই ভাড়া করা গৌড় লেবাররা। একেবারে ফিটফাট ইউনিফর্ম পরা লুঙ্গি আর তেলচিটে জামা-গেঞ্জি নয়। কোমরে ছেনি-বাটালির বদলে রস বের করার আধুনিক যন্ত্র। সেসব এখানে পাওয়া যায় না, বিদেশ থেকে আনাতে হবে। সারি সারি মাটির হাঁড়ি নিচে বসানো। লেবাররা রস এনে তাতে রাখবে। সেই হাঁড়িগুলো গাড়িতে করে চলে যাবে আমার ফ্যাক্টরিতে। সেখানেই কেমিক্যাল মিশিয়ে তৈরি হবে কাল্লু। সেই কাল্লু বোতলে ভরে চলে যাবে হায়দ্রাবাদের সব ওয়াইন শপে, বার-অ্যান্ড-রেস্টুরেন্ট অথবা রেস্টুরেন্ট-অ্যান্ড-বারে। ঘরে ঘরে নেশা ছড়িয়ে দিতে হবে নানাম্মা। স্ট্যাটাস ইম্প্রুভ করতে হবে কাল্লুর স্ট্যাটাস, আমাদের স্ট্যাটাস। আমি স্বপ্নে দেখি লোকে বিয়ার, হুইস্কি, রাম ছেড়ে শুধু কাল্লু খাচ্ছে। শহরের উচ্চবিত্ত লোকেদেরও কাল্লু খাওয়া ধরাতে হবে। তুমি কী জানো কাল্লু খেলে কত রোগজ্বালা সেরে যায় শুনেছি কিডনি স্টোন, জন্ডিস এমনকি ক্যান্সার পর্যন্ত সেরে যায়। যদি শিব ঠাকুরের দয়ায় কাল্লু ব্যাবসা একবার জমে যায়, তাহলে পরে বিদেশে পর্যন্ত কাল্লু রফতানি করা যাবে। ভেবে দেখো যখন বিদেশে বসে লোকে কাল্লুর পেগে চুমুক মারবে তখন কি তাদের মনে পড়বে না নিজেদের দেশের কথা ফেলে আসা তেলেঙ্গানা, অন্ধ্রের সারি সারি তালগাছের কথা মিট্টি কি খুশবু মানে আসলে তাড়ির মোহময় সুবাস’? সুভাষ কথা বলতে বলতে একেবারে বিহ্বল, বিবশ হয়ে যায়।

একটু থেমে সুভাষ শুরু করে, ‘তেলেঙ্গানা, অন্ধ্রের গৌড় সমাজে ছোট-বড় নেতা, মন্ত্রী তুমি অনেক পাবে, কিন্তু এত বড় ব্যাবসায়ী আর খুঁজে পাবে না। তুমি দেখো, একদিন আমার নামও ইতিহাসে লেখা হবে। তুমি তো এত সর্দার পাপান্না গৌড়ের কথা বলো, একদিন দেখবে আমার নামও লোকের মুখে মুখে ফিরবে

সর্দার পাপান্নার কথায় সুভাষের ঠাকুমার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠে। বলে, ‘শোন, তুই তো শুনতে চাস না তবুও তোকে সর্দার পাপান্নার গল্প বলি। তাঁরও তো গৌড় ঘরে জন্ম হয়েছিল, কিন্তু চাষবাস করে বা কাল্লু বিক্রি করে জীবন কাটানোর কথা তিনি কখনও ভাবেন নি। তাঁর লক্ষ্য ছিল অনেক উঁচুতে। মুসলমান শাসকদের অত্যাচার থেকে গরিব হিন্দুদের তিনি বাঁচিয়েছিলেন। তাঁর নিজস্ব সেনাদল বানিয়ে লড়াই করেছিলেন মোগল শাসকদের বিরুদ্ধে। ওয়ারাংগাল, ভঙ্গীর, শাহপুরম এইসব জায়গা নিজের দখলে নিয়ে নিজের রাজত্ব চালু করে দিয়েছিলেন। পাহাড়ের উপর পাথরের কেল্লা বানিয়েছিলেন থাটিকোন্ডা, শাহপুরম এইসব জায়গায়। করিমনগরের পাশে হুস্নাবাদে একটা মন্দির বানিয়েছিলেন, ইয়েল্লাম্মা দেবীর। আমাকে নিয়ে যাবি ওই মন্দিরে, পরের বছর জাতারায়?’

ওঃ, ঠাকুমার সব কথাবার্তা শেষ হয় কিছু না কিছু বায়নায়। ইয়েল্লাম্মা অথবা রেণুকা দেবী হলেন ঋষি জামদ্যগ্নির পত্নী, পরশুরামের মাতা। কর্ণাটকের বেলগাঁওতেও এক বড় মন্দির আছে ইয়েল্লাম্মা দেবীর, সেখানে এখনও দেবদাসী প্রথা চালু আছে বলে শোনা যায়। নানাম্মা সুভাষের বিয়ে-সংক্রান্ত কোন মানত করেছে কিনা কে জানে। সুভাষ কথা ঘোরানোর জন্য বলে, ‘আচ্ছা, আর কী জানা যায় পাপাডু সম্পর্কে?’

শোন তবে। পাপাডু যখন ছোট, একদিন মাঠে গেছে গরু চরাতে। গরু মাঠে ঘুরে ঘুরে ঘাস খাচ্ছে। পাপাডু একটা গাছের তলায় এসে বসেছে। কিছুক্ষণ পরে একজন লোক পাপাডুর পাশ দিয়ে যেতে যেতে দেখে এক অদ্ভুত দৃশ্য! পাপাডু অঘোরে ঘুমোচ্ছে গাছের তলায়। মাথার কাছে বসে আছে এক বিশাল গোখরা সাপ। ফণা ছড়িয়ে দিয়েছে সামনে, যাতে পাপডুর মুখের উপর রোদ না পড়ে। তখনই বোঝা গেছল, এই ছেলে বড় হয়ে রাজা হবে। আমাদের কেষ্ট ঠাকুরের মাথায়ও তো সাপ ফণা ধরেছিল।

নানাম্মা, আমার ছোটবেলার এমন কোন নাগ-কাহিনী নেই? সাপ না হোক, অন্তত কোন টিকটিকি-ফিকটিকিও মাথা বাড়ায় নি আমার মুখের উপরে? নিদেনপক্ষে নেতা-মন্ত্রী কিছু তো হওয়ার চান্স থাকতো।সুভাষ আর নানাম্মা দুজনেই হেসে উঠে। 

সুভাষের আবছা মনে পড়ে, তার ঠাকুরদাও তাকে পাপান্না গৌড়ের কাহিনী শুনিয়েছিল বটে, কিন্তু সেটা ঠিক এরকম ছিল না। তাতে যেন তাঁকে হিন্দু গরিবের ত্রাতা অথবা স্বাধীনতা সংগ্রামী বলে মনে হত না বরং এক অতি উচ্চাকাঙ্ক্ষী, লুটেরা বলে মনে হত যিনি নিজের স্বার্থসিদ্ধি ও ভোগবিলাসের বাসনায়, নিজস্ব সেনাদল বানিয়ে, অবাধে লুটপাট চালাতেন। মনে হয় ঠাকুরদার এমন চিন্তাভাবনা থেকেই সুভাষের নাম সুভাষ হল নাহলে তো পাপান্নাও হতে পারত।

                                                  

হে, সর্দার সরভাই পাপান্না গৌড়, গ্রাম প্রধানের সন্তান, যে-গৌড়জীবন তুমি ঘৃণা ভরে ত্যাগ করেছিলে, সে-পথেই আমার সিদ্ধিলাভ হবে একদিন, তুমি দেখে নিও। ডাকাতদল বানিয়ে লুটপাট করে এখন আর কিছু হয় না। দেশ স্বাধীন হয়েছে। দেশের আইন-কানুন বদলে গেছে। এখন উঁচুতে উঠতে গেলে হয় ব্যাবসা নয় রাজনীতি। দুটোই একসঙ্গে চালাতে পারলে সোনায় সোহাগা’ – আম্মা বয়েজ হস্টেলের তিনতলার একচিলতে বারান্দায় দাঁড়িয়ে এসবই ভাবছিল সুভাষ। দৃষ্টি সামনের রাস্তায়। রাস্তার ধারে ধারে সারি সারি দোকান। শ্রী সত্য সাই হট চিপস, মোবাইল ফোন, জামাকাপড়, ছোট মুদিখানার দোকান, বড় সুপারমার্কেট, হার্ডওয়্যারের দোকান, দুর্গা মাতা ওয়াইনস, বই খাতার দোকান। স্নেহা চিকেন সেন্টার খুব ব্যস্ততা সকাল থেকেই। কর্মীরা সকাল থেকেই মুরগি কাটা, চামড়া ছাড়ানো, ওজন করায় ব্যস্ত। সামনের কোঁকড়ানো চুলের ছেলেটা যে মাংস ওজন করে পিস পিস করে কাটছে, তার টি-শার্টে লেখা - বিয়িং হিউম্যান। সুভাষও একটা ওইরকম টি-শার্ট কিনবে।

ওয়াইন শপের সামনের ফুটপাথটা এখন খালি। ঠেলাগাড়িগুলো অবশ্য রাখা আছে। সন্ধ্যের সময় থেকেই মোচ্ছব চালু হবে। কাচে ঘেরা ঠেলাগাড়িতে শুরু হবে নানাবিধ ভাজাভুজি ডালের বড়া, মিরচি বড়া, মেদু বড়া, পুলুগু, পকোড়া ইত্যাদি মদ্যবিক্রয়ের অনুসারী শিল্পসমূহ। পাশের মিষ্টির দোকান থেকেও প্রয়োজনমত চিপস, মিক্সচার, ‘কুলড্রিংক, প্লাস্টিকের গ্লাস কিনে নেওয়া যায়। সন্ধ্যের সময় আশেপাশের কারখানার শ্রমিক, অটো ড্রাইভার, ছোট ব্যাবসায়ী, বেকার যুবকেরা ভিড় করে এখানে। দোকানের গ্রিলের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে আসে পৌওয়া বোতল, কিংবা পাউচ প্যাক। আপাতত এরাই হবে সুভাষের টার্গেট কাস্টমার। একদল আছেন যারা কার-কাম-বার প্রথায়, ফুটপাথেই গাড়ি পার্ক করে, গাড়ির ভিতরে বসে, এসি এবং মিউজিক চালিয়ে, স্যাট করে দু চুমুকে মেরে বেরিয়ে যান। আরেকদল গাড়ি থামিয়ে, নিজে অথবা ড্রাইভারের হাত দিয়ে বোতল আনিয়ে হুশ করে বেরিয়ে যান। এই দুই দলকে তাড়ির নেশা ধরাতে গেলে সুভাষকে অনেক কসরত করতে হবে। 
 
একটু দূরে সুভাষ দেখতে পেল একজন লোক একটা ঢ্যাঙ্গা তালগাছে চড়ছে। এখানে এখনও বেশ কিছু তালগাছ আছে আশেপাশে। সেইসব তালগাছ সুভাষকে জাডচেরলার কথা মনে পড়ায়। শিরীষ, কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়া, শালিক, বুলবুলি, টুনটুনিও আছে। ফলে বেশ একটা গ্রাম-গ্রাম ভাব - যদিও জায়গাটি জি এইচ এম সি মানে গ্রেটার হায়দ্রাবাদ মিউনিসিপ্যাল করপোরেশনের আওতায় পড়ে। লোকটির সাজপোশাক সুভাষের অতি পরিচিত। মাথায় একটা গামছা বাঁধা, একটা গামছা কোমরে। পরনে তেলচিটে গেঞ্জি, আন্ডারপ্যান্ট এবং লুঙ্গি। আন্ডারপ্যান্ট এবং লুঙ্গি বেশ শক্ত করে একসঙ্গে পরা আছে এবং তার সীমানা শেষ হয়েছে হাঁটুর অনেকটা উপরে। এই ধরনের ঝুলের প্যান্ট দীপিকা পাদুকোনরা পরলে তাকে হটপ্যান্ট বলা হয়। দুটি মাটির হাড়ি, দড়ি এবং আংটা দিয়ে কোমরের সাথে আটকানো আছে। পৌরাণিক যোদ্ধাদের যেমন পেছনে তীর রাখার জন্য একটা তূণ থাকতো, লোকটির পেছনেও একটা ছোট ঝোলা টাইপের জিনিস কোমরের সঙ্গে লটকানো। তার মধ্যে দু-তিনটে আলাদা আকৃতির দা এবং বাটালি - তার জীবন-যুদ্ধের আয়ুধসমূহ। মোটা নাইলন দড়ির উপর গাড়ির চাকার টিউব ফিতের মত সরু করে কেটে কোণাকুণি ভাবে নিচে থেকে উপর অব্দি জড়ানো যাতে দড়িতে গা টা না ছড়ে যায়। দড়ির দুই প্রান্তে দুটো আংটা লাগানো। এই মোলায়েম দড়ি বগলের তলা দিয়ে গলিয়ে তালগাছের সঙ্গে আটকে নেয় লোকটি। যেন দুই দীর্ঘ বাহু দিয়ে আলিঙ্গন করে তাল গাছকে। পায়ের জন্য অন্যরকম ব্যবস্থা। মোটা নাইলন দড়িকেই পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে গামছার মত মোটা করে দুই পায়ে পরে নেয়। সেটা দিয়ে গাছকে ঠেলা দেয় আর হাতের দড়ি দিয়ে গাছকে টানে। এভাবেই টানা-ঠেলা, উত্তল-অবতলের ক্রিয়ায় শুঁয়োপোকার মত উপরে উঠতে থাকে লোকটি। উপরে উঠে গাছে টাঙ্গানো হাঁড়িগুলো থেকে এক এক করে রস ঢেলে নেয় সঙ্গে নিয়ে যাওয়া হাঁড়িগুলোতে। সেগুলোকে সাবধানে আটকে নেয় নিজের কোমরের সাথে ঝোলানো আংটায়। তারপর ধীরে ধীরে নীচে নেমে আসে। হাঁড়িগুলো ঝুলিয়ে নেয় সাইকেলের হ্যান্ডেলে। সামনের দোকান থেকে একটা সিগারেট কিনে, ফুঁকতে ফুঁকতে সাইকেল ধরে হাঁটতে থাকে।

সুভাষ দীর্ঘশ্বাস ফেলে! চাকরিটা তার দরকার ছিল এখনও। অন্তত যতদিন না ব্যাবসাটা দাঁড়াচ্ছে। এদিক ওদিক থেকে বেশ দু-পয়সা আসতে শুরু করেছিল। কিন্তু দু-পয়সা আমদানির ঝুঁকিও থাকে। সুভাষ যখন এ ফোর সাইজের বান্ডিল বান্ডিল কাগজ, অফিসের প্রায়ান্ধকার ব্যালকনি থেকে পাশের বাড়ির ব্যালকনি তে ছুঁড়ে ছুঁড়ে পাঠাচ্ছিল, তখনই নীচে থেকে অ্যাডমিন অফিসারের চোখে পড়ে ব্যাপারটা। অতএব অফিসবয়ের তৎক্ষণাৎ বহিস্কার। এ নিয়ে বেশি ঘাঁটাঘাঁটি করলে মুশকিল। কারণ - কতদিন ধরে চলছে এইসব কারবার, কত এ-ফোরে কত প্রিন্ট আউট, কাগজের ডানা থাকে কিনা, এইসব সঙ্গত প্রশ্নের উত্তর অ্যাডমিনেরও জানা ছিল না।

দিন পনের হল সুভাষ জাডচেরলা ফিরে এসেছে। এখানে কিছুদিন কাটিয়ে হায়দ্রাবাদ ফিরে যাবে। ওখানে গিয়ে আবার চাকরির চেষ্টা করবে। হাতে এখন অঢেল সময়। মাঝে মাঝে নিজেদের চাষের জমিতে যায়। পুরো জমি জুড়ে তালগাছ। তারা নিজেদের নিয়মে বাড়ছে, সুভাষের দ্রুতগতির স্বপ্নের সঙ্গে পাল্লা দেওয়া তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। লোকাল নেতাদের সঙ্গেও সুভাষ যোগাযোগ বাড়িয়েছে। অনেকেই খুব উৎসাহ দিয়েছেন। বলেছেন, সুভাষের ভেঞ্চার সফল হলে রাজ্যের পানচিত্র বদলে যাবে। ইতিমধ্যে তেলাঙ্গানা সরকার নতুন আবগারি নীতি প্রণয়ন করেছেন। লাইসেন্স ফি বাড়ছেবড় শহরে, বড় আউটলেটের জন্য লাইসেন্স ফি কোটি টাকা ছুঁতে চলেছে। লটারির মাধ্যমে লাইসেন্স দেওয়া হবে। হায়দ্রাবাদের নাইট লাইফ বদলে যাবে। আরও অনেক পাব এবং মাইক্রো-ব্রিউয়ারি খুলবে। এরপরেই যেটা হল বিনামেঘে বজ্রপাতের মত - আবগারি বিভাগ থেকে সব বেআইনি কাল্লু ঠেক এবং ভেজাল মদের দোকান বন্ধ করে দেওয়া হল। সকলকে বিশুদ্ধ তালরস পান করার নিদান দেওয়া হল।

এক সপ্তাহ কাটল ভালোয় ভালোয়। তারপরেই নেশাড়ুদের মধ্যে উইথড্রয়াল সিম্পটম দেখা যেতে লাগল। সে-অবস্থা ভয়ানক। সুভাষ গিয়েছিল মেহবুবনগর জেলা হাসপাতালে। দেখল রোগী, তাদের আত্মীয়স্বজন, বাইরের লোকের ভিড়ে গিজগিজ করছে হাসপাতাল চত্বর। পা ফেলার জায়গা নেই। যেন বিরাট কোন প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটে গেছে! নেশার জিনিস না পেয়ে রোগীরা চিৎকার করছে, হাত-পা ছুঁড়ছে, দেওয়ালে-মেঝেতে মাথা ঠুকছে, তাদের ধরে রাখা যাচ্ছে না। ডাক্তার, নার্সদের অবিশ্রান্ত ছোটাছুটি চলছে। হাসপাতালে আর রোগী নেওয়ার ক্ষমতা নেই কেউ শুনছে না সে-সব কথা। এমারজেন্সি, জেনারেল ওয়ার্ড কোথাও বেড খালি নেই, মেঝেতে গড়াচ্ছে রোগীরা। কারুর চোখ বিস্ফারিত, মুখ থেকে লালা গড়াচ্ছে। হঠাৎ হঠাৎ ফিট হয়ে যাচ্ছে কেউ। হাতের শিরা কেটে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিল কেউ বা। বাড়ির লোকে হাতে গামছা জড়িয়ে নিয়ে এসেছে হাসপাতালে। নানারকম খবর উড়ে বেড়াচ্ছে হাসপাতালে কেউ বলছে গত চারদিনে নয় জন মারা গেছে, কেউ বলছে কুড়ি জন। সারা রাজ্যে হাসপাতালেও ভর্তি হয়েছে চারশোর উপর লোক।

সরকার ও বিরোধী পক্ষের চাপানউতোর শুরু হয়ে গেছে। বিরোধী পক্ষ এটাকে হঠকারী এবং অসময়োচিত সিদ্ধান্ত বলছেন। বলছেন, এরকম সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে তার ফলাফল সম্পর্কে আন্দাজ করে নেওয়া উচিত ছিল, বিশেষত যেখানে স্বাস্থ-পরিষেবার এইরকম হাল। রুলিং পার্টির লোকাল নেতারা মাথা চুলকাচ্ছেন। ভাবছেন, হাইকমান্ড এই রকম একটা ডিসিশন না নিলেই পারতেন। গৌড় ভাবাবেগে আঘাত লাগতে পারে। তেলেঙ্গানার প্রায় পঁচিশ-তিরিশ লাখ লোক তাড়ি ব্যাবসার সঙ্গে যুক্ত। এত ভোটার......পরের বিধানসভা ভোটের যদিও এখন দেরী আছে। কোন কোন নেতা গোপনে পরামর্শ দিচ্ছেন, গোপনে আবার কেমিক্যাল মেশানোর জন্য। আশ্বস্ত করছেন যে বিশেষ চিন্তার কিছু নেই, কয়েকদিন পরে আবার সব আগের মত হয়ে যাবে।

সুভাষের মাথাটা ভোঁ ভোঁ করছে সকাল থেকে। কাল অনেকক্ষণ বসেছিল মাঠের ধারের তালপাতায়-ছাওয়া চালাটায়। আকাশ পাতাল ভেবেছে। চাকরিটা নেই। সামনের জমিতে শুধু তালগাছ। এদিকে কাল্লু ব্যাবসার ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। বাড়ীতেও স্বস্তি নেই। নানাম্মা তিনদিন ধরে সমানে চেঁচিয়ে চলেছে কাল্লুর জন্য। তাই আজ নানা (বাবা) সকাল থেকে বেরিয়ে গেছে, পাশের গ্রামে খোঁজ করবে, যদি কিছুটা তাড়ি সংগ্রহ করা যায়। সুভাষকে রেখে গেছে নানাম্মাকে পাহারা দেওয়ার জন্য। ঘরে ঘরে যা বিপদ-আপদ হচ্ছে, কিছুই বলা যায় না কখন কি ভালোমন্দ ঘটে যায়। সুভাষ চোখে চোখে রাখছে নানাম্মাকে। রান্নাঘরেও যেতে দিচ্ছে না। এমন সময় সহসা এক আইডিয়া খেলে যায় সুভাষের মাথায়! সে কদম কদম বাড়িয়ে এগিয়ে যায় বাইরের দরজার দিকে। যেতে যেতে দেখে নেয়, নানাম্মা রান্নাঘরে যাচ্ছে। কেরোসিনের টিন রাখা আছে সামনেই, নানাম্মা ঠিক পেয়ে যাবে। পরের দৃশ্যাবলীও সুভাষ কল্পনা করতে পারে নিখুঁতভাবে নানাম্মার বডি নিয়ে মিছিল চলেছে এম এল এর বাড়ি। সরকারের উপর চাপ বাড়ছে, আবার খুলে যাচ্ছে সব কাল্লু দুকানম, জনজীবন স্বাভাবিক হচ্ছে......সুভাষের দুচোখে আবার স্বপ্ন ফ্রেঞ্চকাট, মাছরাঙ্গা, বিকিনি-সুন্দরী!

[কিছু বাস্তব ঘটনার ছায়া আছে এই গল্পে, তাই সম্পূর্ণ কাল্পনিক বলা গেল না। কিন্তু কোন ব্যক্তি, সম্প্রদায় অথবা স্থানের সম্মানহানি এই গল্পের উপজীব্য নয়, ব্যবহৃত তথ্য কাহিনীর প্রয়োজনেই সেকথা পাঠক মাত্রেই বুঝবেন।]

শুভেন্দু বিকাশ চৌধুরী



কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন