পূজোর গল্প ~ অরুণিমা মন্ডল দাস


পূজোর গল্প
অরুণিমা মন্ডল দাস

রঞ্জন এক মধ্যবিত্ত পরিবারে বড় হয়ে ওঠা যুবক। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করে সদ্য বেকারের জ্বালা অনুভব করছে! কোনরকমে টিউশানি কোচিন করে নিজের হাতখরচ পরিবারকে   কিছুটা আর্থিক যোগান দিতে সহায়ক হয়েছে!

রঞ্জন যখন ছোট ছিল তাঁর পড়াশোনার প্রতি একদম মন ছিল না পাড়ায় পাড়ায় টো টো করে ঘুরে বেড়াত, এ ও বাড়ি পেয়ারা চুরি করা আড্ডা দেওয়া খেলা ধুলা করা প্রভৃতি নানারকম বদমাসি করে বেড়াত।

ক্লাশ নাইন থেকে তাঁর জীবনের এক চরম পরিবর্তন দেখা গেল। সে নিজেকে গুটিয়ে রাখত কেমন যেন অচেনা অজানা পরিবেশে বসবাস করতে শুরু করেছিল।  এমনিতে খুব খারাপ ছাত্র যে ছিল তা নয় মুখে মুখে অঙ্ক করতে পারত ইংরেজীর টেনস প্রো ভার্ব হু হু করে বলতে পারত একটানা এক দুবার পড়েই মুখস্থ করতে পারত।

আগেই বলেছি রঞ্জনের বাবা খুব ধনী ছিলেন না ব্যবসা বানিজ্য করে কোনরকম সংসার চালাত তবে রঞ্জন কে খুব ভালোবাসত বিশেষত এক ছেলে তাই তাঁর কোন ইচ্ছাই অপূর্ণ রাখত না ছোটবেলার নাগরদোলা বর্ণপরিচয় টিউশনি মাষ্টারের কোন অভাব ছিল না অভাব ছিল রঞ্জনের প্রকৃত বন্ধুর! তাঁর এই অভাব দূর করতে পাশের বাড়ির এক বান্ধবী বাড়িতে কথা বলতে আসত কিন্তু কিছুদিন মেশার পর রঞ্জন মেয়েটার প্রতি দুর্বল হতে শুরু করে মেয়েটির গায়ে হাত দেওয়া কিস করা অবস্থায় মায়ের কাছে ধরা পড়ে যায়!

প্রতি পূজোতে ঘুরতে যেত, সিনেমা দেখত হাতে হাত দিয়ে কত গল্প করত সব শেষ সেবারে অষ্টমীতে রঞ্জন একা বাড়িতে বসে হঠাৎ পাশের বাড়ির মেয়েটি
মেয়েটিঃ এ কি রঞ্জন! তুমি একা বসে আছ?
রঞ্জনঃ ভালো লাগছে না! কিন্তু তুমি এখানে? মা এসে পড়বে তাড়াতাড়ি যাও
মেয়েটিঃ তুমি মাকে এতো ভয় করো?
রঞ্জনঃ তো কি করব! সিনেমার হিরোদের বলব! আজা লড়লে”----আমি পালিয়ে করছি যা পারলে আটকাও?
মেয়েটিঃ না সেটা না তবে বাবা বলেছে আমাকে নাইন টেন অবধি পড়াবে তারপর আর পড়াবে না! বিয়ে দেবে!
রঞ্জনঃ তো বিয়ে করো! এখানে কি? যতসব!
মেয়েটিঃ তুমি এরকম কথা বলছ কেন? আমি বলছিলাম যদি----------
রঞ্জনঃ দেখো আমি পালাতে পারতাম যদি আমি নিজে স্বাবলম্বী হতাম কিন্তু তুমি তো সব জানো -----
আরে বাবা আমি তোমাকে নিয়ে কোথায় পালাব? সেই এইখানে এসে পড়তে হবে?
হা তুমি যদি আমার জন্য ওয়েট করো তাহলে দেখা যাবে!
মেয়েটিঃ তা কি করে ------ আমি বড়জোর এক বছর ওয়েট করব! সাত আট বছর! অসম্ভব! বাবা তো এখন থেকেই ছেলে দেখা শুরু করে দিয়েছে!
রঞ্জনঃ হা যাও না বিয়ে করে বরের লাথি ঝাঁটা খাও আর জাঙ্গিয়া ধোও! তোমাদের মেয়েদের না পড়াশোনা করে ভালো থাকতে সুখে থাকতে ভুতে গিলায়?

মেয়েটিঃ   মেয়েদের জীবনটাই এরকম গো! তুমি আর কি বুঝবে!

রঞ্জনঃ  হাঁ তাইতো তা এখানে এসছ কেন? যাও এখান থেকে দূর হও আগে! ----বলে তেলে বেগুনে জ্বলে উঠল!

মেয়েটিঃ    (কেঁদে কেঁদে) হ্যাঁ আমি তো এখন তোমার চোখের বিষ! যাও আমি আর কোনদিন তোমার সামনে আসব না! মরে গেলেও না -----বলতে বলতে কেঁদে বেরিয়ে চলে গেল!

ওদিকে রঞ্জন ও মনের যন্ত্রণায় ছটফট করতে লাগল চোখের জল বাঁধভাঙা বন্যার মতো ঝরে পড়ল।

ক্লাশ নাইনের সেই ঘটনার পর রঞ্জন  কে হোস্টেলে পাঠিয়ে দেওয়া হয় আর মেয়েটিকে এক টাকাওয়ালা ব্যবসায়ীর সংগে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয় দুজনের মধ্যে আর দেখা হয় নি।

হঠাৎ পূজোর মরশুমে রঞ্জন বাড়ি এসেছে ঠিক সেই সময় মেয়েটি ও বাপের বাড়িতে হাজির! আবার দেখা! চোখে চোখ রাখতেই দুজনের হৃদয় ব্যাকুল হয়ে উঠল! রঞ্জন এবারে একজন প্রতিষ্ঠিত যুবক সে নিজেকে আর ধরে রাখতে পারল না দু বাচ্চার মা সেই প্রেমিকাকে দেখতে বাড়িতেই পৌঁছে গেল
রঞ্জনঃ   কি রে কেমন আছিস?
মেয়েটিঃ   ভালো
রঞ্জনঃ   তা তো দেখতেই পাচ্ছি!
মেয়েটিঃ     তো তুমি কি ভেবেছিলে তুমি না বিয়ে করলে মরে যাব? তা হঠাৎ এতো বছর পর! কি মনে করে¡
রঞ্জনঃ    না কেমন আছিস সেটাই জানতে---------
মেয়েটিঃ    রঞ্জনদা আমি ভালোই আছি, তুমি এখান থেকে যাও! তোমার প্রতিবেশীরা আবার-----
রঞ্জন আগের থেকে একটু বেশী সাহসী আর নিজের প্রতি আত্মবিশ্বাসটা একটু বেশি হয়ে গেছিল-----
রঞ্জনঃ   ছাড়ো তো লোকের কথা! এখন তুমি আমার গেস্ট আর কিছু নয়! পূজোতে বেড়াতে এসছিস ---আমাদের বাড়িতে থেকে কদিন বেড়িয়ে যা---অবশ্যই তোর বরকে নিয়ে------
মেয়েটি----কি যে বল না ---তোমার সংগে কথা বলেছি শুনলেই আমার বর পুঁতে ফেলবে!
রঞ্জন ---- তাই! কি বলছিস রে!---
মেয়েটিঃ     আচ্ছা তা তুমি এখনো বিয়েটা করছ না কেন?
রঞ্জনঃ  আরে দূর বিয়েটিয়ে ভালো লাগে না!
মেয়েটিঃ   কাকিমা কিছু বলছে না! এখন তো তুমি বিয়ে করতে পারো?
রঞ্জনঃ   আচ্ছা শোন অষ্টমীর দিন আমাদের বাড়িতে যাস ---নিমন্তন্ন রইল!
মেয়েটিঃ না তা কি করে আমি অষ্টমীর দিন বাড়ি চলে যাব। 
বর বলেছে যেতে  না গেলে----- এছাড়াও আমার ছেলের পরীক্ষা কদিন বাদে----- টিউশনি নষ্ট হচ্ছে!
রঞ্জনঃ   আচ্ছা যা ভালো মনে করিস পুরোনো বন্ধুটার কথা রাখলে খুশি হতাম!

মেয়েটি ও রঞ্জনকে এতো বছর পর রঞ্জনকে দেখে উদাসীন হয়ে গেল ঠিকমতো পূজোর কেনাকাটাও করতে পারত না মনমরা হয়ে বসে থাকত মা খেতে  দিলে খেতে চাইত না শুধু রঞ্জনের বাড়ির দিকে চেয়ে বসে থাকত কখন একবার বেরোবে আর দেখা হবে!

ওদিকে রঞ্জন ও মানসিক কষ্ট পেল শরতের আকাশ যতটা না নির্মল ততটা দুর্বোধ্য ও যন্ত্রদায়ক মনে হল।  স্কুলে পড়াতে যেত ক্লাশে মন বসত না চুপচাপ বসে থাকত মেয়েটির করুন মুখ দীর্ঘশ্বাস যেনো তাকে জড়িয়ে কাঁদত আর অসহায়ভাবে তাকিয়ে থাকত।

এরকমভাবেই রঞ্জনের বিরহের দিনগুলি কাটতে লাগল। 

সকালে উঠে মেয়েটির মুখ দেখলেই কষ্ট ভুলে যেত কিন্তু সারাদিন স্কুলে মন বসত না মনে হতো বাড়িতে ফিরে এসে মেয়েটির সংগে সারাক্ষণ গল্প করে আদর করে চুম্বন দিয়ে সব যন্ত্রণা ভরিয়ে দিতে পারত?

ষষ্ঠীর দিন সকালে রঞ্জন মেয়েটির অপেক্ষা করছিল বারান্দাতে মেয়েটি ও এলো তারপর হঠাৎ এপারে এসে হাতে একটা চিরকুট দিয়ে চলে গেল ফোন করলে অসুবিধে কারণ বাড়ির সবাই রঞ্জনের নাম্বার চেনে।

চিরকুটতে লেখা ছিল রঞ্জন যেনো ষষ্ঠীতে কমলা কালারের পাঞ্জাবীটা পরে পূজো দেখতে বেরোয় আর সে থাকবে ছেলেকে নিয়ে চৌমাথার মোড়ে।

রঞ্জন ঠিক বিকেলবেলা পাঞ্জাবী পরে বাইক নিয়ে চৌমাথার মোড়ে গিয়ে দেখল মেয়েটি তাঁর ই পছন্দের হলুদ শাড়ি পরে ছেলেকে নিয়ে দাঁড়িয়ে!
রঞ্জন বাইকে মেয়েটিকে নিয়ে বসালো তারপর বাইক স্টার্ট করতে যাবে হঠাৎ মেয়েটি বলল রঞ্জনদা একটু দাঁড়াও ভালো করে শাড়িটা তুলে নি! ছেলেটাকে বসাই!

রঞ্জনঃ    আচ্ছা!
মেয়েটিঃ   কতদিন পর তোমার পূজো দেখতে!
রঞ্জনঃ কেনো তোর বর ঘোরায় না!
মেয়েটিঃ    না গো! তাঁর ওতো সময় নেই!
রঞ্জনঃ     তুই ভালো আছিস তো? তোর বর ভালোবাসে তো?
মেয়েটিঃ   যদি না বলি তাহলে তুমি কি আমাকে-------
রঞ্জনঃ    হ্যাঁ করতাম কিন্তু----------

সংগে সংগে পূজোর প্যান্ডেলে হাজির রঞ্জন কখনো ভিড়ে ঠাকুর দেখা পছন্দ করে না।  বিকেলেই পাঁচ দশটা প্যান্ডেলে ঠাকুর দেখে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরে বিশ্রাম নেয়।

কিন্তু আজ রঞ্জনের অনেকক্ষন বাইরে থাকতে ইচ্ছে করল আসলে মানুষের জীবনের প্রথম প্রেম প্রথম ভালোলাগা কখনো ভোলা যায় না সেই ক্লাশ নাইনে পড়াকালীন দুই বন্ধুর খুনসুটি হাতে হাত রাখার প্রথম অনুভূতি ভালো লাগা ----যা সত্যি ই অমূল্য! টাকা পয়সা দিয়ে কেনা যায় না।

যাক অনেকদিন পর দুই বন্ধু তে বেশ খানিকক্ষণ সময় পাশাপাশি বসে কাটাল। রঞ্জনের খুব ভালো লাগল।

ষষ্ঠী সপ্তমী অষ্টমী নবমী দশমী তাঁরা এইভাবেই সবার চোখ এড়িয়ে অনাবিল আনন্দের সাগরে ডুবে থাকল যেখানে কোন ঘৃণা নেই তাচ্ছিল্য নেই জাতপাত নেই  পাড়া প্রতিবেশীর অপমান নেই কোন সেক্সুয়াল রিলেশান ও নেই শুধু আছে অকৃত্রিম প্রেম এক আকাশ বরফের ঠান্ডা শান্তি?

এই চারদিনে দুই ছোটোবেলার প্রেমিক প্রেমিকা ছেলেবেলার দিনগুলিতে ফিরে গেল সেই মিষ্টি খাওয়ানো হাতে লাল ডুরি বেঁধে মায়ের আশীর্বাদ নেওয়া একসাথে হইচই করা সিনেমা দেখা ----------
রঞ্জন এই কদিনে নিজেকে চিনতে পারল না সে আগের সেই ছোট্ট রঞ্জন তে পরিণত হল তাঁর খাওয়া দাওয়া ঘুম স্বপ্ন সব ওই মেয়েটি মেয়েটির নাম ছিল ঋতু!

সারাদিন সারারাত শুধু ঋতু আর ঋতু!

দশমীর দিন মায়ের বিসর্জনের সংগে সংগে ঋতুকে আবার হারানোর ভয়ে বুকটা কেঁপে ওঠল কিন্তু সংসারের নিয়ম বিবাহিতা নারীদের নিজের ইচ্ছা বলে কিছু থাকে না সবটাই অপরের।

দশমীর দিন ------ঋতু রঞ্জনের বাড়িতে নাড়ু হাতে সবাই কে প্রণাম করতে এলো!

ঋতুঃ কালই আমি চলে যাচ্ছি কাকিমা পারলে আমার বাড়িতে যেয়ো রঞ্জনদা বলো যেন আমাদের বাড়িতে যেতে।

রঞ্জনঃ  ঋতু তুই এদিকে আসিস তো! তোর বর ফোন করেছিল!
ঋতুঃ  আচ্ছা বল কিজন্য ডেকেছিলে
রঞ্জনঃ তুই বুঝিস না?
বলেই রঞ্জনের চোখটা ছলছল করে উঠল!
ঋতুঃ    তুমি কাঁদছ! যাবার সময় কাঁদতে নেই হাসিমুখে বিদায় করতে হয় ভাবো না আমি মরে গেছি!
রঞ্জনঃ   একদম ফালতু কথা বলিস না! আর আমার নাম্বারটা লুকিয়ে রাখিস ছেলের যত্ন নিস ভালো থাকিস।
ঋতুঃ    হা আমি তো ভালোই থাকব! তুমিও ভালো থেকো পারলে সুন্দরী বৌদি আন!
রঞ্জনঃ  আমার আর বিয়ে করা হবে না রে! যদি বিয়ে করি তোর ননদ কে করব! তুই পারলে বলে দেখিস! তাহলে তোকে তো সারাজীবন কাছে পাব!----- নিজের চোখের সামনে দেখতে পাব----আর----

বলতে বলতেই রঞ্জনের চোখ বেয়ে জল পড়ে গেল ঋতু ও নিজেকে সামলাতে পারল না হাউহাউ করে কেঁদে উঠল!

আশেপাশের জড় পদার্থ গুলিও যেন দুজনের কষ্টে স্তম্ভিত হয়ে একদৃষ্টে তাকিয়ে!
রঞ্জন তখন আর নিজেকে সামলাতে পারল না ঋতুকে জড়িয়ে ধরে হাউহাউ করে কাঁদতে শুরু করল দরজা চাপা ছিল তাই বাইরে থেকে আওয়াজটা কেউ পেলো না!

ঋতুঃ চলো আমরা দুজনে কোথাও পালিয়ে যাই!
রঞ্জনঃ   না ঋতু তোর সংসার আমি ভাঙতে পারব না তুই সুখে থাকিস!
দুজনেই চোখে জল নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলো।  রঞ্জনের মা রঞ্জনের চোখে জল দেখে জিগ্গেস করায় রঞ্জন বলল ---না মা চোখে কি যেন পড়েছিল তাই!

অরুণিমা মন্ডল দাস


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন