ছায়া ও ছবি ~ সঙ্গীতা দাশগুপ্তরায়

ছায়া ও ছবি
সঙ্গীতা দাশগুপ্তরায়


চূর্ণিবউদির একটা সুন্দর ঘাড় বাঁকিয়ে তাকানো ফটো ছিল। ফুল সাইজ। সাদা কালো ছবি।
ছবিতে বউদি একটা নদীর ধারে গাছের পাশে দাঁড়িয়ে আছে। হাওয়া দিচ্ছে নিশ্চই কারন বউদির চুল বেশ এলোমেলো। গাছকোমর বাঁধা শাড়িটায় চওড়া পাড়। হয়ত সবুজ নীল বা মেরুন পাড়ই হবে। লাল হতে পারে না কারন বউদি লাল রং পছন্দ করত না। বলত ধুত ফ্ল্যাগের রং মনে হয়মনে হতেই পারে। চূর্ণি বউদির গোটা ফ্যামিলিই ছিল কম্যুনিস্ট। বাড়িতে লাল সেলাম, লাল পতাকা, লাল আবির দেখে দেখে বোধহয় অরুচি এসেগেছিল।
ফটোটায় গাছটা যে শিরিষ তা বোঝা যায়। থুপুথুপু ঝিরঝিরে ফুল। পাশে ঢিবির ওপর দুটো কাঁচের গ্লাসবউদি এক হাতে গাছের ডাল টেনে ধরেছে। অন্য হাতটা কোমরের একটু নিচে। দু হাতেই  গোছা গোছা চুড়িকানে পাশা দুল। কপালে টিপ। খোলা এলোমেলো চুলেও কানের কাছে ক্লিপ দিয়ে  ফুল আটকানো। দেখে মনে হয় রঙ্গন। তবে ওই, সবই হয় সাদা নয় কালো।
ফটোটা লাগানো ছিল  চূর্ণি বউদির খাটের পায়ের দিকের দেওয়ালে। কেউ ঘরে ঢুকলেই একবার ফটোটার সামনে দাঁড়িয়ে মুগ্ধ হত। "বাঃ কী অপূর্ব ভঙ্গী ! কোথায় তোলা রে!" বলেছিল সাহানা।
ঘাটশিলায়
অপূর্বদার তোলা? হানিমুনের নাকি! তোর হাসিটা তো দুষ্টুমি মাখামাখি
না না, বিয়ের আগে... ফটো নিয়ে পড়লি কেন? আয় শাড়ি দেখবি আয়। যেটা পছন্দ নিয়ে যা। কিন্তু পিন করার আগে কুঁচিতে আর কাঁধে একটা পাতলা ন্যাপকিনের টুকরো বা খবরের কাগজের টুকরো দিয়ে পিন ফোটাসনইলে বড্ড টান লেগে ছিঁড়ে যায়...হাত ধরে টেনে খাটে বসিয়েছিল চূর্ণিবউদি। শাশুড়ি তখন ঘরে ঢুকেছেন। বললেন বাব্বা! ওই ফটো তো বউমার প্রাণ। অথচ বিয়ের পরে খোকন  নেপাল থেকে ক্যামেরা কিনে আনল, মিনোল্টা না কি যেন। তাতে কত ছবি তোলা হত। কিন্ত বউমার ওই ফটোটি না দেখে ঘুম আসে না। অষ্টমঙ্গলাতেই বাপেরবাড়ি থেকে ওটি গুছিয়ে এনেছে
বউদিফিকিফিকি হাসে। সাহানা শাড়ি বাছে।
নদীটার অন্য পারে ছোট ছোট ঝোপের আভাস। ওদিকেই একটা বাড়িতে ওঠা হয়েছিল সবাই মিলে। বাকিরা কেউ অবশ্য ফটোটায় নেই। বাকিরা কোথায় যেন ছিল!
কেউ ঘরে না থাকলে উত্তরের জানলার পর্দাটা সরিয়ে দেয় বউদি। তেরছা আলো এসে পরে ফটোর ওপর। হালকা ধুলোর  আস্তরণপরিষ্কার  দেখা যায়। বউদি আঁচল দিয়ে মুছিয়ে দেয় কাঁচ ফ্রেম সব। 


অপূর্বদা রেডি হচ্ছে সকালে।
কড়ায় আলু পোস্ত চড়িয়ে বউদি ঘরে আসে...আজকাল কে তোমায় এত রাতে মেসেজ করে বলত? সিগারেট খাবার ছুতোয় উঠে বারান্দায় চলে যাও। দরজা টেনে দিয়ে যাও তবু জানলা দিয়ে মোবাইলের আলোটুকুতে দেখা যায় তোমার মুখ
কে মেসেজ করবে? কেউ না তো! আমি ফোনটায় গেমস খেলি সিগারেট খেতে খেতে
গেমস? আওয়াজ পাইনা তো
সাইলেন্ট রাখি। সি আই ডি -তে নাম লেখালে নাকি? আরে বাহ, কেমন নাকের ডগায় পোস্ত বাটা লেগে আছে। ইস্‌ এত দাম পোস্তর! এভাবে নষ্ট করে! দেখি চেটে নিইঅপূর্বদা কোমর ধরে টেনে বউকে কাছে আনে। ঠোঁটে ঠোঁটে এডাল্ট লক।

টিভিটা খারাপ হয়ে গেছে বেশ কিছুদিন হল। দোকানে খবরদেওয়া হয়েছিল। ডাকুয়া এসেছে তাই টিভি সারাতে। ওকে দেখলেই চূর্ণি মজা করে...
ডাকুয়া আবার কিরকম নাম! কী কী ডাকাতি করেছ বল! আজ কী ডাকাতির মতলব শুনি!
প্রথম প্রথম ডাকুয়া লজ্জা পেত। হাসত। আজকাল পালটা ইয়ার্কি দেয়। এ বাড়িতে মূল্যবান যা আছে তাই নিয়ে যাব ভাবছি
কথাটায় কেমন যেন ইঙ্গিত! বউদি কথা ঘোরায় তোমার সন্ধানে কোন ভালো টেপরেকর্ডার আছে ডাকুয়া?”
টেপ রেকর্ডার! ও জিনিস এখন আর চলে নাকি! বাজারে বিক্রিও হয়না মান্ধাতার আমলের ওই যন্তর
আহা, বাজারে বিক্রি হয়না জানি। মানে অনেকে পুরোনো সারাতে টারাতে দেয় না!
 দিয়ে ভুলে যায় নিতে বা সারানো হয় না আর, ওমনি আছে তোমার কাছে?”
আমার দাদার একটা আছে। টুইনওয়ান। রেডিওটা খারাপ হয়ে গেছে, টেপটা চলে হয়ত
একদিন নিয়ে আসবে? বা, তোমার দাদা কি বিক্রি করবেন? তাহলে জিজ্ঞেস কর, আমি কিনেই নেব
ডাকুয়া টিভি সারিয়ে দিয়ে যায়।
চূর্ণি বউদি মা-কে ফোন করে মা, আমাদের বড় ঘরের দেওয়াল আলমারিতে একটা বাটার জুতোর বাক্সে আমাদের ক্যাসেট রাখা আছে না অনেক?”
আছে কি এখন? বাড়ি রং টং হল তো কিছুদিন আগে। সব বার করা হয়েছিল তো রে। এখন আর আছে কিনা দেখতে হবে রে। কেন বলত
শিগগির বড় ঘরে যাও, গিয়ে আলমারি খুলে দেখ। ক্যাসেটগুলো আমার চাইই চাই
ক্যাসেট কি করবি? বাজাবি কিসে? অপূর্বদের পুরোনো ক্যাসেট প্লেয়ার আছে নাকি!
কিনব বা যোগাড় করব। কিন্তু তুমি আগে দেখ ক্যাসেটগুলো আছে কিনা। আমাদের প্রত্যেকবার বেড়াতে যাওয়ার হইচই রেকর্ড করত যে বাবা! সেই ক্যাসেটগুলো, নেই
কি জানি বাপু। দেখে বলতে হবে। আমি দেখে তোকে ফোন করব খন
মা ফোন রেখে দিলে চূর্নি বউদি বাগানে নামে। লিলির বেডে জল দেয়। জানলার পাশে একটা লতানে গোলাপ লাগিয়েছে। তার যত্ন করে। শাশুড়ির হাতে লাগানো বড় গাছগুলোতে নিমতেল আর হলুদ মেশানো জল স্প্রে করে। উনি চলে গিয়ে থেকে অপূর্ব, তার সংসার, কাজকম্মোর সাথে গাছেদের দায়িত্বও তো চূর্ণি বউদিরই।

রোদের আঁচে মুখখানা লাল-বেগনি হয়ে  যায়। ঘরে এসে শাড়ির আঁচলটা কোমরে পেঁচিয়ে ঘাড় বেঁকিয়ে ফটোটার সামনে দাঁড়ায়। চুলগুলো অবশ্য অত ওড়ে না। এক চিলতে হাসি নিয়ে ফটোর পাথরে রাখা কাঁচের গ্লাসে আঙ্গুল রাখে। তারপর রান্নাঘরে গিয়ে রাতের জন্য সোয়া নাগেটসের তরকারি, সকালে ভেজে রাখা পার্শের মাছের ঝাল গোছাতে থাকে।

অপূর্বদার ফিরতে রাত হয়। বউদি আলমারির কুঠুরি থেকে বার করে আনে দশবছরের পুরোনো ডায়েরি। প্রথম পাতাগুলোয় এটা সেটা গানের কথা। একটা পাতায় সবুজ কলমে লেখা গালিবের এক কলম অনুবাদ ...ও বৃষ্টি, এমন ভাবে ঝোর না যে সে আসতে না পারে...
কার আসার কথা ছিল? সে কি এসেছিল বৃষ্টি উপেক্ষা করে?
একটা বিপত্তারিনীর তাগা গোঁজা ডায়েরির ভাঁজে। একসময় দুব্বো দিয়ে বাঁধা ছিল। এখনও একদুটো হলদে দুব্বো লেগে আছে।
বাইরে গেট খোলার আওয়াজ হয়। চূর্ণি বউদি ডায়েরি শাড়ির ভাঁজে গুঁজে আলমারি বন্ধ করে। ঘর থেকে বেরোনোর সময়ে ছবিটার সামনে দাঁড়ায়, তারপর ফিক করে হেসে বলে এসেছিলে তো বৃষ্টি মাথায়... বাড়ি যাওয়ার সময় সিঁড়িতে পিছলে...মনে নেই!

অপূর্বদার বাড়ি ফিরে একবার চায়ের অভ্যেস। আরাম করে সেই চায়ে চুমুক দিতে দিতেই চূর্ণি বউদি পাশে এসে দাঁড়ায়
তোমায় টিফিনে আলু পটল কুমড়োর পাঁচ মিশেলি ভাজা আর পরোটা দিয়েছিলাম। এখন কৌটো খুলে দেখছি এককুচি ডিমের অমলেট। কার সাথে খেয়েছ আজ?”
উঁ, ওই তো... ইয়ে, গোস্বামী। গোস্বামীর সাথে খেলাম। ওর খাবারে ছিল অমলেট
গোস্বামী তো কট্টর নিরামিষাশী । তুমি বলেছিল গোস্বামীদা মুরগীর ডিম খেলে মুরগীর পায়ে প্রণাম করে ক্ষমা চেয়ে খাবে...
চায়ের মৌতাত ভেঙ্গে  শার্ট আর ট্রাউজার চেয়ারের ওপর ফেলে দিয়ে তোয়ালেটা টেনে নেয় অপূর্ব আরে! আরও অনেকেই ছিল। তুমি কি শুরু করলেটা কি! অফিস থেকে এসে কোথায় চানটান করে বসব তা না, উকিলি জেরা শুরু। ঘরে বসে না থেকে ডিটেকটিভ এজেন্সি  জয়েন করো বরং। হাত খরচটা উঠে আসবে। আর শোন, কাল থেকে আর ওই এক ঘেয়ে কুমড়ো পটল দিতে হবে না। ক্যান্টিনে খেয়ে নেব...


দুদিন বাড়ি ফিরতে পারব না। অডিট শুরু হয়েছে । প্রচন্ড চাপ। থাকতে অসুবিধা হলে কাউকে ডেকে নিও
ডাকতে হবে কেন? নিজের বাড়িতে আবার ভয় কিসের। কিন্তু আসতে পারবে না মানে! এতকাল তো অডিট আছে বলে অফিসে থাকনি। দেরীতে ফিরেছ শুধু
এতকাল গোটা একাউন্টসের মাথা ছিলাম না তাই থাকিনি। প্রমোশন হলে দায়িত্ব আসে। ওসব তো ভাবতে হয় না! গাছ করছ খাচ্ছ দুপুরে ঘুমোচ্ছ আর টিভি দেখছ। এসব তোমার বোঝার আওতায় পরে না...
তুমি আজকাল এমন রেগে যাও কেন কিছু বললে? আগে তো কত গল্প করতে!আজকাল কেবল আমার ঘরে বসে ভাত খাওয়ার খোঁটা দাওচূর্ণি বউদির চোখ ভিজে আসে
আরে রাগিনি! বয়স  হচ্ছে! রাস্তা ঘাটে এত ভিড় ঠেঙ্গিয়ে ফেরা। তারপর কাজের চাপ সবসময় মাথায়। সরি সরি... আচ্ছা কাছে এসো দেখি...

আমারো পরাণ যাহা চায়”  গাইতে গাইতে চূর্ণি বউদি পর্দা পালটায়। বিছানার চাদর ঝাড়ে। বাগানে ঢুকে আসা কালো ছাগলছানাটাকে নিজে হাতে কাঁঠাল পাতা পেড়ে খাওয়াতে যায়। তবে সে ভারি ভিতু। ভয় পেয়ে দৌড়ে গেট পার হয়ে পালায় এক নিমেষে। গেট বন্ধ করে বউদি রান্নাঘরে ঢুকে খাবার গুছিয়ে রাখে। আচারের শিশিগুলো জানলার পাটায় বসিয়ে রোদ্দুর খাওয়ায়। তারপর ফটোর সামনে দাঁড়ায়। ঘাড় বাঁকাতে গিয়ে বোঝে ব্যথা বেড়েছে। এবার ডাক্তার কলার না পরতে বলে। টিভিতে কদিন আগে ঘাড়ের ব্যয়াম দেখাচ্ছিল। সেগুলো করলে হয়।
ছবিটার দিকে খানিক তাকিয়ে বউদি এদিক ওদিক দেখে নেয়। কেউ দেখছে না দেখে টুক করে ফ্রেম পেরিয়ে ছবিতে ঢুকে যায়। চায়ের গেলাসে চা ঢালে... আরাম করে বসে চায়ে চুমুক দেয়।  অন্যহাতে ধরা গ্লাসটা সামনে বাড়িয়ে দিয়ে বলে "থাক, হয়েছে। আর ফটো তুলতে হবে না। অনেক তুলেছ। এবার চা টুকু খাও দেখি" 

রাতে বাড়ি ফিরে অপূর্বদা চান করতে যায় মোবাইলটা চার্জে বসিয়ে। বাইরে খুব ঝড় ওঠে। মেঘডাকা বৃষ্টি দারুন লাগে বউদির। তবে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে খুব। বাগানে যাওয়ার আগে চটপট টিভির প্লাগ খোলে। তারপর ফোনের চার্জারটা খুলতে গিয়ে স্ক্রীণের ওপর দিয়ে সরে যাওয়া মেসেজে চোখ আটকে যায়...বাড়ি ঢুকলেই আমাকে ভুলে যাও, না?”
কাঁপা হাতে মেসেজবক্স খোলে বউদি।
বিকেল ছটা চার-এ অপূর্বদা..."প্লিজ ফোনটা তোল বাবু। আজ একটু দেরি হচ্ছে বলে রাগ কোর না, আমাকে বোঝ। প্লিজ প্লিজ..."
"না, তোমার সাথে আর কথা বলব না যাও। তিন মিনিটের মধ্যে না এলে ফুল ডিভোর্স দিয়ে দেব বলে রাখলাম... "
"বাবু সোনা আমার, রাগ করে না সোনাই। আমার মিত্তি বউ, এই তো গিয়েই আদর করে দেব"

পাগলের মত বাথরুমের দরজায় ধাক্কাতে থাকে চূর্ণি বউদি। অপূর্বদা বেরিয়ে আসে। ঝাঁপিয়ে পড়তে গেলে চট করে সরেও যায়। বউদি ধাক্কা খেয়ে বাথরুমের ভেতরে মুখ থুবড়ে পড়ে। মোবাইলটা তার আগেই কেড়ে নিয়ে হিসহিসিয়ে ওঠে অপূর্বদা  টিকটিকি হয়েছ তুমি! কে বলেছে আমার মোবাইলে হাত দিতে? বড্ড আস্পদ্দা হয়েছে তো তোমার!
তুমি...তুমি... কথা আটকে আসে চূর্ণি বউদির... তুমি কাকে বউ বলছ!
আরে! আবার শুরু করলে! পাগলা গারদে দিয়ে আসব নাকি! লোকে ঠিকই বলে। বাচ্চাকাচ্চা না থাকলে মেয়ে মানুষের মাথার ঠিক থাকে না। এসব আমার না। অফিসের এক কলিগের আর তার বান্ধবীর মেসেজ
মিথ্যে বলছ তুমি! মিথ্যে বলছ! এখনই ওই নাম্বারে ফোন করব আমি..’.বলতে বলতে তেড়ে আসে বউদি। দু পা পিছিয়ে দেওয়ালে মাথা ঠেকে যায় অপূর্বদার.. দেওয়ালে না, ছবিতে। এক টানে ছবিটা তুলে এনে আছড়ে দেয় মাটিতে। চুরমার হয়ে ছিটিয়ে যায় কাঁচ ...
এ কী করলে!ভাঙা কাঁচের ওপর হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে চূর্ণি বউদি। ফ্রেমটাও বেঁকে খুলে গেল কোন থেকে। ছবিটাকে যত্ন করে বার করে নেয় চূর্ণি বউদি। অপূর্বদা সরু চোখে তাকায়... দেখি দেখি! পিছনে কি যেন লেখা!
"আমার ঘাট হয়েছে ঘাটশিলায় আসা...
চূর্ণি ঘুর্ণিকে, বৃষ্টি ভেজার আগে  ...শোভনদা "
বাহহহহ, তাহলে শোভনবাবুকে দেখতে দেখতে ঘুমোতে যাও রোজ!
চূর্ণি স্তব্ধ হতে গিয়েও চেঁচিয়ে ওঠে... দেখতে দেখতে ঘুমোই মানে! ছবি আমার... এতে আর কেউ তো নেই!
আছে তো! ওই যে যাকে দেখে আড়চোখ বাঁকিয়ে ন্যাকামো করছ সেই তো আছে
ছবিটার পিছনের লেখাটায় হাত রাখে চূর্ণি।  কোথা থেকে মাথার মধ্যে ভেসে আসে...
কবে বৃষ্টি পরেছিল , বান এল সে কোথা
শিবঠাকুরের বিয়ে হল কবেকার সে কথা...
সেদিনও কি এমনিতরো মেঘের ঘটাখানা
থেকে থেকে বাজ বিজুলি দিচ্ছিল কি হানা... 
“... কি হল! বললে না!  শোভনবাবুটি কে? কাকে নিজের শোবার ঘরে এদ্দিন ধরে টাঙ্গিয়ে রেখেছ?”
মাথা নিচু করে নেয় চূর্ণি বউদি। ছবিটা বুকে নিয়ে পায়ে পায়ে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। রান্নাঘরের জানলা বন্ধ করা হয়নি। বৃষ্টির ঝাপটায় জল ঢুকছে। ঠাস ঠাস করে দরজাটা হাওয়ায় বন্ধ হচ্ছে আর খুলছে।
ছবিটা ভিজে যাচ্ছে। পাশের ঘরে গিয়ে একটা প্লাস্টিকের প্যাকেট বার করে ছবিটা তুলে রাখে বউদি।
এ ঘরে অপূর্বদা ফোনে টাইপ করতে থাকে "আজ আর মেসেজ কোর না সোনা। এখুনি ধরা পরছিলাম । তবে বুদ্ধি করে গেম উলটে দিয়েছি। কাল অফিসে গিয়ে বলব। চুমু।"


বৃষ্টি টানা তিনদিন চলে। নিম্নচাপ ইত্যাদি। বাজারে ইলিশ ভালো ওঠে। শাকের গায়ে কাঁচা মাটি লেগে থাকে। ঘরের মুড়ি ফুরিয়ে যায়। গেটের ধারের নয়নতারার ঝোপ গলাজলে দাঁড়িয়ে থাকে। লতানে গোলাপের ছোট্ট মাচাটা ঝড়ে ভেঙ্গে পড়ে।শুধু শাশুড়ির আমলের পুরোনোকাঠগোলাপটা ঝড়জলকে পাত্তা না দিয়ে ফুল ফোটানোর চেষ্টা চালায়। অপূর্বদা দ্বিতীয় দিন বেরোনোর সময় বলে অফিসে তো রেনি ডে নেই। যেতেই হবে। তবে ফিরতে না পারলে চিন্তা কোর না। আর ফালতু সন্দেহকে মন থেকে তাড়াও। নিজের ভেতরে শোভনলাল নিয়ে বসে আছ বলেই এত আলফাল চিন্তা আসে মাথায়

কেটেছে একেলা বিরহের বেলা আকাশ কুসুম চয়নে...
গাইতে গাইতে বউদি ছবিটার গায়ে হাত বোলায় । এক কাপ চা বানায় দুধ চিনি আদা দিয়ে। অঝোর বৃষ্টিতে সাপ ব্যাং ছাড়া কেউ কোথাও নেই।তাও জানলার পর্দাটুকু টেনে দিয়ে বউদি ছবির মধ্যে পা রাখে। সমান মাপে চা ঢালে দুটো গেলাসে। ঘাড় বেঁকিয়ে ডাক দেয়, “এসো ... আর ছবি তুলে কাজ নেই। বৃষ্টি আসছে, চা টুকু খাও তো...

পরেরদিন রাত্রে অন্ধকার বাড়িতে অপূর্বদা ফিরে চেঁচিয়ে ওঠে "এ কি! আলো ফালো জ্বালাও না কেন? এদিকে গেটদরজা হাট করে খোলা। যেচে বাড়িতে চোর ঢোকানোর সখ হয়েছে নাকি!"
তারপর সুইচ অন করেই চমকে ওঠে।দরজার মুখোমুখি মেঝেতে দুটো কাঁচের গ্লাসে অর্ধেক ভরা সরপরা চা-এর পাশে হাঁটুতে মাথা রেখে অদ্ভুত ভঙ্গীতে চোখ বুজে ঘুমোচ্ছে চূর্ণী বউদি! নাকের পাটা, চোখের কোন আর ঠোঁটের কষ বেয়ে সারি দিয়ে পিঁপড়ে উঠছে।
হাতে ছবি। দূর থেকে পড়া যাচ্ছে
আমার ঘাট হয়েছে ঘাটশিলায় আসা...

সঙ্গীতা দাশগুপ্তরায়


1 টি মন্তব্য: