"রাজা"--থেকেই রবীন্দ্রনাথের
প্রকৃত তত্ত্ব প্রধান নাটকের যাত্রা শুরু। যেখানে দেখান হয়েছে প্রকৃত প্রেমের দহন
ও মুক্তি। "অচলায়াতনে" - সংস্কারের যাবতীয় বন্ধনকে ছিন্ন করবার আহবান
জানিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। "ডাকঘর" - নাটকে রবীন্দ্রনাথের মৃত্যু ভাবনা এক
শিশুর মানসপটে আত্মপ্রকাশ করেছে। রবীন্দ্রনাথ এই নাটক সম্পর্কে বলেছিলেন ' এর মধ্যে গল্প নেই। এ গদ্য লিরিক।' "ফাল্গুনী"র মধ্যে
দিয়ে পুরাতন কেই নতুন করে দেখেছেন এই মহা- নাট্যকার। মুক্তধারা নাটকে
যন্ত্রসভ্যতার নিরমমতার বিরুদ্ধে প্রান দিয়েছেন এই নাটকের নায়ক অভিজিৎ। "রক্তকরবী"
তে পাশ্চাত্যের ধনতান্ত্রিক সভ্যতার অন্তরালে যে অন্তসারশূন্যতা আছে তাকেই তুলে
ধরেছেন রবীন্দ্রনাথ। এই নাটকের নায়িকা নন্দিনী সম্পর্কে জানিয়েছেন" মাটির
উপরিতলে যেখানে রূপের নৃত্য যেখানে প্রেমের লীলা, নন্দিনী সেই সহজ সুখের, সহজ সৌন্দর্যের।"
কালের যাত্রায়"-- রবীন্দ্রনাথ পরিবর্তনশীল এক চিরন্তন সত্যকে উচ্চারন করেছেন।
ক্ষমতার মহে শাসক দল মানুষকে উপেক্ষা করলে আবার আসে উলটো রথের পালা। তখন ঘটে
উচুতে নিচুতে বোঝাপড়া। ~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
তোমার আলোয় তোমায় দেখি
কাকলি ভট্টাচার্য্য
যে কলম দিয়ে রবীন্দ্রনাথ কাব্য লেখেন, নাটক নিয়ে লিখতে গিয়ে সেই কলমে রঙ ও রেখার প্রতীকী এক
ভুবন গড়ে দিয়ে গেছেন তিনি। যেখানে সহজের কাছে পৌঁছতে চেয়েছেন কঠিনের সিঁড়ি বেয়ে।
এই লেখা শুরু করছি রবি বাবুর লেখা একটি নাটকের সংলাপ দিয়ে --" ... রাজা- এত
বিচিত্র রূপ দেখছ। তবে কেন সব বাদ দিয়ে একটি বিশেষ রূপ দেখতে চাচ্ছ? সেটা যদি তোমার মনের মত না হয় তবে তো সমস্ত গেল!
সুদর্শনা - মনের মত হবে নিশ্চয়ই জানি।
রাজা - মন যদি তার মত হয় তবেই সে মনের মত
হবে। আগে তাই হোক। "অসাধারণ এই কথোপকথনের রূপকার রবীন্দ্রনাথ। তিনি তাঁর
অনুভব প্রকাশ করেছিলেন নাটকে যা অভিনয় করতে গেলে আমাদের শরীরের অনু
পরমানু পর্যন্ত সচল হয়ে ওঠে। তাঁর নাটক গুলিকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করে নেওয়া হয়েছে।
১) গীতিনাট্য , কাব্যনাট্য ও নাট্যকাব্য - রবীন্দ্রনাথের যে নাটকে
গানের প্রাধান্য বেশি তাকে গীতিনাট্য , যে নাটকে কাব্যধর্মের
প্রাধান্য তাকে কাব্যনাট্য এবং যে কাব্যে নাট্যলক্ষন স্পষ্ট হয়ে ওঠে তাকে
নাট্যকাব্য বলা হয়। 'বাল্মিকি -প্রতিভা' এবং মায়ার খেলা তাঁর দুটি উল্লেখযোগ্য গীতিনাট্য। কর্ণকুন্তীসংবাদ, 'গান্ধারির
আবেদন' প্রভৃতি রচনা কে বলা যেতে পারে কাব্যনাট্য। নরকবাস এবং বিদায় অভিশাপ দুটি নাট্যকাব্য।
বাল্মিকি প্রতিভায় বর্ণিত হয়েছে আদি কবির আত্মজাগরনের কাহিনী। প্রকৃতির প্রতিশোধ
এ কাব্য ও নাট্যের আধারে জুরেছে তত্ত্ব। মায়ার খেলায় নাটকের আধারে সংগীত
পরিবেশনের মাধ্যমে প্রেমের হাসি-কান্নার খেলা
২) প্রচলিত রীতির পূর্ণাঙ্গ নাটক - রাজা ও
রানী' , বিসর্জন, মালিনি, মুকুট, প্রায়শ্চিত্ত,
প্রভৃতি প্রচলিত রীতির নাটকে শেক্সপীয়ার এর রীতিই অনুসৃত হয়েছে। 'রাজা ও রানী তে কর্তব্যের সঙ্গে প্রেমের, বিসর্জনে
আনুষ্ঠানিকতা ও প্রথা। আনুগত্যের সঙ্গে
হৃদয় ভক্তির টানা- পোড়েন চলেছে। 'মালিনী' নাটকের ধর্মের প্রথাবদ্ধ রুপ ও উদার রুপের সংঘাতের মধ্য দিয়ে জীবনের এক
আদর্শ রূপের সন্ধানে ব্রতী হয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। মুকুট একটি বালক মনের উপযোগী
আত্মত্যাগের কাহিনী। প্রায়শ্চিত্ত নাটক টি বউ ঠাকুরানীর উপন্যাসের নাট্যরূপ।
৩) রঙ্গনাট্য – গোঁড়ায় গলদ, বৈকুণ্ঠের খাতা,
' হাস্যকৌতুক' ব্যাঙ্গকৌতুক', 'চিরকুমার সভা'।
রবীন্দ্রনাথ শুধুমাত্র গভীর বিসয় নিয়ে নাটক
লিখেছেন তা নয়, তিনি লঘু রসেরও কয়েকটি
নাটক প্রনয়ন করেছেন।
৪) এবার আসি নৃত্যনাট্য প্রসঙ্গে। 'তাসের
দেশ, চিত্রাঙ্গদা,, চণ্ডালিকা, শ্যামা -- অসাধারণ কিছু সৃষ্টি।
৫) ঋতু নাট্যের ক্ষেত্রে ও অসামান্য
দক্ষতার নিদর্শন পাই শেষবর্ষণ, বসন্ত,
নটরাজ, ঋতুরঙ্গশালা, নবীন
ও শ্রাবনগাথা ইত্যাদির মধ্যে দিয়ে।
৬) বাংলা নাটকের ইতিহাসে রূপক সাংকেতিক
নাটক রবীন্দ্রনাথের হাতে এক অভিনব সংযোজন। শারদোৎসব ঋণশোধের পটভূমিকায় লেখা প্রকৃতি
ও মানুষের সম্পর্কের কাহিনী। তবে "রাজা "--থেকেই রবীন্দ্রনাথের প্রকৃত
তত্ত্ব প্রধান নাটকের যাত্রা শুরু। যেখানে দেখান হয়েছে প্রকৃত প্রেমের দহন ও
মুক্তি। "অচলায়াতনে" - সংস্কারের যাবতীয় বন্ধনকে ছিন্ন করবার আহবান
জানিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। "ডাকঘর" - নাটকে রবীন্দ্রনাথের মৃত্যু ভাবনা এক
শিশুর মানসপটে আত্মপ্রকাশ করেছে। রবীন্দ্রনাথ এই নাটক সম্পর্কে বলেছিলেন' এর মধ্যে গল্প নেই। এ গদ্য লিরিক।' "ফাল্গুনী" র মধ্যে
দিয়ে পুরাতন কেই নতুন করে দেখেছেন এই মহা- নাট্যকার। মুক্তধারা নাটকে
যন্ত্রসভ্যতার নিরমমতার বিরুদ্ধে প্রান দিয়েছেন এই নাটকের নায়ক অভিজিৎ।
"রক্তকরবী" তে পাশ্চাত্যের ধনতান্ত্রিক সভ্যতার অন্তরালে যে
অন্তসারশূন্যতা আছে তাকেই তুলে ধরেছেন রবীন্দ্রনাথ। এই নাটকের নায়িকা নন্দিনী
সম্পর্কে জানিয়েছেন" মাটির উপরিতলে যেখানে রূপের নৃত্য যেখানে প্রেমের লীলা,
নন্দিনী সেই সহজ সুখের, সহজ সৌন্দর্যের।" কালের যাত্রায়"-- রবীন্দ্রনাথ পরিবর্তনশীল এক চিরন্তন সত্যকে উচ্চারন
করেছেন। ক্ষমতার মহে শাসক দল মানুষকে উপেক্ষা করলে আবার আসে উলটো রথের পালা। তখন
ঘটে উচুতে নিচুতে বোঝাপড়া।
এই তো রবীন্দ্রনাথ --- আমাদের ছুঁয়ে থাকেন
নাটকের অলিতে গলিতে সর্বত্র। যেন গেয়ে যান-- রক্তকরবীর -- সেই গান টি -- আমায় পরশ
করে প্রান সুধায় ভরে তুমি যাও যে সরে--বুঝি আমার ব্যাথার আড়ালেতে দাঁড়িয়ে থাকো--
ওগো দুখজাগানিয়া তোমায় গান শোনাব --"
কাকলি ভট্টাচার্য্য