দেখা যাচ্ছে যে এক হাজার বা তার বেশী বছর ধরে একটা ভাষার সুত্রপাত হয়ে
ম্যাচিওর করল তার সম্পূর্ণ নিজস্ব একটা পরিশীলিত ব্যাকারন নিয়ে, সেই ভাষার জন্ম
প্রক্রিয়াটাই অনেকটা ধুসর ছায়াচ্ছন্ন, যদিও তাকে ইন্ডো ইরানিয়ান বংশোদ্ভূত ভাষা
বলে নামাঙ্কন করা হয়ে গেল। এবং আর্য অনার্য ভাগের প্রসঙ্গে সেই একই ভৌগলিক খন্ডে
বসবাস করা সবাই কি সংস্কৃতে কথা বলত, নাকি অনার্য দের ভাষা আলাদা ছিল, নাকি
আর্যরাই অনার্য দের ভাষাটাকে অ্যাসিমিলেট করে নিয়েছিল। আনুমানিক ছাড়া শব্দ বর্ন
ভিত্তিক পরিষ্কার উত্তর নেই, বিচ্ছিন্ন ভাবে বর্ণের ধ্বনিমাত্রার সাযুজ্যে বিভিন্ন
সম্পর্কের কথা বলা হয়েছে তত্ত্বগত ভাবে। মজার ব্যাপার হল ভাষা তাত্ত্বিকেরা বলেন যেরকম
ইরানিয়ান যেন্দা ভেস্তা তে যোরোয়াস্টারিয়ান দের কোন, আমরা যাকে বলছি মাইগ্রেসানের
সুত্রে “এক্সটারন্যাল হোমল্যান্ড” এর সঙ্কেত দেওয়া নেই সেইরকম ঋগ বেদেও আর্য
বংশোদ্ভূত দের কোন এক্সটারন্যাল হোমল্যান্ড এর সঙ্কেত নেই। ~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
ভাষা চিত্র
অমলেন্দু চন্দ
বেদ এই সাব-কন্টিনেন্টের সবচাইতে পুরাতন ঐতিহাসিক রচনা। ঋগ বেদের ষষ্ঠ
অধ্যায়ে নাকি একটি যুদ্ধের বিবরন রয়েছে যেটা ঘটছে হরিয়ুপ্পা বলে একটি জায়গায়। সে জায়গাটা
বেদিক বিবরন অনুযায়ী ঘটছে একটি নদীর ধার ধরে সেই নদীর নাম দেওয়া আছে ইয়াবিয়াবতী,
সম্ভবত এই নামের মধ্যেই আজকের রাভী নদীর নামের সুত্র লুকিয়ে আছে। কিছু ইতিহাসবিদ
মনে করেন সম্ভবত এই হরিয়ুপ্পা ই হরপ্পা।
বেদের সেই কাহিনির সুত্র অনুযায়ী এ যুদ্ধে পরাভুত হয়েছিল আক্রমণকারী শক্তি,
এবং সে যুদ্ধে ইন্দ্র নাকি বিজয়ী শক্তি কে মদদ যুগিয়েছিল।
প্রসঙ্গ অবতারনা এটার প্রতি দৃষ্টি
আকর্ষণ করার জন্য যে বৈদিক সভ্যতা খুব সম্ভবত হরপ্পার অবস্থান সম্পর্কে ওয়াকিবহাল
ছিল। দুটো জিনিষ এখানে প্রাসঙ্গিক। এক আর্য সভ্যতার ইনভেসন অর্থে কোন তথ্য বা
প্রামান্য তত্ত্ব নেই। অর্থাৎ ইন্দো ইরানিয়ান সভ্যতার স্ট্রিমে প্রতিপালিত কিছু
মানুষ যে হিন্দুকুশ পেরিয়ে আর্যাবর্তের স্থাপনা করেছিল তার কোন প্রামান্য তথ্য নেই
যদিও এটি একটি বহুল প্রচলিত ধারনা। দুই হরপ্পার
সভ্যতার শেষ পর্যায় আর আর্লি ভেদিক যুগ এর শুরু একটা সময়ের পরিধিতে একই সময়ে ঘটে
চলেছিল। ইন্ডাস ভ্যালি সভ্যতার অন্যতম নগর সভ্যতা হরপ্পা বলা হয় ১৭০০ বি সি নাগাদ বোধহয় ধ্বংস প্রাপ্ত হয়েছিল, আর
আর্লি ভেদিক পিরিওড দু হাজার বি সি নাগাদ শুরু বলে অনেকেই ধরেন। অবশ্য অনেক
ইতিহাসবিদ মনে করেন ইন্ডাস ভ্যালি সভ্যতা শেষ হয়ে গেছিল ২ হাজার বি সি নাগাদ। আবার
কেউ কেউ মনে করেন হরপ্পান সিমেট্রির খননের থেকে পাওয়া নিদর্শন এর সুত্রে যে এই
নির্মান ১৭০০ থেকে ১৩০০ খৃষ্ট পুর্ব শতাব্দী তে হয়েছিল। তাহলে দেখা যাচ্ছে যে
অনেকেই মনে করেন হরপ্পান সভ্যতার শেষ পর্যায় আর আর্লি ভেদিক পিরিওড কঙ্কারেন্ট ছিল
একটা সময়ের পরিসরে।
এখন যেটা বিরাট প্রশ্ন যে ভৌগলিক এবং ঐতিহাসিক কালখন্ডের সুত্রে এত
কাছাকাছি অথচ একটা সভ্যতার সঙ্গে অন্য সভ্যতার বিনিময়ের কোন চিহ্ন নেই, এমনকি আমরা
যেটাকে আজকে আর্লি ভেদিক পিরিওড বলে ধরি তার নিজস্ব স্ক্রিপ্ট এর কোন নিদর্শন নেই,
যদিও হরপ্পান স্ক্রিপ্ট এর শার্ডস বা টুকরো টুকরো প্লেক অনেক পাওয়া গেছে, যার মর্ম
উদ্ধার আজও সে ভাবে সম্ভব হয় নি। প্রায় ষোল খানা তিন দিকে লেখা হরপ্পান ট্যাব্লেট
পাওয়া গেছে রাভি র তীরবর্তী এলাকার খনন থেকে
দেশ ভাগের আগেই স্বীকৃত একটি ইন্দো আমেরিক্যান প্রোজেক্টের সুত্রে যার নাম
হারপ (HARP)। এই প্রোজেক্ট এখনও অ্যাক্টিভ পাকিস্তান আমেরিক্যান
প্রোজেক্ট বলে চিহ্নিত। এটাও ধারনা যে এই স্ক্রিপ্ট এর জন্ম খৃষ্টের জন্মের প্রায়
তিন হাজার তিনশো বছরের আগের আশে পাশে। এটা
পরিষ্কার জলের মত যে সেই স্ক্রিপ্ট আর্য সভ্যতার বাচিক স্ক্রিপ্ট হতে পারে না,
কারন তাহলে তার কিছু নিদর্শন পাওয়া উচিত ছিল যার সুত্রে হয়ত ওই হরপ্পান শিলালিপির
মর্ম উদ্ধার সহজ হত।
একটা খুব প্রাসঙ্গিক কথা হচ্ছে যে যদি আমরা ইজিপ্সিয়ান মেসপটামিয়ান চাইনিজ
আর ইন্ডাস ভ্যালি সভ্যতার কালখন্ডের তুলনামুলক একটা চালচিত্র আঁকি তাহলে দেখব যে তারা
এগিয়েছে এক কঙ্কারেন্ট কালখন্ডে। প্রায় খৃষ্ট পুর্ব চার হাজার বছরের আশে পাশে। বাকি তিনটি সভ্যতা এমার্জ করে ইজিপ্সিয়ান
ইউরোপিয়ান আর চাইনিজ পরবর্তী অধ্যায়ের সভ্যতায়। কিন্তু স্ট্রেঞ্জলি ইন্ডাস ভ্যালি
সভ্যতা যেন মন্ত্রবলে উধাও হয়ে যায় একটা কালখন্ডের পর। অথচ সেই কালখণ্ডের মধ্য
পর্যায়ে শুরু হওয়া যেটা ধরা হয় দু হাজার
খৃষ্ট পুর্ব’র আশে পাশে সেই আর্য সভ্যতার সঙ্গে এদের কারুরই বাচিক বা ভাষিক মিল
নেই। অবশ্য এদের নিজের মধ্যেও বাচিক বা
ভাষিক মিল নেই, আর তাই ইন্ডো ইউরপিয়ান ল্যাঙ্গুয়েজ ছাতার একটা সম্পূর্ণ সেপারেট
ট্রী হল ইন্দো ইরানিয়ান ল্যাঙ্গুয়েজ। মজার ব্যাপার হল পরিচিত ইন্ডো ল্যাঙ্গুয়েজ
বলতে আমরা যাদের বুঝি তাদের সবার সাথেই ইরানিয়ান ল্যাঙ্গুএজের মিলের থেকে অমিল
বেশী।
তাহলে কি ছিল সেই প্রাক বৈদিক যুগের সভ্যতার ভাষা বা কি ছিল তার স্ক্রিপ্ট?
তার থেকেও বড় প্রশ্ন সেই সভ্যতায় কি অলরেডি প্রচলিত ধারনার আর্য মনন মিশে যেতে
শুরু করেছিল দ্রাবিড়ীয় কোন সভ্যতার সাথে। তাহলে সেই দ্রাবিড়ীয় সভ্যতার ভাষা কি
ছিল, আর কোন ভাষা নিয়েই বা সেই আর্য মনন এসে মিশতে শুরু করেছিল, কি ছিল সেই
কনভারজেন্স এর রুপ রেখা?
একটা প্রচলিত তত্ত্ব আছে যাকে ডাকা হয় পি আই ই তত্ত্ব বলে – প্রোটো ইন্দো
ইউরোপিয়ান তত্ত্ব, যাতে ভাবা হয়েছে যে – অনেক গুলো টুকরো টুকরো গোষ্ঠী একটা সময়
চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছিল যার একটা শাখা সেন্ট্র্যাল এশিয়া র দিকে চলে
আসে। তত্ত্ব টা নিজেও স্বীকার করে যে এটা আরকিওলজিক্যাল তত্ত্বের থেকেও বেশী
আরকিওজেনেটিক্স নির্ভর। এবং এটা একেবারে নতুন সাইন্স, জেনেটিক্স নির্ভর হলেও পুরোটা
ফলিত সাইন্সের জেনেটিক্স নয়, অনেকটা অনুমান নির্ভর। এটার ব্যবহার মাইগ্রেসান থিওরি
কে প্রতিপাদ্য করার জন্য হয়। এখন কথা হচ্ছে যে সময়ের পরিসরে এই রকমের রি লোকেসান
ঘটেছিল বলে মনে করা হয় সেটা মেসোলিথিক-নিওলিথিক পিরিয়ড এ অর্থাৎ প্রায় ১০০০০ থেকে
৩০০০ বি সি র মধ্যে, তো তাহলে তাদের কে সভ্য আর্য মনে করার কোন কারন নেই, যেহেতু
তখনও ল্যাঙ্গুয়েজ বা স্ক্রিপ্ট এর আবিস্কার হয় নি সে ভাবে কোন সভ্যতার স্ট্রিমেই –
ইজিপ্সিয়ান, মেসোপটামিয়ান বা চাইনিজ। এবং আরকিওজেনেটিক্স এটা মনে করে না যে এই
সভ্যতার কোন স্ট্রিম থেকে আর্যাবর্তের লোকেরা এসেছিল টুকরো টুকরো গোষ্ঠী বা অন্য
কোন ফর্মে।
কথা হল এই মাইগ্রেসান তত্ত্ব নিওলিথিক পিরিওডে অর্থাৎ সাড়ে পাঁচকি ছ হাজার
বছর আগে, তো তাহলে তো সে সময় ল্যাঙ্গুয়েজ ডেভেলপ করে নি বা ল্যাঙ্গুএজের কোন রুপ
ছিল না। তাহলে এর সঙ্গে তো প্রচলিত আর্য সভ্যতার
মধ্য এসিয়ার থেকে মাইগ্রেটেড লোক জনের প্রসঙ্গের যোগ নেই। কারন যদি লার্জ
স্কেল ইনভেসানের প্রসঙ্গ থাকে তাহলে হয় নতুন জনপদের ইতিহাস গড়ে উঠবে নয় পুরনো
জনপদের ধ্বংসের গাথা থাকবে। এর কোনটাই সে অর্থে পাওয়া যায় না।
তাই এই তত্ত্বটাই প্রাধান্য পায় যে যারা এসেছিল তারা স্থানিক বাসিন্দাদের
সাথে কনভার্জ করেছিল। তাহলে তারা এবং যাদের সাথে কনভারজেন্স হয়েছিল তাদের ভাষা কি
ছিল।
এবারে আসা যাক বেদিক পিরিওডের প্রসঙ্গে। আর্লি বেদিক পিরিওড ধরা হয় ২০০০ বি
সির আশে পাশে শুরু, মতান্তরে ১৬০০ র আশে পাশে। প্রথম বেদ এর এক সুক্ত র প্রসঙ্গ
টেনেছিলাম এ লেখার শুরুতে, সেই ঋগ বেদ শ্রুতি র সুত্রে শুরু এই পর্যায়ের প্রথম
দিকে, তো শ্রুতি যখন সেটা নিশ্চয়ই সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ হতে পারে না, সেটি একটি ভাষা
ছিল, কি ছিল সেই ভাষার স্ক্রিপ্ট, দ্রাবিড়ীয়
ভাষা বলে আজকে যে ভাষাগুলির পিতৃত্বের অধিকার সংস্কৃত কে দেওয়া হয় সেটা তো
উত্তর ভারতের ভাষা ছিল না কোন কালেই, যদি না এই তত্ত্বকেই পুরো মেনে নেওয়া হয় যে
আর্য ইনভেসানের দরুন দ্রাবিড়ীয় ভাষা ভাষীরা পেনিনসুলার ভারতের দিকে সরে গিয়েছিল। কিন্তু
ইনভেসানের এই আগ্রাসী তত্ত্বটাই তো সম্পাদ্য হয় নি কোন দিন, যদিও এন সি ই আর টি ‘র
সমস্ত বইতেই এই তত্ত্বকেই ছেপে দেওয়া হয়েছে। ম্যাক্স মুলার এই তত্ত্বটাকে খারিজ
করে দিয়েছিলেন যদিও বহু বছর আগে।
যেটা খুব লক্ষণীয় বিষয় সেটা হল মৌল তিনটে সভ্যতাই নিওলিথিক পিরিয়ডে শুরু
হয়ে ব্রোঞ্জ এজ পেরিয়ে আয়েরন এজ থেকে এগিয়ে গেছে, আর ইন্দাস ভ্যালি সভ্যতা সেই একই
সময়ের পরিধিতে শুরু হলেও আয়েরন এজ অবধি যেতে পারে নি তার আগেই শেষ হয়ে গেছে, আর
আমাদের আর্য সভ্যতা সোজাসুজি ব্রোঞ্জ এজেই শুরু হচ্ছে। কিন্তু সেই প্রসঙ্গই আবার
এসে পড়ে – এদের ভাষার রুপ কি ছিল।
আগাগোড়াই যে তত্ত্বটাকে শুরু থেকেই উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে সেটা হল এই উপমহাদেশে
একটা ভাষা নিজের থেকে জন্ম নিয়ে বেড়ে উঠেছে সেটার সমীক্ষা। অর্থাৎ যদিও ইন্ডো ইউরোপিয়ান
ল্যাঙ্গুয়েজ ট্রি কে
চিন্তাবিদেরা একটু বদলে নিয়ে নাম দিয়েছেন ইন্ডো অ্যারিয়ান ল্যাঙ্গুয়েজ, এবং যে
ল্যাঙ্গুয়েজ ট্রি তে রয়েছে সংস্কৃত আর ইরানিয়ান বংশোদ্ভূত ভাষারা। কথা হল এই
সংস্কৃতের জন্ম কালখণ্ড ধরা হয়েছে ঋগ বেদের (শ্রুতির পর্যায়ে) সময় যেটা আনুমানিক ১৬
বা ১৫ শ বি সি, চিন্তার ভিন্নতায় তারও একটু আগের থেকে আর এর বিস্তৃতি প্রায় ৬০০ বি
সি পর্যন্ত। অর্থাৎ প্রায় এক হাজার বছর বা ততোধিক সময় ধরে একটা ভাষা ম্যাচিওর
করেছে, যে ভাষাকে তার পরিমার্জন আর পরিবর্ধন এর কালখন্ডে ভাগ করা হয়েছে এই ভাবে –
১। ঋগ বেদিক ভাষা, একেবারে শুরুর যেখানে
ভাষাবিদেরা খুঁজে পেয়েছেন এমন কিছু সুক্ত এবং সেই সুত্রে ব্যবহৃত কিছু শব্দ বা
বর্ণ যে কারনে মনে করা হয়েছে যে এরা কোন
নগর সভ্যতার থেকে উঠে আসে নি; বা ভিন্নতায় নগরকেন্দ্রিক উপনিবেশ যত ছিল তার চেয়ে
ঢের ঢের বেশী গ্রামকেন্দ্রিক বা ছোট ছোট
গ্রুপে মানুষের বসতি ছিল;
২। অথর্ব বেদ, সাম বেদ ও ইয়জুর্বেদ এর
ভাষা যাকে নাম দেওয়া হয়েছে মন্ত্র-ভাষা বা হিম্ন ল্যাঙ্গুয়েজ। ভাষাবিদেরা মনে করেন
এর বিস্তার বিবর্তন আর পরিমার্জন হয়েছে লৌহ যুগের সাথে অর্থাৎ প্রায় এক হাজার বি
সি র সময়ের সাযুজ্যে।
৩। সংহিতা ভাষ্য ও ব্রাহ্মিনিক ভাষ্যের
সুচনা – এই পর্যায়ে আচার সংহিতার জন্ম হয়েছে যেমন হয়েছে ব্রহ্মন্যবাদের
অ্যাডজাঙ্কটের। ধরা হয় এটি ষষ্ঠ থেকে পঞ্চম খৃষ্টপূর্ব শতাব্দী। এই সময়ের পরিধিতেই
পাণিনি ব্যাকারন এসেছে সংস্কৃত কে একটি সুষ্ঠু ব্যাকারন দেওয়া হয়েছে। ধরা হয় এই
সময়ের পরিসরেই মহাভারত ও রামায়নের লিপিবদ্ধকরন প্রক্রিয়া সমাপ্ত হয়। এটাকে বেদিক
যুগের পরবর্তী অধ্যায় বা লেট বেদিক এজ বলা হচ্ছে। এই যুগের সাযুজ্যেই এসেছে
বর্ণাশ্রম – ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয় বৈশ্য শূদ্র ইত্যাদি লেবার ডিভিসনের সুত্রে আর্থ
সামাজিক ভাগ।
তাহলে দেখা যাচ্ছে যে এক হাজার বা তার বেশী বছর ধরে একটা ভাষার সুত্রপাত
হয়ে ম্যাচিওর করল তার সম্পূর্ণ নিজস্ব একটা পরিশীলিত ব্যাকারন নিয়ে, সেই ভাষার
জন্ম প্রক্রিয়াটাই অনেকটা ধুসর ছায়াচ্ছন্ন, যদিও তাকে ইন্ডো ইরানিয়ান বংশোদ্ভূত
ভাষা বলে নামাঙ্কন করা হয়ে গেল। এবং আর্য অনার্য ভাগের প্রসঙ্গে সেই একই ভৌগলিক
খন্ডে বসবাস করা সবাই কি সংস্কৃতে কথা বলত, নাকি অনার্য দের ভাষা আলাদা ছিল, নাকি
আর্যরাই অনার্য দের ভাষাটাকে অ্যাসিমিলেট করে নিয়েছিল। আনুমানিক ছাড়া শব্দ বর্ন
ভিত্তিক পরিষ্কার উত্তর নেই, বিচ্ছিন্ন ভাবে বর্ণের ধ্বনিমাত্রার সাযুজ্যে বিভিন্ন
সম্পর্কের কথা বলা হয়েছে তত্ত্বগত ভাবে।
মজার ব্যাপার হল ভাষা তাত্ত্বিকেরা বলেন যেরকম ইরানিয়ান যেন্দা ভেস্তা তে
যোরোয়াস্টারিয়ান দের কোন, আমরা যাকে বলছি মাইগ্রেসানের সুত্রে “এক্সটারন্যাল
হোমল্যান্ড” এর সঙ্কেত দেওয়া নেই সেইরকম ঋগ বেদেও আর্য বংশোদ্ভূত দের কোন এক্সটারন্যাল
হোমল্যান্ড এর সঙ্কেত নেই। সপ্ত নদীর দেশ সপ্ত সিন্ধু, যার অন্যতম নাম সরস্বতী,
সেই নদীদের নামকরনের সুত্রে টেনে আনার চেষ্টা করা হয়েছে যেহেতু এরকম নাম অন্য
বাচিক এবং ভাষিক ভৌগলিক অবস্থানের দিকে ইঙ্গিত করে, সুতরাং বাইরের থেকে নিশ্চয়ই
একটা মাইগ্রেসান ঘটেছিল।
রামায়ন মহাভারত এবং পুরানের চরিত্রদের ভৌগলিক অবস্থান পাঞ্জাব সিন্ধ আর
গ্যাঞ্জেটিক প্লেনের জনপদ ও সমাজ সভ্যতার কথাই বলে। তাহলে মাইগ্রেসনের তত্ত্বর
একমাত্র সুত্র কি? যা আছে সেটাকে কিছু আরকিওলজিক্যাল আর কিছু আরকিওজেনেটিক্স এর
ব্যখ্যার সুত্রে সাব্যস্ত করা হয়েছে। কিন্তু কালচারাল অ্যাফিনিটি যার অন্যতম
মাধ্যম ভাষা শিল্প সংস্কৃতি গত সেই সুত্রে বিশেষ ভাষাগত সুত্রে এই তত্ত্ব কে খুব
সাব্যস্ত করা যায় নি।
পাণিনী ব্যখ্যা অনুযায়ী তিনটে পর্যায়ে বিভক্ত
ছিল তার আগে এবং সেটা ভৌগলিক খন্ডানুসারে – যথা প্রাচ্য, উদীচ্য এবং মধ্যদেশীয় অর্থাৎ ১) পুর্ব ভারতের অয়োধ্যা,
এবং সমগ্র পুর্বাঞ্চল অর্থাৎ যাদের আমরা
বাংলা বিহার আসাম উড়িষ্যা ও তৎসংলগ্ন অঞ্চল বলি, ২) উত্তর পশ্চিম ভারত, উত্তর
পাঞ্জাব ও ৩) মধ্য পশ্চিম ভারত, সমগ্র
উত্তর ভারত। দেখা যাচ্ছে এই ভাগে দক্ষিন ভারত কনসপিকিউআস্লি বাদ। অর্থাৎ সেখানের
প্রচলিত ভাষা সংস্কৃত ছিল না। এই সমগ্র ভু খণ্ডের ভাষাকে দ্রাবিড়ীয় ভাষা নামে
অভিহিত করা হয়েছে এবং ল্যাঙ্গুয়েজ ট্রি তে এই ভাষাকে সংস্কৃতের ফ্যমিলি ট্রি র
প্রাচীন ভাষা সমুহ বলা হয়েছে। কথা হচ্ছে
তামিল তেলেগু কন্নড বা মালায়ালাম ভাষা গুলির সঙ্গে সংস্কৃতের বহু মিল রয়েছে এটা
প্রমানিত সত্য, কিন্তু সে টা সম্পৃক্ত হওয়ার দরুন
না জন্ম লব্ধ অধিকার সেটা প্রমানিত নয়।
বাংলা ভাষার স্বীকৃত শুরু অনেক অনেক পরে, যদিও প্রি হিস্টরিক্যাল মহাভারতের
প্রাগজ্যোতিষপুর এই সময়ের জলপাইগুড়ি থেকে সমগ্র আসাম পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল, অর্থাৎ
বঙ্গের দোরগোড়ায়। সে সময়টা তো সেই বৈদিক সময়ের আগের, মানে কয়েকশো বছর তো বটেই। এ
ছাড়া ঐত্রেয় আরণ্যকে বঙ্গের উল্লেখ পাওয়া যায়। সে ছাড়া প্রি হিস্ট্রি’র অন্যতম মহাভারতের
চরিত্র জরাসন্ধ মগধের রাজা ছিলেন এবং পৌন্ড্রক বাসুদেভা ছিলেন পান্ডুয়ার রাজা। এরা
দ্বাপরের শ্রী কৃষ্ণের অন্যতম শত্রু ছিলেন। এরাও কি তাহলে সংস্কৃতে কথা বলতেন,
যাকে পাণিনী অভিহিত করছেন প্রাচ্যের ভাষা হিসেবে এবং যাকে তিনি সংস্কৃত সারা
দুনিয়ার অন্যতম প্রাচীনতম একটা ব্যাকারন দিয়েছেন। ঐত্রেয় আরণ্যকে বলা হয়েছে যে
আর্যাবর্তের এই প্রাচ্য ভুখন্ড রাক্ষস এবং পিশাচ অধ্যুষিত।
প্রাক ইতিহাস পর্বের লোক কথার রাজাদের সময় সেই মহাভারতের বৃহদ্রথ রাজার
বংশধর যার শুরু সেই প্রায় আনুমানিক আর্য সভ্যতার প্রথম দিকে অর্থাৎ সেই দু হাজার
খৃষ্ট পূর্বের আশে পাশে। শিশুনাগ বংশের বিম্বিসার বা অজাতশত্রু ঐতিহাসিক সময়ের
ফ্রেমে এসে গেছেন, তারাও এই ভু খন্ডের রাজা ছিলেন, তাদের রাজত্বকাল থেকে নন্দ
বংশের রাজত্বকালের মধ্যে কোন এক সময়ে – এ ব্যপারে নানা মুনির নানা মত, অর্থাৎ
বিদগ্ধজনেরা মনে করেন ষষ্ঠ থেকে চতুর্থ খৃষ্ট পুর্ব কোন এক সময়ে (লেনার্ড
ব্লুমফিল্ড বলছেন চতুর্থ খৃ পু, তার ভাষায় সংস্কৃত কোন একটা ভাষা নয়, একটা
ভাষাতত্ত্বের প্রকরণ, মনিয়ের উইলিয়ামস বলেন পাণিনী পঞ্চম খৃ পু তে তার অষ্টাধ্যায়ী
সংরচনা করেন, তার কথায় সংস্কৃত হচ্ছে সেই প্রথম ভাষা প্রকরণ যা দুনিয়া কে শিখিয়েছে
বর্নমালার প্রত্যেকটি অক্ষর একটি বিশেষ ধ্বনিময়তার সুত্রে রুপ লাভ করছে, আবার ভিন্ন একটি রিসার্চ গ্রুপ মনে করে পাণিনী তার
কাজ করেছেন শাক্য মুনির জন্মের পূর্বে আর তাহলে সেটা ষষ্ঠ খৃ পু, ) পাণিনী তার
অষ্টাধ্যায়ী রচনা করেছিলেন তৎকালীন ভারত ভুখন্ডের সুদূর প্রত্যন্ত কান্দাহারের
কোথাও বসে।
তো তাহলে এটাও কোন তর্কের অবকাশ
রাখে না যে সেই ওই সুদূর পশ্চিম প্রান্ত থেকে এই পূর্ব প্রান্ত তথা মধ্যপ্রদেশ
(তৎকালীন ভু খন্ড) জুড়ে যে ভাষার ব্যবহার হত সেটা নিশ্চয়ই সংস্কৃত ছিল। কথ্য
ভাষাটাও কি তাই ছিল, বিশেষ সেই পর্যায়ে বর্ণাশ্রম পদ্ধতি চালু হয়ে গেছে, তো তাহলে
সে নিশ্চয়ই সোস্যালিস্মের এক ব্যপক চিত্র ছিল কারন তা না হলে রাজাদের থেকে নিতান্ত
ভিস্তি ঝাড়ুদার রাও সেই একই ভাষায় কথা বলত এটা ভাবা যায় কি করে! অথচ পাণিনী তার
অষ্টাধ্যায়ীতেই নাকি বর্ণনা করেছেন যে স্যাক্রেড টেক্সট আর সাধারন কথা বার্তার
ভাষা-রুপ আলাদা ছিল। সেটাই
কি পালি?
এইখানেই এসে পরে সেই অমোঘ তর্ক। শাক্যমুনি তার সমস্ত বলার কথা তার শিক্ষা তার আর্য সত্য তার ধম্মা সমস্ত কিছু পালি তে অনুকৃত করেন, সেটি সেই
পর্যায়ে পুর্বোত্তর ভারতের প্রচলিত একটি ভাষারূপ এবং বুদ্ধধর্মের শিক্ষা যাতে শুধুমাত্র শিক্ষিত এলিটের কাছে নয় অশিক্ষিত
অল্পশিক্ষিত সাধারন মানুষের কাছেও পৌঁছয় তার জন্যই তিনি পালির ব্যবহার করেন বলে
বিশ্বাস, ভিন্ন মতে যেহেতু তার ধম্মা হিন্দু ধরমের থেকে আলাদা ছিল এবং হিন্দু
ধর্মের স্বীকৃত ভাষারূপ ছিল মুল সংস্কৃতে তাই পালির ব্যবহার। অর্থাৎ ভাষার কথ্য এবং লিখিত রুপ আলাদা ছিল।
=====================================================
পালি সু প্রাচীন মগধের রূঢ় ভাষা রুপ ছিল, রূঢ় অর্থাৎ সংস্কৃত ভাষা রুপ নয়,
যে অর্থে ভার্ণাকুলার ল্যাঙ্গুয়েজ বা স্পোকেন ল্যাঙ্গুয়েজ শুদ্ধ ভাষার রুপ থেকে
আলাদা হয়, পালি সেই অর্থে শুদ্ধ সংস্কৃত থেকে আলাদা ভাষা। বুদ্ধ সেই ভাষাকে
আন্তর্জাতিক মর্যাদা এনে দেন, স্বীকৃতি আসে সেই ভাষা রুপের। অশোকের বহু খোদাই করা
এডিক্ট পালি থেকে উঠে আসা মাগধী বা অর্ধ-মাগধী ভাষা রুপ যা কথ্য থেকে ততদিনে লিখিত
রুপ পেয়ে গেছে, এবং স্বীকৃত যে সে ভাষা সোজাসুজি ঋগ-ভেদিক সংস্কৃত থেকে উঠে আসা
ভাষা নয়, তার নিজস্ব মরফো-ফোনোলোজীকাল উৎস রয়েছে, যেটা রিজিওন্যাল ডায়ালেক্ট
ক্ষেত্রে ঘটে। সে ছাড়া উপমহাদেশের অন্য স্থান অনুযায়ী অন্য ভাষার ব্যবহার হয়েছে
যেমন পশ্চিম প্রান্তে সংস্কৃতের কাছাকাছি কথ্য ভাষা, আফগানিস্থানে পাওয়া একটি
এডিক্ট এ অ্যারামিক ( পুরাতন গ্রীক ভাষা) । পালি থেকে সেই অর্থে প্রাকৃত অর্থাৎ সহজাত বা
স্থানিক অর্থে মাগধী একটি ভাষা রুপ। এই সময়েই অর্থাৎ মৌর্য তথা অশোক এর সময়ে এই মাগধী বা অর্ধ-মাগধী দক্ষিন পুর্ব এশিয়ায়
ছড়িয়ে পড়ে।
পালি শব্দের প্রচলিত অর্থ হল টেক্সট লাইন বা অনুশাষনের অনুলিপি অর্থাৎ
ক্যাননিক্যাল টেক্সট। সময়ের বিচারে এবং প্রচলিত তত্ত্ব তথা তথ্যের ভিত্তিতে এটা স্বীকৃত
যে এর প্রচার এবং প্রসার হয় মুল মাগধী বা অর্ধ-মাগধী তে মৌর্য সাম্রাজ্যের
অফিসিয়াল ল্যাঙ্গুয়েজ হিসেবে। তাহলে সময়ের নিরিখে সেটা হল ৩২৪ খৃষ্ট পুর্ব
শতাব্দীর সময়ে। এখন যেহেতু ভাষা একটি বহতা ব্যপার অতএব যাকে বলে ওয়ান ফাইন মর্নিং
এর জন্ম হয় না মানুষের বাচ্চার মত। তাহলে ধরা যেতে পারে যে আরও অন্তত এক বা দেড়শ
বছর ধরে এই ভাষা রুপ টা তৈরি হয়ে উঠছিল। তাহলে আমাদের চলে যেতে হয় নন্দ বংশের একটু
আগে, অর্থাৎ অজাতশত্রু দের সময়ে ধরা যাক পাঁচ শত খৃষ্ট পূর্ব বা তার আশে পাশে। তাহলে
ধরা যেতেই পারে যে এই ভাষা র ব্যবহারের যে লিপিক রুপ আমরা পাই অশোকের প্রস্তর
এডিক্ট এর মাধ্যমে তারা ২৫০ খৃ পূ র কিছু আগেই তৈরী হয়েছিল। আজকের সময়ে এই পালি
ভাষা রুপের স্টাডির জন্য যে সব ইন্সটিটিউশান রয়েছে তারা প্রায় সবই এ দেশের বাইরে।
এই পালির থেকে উঠে আসা প্রাকৃত বা মাগধী
পরের সময়ে স্থান কাল পাত্র ভেদে ভিন্ন ভ্যারিয়েসানের (কথ্য রুপের) সুত্রে
আর্যাবর্তে (ততদিনে পলিটিক্যাল ডিভিসনের দরুন ভু খন্ডের বিভিন্ন প্রান্তের ভিন্ন
নামকরন হয়েছে) বিভিন্ন প্রান্তে অন্যান্য
রুপ নেয়-ওড়িয়া, আসাম অঞ্চলে অ্যাসামিজ তথা বিহারের হিন্দি। এদের অপভ্রংশ ভাষা রুপ
বলা হয়। ধরা হয়ে থাকে যে পূর্বী অপভ্রংশ র থেকে এসেছে মৌল তিন বিহারের ভাষা রুপ –
ভোজপুরি, মগহী হিন্দি এবং মৈথীলি। ভামাহ র কাব্যালঙ্কার শাস্ত্রে এবং দন্ডীর
কাব্যাদর্শে এই অপভ্রংশ দের স্বীকৃত নাট্য শাস্ত্রের ভাষা রুপ বলে ধরা হয়েছে। সেটা
সপ্তম খৃষ্টাব্দের আশে পাশে। অর্থাৎ গৌর বাংলায় সেটা গুপ্ত সাম্রাজ্যের রাজত্বকাল।
বাংলা এই ভ্যারিয়েসানের একটি গৌড়িয়
প্রাকৃত রুপ (সুনীতিকুমার) মতান্তরে মাগধী প্রাকৃত (ডক্টর শহীদুল্লাহ)। অবশ্য গোটা ব্যপারটা এত সহজ পথ ধরে এসে
পড়ে নি। কারন এই ভাষা একাদিক্রমে এসেছে অন্যান্য বিভিন্ন ভাষার সংস্পর্শে যেমন অস্ট্রো এশিয়াটিকভাষা – যাদের মধ্যে অন্যতম
হল সাওতালি, মুন্ডারি, খাসিয়া ইত্যাদি, সে ছাড়া বোড়ো বা কুকি যাদের ওপরে চৈনিক
তিব্বতি ভাষার যথেষ্ট প্রভাব রয়েছে, সে ছাড়া চাকমা বিষ্ণুপ্রিয়া-মনিপুরী লুসাই আরও কত। এই সবের মধ্যে অনেক কথ্য ভাষা রুপের
নিজস্ব কোন বর্নমালা নেই। সবার সংমিশ্রনের প্রভাব রয়েছে বাংলা ভাষার ওপর যে কারনে
আজও এ বাংলা, বাংলা দেশের বিভিন্ন জেলায়
কথ্য ভাষা এত রকমের ভিন্ন ভিন্ন রুপে বর্তমান। ভাষার এই স্থানিক তথা ব্যবহারিক
বৈচিত্রের থেকে উঠে আসে সেই সব সময়ে আরও কিছু অপভ্রংশ ভাষা রুপ যেমন সৌরসেনী,
মহারাষ্ট্রী। এই মহারাষ্ট্রী র থেকেই আজকের মারাঠীর জন্ম। এই বৈচিত্রের জন্মের
মুলে স্থানিক সংস্কৃতি র প্রয়োজন বেশী ছিল বলে ধারনা করা হয় যে কারনে এই
ভ্যারিয়েশানের পরিচিত নাম নাট্য-প্রাকৃত। ভরত এর নাট্যশাত্রে এর তুলনামুলক ব্যবহার
ও ব্যখ্যা রয়েছে। ভরত লিখেছেন যে সময়ে সেটা সম্ভবত তৃতীয় খৃষ্টাব্দ।
একটা খুব মজার ব্যপার হল ভারতীয় ঐতিহ্যের ব্যপারে সচেতন সব দেশের কর্নধার
দের কাছে প্রস্তাব রাখা হয় যে প্রাচীন ভারতীয় ঐতিহ্যের অঙ্গ হিসেবে পালি কে
সংস্কৃতের পাশেই কন্সটিটিউশন্যাল রিকগ্নিশান দেওয়া হোক ভারতীয় ঐতিহ্যের পরিচিত
ভাষা রুপ হিসেবে, ক্লাসিক্যাল ল্যাঙ্গুয়েজ হিসেবে, তো তারা নাকি পাত্তাই দেন নি,
অথচ বুদ্ধ বা জৈন তীর্থঙ্কর কে তো সবাই এ দেশের প্রাচীন ধর্মগুরু বলেই মানেন এবং
তারাও ফলাও করে ঘোষণা করেন আর এরা নিজেদের ধম্মা’র বা জৈন ধর্মের টেক্সট হিসেবে
পালি কেই ব্যবহার করেছেন। তবুও পালির ক্লাসিক্যাল ল্যাঙ্গুয়েজ লিস্টে নাম নেই।
পালি না কি ডেড ল্যাঙ্গুয়েজ, তাই। হয়ত ইংল্যান্ড বা আমেরিকা থেকে ইন্সটিটিউশন্যাল
কোন প্রস্তাবনা এলেই এই সব কর্নধারেরা নড়ে চড়ে বসবেন। আফটার অল আমাদের সাহেব
প্রীতি তো জগৎ বিখ্যাত।
প্রচলিত বিশ্বাস যে চর্যাপদের স্রষ্টারা নেপালে পালিয়ে যান তাদের রচনা নিয়ে
সপ্তম খৃষ্টাব্দের আশে পাশে তুর্কি আক্রমনের ভয়ে। এখন উত্তর ভারতে তখন সেটা
হর্ষবর্ধনের আমল, হর্ষবর্ধন মারা যান ৬৪৭ মতান্তরে ৬৪৮ খৃষ্টাব্দে। তার সাম্রাজ্যের পরিধিতে উত্তর
পশ্চিম ভারত (তৎকালীন) ভূখণ্ডে
আফগানিস্থান অবধি বিস্থার ছিল, সেই সময়ে হর্ষের মৃত্যুর পর অর্জুনের আমলে
ইদানিং এর ইতিহাস বলছে কিছু সাইনো-টিবেটান ইনভেসান হয়। এ ছাড়া ইতিহাসের বিখ্যাত মাহমুদ
গজনী এই উপমহাদেশ আক্রমন করেন ধ্বংস করেন দশম শতাব্দীতে রাজপুত ক্ষমতার নষ্ট হওয়ার
পর। তার পরের স্বীকৃত ঐতিহাসিক আক্রমণকারী হল সবুক্তগীন। তাহলে তুর্কি আক্রমনের তত্ত্ব
টা কতটা বিশ্বাস যোগ্য। সময়ের নিরিখে শশাঙ্ক মারা যান ৬২৫ খৃষ্টাব্দে, আর
হর্ষবর্ধনের আমলে হিউয়েন সাং বা ভিন্ন উচ্চারনে জুয়ান জাং নালন্দায় ছাত্র ছিলেন
শীলভদ্রের সে সময়টা ছিল ৬৩৭ খৃষ্টাব্দ থেকে ৬৩৯ খৃষ্টাব্দ। সে ছাড়া গৌড় বঙ্গীয় ভু
খন্ডে সে সময় গুপ্ত সাম্রাজ্যের শেষ হয়ে গৌড় সাম্রাজ্যের শেষ হয়ে গেছে। যদি ধরে নেওয়া হয় যে ব্রহ্মণ্য ধর্মের প্রকোপ থেকে বাচতেই
তাঁরা পালিয়ে গেছিলেন নেপালে তাহলে এটাও ধরে নিতে হয় যে তাঁরা পালিয়েছিলে গৌড় বঙ্গের
থেকে, ভারতীয় উপমহাদেশের অন্য কোন প্রান্ত থেকে নয়। কিন্তু তাহলে নেপাল কেন,
নালন্দা নয় কেন?
স্কন্দগুপ্তের বাবা বা চন্দ্রগুপ্ত বিক্রমাদিত্যের ছেলে কুমারগুপ্তের আমলে,
পপুলার ঐতিহাসিক বিশ্বাস, নালন্দার গোড়াপত্তন হয়। সেটা পঞ্চম খৃষ্টাব্দের মাঝমাঝি
বা কিছু আগে। উত্তর ভারতের হর্ষবর্ধনের আমলে অর্থাৎ ষষ্ঠ খৃষ্টাব্দের শেষ ভাগ থেকে
সপ্তম খৃষ্টাব্দের প্রথম দু দশকের মধ্যে যখন নালন্দার দুনিয়া জোড়া খ্যাতি সেই সময় হিউয়েন সাং
উচ্চারনের মতান্তরে জুয়েন জং নালন্দায় শীলভদ্রের শিষ্যত্ব গ্রহন করেন তখন
শীলভদ্রের বয়েস আশি বছরের বেশী, সেটা সপ্তম শতাব্দীর চতুর্থ দশক। সেই সময়ে নালন্দা
এক গমগমে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সেই সময়ের কিছু আগে অন্তত এক দশক বা বেশী আগে তো বটেই
গৌড় বঙ্গে শশাঙ্ক গত হয়েছেন। তাহলে শশাঙ্কর হিন্দু ধর্মের প্রচার ও প্রসারের বলি
নিশ্চয়ই এই চর্যাপদের রচয়িতা রা নন, কারন নালন্দা শশাঙ্কের মৃত্যুর পরেও রম রম করে
চলছে সেটা ঐতিহাসিক সত্য। তাহলে?
উত্তর সম্ভবত একটাই, এরা হীনযান তত্ত্বের তান্ত্রিক মতাবলম্বী ধার্মিক
শ্রমন ছিলেন যাদের বজ্রজানী বা এক ধরনের বৈপ্লবিক হীনযানী মতাবলম্বী বলে জানা যায়,
যারা বুদ্ধ ধর্মের মধ্যেও গজিয়ে ওঠা এলিটিস্ম এর বিরুদ্ধে এক মতবাদ চালু করতে
চেয়েছিলেন এবং স্কলার দের ধারনা এই মতবাদ খুব মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে এই ষষ্ঠ এবং সপ্তম
শতাব্দীতেই। তার মানে গোদা ভাবে ভাবতে বসলে মনে হয় বজ্রযান আমাদের সময়ের নকশালবাদের
মতই এক বৈপ্লবিক চিন্তা চেতনা গড়ে উঠছিল সেই সময়ে, সম্ভবত যার ফলে নালন্দা এদের পক্ষে আশ্রয় নেওয়ার
জায়েগা হওয়ার সম্ভাবনা কোনভাবেই ছিল না। ফলেই বোধহয় এদের বহু দূরে নেপালে চলে যেতে
হয়। এবং সম্ভবত এই নেপালের পথেই তিব্বত পর্যন্ত বজ্রজান ছড়িয়ে পরে। ভাষার উদ্ভবের
এই সময়টাকে সুনীতি কুমার চ্যাটার্জি মধ্য ইন্দো অ্যারিয়ান ল্যাঙ্গুয়েজ ডেভেলপমেন্ট
এর পর্যায় বলছেন। তিনি এই মধ্য পর্যায় কে তিন ভাগে ফেলে তার শেষ পর্যায়টাকে
অপভ্রংশ ভাষার উদ্ভবের সময় বলেছেন। সপ্তম বা অষ্টম শতকের চর্যাপদের পর সেই দশম
শতকের রামাই পন্ডিতের শুন্য পূরাণ লেখাই বাংলা ভাষার আরলিএস্ট সৃষ্টির রেলিক। ময়ুর
ভট্টির সমসাময়িক এই ডোমের প্রতিপালিত পুত্র বঙ্গের ধর্মঠাকুরের ভক্ত ছিলেন। তা
ভক্তিগীতির কবিতার হল শুন্য-পূরাণ।
এইখানে একটা কথা বলা দরকার যে মুহাম্মদ শহিদুল্লাহ বলছেন চর্যাপদের সময়কাল
হল সপ্তম থেকে একাদশ শতকের মধ্যে, আবার সুনীতিকুমার বলছেন এটা দশম থেকে দ্বাদশ
শতকের মধ্যে, আর হরপ্রসাদ শাস্ত্রী বলছেন এদের সময়কাল দশম শতকের আশে পাশে। তাহলে
দেখা যাচ্ছে রামাই পণ্ডিতের লেখা আর চর্যা পদের রচনা হয়ত একই সময়ের পরিসরে, একটু
আগে বা পরে (শহিদুল্লাহ র তত্ত্ব যদি আমরা
না ধরি)।
বজ্রযানের একটি রুপ সহজযান সরাসরি বুদ্ধ ধর্মের প্রাতিষ্ঠানিক অবস্থান কে
উপহাস করতে শুরু করে প্রায় চ্যালেঞ্জ করার ভঙ্গীতে। এদের মৌল অবস্থানের পেছনে উদ্দেশ্য
ছিল সমাজের নিম্নতম বর্গের লোকজনকে যাদের এনাদের ধারনা হয়েছিল সামাজিক ডিগনিটি বলে কিছু নেই সেই তাদের সমাজে তুলে আনা।
চর্যাপদের লুইপা এবং তান্তিপা নাকি এই নিম্ন বর্গের সন্তান ছিলেন। আর রামাই পণ্ডিত
যদিও জন্মেছিলেন নিম্ন ব্রাহ্মণ কুলে
কিন্তু প্রতিপালিত হয়েছেন ডোমের ঘরে।
=======================================
বাংলা ভাষার উদ্ভব ও বিকাশের সময়ে
সমাজের এমন এক প্রাকৃত স্তর আর সেই স্তরের কথা বলার প্রয়োজন সক্রিয় ছিল যেখানে অপেক্ষাকৃত বঞ্চিত
স্তরের লোকেদের বাস। সুনীতিকুমার বলছেন “একটি ভাষা সেই স্থানিক সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ, এবং
ভাষাতত্ত্ব সেই কালখন্ডে সেইপর্বে ঘটে চলা ভাষা ও সংস্কৃতির মিথস্ক্রিয়ার
বর্ননামুলক ঐতিহাসিক এবং তুলনামুলক অধ্যয়নের পটচিত্র”। তিনি আরও বলছেন “বর্ননামুলক
ব্যাকারন আমাদের একটি ভাষা শেখার বা আয়ত্ত্ব করার পদ্ধতি এবং প্রক্রিয়া র সঙ্গে
পরিচিত করায়। পাশাপাশি ঐতিহাসিক এবং তুলনামুলক ব্যাকারন আমাদের সেই ভাষার
অন্তর্নিহিত বিজ্ঞান কে উপলব্ধি করতে সাহায্য করে”। তার কথায় ভাষার বিবর্তন একটি
অনন্যসাধারন ঘটমান বিস্ময়কর ব্যাপার।
ঐত্রেয় আরণ্যকে একথা বলা হয়েছিল যে
আর্যাবর্তের ওই ভু খন্ডে রাক্ষস এবং পিশাচের বাস। উপনিষদের শ্রুতি পর্যায়ের
রচনাকাল কে ভাগ করা হয়েছে প্রচলিত একটা সময়সারনীতে যেটা ১২০০ খৃ পূ থেকে ৫০০ খৃ পূ
পর্যন্ত বিস্তৃত। ঐত্রেয় আরণ্যক এর রচনাকাল খুবই প্রাচীন কারন ঔপনিষদীয় এই খণ্ডটি
মৌল ঋগ বেদের অঙ্গ। অবশ্য আজকের এই আরণ্যকের সমস্ত গদ্যধর্মী বা কাব্যধর্মী রচনা
বা সং-রচনা যে সেই মৌল ঔপনিষদীয় খণ্ডের সময়ের এটা জোর দিয়ে অনেকেই বলতে পারেন না
ফলে সংযোজন হলে তাদের রচনাকাল ও উদ্দ্যেশ্য নিয়ে অনেক প্রশ্ন থাকতেই পারে এবং
রয়েছে। এবং সহজগ্রাহ্য ব্যাখ্যা একটা হতেই পারে যে এই সমস্ত জায়েগাতে ব্যবহৃত
প্রাকৃত অপভ্রংশ ভাষার ব্যবহার সংস্কৃতের ব্যবহারে অভ্যস্ত সমুদায় মেনে নিতে পারে
নি সুতরাং ওই বিবৃত ভু খণ্ডে পিশাচ এবং রাক্ষসের বাস বলা হয়েছে, অর্থাৎ এটা ধরে
নেওয়া যায় যে এই ধরনের প্রকাশ ভাষা সংক্রান্ত বিবমিষা জনিত একটি চলতে থাকা যুদ্ধের ইঙ্গিত যেখানে মুল ভাষা বদলে
যাচ্ছে বিভিন্ন প্রদেশে এবং সেটাও বিভিন্ন মাত্রায় যার ফলে হিন্দি বা মাগধী
অপভ্রংশ থেকে গৌড়িয় বা বাংলা অপভ্রংশ আলাদা হয়ে গেল, বা ওড়িয়া আলাদা হয়ে গেল, কি অসমিয়া
এবং মনিপুরী আলাদা হয়ে গেল, বা অসমিয়া বাংলা ভাষার কাছাকাছি রয়ে গেল।
সমস্যা হল পালির স্বীকৃত নিদর্শন প্রস্তর
বা শিলালিপির সুত্রে পাওয়া যাচ্ছে সেই মৌর্য্য কালে এসে, তার আগে নয়। ফলত সেই
সপ্তম খৃ পূ র আগে প্রচলিত এই অপভ্রংশ ভাষাগুলি আদৌ ছিল কি বা থাকলে তাদের রুপ কি
ছিল তার কোনও প্রামান্য তথ্য নেই। বিশেষত
যেখানে আমরা জানি যে অপভ্রংশ ভাষা রুপ সবচাইতে বেশী সংখ্যায় জন্ম নিচ্ছিল পুর্ব,
মধ্য এবং পশ্চিম ভারতে, যার মধ্যে পুর্ব ভারতেই এর সংখ্যা সবচাইতে বেশী ছিল।
একটু ভিন্ন প্রসঙ্গে যাওয়া যাক। সেই সময়ের সংস্কৃত তথা পালির জন্য ব্যবহৃত
লিপি র নাম আমাদের পরিচিত। সেটা হল ব্রাহ্মী এবং খরোষ্টি। এই লিপিদুটির মধ্যে অনেক
ক্ষেত্রেই সিন্ধু সভ্যতার চিত্রলিপির বর্ণমালার ব্যবহার পাওয়া গেছে। এই লিপি দুটির
মধ্যে এই ভূ খণ্ডে ভাষার উদ্ভব বিবর্তন ও
বিন্যাসের প্রসঙ্গে ব্রাহ্মী কে অপেক্ষাকৃত বিস্থীর্ন ভুখন্ডে ব্যবহৃত লিপি এবং
খারোষ্টি কে অপেক্ষাকৃত সীমিত ভুখন্ডে ব্যবহৃত লিপি হিসেবে মান্যতা দেওয়া হয়েছে। খারোষ্টির ব্যবহার এবং
বিস্তার গান্ধার তক্ষশিলা ও আজকের আফগান অঞ্চলে সীমাবদ্ধ ছিল।
ব্রাহ্মী ও খারোষ্টি র উদ্ভবের প্রসঙ্গে
ভাষাবিদেরা মনে করেন যে এরা প্রায় একটি বা একাধিক সেমিটিক ভাষার বংশের
সন্তান, যেমন অনেকেই মনে করেন যে খারোষ্টির মৌল স্বরের বংশগত মিল বা কুটুম্বিতা
রয়েছে ফিনিশিয় ভাষারুপের সঙ্গে আবার তেমনি অনেকেই দেখিয়েছেন যে এই মিল রয়েছে
ইথিওপিয়ান সাউথ সেমিটিক ভাষারুপের সঙ্গে। যদিও ব্রাহ্মীর ক্ষেত্রে কেউই সন্দেহাতীত
ভাবে এর প্রমান দিতে পারেন নি, শুধু কিছু
মৌল মিলের ছোঁয়ার সুত্রে প্রমান করতে চেয়েছেন এই কুটুম্বিতার কাহিনী। মনে রাখা
দরকার যে যে সমস্ত সেমিটিক ভাষারুপের প্রসঙ্গ এখানে আসছে তাদের জন্মের সময় প্রায়
তিন হাজার খৃ পূ বা তার একটু আগে,অর্থাৎ আজ থেকে প্রায় পাঁচ হাজার বছর বা তার একটু
আগে, যে সময়ে প্রায় একই সঙ্গে ইথিওপিয়ান
বা ইজিপ্সিয়ান, চাইনিজ, ফিনিশিয়ান বা মেসপটামিয়ান এবং সিন্ধু সভ্যতার ভাষার শুরু।
এই চারটের মধ্যের তিনটে ভাষারূপ বিবর্তিত হতে হতে সারা দুনিয়ার বিভিন্ন প্রান্তে কোন
না কোন ভাষা হয়ে বেঁচে আছে বলে ভাষাবিদেরা মনে করেন, শুধু সিন্ধু সভ্যতার ভাষা
রুপটাই গায়েব হয়ে যায়।
সিন্ধু সভ্যতার লিপির কিছু কিছু দৃষ্টান্তমুলক এবং স্ট্রাকচারাল অর্থ করা
গেলেও তাকে একটা ভাষা হিসেবে বুঝে উঠতে পারা যায় নি, সহজ কথায় যদি বা কিছু কিছু
লিপির মর্ম কে অনুভব করা গিয়েছে, কিন্তু সেই লিপিদের ফরমেশানের কোন ব্যাকারন মেনে
কি স্ট্রাকচারাল অর্থবহতা কে নির্মান
করেছে সেটা ধরতে পারা যায় নি, অর্থাৎ ঠিক কি পদ্ধতি এবং প্রক্রিয়ার সুত্রে
কি কমিউনিকেট করতে চাওয়া হয়েছে সেটার মর্মোদ্ধার আজও হয় নি।
খারোষ্টি কে ইরানিয়ান ভাষারূপ বংশোদ্ভুত বলা হয়। উত্তর সেমিটিক ভাষারূপ ফিনিশিয়ান
অ্যারামিকের সঙ্গে এর কুটুম্বিতা প্রমানিত। এটা গজিয়ে ওঠে দক্ষিন পশ্চিম সীমান্তবর্তী গান্ধার আফগানিস্তান এলাকার তৎকালীন
সিন্ধু ভূ খণ্ডে প্রায় পঞ্চম খৃ পূ তে। প্রাক ঐতিহাসিক বিবরন বলে খৃ পূ অষ্টম শতাব্দীর প্রায় শেষ ভাগে (৭১৫ খৃ পূ
থেকে ৭০৫ খৃ পূ র মধ্যে) পারশিয়ান রাজচক্রবর্তী সম্রাট আখমেনাইড তার সাম্রাজ্য
বিস্তার করে, কিছু প্রাক ঐতিহাসিকের বিবরন যে সারা দুনিয়ার কোন কালেই এত বড়
সাম্রাজ্য আর কোন রাজবংশই স্থাপন করতে পারে নি। সেই সাম্রাজ্যের বংশধর দ্যারিয়াস
পঞ্চম খৃ পূ তে গান্ধার আফগানিস্তান এ সাম্রাজ্য বিস্তার করতে চান এবং কথিত তিনি
এখানে র সেই সময়ের ওই স্থানের চিফটেইনদের জমিদারী বা রাজত্ত্ব কেড়ে নেন নি শুধু
অধীনতা স্বীকার করিয়ে কালচার্যাল বিনিময়ের সুত্র স্থাপন করেন। এই আখমেনাইড দের
মাতৃ ভাষা ছিল অ্যারামিক। তাই খারোষ্টি তে
অ্যারামিক প্রভাব সুস্পষ্ট।
এটা মনে করা হয় যে শাশানিয়ান বা
কুশানদের রাজত্ত্বকালের মধ্যভাগ থেকে অর্থাৎ তৃতীয় – চতুর্থ খৃষ্টাব্দ এই লিপিটি
আস্তে আস্তে বিলুপ্ত হয় এবং ব্রাহ্মী র ব্যবহার ব্যাপ্ত হয়ে যায়। ভাষাবিদেরা বলেন
যে পরবর্তী পর্যায়ে ব্রাহ্মী লিপির বিলয় ঘটে প্রাকৃত ভাষারূপের নাগরি লিপিসমুহে। সুনীতিকুমার ব্রাহ্মীর বিবর্তন কে
দু ভাগে ভাগ করেছেন। উত্তর ভূ খণ্ডের লিপিসমুহ যার থেকে আস্তে আস্তে উদ্ভূত হয়ে
অন্যতম হয়ে ওঠে নাগরী লিপি যাকে এগারশ
শতাব্দীতে নামকরন করা হয় দেবনাগরী লিপি বলে, যাতে বর্তমান সংস্কৃত চর্চিত। সুনীতিকুমার
বলছেন সময়ের এই পর্যায়েই আমারা যাদের
ইন্ডিক ল্যাঙ্গুয়েজ বলি তাদের রুপ রেখা তাদের বৈশিষ্ট নিয়ে বিবর্তিত হয়, আলাদা হয়ে
ওঠে। এই ভাষাগুলির লিপিসমুহে র ব্যুৎপত্তি ঘটে এক বিশাল বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে যার ব্যাপ্তি
ছিল উত্তর পশ্চিম ভারত ভু খন্ড থেকে উত্তর ভারতের প্রান্তস্থ নেপাল তিব্বত থেকে
আজকের বাংলা এবং বাংলাদেশ থেকে দক্ষিন পুর্ব এশিয়া। এটা মনে রাখা দরকার যে
খারোষ্টির মত ব্রাহ্মীর যাকে বলে পেরেন্ট্যাল ইনফ্লুএন্স প্রামান্য তথ্যের
ভিত্তিতে সাব্যস্ত করা যায় নি।
এটা বিশেষ করে মনে রাখা দরকার যে এই সমস্ত সময়ের ভাষার মৌল নিদর্শন রয়ে
গেছে সীলমোহর বা নামাঙ্কন মুদ্রা বা কিছু মুদ্রার দুই পিঠে অঙ্কিত বিভিন্ন রুপক বা
প্রতিমুর্তির ছবি, যা পাওয়া গেছে বিভিন্ন
প্রত্নতাত্মিক খননের ফলে। এই সময়ে ভুর্জ-পত্র বা তাল-পাতার ব্যাবহারের কোন নিদর্শন
খুঁজে পাওয়া যায় নি।
খৃ পূ ষষ্ঠ শতাব্দীর শেষ পঁচিশ বছরের সময়ে আখমেনাইড রাজত্ত্ব বিস্তৃত হয়
সাইরাসের নেতৃত্বে আজকের কাবুল কান্দাহার সেই সময়ের গান্ধার অবধি। ইরানিয়ান
সাম্রাজ্য বিস্তারের হাত ধরেই, যার সুত্রপাত ঘটেছিল সাইরাসের পুর্বসূরী
দ্যারিয়াসের হাত ধরে আরও কিছু বছর আগেই, খারোস্টির ইরানিয়ান প্রভাবের কারন হিসেবে
চিহ্নিত করা যায়। ব্রাহ্মী এবং খারোস্টির মধ্যে একটি দ্রষ্টব্য মৌল ফারাক ছিল
খারোস্টি লেখা হত ডান থেকে বাম দিকে ও ব্রাহ্মী ঠিক এর উল্টো।
আলবেরুনী বলেছেন এই ভাষার জন্ম প্রায় চতুর্থ মিলেনিয়া র শেষ দিকে অর্থাৎ
প্রায় তিন হাজার দুশো খৃ পূ তে। ব্রাহ্মী ভাষার বিশেষজ্ঞ রা মনে করেন ব্রাহ্মী
পুর্ন শব্দাংশ-সুচক লিপি হিসেবে গড়ে ওঠে যে লিপি তে প্রত্যেকটি ধ্বনি মাত্রিক দল
আলাদা ভাবে চিহ্নিত হয়। অর্থাৎ ব্যঞ্জন ও স্বরের আলাদা ভাবে চিহ্নিতকরন এই লিপি তে
শুরুর থেকেই রয়েছে, বা সেই ভাবেই সেই লিপি গড়ে উঠেছে, ফলশ্রুতিতে ব্রাহ্মী র এই
স্ট্যান্ডারডাইজড রুপ খারোস্টি র থেকে বেশী প্রাধান্য পায় তার গঠন সংক্রান্ত বৈজ্ঞানিক
সৌন্দর্যের কারনে, এবং খারোস্টি একটা সময়ের পর হারিয়ে যায়, কোন উত্তরসূরী না
রেখেই।
.....................................................................................................................
অমলেন্দু চন্দ