প্রশ্ন শুনে অন্য দিকে তাকিয়ে শুন্য দৃষ্টি মেলে
ধরে মিদ্দা। কি যেন খুজে ফেরে তার চোখ। চৌদ্দগুষ্টির ঠিকুজী খুজেও এমন কাউকে পায়না
সে যাকে আপন ভাবতে পারা যায়। মায়ের চোখ মনে পড়ে না। অত ছোটবেলার অতীত কি মাথায়
থাকে? বাবার নিরুদ্দেশের গল্প
শুনেছে বুজীর মুখে- দূর সম্পর্কের বোন, মা গত হবার পর যে তাকে বড় করে তুলেছে মায়ের চোখের ঠান্ডা দৃষ্টির প্রলেপ দিয়ে।
কিন্ত সে তো থাকে নিশ্চিন্তপূর। মরহুম স্বামীর ভিটেয় বসত গেড়েছে ছেলে-পুলে নিয়ে।
সে তো চেনে তার পুটুকে, সে তো রজব আলী মৃধাকে চেনে
না। এই শেষ বেলায়, কুবেলায় সে তাকে ডাকবে
কিভাবে? তারপরেও যাবার বেলায় এমন
কাউকে খুঁজে পেতে মনটা তার দাপাদাপি করে শক্ত পাঁকে আটকে যাওয়া বুনো শুয়োরের মতো।
সময়ের চাওয়া সময়ে না চাইলে পাওয়া যায়না তা কোনভাবে- ~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
দৌড়
শাখা
নির্ভানা
দিন-তারিখ-মাস-বারের
হিসাব রাখতে ভাল লাগে না রজবের, তাই ওসব সে করেনা এখন। সময়ের
হিসাব নিয়ে আগে কখনও সে যে মাথা ঘামিয়েছে তাও না। সময়কে তার ভয়ংকর লড়াকু শত্রুর
মতো লাগে, তাই সে তাকে এড়িয়ে চলে-
ভুলে যাবার কোশেস করে সজ্ঞানে। তবে তার নিজের কিছু ভাল লাগার জিনিস আছে। বড্ড বেশী
অন্য রকম সেসব- বড় বেশী বিদ্ঘুটে। তারা তাকে ক্ষুধার্ত করে খেকে থেকে নির্দিষ্ট
সময় পর পর- ঠিক অনেকটা দেহের ক্ষুধার মতো, কিছুটা যৌন ক্ষুধার মতোও। ওগুলোর ডাকে সাড়া না দিয়ে তার আর
উপায় কি? সারা দুনিয়ায় তার যদি আপন
কেউ থেকে থাকে তা ঐ অদ্ভুত ক্ষুত-পিয়াস, বন্ধু শত্রু সবই তারা। তারা আছে তার মাথার ভিতরে সাপ-প্যচানি দিয়ে, আছে শরীরের সব কোষে কোষে। ঐ সাপেই তো তাকে এখানে
এই কনডেম সেলে এনে ফেলেছে।
মাথার উপরে চল্লিশ পাওয়ারের একটা বিজলী বাতি
দিন-রাত চব্বিশ ঘন্টা জ্বলে। দেয়ালের কালো রং যেন তার সব আলো শুষে নিয়ে আলোর
ছোবড়াগুলো ঘরময় ছড়িয়ে দেয়। কবরের মাপের লম্বা রুমটার কোন দিকে কোন জানালা নেই, এমনকি কোন ছিদ্রও নেই যেখান দিয়ে এক খামছা রোদ
এসে পড়তে পারে গায়ে। তবে করিডোর বরাবর ভারি শিকের একটা লোহার দরজা আছে যেখান দিয়ে
ধাক্কা মেরে তাকে ঘচিয়ে দেয়া হয়েছিল এই রুমটার ভিতরে, তা প্রায় বছর দেড়েক আগে। পায়ে ডান্ডাবেড়ী, হাতে হাতকড়া, শেকল দিয়ে সেগুলো আবার বাঁধা-ছাদা একগাদা লোহা পিতল গায়ে
পেঁচিয়ে ঘরটার মধ্যে পড়ে পড়ে পেছনের এবড়ো থেবড়ো অতীতটাকে ঘাঁটতে ছেনতে মন্দ লাগে
না রজব আলি মৃধার। অতীতের সব কথা-কাজ-ঘটনা যেন লবন ক্ষেতের ভিতরে পড়ে থাকা বড় বড়
লবনের চাংড়া, খায়েশ জাগলেই হাত দিয়ে ধরা
যায়, ছোয়া যায়। ভারী মজা তো!
অবাক হয় রজব। ভাব-চিন্তার জটিল কোন শেকড়ে বাকড়ে ঘুরতে ঘুরতে এই পড়ন্ত সকালে হঠাত
করে তার নেতার কথা মনে পড়ে যায়। নিজের চোখে কোন দিন দেখেনি তারে, শুধু জবানের আওয়াজ শুনেছে। তারপরেও তারে স্মরনে
আসে সহসা। রজব কি তাকে কোন দিন ভুলতে পেরেছে, না কোন দিন পারবে? না-ভোলা সেই নেতার কথা মনে আসায় আচমকা পুরা জেলখানাটা কাঁপিয়ে আরব্য রজনীর
চল্লিশ ডাকাতের সর্দারের মতন একটা ‘হা হা’ হাসি ছেড়ে দেয় সে শুন্যে। আওয়াজ শুনে যেন চমকে
ওঠে সবাই। দুই-তিন জন কারারক্ষী দৌড়ে আসে রজব আলীর নির্জন কক্ষটাকে লক্ষ করে।
-র-র-রজব আলী সাহেব, কি হইছে? কি হইছে? আফনের কোন কিছু লাগলে আমাগো কইবার পারেন।
-এই ব্যাটা, রজব আলী সাহেব কিরে? আমার নাম মিদ্দা, জানস না এইটা? আমি কি তোগো জেলখানার জামাই নাকি?
বিরক্ত হয় রজব। আজকে কী যে হয়েছে এদের, বড্ড বেশী ত্যক্ত করছে জেলের লোকগুলো। সেই
সাতসকালে, সূর্য্যও তখন ওঠেনি, জেলার সাহেব আর ইমাম সাহেব এক সঙ্গে এসে হাজির।
ভোর সকালের ঘুম বলে কথা, খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে সেটাকেও
দেহছাড়া খাঁচাছাড়া করে ছাড়লো তারা। আড়মোড়া দিয়ে আস্তে আস্তে পোলেস্তারা উঠে যাওয়া
মেঝে ছেড়ে উঠে বসে রজব মিদ্দা।
-আজকে আপনের শ্যাষ দিন। আল্লাহ সোবহানাল্লাতা’য়ালা আমাদের যতটুকুন হায়াত দিছেন, সেটাই শোকর গুজার। আপনের এই নতুন লেবাস, খুসবু, সাবান আর মেছোয়াক থাকলো। আপনি গুশল করে ফজরের নামাজটা পড়ে নিতে পারেন। আপনাকে
আমি তওবা পড়াবো ইনশাল্লাহ।
নুরানী চেহারার ইমাম হুজুর কি জানি কি এক ভাষায়
সুন্দর করে কথা বলে চলে। তার কথার বয়ানে বেহেশতের নরম সুখের খুশবু পায় মিদ্দা। তবে
হজুরের নুরানী চেহারার উপরে সুরমা টানা চোখ দুটো যেন পুরা মুখটাকে একটা আস্ত
মেয়েলোকের চেহারাটাকে তুলে ধরেছে। বড্ড বিরক্ত লাগে- পুরান মরন-ক্ষুধাটা মাথার
ভেতরের সাপটার শরীরে ছোট্ট একটা মোচড় খায়। অবাক হয়ে দেখে সে, জেলার সাহেব মুখ কাচুমাচু করে হুজুরের পাশে
দাড়িয়ে রয়েছে, হাতে তার বড় এক ফাইল- লাল
ফাইল। তার মুখের উপরেও যেন বসান ছন্নছাড়া মেয়েলোকের মুখ। রজবের মনে কিছুটা মায়া
জাগে লোকটাকে দেখে- কি অদ্ভুত পেশা, আসামী ঠেঙ্গিয়ে ভাত খায়, সংসার চালায়। মনে মনে ভাবে রজব- যেমন তারও অদ্ভুত
এক পেশা ছিল- নেতার কথায়, তাজা টাকার গন্ধে শত্রুর
লাশ নামাইতো মেঘনার উদরে, ব্রীজের উপর থেকে ধপাশ নীচে
অন্ধকারে, তারপরে সব বস্তা হাওয়া। তার
আগে নামাইতো শুধু মাইয়া লোকের লাশ- খারাপ মাইয়া লোকের লাশ, তবে তা পেশায় না- করতো নেশায় পড়ে- মরন-ছোবলে পড়ে যাওয়া কাতর
চোখের নেশায়- মাথার ভেতরে পেচিয়ে থাকা সাপের তাড়নায়। হুজুরের বয়ান শেষ হলে মুখ
খোলে জেলার সাহেব।
-রজব আলী সাহেব, ভালো-মন্দ কিছু খেতে ইচ্ছা করে?
উত্তরে মাথাটাকে ডাইনে বায়ে নাড়ে মিদ্দা। কথা
শুনে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে জেলার সাহেবের মুখের দিকে, যেন এমন একটা বাক্য জীবনে কোন দিন সে শোনেনি।
-কারো সাথে দেখা করতে মন চায়, আপন কারো সাথে?
প্রশ্ন শুনে অন্য দিকে তাকিয়ে শুন্য দৃষ্টি মেলে
ধরে মিদ্দা। কি যেন খুজে ফেরে তার চোখ। চৌদ্দগুষ্টির ঠিকুজী খুজেও এমন কাউকে পায়না
সে যাকে আপন ভাবতে পারা যায়। মায়ের চোখ মনে পড়ে না। অত ছোটবেলার অতীত কি মাথায়
থাকে? বাবার নিরুদ্দেশের গল্প
শুনেছে বুজীর মুখে- দূর সম্পর্কের বোন, মা গত হবার পর যে তাকে বড় করে তুলেছে মায়ের চোখের ঠান্ডা দৃষ্টির প্রলেপ দিয়ে।
কিন্ত সে তো থাকে নিশ্চিন্তপূর। মরহুম স্বামীর ভিটেয় বসত গেড়েছে ছেলে-পুলে নিয়ে।
সে তো চেনে তার পুটুকে, সে তো রজব আলী মৃধাকে চেনে
না। এই শেষ বেলায়, কুবেলায় সে তাকে ডাকবে
কিভাবে? তারপরেও যাবার বেলায় এমন
কাউকে খুঁজে পেতে মনটা তার দাপাদাপি করে শক্ত পাঁকে আটকে যাওয়া বুনো শুয়োরের মতো।
সময়ের চাওয়া সময়ে না চাইলে পাওয়া যায়না তা কোনভাবে- এমন একটা ভাব ধরা দেয় মিদ্দার
বুনো বোধে। সময় কেটে যায়, প্রশ্নের উত্তর না পেয়ে চলে
যায় জেলার সাহেব, চলে যায় ইমাম সাহেবও।
আপত বিদায় হয়ে যাবার পর মিদ্দা যথারীতি অতীত
দিনের খাতা খুলে বসেছিল- লবনের চাঁইয়ের উপরে হাত রেখে বুঝেছিল স্মৃতিদের হাতেনাতে
কিভাবে ধরতে হয়। ঘোর লাগে তার মনে। কিন্তু পড়ে যাওয়া সকালের ঝাঝালো হাওয়ায়
কারারক্ষীগুলো অমন রৈ রৈ করে ছুটে আসায় সে ঘোর কেটে যায় তার। বেশী কথা বলতে ভাল
লাগে না মিদ্দার। দু-এক শব্দে রক্ষীদের বিদায় করেছে সে- এবার রক্ষে। সুতো ছিড়ে
যাওয়া স্মৃতির পুরান ঘুড়িটাকে খুজে পেয়েছে আবার সে- এখান থেকে তবে শুরু হোক অতীত
ঘাটার কাজ। নেতাকে সে আবার খুজে পায় সেখানেই। সেদিনের কথা পরিস্কার মনে আছে রজব
আলীর। বসে ছিল নিজের ঘরে আনমনে- মোবাইল ফোনটা বেজে উঠলো- ধরবে কি ধরবেনা দ্বিধায়
ছিল- ধরলো শেষে ফোনটা মৃধা।
-কেমন আছেন রজব আলী সাহেব। আমি কি কিছুটা সময় আপনার সাথে কথা
বলতে পারি?
অচেনা মেয়েলী স্বরের পুরুষ কন্ঠ। ভদ্দরলোকদের
জবানে কথা কয়। কচিত দু-একটা ফোন আসে মিদ্দার। আজকে অপরিচিত লোকের ফোন পেয়ে একটু
অবাকই হয় সে।
-কইতে পারেন। তয় আপনারে তো আমি চিনলাম না। আপনের পরিচয়?
-আমাকে আপনি নেতা বলতে পারেন। আসলে আমি তাইই। নিয়মিতভাবে
আমার কিছু কাজ আপনাকে করে দিতে হবে। তার জন্য আপনাকে পারিশ্রমিক দেয়া হবে।
-কিন্তু কি কাম তা তো কইবেন!
টাকায় নেশা ধরে রজবের। বড় বড় বান্ডিলের একটা
দুইটা যেন সে দেখতে পায় হাতের কাছে- সেখান থেকে মাতাল এক গন্ধ এসে নাকে লাগে। আর
তাকে কারখানায় কাজ করা লাগবে না- সময় অসময় ছিঁচকে চুরি করা লাগবে না। লোভে কাতর হয়
মন। নিজের ভবিষ্যত উত্তোরনের কথা ভেবে আরামে হাত-পা সির সির করে তার।
-হ্যা, বলছি সংক্ষেপে। মন দিয়ে
শুনুন। ক্ষমতা একটা বিরাট ঝামেলা আরকি- সেই পথে হাটতে হাটতে কিছু কাঁটা এসে সব সময়
পায়ে বেঁধে। পথের ঐসব কাঁটা সরিয়ে দিতে হবে। আপনার কাছে ঠিক সময়ে সঠিক হাতিয়ার, কাঁটার নিখুত বিবরন এবং সঠিক পারিশ্রমিক পৌছে
যাবে। কাজ এইই। মনে করেন আপনি দেশের জন্যে কাজ করছেন। পারবেন না করতে?
-হ, পারুম। আমনের কাম না কইরা
আমার যে আর পথ নাই, এইটা বুঝতাছি এহন। আমার মনে
লয়, আমনে রাজার রাজা, রাজাগো বাপ। তয়, এক একটা কামে কতো ট্যাকা দিবেন?
-এসব আপনাকে কিছুই ভাবতে হবে না। কাজের আগে আপনার আশার চেয়ে
বেশী আপনার ব্যাংক হিসাবে পৌছে দেয়া হবে। তবে কিভাবে কাজটা করবেন তা আমার থেকে
আপনিই ভালো করে জানেন। আপনার সম্পর্কে আমরা সব জানি। তবে একটা অনুরোধ, ঐ মেয়ে নামানোর পরিমানটা একটু কমিয়ে দিতে হবে।
-ঐটা পারবোনা নেতা স্যার। আমনে যহন আমার সব জানেন তাইলে কই, এইটা ছারলে আমি বাচতা পারুম না। সুন্দরী শইল
খাটানো মাইয়া গুলার চোখে যত করুন মিনতি ঝরে আমার তিয়াসের পেয়ালা ততো বেশী ভরে। তয়
সবের আগে ভেতরের পুরুষটারে শান্তি দিয়া লই- বেবাক সুখের রাজা। তারও পরে অগো কইলজা
চিরা দেইখাই আমার পরানে শান্তি। আমি ঘুমাইবার পারি, আমি বাচি। তারও পরে মেঘনার উদরে যায় অরা, বস্তা পড়ে ঝপাত ঝপ। এইডা আমি কেমনে কমাই, স্যার?
-বুঝেছি। তবে খেয়াল রাখবেন সব কিছু যেন গুলিয়ে না ফেলেন।
রাখি এখন।
মেয়েলী কন্ঠ বন্ধ হয়। বন্ধ মোবাইল ফোনটার দিকে
মুগ্ধদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে রজব আলী মৃধা।
মৃধার বাড়ীটা এক আজব সুরক্ষার ডেরা- সত্যিই আজব।
সে থাকে লোকালয়ের শেষ সীমানায়- মানুষের সঙ্গ তার বিছার কামড়। মরন যে কোন মার্গের
কলা হতে পারে তা তার বাড়িতে না ঢুকলে বুঝা দুস্কর। কিন্তু এমন মানুষ কেউ নেই যে
তার ঘরে ঢোকে ছলে-বলে-কুতুহলে অথবা সাহসে। তার একটা ঘরে সারি সারি বড় দু-তিনটা
কাঁচের জার। তার ভিতরে দশ-বারটা করে চোখ। মানুষের চোখ ভেসে আছে কোন জটিল রাসয়নিক
তরলে- মমি হবার জন্যে। চোখগুলো সব খারাপ মেয়েলোকের। তারা সব আকারে, রং-এ কিছুটা ভিন্ন হলেও কেমন জোড় বেধে আছে
নিরুপোদ্রবে। যেমন, বাণুর চোখ জোড় বেঁধেছে
ফুলিরটার সাথে, বকুলেরটার সাথে সাথির চোখ
আবার ময়মুনার চোখের সাথে জোড় বেঁধে আছে সকুন্তলারটা। তবে সব চোখে একটা জিনিস লেগে
আছে- সেটা মিনতী, বাচার কাকুতি ভয়ে আর
ত্রাসে। এ সম্পদ জলে বিসর্জন দিতে পারে না মিদ্দা, তাই এই ব্যবস্থা- মমি করে রেখে দিয়েছে জারে। ফেরাউনদের বিরল
প্রতিভা ভর করেছে তাকে। বন্দী চোখগুলোর চোখে চোখ রেখে দানব নৃত্য করে বুনো মিদ্দা।
তাতে ধীরে ধীরে তার সামনে পরিস্কার হয়ে যায় জাহান্নামের রাস্তাটা- খুলে যায়
রাস্তার শেষে নরকের দরজা। ঐ পথে আসা যাওয়ায়ই তার আনন্দ। রজব আলী একজন মরন শিল্পী, যম শিল্পী। শিল্প জীবন্ত হয়ে উঠেছে তার হাতে। এই
কলা তার পিয়াস মেটায়, মাথার ভিতরে প্যচানো
সরিসৃপটাকে শান্তি দেয় এক দন্ড। তবে একসময় এগুলোতে আর কুলায় না, এক ঘেয়েমী এসে যায়- ঘুমের আগে জারের চোখে চোখ
রেখেও আর ঘুম পায় না রজব মৃধার। তখন নতুন শিকারে বের হওয়া লাগে।
সময় বয়ে যায় তার নিজের গতিতে। মেঘনা নদী দিয়েও
প্রচুর জল বয়ে যায় স্বচ্ছন্দে। এত পানি সেখানে তবু তার উদর ভরে না। তাইতো লাশ দিয়ে
ভরতে হয় পেট। মেঘনা-পূত্র বটে রজব আলী- মায়ের দুঃক্ষ ভালই বোঝে। এখন আর শুধু খারাপ
মেয়েলোকই পড়ে না, ব্যাটালোকও পড়ে সমান তালে
সেখানে। তবে কিছু লাশ পড়ে নেশার ঝোকে, আবার কিছু পড়ে পেশার ঝোকে, এই যা ফারাক। যা হয় তা কারো
না কারো ভালর জন্যই হয়। রজব আলীর উদয়ে কারো না হলেও এই রাজ্যের কোতোয়ালদের ভাল
হলো। তাদের এখন মৃধার দিকে বেশী নজর দেবার দরকার হবে না। শুধু কোতোয়াল না, ভাল হয়েছে মিদ্দারও। এখন তার অনেক ব্যস্ততা, সেই সাথে ক্ষমতাও। জিহবায় তার নতুন স্বাদের আঁচ
লেগেছে। মানুষের সব দিন সমান যায় না। এই সব দিন-রাতের কোন এক সময়ে ভুল করে বিধি
তার কলকাঠি উল্টা নাড়ে। জটিল প্যাঁচান এক রাজনীতির ভেতরে পড়ে যায় মিদ্দা। নেতা
স্যারের কোন এক জাতভাইকে নামিয়ে ফেলে মেঘনার উদরে। তারপরে খুব সংক্ষিপ্ত এক
ইতিহাসের কাছে হাতে-নাতে ধরা পড়ে যায় মৃধা। ইতিহাস ক্ষমা কারে কয় জানে না, তাই সেই তাকে এনে ফেলে এই কনডেম সেলে।
রজব আলীর আজকে শেষ দিন। একথা এই জেলখানার সবাই
বিশ্বাস করলেও সে বিশ্বাস করে না। কারন তার আছে ভয়াবহ মজবুত অতীত আর ভবিষ্যত। কি
এক ঘোরে সেসব সে দেখছে একেবারে ধরাছোয়া বর্তমানের মতো। ভবিষ্যতের দুটো কাজ তার করা
বাকী। একটা তার নেতা স্যারের বিষয়। মেয়ালী কন্ঠের মানুষটারে সে একবার দেখতে চায়-
একবার মাত্র। কলজেটা তার চিরে সে দেখবেই, তা সে মেয়ে হোক আর পুরুষ হোক। আরেকটা হলো বুজির সাথে দেখা করা, তার পায়ে একটুখানি মাথাটা রাখা। কোনটা আগে- আগে
নেতা স্যার, না আগে বুজী? আগে বুজীই- সিদ্ধান্ত পাকা হয়। নাটকের শেষ
অঙ্কের রিহার্সাল বহুবার হয়েছে, হচ্ছে এবং আরও হবে।
ওস্তাদের উপর তার ভরসা আছে ষোল আনা। মিদ্দা জানে তার অস্তাদ ভূবন জয়ী। সে তাকে
শিখিয়েছে কি ভাবে ফাসীর দড়ি পরেও শ্বাসটাকে ধরে রাখা যায়, কিভাবে দড়ির ধাক্কা থেকে ঘাড়টাকে বাচানো যায়, কি ভাবে নাড়ির নড়াচড়া লুকিয়ে রাখতে হয় মড়ার মতন।
সব শিক্ষার শেষ পরীক্ষা হয়ে যাবে আজ- ওস্তাদের মার শেষরাত্রে। তাকে ফাসী দিয়ে
মারবে? কি বেয়াক্কেল এরা! নাটকের
শেষ অঙ্কের আগাম কুশীলবদের সাথে আলাপ করছে মিদ্দা বিড় বিড় করে। বহুদিন পরে বুজী
তাকে দেখে কি করবে, কি বলবে? আবার নেতা স্যার তার উদয়ে থত্তরিকম্প হয়ে কিভাবে
প্রান ভিক্ষা চাইবে- সেসব যেন তার সামনেই ঘটছে ঘটার আগে। ভয় তাই তার পালিয়েছে
কর্পুরের মতো। কি ঘটছে আশেপাশে তার কোন খবর নেই তার মাথায়। বর্তমান তার মৃত। তাই
গুটি গুটি পায়ে সময় ঠিকই পৌছে গেছে ভোররাতের সাড়ে তিনটার কাঁটায়। সব আয়োজন শেষ-
ফাসীর দড়িতে তেল মাখানো থেকে শুরু করে মঞ্চ ধোয়া মোছা পর্যন্ত সব। সবকিছু ঠিকঠাক
নিয়ম মাফিক এগুচ্ছে, দেখল মিদ্দা। এক সময় জল্লাদ
এসে যমটুপি পরিয়ে দিল। এখন জেলার সাহেব রুমাল উচু করলেই জল্লাদ দড়ির সুইচটায় টিপ
দিবে। কয়েক মুহুর্তের ভিতরে জেলার সাহেব উচু করল তার হাতে ধরা রুমাল। জল্লাদও এক
সেকেন্ড দেরী না করে তার দায় সারলো। কিন্ত এসব কি দেখছে মৃধা! সে তাহলে সত্যিই
বেচে আছে! মনে মনে ওস্তাদের পায়ে একটা চুমু দিল সে। শেষমেষ ডাক্তার এসে তাকে মৃত
ঘোষনা করে কাগজে কি জানি লিখে দিল খচখচ করে।
সব দেখছে মিদ্দা- আগা থেকে পাছা সব। যত দেখছে
ততো অবাক হচ্ছে। একে একে সব কাজ এগুচ্ছে। গোসল হয়ে গেছে। এবার গোরস্থান যাত্রা। এ
যাত্রায় তিনজন খোদক আর একজন রক্ষী সাথী হলো মিদ্দার। গোরস্থানে লাশ নামালেই পালাতে
হবে- সে এক মজার খেলা হবে সেখানে- এসব ভেবে হাসি পায় মড়া মিদ্দার। বিশ্রী শব্দ করে
লাশ বহনকারী লক্কর ঝক্কর ভ্যানটা থেমে গেল ঠিক গোরস্থানের গেটে। মিদ্দার
দৃষ্টিশক্তি যেন বেড়ে গেছে দ্বিগুন। শ্রমিকরা লাশসহ খাটিয়াটা গেটে রেখে একটু
প্রস্তুত হয়ে নিচ্ছে। কেউবা বিড়ি ধরিয়ে দু-একটা সুখটান দিচ্ছে। সূর্য্য উঠতে এখনও
ঘন্টাখানেক বাকী। আকাশটা সামান্য ফর্সা হয়ে উঠলেও আলো আঁধারির একটা রহস্যময় মিশ্রন
চারদিকটা বেশ খানিক নির্জন করে রেখেছে। এইটাই মোক্ষম সময়। কিছু করতে হলে তার এখনই
সময়, তা না হলে একেবারে গোরের
তলে- মনে মনে ভাবে রজব মিদ্দা। খাটিয়ায় উঠে বসলো, বসা থেকে দাড়ালো সে। কন্ঠটা যতদূর সম্ভব ভারি করে গোটা দুই
শব্দ উচ্চারন করলো। শব্দ শুনে আর অবিশ্বাস্য দৃশ্য দেখে জ্ঞান হারিয়ে ধপাস করে পড়ে
গেল মাটিতে দুই জন। বাকী দুজন প্রাণপণ চিতকারে দিকবিদিক ছুটে পালালো। এবার মিদ্দার
পালা। দ্রুত হাতে কাফনের কাপড়টাকে লুঙ্গির মতো পরে নিয়েই দৌড়। রজব আলীর দৌড় আর শেষ
হয় না যেন। মাঠ-ঘাট-বিল পেরিয়ে, শহর-টিলা-ক্ষেত পেরিয়ে
অবশেষে পড়লো গিয়ে মাঝারী আকারের এক নদীর পাড়ে। আহ, কি শান্তি! বুক ভরে মুক্ত শীতল ভোরের বাতাসে কয়েকবার শ্বাস
নিয়ে আবার দৌড়াতে শুরু করলো মৃধা। তাইতো, ঠিক পথেইতো সে চলেছে। এই নদীর পাড় বরাবর আর কিছুদূর দোড়ালেইতো নিশ্চিন্তপূর, তার বুজীর গ্রাম। ভোর সকালে বুজী কাপড় ধুতে আসে
নদীর ঘাটে। কতদিন পরে বুজীর সাথে দেখা হবে- আবেগে উত্তেজনায় আরো জোরে দৌড়াতে থাকে
মিদ্দা। ঐতো আবছা দেখা যাচ্ছে সেই পুরান নদীর ঘাটটা। ভাল করে চোখ রগড়ে দেখলো সে, কে যেন ঘাটে কাপড় ধুচ্ছে। বুজীর পায়ের ধুলো নিতে
হবে, তার জীবন ফিরে পাবার গল্পটা
তাকে শুনাতে হবে। আর বুঝি ধরে রাখতে পারে না মিদ্দা নিজেকে। হাত উচিয়ে চিতকার করে
ডাকতে যাবে এমন সময় সূর্য্যের আবছা আলোয় দৃষ্টি তার আটকে গেল চলমান নদীর শরীরে।
কন্ঠের চিতকার হলকুমে আটকে গেল মিদ্দার। একি দেখছে সে! নদীর বুক ভরা শত শত
বস্তাবন্দী লাশ- কারো বা গলিত হাত পা অথবা মাথা বেরিয়ে এসেছে বস্তার ফাঁটা গলিয়ে।
সব লাশে চোখ ঘুরে একসময় একটা আনকোরা মড়ায় এসে চোখ আটকে গেল তার। “হায় আল্লা, এ কার লাশ! এতো আমারই। কি করে আসলো এটা এখানে! আমি কি তবে
বেঁচে নেই!”- কান্নায় সব কথা গলায় আটকে
গেল তার ঠিক ফাঁসের মতো। নিজের শবটার উপরে তার খুব মায়া হতে লাগলো। এটাকে ছেড়ে সে
এখন আর কোথাও যেতে পারবে না। বুজীর কাছে তার আর ফিরে যাওয়া হবে না। নেতা স্যারকেও
আর দেয়া হবে না শেষ শিক্ষাটা। নিজের উপরে তার বড্ড অভিমান হলো, অভিমান হলো ওস্তাদজীর উপরও। নদীর স্রোতে টান
পড়লো। নদীর বুকে ভাসমান লাশের মিছিলও এগিয়ে চললো তরতর করে। তার এই দেহের সতকার না
হওয়া পর্যন্ত তার মুক্তি নেই। কিন্তু কে করবে সতকার? বড় কষ্ট হলো- কষ্টে বুকটা ভেঙ্গে যেতে লাগলো মিদ্দার, কিভাবে গলিত বস্তাবন্দী শবের মিছিল তার দেহটাকে
ঘিরে ক্রমাগত ফরিয়াদ করে চলেছে তাই দেখে। একটা তীক্ষ্ণ দানব-হাসি একরাশ ব্যাঙ্গ আর
শ্লেষ নিয়ে কানে এসে আছড়ে পড়লো সহসা। এ কার হাসি? নেতা স্যারেরইতো- ধরতে পারে মৃধা। সে হাঁসির কোন শেষ নেই-
থেকে থেকে তা ক্রমাগত রক্তাক্ত করে চলে মিদ্দার মরুময় অন্তর অপমানে আর বিদ্রুপে।
এতদিনে বুঝতে পারে সে- নেতা স্যার আসলে মহাশিল্পী, তারও থেকে বড় শিল্পী। কিন্ত সে তো সুখেই আছে। তাই সব ফরিয়াদ
কাঁধে নিয়ে ধাবমান শব-মিছিলের সাথে দৌড়াতে লাগলো সে একা। এই যাত্রা কোথায় শেষ হবে-
কেউ জানে না তা। তবে রজব মৃধার বুনো ভোতা বোধে সব অজানাই ধরা দিল একে একে। কি এক
রহস্যময় উপায়ে সে জানতে পেল- চিরচেনা এই মেঘনার কোল বরাবর তার এই দৌড় কোন দিন শেষ
হবে না, কারন এখানে এই মেঘনা নদীর কোন
শুরুও নেই শেষও নেই, আছে শুধুই স্রোত।
শাখা নির্ভানা