সম্পাদকের কলমে

 


সম্পাদকের কলমে

 


করোনার সংকট কতটা স্বাস্থ্য জনিত আর কতটা জীবন জীবিকা সংক্রান্ত অর্থনৈতিক বিষয় সেই বিষয়ে মনযোগ দেওয়ার সময় এসে গিয়েছে বলেই মনে হয়। দেশে দেশে করোনার বিপুল সংক্রমণ ও মৃত্যু সত্যিই কি মহামারীর আকার নিয়েছে? নাকি সংক্রমিতের তুলনায় মৃতের সংখ্যা ঠিক ততটা ভয়াবহ নয়। যতটা আতঙ্কিক আমরা সকলেই। কিংবা যতটা আতঙ্কিত করা হচ্ছে আমাদের। সরকারী প্রশ্রয়ে মিডিয়ার মদতে। জানুয়ারীতে বিশ্বব্যাপী করনা ছড়িয়ে পড়ার সময় থেকে পুরো দশ মাস সময় অতিক্রান্ত। এই সম্পাদকীয় লেখার সময় আবিশ্ব করোনা সংক্রমিতের মোট সংখ্যা: ৪ কোটি ৯৬ লক্ষ ৮৫ হাজার ৩১১ জন। আর সুস্থ হয়ে উঠেছেন ৩ কোটি ৫২ লক্ষ ৬৮ হাজার ৯৩৭ জন। আবিশ্ব মৃত্যু হয়েছে ১২লক্ষ ৪৯ হাজার ০৩০ জনের। না মৃতের সংখ্যাটি কম নয়। গড়ে প্রতি বছর সাধারণ ইনফ্লুয়েঞ্জায় মারা যায় যেখানে ছয় থেকে আট কি নয় লক্ষ মানুষ। তবুও এখন অব্দি আবিশ্ব পরিসংখ্যান আনুসারে কারোনা সংক্রমিতের ভিতর সুস্থতার হার ৯৭% এবং মৃত্যুর হার ৩ শতাংশ। এইখানেই প্রশ্ন, করোনা কি সত্যই মহামারীর আকার নিয়েছে? না’কি মানুষের প্রয়াসে মহামারী আটকিয়ে দেওয়া সম্ভব হয়েছে। অন্তত এখন অব্দি। এই দশ মাসে। এবং আমাদের মনে রাখতে হবে করোনার কোন ওষুধ এখন অব্দি আবিষ্কৃতই হয় নি। এবং যে রোগের ওষুধই আবিষ্কার হয় নি, সেই রোগের মৃত্যুর হার বিগত দশ মাস ব্যাপী ৩% এর ভিতর আটকিয়ে রাখা রীতিমত সাফল্যের বিষয়। এবং সবচেয়ে বড়ো কথা মৃত্যুর এই হার বিশ্বের মোট জনসংখ্যার অনুপাতে নয়। মোট করোনা সংক্রমিতের অনুপাতে। যদি মোট জনসংখ্যার অনুপাতে হতো। তাহলে আমরা বলতে পারতাম লকডাউন একটা বড়ো সাফল্য। ৯৭% মানুষের জীবন রক্ষা করা গিয়েছে। কিন্তু ৩% মৃত্যুর হার যখন মোট সংক্রমিত রুগীর তুলনায়, তখন সেই হার কোনভাবেই লকডাউনের উপরে নির্ভরশীল নয়। বরং একদিকে প্রচলিত স্বাস্থ্য পরিকাঠামো ও চিকিৎসাবিজ্ঞানের অগ্রগতি ও অন্যদিকে করোনার কম ভয়াবহতার উপরেই নির্ভরশীল। অর্থাৎ তর্কের খাতিরে যদি ধরেই নিই। বিশ্বব্যাপী লকডাউন সফল। তবে বলতেই হবে সেই সাফল্য মোট সংক্রমিতের সংখ্যায় হতে পারে মাত্র। আবার যদি ধরে নেওয়া যায়। কোথাও যদি কোন লকডাউন করা নাই হতো। তাহলেও কিন্তু এই ৩% মৃত্যুর হারের কোন হেরফের হতো না। সেক্ষেত্রে অবশ্যই মোট সংক্রমিত রুগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেত। মোট আরোগ্যলাভ করা রুগীর সংখ্যাও বৃদ্ধি পেত। বৃদ্ধি পেত মোট মৃতের সংখ্যাও। কিন্তু প্রতিটি পরিসংখ্যানের তুলনামূলক শতাংশের হার একই থাকতো।


আর মূল প্রশ্নটা কিন্তু এইখানেই। লকডাউন করে ও না করেও যদি সুস্থতার হার ও মৃত্যুর হার একই থাকে। এবং করোনার ওষুধ আবিষ্কার ছাড়াই। তবে এই লকডাউনের যৌক্তিকতা কতটুকু? এবং চিত্রের অন্যদিকে রয়েছে লকডাউন করে দিয়ে দেশে দেশে অর্থনৈতিক বিপর্য্যয় সৃষ্টি করে মানুষের জীবন জীবিকাকে ঘোর সংকটে ফেলে দেওয়ার বিষয়টি। বিষয়টি আর আশংকার ব্যাপার নয়। বিষয়টি এই সময়ের ঘোর বাস্তব সত্য। দেশে দেশেই সত্য। বিশেষ করে ভয়াবহ সত্য আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের অনুন্নত দেশগুলির ক্ষেত্রে। লকডাউনের প্রথম ছয় মাসে এই ভারতবর্ষেই নতুন করে পনেরো জন শিল্পপতি বিলিয়নীয়র হয়ে উঠেছেন। এবং আরও মজার কথা পূর্বের কোন বিলিয়নীয়রই লকডাউনের দশ মাসে সম্পত্তির মুল্যায়ণ কমে মিলিয়নীয়র হয়ে গিয়েছেন, এমন কোন তথ্য কারুর হাতে নাই। উল্টে বিলিয়নীয়রদের সম্পদের পরিমাণ এই সময়ে আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। দেশে দেশে চাকুরীজীবিরা সংকটে। অধিকাংশেরই মাস মাহিনায় কোপ পড়েছে। শ্রমজীবি মানুষরা কাজ হারিয়ে বেকার হয়ে পড়েছেন। দেশে দেশে কলকারখান বন্ধ করে সাধারণ মানুষের জীবন জীবিকাকে বিপর্য্যয়ের কবলে ফেলে দেওয়া হয়েছে অত্যন্ত সাফল্যের সাথে। ব্যাবসা বাণিজ্যের উপরে করোনার প্রভাব পড়েছে ব্যাপক ভাবে। ছোট ও মাঝারি ব্যাবসায়ীদের অবস্থা মোদেই ভালো‌ নয়। অর্থনীতির চাকা অত্যন্ত ধীরগতিতে চলছে। আকাশ ছোঁয়া দ্রব্যমূল্যের বৃদ্ধি মানুষের দৈনন্দিন জীবনকে সংকটজনক করে তুলেছে। অথচ দেশে দেশে বিলিয়নীয়রদের মোট সম্পদের পরিমাণ ফুলে ফেঁপে উঠছে। অর্থনীতির কোন জাদুতে এটা সম্ভব হচ্ছে। সেটি সাধারণ মানুষের ধারণার বাইরে। কিন্তু ঘটনা যে ঠিক এই রকমই সেটি তো নিশ্চিত সত্য। তখনই কি মনে হয় না, লকডাউনের আসল সাফল্য এইখানেই?


লকডাউনের ফলে যে অর্থনৈতিক বিপর্য্যয় নেমে এসেছে। সেই বিপর্য্যয় কোন ভাবেই মিলিয়নীয়র বিলিয়নীয়রদেরকে স্পর্শ করতে পারেনি। পারলে করোনায় মানুষের মৃত্যুর হার বেশি হলেও দেশে দেশে লকডাউন হতো না যে, সেকথা বলে দেওয়া যায় চোখবুঁজেই। করোনার আতংক ছড়িয়ে দিয়ে এই যে লকডাউন করে অর্থনীতির চাকাকে বিশেষ ভাবে নিয়ন্ত্রণের খেলা। এই খেলাটি বিশ্বে এই প্রথম। এর কোন পূর্ব ইতিহাস নাই। আর নাই বলেই সাধারণ জনগণের চোখে ধুলো দেওয়া অনেক সহজ হচ্ছে। জনসাধারণকে মিডিয়া যেভাবে চালিত করছে, সেই ভাবেই চলছে জনগণ। অনেকেই মনে করতে পারেন। লকডাউন না করলে আরও বেশি সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়তো্ মৃত্যু হতো আরও বেশি মানুষের। নিশ্চয় তাই। কিন্তু কতজন বেশি সংক্রমিত হতো আর আরও কতজনের মৃত্যু হতো? আমরা পূর্বেই দেখে নিয়েছি। সংক্রমণের হার যাই হোক না কেন। সংক্রমিত রুগীর ভিতর সুস্থতার হার ও মৃত্যুর হার কিন্তু একই থাকতো। আর সেই একই সময়ে আসুন দেখে নিই। ভারতে লকডাউন উঠে যাওয়ার পরের অবস্থা। দোকান বাজারে পুজোর কেনাকাটায়। পরিবহনে সর্বত্রই ভিড়ে ঠাসাঠাসির ছবি। পুজোর কেনাকাটার প্রথম দিকেই কলকাতার একটি বিখ্যাত জুতোর বিপণীর ঠাসাঠাসি ভিড়ের ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়ে অনেককেই আতঙ্কগ্রস্ত করে দিয়েছিল। মনে হয়েছিল এই এক দোকানের ভিড়েই বুঝি কলকাতায় মড়ক লেগে পথে ঘাটে মানুষ মরে পড়ে থাকবে। কিন্তু তারপরেও এক মাসব্যাপী হাতিবাগান নিউমার্কেট গড়িয়াহাটের ঠাসাঠাসি ভিড়ের ভিতর দিয়েই মানুষ পুজোর কেনাকাটা করেছে। অনেকের অনেক রকম প্রেডিকশন ভুল প্রমাণিত করেই কলকাতায় এখনও মড়ক লাগেনি। হাসপাতাল উপচিয়ে মৃতদেহ গড়াগড়ি খায়নি রাজপথ থেকে কানাগলিতে। বাজার দোকান সর্বত্র থিক থিক ভিড়েও করোনা সংক্রমণের হার সুস্থতার হার ও মৃত্যুর হারও কলকাতায় বিশেষ বাড়ে কমেনি। লোকাল ট্রেন চলাচল বন্ধ রেখে, মানুষের ভোগান্তিকে চরম পর্যায় নিয়ে গিয়ে তিন চার বাসের যাত্রীকে এক বাসে ঠুসে দিয়েও এই হারেও কোন পরিবর্তন আনা যায় নি। বরং ভারতীয় রেল পরিসেবাকে ধাপে ধাপে বেসরকারী শিল্পের হাতে নাম মাত্র মূল্যে বিক্রী করে দেওয়ার পরিকল্পনার দিকে দৃঢ় পদক্ষেপে এগিয়ে চলছে সরকার তলায় তলায়। করোনার আতঙ্ককে ঢাল করেই।


একটু ভেবে দেখলেই আমরা দেখতে পেতাম লকডাউন না করে গণপরিবহণের সামর্থ্যকে বাড়িয়ে দিয়ে অর্থাৎ আরও বেশি সংখ্যায় ট্রেন চালিয়ে। সরকারী বেসরকারী বাসের সংখ্যা বাড়িয়ে দিয়ে তুলনামূলক কম ভিড় বজায় রেখে জনজীবন সচল করে রেখেও করোনা মোকাবিলা করা সম্ভব ছিল। মানুষ ঠিক মত মাস্ক ব্যবহার করে বাড়ি ফিরে সাবান দিয়ে সব কিছু ধুয়ে নিয়ে এবং যতটা সম্ভব পারস্পরিক দূরত্ব বজায় রেখেই সংক্রমণের হার এই একই জায়গায় ধরে রাখতে পারতো। সরকার যদি সঠিক পদক্ষেপ গুলি নিতে চাইতো। কল কারখানা বন্ধ না করেও সংক্রমণ ঠেকানোর উপায় নিশ্চয় ছিল। ছিল না কোন সদিচ্ছা। ফলে শিল্প বাণিজ্য সাধ্যমতো চালু রেখে, প্রতিদিনের অবস্থা ও উদ্ভুত পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে এবং সংক্রমণের হারের উপর নির্ভর করে এক এক অঞ্চলে এক এক রকম ব্যবস্থা গ্রহণ করেও সংক্রমণ মোকাবিলা করা সম্ভব ছিল। দরকার ছিল না গোটা দেশের পরিবহণ ব্যবস্থাকে স্তব্ধ করে দিয়ে সর্বত্র একই ভাবে লকডাউন করে দেওয়ার। সংক্রমণের হারের তারতম্যের উপরে নির্ভর করে এক এক অঞ্চল এক এক সময়ে সাময়িক লকডাউনের আওতায় নিয়ে আসা যেতে পারতো নিশ্চয়। পরিস্থিতির গুরুত্ব বিচার করে।


কিন্তু সরকার আতশত হিসাব নিকাশে যায় নি। সরকার ঠিক সেটিই করেছে যেটির সাফল্যে আরও নতুন করে ১৫জন ভারতীয় বিলিয়নীয়র হয়ে উঠতে পেরেছেন। এবং বাকি বিলিয়নীয়রদের সম্পত্তির পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে জেট গতিতে। সরকার ঠিক সেটিই করেছেন, যেটি করলে সরকারী সম্পত্তি নাম মাত্র মূল্যে কোটিপতিদের হাতে বিক্রী করে দেওয়া যায়। সরকার কিন্তু এই লকডাউনে হাত গুটিয়ে বসেছিল না। করোনার জুজু দেখিয়ে মানুষকে আতঙ্কগ্রস্ত করে রেখে সরকার তলায় তলায় দেশের সম্পত্তির বিক্রীবাটার ব্যবস্থাই করে চলেছে। আরও একটি কাজে সরকার হাত লাগিয়েছে। সেটি হলো বিদেশী ভ্যাকসিন কোম্পানীগুলির স্বার্থরক্ষায় সব রকম সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেওয়া। লকডাউন করে মানুষকে ভীত সন্ত্রস্ত করে তোলাই যার প্রাথমিক ধাপ। মানুষকে বোঝানো ভ্যাকসিন নেওয়াই স্বাভাবিক জীবনযাত্রা অব্যাহত রাখা ও নাগরিক পরিসেবা পাওয়ার প্রধান শর্ত। আমাদের দেশকে সেই অভিমুখেই এগিয়ে নিয়ে চলেছে সরকার। অত্যন্ত বলিষ্ঠ হাতে। সেই পরিকল্পনা সম্বন্ধে অনেকেই আজও ওয়াকিবহাল নয়। সামনের বছরগুলিতে নতুন নতুন সরকারী আইন প্রণয়নের মধ্যে দিয়েই বিষয়গুলি স্পষ্ট হয়ে উঠতে থাকবে দিনে দিনে। না, এই অবস্থা শুধু ভারতেই সীমাবদ্ধ নয়। বিশ্বের অধিকাংশ অনুন্নত দেশেরই চিত্র একই রকম। এমনকি উন্নত বিশ্বের ধনতান্ত্রিক দেশগুলিতেও আজ সাধারণ মানুষ এই রকম ভাবেই বিপন্ন। বিষয়টি তাই আর আঞ্চলিক নয়। বিশ্বব্যাপী এক মহাসংকট।


ফলে করোনায় মৃত্যুর হার দেখে আতঙ্কগ্রস্ত হওয়ার কিছু নাই আসলেই। কিন্তু করোনার সুযোগে এই যে এক নিউ নরম্যাল স্লোগান ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। যার বলে যখন যেমন খুশি নাগরিকের অধিকার খর্ব করা যেতে পারে। জনসাধারণকে আরও বেশি করে দারিদ্র্যের আবর্তে আটকিয়ে ফেলে বিলিয়নীয়রদেরকে ট্রিলিয়নীয়র করে তোলার এক অশুভ আঁতাত গড়ে উঠেছে শাসক ও পুঁজির নিয়ন্ত্রকদের যোগসাজগে। আতঙ্করে বিষয় এইটিই। করোনার ভয়াবহতার তুলনায় তাই লকডাউনের ভয়াবহতা চতুর্গুণ বেশি। বুঝতে হবে আমাদের সেটাই। ৩% মানুষের মৃত্যুর হারে সাধারণ জনগণকে ভীত সন্ত্রস্ত করে রেখে ৯৭% এর সম্পত্তি হাতিয়ে তাদেরকে দারিদ্যসীমানায় ঠেলে দেওয়ার পদ্ধতিই এই লকডাউন। করোনাকে অজুহাত বানিয়েই সভ্যতাকে আজ এই ভয়াবহ সংকটের সম্মুখীন করে তুলেছে বিশ্বপুঁজির নিয়ন্ত্রক গোষ্ঠী। এইখানেই সভ্যতার সংকট।


৭ই অক্টোবর’ ২০২০


কপিরাইট শ্রীশুভ্র কর্তৃক রক্ষিত

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন