রবীন্দ্রনাথ ও আমরা * রণবীর চন্দ



রবীন্দ্রনাথ
ও আমরা

ছোটবেলায় চাবাগানে শৈশবের অনেকটা সময় কাটানোর সময় চারপাশের গাছপালা, পশুপাখি, গরুর গাড়ি, ছোট পাহাড়ী নদী, ঝর্ণা এসবের মধ্যেই সহজপাঠের বা রবিঠাকুরের লেখার একেকটা চরিত্র খুঁজে পেতাম। সকালবেলায় কোনো ফেরিওলা বাড়ির সামনের রাস্তা দিয়ে হেঁকে গেলেই রবিঠাকুরের বিচিত্র সাধ কবিতাটা মনে পরে যেত।  মনে হতো আমিও যেন ফেরিওলার মতো এগলি  ওগলি হয়ে দূরে কোথাও চলে যাই। একবার ডাকঘর নাটক অভিনয় করতে গিয়ে নিজেকে অমল, কবিরাজ বা অন্যকারোর সাথে নয় মিশিয়ে দিয়েছিলাম দইওলার সাথে। মনেহতো  দইওলার মতোই বাঁক কাঁধে নিয়ে দূর পাহাড়ের আড়ালে চলে যাই। আবার রাতের বেলায় গরুর গাড়ির ঘন্টার আওয়াজ তুলে যখন কেউ দূরের হাট থেকে ফিরে আসত তখন মনের কোনায়  ভেসে উঠতো শান্তিনিকেতনের পৌষ মেলায় মেলা শেষে লোকজনের বাড়ি ফেরার ছবি।  আসলে তখন আমাদের জীবনে রবিঠাকুর এমনভাবে জড়িয়ে গিয়েছিলেন যে চারপাশের প্রকৃতির মধ্য দিয়েই আমরা আমাদের বইয়ে পড়া গল্প কবিতাগুলি মিলিয়ে নেবার চেষ্টা করতাম। " তিনটে শালিক ঝগড়া করে রান্নাঘরের চালে" পড়ার সাথে সাথে চোঁখ চলে যেত রান্না ঘরের চলে।  খুঁজে ফিরতাম তিনটে শালিককে।
       
আমাদের মতো যৌবনের শেষ প্রান্তে দাঁড়ানো লোকজনের কিন্তু বাংলা অক্ষর শেখা শুরু হযেছিলো রবি ঠাকুরের সহজপাঠ প্রথম ও দ্বিতীয় ভাগ পড়ে।  হ্যা, সেইসময়  রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে আমরা রবি ঠাকুর বলতাম।  সহজপাঠের উস্তি নদীর ঝর্ণা , গুপ্তিপাড়ার বিশ্বম্ভর বাবুর পালকিতে ডাকাত পরা বা বক্সী গঞ্জের শুক্র বারের হাট বেশ কয়েকটা প্রজন্মকে বাংলা সাহিত্যের দিকে টেনে এনেছিল।যার ফসল আর একটু বড় হলে শুকতারা , আনন্দমেলা বা কিশোরভারতীর মতো পত্রিকা মাসিক বা পূজা বার্ষিকী বের হবার সাথে সাথে হামলে পরে পড়ে ফেলা। প্রতিমাসে কেনার ক্ষমতা না থাকলে অন্যের কাছ থেকে চেয়ে নিয়ে পড়া বা পাড়ার লাইব্রেরি থেকে নিয়ে  এসে পড়া , কিন্তু যেভাবেই হোক পড়া চাই। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে বাংলা সাহিত্যের প্রতি এই যে ভালোবাসা তা রবি ঠাকুরেরই অবদান , আরো ভালো করে বললে সহজপাঠের অবদান। কিন্তু বাংলা সাহিত্যের প্রতি তরুণ প্রজন্মের এই যে আকর্ষণ গত আটের দশকের শেষ থেকে হঠাৎ করে উবে যায়।  আমি এখানে পশ্চিম  বাংলার বাঙালীদের কথা বলছি।  যখন থেকে তৎকালীন বাংলা সরকার সরকারী ইস্কুলগুলি থেকে প্রাথমিক স্তরে ইংরেজি তুলে দিলো, বলতে হয় তখন থেকেই পশ্চিম বাংলার উচ্চ ও  মধ্যবিত্ত   সম্প্রদায়ের ছেলে মেয়েদের মধ্যে থেকে বাংলা সাহিত্য তথা রবীন্দ্রনাথের প্রভাব ও মুছে যেতে থাকলো।  বস্তুত তৎকালীন সরকার রবীন্দ্রনাথকে ব্যবহার করেই রবীন্দ্রনাথকে হটিয়ে দিয়েছেলো। সরকারী ইস্কুলগুলি  থেকে ইংরাজি  উঠানোর জন্য রবীন্দ্রনাথের লেখা মাতৃভাষা মাতৃ দুগ্ধ , এত বহুল পরিমানে ব্যবহার হতে লাগল যে দলে দলে  অভিভাবকরা সরকারী ইস্কুলগুলি ছেড়ে বেসরকারী ইংরাজি মাধ্যম ইস্কুলগুলিতে ছেলেমেয়েদের ভর্তি করতে লাগলেন।  এতদিন ধরে বাঙালী মধ্যবিত্ত শ্রেণীর হাত ধরে যে বাংলা তথা রবীন্দ্র সাহিত্যের চর্চা এগিয়ে চলছিল তাতে হঠাৎ করে দাঁড়ি পরে গেল। আর্থিকভাবে কিছুটা সচ্ছল পশ্চিম বাংলার এক বিরাট অংশের ছেলেমেয়েরা রবীন্দ্রসাহিত্য থেকে মুখ ঘুরিয়া নিল।  আর্থিকভাবে দূর্বল ছেলেমেয়েরা যারা নিরুপায় হয়ে বাংলা মাধ্যম ইস্কুলে ভর্তি হয়েছে তাদের মধ্যেই বেঁচে থাকছে রবীন্দ্রনাথ।  এদের অনেকেই প্রথম প্রজন্মের পড়ুয়া  এবং অনেকেরই  ইস্কুল শেষ হবার আগেই ইস্কুল ছুট হয়ে যায়।  ছেলেদের মধ্যে এক বিরাট অংশ দশমশ্রেণী পাশ করার আগেই পড়া ছেড়ে দিয়ে কোনো কাজে লেগে যায় অথবা কাজের সন্ধানে ভিনরাজ্যে পাচার হয়ে যায়।  আর ক্লাস এইটে উঠলেই মেয়েদের মধ্যে অনেকেরই বিয়ে হয়ে যায়।  যাদের ছোটবেলা থেকেই আর্থিক অসচ্ছলতার বিরুদ্ধে লড়তে হয়, প্রতিদিনের জীবনধারণের কথা চিন্তা করতে হয়, তাদের পক্ষে শুধু রবীন্দ্রনাথ কেন যেকোনো সাহিত্য সংস্কৃত চর্চা চালিয়ে যাওয়াই কঠিন।  যদিও সরকারী পর্যায়ে অনেক পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে, তবুও পশ্চিম বাংলায় ইস্কুলছুটের সংখ্যা এখনও বিপদসীমার অনেক উপরে।  আমার প্রতিবেশী একটি ছেলে একটি ইংলিশ মাধ্যম বিদ্যালয়ে পঞ্চম শ্র্রেণীতে পড়ে।  ওকে যদি পঞ্চাশ ষাট এইসব বাংলা সংখ্যার কথা বলি ও সেগুলি ইংরেজিতে বলতে বলে, বাংলায় বুঝতে পারেনা। যেখানে এই অবস্থা সেখানে বাংলা তথা রবীন্দ্রসাহিত্যের চর্চা আশা করাটা বাতুলতা। বস্তুত যেদিন থেকে ইংরাজী মাধ্যম ইস্কুলগুলিতে ছেলেমেয়েদের ঢল নেমেছে, বলা চলে সেদিন থেকেই  এক বিরাট অংশের বাঙালীদের কাছে রবীন্দ্রচর্চার অন্তর্জলি যাত্রা শুরু হয়ে গেছে। বর্তমান সরকার যেমন একদিকে বাংলা মাধ্যম স্কুলগুলিকে ইংরাজী মাধ্যম স্কুলে পরিণত করার চেষ্টা করে চলেছে, অপরদিকে অভিভাবকেরাও তাদের ছেলেমেয়েদের ইংরাজী মাধ্যম স্কুলে ভর্তি করানোর জন্য লাইন দিয়ে পড়েছে।  ২০১১ সালের জনগণনায় পশ্চিম বাংলায় ০-৬ বছর বয়সি শিশুদের সংখ্যা ছিল ১ কোটি ৫ লক্ষ ৮১ হাজার ৪৬৬। বর্তমানে ওই শিশুদের বয়স ৯-১৫ বছরের মধ্যে।  তাদের মধ্যে কতজন কোন মাধ্যম স্কুলে পড়াশুনা করছে সেটাই গুরুত্বপূর্ণ বলে জানাচ্ছেন শিক্ষাবিদরা।  কারণ এই বয়সেই বাচ্চারা ভাষার গাঁথুনিটা ভালো করে শিখে থাকে।  সেখানেই যদি বাংলাভাষার গুরুত্ব হারিয়ে যায় তবে খালি রবীন্দ্রচর্চা কেন পরবর্তীকালে গভীরভাবে বাংলা সাহিত্য সংস্কৃতি নিয়ে আবেক গড়ে উঠাও মুশকিল।   

একটা সময় বাঙালী মেয়েরা পড়াশুনার সাথে সাথে কয়েকটা রবীন্দ্রসংগীত শিখে রাখত। বিয়ের সমন্ধ আসলেই সুচিত্রা মিত্রের গাওয়া কোনো একটা , দুটো রবীন্দ্র সংগীত গেয়ে দিত।  রবীন্দ্রসংগীত ছিল বিয়ের সম্বন্ধ পাকা হবার অন্যতম প্রধান চাবিকাঠি। তবে বিয়ের জন্য রবীন্দ্রসংগীত শেখা কমে গেলেও রবীন্দ্রসংগীতের চর্চা কমেছে বলে তো মনে হয়না। রবীন্দ্রসংগীত এখনও বাঙালী সমাজে অষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে আছে।  বাঙালীর যেকোনও সামাজিক উৎসবে তা সে বিয়ে, অন্নপ্রাশন বা পূজো যাই হোক না কেন,  বাড়িতে গান শিখছে এমন কোনো ছেলেমেয়ে থাকলে বাড়িতে কোনো অতিথি এসে অনুরোধ করলে প্রথমেই সে একটা রবীন্দ্রসংগীত গাইবে। দুর্গা পূজায় প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে রবীন্দ্রসংগীত বাজবেই আবার স্কুল কলেজের যেকোনো ফাংশনেও কেউ না কেউ রবীন্দ্রসংগীত গাইবেই। তবে তা সাংস্কৃতির আভিজাত্য দেখানোর জন্য না অন্য কোনো গান জানেনা বলে রবীন্দ্রসংগীতই গাইছে তা অবশ্য বলা মুশকিল। কারণ আমি অনেক উচ্চ শিক্ষিত লোকজনের বাইরের বসার ঘরে দেখেছে যে আলমারি বা সেলফে থরে থরে বিশ্ব ভারতী থেকে প্রকাশিত রবীন্দ্রা রচনাবলী সাজানো আছে। কিন্তু ওগুলোর পাতা উল্টেও কোনোদিন দেখা হয়নি। 

বাংলা নিয়ে না পড়লেও বা রবীন্দ্র সাহিত্য বা সংগীত চর্চা না করলেও রবীন্দ্রনাথ ছড়িয়ে পড়েছে বাঙালীর জীবনের আনাচে কানাচে। প্রযুক্তির উন্নতির সাথে সাথে, সামাজিক মাধ্যম বা সোশ্যাল নেটওয়ার্ক সাইডের দৌলতে রবীন্দ্র সাহিত্য, সংগীত পৌঁছে গেছে বাঙালীর  ঘরের কোনায় কোনায়। ভালো, খারাপ, সুরে, বেসুরে যেভাবেই হোক না কেন রবীন্দ্র নাটক, সংগীত চারিদিকে প্রচার করতে  সামাজিক মাধ্যম বা সোশ্যাল নেটওয়ার্ক একটা বিরাট ভূমিকা নিয়ে চলেছে। যেকোনো ভাবে রবীন্দ্রসংগীত গেয়ে বা পাড়ায় নাটক করে যেকোনো সোশ্যাল নেটওয়ার্ক সাইডে  আপলোড করে দিলেই হলো।  রবীন্দ্রসাহিত্য, সংগীতের ওপর থেকে বিশ্বভারতীর অধিকার সরে যাবার পর থেকেই কলকাতায় রবীন্দ্রসাহিত্য প্রকাশের বান এসে গেল। ভালো খারাপ সবসকমভাবেই রবীন্দ্রাসাহিত্যের বাজারীকরণ শুরু হলো।  বটতলার কিছু প্রকাশনী সংস্থা তো চটি বই বের করে ট্রেনে বাসে ফেরি করা শুরু করে দিলো।  এতে একদিকে যেমন রবীন্দ্রাসাহিত্য কিছুটা হলেও বিকৃত হলো কিন্তু সাথে সাথে আপাময় জনসাধারণের কাছেও রবীন্দ্রসাহিত্য  বিশেষ করে রবীন্দ্রনাথের ছোট গল্পগুলি  পৌঁছে গেল। আমি দূরপাল্লার ট্রেনে যাত্রা করার আগে অনেক বয়স্ক যাত্রীকেই দেখেছি প্ল্যাটফর্ম থেকে বা হকারের কাছ থেকে রবীন্দ্রনাথের ছোট গল্পের সংকলন  কিনে নিয়ে ট্রেনে উঠতে। বলতে বাধা নেই, এই সস্তার রবীন্দ্রাসাহিত্য অনেক বয়স্ক বাঙালীর সময় কাটানোর উপায় হয়ে উঠেছে।      

যদিও একদিক থেকে দেখলে মনে হবে তরুণ প্রজন্মের বাঙালী জীবনে রবীন্দ্রনাথের বা রবীন্দ্রাসাহিত্যের কোনো প্রভাবই এখন আর অবশিষ্ট নেই।  কারণ একমাত্র যারা বাংলা সাহিত্য নিয়ে পড়ে তারা ছাড়া কোনো বাঙালী বাঙালী তরুণ বা ছাত্রই সারা জীবনে একটা গোটা রবীন্দ্রনাথের বই পড়েছে কিনা সন্দেহ!  কিন্তু সামাজিক মাধ্যম বা সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে অনেকেই রবীন্দ্রনাথের কবিতার সাথে পরিচিত হয়ে গেছে।  একসময় ছেলেমেয়েরা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পুরো কবিতা না জানলেও স্কুলে বা পরীক্ষার সময় ভাবসম্প্রসারণ করার জন্য অনেক লেখারই অংশবিশেষ মুখস্থ করে রেখে দিত।  উঁচু ক্লাসে বাংলা এমনকি ইংরাজী রচনা লেখাতেও রবীন্দ্রনাথের কবিতা বা গানের লাইন তুলে দেওয়া একটা রীতি ছিল।  অনেকেই এরজন্য আলাদা করে কবিতার বা গানের কিছু কিছু অংশ খালি মুখুস্থ করে করে রেখে দিত। পরবর্তী সময়ে মোবাইল ফোন চলে এলে প্রেমের বা বন্ধুত্বের  এসএমএস  করার জন্য বাজারে অনেক চটি বই বেরিয়ে পরে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতার মাথামুন্ডু না বুঝলেও এসএমএস পাঠানোর দৌলতে  চার পাঁচ লাইনের ছোট ছোট কবিতার কিছু অংশ অনেক ইস্কুল, কলেজ পড়ুয়া ছেলেমেয়দেরই মুখস্থ হয়ে যায়।

আমাদের   রোজকার জীবন থেকে  রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রভাব যে একেবারেই মুছে গেছে তাই বা বলি কি করে? বাঙালীর বারো মাসের তেরো পর্বনের অন্যতম  প্রধান পর্ব দোলযাত্রা উৎসব বা রংখেলা।  এই রংখেলা বা দোলের  দিন হারমোনিয়াম, খোল করতাল বাজিয়ে পাড়ায় পাড়ায়  ঘুরে গান করতে করতে রং খেলা তো রবিঠাকুরের শান্তিনিকেতনের অনুকরন! অন্ধভাবে না জেনেবুঝে যেরকমভাবেই অনুকরণ করা  হোক না কেন তবু তো ওই একটা দিনের জন্য হলেও সবাই মিলে রবীন্দ্রনাথকেই অনুসরণ করে চলে! সারাবছর বাঙালী  যতই হিন্দি বা ইংরেজি গানে বুঁদ হয়ে থাকুক না কেন ওই একটা দিন অন্তত হিন্দি এবং ইংরেজি গান কে কাছে ঘেঁষতে দেয় না।  রবীন্দ্রসংগীত হয়ে উঠে আমবাঙালীর কাছে আভিজাত্যের প্রতীক।  

আজকের বাংলার শিক্ষা ব্যবস্থায় কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রবর্তিত শিক্ষা ব্যবস্থার একটা ছাপ থেকে গেছে। বর্তমানে পশ্চিম বাংলার অভিভাবকদের মধ্যে যাদেরই সামান্যতম ক্ষমতা আছে তারাই ছেলেমেয়েদের সহশিক্ষামূলক ইংরাজী মাধ্যম বিদ্যালয়ে পাঠিয়ে দেয়। এই বিদ্যালয় স্তরে সহশিক্ষামূলক শিক্ষাব্যবস্থা কিন্তু আমাদের দেশে শান্তিনিকেতনে প্রথম শুরু হয়। আজকাল ইস্কুলে শারীরিক শাস্তি উঠেই গেছে বললে হয়। শান্তিনিকেতনে প্রথম থেকেই শারীরিক শাস্তি নিষিদ্ধ ছিল। এ নিয়ে ওখানে অনেক মজার মজার গল্প চালু আছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আজ থেকে একশো বছর আগে চেয়েছিলেন শিক্ষা যেন বই মুখস্থ নির্ভর না হয়ে থাকে।  কারিগরি শিক্ষা ব্যবস্থা প্রসারেও তিনি জোর দিতে চেয়েছিলেন।  হাতেকলমে কাঠের কাজ, মাটি, ধাতু ও তাঁতের কাজ শিখে বাংলার ছেলেমেয়েরা যাতে স্বনির্ভর হয় তারজন্য শান্তিনিকেতনে আলাদা আলাদা বিদ্যালয়ও প্রতিষ্টা করেছিলেন।  আজকের কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা আইটিআইগুলি সেসবেরই উত্তরসূরি। শিক্ষার বাহন প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন যে  " মুখস্থ করিয়া পাস্ করাই তো চৌর্যবৃত্তি।  যে ছেলে পরীক্ষাশালায় গোপনে বই লইয়া যায় তাকে খেদাইয়া দেওয়া হয়; আর যে ছেলে তার চেয়েও লুকাইয়া লয়, অর্থাৎ চাদরের মধ্যে না লইয়া মগজের মধ্যে লইয়া যায় সেই  বা কম কী করিল ? সভ্যতার নিয়ম অনুসারে মানুষের স্মরণশক্তির মহলটা ছাপাখানায় অধিকার করিয়াছে। অতএব, যারা বই মুখস্থ করিয়া পাস্ করে তারা অসভ্য রকমে চুরি করে অথচ সভ্যতার যুগে পুরস্কার পাইবে তারাই ? " 

শিশুশিক্ষাকে আনন্দদায়ক করার জন্য আজকাল শিক্ষা বিষয়ে যেসব গবেষণা চলছে এবং তার প্রয়োগ করা হচ্ছে, বিংশ শতাব্দীর প্রথমযুগে রবীন্দ্রনাথ তার বাস্তব প্রয়োগ করে গেছেন।  চিরাচরিত পাঠ্যসূচী নির্ভর  শিক্ষাব্যবস্থার  সাথে সাথে প্রতিটি শ্রেণীতে নাচ, গান , ছবিআঁকা, শিল্পকলা এসব বিষয়েও শিক্ষার ব্যবস্থা করেছিলেন। উনি আশা করেছিলেন যে এই শিক্ষা ব্যবস্থায় ছেলেমেয়েদের মধ্যে নিজের নিজের প্রতিভার বিকাশ ঘটবে।  এই শিক্ষানীতি আজকের দিনে বেসরকারী শিক্ষাপ্রতিষ্টান তো বটেই অনেক সরকারী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও অনুসরণ করে থাকে।  যেগুলো এখন বিভিন্ন ইস্কুলে নানারকম ক্লাব বা ফোরাম নাম দিয়ে চলছে। যেমন মিউজিক ক্লাব , ড্রামা ক্লাব , আর্ট ইস্কুল ইত্যাদি।  যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে গিয়েও আমি দেখেছিলাম ওখানে এরকম প্রায় ২৫টা ক্লাব আছে। অবশ্যই রবিঠাকুর যে তপোবন নির্ভর শিক্ষা ব্যবস্থা কল্পনা করেছিলেন, পশ্চিমী আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থার সাথে সাথে প্রাচীন ভারতের শিক্ষাব্যবস্থার মিশ্রণ ঘটাতে চেয়েছিলেন সেটা আর সম্ভম হয়ে উঠেনি।  শান্তিনিকেতন ছাড়া ওরকম শিক্ষাব্যবস্থা খুব কম প্রতিষ্টানেই আছে। ইস্কুল পর্যায়ে মানসিক শিক্ষার বিকাশের যে কল্পনা উনি করেছিলেন তা এখন মনোবিদদের কাজ হয়ে গেছে। অনেক ইস্কুলেই এর জন্য পেশাদার মনোবিদ আছে যারা ছাত্রছাত্রীদের মানসিক কোনো সমস্যা হলে তার থেকে বের হয়ে আসার উপায় বলে দেন।  তবে রবীন্দ্রনাথ চেয়েছিলেন  এমন শিক্ষাব্যবস্থা যেখানে শিক্ষা গ্রহণের সাথে সাথে ছাত্রছাত্রীদের মানসিক অবস্থার বিকাশ স্বাভাবিকভাবেই ঘটবে। এরজন্য আলাদা করে কোনো মনোবিদ বা শিক্ষকের দরকার হবে না। 

শিক্ষার যে মূল কাঠামো রবীন্দ্রনাথ তৈরি করে দিয়েছিলেন তা খালি পশ্চিমবাংলা নয়, এখন ভারতের সব রাজ্যের শিক্ষাবিভাগই অনুসরণ করে চলেছে।  নানারকম ভাষা আর অলংকারের মোড়কে সেই রবিঠাকুরই চলছে।  ব্রিটিশ শিক্ষাব্যবস্থা থেকে ওই শিক্ষা ব্যবস্থার পার্থক্য ছিল এই যে, আমাদের দেশে ব্রিটিশরা যে শিক্ষাব্যবস্থা চালু করে ছিল তা তাদের প্রশাসনিক প্রয়োজনেই করে ছিল।  ওতে একজন ছেলে বা মেয়ের মানসিক বিকাশের কোনো ব্যবস্থাই ছিল না।  ঐ সময়ের ইংল্যান্ডের শিক্ষাব্যবস্থার সাথে আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থার কোনো মিলই  ছিল না, ছিল আকাশপাতাল পার্থক্য।  রবীন্দ্রনাথ প্রবর্তিত শিক্ষাব্যবস্থা মূল যে কাঠামোর ওপর দাঁড়িয়ে আছে তা হলো - Self Realization বা আত্মনির্ভরতা, যার থেকে ছাত্রছাত্রীরা নিজেদের ওপর বিশ্বাস বা ভরসা করতে পারবে। Intellectual Development বা বুদ্ধিবৃত্তির বিকাশ- রবীন্দ্রনাথ বিশ্বাস করতেন যে বুদ্ধিবৃত্তির স্বাভাবিক  বিকাশ না হলে শিক্ষার উদ্দেশ্যই ব্যর্থ হয়ে যায়। Physical Development বা শারীরিক সক্ষমতা বৃদ্ধি- শারীরিক সক্ষমতা বৃদ্ধি না পেলে যে শিক্ষা কোনো কাজেই লাগে না তা অনেক আগেই রবীন্দ্রনাথ বুঝেছিলেন।  বিদ্যালয়ের প্রতিদিনকার নিয়মে নানারকম যোগ ও শারীরিক ব্যায়ামের ব্যবস্থা যেমন ছিল তেমনি জাপান থেকেও শিক্ষক এনে জুডো, কুংফু  এসব শিক্ষার ব্যবস্থাও করেছিলেন।  আজকে বাংলা তথা সারা ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় দশম শ্রেণী অবধি বাধ্যতামূলকভাবে যে শারীরিক শিক্ষার প্রচলন আছে তার সূত্রপাত কিন্তু সেই বিশ শতকের গোড়ায় রবিঠাকুর শান্তিনিকেতনে করে গিয়েছিলেন। Love for humanity বা মানবতাবোধ- ইস্কুলপর্যায়ে ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে মানবতাবোধের বিকাশ ঘটানোর প্রচেষ্টা আমাদের দেশে শুরু হয়েছে  বিশ পঁচিশ বছর আগের থেকে। এখন প্রায় সমস্ত প্রদেশের শিক্ষা ব্যবস্থাতেই humanity বা মানবতা বলে একটা বিষয় থাকে।  এই জিনিস রবীন্দ্রনাথ বহুবছর আগেই চিন্তা করে গেছেন।  Freedom বা স্বাধীনতা-এখনকার শিক্ষাব্যবস্থার মূল কথা চিন্তা শক্তির স্বাধীনতা।  হারিয়ে যেতে যেতেও বাঙালী  যার সাহায্যে উঠে দাঁড়ায় তা হলো স্বাধীনভাবে চিন্তা করার ক্ষমতা ।  ইস্কুল পর্যায় থেকেই যা চালু হয়েছিল শান্তিনিকেতনে।  Co-relation of Objects- যেটা খুবই আধুনিক বিষয়, মানুষ ও প্রকৃতির মধ্যে সম্পর্ক তৈরি করা, যা নিয়ে এখন দেশের বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা হচ্ছে, ভাবতে অবাক লাগে সেই বিষয়ে রবীন্দ্রনাথ চিন্তা করে গেছিলেন কত বছর আগে।  Moral and spiritual development বা মানসিক ও আধ্যাতিক বিকাশ- এটাও শিক্ষাক্ষেত্রে একটা আধুনিক শাখা। যার সূত্রপাত শান্তিনিকেতনে, রবীন্দ্রনাথের হাত ধরে। রবীন্দ্রনাথের সবচেয়ে আধুনিক চিন্তা বোধ হয় ছিল শিক্ষার সব পর্যায়ে মাতৃভাষার ব্যবহার। যেটা আজও পুরোপুরি সফল হয়নি।  রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর চেয়েছিলেন এমন শিক্ষা ব্যবস্থা যেখানে , "চিত্ত যেথা ভয় শূন্য , উচ্চ যেথা শির, জ্ঞান যেথা মুক্ত , যেথা গৃহের প্রাচীর "- তা এখনও স্বপ্নই থেকে গেছে।   

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যে কেবল শিল্প, সাহিত্য ,নাট্যকলা বা  সংগীতের ওপর শতাব্দীব্যাপী প্রভাব রেখে গেছেন তা নয়।  উনার সর্বব্যাপী চিন্তাধারা ও কাজের মধ্যে পরিবেশ সংরক্ষণ ও অন্যতম ছিল।  আজকে যে দেশজুড়ে বৃক্ষরোপন উৎসব পালন করা হয় তার সূচনা উনি একশো বছর আগেই করে ছিলেন।  ১৯১৬ সালে জাপান যাত্রার সময় সমুদ্রের ওপর তেল ভাসতে দেখে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রথম মানুষের কৃতকার্যের ফল পরিবেশের ওপর কি প্রভাব বিস্তার করে তা অনুভব করেন।  পরে ১৯২৮ সালের ১৪ই জুলাই থেকে শান্তিনিকেতনে বৃক্ষরোপন উৎসব চালু করেন।  ঐদিন আশেপাশের গ্রামের লোকজনের মধ্যে মরশুমি ফল যেমন আম, পেয়ারা, জাম এইসব গাছের চারা বিতরণ করা হয়।  ঐসময়ই শান্তিনিকেতনে বর্ষামঙ্গল উৎসব ও চালু করা হয়।  এখন অবশ্য বৃক্ষরোপন উৎসব ২২শে শ্রাবন হয়।  শতাব্দীপূর্বে রবিঠাকুর প্রকৃতিকে তার জিনিস  ফিরিয়ে দেবার যে চিন্তাভাবনা করেছিলেন, আজ খালি বাংলা নয় সমগ্র ভারতের প্রতিটি ব্লকে ব্লকে বৃক্ষরোপনের মাধ্যমে পরিবেশ সংরক্ষণের ব্যবস্থা করে তা পালন করা হয়।  যে কাজ কবিগুরু প্রায় একশ বছর আগে করে গেছেন, আজ বিশ্বপরিবেশ দিবস পালন করে আমরা সেই পরিবেশ সংরক্ষণের কাজই করে চলেছি। একটা জিনিস ভাবতে অবাক লাগে যখন পরিবেশ সমন্ধে কারোর কোনো সচেতনাই ছিল না, বিশ্ব পরিবেশ দিবস, বিশ্ব উষ্ণায়ন এসব বড়বড় কথা তখন অভিধানেই নেই, সেই যুগেও রবীন্দ্রনাথ পরিবেশ ধ্বংসের বিপদ বুঝতে পেরেছিলেন এবং বুঝতে পেরেই পরিবেশ রক্ষার জন্য এগিয়ে এসেছিলেন।

আজকের বাঙালী তথা ভারতের সমাজজীবনে রবীন্দ্রনাথের ভূমিকার কথা চিন্তা করলে কুলকিনারা পাওয়া যায় না।  কতরকম বিষয় নিয়ে উনার চিন্তাধারা ছড়িয়ে ছিল তা ভাবলে অবাক হতে হয়।  গরীব  কৃষক ও গ্রামীণ হস্তশিল্পীদের  মহাজনের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য ১৯২২ সালে উনি শ্রীনিকেতন প্রতিষ্টা করেন।  শ্রীনিকেতনে তাঁতের কাপড় বোনা , বাটিকের কাজ , কাঠের ও নানারকম ধাতুর কাজ - এসবের ওপর প্রশিক্ষণকেন্দ্র করা হয়।  ওখানে গ্রামীণ শিল্পীরা উন্নতমানের প্রশিক্ষণ পেয়ে যে শিল্পসামগ্রী উৎপাদন করতেন তা ওখানেই সমবায় ব্যবস্থার মাধ্যমে বিক্রি করা হতো।  আজকে সারা দেশে কৃষক, পশুপালক , শিল্পীরা যে বিভিন্ন ধরণের সমবায় বা কোঅপারেটিভ সোসাইটি তৈরি করে কাজ করে চলেছেন তার সূত্রপাত কিন্তু হয়েছিল ১৯২২ সালে ওই শান্তিনিকেতনে।  আজকের তন্তুজ , তন্তুজা , আমূল , লিজ্জৎ পাঁপড় সেই ইতিহাসেরই উত্তরসূরি।  রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকে গান্ধীজী এই সমবায় বা কোঅপারেটিভ সোসাইটির ধারণা নিয়ে গুজরাটে তা প্রচলন করেন।  রবীন্দ্রনাথ জানতেন যে গ্রামীণ অর্থনীতির উন্নতি বা বিকাশ করতে হলে অর্থের যোগান নিশ্চিন্ত করা দরকার।  সেইলক্ষ্যে ১৯০৫ সালে পতিসর কৃষি ব্যাঙ্ক তৈরী করেন। তিনি আরও জানতেন  ভারতীয় কৃষকের অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কাহিনী।  আমাদের দেশের ফসল যে সম্পূর্ণভাবে প্রকৃতি নির্ভর তাও শতবর্ষ আগেই কবিগুরু বুঝতে পেরেছিলেন। প্রায় তিরিশ বছর চলার পর পতিসর কৃষি ও আরো কয়েকটা ব্যাঙ্ক মিলে ১৯২৭ সালে তৈরী হয় বিশ্বভারতী সেন্ট্রাল কোঅপারেটিভ ব্যাঙ্ক। গ্রামের মানুষের অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর খালি কৃষি বা কোঅপারেটিভ ব্যাঙ্ক প্রতিষ্টা করেই থেমে থাকেননি,  তৈরী করেছিলেন গ্রেইন বা শস্য ব্যাঙ্ক। যেখান থেকে কৃষকেরা চাষের জন্য টাকা নিয়ে টাকার বদলে শস্য দিয়ে সেই ধার শোধ করবে। ১৯২৭ সালেই শ্রীনিকেতনে তিনি প্রথম গ্রেইন বা শস্য ব্যাঙ্ক প্রতিষ্টা  করেন।  যা বেশ কয়েক বছর কাজ করেছিল।  এখন অবশ্য গ্রেইন বা শস্য ব্যাঙ্কের ধারণাটা আর নেই। ব্যাঙ্কের প্রয়োজন  ও আর নেই।  ব্যাঙ্ক থেকে থেকে টাকা ধার নিয়ে ফসলের বিনিময়ে সেই টাকা আর কেউ শোধ করে না।  ভারতে এফসিআই বা ফুড কর্পোরেশন অফ ইন্ডিয়া নির্ধারিত দামে চাষীদের কাছ থেকে সরাসরি ফসল কিনে নেয়।  তবে ফড়ে বা দালালদের হাত থেকে কৃষকদের ফসল রক্ষা করতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গ্রেইন বা শস্য ব্যাঙ্ক একসময় উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিয়ে ছিল। গ্রেইন বা শস্য ব্যাঙ্কের পরিকল্পনা সফল না হলেও  গ্রামীণ ও কোঅপারেটিভ  বা সমবায় ব্যাঙ্কের কাজকর্ম সারা দেশেই ছড়িয়ে পড়েছে।  অন্তত হাজার দশেক গ্রামীণ ও কোঅপারেটিভ ব্যাঙ্ক সারা দেশ জুড়ে কাজ করছে।  পশ্চিম বাংলাতে এই সংখ্যাটা হাজার খানেক। একদম ভূমিহীন কৃষকদের জন্যও তিনি সাঁওতালপাড়ায় সমবায় বা কোঅপারেটিভ ব্যাঙ্ক প্রতিষ্টা করেছিলেন। এরকম আরও কয়েকটি সমবায় বা কোঅপারেটিভ ব্যাঙ্ক উনি বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে প্রতিষ্টা করেন। রবীন্দ্রনাথ যে খালি কৃষক বা চাষীদের জন্য গ্রামীণ ব্যাঙ্ক, কৃষি ব্যাঙ্ক এসব প্রতিষ্টা করেছিলেন তা নয়, উনি জানতেন যে কৃষি ব্যাঙ্ক স্থাপন করেই কৃষকদের উন্নতি সম্ভব নয়,  এর জন্য দরকার কৃষি ক্ষেত্রে আমূল সংস্কার।  সার্বিক কৃষি বিপ্লব না হলে কৃষকদের অবস্থার উন্নতি হবেনা।  এজন্য ছেলে রথীন্দ্রনাথকে বিদেশে পাঠিয়েছিলেন কৃষি বা agreeculture নিয়ে পড়াশুনা করে আসার জন্য।  উন্নত মানের কৃষি ব্যবস্থা চালু করার জন্য উনি যা সার্বিক পরিকল্পনা করেছিলেন তার সুফল কয়েক দশক পার করেও আমরা ভোগ করছি।  আবার উনার পরিকল্পনা পুরোপুরি অনুসরণ না করার ফলে দুর্ভোগ এসেছে তাও আমাদের ভোগ করতে হচ্ছে।  বস্তুত রবীন্দ্রনাথ সমগ্র কৃষি ব্যবস্থার ওপর যে পরিকল্পনা নিয়েছেলেন তা যদি পুরোপুরি আমাদের দেশ অনুসরণ করত তবে আমাদের দেশে প্রতিবছর এত  কৃষক আত্মহত্যা করতো না। এটাই বাস্তব যে আজ থেকে একশো বছরেরও আগে রবীন্দ্রনাথ যে জিনিস চিন্তা করে গেছেন আজকের প্রশাসকদের তা চিন্তা করতে হচ্ছে।  সময়ের থেকে কতটা এগিয়ে থাকলে একজন এইরকম যুগান্তকারী চিন্তাশক্তির অধিকারী হতে পারেন।

বাংলা ভাষা ও সাহিত্য কি  রবীন্দ্র প্রভাব থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছে ? রবীন্দ্রপরবর্তী যুগে জীবনানন্দ দাশের প্রভাবে রবীন্দ্র প্রভাব থেকে বাংলা কবিতা পুরোপুরি না হলেও অনেকটাই বেরিয়ে এসেছে, কিন্তু ছোট গল্প, নাটক বা উপন্যাসের ক্ষেত্রে তা বলা যায় না।  রবীন্দ্রনাথের আগের বাংলা সাহিত্য আর রবীন্দ্রপরবর্তী যুগের বাংলা সাহিত্য পাশাপাশি রাখলেই বিষয়টা পরিষ্কার বোঝা যায়।  বিশেষকরে ছোট গল্পের ক্ষেত্রে তো রবীন্দ্রনাথের প্রভাব থেকে বাংলা সাহিত্যিকরা একেবারেই বেরিয়ে আসতে পারেননি বলেই চলে। বাংলা ভাষা চর্চার  ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ যে ধারা এনেছিলেন  এখনও পশ্চিম বাংলার সাহিত্যিকেরা সেই ধারাই অনুসরণ করে চলেছেন।  বাংলা ভাষাকে সংস্কৃতির প্রভাব মুক্ত করে, তার সাথে সাথে আঞ্চলিক ভাষার জড়তা কাটিয়ে একটা সর্বজনগ্রাহ্য ভাষার যে চেহারা রবীন্দ্রনাথ এনেছিলেন আজ প্রায় সব বাঙালীই তা অনুসরণ করে। এখন পশ্চিম বাংলার বাঙালীরা আধুনিক বাংলা বানানের যে ধারা  অনুসরণ করে তাও রবীন্দ্রনাথের অবদান। খালি ভাষা বা সাহিত্যের ক্ষেত্রে নয়, সংগীতের ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ যে ধারা তৈরী করে দিয়ে গেছেন আজও শুধু বাংলা কেন সারা ভারতই  অনুসরণ করছে।  একদিকে উনি যেমন পাশ্চাত্য সংগীতকে ভারতীয়করণ করেছিলেন, অন্যদিকে তেমনি  লোকগীতি, বাউল, সারি, ভাটিয়ালি এইসব গ্রামীণ সংগীতকেও তুলে এনেছিলেন বিশ্ব সংগীতের আসরে।  এতে একদিকে যেমন পশ্চিমী সংগীতের ভারতীয়করণ ঘটেছিল, অন্য দিকে বিশ্বের দরবারে ভারতীয় লোক সংগীতের প্রবেশ ও সহজবোধ্য হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ এরসাথে ভারতীয় ক্লাসিকাল সংগীতকেও ব্যবহার করেছেন একান্তই আমাদের নিজেদের মতো করে। সংগীতের ক্ষেত্রে বিভিন্ন সংস্কৃতির গান বা সংগীতকে নিজেদের মতো করে ব্যবহার করার যে জিনিস রবীন্দ্রনাথ শুরু করে করেছিলেন, পরবর্তীকালে শচীনদেব বর্মন, হেমন্ত মুখার্জী, সলিল চৌধুরী, রাহুল দেব বর্মন হয়ে আজও সেই ধারা বহমান।  এতে একদিকে যেমন ভারতীয় লোক ও  ক্লাসিকাল গানকে যুগোপযোগী করে ব্যবহার করা হচ্ছে, অপর  দিকে তেমনি পাশ্চাত্য সংগীত ও আমাদের সংগীতের সাথে মিশে  আমাদের মনের মতো হয়ে উঠছে।  রবীন্দ্রনাথের আগে এই জিনিস কে চিন্তা করেছিল? বাংলা তথা ভারতীয় সংগীতের ক্ষেত্রে রবীন্দ্রাপূর্ববর্তী আর রবীন্দ্রপরবর্তী সংগীতের ধারা পাশাপাশি রাখলেই ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে যায়।

এই লেখাটা যখন লিখছি তখনই দেখা গেল রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের দোল উৎসবে কিছু ছেলেমেয়ে রবীন্দ্রসংগীত তথা রবীন্দ্রনাথকে রাস্তায় নামিয়ে এনেছে।এটা ভালো কি খারাপ এই বিতর্কে না গিয়েও বলা যায় কেন ওরা এসব করতে গেল? এই ঘটনাটা নিয়ে নানা জনের নানা মত আছে। কারুর কাছে ব্যাপারটা চরম নিন্দাজনক আবার কারুর কাছে ব্যাপারটা নীতিপুলিশের বাড়াবাড়ি। কিন্তু কিছু লোক কেবল রবীন্দ্রসংগীতেই কেন অশ্লীল শব্দ ব্যবহার করে চলেছে? নিজেদের গান লেখার ক্ষমতা নেই বা ওই পর্যায়ে যাবার ক্ষমতা নেই তাই রবীন্দ্রসংগীতেই অশ্লীল শব্দ বসিয়ে চালিয়ে দেবার চেষ্টা! এখানেও সেই রবীন্দ্রনাথ! একটা অশ্লীল গান বানালে বা গাইলেও দরকার রবীন্দ্রনাথকে। ভাষার যে একটা রকমফের আছে, রকের ভাষা, ঘরের ভাষা আবার পোশাকি ভাষা যে এক নয় সেই  চৌকাঠগুলোই উঠে যাচ্ছে। যে ভাষা রকের ভাষা সেটাই ঘরের ভাষা, পোশাকি ভাষা হিসাবে চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে।  আর এই কাজে টেনে নামানো হচ্ছে রবীন্দ্রনাথকে।  কারণটা কি ? রবীন্দ্রনাথ সাধারণের কবি নয় বলে? নাকি রকের ভাষা ব্যবহার করে রবীন্দ্রনাথকে রক সংস্কৃতির সাথে মিশিয়ে দেওয়ার একটা চেষ্টা? রবীন্দ্রনাথকে বিশেষ করে রবীন্দ্র সংগীত নিয়ে অতীতেও নানা বিতর্ক ছিল। একসময় দেবব্রত বিশ্বাসকেও বিশ্বভারতী মিউজিক বোর্ডের চাপে রবীন্দ্র সংগীত রেকর্ড করে ছেড়ে দিতে হয়েছিল। কিন্তু সেসব ছিল আলাদা।  ওখানে ছিল দুইদল সংগীত বোদ্ধার  লড়াই।  সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কেও এই ধরণের ঘটনার মুখোমুখি হতে হয়েছিল।  কেতকী কুশারী ডাইসন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখায় রবীন্দ্র অপমানের তীব্র প্রতিবাদ করেছিলেন।  কিন্তু সেখানেও কেউ রবীন্দ্রনাথকে রাস্তায় নামানোর চেষ্টা করেননি। অন্তত রবীন্দ্রনাথের লেখায় তথাকথিত রকের শব্দ বসিয়ে সেই লেখার তথাকথিত আধুনিকরণের চেষ্টা করেন নি। কিন্তু কেনই বা রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে টানাটানি? এই সব ঘটনাতেও অনেকে শিকল ভাঙার গান শুনতে পাবেন।  কিন্তু তারা ভুলে যাবেন, রবিপূজো যদি বাঙালীর একটা বদভ্যাস হয়ে থাকে, তবে রবিঠাকুরকে জঞ্জালে ফেলে আসাটাও তার একটা সমাধান হতে পারে না।বাঙালীর এই গর্বের জায়গাটাই আজ শেষ হয়ে যেতে  চলেছে। বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়া বা সামাজিক মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথের বিকৃত কবিতা, গানের ছড়াছড়ি। রবীন্দ্রসংগীতে অশ্লীল শব্দ বসিয়ে বেশ কিছু ইউটিউবার রোজগার করে চলেছেন। তাদের আবার লক্ষ লক্ষ ফলোয়ার আছে।  তারা গর্বের সাথেই নিজেদের পরিচয় দেয়।  কয়েক বছর আগেও যা  কল্পনা করা যেত না। আজ বিশ্বভারতীর হাতে রবীন্দ্রনাথের লেখার সব স্বত্ব থাকলে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে কি এরকমভাবে উপহাস করা যেত? যেভাবে নিজেদের গণতান্ত্রিক অধিকার বলে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে ছেলেখেলা শুরু হয়েছে তাতে আর বেশিদিন রবীন্দ্রসংগীত তো বটেই সমগ্র রবীন্দ্রাসাহিত্যকেও সুস্থভাবে বাঁচিয়ে রাখা যাবে কিনা সন্দেহ? রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে কাটাছেঁড়া করেছিলেন নিরোদ চন্দ্র চৌধুরী।আবার অন্যচোখে দেখেছিলেন সৈয়দ মুস্তাফা আলি বা খুশবন্ত সিং। কিন্তু কেউ এখনকার ইউটিউবারদের  মতো এই পর্যায়ে যাননি।

ভাষা, সাহিত্য, সংগীত, শিল্পকলা সবকিছু বাদ দিলেও এই উপমহাদেশ রবীন্দ্রনাথকে মনে রাখবে অন্তত তিনটি কাজের জন্য।  প্রথম কাজ পরিবেশ সংরক্ষণের প্রতি দায়বদ্ধতা।  সেইযুগে যখন লোকজন জঙ্গল কেটে ঘরবাড়ি বানাত, রাজামহারাজারা পশুপাখি শিকার করে ছবি তুলতেন, সেই সময় রবীন্দ্রনাথ শুরু করেছিলেন গাছ লাগিয়ে এই পৃথিবীকে বাঁচাতে। দুই গ্রামীণ শিল্পী, কৃষক ও সাধারণ মানুষকে মহাজন বা   ফড়েদের হাত থেকে বাঁচাতে কোঅপারেটিভ ও গ্রামীণ ব্যাঙ্ক প্রতিষ্টা করা।  আজ পশ্চিম বাংলা তো বটেই সারা ভারতে গ্রামে গ্রামে ছড়িয়ে গেছে এই কোঅপারেটিভ  বা গ্রামীণ ব্যাঙ্ক।  বস্তুত সহজশর্তে, কমসুদে  শিল্পী, কৃষকদের ঋণ দেবার ব্যাপারে গ্রামীণ ব্যাংকগুলোর কোনো বিকল্প নেই। আজকের এই গ্রামীণ ও কোঅপারেটিভ  ব্যাঙ্কগুলো রবীন্দ্রনাথের সেই গ্রামীণ মানুষকে আর্থিক দিক থেকে স্বনির্ভর করার স্বপ্ন সফল করে চলেছে। তৃতীয়ত, তীব্র প্রতিযোগিতার মধ্যে ক্ষুদ্র শিল্পীদের শিল্প যাতে হারিয়ে না যায়, তা যাতে বাজারজাত করে শিল্পী তার সঠিক মূল্য বা পারিশ্রমিক পায়, এজন্য প্রতিষ্টা করেছিলেন সমবায় বা কোঅপারেটিভ সোসাইটি।আজকের এই বিশ্বায়নের যুগে যার প্রয়োজনীয়তা অনেক বেড়ে গেছে।  কোঅপারেটিভ সোসাইটি ছাড়া বহুজাতিক সংস্থাগুলির সাথে লড়াই করে ক্ষুদ্র শিল্পী, কৃষক  বা পশুপালকরা বেঁচে থাকতে পারবে না।আজকে গুজরাটের সমবায় বা কোঅপারেটিভ সোসাইটি আমুলের বার্ষিক ব্যবসার বা টার্ন ওভারের পরিমান দেখলে যে কোনো বহুজাতিক সংস্থা ভিরমি খাবে।আমুলের মতো অত বড় না হলেও সারা বাংলাজুড়ে এরকম অনেক কোঅপারেটিভ সোসাইটি তৈরি হয়েছে, যার মাধ্যমে খুব স্বল্প মূলধন নিয়ে ব্যবসা করতে নাম মানুষজন তাদের জিনিসপত্র ঐসব সোসাইটির মাধ্যমে সহজেই বিশ্ব বাজারে বিক্রি করতে পারছে।আজকের বাঙালী  শুধু বাঙালী বলি কেন এই উপমহাদেশের মানুষজন রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকে যা পেয়েছে তা যদি সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারে তাহলেই সে সুখী হয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে পারবে।  রবীন্দ্রনাথের ভাষাতেই বলা যায়, " যেটুকু পাইবার মতো পাওয়া সেটুকু পাইয়াই যেন সুখী হইতে পারি ; তার চেয়ে বেশি যতটুকুই পাওয়া যায় তার অনেক ভার, অনেক দুঃখ। " (নৌকাডুবি উপন্যাসে হেমনলিনীর চরিত্রের উক্তি)।

কপিরাইট রণবীর চন্দ কর্তৃক সংরক্ষিত

তথ্যসূত্র

১. মাতৃভাষা বাংলাই, তবু জীবন জুড়ে থাকছে কি, আনন্দবাজার পত্রিকা , ২০ ফেব্রুয়ারী,
  ২০২০।
২.  Ram Tirath. Role and Impact of Rabindernath Tagore Education Philosophy in
       Contemporary Indian Education. International Journal of Business Administration
       and Management. ISSN 2278-3660, 7: (1):150-160, 2017.
৩.  Ravi Singh, Sohan Singh Rawat. “Rabindranath Tagore‘s Contribution in Education”.
      VSRD International Journal of Technical & Non-Technical Research. 4(8): 201-208,
      2013.
৪.  Dreamsea Das. Educational Philosophy of Rabindranath Tagore. International Journal of
     Research in Humanities. 2(6): 1-4, 2014.
৫..  RL Basu. The Eco-Ethical Views of Tagore and Amartya Sen Cultural Mandala.
      Bulletin of the centre for East West Culture and Economic Studies. 8 (2): 56-61,
      2009.
৬.  Debesh Bhowmik. Rabindranath Tagore: An Environmentalist and An Activist.
      International Research Journal of Humanities and Environmental Issues. 1(5): 10-14,
      2012.
৭. জাগরী বন্দোপাধ্যায়, আপত্তি মানেই নীতি পুলিশি? আনন্দবাজার পত্রিকা, সম্পাদকীয়,
   ১৩/০৩/ ২০২০।
৮. সুব্রত গুপ্ত, পরিমল চক্রবর্তী, রবীন্দ্রনাথের অর্থনৈতিক চিন্তা, মর্ডান কলম, কলকাতা,
   ১৯৮৭।
৯. Bihari Kunja Nayak. Sustainable Development: An Alternative Approach in
     Rabindranath Tagore’s Vision. Serial Publications. New Delhi, 2008.

1 টি মন্তব্য: