রবীন্দ্র সমাজভাবনা এবং আজকের প্রেক্ষিতে তার প্রাসঙ্গিকতা * বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায়


রবীন্দ্র সমাজভাবনা এবং আজকের  প্রেক্ষিতে তার প্রাসঙ্গিকতা

একজন কবি যখন লেখেন তখন তিনি একা, চুপচাপ। তবু তাঁর লেখার ভেতর সমাজের সচেতন অংশগ্রহণ  থাকে। এই সামাজিক ভাবনার লিপিবদ্ধরূপ থেকে যায় তাঁদের সৃজনকর্মে। কখনও লেখায় কখনও বা প্রত্যক্ষ কোন কাজে স্পষ্টভাবে ফুটে থাকতে পারে দেশ কাল সমাজের বিভিন্ন দিগন্ত। তাঁদের কবিতার দেহ ও আত্মায় অদৃশ্য বন্ধনের মতো জড়িয়ে থাকে এক বিশেষ দর্শন। সমাজ দর্শন। মানব দর্শন। এর পিছনে থাকে বিবিধ প্রেরণা ও তাড়না। এই প্রেরণা ও তাড়নার সঙ্গে যা কিছুর যোগাযোগ আছে সেগুলোই মূল চালিকা শক্তি হিসেবে পরিচালিত করে নতুন সমাজ গঠনের স্বপ্নে । একটু ঘুরিয়ে যদি কথাটা এভাবে বলি যে শিল্পীমাত্রেই সমাজবিরোধী। যে সমাজ পচা গলা হাজার অশিক্ষা আর কুসংস্কারের আবর্তে বন্দী। যে সমাজ ঘুনধরা, নিরন্নের মুখে অন্ন জোগানোর ন্যুনতম দায়িত্ব পালন করে না। বিপন্ন অসহায় মানুষকে ঠেলে দেয় ঘৃণার প্রান্তে। কবিরা সেই সমাজের বিরোধীতা করেন। বিরোধীতা করেন এক সুন্দর সমাজের স্বপ্ন দেখেন বলেই। জীর্ণ মৃতপ্রায় এই ব্যবস্থাকে ভেঙে তাঁদের অন্তরের আলো প্রায় অসীম দূরত্বকে আলোকিত করে।

কেন আজকের সমাজে দাঁড়িয়ে রবীন্দ্রনাথের  কথা আমরা ভাবব আজ এই ২০২০ তে দাঁড়িয়ে ? বহু বছর আগে  জন্ম নেওয়া একজন মানুষ এই সময়ে কতখানি প্রাসঙ্গিক? তার মূল্যায়ন করতে হবে এই রেফারেন্স ফ্রেমকে সামনে রেখে যখন দেশ শুধুমাত্র ধর্মকে মূলধন করে  এগিয়ে যেতে চাইছে একুশ  শতকের প্রযুক্তি দুনিয়ায়। যখন দেশ আবার অন্ধকারে নিমজ্জিত হতে চাইছে দীর্ঘ সময় ধরে অর্জিত আমাদের শ্রেয়োচেতনাকে জলাঞ্জলি দিয়ে। আমরা সত্যিই কতটুকু জানি রবীন্দ্রনাথকে ? জানি তিনি কবি  ছিলেন, জানি তিনি সাহিত্যের সমস্ত ধারায় বিপ্লব  ঘটিয়েছিলেন এবং এও জানি শিক্ষাচিন্তার মধ্যে নতুন যুগের সূচনা করেছিলেন। 

কিন্তু এই কুয়াশাচ্ছন্ন সময়ে সে জানার কতটুকুই বা মূল্য আছে? ধর্মীয় ফ্যাসিবাদের উলম্ফন যখন  মানবিক চিন্তাগুলিকে সন্ত্রাসের জাঁতাকলে পিষে মারছে এবং আমরা ক্রমাগত হাততালি দিচ্ছি ভিখিরি হয়ে যাওয়ার গৌরববোধ নিয়ে। আত্মসমর্পণ এবং প্রশ্নহীন আনুগত্য আমাদের রাজানুগ্রহের ইপ্সিত ঠিকানা খুঁজে দেবে এই ভাবনা আমাদের নিঃশর্ত বশংবদ বানাতে পারে কিন্তু কোন অবস্থাতেই রবীন্দ্রনাথকে আত্মস্থ করার উপযোগী আবহাওয়া তৈরি করতে পারে না।

সাম্প্রতিক কালের পশ্চিমবঙ্গে যুক্তিহীনতার আস্ফালন এবং  বিবেক বিক্রির যে নজির আমরা দেখছি, প্রতাপের কাছে নিজেদের মেরুদন্ডকে কত কম দামে নিলামে চড়ানো যায় তার প্রগলভ  প্রদর্শনী রামমোহন বিদ্যাসাগর  রবীন্দ্রনাথের রেনেশাঁ উদ্ভাসিত বাংলায় এক চমকপ্রদ ঘটনা ।ক্রমবর্ধিষ্ণু নারীনির্যাতন, শিক্ষার উপর, সংস্কৃতির উপর , মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকারের উপর নির্লজ্জ আক্রমন এবং মর্মচ্ছেদী আঘাত দেখেও যখন নীরবতার আবর্তে ঘুমিয়ে পড়ছে স্বঘোষিত সমাজ বিবেকেরা। এই পরিপ্রেক্ষিত থেকেই আরও বেশি প্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ছে রবীন্দ্রনাথকে  নিবিড়ভাবে জানার বিষয়টি।

রবীন্দ্রনাথের সমাজভাবনার বিষয়টি বহুব্যপ্ত। স্বল্প পরিসরে তা বলা খুব জটিল বিষয়।রবীন্দ্রনাথ অনুভব করেছিলেন সামাজিক বিচ্ছিন্নতা মানুষকে আনন্দ দিতে পারে না বরং এক অদ্ভুত অসুখ মানুষের অন্তরের সুকুমার প্রবৃত্তিগুলি নষ্ট করে দেয়।তাই খুব সহজ ভাষায় তিনি বলেছেন ‘ একা অন্ন ভক্ষন করিলে পেট ভরে ঠিকই কিন্তু পাচজনে মিলিয়া খাইলে পেটও ভরে আনন্দও মিলে এবং পাওয়া যায় আত্মরক্ষার উপায়।’ কোন ব্যক্তি দল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে একলা চলতে গেলে তখনই সে হয়ে যায় টুকরো মানুষ। তাই সামাজিক পুঁজি গঠনের মাধ্যমে যৌথ খামার গড়ে তোলার উপর গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন তিনি । সাম্যবাদী ভাবনার প্রতিফলন রয়েছে তাঁর সমাজচিন্তায় । তিনি বিশ্বাস করতেন একক মূলধনের চেয়ে সমবায়িক পুঁজির মাধ্যমেই দারিদ্র্য দূরীকরণ সম্ভব। এই প্রেক্ষিতের উপর দাঁড়িয়ে দেশের সামগ্রিক সম্পদের বিকাশে তিনি সার্বিক অংশগ্রহনের কথা বারবার ঘোষণা করেছেন। “আমাদের প্রত্যেকের মধ্যেই ধন নিহিত আছে এই সহজ কথাটি বুঝলে এবং কাজে লাগালে তবেই  আমাদের দারিদ্র্যমুক্তি ঘটবে” সমবায়িক ভাবনাকে আত্মস্থ করেছিলেন বলেই তিনি দ্বিধাহীন ভাবে বলেছেন “ একলা মানুষ টুকরা মাত্র। মানুষ যদি মিলতে না পারে তাহলে তাহলে তাদের ভরসার পরিবেশ তৈরি হবে না।” তাই সামাজিক ঐক্যের উপর তিনি জোর দিয়েছেন বারবার। বলেছেন , দল বেঁধে থাকা দল বেঁধে কাজ করাই মানুষের ধর্ম। এই ধর্ম থেকে বিচ্যুত হলেই মানুষের লোভ মানুষকে গিলে খায়। এই কথাগুলি বলার জন্যই তিনি বলেননি, প্রায়োগিক দক্ষতার প্রতিফলন ঘটেছে তার জীবনব্যাপ্ত দীর্ঘ কর্মে। কেবলমাত্র তার সাহিত্যচিন্তার বিবিধ আধারে নয় প্রত্যক্ষভাবে সমাজের কল্যাণে তিনি নেতৃত্ব দিয়েছেন। ভারত একটি কৃষিপ্রধান দেশ। রবীন্দ্রনাথ বুঝেছিলেন এই দেশের সামগ্রিক বিকাশভাবনার সাথে জড়িয়ে আছে কৃষির উন্নয়ন। আমাদের দেশে সমবায় ভাবনার পথিকৃত তিনি। বাংলার কৃষকদের কথা ভেবে পল্লী উন্নয়নের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। সমবায়ভাবনার ভিত্তিভূমি রচনা করেছিল এইসব অনুচিন্তাগুলিই। তিনি চেয়েছিলেন পল্লীর কাদামাটিতে দেশের প্রতিভা, মেধা, জ্ঞান বিজ্ঞান ও বিদ্যা যেন সংযুক্ত হয়। এর জন্য কৃষকদের অভাব দূর করতে হবে প্রথমে। তাই কৃষকদের সরল সুদে ঋণ দেবার মহৎ উদ্দেশ্যে পাতিসরে কৃষি ব্যাঙ্কের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। কৃষির উন্নতির কথা ভেবে ছেলে ও জামাইকে আমেরিকায় পাঠিয়েছিলেন কৃষিবিজ্ঞান পড়ার জন্য। সমবায়নীতি প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ জমির বিখন্ডতার অবসান , যান্ত্রিক চাষাবাদ এবং বিপননের উপর গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন। কৃষকের হাতে অর্থের জোগান না থাকলে বিপন্ন হবে দেশের সার্বিক অর্থনীতিই এ কথা তিনি দৃঢ় গলায় বারবার উচ্চারণ করেছেন। “ যাহাদের মনে ভরসা নাই, তাহাদিগকে ভিক্ষা দিয়া সেবা শুশ্রূষা দিয়া কেহ বাঁচাইতে পারে না। ইহাদিগকে বুঝাইতে হইবে যাহা একজনে না পারে তাহা পঞ্চাশজনে জোট বাধিলেই হইতে পারে।” ( সমবায় নীতি) এই তার অন্তরের আহ্বান “ সমবায়নীতি অনুসারে চাষের ক্ষেত্র একত্র করে চাষ না করতে পারলে কৃষির উন্নতি হতেই পারে না ( রাশিয়ার চিঠি)”

একদিকে সংখ্যালঘু ধনিক শ্রেণী,অন্যদিকে বিস্তৃত পরিসরের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী এই ছিল রবীন্দ্র সময়ের ভারতবর্ষের রূপ।নিজে জমিদার হয়েও তিনি কেবলমাত্র ধনিক সম্প্রদায়ের উন্নয়নের কথা বলেননি। তার মানবিক উন্নয়নের ধারনা গড়ে উঠেছিল গ্রামকেন্দ্রিক ভারতের বিকাশভাবনার ভেতর দিয়ে । গ্রাম মানে যেখানে প্রায় নব্বই শতাংশ মানুষের বসবাস। শিক্ষার আলো থেকে বহুদূরে তলিয়ে যাওয়া চিকিৎসার সুবিধাবঞ্ছিত এইসব ম্লান মুক মুখে ভাষা তুলে দেওয়ার পাশাপাশি তাদের জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন, স্কুল নির্মাণ , রাস্তাঘাট নির্মাণ, পরিশুদ্ধ জলের আয়োজন, পুকুর খনন, স্থানীয় স্বাস্থ্যকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা তাঁর সমাজনৈতিক ভাবনার নিদর্শন।

আজ চুড়ান্ত বিচারে মানব উন্নয়ন মানে মানুষের উন্নয়ন, মানুষের জন্য উন্নয়ন এবং মানুষের দ্বারা উন্নয়ন। মানুষের উন্নয়ন বলতে বোঝায় মানব সম্পদ উন্নয়ন, মানব সক্ষমতার বৃদ্ধি ও প্রসার। উন্নয়নের সুফল প্রত্যেক মানুষের জীবনে পৌছে দেওয়ার অন্য নাম মানুষের জন্য উন্নয়ন। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি থেকে শুরু করে রাজনৈতিক সামাজিক এবং অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের সুফল সমাজের প্রতিটি মানুষ যেন ভোগ করতে পারে। মানুষের দ্বারা উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় সাধারন মানুষের অংশগ্রহণ প্রক্রিয়াকে বোঝায় । এ অংশগ্রহন শুধু সিদ্ধান্ত গ্রহণের বাস্তবায়নের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হবে।” আজকের পঞ্চায়েতী ভাবনার সার্থক রূপ সেদিন রবীন্দ্রভাবনায় প্রতিফলিত হয়েছিল। সমাজ নিয়ে সমাজের বৃহত্তর পরিসরের মানুষের কল্যাণভাবনা তাঁর কবিতার ভেতর তাঁর রচনার ভেতর শুধুমাত্র আশ্রয়লাভ করেনি, তার বাস্তবায়ন ঘটেছিল বিভিন্ন কর্মে। কবি রবীন্দ্রনাথ এভাবেই হয়ে উঠেছেন রাষ্ট্রনায়ক।তাই তাঁর অন্তর্নিহিত ভাবনায় নানা মাত্রিক ভাবনার মিশ্র চরিত্র, সেখানে অনেক সময় বৈপরীত্য যে আসেনি তাও নয়। তবুও সমাজের গঠনে দেশের আর্থিক স্থাপত্য নির্মানের প্রশ্নে তাঁর স্বদেশভাবনা তাঁর রাজনৈতিক চিন্তা আলোকিত করে সমকাল পেরিয়ে উত্তরকালকেও। তিনি উপলব্ধি করেছেন প্রাচীন ভারত, উপলব্ধি করেছেন সনাতন ভারতের নিজস্ব চরিত্র। রবীন্দ্রনাথের সমাজ ভাবনার বৃহদায়তন জুড়ে রয়েছে ভারতবর্ষে ইংরেজ শাসনের চরিত্র বিশ্লেষণ নিয়ে, জাতীয়তাবাদী ও বিপ্লবী আন্দোলন নিয়ে, হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক নিয়ে, সর্বোপরি বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদ ও ধনতান্ত্রিক আধিপত্যবাদের আস্ফালন এবং পুঁজির আগ্রাসন নিয়ে তিনি তার সুস্পষ্ট অবস্থান চিহ্নিত করেছেন। রবীন্দ্রনাথকে আমরা চিনি ও জানি একজন সমন্বয়বাদী ধারণায় বিশ্বাসী ব্যক্তি হিসেবে। ব্যক্তিজীবনের ক্ষেত্রে, দেশ বা সমাজের সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে তাঁকে সমন্বয়বাদী রূপে দেখা গেছে। তিনি প্রাচ্যের সাথে প্রাশ্চাত্যের মেলবন্ধনে বিশ্বাস করতেন । দেশ ও সমাজ গঠনে সনাতন ভারতবর্ষের যা কিছু কল্যাণকর তা যেমন গ্রহণ করেছেন পাশাপাশি ইউরোপীয় বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির দিকচিহ্নগুলিকে সমাদর করেছেন। উন্নত, আধুনিক ভারতবর্ষ বিনির্মাণে বিজ্ঞান প্রযুক্তি এবং যুক্তিবাদী চিন্তা যেমন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেবে পাশাপাশি ভারতীয় আধ্যাত্মিক দর্শনেরও প্রয়োজন হবে দীর্ঘদিন এমন বিশ্বাস তিনি লালন করেছেন। ফলে বিজ্ঞানের অগ্রগমনের সাথে পরিবেশ চেতনার বিষয়টিকেও তুলে এনেছেন নির্ভুলভাবে। যত দিন যাচ্ছে পরিবেশ চেতনায় রবীন্দ্রনাথের কথাগুলি আমাদের কাছে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে জরুরি হয়ে উঠছে। তিনি বিশ্বাস করতেন পরিবেশ রক্ষা না পেলে মাটি ও মানুষের যে চিরায়ত সম্পর্ক তাও ধাক্কা খাবে ভঙ্গুর হয়ে উঠবে। তার কবিতায় গল্পে গানে আমাদের পৃথিবীর সুরক্ষার কথা তিনি বারবার তুলে এনেছেন। নগরায়নের ধারাবাহিক প্রসারতার বিরুদ্ধে তাকে এমন কথাও বলতে হয়েছে “ দাও ফিরে সে অরণ্য লও এ নগর” মানুষের সমাজ যেখানে প্রথম সভ্যতার প্রথম পাঠ শিখেছিল অরণ্যই সেই প্রমিথিউস। ফলে নগরায়নের নামে নির্বিচারে অরণ্য নিধন এক আত্মধ্বংসী প্রয়াস তা তিনি স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। মরুবিজয়ের কেতন উড়াতে বলেছেন বারংবার। মুক্তধারা নাটকে মানুষের সীমাহীন প্রলম্বিত লোভ লালসা এবং প্রকৃতির নেতিবাচক প্রভাবকে প্রতীকায়িত করেছেন। আকাশ ভরা সূর্য তারা বিশ্ব ভরা প্রাণের মাঝেই মানুষকে খুজে নিতে হবে তার বেঁচে থাকার পৃথিবী।

ইংরেজ মানেই তাদের সবকিছু বর্জন করতে হবে এরকম কথা রবীন্দ্রনাথ কখনই বলেন নি।বরং তাদের সামাজিক চিন্তার মানবিক দিকগুলিকে গ্রহন করে এক সমৃদ্ধ ভারত গড়ার কথাই রাবীন্দ্রিক দর্শন।একাধিক প্রবন্ধে তা প্রকাশ পেয়েছে। তাঁর ‘পূর্ব ও পশ্চিম’ (১৯০৮) প্রবন্ধটি যেন তাঁর ভারতবর্ষ-বিষয়ক ইতিহাস-ভাবনার প্রতিফলন। এখানে রবীন্দ্রনাথ পূর্ব ও পশ্চিমের যোগসূত্রের প্রত্যাশা করেছেন। কিন্তু পশ্চিম বলতে এখানে তিনি ইংরেজকেই বুঝিয়েছেন। তাই বলতে পেরেছেন : ‘ইংরেজের সঙ্গে আমাদের মিলন সার্থক করিতে হইবে। মহাভারতবর্ষ গঠনের ব্যাপারে এই ভার আজ আমাদের উপর পড়িয়াছে। ইংরেজের যাহা কিছু শ্রেষ্ঠ, ইংরেজ তাহা যে সম্পূর্ণভাবে ভারতবর্ষে প্রকাশ করিতে পারিতেছে না, সেজন্য আমরা দায়ী আছি।’রবীন্দ্রনাথ এক সমন্বয়ের নাম। ‘দেবে আর নেবে মিলাবে মিলিবে’ এই মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ হয়েই তিনি ঘুরেছেন পূর্ব ও পশ্চিম ইউরোপ, উত্তর ও দক্ষিন আমেরিকা, আফ্রিকার মিশর সহএশিয়ার বিভিন্ন দেশ।সেখানে তুলে ধরেছেন নিজের বক্তব্য।নিজের কবিতার কথা তিনি বলেন নি। সাহিত্যচর্চার কথা তিনি বলেননি। তার বক্তব্যের অভিমুখ ছিল বিশ্বশান্তি।তিনি ভারতীয় সংস্কৃতির বহুত্ববাদী ভাবনাকে তুলে ধরেছেন। বৌদ্ধ ধর্মের অহিংসা, ইসলাম ধর্মের সুফিবাদ, বাউলদের ভাববাদী চেতনার অন্তর্নিহিত সত্যকে বিশ্বের দরবারে তুলে ধরেছেন। রবীন্দ্রনাথ সারা বিশ্বে আজও চর্চিত হন, আগামীদিনেও হবেন তার কারণ তার কাব্য নয়, তার মতাদর্শিক প্রভাব। তার সামাজিক সমন্বয়ের ভাবনা। কবি রবীন্দ্রনাথের চেয়েও অনেক বড় হয়ে উঠেছে বিশ্বচিন্তক রবীন্দ্রনাথ।যে রবীন্দ্রনাথকে আমরা আত্মস্থ করেছি এভাবে যেথাকার যত আছে ধ্বনি, আমার বাশির সুরে সাড়া তার জাগিবে তখনই। সারা পৃথিবীর সমস্ত ধ্বনির সাথে তিনি নিজেকে বাঁধতে চেয়েছেন বলেই তিনি হয়ে উঠেছেন বিশ্বমানব “ দেশে দেশে মোর দেশ আছে, আমি সেই দেশ লব যুঝিয়া। পরবাসী আমি যে দুয়ারে যাই , তারই মাঝে মোর আছে যেন ঠাই, কোথা দিয়া সেথা প্রবেশিতে পাই সন্ধান লব বুঝিয়া। ঘরে ঘরে আছে পরমাত্মীয় তারে আমি ফিরি খুঁজিয়া” সমসাময়িক যুদ্ধাক্রান্ত পৃথিবীতে এরকম মানবকল্যাণমুখী চিন্তকের প্রয়োজ়ন ছিল সবচেয়ে বেশি, সমস্ত সীমান্ত অতিক্রম করে সারা দুনিয়াকে আলোকিত করার মতো এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। তাই শধু দেশে নয়, নিখিল বিশ্বে সাহিত্যের বাইরে তাঁর একটা সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় গ্রহনযোগ্যতা তৈরি হয়েছিল। ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে তিনি সোচ্চার হয়েছেন বারবার।

নাগিনীরা চারিদিকে ফেলিতেছে বিষাক্ত নিঃশ্বাস ,
শান্তির ললিত বানী শোনাইবে ব্যর্থ পরিহাস-
বিদায় নেবার আগে তাই
ডাক দিয়ে যাই
দানবের সাথে আজ সংগ্রামের তরে
প্রস্তুত হতেছে ঘরে ঘরে

বিশ্বশান্তির সপক্ষে ফ্যাসিবাদ বিরোধী আন্তর্জাতিক অবস্থান শুধু নয়, রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাচিন্তা সারা বিশ্বের সমাজে আদৃত হয়েছে। প্রকৃতিকে শিক্ষার সাথে সংযুক্ত করার যে সমীকরণ তা লাতিন আমেরিকার অনেক অনেক দেশে শিক্ষাব্যবস্থার একটি মূল চরিত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে। কোস্টারিকার সল আলগুয়েলোর বলেছেন যে তাঁদের দেশের শিক্ষার ভিত নির্মানে রবীন্দ্রভাবনার গুরুত্ব অসীম।এছাড়া লেখক হোসে ভাসকোনসেলোস ১৯২০ সালে রবীন্দ্রভাবনার সাথে সংযুক্ত করেছিলেন মেহিকোর আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থাকে। রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাচিন্তা হল নান্দনিকতা, মানবিকতা এবং আনন্দের যোগফল। প্রকৃতির সাথে ব্যক্তির, ভাবনার সাথে কর্মের, জ্ঞানের সাথে মনুষ্যত্ববোধের  এবং স্থানিকতার সাথে আন্তর্জাতিকতার মেলবন্ধন। 

তাঁর অজস্র কবিতায় উদ্দীপক সুরে স্বাধিকার চেতনার কথা তিনি বলেছেন আবার অনেক কবিতায় ভক্তিবাদ ও তপোবন সংস্কৃতির পাশাপাশি শাসক বিরোধী, অন্যায়বিরোধী বক্তব্য স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে। সাম্রাজ্যবাদী লিপ্সার আগ্রাসন থেকে রাজনৈতিক মুক্তি যেমন তিনি চেয়েছেন ঠিক সেরকম ভাবে চেয়েছেন আত্মিক মুক্তিও। সাম্রাজ্যবাদী মুক্তির সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদ ও তার আগ্রাসী চরিত্রের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ভিন্নতর রূপ নিয়ে প্রকাশ পেয়েছে তাঁর চেতনায় । উগ্র জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে কবি বরাবর সোচ্চার। তা দেশি বা বিদেশি যা-ই হোক। ইতিহাসবিদ রামচন্দ্র গুহ তাই বলেছেন – “ রবীন্দ্রনাথ ভারতবাসীকে জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ করেছেন জুগিয়েছেন স্বাধীনতার প্রেরণা। জাগিয়েছেন তার চেতনার রঙে, নানা বর্ণ সমাহারে। ভাসিয়েছেন তার সত্তার জ্যোতির্ম্ময় শিখার আলোকের ঝর্নাধারায়।রবিরশ্মির দ্যুতি ছড়িয়ে পড়েছে ভারতবর্ষ সহ সারা বিশ্বময়। তবে রবীন্দ্রনাথের জাতীয়তাবাদ ছিল সর্ব অর্থে।অর্থাৎ তিনি সার্বজনীন। একই সঙ্গে বস্তুনিষ্ঠ এবং যুক্তিনির্ভর” রবীন্দ্রনাথ গভীর আবেগ নিয়ে বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণভুমিকা নিয়েছিলেন। তার স্বদেশবন্দনা ও প্রতিবাদী কবিতাগুলি যা দেশ ও সমাজকে আলোড়িত করেছিল তখন এবং মানুষের মনে গভীর রেখাপাত করেছিল– যেগুলোর অন্যতম ‘আমার সোনার বাংলা’, ‘ও আমার দেশের মাটি’, ‘বাংলার মাটি বাংলার জল’, ‘সার্থক জনম আমার’, ‘বাধা দিলে বাধবে লড়াই’ ইত্যাদি। ভাতৃত্বের বন্ধনে তিনি ঐক্যবদ্ধ করার চেষ্টা করেছিলেনহিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সমগ্রবাঙালিকে। তাই ‘অবস্থা ও ব্যবস্থা’য় তিনি বলেন : ‘আমরা হিন্দু মুসলমান, ধনীদরিদ্র, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, স্ত্রীলোক ও পুরুষ সকলেই বাঙালি বলিয়া যে এক বাংলার বেদনা অনুভব করিতে পারিয়াছি – আঘাতের কারণ দূর হইলেই সেই ঐক্যের চেতনা যদি দূর হইয়া যায় তবে আমাদের মতো দুর্ভাগা আর কেহ নাই। এখন হইতে আমাদের ঐক্যকে নানা উপলক্ষে নানা আকারে স্বীকার করিতে হইবে। লোকহিত প্রবন্ধের ভেতর দিয়ে তিনি একদিকে যেমন বিভেদের কারণ চিহ্নিত করেছেন পাশাপাশি সামাজিক ঐক্যকে সম্প্রসারিত করার কথাও তুলে ধরেছেন। সাম্প্রদায়িক ঐক্য রবীন্দ্রনাথের রাজনৈতিক ভাবনায় বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছিল তিনি আত্মীকরণ করেছিলেন সামগ্রিক ঐক্য ছাড়া অখন্ড ভারত গড়া সম্ভব নয়। ধর্মনিরপেক্ষ ভারতবর্ষের চেহারা কেমন হবে তার চরিত্রের রূপরেখাই বা কী হবে তা তিনি গোরা উপন্যাসের আনন্দময়ী চরিত্রের মধ্য দিয়ে তুলে ধরেছেন। যেকোন বিচ্ছিন্নতার বিরুদ্ধে মানবিক ঐক্য বাস্তবায়িত করতে চেয়েছেনতিনি জাতীয় জীবনের নানা স্তরে । কখনও লেখায় কখনও কাজে।

ফেমিনিজম আজ অত্যন্ত চর্চিত বিষয়। রবীন্দ্রনাথ তাঁর সময়ে দাঁড়িয়ে যেভাবে উপলব্ধি করেছিলেন মেয়েদের সমস্যাগুলিকে এবং  তা নিরসনের রাস্তা খুঁজেছিলেন তা আজকের আত্মপ্রচারসর্বস্ব নারীবাদী চিন্তার আয়ত্বেরও বাইরে। সেই সময়ের সমাজ বন্ধন এবং মুক্তিপ্রয়াসের যে তরঙ্গরেখা রবীন্দ্রসাহিত্যে প্রতিফলিত হয়েছে তা আজকের সময়ে দাড়িয়েও দুর্লভ। সমকালের নারীদের ব্যথা বেদনা এবং অবহেলিত জীবনের বিভিন্ন পরিসর তাঁর গল্পে মুক্তির নতুন দরজা খুলেছে। শিক্ষায় বঞ্ছিত নারীর ব্যক্তিত্ব বিকাশের অভাব,অপরিণত কন্যাসন্তানের বিবাহ  দাম্পত্যে মানসিক ব্যবধান রবীন্দ্র উপন্যাসে প্রতিফলিত হয়েছে। চোখের বালি উপন্যাসে  বিনোদিনী, আশা, রাজলক্ষ্মী এবং অন্নপূর্ণা  এই চারজন নারী চরিত্রের অন্তর্লোকের গভীর প্রদেশ থেকে তাদের অন্তসলিলা লুপ্ত চেতনার ভেতর দিয়ে  রেনেসাঁ উদ্ভাসিত বাংলার ব্যক্তিস্বাতন্ত্রের ঢেউ উদ্বেলিত করেছিল সমাজকে নাড়া দিয়েছিল সমাজের মর্মমূলে তারই পরিস্ফুটন ঘটেছে। নারীশিক্ষা, তার উত্তরাধিকারের দাবি, বিধবাদের পূণর্বিবাহের অধিকার, সধবার প্রণয়ের স্বাধীনতা এসবই ব্যক্তি স্বাতন্ত্রবাদকে প্রতিষ্ঠিত করে। চতুরঙ্গের দামিনী এক চোখে জল আর অন্য চোখে আগুন নিয়ে হয়ে ওঠে সময় অতিক্রান্ত এক নারী। তার নিজস্ব চাওয়ার তেজে একদিকে যেমন ধ্বংস অন্যদিকে তেমনই সৃষ্টির স্বীকৃতি। বিধবা নারীর প্রেম এবং দৈহিক আকাঙ্ক্ষার এক বাস্তব সমীকরণ দামিনীকে রক্তমাংসের নারীতে রূপায়িত করে। ঘরে বাইরে উপন্যাসে আমরা পাই এক অন্তপুরবাসিনী নারীর আত্ম আবিষ্কারের রসায়ন।

রবীন্দ্রনাথ তাঁর সমগ্র জীবন ব্যাপী সম্পাদিত কর্মের মধ্যে মানুষের কল্যাণের কথা ভেবেছেন। শিল্পের প্রায় সব মাধ্যমে সগৌরবে উপস্থিত থেকেও শিল্পের জন্য শিল্প এই ভাবনার অনুবর্তী হননি তিনি। আপন হতে বাহির হয়ে বাইরে দাঁড়িয়ে  বুকের মাঝে বিশ্বলোকের  সাড়া যেমন পেয়েছেন  তেমনই তিনি চিন্তা করেছেন  দেশ জাতি এবং সমষ্টির মঙ্গলের কথা।নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি  না হয়েও জনকল্যাণে নিজেকে উৎসর্গ করেছেন।সাম্প্রতিক কালে প্রতিটি রাজনৈতিক দলের নির্বাচনী ম্যানিফেষ্টো যেভাবে জনমুখি কাজের খতিয়ান তুলে ধরে এতে আমাদের মনে পারে সমাজকল্যাণ খুব সহজ কাজ। লোকহিত অত্যন্ত সস্তা এক উপাদান। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন- “ মানুষ কোনোদিন কোনো যথার্থ হিতকে ভিক্ষারূপে গ্রহণ করিবে না, ঋণরূপেও না, কেবল প্রাপ্য বলিয়াই গ্রহণ করিতে পারিবে।( লোকহিত, রবীন্দ্র রচনাবলী) প্রকৃত প্রস্তাবে অন্যের কল্যাণের জন্য তাকে সম্মান জানানো আগে দরকার নইলে সমগ্র আয়োজন আত্ম অহংকারে পর্যবসিত হয়।

আজ বিশ্বায়নের ছায়া পড়েছে আমাদের চেতনায়। শিক্ষাব্যবস্থার উপর সমাজ ব্যবস্থার উপর তার নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।“ শিক্ষার পরিমাণ শুধু সংখ্যায় নয় , তার সম্পূর্ণতায় তার সমগ্রতায়” রবীন্দনাথ বলেছিলেন রাশিয়ার চিঠিতে । শিক্ষা এখন আর মানুষের অধিকার নয়, লাভজনক পণ্য হিসেবে বাজার অর্থনীতির উন্মুক্ত দুনিয়ায় তার কদর বেড়ে চলেছে দিনদিন।দেখা দিচ্ছে সামাজিক অসাম্য এবং নীতিহীনতা। উতপাদিত ডিগ্রির সমান্তরালভাবে মানুষ তৈরি হচ্ছে  না। যত দিন যাচ্ছে আমাদের কাছে আমাদের কাছে জরুরি হয়ে পড়ছে রবীন্দ্র নির্দেশিত পথ।  আমাদের সমাজে কৃষকের কল্যাণে, সমবায় নীতির সম্প্রসারনে , আমাদের শিক্ষাচিন্তায়  এবং অস্তিত্বের সংকটে রবীন্দ্রভাবনা আজ আরও বেশি বেশি  করে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে।         

কপিরাইট বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায় কর্তৃক সংরক্ষিত


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন