নির্ভয়ে ছুটিতে হবে সত্যেরে করিয়া ধ্রুবতারা * চন্দ্রানী মিত্র বোস



নির্ভয়ে ছুটিতে হবে
সত্যেরে করিয়া ধ্রুবতারা

"কল্পনা করছি
অনাগত যুগ থেকে তীর্থযাত্রী আমি
ভেসে এসেছি মন্ত্রবলে ..
উজান স্বপ্নের স্রোতে
পৌঁছলেম এই মুহুর্তেই
বর্তমান শতাব্দীর ঘাটে "...


প্রণাম নিও কবি! তোমার লেখা এই কিছু অক্ষর দিয়েই শুরু করলাম আজ। তোমাকে নিয়ে লেখার স্পর্ধা নেই আমার .. শুধু সেই কবে ছাতিম তলায় বা পদ্মা তীরে বসে তুমি লিখে গেছো  নানান কাব্য, গদ্য,কবিতা আর গান সেই  বুকে জড়িয়ে আমি রোজকার পথচলা শুরু করি। আমার ছোটবেলায় ঘুম থেকে উঠে "মাগো আমি হব সকাল বেলার পাখী, সবার আগে কুসুম বাগে উঠবো আমি ডাকি" বলে মার গলা জড়িয়ে ঘুম থেকে উঠেছি। তোমার লেখা কবিতা "মাগো আমায় ছুটি দিতে বল, সকাল থেকে পড়েছি যে মেলা " বারবার সুর করে গেয়েছি বৃষ্টি ভেজা দিনে মার কাছে পড়ার ছুটি চাইতে গিয়ে। আনন্দে খুশীতে বৃষ্টিতে কাগজের নৌকা ভাসাতে ভাসাতে আমি ছড়া বলেছি নানান রকমের। আমার স্কুল  বা কলেজের জীবনের সাথে অঙ্গাঙ্গি ভাবে জড়িত ছিলে তুমি। আমি "ফাগুন হাওয়ায় হাওয়ায় করেছি যে দান " গাইতে গাইতে নাচের অনুষ্ঠানে তোমাকেই স্মরণ করেছি। জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে তোমার ছায়া বারবার আমাকে পথ দেখিয়েছে। তোমার "দুরদেশী সেই রাখাল ছেলে"স্বপ্নে এসে আমাকে মৃদু হাতছানি দিয়ে ঘর ছাড়া করতে চেয়েছে বারবার। আমি হেসেছি ভেসেছি তোমার কাব্যের হাত ধরে। আমি জীবনের নানান পর্বে গেয়েছি তোমার গান, তোমার কবিতা আর মননে সযত্নে রেখেছি তোমায় !

কিন্তু যত বড় হয়েছি তত একটু একটু করে দূরে সরে গেছো তুমি। আমি আধুনিক হবার বাসনা বুকে নিয়ে এগিয়েছি অন্য পথে। কাব্যের সন্ধানে তোমাকে ভুলেছি, আমি আধুনিকতার গড্ডালিকা প্রবাহে নিজেকে ভাসাতে ভাসাতে কখন যেন তোমার হাত ছাড়িয়ে অনেক দূরে এগিয়ে গেছি। কখনও অজান্তে ভেবেছি তোমার কথা বা সুখে দুঃখে শুনেছি তোমার গান কিন্তু কি জানি কখন বেশ দূরে সরে গেছি তোমার কাছ থেকে। সত্যি বলতে একটুও দ্বিধা নেই আজকের জীবনে  তোমাকে ভুলে  আমি বা আমরা বেশ আছি।

স্কুল কলেজের পাঠ্য বইতে হয়তো আছে আজও তোমার লেখা কিছু গল্প। কিছু গান আজও গাই বটে আমরা। কিন্তু আমাদের আর সেই সাথে নতুন প্রজন্মের কাছ থেকেও তুমি ধীরে ধীরে সরে গেছো। আমাদের প্রতিদিনকার যে জীবন সেখানেও আমরা তোমার গান শুনেছি  কবিতা বা প্রবন্ধ পড়েছি কিন্তু সে গানে, কবিতায় বা প্রবন্ধের অন্তর্নিহিত অর্থ বুঝে জীবনের পথে তা ব্যবহার করিনি। তুমি আমাদের অনুভূতিতে মিশে আছো।কিন্তু আমরা রোজকার জীবনে তোমার ভাবনা কতটা বাস্তবায়ন করার চেষ্টা করেছি তা বলতে গেলে হয়তো তেমন কিছুই বলতে পারবো না। আজকের যুগেও তুমি সমান প্রাসঙ্গিক। কিন্তু সে প্রাসঙ্গিকতা আজকের নবীন প্রজন্মকে কোনভাবে নাড়া দিচ্ছে কি সেটা নিয়ে একবারও ভেবে দেখি নি আমরা। আজকের এ গ্লোবালাইজেশনের যুগেও জীবনের প্রতিটি বাঁকেই খুজে পাওয়া যায় তোমাকে জেনেও আমরা তোমার আদর্শ থেকে সরে গেছি। তোমার লেখনী থেকে জীবন সাজিয়ে নেওয়া কিংবা শিক্ষা নেওয়ার অনেক কিছু আছে। কিন্তু আমরা সত্যি কি চেষ্টা করেছি তা' ...

আমাদের যাপিত জীবনের কোথায় রবীন্দ্রনাথ নেই ..এই কথা হয়তো খুব সত্যি কিন্তু কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কোথায় কোথায় আছেন সেটা ভেবে দেখি নি আমরা!! আমরা ছোট থেকে বড় হয়েছি তাঁর আদর্শকে বুকে আগলে, আমরা গান গেয়েছি তার কথায়, আবৃত্তিতে বারবার আমরা ডেকে এনেছি তাঁকে। সুখে দুঃখে তিনি মিশে আছেন আজও আমাদের কাছে। কিন্তু সে শিক্ষা আমরা, সে অনুভব আমরা কতটা কাজে লাগিয়েছি ! আমরা  শুধু মনের ঘরে আসনে বসিয়ে সে দরজা চিরতরে বন্ধ করে দিয়েছি। তার আদর্শ মনেই রেখেছি কিন্তু কাজে তার প্রতিফলন চোখে পড়ে নি কখনও আর আমরা ভাবিও নি কখনো তা নিয়ে।

দোষ  কার!! আমার আপনার বা এই পুরো সমাজের। আমরা গড্ডলিকা প্রবাহে ভাসতে ভাসতে আজ যেখানে এসে দাঁড়িয়েছি সেখান থেকে ফেরার পথ  আছে কি না আমার জানা নেই। একটু একটু করে সরে গেছি আমরা তাঁর দেখানো পথ থেকে। যে শিক্ষা আমরা পেয়েছি আমাদের বাবা মা বা দাদু ঠাকুমার কাছে, তার কোনটাই আমরা কাজে লাগাতে পারি নি। রবীন্দ্রনাথ আসলে কোন কবির নাম নয়, রবীন্দ্রনাথ কোন লেখকের নাম নয়। রবীন্দ্রনাথ সাহিত্যের আকাশের নাম। অথচ আমরা তাঁকে ভোলার সবরকম চেষ্টা করেছি। এমন কোন দিক নেই যা নিয়ে বা যার সম্বন্ধে তিনি আলোকপাত করেন নি। তিনি মানুষকে ভালোবাসার মূল মন্ত্র শিখিয়ে গেছিলেন! অথচ আমরা আমাদের সন্তানদের সে শিক্ষা দিই নি। আমরা জানি সব, আমরা মানি সব কিন্তু অপসংস্কৃতির নানান প্রলোভনে আমরা নিজেদের পূর্ব পুরুষদের থেকে শেখা সমস্ত শিক্ষা জলে ভাসিয়ে  শুধু নতুন পথে এগিয়েছি। একটি শিশুর শিক্ষার প্রথম সূত্রপাত তার মা বা বাবার কাছেই হয়। বাড়িতে বুর্জুগ থাকলে তিনিও শেখান। আমরাও ছোটবেলায় বাড়িতে বাবা মার কাছেই সব শিখেছি। একটু বড় হতে হতে কি জানি কি করে রবীন্দ্রনাথ আমাদের পাঠ্য পুস্তকের গন্ডি ছাড়িয়ে আমাদের জীবনের অঙ্গাগী অংশ হয়ে উঠে ছিলেন। আমরা ছোট ছোট খুশীতে, গভীর দুঃখে কিংবা কখনও কোন একান্তে বসে তাকেই ভেবেছি।  অথচ জীবনের চলার পথে যখন সেই আমরা নতুন বৃহত্তর জীবনে পা ফেলেছি, আমরা উচ্চতর শিক্ষার পথে স্বপ্ন পূরণের জন্য এগিয়েছি ঠিক সেই সময়ে কি করে যেন তাঁর শক্ত করে ধরে রাখা হাতের বাঁধন আলগা করে আমরা তাঁকে পেছনে ফেলে সামনে এগিয়ে গেছি। ভুলে গেছি যে এতদিনের সাথে রাখা শিক্ষা এক লহমায় পথের প্রান্তে ফেলে আমরা জীবনের সাফল্য অর্জনের দৌড়ে নিজেদের ছাপ বজায় রাখার জন্য যা যা প্রয়োজন তা করেছি।

ষাট বা সত্তরের দশকে যেখানে  বাবা মায়েরা এক্কা দোক্কা ইংরেজি স্কুলে পড়লেও বেশীর ভাগ গর্ব অনুভব করেছেন নিজের সন্তানকে বাংলা মিডিয়াম স্কুলে ভর্তি করার পরে। কারণ তাঁরা জানতেন হয়তো মাধ্যমে কিছু এসে যায় না। তারা বিশ্বাস করতেন উপযুক্ত শিক্ষা বাংলা বা ইংরেজি মাধ্যমের জন্য অর্জিত হয় না। অর্জিত হয় উপযুক্ত পথ প্রদর্শনের ফলে। আর সেই শিক্ষার জোরেই  তাঁদের সন্তানেরা হয়তো প্রায় সকলেই  মোটামুটি কৃতী নিজের নিজের জীবন ক্ষেত্রে। আমি হলফ করে বলতে পারি তারা কিন্তু সবাই মোটামুটি বাংলা মিডিয়াম স্কুলেই লেখাপড়া করে এসেছেন। কেউ ইংরেজী মাধ্যমে পড়েন নি তাও আমি বলতে চাইছি না। শুধু এটুকু বলতে চাই যে কোন মাধ্যম শিক্ষার মাপকাঠি হয় না। সুশিক্ষা অভিভাবক এবং সমাজের দেন। বাংলা মাধ্যমে পড়েও জীবনে সাফল্য অর্জন করতে তাদের কোন অসুবিধে হয়েছে বলে আমার অন্ততঃ জানা নেই। আমি জানি এবং দৃঢ় বিশ্বাস আপনারাও জানেন এমন বেশ কিছু মানুষের কথা। যারা বাংলার হাত ধরেই জীবনের সমস্ত কঠিন পরীক্ষা নির্দ্বিধায় অতিক্রম করেছেন। দেশ বিদেশে প্রতিষ্ঠিত কিছু সফল মানুষের তালিকায় আছেন এঁরা তা আমরা সকলেই জানি।

রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, "কেউ কেউ যেমন প্রথম শ্রেণীতে পাস করে, কেউ কেউ তেমনি প্রথম শ্রেণীতে ফেল করে। কিন্তু যারা পাস করে তাদেরই ভিন্ন ভিন্ন শ্রেণী নির্দিষ্ট হয়, যারা ফেল করে তাদের মধ্যে শ্রেণীনির্দেশ করা কেউ আবশ্যক মনে করে না"....এই কথার অন্তর্নিহিত অর্থ কজন বুঝেছেন জানি না কিন্তু আমার ক্ষুদ্র বুদ্ধিতে মনে হয় তিনি বলতে চেয়েছেন..শুধু যারা সাফল্য অর্জন করে তাদেরই উচ্চস্থানে বসাই আমরা, কখনও ভেবে দেখি না যারা সেই মাপকাঠিতে সাফল্যের মুখ দর্শন করলো না তারা ঠিক কতটা পিছিয়ে আছে। কি তাদের পরাজয়ের কারণ ! আর সেই প্রথম শ্রেণীর ফেল হওয়া মানুষগুলো জীবনে কি সত্যিই পিছিয়ে রইলো !  আমরা স্বার্থপর হতে হতে নিজেদের বুদ্ধিকেও সংকীর্ণ করে ফেলেছি আর নিজেদের স্বার্থের বাইরে ভেবে দেখিনি কোনদিন আর কারোর জন্য। আমরা আসলে ছোট থেকে যে শিক্ষা পেয়েছি আমাদের অভিভাবকদের কাছ থেকে সেখানে প্রতিপদে তাঁরা চেষ্টা করে গেছেন আমাদের এক সুস্থ উজ্জ্বল দিশা দেখানোর। তাঁরা প্রতি পদে চেষ্টা করেছেন আমাদের এক নতুন দিশা দেখানোর, চেষ্টা করেছেন সত্যি করে আমাদের মানুষ বানানোর আর আমরাও গর্বের সাথে বলেছি বা আজও বলে চলেছি ...হ্যাঁ আমি রবীন্দ্রনাথকে ভালোবাসি, আমি নজরুলের গান বা কবিতার মাঝে আমার আমি কে খুঁজে পাই। আমি অতুল প্রসাদের গানে মাটির গন্ধ পাই আর দিনের শেষে আমি রবীন্দ্রনাথের গল্প পড়তে পড়তে বা গীতবিতানের পাতায় নিজের চেনা কোন এক গানকে খুঁজে পেয়ে আমার তারার দেশে হারিয়ে যাওয়া বাবা মার কথা ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ি। আমার জীবনের প্রতিটি কোণায় কোণায় তাঁর ছায়া আমাকে সাহস জোগায়। আমি পথ ভুলে দিনের শেষে আশ্রয় খুঁজি তার কাছে, আমি "আকাশ জুড়ে শুনিনু ওই বাজে, তোমারই নাম সকল তারার মাঝে "  শুনতে শুনতে আজও ঘুমিয়ে পড়ি দিনের শেষে।

কিন্তু বেশ কিছুদিন ধরে, কিছুদিন নয় বেশ কিছু মাস ধরে নিজের সাথে নিজের এক অদৃশ্য যুদ্ধ চলছে। অদৃশ্য লড়াই নিজের বিবেকের সাথে। আমার বাবা মা বা পূর্ব পুরুষের শেখানো পথে আমি কি ঠিকঠাক এগোতে পেরেছি ! পেরেছি কি সে শিক্ষার মান রাখতে ! আমি কি উত্তরাধিকারী সূত্রে পাওয়া আমার সব শিক্ষা ছড়িয়ে দিতে পেরেছি আমার আত্মজ বা আত্মজার মধ্যে। আমি কি এই নতুন প্রজন্মের একজনকেও পেরেছি সে আদর্শের দীক্ষা দিতে। নিজে যার বা যাদের ছত্রছায়ায় বড় হয়ে উঠেছি আর আজও সে শিক্ষার বলে এগিয়ে চলেছি পেরেছি কি তাদেরও সে শিক্ষা দিতে। আমি কি আমার বাবার মতো বলতে পারবো তাকে সঞ্চয়িতার "পুনশ্চ"থেকে "সাধারণ মেয়ে"পাঠ করে শোনাতে। বলতে পারবো তাদের গীতাঞ্জলির পাতায় পাতায় কি লেখা আছে বা তার ভাবার্থ কি! একবারও দিনের শেষে আমার গাওয়া গানে তারা কি কন্ঠ মেলাবে আর গাইবে .. আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে .. এ জীবন পুণ্য করো !

না না কোনদিন মেলাবে না, মেলাবে না কোনদিন আমার আবৃত্তি পাঠের সময় আমার দরদর করে ভেসে যাওয়া পংক্তিতে নিজেদের কন্ঠ স্বর। তারা তো দু এক শব্দ ছাড়া জানেই না কিছু তাঁর সম্বন্ধে। তারা জানে কি তিনি বিশ্ব কবি ! জানে কি ছাতিম তলায় বসে ঠিক কোন কবিতাটা তিনি লিখে গেছেন। অথচ জানে তিনি জাতীয় সঙ্গীতের স্রষ্টা । জানে তিনি নোবেল প্রাইজ পেয়েছিলেন আর তো আর এটাও জানে কি অবস্থায় বা কি পরিস্থিতিতে তিনি "নাইট উপাধি"ছেড়ে দিয়েছিলেন।  কিন্তু তারা তাঁকে পথ প্রদর্শকের স্থানে ভাবে কি! তারা কি মেঘলা দিনে বা সুখ দুঃখের সময় তাঁকে খোঁজে। খোঁজে কি নিজের প্রেম বা বিরহের সময়ে ! একবারও গেয়েছে কি ওরা "কি গাব আমি কি শোনাবো আজি আনন্দ ধামে"!!

দোষ কার! তাদের না আমার বা আমার মতো কিছু অভিভাবকের। দোষ কার যে তারা চেনে না আজ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে। দোষ কার যে তারা অবসরে গল্পগুচ্ছ বা সঞ্চয়িতা না পড়ে রাস্কিন বন্ড বা রবার্ট ফ্রস্ট এর লেখার মাঝে নিজেদের ডুবিয়ে দেয়। তারা গান শোনে বৈকি সব সময় শোনে, শোনে ল্যাপটপে কাজ করতে করতে, শোনে গাড়ি চালাতে চালাতে, শোনে খুশীতে, দুঃখে আর খুব আনন্দেও। কিন্তু সে গানে রবি ঠাকুর কোথাও থাকেন না। থাকেন না আমাদের জানা শোনা আরো কোন স্বনামধন্য মানুষের ছোঁয়া। তারা তাদের নতুন জীবন বা নতুন পৃথিবীতে রবীন্দ্রনাথ নামক মহা মনীষী কে দূরেই রেখেছে। তারা অসম্মান করে নি অথচ আমাদের মতো তাঁকে জীবনের অঙ্গাঙ্গি অংশও বানিয়ে নেয় নি।

চোখের সামনে একের পর এক দৃশ্য সামনে এলো। চেষ্টা করলাম বুঝতে কোথায় ভুল হয়েছে .. কোথায় আমরা তাঁর হাত ছেড়েছি নিজের অজান্তেই অথচ পুরো সজ্ঞানে। আমরা এগিয়ে যাবার মোহে দেখিনি পেছনে কি কি ছেড়ে যাচ্ছি। একবারও ভাবিনি আজ যা আমরা করছি আগামী কাল তাকে কি ভাবে মেনে নেবে ! সমাজের কি উন্নতি হবে এই কার্যকলাপের থেকে ! আর তো আর এটাও ভেবে দেখি নি একদিন আমরা পারবো তো এদের সামলাতে বা পারবো তো এদের মতাদর্শ মেনে নিতে। আমরা অ আ ক খ নাম মাত্র শিখিয়ে জোর দিয়েছি ইংরেজি শিক্ষার দিকে। আমরা বাংলা মিডিয়াম স্কুলে না ভর্তি করে তাদের ভর্তি করেছি নামকরা ইংরেজি স্কুলে। ছোট থেকে শিখিয়েছি প্রতিযোগিতা করার ব্যাপারে । তার খেলা ধুলা আঁকা লেখা সব দিনরাত অন্য ছেলে মেয়ের সাথে তুলনা করে তাকে প্রতিদ্বন্ধী বানিয়ে তোলার শিক্ষা দিয়েছি একটু একটু করে। নিজের বন্ধু বান্ধবের সাথে সহযোগীতা নয়, সহমর্মিতা নয় .. তিলে তিলে তাদের মনে বিষ ঢুকিয়েছি।  প্রতিমুহূর্তে তাদের বুঝেয়েছি যে কি ভাবে এগোতে হবে অন্যকে পরাস্ত করে। লেখা পড়া বা খেলায় শুধু এগোবার কথা বুঝিয়েছি, বুঝেয়েছি বন্ধুকে বন্ধু নয় প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবতে। তিনি বলেছিলেন "আমাদের শিক্ষার মধ্যে এমন একটি সম্পদ থাকা চাই যা কেবল আমাদের তথ্য দেয় না, সত্য দেয়; যা কেবল ইন্ধন দেয় না, অগ্নি দেয়।" আমরা শুনেছি, বুঝেছি আর সযত্নে বইয়ের মাঝেই সব শিক্ষা রেখে এগিয়ে গেছি অন্য পথে। আমরা তথ্য সন্ধান করেছি বটে কিন্তু সেই তথ্যের মাঝে কতটা সত্য আছে তা'কোনদিন ভেবে দেখিনি। আমরা ইন্ধন জোগাই নি কোন সত্যকে সামনে আনার জন্য বরং আগুন জ্বালিয়েছি একে অপরের মনে।

রবীন্দ্রনাথের শিক্ষা মননে রেখেও পায়ে পায়ে সে লক্ষণ রেখা অতিক্রম করেছি আমরা। আমরা নিজের অজান্তেই তাঁর হাত ছেড়ে আধুনিক হবার খেলায় মেতেছি। আর তো আর দিনের পর দিন দেখেছি, অনুভব করেছি সেই শিক্ষা সংস্কৃতির বলয়ের বাইরে আমরা শুধু পা রাখিনি নতুন প্রজন্মকেও যে পথে ঠেলে দিয়েছি তার ভয়াবহতা স্বপ্নেও ভাবিনি আমরা কোনদিন। আমরা প্রতিবাদ করিনি একবারও যখন পাশ্চাত্য শিক্ষার বুলি আওরে তারা আমাদের বাংলার সংস্কৃতি বা শিক্ষার অবমাননা করেছে। আমরা মুখ বুজে সহ্য করেছি দিনের পর দিন রবীন্দ্র সঙ্গীতের বিকৃত রূপ বা গায়ন ভঙ্গী। আমরা পথে ঘাটে রবীন্দ্র জয়ন্তী পালন করেছি ঠিকই কিন্তু খুঁজে পাইনি আমাদের পূর্বপুরুষের বলা বা আমাদের চিন্তার মাঝে বসে আছেন যিনি সেই রবি ঠাকুরকে।

তিনি বলেছিলেন..."অসম্পূর্ণ শিক্ষায় আমাদের দৃষ্টি নষ্ট করিয়া দেয়—পরের দেশের ভালোটা তো শিখিতে পারিই না, নিজের দেশের ভালোটা দেখিবার শক্তি চলিয়া যায়।" সত্যিই হয়তো তাই। আমরা আমাদের আগামী প্রজন্মের কাছে সঠিক শিক্ষার পরিভাষা  যে কি তা কি বোঝাতে পেরেছি, পেরেছি কি পদে পদে তাদের মানসিক এবং শারীরিক সঠিক দিশা নির্দেশ করতে। বিষণ্ণ মনে ঘন্টার পর ঘন্টা আমরা টিভি, খবরের কাগজ আর মুঠোফোনে ঝড় তুলেছি  কিছু বিকৃত ঘটনা ঘটার পরে। আমরা দিনের পর দিন প্রতিবাদ করেছি কিন্তু কেন করেছি সে প্রশ্ন একবারও নিজেকে করিনি হয়তো। তিনি বলেছিলেন "অত্যাবশ্যক শিক্ষার সহিত স্বাধীন পাঠ না মিশাইলে ছেলে ভালো করিয়া মানুষ হইতে পারে না—বয়ঃপ্রাপ্ত হইলেও বুদ্ধিবৃত্তি সম্বন্ধে সে অনেকটা পরিমাণে বালক থাকিয়াই যায়।" সে কথা যে কত সত্যি তা আশাকরি আজকের প্রজন্মকে দেখার পর বুঝিয়ে বলার কোন প্রয়োজন নেই।

আজকের এই পতনের জন্য দায়ী কে বা কারা তার বিচার করেছি কি আমরা। একবারও সত্যি সত্যি এর প্রতিকারের কথা ভেবেছি কি আমরা। ভেবেছি কি একবারও কি করে এই অধঃপতন থেকে বেরোবো আমরা।  অসুস্থ সমাজকে সুস্থতার পথে নিয়ে যাবার জন্য একবারও কি কোন কড়া পদক্ষেপ নিয়েছি আমরা!! না অন্ততঃ আমার জানা নেই। আমরা দুদিন চারদিন উত্তেজনায় কাটিয়ে ধীরে ধীরে আবার শান্ত হয়ে গেছি। আমরা আবার নিজের পুরোনো দিন চর্যায় ফেরত এসেছি সব পেছনে ফেলে। রবীন্দ্রনাথ আবার আমাদের বইয়ের আলমারি আর মননে সীমাবদ্ধ হয়ে গেছেন।

তিনি বলেছিলেন,"বিদ্যা যে দেবে এবং বিদ্যা যে নেবে তাদের উভয়ের মাঝখানে যে সেতু সেই সেতুটি হচ্ছে ভক্তিস্নেহের সম্বন্ধ। সেই আত্মীয়তার সম্বন্ধ না থেকে যদি কেবল শুষ্ক কর্তব্য বা ব্যবসায়ের সম্বন্ধই থাকে তা হলে যারা পায় তারা হতভাগ্য, যারা দেয় তারাও হতভাগ্য।" সে কথা মর্মে মর্মে বুঝেও আজ  হয়তো কিছু করার ক্ষমতা নেই আমাদের। আমরা আজ যেখানে দাঁড়িয়ে আছি ঠিক সেখানে দাঁড়িয়েও আমরা সত্যি কি কিছু পরিবর্তনের কথা ভাবছি না কি দিনের শেষে ঘুমের  দেশে তলিয়ে যেতে যেতে সব ভুলে যাচ্ছি। এই ঘুম আমাদের কবে ভাঙবে। অনেক দেরী হয়ে যায় নি তো!  ঠিকই বলেছিলেন তিনি আমরা তার কথার সারমর্ম সেদিনও বুঝিনি আর আজও বুঝতে চাইছি না। আমরা মনে মনে প্রতিনিয়ত হয়তো এই অধঃপতনের থেকে বেরোতে চাইছি। হয়তো চাইছি পরিবর্তন হোক .. ফিরতে চাইছি আবার শান্তিনিকেতন আর জোড়াসাঁকোর অনুষ্ঠানে হাতে এক মুঠো আবির, চোখে ভক্তি আর হৃদয়ে গান নিয়ে। সমাজের প্রতিটি স্তরে ভেদাভেদ দূর করার জন্য তিনি ছিলেন সদা তৎপর। তার স্বপ্নের বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় যাঁকে তিনি ‘যত্র ভবতি বিশ্ব একনীড়ম’রূপে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন, সেখানে সকল শিক্ষার্থীকে এক সারিতে বসার বন্দোবস্ত করেছিলেন। সেখানে ধনী-দরিদ্র, উচ্চ-নীচ  বলে কিছু ছিল না।

আমরা  মনে প্রাণে চাইছি এমন একটা দিন আবার ফিরে আসুক যেখানে দাঁড়িয়ে বলতে পারি আমরা "মনুষ্যত্বের শিক্ষাটাই চরম শিক্ষা আর সমস্তই তার অধীন" চাইছি আবার একবার  ঘরে ঘরে রবীন্দ্রনাথের শুধু ফটো বা মূর্তি সাজিয়ে নয় .. তার লেখা আর বলা প্রতিটা কথার মর্ম বুঝে আমরা জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে তা ব্যবহার করি। তার শেখানো, দেখানো পথে গর্বের সাথে চলে বলতে পারি, হ্যাঁ আমরা রবি ঠাকুরের দেশের লোক! আর তাঁরই ভাষায় সবাই একসাথে বলে উঠি করজোড়ে ...

মহাবিশ্বজীবনের তরঙ্গেতে নাচিতে নাচিতে
নির্ভয়ে ছুটিতে হবে, সত্যেরে করিয়া ধ্রুবতারা।
মৃত্যুরে করি না শঙ্কা। দুর্দিনের অশ্রুজলধারা
মস্তকে পড়িবে ঝরি-- তারি মাঝে যাব অভিসারে
তার কাছে, জীবনসর্বস্বধন অর্পিয়াছি যারে
জন্ম জন্ম ধরি। কে সে? জানি না কে। চিনি নাই তারে--

প্রণাম জানাই কবি 🙏🙏

কপিরাইট চন্দ্রানী মিত্র বোস কর্তৃক সংরক্ষিত

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন