মেঘমল্লার
রিয়া চক্রবর্তী
"কাগজ আবিষ্কারের পূর্বে মানুষ প্রেমের কবিতা
লিখে রেখেছে আকাশে
সেই ভালোবাসার কবিতা এই বৃষ্টি,
এই ভরা বর্ষা।"
মহাদেব সাহা
বাংলা কাব্যজগতে যে দুটি ঋতুর আনাগোনা বেশি তা হল বসন্ত ও বর্ষা। বসন্তে কোকিল
ডাকে! ফুল ফোটে। প্রকৃতি সাজে হরেক
প্রসাধনে। তার একটাই ইচ্ছা, নিজেকে আকর্ষণীয় করে তোলা,। অপরদিকে বর্ষার আবেদন চতুর্মুখী। বর্ষার স্বরূপ যেমন মনে
কুহক জাগায় ঠিক তেমনি বিষাদও এনে দেয়।বর্ষার এই চতুর্মুখী আবেদনের কারণেই হয়তো
বাংলা কবিতায় এর আতিথেয়তা অন্য ঋতুর তুলনায় বেশি।
জানি না বর্ষা কালিদাসের সমাধীতে নৈবেদ্য আকারে সারাক্ষণ ঝরে কি না। তবে
বর্ষার আজীবনের ঋণ তাঁর কাছে। "আষাঢ়স্য প্রথমদিবসে মেঘমাশিস্নষ্টসানুং"
যদি না রামগিরি পর্বতের ওপর দিয়ে উড়ে যেত, আর সে
মেঘ দেখে যক্ষের মনে না জাগতো প্রিয়া বিরহের যাতনা, তবে কি
মেঘ কিংবা এই বর্ষা হতো কাব্য দেবীর যোগ্য রসদ। বর্ষাকে তিনি দিলেন
স্থিতিস্থাপকতা। লম্বা হলেও তার কেন্দ্রটান বাড়তেই থাকে ক্রমশ।বর্ষা নতুনত্ব পায়
মধ্যযুগের বাংলা গীতিকবিতায়।চণ্ডীদাস,
বিদ্যাপতি, জ্ঞানদাস, গোবিন্দদাস কিংবা আরও সব পদকর্তাদের কবিতায় বর্ষা এসেছে রাধিকা বা কৃষ্ণের
প্রেমকে উসকে দেবার জন্যে। বিশেষ করে অভিসার আর বিরহ পর্বে এ বর্ষা যেন প্রেমাণলে
ঘৃতের ছিটা। যেমন রাধার কণ্ঠে বেজেছে_
"এ ঘোর রজনী মেঘের ঘটা
কেমনে আইলো বাটে।
আঙ্গিনার মাঝে বঁধূয়া ভিজিছে
দেখিয়া পরান ফাটে "।
(চণ্ডীদাস)
অন্যখানে রাধা বলেছে_
"এ সখি হামারি দুখের নাহি ওর।
এ ভরা বাদর মাহ বাদর
শূন্য মন্দির মোর "।
(বিদ্যাপতি)
ওপরের কবিতা দুটিতে রাধার মনের প্রেম, কামনা
বাসনা আরও উসকে দিয়েছে বর্ষা। এখানেই বর্ষার জয়। একমাত্র বর্ষারই বিচিত্র ও
সার্থক ব্যবহার হয়েছে বাংলা কবিতায়। বর্ষা কখনো নিটোল প্রেমের অনুঘটক,কখনো প্রকৃতির রূপ বর্ণনায়, কখনো শৈশব বা কৈশরের স্মৃতি
দর্পণ। বর্ষা কখনো স্বয়ং নারী। বর্ষা কোনখানে প্রেমকে অঙ্কুরিত করে, কোনখানে ফুলে ফলে সুশোভিত করে; আবার কোথাও প্লাবনে ভাসিয়ে
নিয়ে যায় অকূল পাথারে।
মদুসূদন তাঁর কবিতায় বর্ষাকে এনেছেন প্রকৃতির অরূপ শক্তি হিসাবে। বর্ষার
প্রকৃতি আর মানব প্রকৃতি এখানে একাকার। যার সাথে একাত্মতা ঘোষণা করেছেন দেবতাগণও। 'বর্ষকাল'
কবিতায় এসেছে
এভাবে -
"গভীর গর্জ্জন সদা করে জলধর,
উথলিল নদ-নদী ধরণী উপর।
রমণী রমণ লয়ে, সুখে কেলি করে,
দানবাদি,
দেব, যক্ষ সুখিত অনত্মরে।"
(বিবিধ কাব্য)
বাংলা কবিতায় বর্ষাকে যিনি পূর্ণতা দিলেন, তিনি
রবীন্দ্রনাথ। বর্ষা বন্দনা, বর্ষার রূপ বর্ণনা কিংবা বর্ষার
বিচিত্র রূপের রসাত্মক প্রকাশ বলতে গেলে রবীন্দ্রনাথই প্রথম ঘটালেন। বাংলা কবিতায়
বর্ষা পেল নতুন মাত্রা। বর্ষার একটানা বৃষ্টি কবির স্মৃতিতে নিয়ে এসেছে শৈশব।
কখনো বা এনে দিয়েছে প্রেমের উদ্রেক। রবি ঠাকুরের বহুল পঠিত একটি কবিতা_
“বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর”। এখানে ঘোরঘন বরষার দিনে
কবি মনকে সিক্ত করেছে শৈশবের স্মৃতি। বৃষ্টিভেজা দিনগুলি কবিকে আজও হাতছানি দিয়ে
ডাকে। কবি ভোগেন নস্টালজিয়ায়। বর্ষার দিনে কবিতায় কবি নিজেকে সমর্পণ করেছেন
প্রেমের বেদীতে। ঘন বরষায় চারদিক সুনসান, সমাজ
সংসার সব মিছে মিছে সকল কলরব, এখানে শুধু কবি আর তার
প্রেমিকা। আবার রবীন্দ্রনাথ কবিতাকে বর্ষার কিংবা বর্ষাকে কবিতার প্রতিদ্বন্দ্বী
করে তুলেছেন। বর্ষার রূপ বর্ণনা করেছেন নিখাদ কাব্য সুষমায়। সে রকম একটি কবিতা
বর্ষামঙ্গল।এছাড়া রবীন্দ্রনাথ তাঁর আষাঢ়, নববর্ষা, আষাঢ় সন্ধ্যা, বর্ষাররূপসহ কিছু কবিতায় বর্ষা ঋতুর সকল
রূপ চিত্রিত করেছেন। আর যেখানে রয়েছে সকল রস সম্ভার। এখানে কবির মন যেমন ময়ূরের
মত নেচেছে ঠিক তেমনি অপরদিকে শঙ্কিত হয়েছেন কালো মেঘের ঘনঘটা দেখে। আবার কখনো কবি
মেঘের দিকে তাকিয়ে বলেছেন -"আজি বরষার রূপ হেরি মানবের মাঝে।" মানব আর
প্রকৃতি যেখানে মিলে একাকার, তা হলো বর্ষা। বর্ষাকে একজন কবি
কত বেশি আত্মস্থ করতে পারে কিংবা বর্ষার প্রকৃতির সাথে মানব প্রকৃতির একটা
যোগসূত্র স্থাপন করতে পারে।বলার অপেক্ষা রাখে না যে, রবীন্দ্রনাথ
কত বেশি বর্ষাপ্রেমিক ছিলেন।
কবি অক্ষয় কুমার বড়ালের বর্ষা ভাবনা কিছুটা আলাদা। বর্ষা শুধু যে মাঠঘাট
ভরিয়ে দেয় তা নয়। কোথাও না কোথাও শূন্যতারও সৃষ্টি করে। যখন চারদিক শুধু বৃষ্টি
আর বৃষ্টি তখন মাঠঘাটে এক ধরনের শূন্যতা বিরাজ করে। কবির মনেও সেই শূন্যতা দাগ
কাটে। কবির এ ধারার একটি কবিতা এমন -
"ঝরে বৃষ্টি গুঁড়িগুঁড়ি কভু বা ঝর্ঝরে
ছিন্নভিন্ন লঘু মেঘ ভাসিছে আকাশে;
এখনো সুষুপ্ত গ্রাম তরম্নছায়া ভরে;
সত্মব্ধ মাঠে শ্রানত্ম পদে শূন্য দিন আসে।"
প্রেমের কবি কাজী নজরুল কবিতায় বর্ষা এসেছে প্রেমের বাহক হিসাবে। প্রিয়া
বিরহ আরো দ্বিগুণ করেছে বাদল দিনের মেঘ। বাদল ধারা প্রিয়ার আগমনী সুরকে বিদায়ী
সুরে পরিণত করেছে। বাদল রাতের বর্ষণ সিক্ত রাতের পাখি হয়ে ওঠে কবির বেদনা বিজয়ী
চিত্তলোকের চিত্রল প্রতীক। বিরহ কাতর পাখিকে কবি তাই বলছেন, তুমি যার জন্যে কাঁদছো সে তো তোমার জন্যে কাঁদে না। কবির উপদেশ -
"বাদল রাতের পাখী।
উড়ে চল_যেথা আজো ঝরে জল,
নাহিক ফুলের ফাঁকি।"
(চক্রবাক;
বাদল রাতের পাখী)
কবি বর্ষার এই রাতে পাখিকে বন্ধু ভেবেছেন। পাখির বিরহের সাথে নিজের বিরহ
একাকার করেছেন। আসলে সকল কোলাহল ছেড়ে কবি বর্ষার নির্জনতায় প্রেমের প্রকৃত
মূর্তি গড়েন। অন্যদিকে নজরম্নল ইসলাম বর্ষার বিদায় মুহূর্তে ব্যথিত হয়েছেন। কবি
বর্ষাকে বলেছেন -
"সেথা যাও তব মুখর পায়ের বরষা নুপূর খুলি'
চলিতে চলিতে চমকি' উঠ না কবরী উঠে না দুলি'!
সেথা রবে তুমি ধেয়ান-মগ্ন তাপসিদী অচপল,
তোমার আশায় কাঁদিবে ধরায় তেমনি 'ফটিক-জল'!
(চক্রবাক;
বর্ষা-বিদায়)
কবি জীবনানন্দ দাশের কবিতায় বর্ষা তেমন প্রভাব না ফেললেও অমিয় চক্রবর্তীর,কিংবা বিষ্ণু দে'র কবিতায় বর্ষা এনেছে
অন্যমাত্রা। এখানে বর্ষা শুধু প্রেমের প্রতীক নয়। এখানে বৃষ্টি নতুন প্রাণের
সঞ্চারক। অমিয় চক্রবর্তীর বৃষ্টি কবিতাটি এমন-
"অন্ধকার মধ্যদিনে বৃষ্টি ঝরে মনের মাটিতে
বৃষ্টি ঝরে রম্নক্ষ মাঠে, দিগনত্মপিয়াসী মাঠে, স্তব্ধ মাঠে,
মরম্নময় দীর্ঘ তিয়াষার মাঠে, ঝরে বনতলে,
ঘনশ্যামরোমাঞ্চিত মাটির গভীর গূঢ় প্রাণে
শিরায় শিরায় স্নানে, বৃষ্টি ঝরে মনের মাটিতে।"
(একমুঠো)
এখানে বর্ষা সবকিছুকে জাগিয়ে তুলেছে। রয়েছে নতুনের সুর। এখানে বৃষ্টি নামে
সৃজনের অন্ধকারে বর্ষা জলধারে। কবি বিষ্ণু দে'র
একাধিক কবিতা রয়েছে বর্ষা বন্দনা নিয়ে। যেমন -
"বৃষ্টি চলে বৃষ্টি অবিরাম, দামিনী, শ্রাবণের
দৃষ্টি ঘ্রাণ প্রাণ, বৃষ্টির পরে বর্ষার ত্রিকূট, শ্রাবণসহ অন্যান্য।"
বর্ষার আগমনে যেমন চারদিকে গুঞ্জরিত হয় নতুনের গান, ঠিক
তেমনি বর্ষার বিলম্বেও হাহাকার পড়ে যায় চারদিক।বর্ষা যেন থমকে দেয় আমাদের
স্বপ্নকে। বাংলা সাহিত্যেও ঠিক তাই। জসীম উদ্দিনের নকশীকাঁথার মাঠে আমরা দেখেছি
বৃষ্টির জন্যে প্রার্থনা গীত 'বদনা বিয়ে', কবি শামসুর রাহমান বৃষ্টির বিলম্বকে তাঁর সৃজন বেদনার সাথে তুলনা করেছেন।
যেমন-
"টেবিলে রয়েছি ঝুঁকে, আমিও চাষীর মতো বড়
ব্যগ্র হয়ে চেয়ে আছি_খাতার পাতায় যদি জড়ো
হয় মেঘ,
যদি ঝরে ফুল, বৃষ্টি। অলস পেনসিল
হাতে,
বকমার্কা। পাতা-জোড়া আকাশের খাঁ-খাঁ নীল।"
(দুঃসময়ের মুখোমুখি; অনাবৃষ্টি)
বাংলা কবিতায় বর্ষা বন্দনা যুগে যুগে। বর্ষা আর বৃষ্টি এখন কবিতার একটি অংশ।
বর্ষামঙ্গলের স্তুতি আর রবীন্দ্রনাথের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। এই স্তুতি এখন প্রতি
কবি মনে। বর্তমান সময়ের প্রায় কবিরই কোন না কোন কবিতায় রয়েছে বর্ষার বন্দনা।
ঐশ্বর্যের ঋতু বর্ষা; অকৃপণ ঋতু বর্ষা। এ ঋতু নিজের
প্রাণরসে সিক্ত করেন ধরণী। নতুন করে জাগিয়ে তোলেন প্রকৃতি। ধুয়েমুছে সাফ করেন যত
জরা। যতটা কাঁদে তার অধিক হাসে। তার কন্নার শব্দই যেন হাসির খলখলানি, নুপুরের নিক্কন। বর্ষায় পুলকিত হন কবি, পুলকিত
করেন পাঠককে। ঘোর বরষা প্রতিটি মনকে করে তোলে প্রেমিক। যেহেতু একজন কবি আপাদমসত্ম
বর্ষার সঠিক সমঝদার। বর্ষা বন্দনা তার কাছেই বড় বেশি মানায়। আর তখনই হয়তো কবি
বলতে পারেন-
'এমন দিনে তারে বলা যায়
এমন ঘনঘোর বরিষায়',
যা হয়ে ওঠে নৈর্ব্যক্তিক। যে ভাবনা বা বলা শুধু কবির বলা হয়ে থাকে না। এ বলা
সবার,
এ ভাবনা সবারই মনের গুঞ্জরিত বুদবুদ।
রিয়া
চক্রবর্তী
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন