মৈত্রেয়ী চক্রবর্তী~যে দিন ভেসে গেছে

দমদমে থাকতে বইএ পড়ত ছ'টা ঋতুর কথা। কিন্তু পঞ্চসায়রে এসে প্রথম চোখের সামনে ঋতু বদল দেখল রুনুরা। গনগনে গ্রীষ্মের শেষে কেমন দীগন্ত প্রসারী আকাশ ঢেকে গেল কালো মেঘে।  পুবদিক থেকে ধেয়ে এলো বর্ষা। দীঘির জলে সমুদ্রের ঢেউএর ক্ষুদ্র সংস্করণ। মাথায় শাদা ফেনাওলা ঢেউ। তীব্র গতীর বাতাস কোথা থেকে যেন ধুলোবালি নিয়ে আছড়ে পড়ত বাড়ির ওপর। তিনভাই বোনে গলা ছেড়ে গান ধরত "ঝড় এসেছে, ওরে এবার ঝড়কে পেলাম সাথী"। বৃষ্টি, বর্ষাকাল প্রথম এক দুদিনের পরেই সব রোমান্স উড়ে যেত। চারিদিকে ব্যাঙের ডাকের সাথে বিভিন্ন সাইজের, বিষাক্ত নির্বিষ সাপ। সন্ধ্যের পর রাস্তায় বের হলে টর্চ রাখতেই হতো। সেই সাথে পা ঠুকে ঠুকে চলা। সাপ যেহেতু শুনতে পায় না কানে, তারা কম্পন অনুভব করে। কাজেই মানুষ আসছে বা বিপদ আসছে এরকম একটা টের পেলে তারা পালাবে, অতএব জোরে জোরে পা ফেলে চলা। চারিদিকে কিলবিল করত জোঁক। মুহূর্তে গায়ে উঠে তো যেতই।~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~


যে দিন ভেসে গেছে
মৈত্রেয়ী চক্রবর্তী


বাড়ির ছাদে আরাম কেদারাটা পেতে বসে রইল রুনু। ছাদ, তাদের বাড়ির সেই বিশাল ছাদে শুয়ে পুরোটা আকাশ দেখা যেত আগে। বাবা তারা মণ্ডলী চেনাতেন ধরে ধরে। সন্ধ্যে নামছে, কিন্তু চারিদিকের বিজলী বাতির দাপটে সব অন্ধকার দূর হয়ে যায় আজকাল। আকাশ যেন ঠিক ভাবে দেখাই যায় না। ছাদের ওপর ঘর আর চারিদিকে বহুতল ওঠার ফলে সীমিতও হয়ে গেছে আকাশটা। বাড়ির সামনের রাস্তা এখন, শহরের আর পাঁচটা ব্যস্ত রাস্তার মতোই গাড়ী বহুল। কানে তালা লাগানো নিস্তব্ধতার বদলে ভেসে আসছে টিভি সিরিয়ালের সংলাপ। চোখ বুজে অনুভব করার চেষ্টা করে রুনু। সেই আদীগন্ত খোলা মাঠ, ধানক্ষেত, দীঘি, পুবের সূর্য, অস্তগামী সূর্য আরোও যে কতো কী মনেপড়ে। 

প্রথম যখন এসেছিল তাদের দমদমের ভাড়াবাড়ি ছেড়ে নিজেদের বাড়িতে, সে এক মিশ্র অনুভূতি। আজন্ম যে বাড়িতে, যে পাড়ায়, সেসব ছেড়ে এক্কেবারে নতুন পরিবেশে, নতুন বন্ধু, নতুন স্কুল সবখানে মানিয়ে নেওয়া। আবার ভাড়ার বাড়ির সেই ছোট্ট ছোট্ট আধা অন্ধকার ঘরের বদলে, আলোহাওয়ায় ভেসে যাওয়া নিজেদের অতো বড়, অমন আধুনিক ধাঁচের বাড়ি; সাথে তিনপাশে সরু হলেও বাগান করার মতো জমি। আশেপাশের বহু জমিই তখন খালি পড়ে আছে, কোনো এককালে বাড়ি ওঠবার অপেক্ষায়।

গড়িয়া আর বাঘাযতীন স্টেশনের মাঝামাঝি জায়গায় প্রায় তিনশো বিঘা জমির ওপর এজি বেঙ্গল আর ইনকাম ট্যাক্সের উচ্চপদস্থ কর্মচারীদের আবাসন পঞ্চসায়র। যদিও তার বাবা এইদুটো অফিসের কোনোটাতে কাজ করতেন না, তবু ওই দুই অফিসের বাইরের কিছু মানুষও জমি পেয়েছিলেন সাম্মানিক হিসেবে। যথেষ্ট সুপরিকল্পিত এই এলাকা, পাঁচটা বড় ও গভীর দীঘি কেটে তার মাটি দিয়ে হোগলা জলা বুজিয়ে তৈরী করা হয়েছিল। পাঁচ পাঁচটা বিশাল দীঘি, প্রতিটা ব্লকে একটা করে প্লট প্লেলট হিসেবে রাখা, এছাড়াও বেশ কটা বড় জমি শুধুমাত্র উড ল্যান্ডস হবে সেই পরিকল্পনায় রাখা। আর বাইপাস লাগোয়া সাতাশ বিঘে জমি যার ওপর এখন পিয়ারলেস হাসপাতাল দাঁড়িয়ে, সেটা তখন ধু ধু করত, কোনো একদিন গাছ লাগানোর আশায়। ফলে বাড়ি ছাড়াও প্রচুর খোলা মাঠ ছিল চারদিকেই। 

ইস্টার্ন মেট্রোপলিটন বাইপাস, নামই সার ছিল। রুনুরা নিয়মিত দেখত মাটি ফেলে উঁচু করা হচ্ছে সেই রাস্তা। কোনো একদিন পাকা হবে, জুড়ে যাবে শহরের সাথে। অবশ্য কাঁচামাটির রাস্তাতেই শুরু হয় বাস চলাচল। গড়িয়া থেকে বাগবাজার। রুনুদের বাড়ির ছাদে দাঁড়ালে বাঁদিকে অনেক দূরে যাদবপুর, ঢাকুরিয়ার আলোকজ্জ্বল নগরীর আভাস পাওয়া যেত। আর ডানদিকে তাকালে বাণতলা বা ওইসব দিকের ঘন অন্ধকার। চারিদিকেই তখন ধান জমি। রুনুরা দেখেছে হাওয়া কেমন ঢেউ দিতো সেই ধানের সবুজ গাছের ওপর। ধান পাকলে হাওয়ায় সে ধান ঝুনঝুনি হয়ে বাজত। অন্ধকারে ছাদের থেকে দেখা যেত সেই কাঁচামাটির বাইপাসের ওপর দিয়ে ছুটে চলা এস একুশ বাসের জানলার আলো। রুনুরা স্কুলে যেত মোটামুটি দল বেঁধে দশ বারোজন একসঙ্গে। প্রায় মাইল খানেক কি তারও বেশি হেঁটে বাঘাযতীন স্টেশন, সেখান থেকে রিক্সায় বা হেঁটে আরোও প্রায় অতোটাই বাঘাযতীন মোড়, সেইখানে স্কুল। বৈষম্যটা বড্ড বেশীই মনে লাগত রুনুর। দমদমে ভাড়া বাড়ির সামনে রিক্সা স্ট্যান্ড। পরিচিত সব রিক্সাওলা, যাঁদেরকে ছোট্ট থেকে দেখছে রুনুরা। তাঁরা স্কুলতো বটেই, এমনকি রুনুর মামাবাড়িও চিনতেন। সেখানে, স্কুলের দূরত্ব তেমন কিছু না হওয়া সত্ত্বেও রুনু কিন্তু হেঁটে স্কুল যেত না। 

পঞ্চসায়র আর তার আশপাশের সব রাস্তাই তখন কাঁচামাটির। কোনো অতিথি এলে তার ফেরত যাওয়ার সময়ে কি লজ্জায় পড়ত ওরা। কারণ, বেশীরভাগ সময়ে ওই দুরন্ত দূর হেঁটে হেঁটেই ফিরতে হতো তাঁদের। গড়িয়া স্টেশন সংলগ্ন এলাকায় কিছু রিক্সা পাওয়া গেলেও বাঘাযতীন স্টেশনের দিক থেকে রিক্সা আসা অসম্ভব ছিল। রেললাইন পার হয়ে লাইনের ধার ধরে সরু পায়ে চলা রাস্তা দিয়ে এসে পৌঁছত আগামী দিনের বড় রাস্তা ই.এম.বাইপাসের ওপর। সেখানে রেল লাইনের ওপর তখন লেভেল ক্রসিং ছিল ঠিকই কিন্তু রাস্তা যাবে তার উপযুক্ত পরিবেশ করতে ছিল একটা উঁচু কালভার্ট। আর কালভার্ট পেরিয়ে রাস্তা ঢালু হয়ে নেমেছিল পঞ্চসায়রের দিকে যেতে, সেই রাস্তাও কাঁচা মাটির আর তার দু'ধারে ধান জমি। কাজেই গড়িয়া স্টেশন একটু দূর পড়লেও রুনুরা অতিথিদের বাড়ির নির্দেশ দেওয়ার সময়ে অনুরোধ করত গড়িয়া হয়ে আসতে। তাহলে অবশ্যই রিক্সায় আসতে পারবেন তাঁরা আর রিক্সাওলাকে অনুরোধ করলে, কিছু টাকা বেশী দিলে ফেরার সময়ের নিশ্চিন্দি। 

তখন তো মোবাইল ছিল না, এমনকি ঘরে ঘরে ল্যান্ড লাইন ফোনও ছিল না। ফলে, অতিথিদের আসবার আগাম খবর প্রায় কখনই জানা থাকত না। যদি কেউ চিঠি দিয়ে জানিয়ে রাখতেন তাহলেই খবর পাওয়া যেত। সে চিঠিও পাড়ার অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ বিল্ডিংএ একটা কাঠের বাক্সে গড়িয়া পোস্ট অফিস থেকে পোস্টম্যান সপ্তাহে একদিন বা দু'দিন এসে ফেলে দিয়ে চলে যেতেন। রুনুদের অভ্যেস ছিল, মাঝে মাঝেই গিয়ে খুঁজে দেখা তাদের নামে কোনো চিঠি আছে কি না। আবার, পরিচিত কোনো বাড়ির চিঠি থাকলে তারা পৌঁছেও দিত। হ্যাঁ, তাদের বহু চিঠিও এভাবে ঘরে পৌঁছেছেন পাড়ারই কেউ। রুনুর মা, মিষ্টি, ভালো মাছ, মুরগীর মাংস, এসব ফ্রিজে মজুত রাখতেন যদি হঠাৎ অতিথি এসে পড়েন তাদের আতিথেয়তায় ত্রুটি না থাকে, সেই ভেবে। দমদমে তো হাতের সামনে পোস্ট অফিস, বাজার আর বাড়ির পাশে মিষ্টির দোকান ছিল। 

দমদমে ব্যস্ত রাস্তার সামনে থাকত রুনুরা। রুনুদের স্কুলের পাশ ঘেঁষে ছিল জেসপ কারখানা। আওয়াজ, ধুলো, ধোঁওয়া এতেই তারা অভ্যস্ত ছিল। কিন্তু পঞ্চসায়রে পাখির ডাক, গরু মহিষের ডাক ছাড়া আর হয়ত কারো বাড়ির টিউবওয়েল পাম্প করার আওয়াজ পেত দিনের বেলায়। রাতের বেলায় তো আরোও নিস্তব্ধতা গ্রাস করত চারিদিক। দুপুরের দিকে অবশ্য গোবর কুড়ানিদের অদ্ভুত আওয়াজ পেত। কোনো গরুকে পটি করতে দেখলেই তারা হাঁক পাড়ত। যে আগে হাঁক পাড়বে ওই গোবরটা তার বরাদ্দ হবে। এমন বিচিত্র পরিবেশে খাপ খাওয়াতে গিয়ে কান্না পেত রুনুর। আবার, ওইযে, নিজেদের বাড়ি কাজেই অনন্যোপায়ও ছিল, আবার কোথাও একটা খুশির সুরও যেন বাজত মনের মধ্যে। শহরের এতো কাছে এমন সুন্দর গ্রাম্য পরিবেশ, শান্ত, নিরিবিলী সবাই কেমন খুশি হতো রুনুদের বাড়ি ঘুরতে এলে। গরমের দিনেও এতো তুমূল হাওয়া চলাচল করত, একতলা বাড়িতেও গরম টেরই পাওয়া যেত না যেন। বহুদিন এমন হয়েছে, প্রচণ্ড গরমের দিনেও পাখা না চালিয়েই থাকত রুনুরা। ওদের ভাষায় সে ছিল 'অসভ্যের মতো হাওয়া'। কারণ, খোলা দরজা জানলা দিয়ে আসা হাওয়ার তেজ এতো ছিল যে, দেওয়ালের হাল্কা ক্যালেন্ডার তো উড়ে যেতই অনেক সময়ে ঘড়ি, বেকায়দায় রাখা কাঁচের গেলাস, কাপ, পড়ে ভেঙ্গে কাণ্ড ঘটাত। আর বিছানার চাদর যদি ঠিক মতো জাজিম তোষকের নীচে গুঁজে দেওয়া না হতো, তাহলে তাকে পাওয়া যেত বিছানার অন্য প্রান্তের মাটিতে। সে ও শক্ত করে সলতের মতো পাকানো অবস্থায়। 

রুনুদের পাড়ায় ছিল সরকারি বন বিভাগের বড়সড় একটা বড়সড় ব্রাঞ্চ। বর্ষার সময়ে গাছের চারা বিনামূল্যে বিতরণ হতো সেখান থেকে। দুই দিঘীর মাঝে চৌকো একটা জমি, তাতে প্রচুর ইউক্যালিপ্টাস গাছের মাঝে ছোট্ট একটা কুঁড়ে ঘর, এই ছিল বনবিভাগের অফিস। বন বিভাগের এই গাছগুলো ছাড়াও পঞ্চসায়রে প্রতিটা পুকুরের পাড়ে, রাস্তার ধারে ধারে ক্যাজুরিনা, পলাশ, জারুল, বকুল, অশোক,এমন কতো যে গাছ ছিলো। আর ওই দুরন্ত হাওয়া যখন গাছের মধ্যে দিয়ে চলাচল করতো, হাজার হাসির শব্দ উঠতো। রুনুদের কান কয়েকদিনেই অভ্যস্ত হয়ে গেছিলো যদিও, কিন্তু অতিথিরা প্রায়শঃই প্রশ্ন করতেন, 'কিসের আওয়াজ?' বা 'কাছাকাছি কোনো স্টেডিয়াম আছে? আজকে সেখানে খেলা চলছে? তাহলে এই হৈহৈ শব্দ কিসের?' হাওয়ার শব্দ জেনে তাঁরা বিস্মিত হতেন বৈকি। 

সূর্যোদয় দমদমে থাকতেও দেখতে পেত, তবে এখানে যেমন সূর্যের রঙ বদলে বদলে ওঠা দেখত তেমনটা নয়। লাল থেকে কমলা হয়ে হলুদ। আর সূর্যাস্ত তো তেমন ভাবে দেখেইনি রুনু এর আগে। বহুদিন ছাদে দাঁড়িয়ে দেখত কেমন রঙ বদলাল আর ফিকে হয়ে যেন মিলিয়ে গেল ট্রেন লাইনের ওই পাড়ে। কেমন অদ্ভুত শিরশিরে ঠান্ডা লাগার অনুভূতি হতো রুনুর। সূর্যাস্তের পরেই শুরু হতো শেয়ালের ডাক। লাইনের পাড়ের ঝোপঝাড় থেকে দলে দলে শেয়াল হু হু শব্দে ডাকতে থাকত। প্রথম যেদিন শোনে রুনুরা, যথেষ্ট ঘাবড়ে গেছিলো। পরে শুনতে শুনতে তাদের কান অভ্যস্ত হয়ে গেলেও, রাতে যদি কোনো অতিথি থাকতেন, তাঁরা খুব ভয় পেয়ে যেতেন। শেয়ালের ডাক যাঁরা শুনেছেন বুঝবেন কেমন বুক কেঁপে ওঠে শুনলে। 

প্রথমদিকে উনুনে রান্না হলেও কিছুদিনের মধ্যে নিয়ম হলো গ্যাসে রান্না করতে হবে। পাড়ায় লোক সংখ্যা বাড়ছে কাজেই সবাই উনোন ধরালে পরিবেশ দূষণ বাড়বে। আর একটা বাড়ির জন্য গ্যাস সিলিন্ডার সাপ্লাই দিতে আসবে না, কিন্তু দশ পঁচিশটা পরিবারের হলে অবশ্যই আসবে। পাড়ায় কারো নতুন গ্যাসের কানেকশন এলে প্রতিবেশিরা ডেমো দেখতে যেতেন, অবশ্যই চা বানিয়ে দেখানো হতো কতো দ্রুত কাজ হচ্ছে গ্যাসে। সে যেন এক উৎসব চলত পাড়ায়। 

দমদমে থাকতে বইএ পড়ত ছ'টা ঋতুর কথা। কিন্তু পঞ্চসায়রে এসে প্রথম চোখের সামনে ঋতু বদল দেখল রুনুরা। গনগনে গ্রীষ্মের শেষে কেমন দীগন্ত প্রসারী আকাশ ঢেকে গেল কালো মেঘে। পুবদিক থেকে ধেয়ে এলো বর্ষা। দীঘির জলে সমুদ্রের ঢেউএর ক্ষুদ্র সংস্করণ। মাথায় শাদা ফেনাওলা ঢেউ। তীব্র গতীর বাতাস কোথা থেকে যেন ধুলোবালি নিয়ে আছড়ে পড়ত বাড়ির ওপর। তিনভাই বোনে গলা ছেড়ে গান ধরত "ঝড় এসেছে, ওরে এবার ঝড়কে পেলাম সাথী"। বৃষ্টি, বর্ষাকাল প্রথম এক দুদিনের পরেই সব রোমান্স উড়ে যেত। চারিদিকে ব্যাঙের ডাকের সাথে বিভিন্ন সাইজের, বিষাক্ত নির্বিষ সাপ। সন্ধ্যের পর রাস্তায় বের হলে টর্চ রাখতেই হতো। সেই সাথে পা ঠুকে ঠুকে চলা। সাপ যেহেতু শুনতে পায় না কানে, তারা কম্পন অনুভব করে। কাজেই মানুষ আসছে বা বিপদ আসছে এরকম একটা টের পেলে তারা পালাবে, অতএব জোরে জোরে পা ফেলে চলা। চারিদিকে কিলবিল করত জোঁক। মুহূর্তে গায়ে উঠে তো যেতই। মেয়েদের গোপন অঙ্গ দিয়ে অনেক সময়ে শরীরের ভেতরে ঢুকে চূড়ান্ত বিপদ ডেকে আনত। হাসপাতাল নিয়ে যাওয়া যে কতো কঠিন ছিল। তাই মেয়েদের অতিরিক্ত সাবধানতা অবলম্বন করতে হতো। বর্ষার সময়ে রুনুদের সেই দলটা, স্কুলে যেত ট্রেন লাইনের প্রায় ওপর দিয়ে। যদি দেখত ট্রেন আসছে, হাত ধরাধরি করে শক্ত চেইন বানিয়ে পাশ ফিরে লাইনের ধারে দাঁড়িয়ে থাকত সবাই। সোজা দাঁড়ালে ধাক্কা খেতে হতো ট্রেনের। কাজেই বিপদ যাতে কাউকে ছুঁতে না পারে তারই প্রচেষ্টা থাকত সবার। আর সাধারণ সময়ে যে রাস্তায় স্কুল যেতো, সে রাস্তার দিকে তো তাকাতেই ভয় লাগত। এঁটেল মাটি তায় ভসভসে কাদা ভর্তি হয়ে থাকত সেই রাস্তায়। স্কুল যাওয়ার পথে পা পিছলে পড়ে কাদা মেখে বাড়ি ফিরে আসা প্রায় প্রতিদিন কারো না কারো ভাগ্যে জুটেই যেতো। সে বেচারা তখন একা একা আবার সেই বিপদসঙ্কুল পথে বাড়ি ফিরত। 

হঠাৎই দেখা যেতো আকাশের চেহারা বদলে যাওয়া। পেঁজা তুলোর মতো মেঘ কাকে বলে সেই প্রথম দেখেছিল রুনু। দমদমে থাকতে ধুনুরীকে তুলো ধুনতে দেখেছিল তারই সাথে মিলিয়ে নিত রুনু। রোদের রং যেন আরোও সোনালী হয়ে পুজোর বার্তা বয়ে আনত। ঝুপ্পুস করে বৃষ্টি নামত হয়ত মিনিট পাঁচেকের জন্য, আবার রোদ ঝলমল হয়ে উঠত মুহূর্ত পরেই। সবার বাড়িতে নানান রকম গাছ ছিল। স্থল পদ্ম, শিউলি ফুটতে শুরু করত। পুজোতে তখন পাড়ার সবাই পুজোর কাজ করত, অনুষ্ঠান করত। পুজো শেষে কালী পুজোর সময় অবধি রাতে কেমন হিম পড়ত। রাতের আকাশ সে সময়ে সবথেকে চকচকে পরিষ্কার থাকলেও, সন্ধ্যের পর মা ছাদে যেতে মানা করতেন, হিম লেগে শরীর খারাপ করবে বলে। সকালে হীরে কুচি শিশির পরে থাকত ঘাসে। কতোদিন রুনুরা খালি পায়ে বের হয়ে যেত রাস্তায়। কারণ তাদের বাড়ির সামনের রাস্তাও তখন ঘাসে ঢাকা। সেই শিশির ভেজা ঘাসে পা দিয়ে দিয়ে এক অন্য জগতকে অনুভব করেছিল তারা। এরপর শীত, বসন্ত দুটোই নিজের নিজের রূপ নিয়ে হানা দিত তাদের পাড়ায়। শীতে চলত পাড়ার স্পোর্টস, ক্রিকেট, রাতের ব্যাডমিন্টন খেলা বা ছোটদের, বড়দের, বয়স্কদের নিজস্ব নিজস্ব পিকনিক। সবাই মিলেও হতো একটা। আবার কখনও দল বেঁধে অ্যাকাডেমিতে নাটক দেখতে যাওয়া। দারুণ ভাবে উপভোগ করা শীতের আমেজকে।

বসন্তের সময়ে আবার দেখত সারা মাঠ ছেয়ে যাচ্ছে ছোট্ট ছোট্ট কাশ ফুলের মতো ফুলে। মিনিয়েচার কাশ ফুল দেখে আনন্দে আত্মহারা রুনু। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই টের পেল এগুলো চোরকাঁটার ফুল। অমন নরম, মিষ্টি দেখতে ফুলগুলো পরিণত হত জ্বালাতনকারী কাঁটায়। সত্যি সত্যি চোখের সামনে দেখত, "চোরকাঁটাতে মাঠ রয়েছে ঢেকে"। জামাকাপড়ে ভরে যেত রাস্তায় চলতে গেলে। তাদের অবসর সময়ের একটা বড় কাজ ছিল কাপড়জামা থেকে চোরকাঁটা বাছা। পাজামা বা প্যান্টে একটাও যদি থেকে যেত, সে হয়ত কাপড় কাচার সময়ে লেগে গেল জামার পিঠে কিম্বা ব্লাউসের হাতায়। সেইখানে তখন পোকার কামড়ের মতো কুটকুট করে। কাজেই উৎপাত মনে হতো চোরকাঁটাকে। দু'একবার তারা চেষ্টা করেছিল ফুল অবস্থাতেই তাদের সমূলে উৎপাটন। কিন্তু সে কি আর একটা দুটো, যে তুলে শেষ করতে পারবে? হাতও ছড়ে যেত। 

তখনকার সময়ে তো আর ইন্টারনেট, মোবাইল ছিল না, এমনকি টিভি বস্তুটাও সবার বাড়ি ছিল না। তাই প্রকৃতিকে দেখার, জানার আগ্রহও ছিল, হয়ত সময়ও ছিল। পড়াশোনার বাইরে আরোও কতো নতুন কাজ করত তারা। পাখি চিনত, সাপ চিনত বইএর সাথে মিলিয়ে মিলিয়ে। বন্ধুদের সঙ্গে সময় কাটানো, বৈকালিক বিভিন্ন খেলা তখন প্রচুর হতো। আবার না বলা কিছু কম্পিটিশনও চলত। যেমন, কে কতো সময় পড়ে বা নিজেদের বাগানের দেখভাল, বাড়ির গ্রিল রং করা এমন বিভিন্ন কাজ তারা নিজেরা করত। 'ও করছে? আমিও করে দেখিয়ে দিই আমিও পারি'। এইরকম ভাবনা চোরাস্রোতের মতো কাজ করত। তবে, সত্যি সত্যি বাগানের মাটি কোপানো, শহরের দিকে গেলে চারা গাছ কিনে এনে লাগানো, তাদের যত্নআত্তি এসব শিখে গেছিল শহুরে মেয়ে রুনুও। টিভি ছিল শিপ্রাদিদের বাড়ি, কোনোদিন ভালো সিনেমা থাকলে শিপ্রাদিরা বলে দিলে বাড়ির অনুমতি নিয়ে রুনুরা সবাই পৌঁছে যেত শিপ্রাদিদের বাড়ি। আবার সিনেমার মাঝপথে লোডশেডিং হয়ে গেলে সে আরেক আনন্দ, সবাই মিলে তখন গল্প করে, গান গায়। যেহেতু, নিজের নিজের আলাদা জগৎ ছিল না ওদের, বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো; তাই শুধুমাত্র পাড়ার মানুষদের নিয়ে নিজস্ব স্পোর্টস্ হতো, শীতের সময় ব্যাডমিন্টন খেলা, পিকনিক হতো, দোলের উৎসব হতো, সে ও আবার শুধু দিনে নয় রাতেও। রবীন্দ্র-নজরুল সন্ধ্যা হতো, পাড়ার জন্মদিন, বসন্ত উৎসব, পুজোর সময়ে গণভোজ কতো কী যে হতো সবাই মিলে। না, সেখানে যে শুধুই আনন্দ ছিল তা নয়, ঝগড়াও ছিল। তবু মনেহয় সে বড়ো ভালো ছিল, কোনো মানুষ নিজেকে একা ভাববার সময় সুযোগ কোনোটাই বুঝি পেত না।

তাদের এলাকার জল লবণাক্ত, সে এমন নুন যে লোকে হাসাহাসি করত সেই জল খেয়ে। রুনুদের কতো রকম প্রচেষ্টা চলত জলের নুন কম করবার। ঘরবাড়ির দ্রুত ক্ষয় হতো সেই লবণাক্ত পরিবেশে। কাজেই, লোহার গ্রিলের যত্ন নিত রুনুরা নিজেরাই। শিরিষ কাগজ দিয়ে ঘষে তারপর রঙের কৌটো থেকে গাঢ় রঙ নিত, তাতে মেশাত তার্পিন তেল। অন্য একটা পাত্রে মিশিয়ে সেই পাতলা করা রঙে ন্যাকড়া ডুবিয়ে রঙ করত গ্রিল। 

কতো বছর হয়ে গেল রুনু বিয়ে হয়ে, বাড়ি ছাড়া, পাড়া ছাড়া। আজ তাদের সেই খোলামেলা পরিবেশ জমজমাট হয়ে উঠেছে। যে সাতাশ বিঘা জমিতে উডল্যান্ডস হবার কথা ছিল, সেখানে হয়েছে বিশাল এক হাসপাতাল। যেদিকে তাকালে ধানক্ষেতের ওই পাড়ে সূর্যোদয় দেখা যেত, সেখানে মাথা তুলেছে বিশাল কটা বহুতল আবাসন। কাঁচামাটির রাস্তাগুলো পাকা হতেই ই এম বাইপাস থেকে গড়িয়া স্টেশনের দিকে যাওয়ার শর্টকাট হয়ে, গাড়ি চলাচল বেড়েগেছে। সবার ঘরে টিভি, হাতে মোবাইল ফলে প্রত্যেকের নিজস্ব আলাদা জগৎ। জমজমাট আধুনিকতায় মুড়ে গেছে সারল্য। সেই বাড়ি, আজ বয়সের ভারে বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে রুনুর দাদার কাছে। পুরোনো বাড়িকে সেভাবে পরিচর্যা না করতে পারলে যা হয়। কাজেই বিক্রি করে দিলেই হ্যাপার মুক্তি। রুনু তাই শেষবারের মতো বিদায় জানাতে এসেছে তার পরম আত্মীয়রূপী বাড়িকে। 

এতো বদলে যাওয়া পাড়ার পরিবেশ চোখ খোলা রাখলে সব অচেনা, নিজেকে খাপ খাওয়াতে কেমন অসুবিধে হয় রুনুর। তবু আজও রুনু চোখ বুজলে অনুভব করে, প্রথম বৃষ্টির পর মাটি থেকে আসা গন্ধ, উদ্দাম বৃষ্টিতে ভেজা, শিশিরে ভেজা ঘাসে পা ডোবানোর অনুভূতি কিম্বা শীতের হাওয়ায় ভেসে বেড়ানো সন্ধ্যের ধুনোর গন্ধ। 


মৈত্রেয়ী চক্রবর্