পারমিতা চক্রবর্ত্তী - বৃদ্ধাশ্রম কি সত্যই বৃদ্ধ - আশ্রম

বৃদ্ধশ্রম (বৃদ্ধাশ্রম নয়) নিয়ে কিছু কথা লিখতে হবে ভাবিনি কিন্তু এই দায় থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখতে পারলাম না ৷ পাশ্চাত্য উন্নয়নশীল দেশগুলিতে শিশুশ্রম নিয়ে এত সোচ্চার কিন্তু বৃদ্ধাশ্রম নিয়ে তারা এত নীরব কেন? জাতিসংঘ, ইউনেস্কো বা ইউএনডিপি, যাই বলুন বৃদ্ধাশ্রমের বিপক্ষে কি তাদের কোনো প্রচারণা অাছে? সহজ উত্তর সবার জানা এক্ষেত্রে তাদের অবস্থান ঠিক গিরগিটির মত। পাশ্চাত্যের দেশসমূহে ভঙ্গুর পরিবারপ্রথা, পিতৃপরিচয়হীন প্রচুর সন্তান, মায়ের দ্বিতীয়/তৃতীয়/চতুর্থ .... বিয়ে। এসব নানাবিধ অসঙ্গতিপূর্ণ অবস্থা পশ্চিমা ও ইউরোপীয় দেশসমূহে দেখা যায়। ফলসরূপ সেখানকার বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা খুব কম ক্ষেত্রেই পারিবারিক বন্ধনের উষ্ণতা পায়। খুব অবাঞ্ছিত, কষ্টকর, মমতাহীন ও নিঃসঙ্গ জীবন সেসব মানুষদের ৷ একা একা তাদের নিজেদের কাজ নিজেদের করতে হয় শরীর/মন না চাইলেও। ছেলেমেয়েরা থাকে শহরের এক বা অন্যপ্রান্তে। বার্থডে, খ্রিস্টমাসে কার্ড পাঠিয়ে উইশ করে তাদের দায়িত্ব শেষ। 
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~


বৃদ্ধাশ্রম কি সত্যই বৃদ্ধ - আশ্রম
পারমিতা চক্রবর্ত্তী


ছেলে আমার মস্ত মানুষ, মস্ত অফিসার/ মস্ত ফ্ল্যাটে যায় না দেখা এপার-ওপার/ নানান রকম জিনিস আর আসবাব দামি দামি/ সবচেয়ে কম দামি ছিলাম একমাত্র আমি/ ছেলের আমার, আমার প্রতি অগাধ সম্ভ্রম/ আমার ঠিকানা তাই বৃদ্ধাশ্রম।নচিকেতার এই গানটিতে  সমাজ জীবনে এক প্রবল আলোড়ন ফেলেছিল ৷ বৃদ্ধাশ্রম অর্থাৎ বৃদ্ধদের আশ্রয়স্থল ৷ নিঃসঙ্গতার অপর নাম বলা চলে ৷

Loneliness is a long, unbearable pain….There was never a place for me in the scheme of things….I had become a living fantasy on a theme in dark, endless dirges….I made another world, and real men would enter it and they would never really get hurt at all in the vivid, unreal laws of the dream. I caused dreams which caused death. This is my crime.

—Dennis Nilsen


একসময় সহায সম্বলহীন মানুষদের পাড়ার লোকেরা চাঁদা তুলে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসত ৷ যৌথপরিবার সমাজব্যবস্থায় বৃদ্ধরা গয়া, কাশী তীর্থ করতে যেতেন ৷ তখন বলা হত অসুবিধায় পড়লে তেমাথার কাছে যাও ; একটা সমাধান নিশ্চয় পাবে ৷ বৃদ্ধ বাবা, মা ছিলেন সংসার তথা সমাজের অবলম্বন ৷


 ধীরে ধীরে যৌথ ভেঙে নিউক্লিয়ার হয়েছে আর বৃদ্ধ মানুষের জায়গা কমে গেছে ৷ আমি যতটুকু জানি, পৃথিবীর প্রথম বৃদ্ধাশ্রম প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল প্রাচীন চীনে। ঘরছাড়া অসহায় বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের জন্য আশ্রয়কেন্দ্রের এই উদ্যোগ ছিল শান রাজবংশের। খ্রিষ্টপূর্ব ২২০০ শতকে পরিবার থেকে বিতাড়িত বৃদ্ধদের জন্য আলাদা এই আশ্রয়কেন্দ্র তৈরি করে ইতিহাসে আলাদা জায়গাই দখল করে নিয়েছে এই শান রাজবংশ। পৃথিবীর প্রথম প্রতিষ্ঠিত সেই বৃদ্ধাশ্রমে ছিল বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের আরাম-আয়েশের সবরকম ব্যবস্থাই। ছিল খাদ্য ও বিনোদন ব্যবস্থা।

এখন সেই বৃদ্ধাশ্রমে বৃদ্ধদের প্রবেশ ঘটেছে সর্বোতভাবে ৷ সারাজীবন কর্মক্ষম বাবা, মা'র আশ্রয়টুকু বিপন্ন ৷ যদি অতীতে ফিরে যাই তবে দেখতে পাব কী  অপরিসীম পরিশ্রম করে একজন কর্তাকে  তার সংসারকে টিকিয়ে রাখতে হত। সংসার বলতে তখন শুধু ছেলেমেয়ে বোঝাত না, সংসার ছিল কাকা, পিসি, খুড়ো, জ্যাঠা, কাকিমা, মাসিমা বিস্তর হয়ত সংসারে উপার্জনক্ষম মানুষ থাকত একজন ৷ অার সংসারের গিন্নীকে নিজের স্বাদ, আহ্লাদ এমনকি নিজের মুখের গ্রাসটুকু অক্লেশে ছেড়ে দিতে দেখা গেছে ৷ এই ছিল সামাজিক পরিকাঠামো সেই সংসারের কর্তাকে একে একে বিদায় দেয় সবাই ৷ পড়ে থাকে তার ঔরসজাত সন্তানগণ ৷ সেখানেও নিউক্লিয়ার ৷ ছেলেমেয়েরা বাবা-মাকে বিভক্ত করে ৷ অন্দরমহলের পরিচয় তখন সামাজিক হয়ে ওঠে ৷ জীবনের শেষ প্রান্তে এসে  বাবা-মাকে ছাড়া থাকতে অরাজী হন ৷ তখন বৃদ্ধাশ্রমের দুয়ার এদের জন্য খুলে যায় ৷

সন্তান ভুলে যায় বাবা, মা তারাও হবে একদিন ৷ ছোট হতে হতে ঘরের চার দেওয়াল আরও ছোট হয়ে যায় ৷ একদিন চকচকে আসবার পুরানো হয় এবং ঘুণ ধরে, পরিত্যক্ত হয়, তারপর বিক্রি হয় ৷ এখানে মূল্যবোধগুলো তেমনই ঠিক ক্রমশ অপভ্রংশ হয়ে যাচ্ছে ৷ ঠাকুমা, ঠাকুরদা এখনকার প্রজন্ম চিনছে না ৷ ক্রেশে বড় হয়ে উঠছে এখনকার প্রজন্ম ৷ তাদের মূল্যবোধগুলো যান্ত্রিক হয়ে পড়ছে ৷ বাবা-মা'র বাইরে পরিবার বলতে কিছু চিনছে না ৷ কিন্তু এই অবক্ষয় থেকে রোধ করা সম্ভব নয় ৷ সন্তান বাবা-মাকে  খুন করছে, বা বাবা-মার সম্পত্তি বাহুবলে নিজের নামে লিখিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া হচ্ছে ৷ বর্তমানে নিজের প্রাণের অর্থাৎ বেঁচে থাকার তাগিদে বহু বাবা-মাকে আদালতের দারস্থ হতে হচ্ছে ৷ কোর্টের রায় বাবা-মা'র পক্ষে গেলে বাড়ি বৃদ্ধাশ্রম হয়ে উঠছে

এখন প্রশ্ন হল কেন এই রেচনক্রিয়া রন্ধ্রে রন্ধ্রে শুরু হয়েছে ৷ সন্তানকে পালন করতে আমাদের ফাঁক থেকে যাচ্ছে ৷ পাশ্চত্য সংস্কৃতিকে আয়ত্ত করতে আমরা নিজেদের ঘরকে হারিয়ে ফেলছি ৷ ধন, প্রাণ নিঃশেষ করে একজন বাবা, মা সন্তানকে পালন করেছেন ৷ সেই সন্তান প্রতিষ্ঠা পাবার পর বাবা-মাকে ভুলে যাচ্ছে ৷ এর থেকে অরণ্যের জীবজন্তু অনেক একতাবদ্ধ ৷ নিজের মাকে ছেড়ে যাবার কথা ভাবতেও পারে না ৷ বিশ্বায়ন হচ্ছে ! ইন্টারনেট, প্রিন্ট মিডিয়ার মাধ্যমে গোটা পৃথিবী হাতে মুঠোয় ৷ আর কুঁড়ে কুঁড়ে বেড়ে উঠছে অমানবিকতা অসহায় বৃদ্ধ মরে পড়ে থাকছে ফাঁকা ফ্লাটে কিংবা পাশের ঘরে থেকেও বাবা-মা'র শেষ সময়ে পাশে থাকতে পারছে না সন্তান ৷ সভ্য হচ্ছি আমরা ! সভ্যতা এগিয়ে চলছে ...

তবে বৃদ্ধাশ্রম মানে শুধু নিরবিছিন্ন হাহাকার ! তা ঠিক নয় ৷ একসাথে বহু মানুষের বেঁচে থাকার অঙ্গীকার সময়ের শেষ প্রান্তে এসে বহু বৃদ্ধ ও বৃদ্ধা নিজেকে আবিষ্কার করেন ৷ বিভিন্ন সামাজিক কাজ, হাতের কাজের মধ্যে নিজেদের অবসরকে ভাগ করে চলেছেন ৷ তবে কোনো বৃদ্ধাশ্রম কখনোই কোনো বৃদ্ধ বা বৃদ্ধার শেষ ঠিকানা হতে পারে না ৷ যে সময় মানুষ দ্বিতীয় শৈশবে পদার্পণ করে সেই সময়ে অসহয়তা কাম্য নয় ৷ বৃদ্ধ বয়সে মনের কোমলতা বেড়ে যায় ...

এখন বৃদ্ধাশ্রম শব্দটির মধ্যে কোনো না কোনোভাবে লুকিয়ে থাকে অসহিষ্ণুতা ৷ যদি আমরা প্রাথমিকভাবে চিন্তা করি তাহলে দেখব এর কেন্দ্রবিন্দুতে দাঁড়িয়ে মাত্রাতিরিক্ত চাহিদা ৷ একজন বাবা বা মা সর্বস্ব দিয়ে ছেলেকে গড়ে তোলে ৷ পরিবর্তে বেড়ে ওঠে প্রত্যাশা ৷ ছেলে বড় হয়, কারোর সহমর্মী হয় ৷ তখনই শুরু হয় দোলাচল ৷ ছেলের বউ আর মা'র ছেলেকে কেন্দ্র করে নামহীন যুদ্ধ ৷ একটু সময়, সহনশীলতা কারোরই মধ্যে দেখা দেয় না ৷ বিন্দু বিন্দু করে ক্রোধ, অসহিষ্ণুতা দেওয়াল তুলে দেয় সম্পর্কের মাঝে একদিকে স্ত্রী অন্যদিকে বাবা অথবা মা ৷ এই সবের মাঝে সন্তানটি হারায় তার জীবনের ভালোবাসার মানুষগুলো ৷

Yes, there is joy, fulfillment and companionship—but the loneliness of the soul in its appalling self-consciousness is horrible and overpowering.

—Sylvia Plath

সংসারের নতুন মানুষ যে বা যার হাত ধরে পরিবারে প্রবেশ করে সেই মানুষটিকে কোনো না কোনো সময় তার একার কথা ভাবতে শুরু করে ৷ অধিকারবোধের লড়াইতে সে একা জিততে চায়। তখনই শুরু ছলনা, প্রতারণা ৷ বৃদ্ধ বা বৃদ্ধা মানুষটি সংসারের চক্ষুশূল হয়ে ওঠে ৷ আর তারা এতদিন তিল তিল করে গড়ে তোলা সংসারের আচার্য পদ ছাড়তে নারাজ ৷ এই অলিখিত যুদ্ধের করুণ পরিণতি হল বৃদ্ধাশ্রম ৷ টাকার বিনিময়ে দায়িত্ব, কর্তব্য পরিত্যাগের অপর নাম বৃদ্ধাশ্রম বলা চলে ৷

"It is better to lead from behind and to put others in front, especially when you celebrate victory when nice things occur . You take the front line when there is danger . Then people will appreciate your leadership ."
~ Nelson Mandela

বৃদ্ধ মানে বর্জ্য, সেই মানসিকতার পরিবর্তন অনেকটাই হয়েছে ৷ এক-দু'দশক আগেও আমাদের দেশে বৃদ্ধাশ্রম তেমন একটা ছিল না। সময়ের সাথে সাথে এর সংখ্যা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু কেন এই বৃদ্ধাশ্রম? এ প্রশ্নের উত্তর বড়ই করুণ। যে সন্তান বাবা-মাকে ছাড়া এক মুহূর্ত থাকতে পারত না, মা-বাবাই ছিল যার সারাজীবনের আশ্রয়স্থল, সে কিনা আজ বাবা-মাকে নিজের কাছে রাখার প্রয়োজন বোধ করছে না, বাবা-মাকে ঝামেলা মনে করছে। তাঁদেরকে রেখে আসছেন বৃদ্ধাশ্রমে। অথবা অবহেলা ও দুর্ব্যবহার করে এমন অবস্থার সৃষ্টি করছে যেন তারা নিজেরাই ভিন্ন কোনো ঠাঁই খুঁজে নেন। অনেকের ভাব এমন, টাকাপয়সার অভাব না থাকলেও বাবা-মাকে দেওয়ার মত সময়ের তাদের অভাব আছে। তাদের সঙ্গে কথা বলার মতো পর্যাপ্ত সময় তাদের নেই। তাই বাবা-মা একা নির্জনে থাকার চেয়ে বৃদ্ধাশ্রমে অন্যদের সঙ্গে কাটানোই নাকি ভালো মনে হয়। এই ধারণা এখন বহু  মধ্যবিত্ত পরিবারের রন্ধ্রে, রন্ধ্রে ধাবমান। নানা অজুহাতে বাবা-মাকে দূরে সরিয়ে রেখে সন্তান যে খুব ভাল আছে এমন কিন্তু নয় একাকিত্বের দোড়গড়ায় দাঁড়িয়ে বহু সন্তান আত্মহত্যা করছে ৷ স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক ভেঙে যাচ্ছে ৷ স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সম্পর্কের দৃঢ়তা কমে যাচ্ছে ৷ বাবা-মাকে বাদ দিয়ে একা থাকতে গিয়ে একাকিত্বের দোসর হয়ে পড়ছে৷

একসময় যারা প্রখ্যাত বুদ্ধিজীবী, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, শিক্ষক ও চাকরিজীবী অর্থাৎ যাদের  উচ্চমধ্যবিত্ত শ্রেণী বোঝাত, তাঁরা বৃদ্ধ বয়সে এসে নিজ সন্তানদের অবহেলা ও বঞ্চনার শিকার হয়েছেন ৷ বহু পিতা-মাতা এখন বৃদ্ধাশ্রমের স্থায়ী বাসিন্দা হতে বাধ্য হচ্ছেন। পরিবার ও সন্তান থেকেওসন্তানহারা' হয়ে জীবনযাপন করছেন।  পত্রিকা, সংবাদপত্রের পাতায় নজর বোলালেই এর প্রমাণ পাই বিভিন্ন সময়ই বৃদ্ধাশ্রম থেকে সন্তানের কাছে লেখা বৃদ্ধ পিতা-মাতার চিঠি পত্রিকায় ছাপা হয়। যা পড়ে নিজেদের বৃদ্ধ হতে ইচ্ছা করে না ৷

আমরা যারা বৃদ্ধ পিতা-মাতাকে অবহেলা করছি, তাদেরকে বোঝা/ দায়  মনে করছি, বৃদ্ধাশ্রমে তাদের ফেলে রেখেছি, তারা কি কখনো ভেবে দেখেছি, আজ তারা বৃদ্ধ, কাল আমরাও সেই পথ বেয়ে হেঁটে যাব বৃদ্ধ হয়ে পৃথিবীতে কেউ  আসে না তাঁরা তো পরিবারের বোঝা ছিলেন না। বরং আমরা সন্তানরাই তো তাদেরবোঝা' ছিলাম। তারা তো কখনো আমাদেরকে বোঝা মনে করেননি। আমাদেরকে বড় করে তোলার জন্য তাঁরা বিন্দু পরিমাণ কমতি করেননি।

মা আমাদের জন্য কতই না কষ্ট করেছেন। গর্ভধারণের কষ্ট। প্রসবের কষ্ট। স্তন্যদানের কষ্ট। রাতের পর রাত নির্ঘুম কাটিয়ে দেয়ার কষ্ট। এ তো প্রাথমিক কষ্ট। এরপর প্রাপ্তবয়স্ক হওয়া পর্যন্ত মা আমাদের জন্য কষ্ট করেছেন, এর কোনো হিসেব আছে বলে মনে হয় না কোনো  সন্তান নিজের উদ্যোগে বাবা/মাকে বৃদ্ধাশ্রমে দিয়ে আসেন ৷ তারপর আর কোনো খোঁজ-খবরও রাখেন না, কোনো  আনন্দ-উৎসবেও তাঁদের একনজর দেখার সময় হয় না, এমনকি মৃত্যুর সংবাদ পেলেও এই বাবা/মায়ের লাশ দেখতে বা নিতেও আসে না। আমরা নাকি সভ্য জাতি ৷ আমরা আমাদের যোগ্য উত্তরসূরী রেখে যাব ৷

কেন আমরা ভুলে যাই, দীর্ঘ জীবন পেলে বার্ধক্যের স্বাদ আমাদের সবাইকে পেতে হবে, এটাই জীবনের ধর্ম। তাই বৃদ্ধাশ্রম নয়, জন্ম হতে মৃত্যু পযর্ন্ত পরিবারই হোক আমাদের সবার একমাত্র ঠিকানা আর বৃদ্ধ বাবা-মা আমাদের সবার সাথে হাসি-খুশি, আনন্দে তাদের জীবনের শেষ দিন পযর্ন্ত কাটবে এটা সুনিশ্চিত করতে হবে ৷

বৃদ্ধশ্রম (বৃদ্ধাশ্রম নয়) নিয়ে কিছু কথা লিখতে হবে ভাবিনি কিন্তু এই দায় থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখতে পারলাম না ৷ পাশ্চাত্য উন্নয়নশীল দেশগুলিতে শিশুশ্রম নিয়ে এত সোচ্চার কিন্তু বৃদ্ধাশ্রম নিয়ে তারা এত নীরব কেন? জাতিসংঘ, ইউনেস্কো বা ইউএনডিপি, যাই বলুন বৃদ্ধাশ্রমের বিপক্ষে কি তাদের কোনো প্রচারণা অাছে? সহজ উত্তর সবার জানা এক্ষেত্রে তাদের অবস্থান ঠিক গিরগিটির মত। পাশ্চাত্যের দেশসমূহে ভঙ্গুর পরিবারপ্রথা, পিতৃপরিচয়হীন প্রচুর সন্তান, মায়ের দ্বিতীয়/তৃতীয়/চতুর্থ .... বিয়ে। এসব নানাবিধ অসঙ্গতিপূর্ণ অবস্থা পশ্চিমা ও ইউরোপীয় দেশসমূহে দেখা যায়। ফলসরূপ সেখানকার বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা খুব কম ক্ষেত্রেই পারিবারিক বন্ধনের উষ্ণতা পায়। খুব অবাঞ্ছিত, কষ্টকর, মমতাহীন ও নিঃসঙ্গ জীবন সেসব মানুষদের ৷ একা একা তাদের নিজেদের কাজ নিজেদের করতে হয় শরীর/মন না চাইলেও। ছেলেমেয়েরা থাকে শহরের এক বা অন্যপ্রান্তে। বার্থডে, খ্রিস্টমাসে কার্ড পাঠিয়ে উইশ করে তাদের দায়িত্ব শেষ। এভাবে একসময় অনেকে নিঃসঙ্গ অবস্থায় বাসায় মৃত্যুবরণ করেন। লাশ পচে দুর্গন্ধ বেরলে প্রতিবেশীরা পুলিশে খবর দেয়, অনেক সময় সেসব লাশ বিশাল ফ্ল্যাটে শুঁটকি হয়ে যায়। বিত্ত ঐশ্বর্যের অভাব না থাকলেও সেখানে যে জিনিসটির বড়ই অভাব সেটি হল ভালোবাসা, মমতা।

আমাদের  সমাজ  ভালোবাসা, মমতায়পূর্ণ সুন্দর পরিবারপ্রথা দেখতে অভ্যস্ত ৷ পাশ্চাত্যের মানুষ ঈর্ষা করেন আমাদের পরিবারতন্ত্র দেখে এটা ভাঙতে পাশ্চাত্য দেশগুলো  কি না করছে ! এইডস সচেতনতার নামে অবৈধ যৌনাচারকে উস্কে দেয়া হচ্ছে, বিয়ে বহির্ভূত লিভ টুগেদারকে উৎসাহিত করা হচ্ছে, পতিতাবৃত্তিকে সমাজে সহনীয় করার জন্য পতিতাদের আদুরে নাম দেওয়া হয়েছে যৌনকর্মী। সমাজকে ভেঙে টুকরো টুকরো করা হচ্ছে ৷ যদিও ব্যক্তিগতভাবে লিভ টুগেদার অবৈধ নয় বলে আমি মনে করি ৷ কিন্তু পাশ্চাত্যকে অনুসরণ করতে ঘর খালি হয়ে যাচ্ছে ৷  অন্য কথায় চলে যাচ্ছি নির্মম নিষ্ঠুর বৃদ্ধাশ্রমের বিরুদ্ধে পাশ্চাত্যের কোনো মাথাব্যথা থাকার কথা নয়, কারণ তাদের সমাজব্যবস্থার ভিত্তি এমনই ৷

কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে- বৃদ্ধাশ্রমসমূহ দরিদ্র পরিবারের নয়, ধনী ও অভিজাত পরিবারের বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের সংখ্যাই বেশি। এর কারণ নিশ্চয়ই আমাদের অজানা নয়। এর দায় সেই সব বৃদ্ধ-বৃদ্ধারাও এড়াতে পারেন না। সন্তানদের তাঁরা সুশিক্ষা দিতে ব্যর্থ হয়েছেন। পরিণামে তাঁদের সন্তানরা অর্থ বিত্ত ও আভিজাত্য অর্জন করলেও মনুষত্ব অর্জন করতে পারেনি। শেষে বলি বৃদ্ধাশ্রম যেন কারোর ঠিকানা না হয় ৷বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের সম্মান করি, বাবা-মায়ের প্রতি অর্পিত দায়িত্ব পালন করি।

পারমিতা চক্রবর্ত্তী