শুভব্রত দাশগুপ্ত - প্রফেশনালিজম

মার কাছে থেকে ১০০টা টাকা ম্যানেজ করে বেরিয়ে পড়লাম। ব্যাঙ্কশাল কোর্টের সামনে এক শীর্ণ-বৃদ্ধ টাইপিস্ট মোটা চশমা সামলে এক-এক করে চারখানা Biodata খটাখট-খটাখট শব্দে বানিয়ে হাতেহাতে ধরিয়ে দিতে লাগলেন। আমারটা চোখের সামনে ধরতে, এক অভাবনীয় অনুভূতি আমাকে আচ্ছন্ন করল। ছাপার অক্ষরে নিজের নাম - অনুপম ভাদুড়িপ্রথমবার দেখতে-দেখতে স্বরন করতে লাগলাম – Professionalism show করতে হবে!! হাঁটতে হাঁটতে ধর্মতলাতে এসে প্রথমবার বিফ-রোলেরস্বাদ পেলাম বাবু ভুরু নাচিয়ে বলল, ‘সব শিখতে হয়!!জিতু আর্তনাদ করে ওঠে, আমরা চমকে তাকাই, Biodataতে রোলের তেল গড়িয়ে এসে লেগেছে। মুখটা বিশ্রী করে বাবু বলে, ‘শালা! বলদ একটা!! নে, যা আবার টাইপ করে আন আমরা আর যাচ্ছি না!!~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~‍‍‍~


প্রফেশনালিজম
শুভব্রত দাশগুপ্ত

শব্দটার মানে কখনই বুঝিনি। যখন সদ্য কলেজ ছেড়ে চাকরির আশায় রাস্তায় বেরোলাম, প্রথমবার শুনলাম শব্দটা, বাব্লুকাকার কাছে। Biodata কি ভাবে লেখা হবে জানতে বাবাই পাঠিয়েছিলেন পাড়ায় বাব্লুকাকার কাছে। টাটাতে বড় কাজ করেন বাব্লুকাকা, জানতাম
পলটু Biodata কোন মাজাকি ব্যাপার নয়। কাকে লিখবি? কেন সে তোর Biodata পড়বে? জানিস কি??’
চিন্তায় পড়ে গেলাম, এতসব তো ভাবিনি?
তোকেই বা চাকরিতে নেবে কেন? ভেবেছিস কখনো?’ বাব্লুকাকার পাজামায় গিঁট পেকে গেছে, সম্পূর্ণ মন এখন সেদিকেই।
আমি বাবাকে জোর গলায় শুনিয়ে এসেছি, ‘যাই হোক, ওই তোমাদের সরকারী আপিসের কেরানী হতে পারবো না! Corporateএ ভাল চাকরি করব।বাবা বেশী কথার মানুষ নন, ‘যা তাহলে, বাব্লুই বলতে পারবে ওসব বড়-বড় ব্যাপার আমি বুঝিনা!!২৮ বছর ধরে সরকারী দপ্তরে মাথা গুঁজে কাজ করছেন বাবা, শখ বলতে, একাডেমীতে নাটক দেখা আর ৩-৪টি বাল্যবন্ধু এখনও টিকে আছে, তাদের সাথেই মাঝেমধ্যে দেখাসাক্ষাত, আড্ডা।
এদেশে কত-লক্ষ বেকার আছে, জানিস কি?’ পাজামা বাগে এসেছে এতক্ষণে। আমিও মন দেওয়ার চেষ্টা করি।
কটা graduate – কটা masters – কটা MBA – doctorate চাকরির চেষ্টায় ঘুরে বেড়াচ্ছে, খোঁজ রাখিস??’  আমি বোবা হয়ে তাকিয়ে থাকি। এতসব না জেনে চলে এসে খুব অপরাধী মনে হতে লাগলো নিজেকে,
তাহলে কি... চাকরি হবে না??’
‘Professionalism show করতে হবে এই আমাদের মত কোম্পানি-তে যে-সে এলো আর চাকরী হয়ে গেলসেটি হবার নয়!বাব্লুকাকা চোখটা ছোট করে মিচকি-মিচকি হাসতে লাগলেন, ‘একটা draft করে আন, দেখেশুনে final করে দেবখন…’
বাবাকে ফিরে এসে জিজ্ঞাসা করে ফেললাম, ‘বাবা ! Professionalism কাকে বলে?’
বাবা সবে বাংলা সংবাদটা শেষ হতে টিভি বন্ধ করেছেন, ‘অ্যা !!মুখটা বিদঘুটে করে উল্টে আমাকেই জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কোতা থেকে শুনে আসিস এসব ঝকমারি শব্দ??’
বাব্লুকাকা বলে দিলেন... Professionalism ছাড়া চাকরী মিলবে না !
নাও ঠ্যালা সামলাও, সেটা শিখতে আবার খরচ করো ! টিভির রিমোটটা বিরক্তি-সহ পাশের টেবিলে রেখে তাকালেন,
বলে দিলাম, যাই করো অল্প টাকা হলে হবে, নয়তো...!
আমি মুখ গোঁজ করে জামা খুলতে লাগলাম, বাবা আড় চোখে তাকিয়ে বললেন, ‘সরকারী চাকরী সহজ সরল ব্যাপার। ওসব সাহেবি কায়দা তো... এখন খোঁজো Professionalism কে শেখায় !
বন্ধুরা সটান শুনিয়ে দিল Professionalism নামক কোন কিছু শোনেইনি তারা। দুটোদিন ঘরের কোনায় গুম-মেরে বসে কাটিয়ে দিলাম। ডিকশনারি খুলে মানে যা বেরোল, তা আরও জটিল আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম, বাব্লুকাকার কাছে যাওয়ার কথা মাথা থেকে সরিয়ে দিলাম।
দু-তিনদিন বাদে মিলন, বাবু আর জিতু সন্ধ্যাবেলা হাজির, ‘Biodata বানাবি? লোকের খোঁজ পেয়েছি !!
আমি উঠে বসলাম, ‘কোথায়?’
ডালহৌসিতে, কোর্ট চিনিস তো? একটা বুড়ো টাইপিস্ট আছে। সকাল-সকাল যেতে বলেছে –‘
মার কাছে থেকে ১০০টা টাকা ম্যানেজ করে বেরিয়ে পড়লাম। ব্যাঙ্কশাল কোর্টের সামনে এক শীর্ণ-বৃদ্ধ টাইপিস্ট মোটা চশমা সামলে এক-এক করে চারখানা Biodata খটাখট-খটাখট শব্দে বানিয়ে হাতেহাতে ধরিয়ে দিতে লাগলেন। আমারটা চোখের সামনে ধরতে, এক অভাবনীয় অনুভূতি আমাকে আচ্ছন্ন করল। ছাপার অক্ষরে নিজের নাম - অনুপম ভাদুড়িপ্রথমবার দেখতে-দেখতে স্বরন করতে লাগলাম – Professionalism show করতে হবে!! হাঁটতে হাঁটতে ধর্মতলাতে এসে প্রথমবার বিফ-রোলেরস্বাদ পেলাম বাবু ভুরু নাচিয়ে বলল, ‘সব শিখতে হয়!!জিতু আর্তনাদ করে ওঠে, আমরা চমকে তাকাই, Biodataতে রোলের তেল গড়িয়ে এসে লেগেছে। মুখটা বিশ্রী করে বাবু বলে, ‘শালা! বলদ একটা!! নে, যা আবার টাইপ করে আন আমরা আর যাচ্ছি না!!
পনেরো-বিশখানা চিঠি ছাড়া হয়ে গিয়েছে, মাসদুয়েক মাঝে কেটেও গেছে, বন্ধুদের সাথে বসে ১টাকার চারমিনার ফুঁকতে-ফুঁকতে বলেই ফেললাম, ‘বাবা বলেছে নেশা করতে গেলে নিজের পয়সায় খেতে!
জিতু একটু ঘটা করেই বলল, ‘একটা টুইশানি ধরেছি। মাস গেলে ৩৫০!!
আমরা এই মারি-কি সেই মারি, ‘শালা! গদ্দার !!
বাড়ি ফিরে এসে সার্ট খুলতেখুলতে মা এসে দাঁড়ালেন, ‘তোর একটা চিঠি এসেছে –‘
আমার হার্টবিট বন্ধ হবার দাখিল এতো ইন্তারভ্যু লেটার !!! সারা পাড়া নেচে বেড়ালাম ধরেই নিয়েছি, চাকরী আমি পেয়ে গিয়েছি! বন্ধুরা লিস্ট করে ফেলেছে গোটা প্যাকেট ফীলটার উইলস, যমুনাতে ব্রুস-লির বই, আর অনাদিতে কষা-মাংস, মোগলাই খাওয়াতে হবে।
হপ্তাখানেক বাদে ইন্তারভ্যু, মা সকাল-সকাল পুজো দিয়ে কপালে দইয়ের ফোঁটা দিয়ে বলেছেন, ‘মাথা ঠাণ্ডা রাখিস কিন্তু!’   অবাক করে দিয়ে বাবা বললেন, ‘টাই পড়ে নিস, বিছানায় ইস্তিরি করে রেখেছি!
বাবার কাছে টাই? আমি অবাক হয়ে ভাবি। পরে জেনেছিলাম, বিয়েতে বাবাকে স্যুট দিয়েছিল দাদু, একবারই সে সব পড়েছিল। আলমারির কোনা থেকে আমার জন্য বের করে দিয়েছিল সেদিন।
লেনিন সরণির ঠিকানায় পৌঁছে আমি তো আঁতকে উঠি জনা ৮০আগেই পৌঁছে লাইন দিয়েছে। নাম লিখিয়ে, লাইনে আমিও জায়গা নিলাম। বেলা-বাড়ার সাথেসাথে লাইন সিঁড়ি ছাড়িয়ে ফুটপাথে পৌঁছেছে। সকালের সাজগোজ ধীরে ধীরে ম্লান হতে লাগল। রুঢ় সত্যর সাথে প্রথম মোলাকাত বেশ ক্লেশপূর্ণ হল। বেলা ৩টে নাগাদ দরজার সামনে পৌঁছলাম। ইন্তারভ্যু কি যে হল এখন আর স্মৃতিতে নেই। তবে, ভাগ্য আমাকে বেশী দোলা দেয়নি, মাস-দুয়েকের পরেই প্রথম চাকরী জুটল। ম্যানেজার ছিলেন মিঃ গুপ্ত, ‘শুনুন ভায়া বয়েস কম, টিকে থাকতে হলে Professional হতে হবে!!এই আমার দ্বিতীয় দফার Professional শব্দের সাথে যোগাযোগ। কিন্তু, সেটা হতে গেলে কি কি করতে হবে, সেটার নাগাল, না তিনি দিলেন, না আমি বুঝে উঠতে পারলাম। তানানানা করে বছর দুয়েক কেটে গেল সেখানে; কপালগুনে মাইনেটাও বেড়ে দেড়া হল, মা বেজায় খুশি। বাবাও আর সরকারী চাকরির কথা উচ্চারণ করেন না। তাঁর আর হাতে গুনে চার-বছর, মা আমাকে মাথায় হাত রেখে বোঝান, ‘এরপর তুইই ভরসা, দেখিস বাবা, ঝামেলা কিছু করিসনি !
আমি দাঁতে-দাঁত চিপে ওপরতলার নির্দেশ অক্ষরে-অক্ষরে মেনে চলি। এখন মিঃ গুপ্ত আর আমার ম্যানেজার নন, ওপরঅলার দয়ায় আমি তাঁরই সমান-সমান। আগে স্যারবলতাম তারপর থেকে অসোয়াস্তিতে 3rd personএ  কথা সারতাম। কোম্পানির বড়-কর্তা মিঃ শেঠি তারপর থেকে আমাকে একটু বেশীই স্নেহ করতে লাগলেন মাস ছয়েকের মাথায় শুনলাম মিঃ গুপ্তর চাকরী নাকি গেছে... শুনলাম, Professionalismএর অভাব ছিল। আমি ধাক্কা খেলাম, Professionalism show করার কি কি পন্থা, আমার এক্ষুনি জেনে রাখা জরুরী।
জয়ন্ত, অমিতাভ, সুদীপ, নির্ঝর আমার সাথে কর্ম-সুত্রে বন্ধু; পিটার-ক্যাটে হুইস্কি পান করতে-করতে একই ইশারা দিলো, ‘উপায় নেই, আজকাল সবাই Professional, কেউ কারোর নয়!আমি কল্পনা করলাম তার মানে Professionalএর সাথে আত্মার সম্পর্ক অসম্ভব।
মাঝে ৯-১০টা বছর কেটে গেছে, আমি দুটো চাকরী ছেড়ে এখন ভারী-মাপের ম্যানেজার কোম্পানির হয়ে দেশের পূর্ব আর উত্তরের গোটা দশেক রাজ্যের দণ্ডমুণ্ডের মালিক। কম্প্যুটারে ২৫-৩০জনের কাজের লেখাজোখা হাতের মুঠোয়। বোতামের হেলনে গত দুমাসে দুজনের গর্দান নিয়েছি বিরক্তহয়ে। তারা মোটেই Professional নয়! পদে-পদে প্রমান হচ্ছিল। একটি আবার কাঁদকাঁদ হয়ে বলেছিল, ‘স্যার! আমাকে ২টো মাস টাইম দিন, ঠিক শুধরে নেব।আমাকে Professionalism show করতেই হচ্ছিল। পরে শুনেছিলাম ছেলেটা বড়রকম সমস্যায় পড়েছে – Personal Loan শোধ না করতে পারার জন্য সদ্য বিয়ে করা বউএর গয়েনা বিক্রি করে মাথা বাঁচিয়েছে। উপায় কি?
আমি ক্রমে ক্রমে বুঝে ফেলতে শুরু করেছি – Professional কাকে বলে। কারন এখন আমি নির্দয়, নির্মম আর অনাত্মীয়। এখন আমার আপন বলতে হাতে গোনা কেউ কেউতাতে আমি care করি কম।
রাস্তায় এর মধ্যে টোটোর সাথে দেখা, টোটো আমাদের পুরনো পাড়ার সেই বাব্লুকাকুর ছেলে। আমি ডাকলাম, ‘আরে টোটো না?’
বিরক্ত চোখে টোটো আমাকে দেখল কিন্তু বেশ বুঝলাম, চিনতে চাইল না। পরে বাবুর কাছে শুনলাম সে এখন অনিরুদ্ধ ধর, টোটো নয়। আমি শিখলাম Professionalism show করার আরেক পন্থা।
শ্রবণা, আমার সহ-ধর্মিণী, আমাকে প্রায়ই শোনায়, ‘তোমার এই দয়া-ধর্মগুলো বন্ধ রাখো। কথায়কথায় CRY আর UNICEF… পাঁচশো টাকা হাজার টাকা, ব্যাপারটা কি?‘
আমি বোঝানোর চেষ্টা করি, ‘ওগুলো status maintain করার জন্য করি ভারত সেবাশ্রমেতো আর দিই না!!
শ্রবণা, আমার চেয়ে অনেক বেশী Professional, অন্তত ছেলের মাস্টারদের ফী দেওয়ার সময় দেখে ভাবি আরও শেখা বাকি রয়ে গেল
বছরখানেক আগে, গৌতম কর্মকার আমাকে বিশেষ করে নিমন্ত্রন করে ডেকে পাঠান তাঁর অফিসে। গৌতমবাবু কলকাতার অন্যতম সেরা বাঙ্গালী ব্যাবসাদার। সামান্য ২০০টাকা সম্বল করে ঢাকা থেকে একবস্ত্রে পালিয়ে আসেন বছর-আটেক আগে। শিয়ালদা স্টেশনে যখন পা রাখেন তখন হাতে কেবল ৫০টাকা সেই অবস্থা থেকে কি করে তিনি আজ কোটিপতি সে-কথা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে শোনাতে ভালবাসেন; আর ভালবাসবেন তাতে আর আশ্চর্য কি! কজনই বা সে-কাজ করে দেখাতে পেরেছেন?
এই যে অনুপমবাবু! আমি আপনাকে অনেকদিনই খুঁজছি...... জানেন তো?’ বড় টেবিলের ওপারে কুঁজো হয়ে বসে দাঁত খোঁচাচ্ছেন গৌতমবাবু।
আমি একটু হোঁচট খেলাম, ‘আমাকে?’
হ্যাঁ ! অবাক হবেন না, পছন্দ হলে আমি নিজেই খুঁজি। আরে বসুন ! বসুন !গৌতমবাবু হেলান দিয়ে বসলেন।
আমিও বসলাম।
আমার সাথে কাজ করবেন?’ দাঁতখোঁচানিটা আঙ্গুলে নাড়াচাড়া করতে করতে তাকিয়ে আছেন।
আ-আজ্ঞে, আমি তো কাজ –‘ শেষ করতে দিলেন না।
সেসব জানি বলেই না ডেকে পাঠালাম! আপনি কাজের লোক, কাজ না করে তো বসে থাকবেন না!!
আমি স্তব্ধ হয়ে বসে থাকি। এমন ভাবে কথা আমার সাথে কেউ বলেনি আগে।
কত পান? ... দেখুন লজ্জা করবেন না। যেটা পান হাতে বলুন না?’
আমি টেবিলের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে শুকনো গলায় বললাম, “আজ্ঞে, মাসে ৩৫০০০!!
অভিনয়টা একেবারেই জানেন না বুঝলাম, ‘সেকি? ৩৫০০০? বলেন কি??’ চোখে কৌতুক।
আমার কথার-ধারটা মোটেই ভাল লাগছিল না।
টেবিলে পেপারওয়েটটা একপাক দিয়ে সোজাসুজি বললেন, ‘শুনুন ! ৬০০০০ পাবেন, পরের বছর থেকে ৭৫০০০, কোন প্রশ্ন তুলব না। চাইলে আরও বেশী পাবেন, পরশু জয়েন করুন।বেয়ারা চা নিয়ে ঢুকল, হাল্কা বোনচায়না কাপে সুগন্ধি দার্জিলিং টি। টেবিলে কাপটা রাখার পর, চায়ের ঢেউ দেখতে দেখতে একটু আনমনা হয়ে গিয়েছিলাম বোধহয়। টাকার পরিমাণটা প্রায় আমার দমবন্ধ করে দিয়েছিল...
গৌতমবাবু টেবিলে হাল্কা চাপড় দিয়ে তাকালেন, ‘শুধু একটা ব্যাপার বলে রাখি, আপনার সময় আমি কিনে নিলাম, সকাল ৯টা থেকে সন্ধ্যে ৯টা আমার সময়। ভাইফোঁটা, রবীন্দ্রসদন, নন্দন, মহালয়া ইত্যাদি ইত্যাদি আমার সাথে কাটবে বলতে পারবেন না, ছুটি চাই। Professional আমরা, ওসব ফন্দি-ফিকির আমাদের পছন্দ নয়। মোটা-মাল কামাবো আর …… হ্যাঁ, আমরা বছরে ছুটি কাটাই প্ল্যান করে ১০দিন। আমার এজেন্ট আছে, সেই সব ঠিকঠাক করে দেয় এবার শ্রীলংকা, মায়নামার, ফিলিপিন্স যাচ্ছি। আপনিও যাবেন – with family!!
পরের ৭টা দিন, আমি অফিসে বলে রেখেছিলাম গৌতম কর্মকার বা তাঁর সম্পর্কিত কেউ খুঁজলে যেন বলে দেওয়া হয় আমি ছুটিতে। তখনও মোবাইলফোন আসেনিতাই রক্ষে।
জিতু, মিলন আর বাবু এখনো আমার সাথে মেলামেশা করে ওটাই একমাত্র আমার বাল্যকালের সাথে সম্পর্ক। ওরা তেমন কিছু করে উঠতে পারেনি, তাই চকমিলানো বারে বসা যাচ্ছিল না। বারতিনেক ব্রডওয়ে হোটেলে কাঁচাশসা আর পাঁপড়ভাঁজা দিয়ে রাম খেয়েছিলাম কলেজের সময়টা যেন চোখের সামনে জ্বলজ্বল করছিল বাদ সাধল পুরনো অফিসের accountantসে ব্যাটা আমাকে ওখানে দেখে দাঁত বের করে হেঁসে দাঁড়ালো, ‘এখানে??’
আমি মিলন আর বাবুকে যদিবা বোঝাতে পারলাম, জিতু মানল না, ‘আমরা যেমন, তেমনই থাকবো, তোর অসুবিধা হলে আসিস না।
ব্যাটা আজও ছাত্রনেতার মেজাজটা হারায়নি। ২৫-৩০টা ছাত্র পড়ায়, আর পুরনো ভাড়াবাড়িতে ভাগের জল নিয়ে আজও মারামারি করে। মাসে একটাদিন সে যে ভাবেই হোক ব্রডওয়েতে পৌঁছে যায়। মিলন নিচুগলায় বলে, ‘জিতু এই ঠিকানাটাই চেনে। বদলানো যাবে না।
অতএব, জিতুকে বাদ রেখেই আমি বারকয়েক Bar BQতে আমারই খরচে মিলন আর বাবুকে নিয়ে বসলাম ওই সূত্রটা আমি ছাড়তে পারলাম না।
গতকাল কোম্পানির গুরগাও অফিসে review meeting ছিল, National Head – Sales & Distribution, শ্রীভুবন সিং আমার ৬মাসের খতিয়ান নিয়ে কটাক্ষ করতে কসুর করলেন না, ‘মিঃ ভাদুড়ি! আপনার সেন্টারে কোন growth নেই। কারন বলবেন?’
আমি ভাবনা-তর্ক-যুক্তি ব্যাবহার করতে-করতে কখন যেন কল্পনায় চক্রব্যূহের ভিতরে নিজেকে আবিস্কার করলাম।
সেই অমোঘ শব্দটি ঘুরে ঘুরে আমাকে পেঁচিয়ে ধরছে – ‘Mr Bhaduri, I fail to see your professionalism? How can you forget it so easily?’  সে মুহূর্তে মনে পড়ল কবে সেই ছেলেটা করুণ স্বরে বলেছিল -স্যার! আমাকে ২টো মাস টাইম দিন, ঠিক শুধরে নেব।আমিও যেন তারই মতো ছোট্ট হয়ে গেলাম আর আমার চারপাশে অনেকে ঘিরে ফেলতে লাগলো আমাকে আর আমি চিৎকার করতে গিয়ে বুঝলাম আমার গলা দিয়ে শব্দ বেরোচ্ছে না কিন্তু বলতে চাইছি স্যার! আমাকে টাইম দিন!! স্যার! আমাকে টাইম দিন!!...
শুনুন আপনাকে আমরা টাইম দিচ্ছি, পুরো ৬মাস, shape up!!’
আমি জানি, কথাটার পূর্ণ অর্থ কিহয় লাভের খাতায় সবুজের ছোঁয়া আনতে হবে নয়তো দরজা খোলা……
আজ আমি অফিসে যাইনি, না না, চাকরী আমি ছাড়িনি!!  তবে, শ্রবণা জানতে পারলে আমার সমস্যা বাড়বে বই কমবে না। বছরখানেক আগে কেনা কামালগাজিতে ১১৫০sqftএর ১০বছরের দায় এখন মাথায়চাকরী ছাড়লে হবে?

অনেকদিন পর ময়দানে এলাম ছোটবেলায় বাবার হাত ধরে অনেকবার এসেছি। জুতো খুলে খালিপায়ে এক পা এক পা করে হাঁটতে লাগলাম। ভেজা ঘাসের ছোঁয়া অনেকদিন বাদে শরীরে যেন প্রানের সঞ্চার করলো। গলা অবধি গ্লানি মনের মধ্যে তোলপাড় করে বেড়াচ্ছে। ইচ্ছে হচ্ছে সেগুলোকে শরীর থেকে টেনে বের করে নিজেকে হাল্কা করি, পারছিনা
বারবার আজ বাবাকে মনে পড়ছে বাবা সরকারী দফতরে ৩২বছর কাজ করে রিটায়ার করলেন যেদিন ফুলের তোড়া আর একবাক্স তালশাঁস সন্দেশ নিয়ে ফিরেছিলেন। মা তাতেই খুব খুশি হয়েছিলেন, ‘এতো মিষ্টি? বাঃ কি সুন্দর ফুলের গোছা??’ যৎসামান্যই রোজগার ছিল বাবার, প্রায় পুরোটাই তুলে দিতেন মায়ের হাতে মা সেটা দিয়েই নিখুঁত ভাবে সংসার চালাতেন। professionalism নিয়ে কোনদিন তাঁকে উতলা হতে দেখিনি উনি তো জানতেনইনা সেটা খায় না মাথায় দেয়। অথচ, শুনেছি, উনি নীতিপরায়ণ মানুষ ছিলেন। কাজ ফেলে রাখতে পছন্দ করতেন না, আমাকে প্রথম চাকরী পাওয়ার পর বলেছিলেন, ‘অন্যায় কাজ করবে না, মাথা নত করে কাজ করবে না...সেটা professionalism কিনা প্রশ্ন উঠতেই পারে, আমি জানি না।
আসলে ইংরেজ আমাদের জন্য অনেকগুলি concept ছেড়ে গেছে professionalism তার মধ্যে একটি নতুন করে শব্দটার অর্থ খুঁজে বেড়াচ্ছি।

শুভব্রত দাশগুপ্ত