সুর সঙ্গীত গীতিধারায় কাজী নজরুল * ঝিলিমিলি


তবে চারপাশের মানুষের মধ্যে অন্তর্নিহিত সুরের গুঞ্জনরণের যে ভান্ডার তা থেকে নজরুল সুর আহরণ করেছিলেন। পথে না নামলে পথের কিনারা হয় না, সে আমরা যে কোন সময়ে উপলব্ধি করে থাকি। পথের মাঝে মূল্যবান যে রত্নটি আছে,তাকেও চিনে নিতে হয়, খোঁজার পদ্ধতি জানা চাই সে রত্ন কুড়িয়ে নিলেও কোন না কোন মুহুর্তে তা কাজে লাগবে। তাই বুঝি নজরুল নিতান্ত অজানা কোন পথচারী, ভিখারী,মাঝি-মাল্লার কন্ঠ থেকে এমন কি রাস্তায় বসে যে কাওয়াল রুজী সংগ্রহ করে তাদের কাছে থেকেও সুরের বিচিত্র রঙ খুঁজেছেন। চট্টগ্রাম এবং সন্দ্বীপে বেড়াতে গিয়ে কবি রচনা করেছিলেন ভাটিয়ালী আর সাম্পানের গান। মাঝি মাল্লাদের সুরের অবদানকে তিনি অকুণ্ঠে স্বীকার করেন। এভাবে সুর সংগ্রহের ধারাটি নজরুল গীতির উল্লেখযোগ্য সম্পদ।~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~


সুর সঙ্গীত গীতিধারায় কাজী নজরুল
ঝিলিমিলি

“‘বেণুকাদোলানচাঁপাদুটি রাগিণীই আমার সৃষ্টি। আধুনিক(মর্ডাণ)গানের সুরের মধ্যে আমি যে অভাবটি সবচেয়ে বেশী অনুভব করি তাহচ্ছে সিমিট্টিবা ইউনিফর্মিটির অভাব।কোন রাগ বা রাগিণীর সঙ্গে অন্য রাগ বা রাগিণীর মিশ্রণ ঘটাতে হলে সংগীতশাস্ত্রে যে সূক্ষ্ম জ্ঞান বা রসবোধের প্রয়োজন তার অভাব আজকালকার অধিকাংশ গানের সুরের মধ্যেই লক্ষ্য করা যাচ্ছে এবং ঠিক এই কারণেই আমার নতুন রাগ-রাগিণী উদ্ধারের প্রচেষ্টা ।রাগ-রাগিণী যদি তার গ্রহন্যাসএবং বাদী, বিবাদী ও সংবাদী, মেনে নিয়ে সেই রাস্তায় চলে তাহলে তাতে কখনও সুরের সামঞ্জস্যের অভাব বোধ হবে না- কাজী নজরুল ইসলাম নতুন রাগ সৃষ্টি বা লুপ্তপ্রায় রাগ-রাগিণীর পুনরুদ্ধার ছাড়াও বাংলা সঙ্গীতে নজরুল যেভাবে গজল, দাদরা,টপ্পা, খেয়াল, ভাঙ্গা-খেয়াল, ভাঙ্গা খেয়াল ঠুমরী প্রভৃতির ব্যাপক প্রচলণ ঘটিয়েছেন সে যে এক বিস্ময়কর ব্যাপার।

আমার আজকের বিষয়বস্তু নজরুল ইসলামের নজরুলসংগীতকে নিয়ে, কবিতায় নজরুলকে অর্ধেক করে পাই আর তার বাকী অর্ধেক সঙ্গীতের নজরুল। নজরুল একদিকে কবি অপরদিকে সুরকার দুইয়ের সমন্বয়ে আমরা পরিপূরক নজরুলকে পাই। বহুগুণে গুণান্বিত আমাদের নজরুল একধারে বিদ্রোহী বা কবিই নয় শুধু, তিনি ছিলেন গল্পকার, ঔপন্যাসিক,নাট্যকার, প্রাবন্ধিক, সাংবাদিক,সম্পাদক এবং অনুবাদক। কিন্তু এসকল ছাড়াও সঙ্গীত জগতের এমনি এক বিস্ময়কর প্রতিভাধর ব্যাক্তিত্ব তার মধ্যে এতো প্রাবল্যের যে যার যাদুর স্পর্শে তার রচিত সকল গানগুলো সুরের সাবলীল ধ্বনিমাধুর্যযোগে অপরূপ ছন্দময়ে পুর্নতা লাভ করেছে তরঙ্গায়িত হয়ে ।কবির কবিতা ও গানের মধ্যে একটি আত্মিক যোগাযোগের সমন্বয় ঘটেছিল ঐশ্বরিক কোন সূত্র ধরেই যেন, যার ফলে তার সৃষ্টিশীল আবেগের উৎসমুল থেকে স্বকীয় সুরের ধারায় গান আপনার হয়ে জগতে সমোহারে বিস্তার লাভ করে আছে।কবি গানের জগতে নিমজ্জিত ছিলেন একনিষ্ঠের সাধনার সঙ্গমে, তার প্রাণের আকুলতা ছিল বাঙলা গানকে উচ্চতরেরআসনে নিয়োগের জন্যে, তিনি বৈচিত্র সুরের মধ্যে গানের বাণীকে নিয়ে তাকে অপরূপ মহিমা দিয়েছেন । তিনি গানের সুরের অবহেলিত দিক খুঁজে সুরের সেই সার্বিক ব্যাঞ্জনা দিয়ে স্বার্থকরূপে গানকে প্রকাশ করে নতুন দিগন্তের সূচনা করেছেন। গান রচনাকালে তার চরিত্রের উদারতা খেয়াল করা যায়, গানের ঢঙকে বিশেষ মহিমায় রূপান্তরিত করার লক্ষ্যে তিনি কখনও গান সংযোজনার মূল চাহিদা ব্যাতীত ব্যাক্তিগত চাহিদাকে বড় করে দেখেননি। বাংলাভাষা যেমন কোন হিন্দু মুসলিমের একক সম্পত্তি নয় যদিও কিছু শব্দ হিন্দু বা মুসলমানের ঘরে আলাদা করে ব্যাবহারের রীতি পরিলক্ষিত হয়। নজরুল সে সকল রক্ষনশীল মনোভাব থেকে ঊর্ধ্বে ছিলেন । গজল রচনায় নজরুলের কয়েকটি বৈশিষ্ট বিশেষভাবে আমাদেরকে আলোড়িত করে। নজরুলই প্রথম আরবী-ফার্সী শব্দের ব্যাপক প্রচলন বা প্রয়োগ করলেন তার সৃষ্ট গজলের বাণীতে এবং বলা বাহুল্য সাফল্যের এক নব উন্মেষ কাল তথায় আবির্ভূত হয়। এন্ট্যানী ফিরিঙ্গি যেমন বলেছিলেন বাংলায় বাঙ্গালী হয়ে কোর্তা টুপি ছেড়েছি’—তেমনি নজরুলের হাতে এই বিদেশী শব্দগুলি একেবারে বাঙ্গালী হয়ে গেছে । সবার অলক্ষ্যে এই মেলামেশা হিন্দু মুসলিম উভয় সাংস্কৃতির ঐতিহ্যকে আরও খানিকটা সুদৃঢ় করেছে, বাংলার শব্দভাণ্ডার ও কাব্যসৌন্দর্যও বৃদ্ধি পেয়েছে।

এ ছাড়াও নজরুল আমাদের ঘুণে ধরা সমাজকে উঠে দাঁড়াবার আরও একটি মন্ত্রমুগ্ধকর পরিবেশ সৃষ্টি করলেন গানের গায়ে আসন পেতে দিয়ে । যেখানে শ্রেণী বিন্যাসের প্রশ্ন তুলে জাত-বেজাতের প্রাচীর ছিল, সেই প্রাচীরকে তিনি ভেঙ্গে দিয়ে তাতে সমস্তরের নিশান উড়িয়ে দিলেন, মেধা মনোয়নে যে কেউ প্রবৃত্ত হতে পারে এই যৌক্তিকতা ধরে তার গান এগিয়ে চলল। এতদিন সংগীতের ক্ষেত্রে আশরাফ- আতরাফের একটা স্পষ্ট সীমা রেখা ছিল। বিত্তশালীরা গাইতেন এক শ্রেণীর গান আর মুটে মজুরের মুখে শোভা পেত অন্য শ্রেণীর গান। অর্থাৎ সংগীতেরও জাত-বেজাত ছিল। নজরুলের গজল বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনে মালিক মজুরের সেই ব্যাবধানের বেড়াকে ধুলিস্মাৎ করে দিল। আর একটু সুন্দর করে বললে মনোজগতের এত বড় একটা বৈপ্লবিক পরিবর্তন কিন্তু ঘটে গেল সম্পূর্ণ নীরবে। অভিজাত ড্রয়িংরুম থেকে শোনা গেল- বাগিচায় বুলবুলি তুই ফুল শাখাতে’, কর্মরত কিষাণের মুখ থেকে ভেসে এল কে বিদেশী বন উদাসীগজলের প্রবল স্রোত তেতলা-তালতলাকে সমান করে দিল। সুর মানুষের চিত্তকে উদার করে । কবির কথায়ঃ পাষাণের ভাঙ্গালে ঘুম কে তুমি সুরের ছোঁয়া ।তাই সুরের বিভিন্ন বৈচিত্রের অঙ্গনে নজরুলের এই নিঃশঙ্ক পদার্পণেতার গান হয়ে উঠেছে তাললয়-সুরে ভিন্ন মাত্রার স্বাদে অনবদ্যের। নজরুলের রাগ রাগিণীর উপর ভালো দক্ষতা ছিল(ধরাণায় ধারণ করার মত তার অসাধারণ ক্ষমতা ছিল, নিত্য অনুশীলণে দীক্ষিত না হয়েও)। নজরুলের একাধারের ঐকান্তিক অনুশীলন দ্বারা সুরের কাঠামোর উপর উচ্চাঙ্গ সংগীতের কলাকৌশল যথাযথ প্রয়োগে সুরগুলো নজরুলের বশ্যতা স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছে, নতুন সুরের ঝঙ্কার তার ওস্তাদি বা পাণ্ডিত্যে সম্ভব হয়েছিল। নজরুল কোন সুরের বশ্যতা স্বীকার করেন নাই, প্রয়োজনে সুর নজরুলের বশ্যতা স্বীকার করেছে বলেই প্রমাণিত হয়। নজরুল নতুন রাগিণী সৃষ্টি করেছেন সে কথা শুরুতেই নজরুলের জবানীতে উল্লেখ করেছি । জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের অনন্যসাধারণ সৃজনী প্রতিভার অবদানে বাংলা সাহিত্য, সংগীত এবং সমাজ ও সংস্কৃতি নানাভাবে সমৃদ্ধ ও ঐশ্বর্য মন্ডিত হয়েছে। নজরুল ইসলাম গীতিকার ও সুরকার হিসাবে অভাবনীয় সৃজন ক্ষমতার স্বাক্ষর রেখেছেন নতুন করে বলার নাই।

বলা বাহুল্য পুর্বে বাংলা সঙ্গীত ধারায় সুরবৈচিত্রের অভাব ছিল। কিছু লোকসঙ্গীত, ‘প্রসাদীএকতালায়নিবন্ধ রামপ্রসাদী গান, কীর্তন এবং নিধুবাবুর টপ্পা ইত্যাদির সুরভঙ্গী ছাড়া আর কিছুই শ্রুতিগোচর হয় না। শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের অনুপ্রবেশ ও প্রসার ঘটতে বেশ কিছু সময় লেগেছে। ধ্রুপদ ছিল ভারতীয় রাগসঙ্গীতের আদি রূপ। মুসলমানগণের যখন ভারতে আগমণ ঘটে তারা ধ্রুপদকে ভারতীয় সঙ্গীতের আদিরুপে পান। কিন্তু কড়া শাসনের দ্বারা সুরের সুচিহ্নিত পথে গাইয়েদের চলতে হত। সুরের বাইরে গিয়ে কোন পদলঙ্ঘন না ঘটে সেদিকে ছিল সতর্কতা -সুরবিস্তার বা সুর পরিব্যাপ্তির(ধ্রুপদের সুর পূর্ব নির্দিষ্ট)কোন এখতিয়ার কারও ছিল না। ক্রমেই ধ্রুপদের সীমাবদ্ধতা ভাঙ্গা হল সঙ্গীত প্রতিভার স্বচ্ছন্দ বিহার ও বিকাশের সম্ভাবনার কারণকে গ্রথিত করে।মুসলমানগণ এদেশে এসে সুরের এই সীমাবদ্ধতাকে উপলব্ধি করেন। ধ্রুপদের এই আঁটসাঁট বাধনকে ভেঙ্গে প্রবর্তিত হল খেয়াল এবং আরও সহজতর ঠুংরীর। সঙ্গীত সাধনায় শিল্পীদের স্বাধীন স্বত্বাকে ফিরিয়ে দেওয়া হল, তারা ঠুংরীতে কণ্ঠের কসরত দেখাবার সম্পুর্ন সুযোগ পেলেন। ধ্রুপদ বেশী রকম শাস্ত্রের অনুশাসন মেনে চলে,এসব গানের সুরের বিশুদ্ধি আছে কিন্তু উচ্ছলতা নাই,বন্ধন আছে মুক্তি নাই। পক্ষান্তরে খেয়াল,ভাঙ্গা খেয়াল,ঠুংরী ইত্যাদিতে সুরের ঐশ্বর্য আছে,এসব গান সুরের মাদকতায় ভরপুর। তবে এসব গা্নে শাস্ত্রের বাঁধন অবশ্যই আছে কিন্তু সে বাঁধনে সুরের প্রাণ ওষ্ঠাগত নয়। অল্প বাঁধন আছে বলেই এলায়িত না হয়ে সুর সেখানে অধিকতর ছন্দোবদ্ধ ও লীলাময়ি হয়ে উঠেছে। প্রাণের দ্বারে সুরের খেলা এখানে সুস্পষ্ট।

বাণী ও সুরের আলিঙ্গন নিয়েই গান হয়, সে গান কারো কণ্ঠে গীত হয় আর বাকীরা সেই আওয়াজে(শ্রাব্যে) মোহিত হন সুরের সম্মোহনে। নজরুলের গানে বাণীর চেয়ে সুরের অবদান বেশী যেখানে রবীন্দ্রসঙ্গীতে কথার ভুমিকা(বাণী) সুরের চেয়ে অগ্রগণ্য ভুমিকাই রাখে। তাই রবিন্দ্রসঙ্গীতের বাণীর কাব্যসৌন্দর্য অপূর্ব পবিত্রতায় রক্ষিত। সুরের ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ প্রধানত ধ্রুপদাশ্রয়ী। হিন্দু ঘরানার সৃষ্ট ধ্রুপদের আঁটসাট বাঁধনে রবীন্দ্র সঙ্গীতের সুরগুলি সুনির্দিষ্ট সুরের পরিবর্তন এখানে অপরাধের আওতায় পড়ে। তাই রবীন্দ্র সঙ্গীতে সুরের বিশুদ্ধি থাকলেও গায়কের স্বাধীনতা নাই । সেই জন্যে রবীন্দ্রসঙ্গীতে নিয়ম নীতির অনুশাসন বেশী নজরুল গীতিতে শাস্ত্রীয় বাঁধন কম সুর বিকাশের অবাধ স্বাধীনতা।

আর একটু পর্যালোচনা করে পরিস্কার করা যাক। ভারতীয় সঙ্গীতের দুইটি ধারা একটি ধারায় ধ্রুপদ, অন্য ধারায় খেয়াল, ঠুংরী ইত্যাদি। প্রথমটি হিন্দু ঘরানার সৃষ্টি, দ্বিতীয়টি মুসলিম ঘরানার অবদান। একটি হিন্দু ঐতিহ্য ঘেঁষা হিন্দুস্থানী ধারা, অপরটি মুসলিম ঐতিহ্যবাহী মুসলমানী ধারা । প্রথমটি বড্ড বেশী শাস্ত্রের নিয়ম মেনে চলে, অনেক ছোঁয়া বাঁচিয়ে অতি সতর্কতায় তার চলাফেরা; দ্বিতীয়টিতে নিয়ম নীতির কঠোরতা নেই, ছুতমার্গও নয়। ধ্রুপদে আছে গাম্ভীর্য,আছে ওস্তাদী কসরৎ। ঠুংরিতে আছে সুরের মাদকতা, প্রাণ মাতানো গুঞ্জণ। অধিকাংশ মানুষের কাছে তাই মুসলিম ঘরানার সৃষ্ট সঙ্গীতধারা অধিকতর প্রিয়।এই দুই ঘরানার কথা বলতে গিয়ে নারায়ণ চৌধুরী লিখেছেনঃ হিন্দু ও মুসলমানকথা দুটি বলাই বাহুল্য, আদৌ সাম্প্রদায়িক অর্থে ব্যাবহার করা হয়নিব্যবহার করা হয়েছে সৃষ্টিশীলতার তারতম্যের বিচার করে। সুর রচনায় দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের মৌলিক বিশেষত্ব হচ্ছে বাংলা গানে তিনি খেয়ালের অনুপ্রবেশ ঘটিয়েছেন, খেয়াল ভেঙ্গে সুরের সূক্ষ্ম কারুকাজগুলিকে তিনি স্বীকরণ করে সুরোবদ্ধ করেছেন। খেয়াল ও টপ্পার সংমিশ্রণে তিনি আর এক প্রকার সুর সৃষ্টি করেছেন তার সঙ্গীতেযাকে বলা যায় টপ-খেয়াল।

তার কোরাস সঙ্গীত রচনাও সেই সঙ্গে বিরাট অবদান রেখেছে। পক্ষান্তরে রজনীকান্তের সঙ্গীতের ভাষায় কোন কারুকাজ নাই, সুরের ও জটীলতা নাই, সঙ্গীত ও সুর দুই-ই নির্মল, অনেকটা রামপ্রসাদের গানের বাণীর মত সহজ-সরল এবং সুন্দর। ভক্তিভাবের সারল্যের ছন্দময় আবেদন রজনীকান্তের গানে বয়ে যায়। অতুলপ্রসাদ তার গান রচনার ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের অনুগামী থাকলেও সুরের ক্ষেত্রে তিনি ধ্রুপদ থেকে সরে এসে খেয়াল এবং বিশেষ করে ঠুংরীর আশ্রয় গ্রহণ করেন। কারণ হিসাবে বলা যায় তিনি জীবিকার প্রয়োজনে দীর্ঘদিন লক্ষৌ প্রবাসী ছিলেন। সুতরাং মুসলমান ঘরানার পুষ্ট উত্তর ভারতীয় সঙ্গীতধারার সঙ্গে তার ঘনিষ্ট পরিচয়ের সুযোগ হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ, দ্বিজেন্দ্রলাল, রজনীকান্ত এবং অতুল প্রসাদ এই চারজন মৌলিক ধারাকে মানে ধ্রুপদকে আশ্রয় করে তাদের সঙ্গীতের কাঠামো প্রধানত প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন।

এবার ফিরে আসি নজরুলের কথায়। সুরের জগতে নজরুলের পরিপুরক ধারণা সেই সঙ্গে নতুন সুর শিক্ষা ও সংগ্রহ তার সাধনার একনিষ্ঠ বিষয়বস্তু ছিল। পুর্বেই বলা হয়েছে রাগ-রাগিণীর প্রকৃতি ও চরিত্র সম্পর্কে তার মোটামুটি একটা ধারণা গড়ে উঠেছিল এবং তিনি তার মেধাবলেই স্বল্প সময়ে দীর্ঘ দিনের অনুশীলন ব্যাতিতেই করায়াত্ত করেছিলেন। সুতরাং নিষ্ঠার সাথে ব্যাপক অনুশীলন না করেও মার্গ সঙ্গীতের সঙ্গে তাঁর বিশেষ যোগসূত্র স্থাপিত হয়েছিল। রাগ সঙ্গীতের গতি প্রকৃতি বা স্পিরিটকে তিনি আত্মস্থ করতে পেরেছিলেন। বনগীতিরউৎসর্গ পত্রে জমিরুদ্দীন খানকে তিনি আমার গানের ওস্তাদবলে উল্লেখ করেছেন। খান সাহেব ছিলেন ঠুংরীর সম্রাট। ধ্রুপদ,টপ্পা, গজল, দাদরা সবকিছুতেই তিনি ছিলেন সুপন্ডিত। তাঁর সান্নিধ্য তাই কবির সাঙ্গীতিক জীবনে বিশেষ ফলপ্রসূ হয়েছিল।

যে কোন কারণেই হোক, বাংলা গানে নজরুলের পূর্বে খেয়াল ও ঠুংরীর ব্যাবহার ব্যাপকভাবে হয়নি। হিন্দি ছাড়া যে,অন্য ভাষায় খেয়াল রচনা হতে পারে এই ধারণা অনেকেরই ছিল না। বহুদিনের প্রচলিত ধারণা ও সংস্কার অনুযায়ী অনেকের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে খেয়াল এবং রাগ প্রধান মানেই হিন্দুস্থানী সঙ্গীত । নজরুল তাঁদের সেই ভুল ভাঙ্গালেন। এর পর যাদের নাম উল্লেখ করা হয় তারা হলেন ওস্তাদ কাদের বক্স, গজল গাইয়ে মস্তান গামা, মঞ্জু সাহেব প্রমুখ। এঁদের থেকেও তালিম পাওয়া রাগ-রাগিণীর সংখ্যা কম নয়। স্বর্গীয় সুরেশ চন্দ্র চক্রবর্তীর মুখে শুনা যায় এক সময় নজরুল আমীর খসরু রচিত ফার্সী ভাষায় এক বিশালায়তন সঙ্গীত বিষয়ক গ্রন্থ এবং নওয়াব আলী চৌধুরী কৃত মআরিফফুননাঘমাতগ্রন্থ দুখানি অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে পাঠ করেছিলেন।

তবে চারপাশের মানুষের মধ্যে অন্তর্নিহিত সুরের গুঞ্জনরণের যে ভান্ডার তা থেকে নজরুল সুর আহরণ করেছিলেন। পথে না নামলে পথের কিনারা হয় না, সে আমরা যে কোন সময়ে উপলব্ধি করে থাকি। পথের মাঝে মূল্যবান যে রত্নটি আছে,তাকেও চিনে নিতে হয়, খোঁজার পদ্ধতি জানা চাই সে রত্ন কুড়িয়ে নিলেও কোন না কোন মুহুর্তে তা কাজে লাগবে। তাই বুঝি নজরুল নিতান্ত অজানা কোন পথচারী, ভিখারী,মাঝি-মাল্লার কন্ঠ থেকে এমন কি রাস্তায় বসে যে কাওয়াল রুজী সংগ্রহ করে তাদের কাছে থেকেও সুরের বিচিত্র রঙ খুঁজেছেন। চট্টগ্রাম এবং সন্দ্বীপে বেড়াতে গিয়ে কবি রচনা করেছিলেন ভাটিয়ালী আর সাম্পানের গান। মাঝি মাল্লাদের সুরের অবদানকে তিনি অকুণ্ঠে স্বীকার করেন। এভাবে সুর সংগ্রহের ধারাটি নজরুল গীতির উল্লেখযোগ্য সম্পদ। পথচারী হিন্দুস্থানীদের কণ্ঠে জাগো পিয়া’ -গানটি শুনে তিনি সেই সুরে লিখলেন নিশি ভোর হল জাগিয়া’, নৃত্যসহযোগে গীত মিস ফরিদার উর্দু গজল কিসকি খায়রো ম্যায় নাজনে কবরো মে দিল হিলা দিয়া’ – এর অবলম্বনে লিখলেনআসে বসন্ত ফুল বনে, সাজে বনভূমি সুন্দরী’, আব্বাস উদ্দিনের কণ্ঠে নদীর নাম সই কচুয়াশুনে ঠিক এই সুরে কবি লিখলেন নদীর নাম সই অঞ্জনাআর এক ভাওয়াইয়া তেরষা নদীর পারে পারে ওর অবলম্বনে লিখলেন পদ্মা দীঘির ধারে ধারে ঐএই বিখ্যাত গানটি । বিভিন্ন সুরের ভাঙ্গা-গড়া এবং সংমিশ্রণে তিনি অনায়াসে এবং আশ্চর্য দক্ষতায় অসংখ্য সুর সৃষ্টি করতে পারতেন। সুরের এই সংমিশ্রন ঘটাতে যেখানে বড় বড় ওস্তাদেরা দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়েন নজরুল সেখানে নিঃশঙ্ক। উদাহরণ স্বরূপ –‘সন্ধ্যা মালতি যবে ফুল বনে ঝুরে/কে আসি বাজায় বাঁশী ভৈরবী সুরে’-গানটির কথা ধরা যাক। প্রথম পংক্তিতে আছে সন্ধ্যাবেলাকার সন্ধ্যা মালতীর সুর, দ্বিতীয় পংতিতে আছে প্রভাতের সুর ভৈরবী-এই দুই বিপরীতধর্মী সুরকে তিনি নিপুণ দক্ষতায় মিলিয়ে দিয়েছেন অথচ সুরের এই সংমিশ্রণে কোন খোঁচ বা অসংগতি নেই। তিনি যেন এক আনন্দদায়ক খেলার ছলে এই মহৎসৃষ্টি কর্মটি সম্পন্ন করেছেন। তাই আত্মগর্ব্বী মধুসূদনের মত(মধুসূদন বলতেনঃ আমি ব্যাকরণ অনুসরণ করি না ব্যাকরণ আমাকে অনুসরণ করবে) নজরুলও বলতে পারতেনঃ আমি সুর অনুসরণ করি না, সুর আমাকে অনুসরণ করে ধন্য হবে।

গান রচনার কালে নজরুল চরিত্রের আর একটি বিশেষ উল্লেখযোগ্য পদ্ধতি ছিল তিনি প্রথমে স্থির করে নিতেন গান কোন রাগের ভিত্তিতে হবে সুরের কাঠামো ঠিক হয়ে গেলেই তিনি সেই অনুযায়ী বাণী বসিয়ে দিতেন। যেমন দোলন চাঁপা রাগের উপর ভিত্তি করে লিখবেন সেটা পুর্বাহ্নেই ঠিক করে নিয়েছিলেন। পরে তিনি গানটিকে লিখে নিলেন –‘দোলন চাঁপা বনে দোলে দোল পুর্নিমা রাতে চাঁদের সাথে।এভাবে তার অনেক বিখ্যাত গানের উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে । নজরুলের গানের সুরসৃষ্টির দৃষ্টান্ত এবং প্রাচীন সংস্কারের বেড়াজাল থেকে তিনি যে বেড়িয়ে এসেছেন তা ছত্রে ছত্রে উল্লেখ করা হয়েছে পুর্ব ইতিহাসকে টেনে এনে। এবার উনার গানের শ্রেণী-বিন্যাসকে নিয়ে আলোচনা করা যাক।
তিনি একাধারে রচনা করেছেন গজল, গান, কাব্যসঙ্গীত বা প্রেমগীতি,ঋতু-সঙ্গীত,খেয়াল,রাগপ্রধান, হাসির গান, কোরাস গান, দেশাত্মবোধক গান, গণসংগীত শ্রমিক-কৃষকের গান,ধিবরের গান, ছাদপেটার গান, তরুণ বা ছাত্রদলের গান, মার্চসঙ্গীত বা কুচ কাওয়াজের গান, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির গান, নারী জাগরণের গান, মুসলিম জাতির জাগরণের গান,শ্যামা সঙ্গীত, কীর্তন, বৈষ্ণবপদাবলী, অন্যান্য ভক্তিগীতি, ইসলামী-সঙ্গীত, শিশু-সঙ্গীত,নৃত্যসঙ্গীত, লোকগীতি, ভাটিয়ালী, ভাওয়াইয়া, সাম্পানের গান, ঝুমুর, সাঁওতালী,লাউনী, কাজরী, বাউল, মুর্শেদী এবং আরও নানা বর্ণের গান

এবার নজরুলের গজল সম্পর্কে সংক্ষেপে কিছু না বললে গজলের সুরের আঙিনায় নজরুলের রসবোধের কলাকৌশলগুলো যে নৈপন্যে বা সুরের পরিপক্কতা নিয়ে প্রয়োগ হয়ে আছে সে কাহিনীখানি অজানা রয়ে যাবে। নজরুল বাংলা গজলের সৃজন করেছেন আশ্চর্যের প্রদীপমালা দিয়ে।নজরুল সুরের প্রবর্তক ছিলেন সুরের সিংহাসনে বসেই, নানান পরীক্ষা নিরীক্ষার ঘাত ভেঙ্গে তিনি বাংলার গজলকে রাঙ্গিয়ে দিলেন সুরের অপরূপ মুর্ছনার মাধুর্যের নিবিড় বন্ধন পরিয়ে দিয়ে। অতুলপ্রসাদও গজল সৃষ্টি করতে গিয়ে ব্যাহত হয়েছিলেন। নজরুল দেখলেন গজলের আদি নিবাস পারস্যে। পারস্যের প্রেম সঙ্গীত রূপায়নের জন্যে গজলের জন্ম। গজলের প্রধানত দুটি অংশ --অস্থায়ী এবং অন্তরা। সুর এবং তালকে কেন্দ্র করেই অস্থায়ী অংশ গাওয়া হয় আর অন্তরার সময় তালকে নিঃশব্দ করে দিয়ে কিছুটা সুর/তালের বিকাশ রেখে আবৃত্তির ভঙ্গীতে উচ্চারণ করা হয়, এই অংশকে শের বা শেয়র বলা হয়। বিলম্বিত লয়ে অন্তরার এই অংশটির সুরবদ্ধ আবৃতি শেষ হওয়া মাত্র যখন অস্থায়ীতে ফেরা হয় তখন হঠাৎ সুর ও তালের ছন্দোবদ্ধ যোজনার একটি অপূর্ব সংগীতের আমেজ ও স্ফূর্তির প্রকাশ ঘটে। সাধারণ গান সমূহে এধরণের অনুসরণের নজীর নাই। গজলের গায়ক, বাদ্যকারগণ এবং শ্রোতাবৃন্দ এই সংগীত মুর্চ্ছণার মুহুর্তটুকুর জন্য সাগ্রহে অপেক্ষা করে থাকেন। শেরঅংশ অপূর্ব কাব্যসৌন্দর্য সমৃদ্ধ --- এই অংশের কাব্যগুণ শ্রোতাদের মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখে(মানে সঙ্গতকারের অন্তরা থেকে অস্থায়ীতে ফেরার সময় গায়কী ঢঙ অনবদ্যের হয়ে ফুটে।)। অনেকটা ঠুংরীর মুখপাতের অংশ চক্রাকারে পুনরাবৃত্ত হওয়ার সময় ছন্দের নিপুণ কাজের মত। ঠুংরির সাথে গজলের এই অংশের তাল ক্রিয়ার প্রধান তফাৎ এই যে ঠুংরী গাওয়া হয় সাধারণতঃ দাদরা বা আদ্ধা তালে; আর গজল গাওয়া হয় প্রায়শঃ সাধারণ কাহারবা তালে। বিভিন্ন রাগ রাগিণীর সমাবেশ এই গজলে সুরাবদ্ধ করে নজরুল তার মনের চাহিদা পূরণ করেছেন। তিনি ঠুংরী ও দাদরা আঙ্গিকে অপূর্ব গজল রচনা করেছেন যাকিনা সহজেই মানুষের হৃদয়ের দ্বারে ছাপ রাখে। যেমন উচাটন মন ঘরে র্য়া না’, ‘গান গুলি মোর আহত পাখী সম’,‘আধ আধ বোল লাজে বাধ বাধ বোলইত্যাদি গানগুলোর কথা বলা যায়।। শুধু মাত্র কি তাই, তিনি বিভিন্ন রাগের সমাবেশে নতুন আঙ্গিকে গজলকে সাজিয়েছেন। উদাহরণ স্বরূপে বলা যায় পিলু খাম্বাজ ঠাটের রাগ আর বাগেশ্রী কাফি ঠাটের এমনি নিভৃতের মিলনে বেধে সুরকে আরোপিত করেছেন যে তার সেই বিখ্যাত গান চেওনা সুনয়না আর চেয়োনাগজলটি নজরুলের সুর প্রয়োগের নিপুণতা বা পরিচয় বহন করে আছে খুব সাবলীল ভঙ্গিমাতেই । অথচ সাধারনভাবে এই দুই রাগের সহজ মিলন সম্ভব হয় না। আর পূর্বেই বলেছি এই গজল সৃষ্টির মাধ্যমে মানুষের মূল্যবোধ চেতনাতে বৃদ্ধি পেয়েছে, প্রাণের গান গাইবার জন্যে সকলের প্রতি চির-আহ্বান নবযুগ সূচনা করে দিয়েছিল, গান গাইবার ক্ষেত্রে উঁচু-নিচুর জাত বেধে সীমানা নির্ধারণের প্রক্রিয়া ভেঙ্গে গেল সেই ক্ষণেই।

ইসলামী সঙ্গীতের ধারা নজরুলের মাধ্যমে পসার লাভ করে। লালনফকীর বা হাসানরাজার কিছু দেহতত্বমুলক গান আমাদের চারিপাশের হাওয়ায় বিচ্ছুরণ করে আছে এবং এই বাউলচরিত্রে পল্লীমানবের দর্শনচিন্তার সাবলীল প্রকাশ ঘটেছে সুরের বৈচিত্রের সুধা নিয়েই। মীর মোশারফ হোসেনের সোনার খনি জাতীয় কিছু পয়ার ছাড়া প্রকৃত ইসলামী সঙ্গীত বাংলায় রচিত হয়নি। ইসলামিক গান বাধার পিছনে পুর্ব ইতিহাসকে ছোট্ট করে যদি টানি তবে পাঠক সমাজে আমার অপরাধ হবে না বলে মনে করি। তদানিন্তন মরহুম সাহিত্যিক ও প্রথম শিক্ষাবিদ প্রিন্সিপ্যাল ইব্রাহীম খাঁর লিপি সংলাপবইয়ে দুটি পত্র পাওয়া যায়(নজরুলকে লিখিত প্রিন্সিপ্যালের পত্র এবং নজরুলের উত্তর প্রিন্সিপ্যালকে)। এখানে ইব্রাহীম খাঁ সাহেব নজরুলকে ইসলামিক গান লিখার জন্যে অনুরোধ জানিয়েছিলেন এবং পরবর্তীতে এরই পরিপ্রেক্ষিতেই যেন নজরুল অসংখ্য ইসলামিক গান রচনা করেছিলেন। নজরুলের পত্রখানি পড়লে নজরুলের সরল উক্তি সেখানে পাওয়া যাবে। নজরুল শুধু নিছক ইসলামকে নিয়ে গান বাধেননি, তিনি ইসলামের মূল আদর্শের চেতনায় গানগুলোকে রচনা করেছিলেন যাতে বাঙালি মুসলমানগণ তাদের পূর্বের ভুল ধারণাসমুহকে ভেঙ্গে জাতীয় স্বত্বায় অগ্রগতির চিন্তাচেতনায় উদ্ভূত হতে পারে।অতি সংক্ষেপ করে হলেও নজরুলের ইসলামী সঙ্গীতের আন্তঃবিভাগ সম্পর্কে কিছুটা ধারণা এখানে দেই হামদ, নাথ, মর্সিয়া, মুনাজাত, মুর্শেদী, দেহতত্বমুলক সঙ্গীত ইত্যাদি শ্রেণীতে বিভক্ত। এই নতুন ধারার সঙ্গীতগুলোর বাণী মধুর এবং তার সুরগুলোও মধুরতর।

রাগাশ্রিত গানগুলির বেলায় খেয়াল, ভাঙ্গা-খেয়াল এবং রাগ প্রধান এই তিনটির শব্দ ব্যাবহার পাওয়া যায়। তবে এগুলোর মধ্যে সম্পর্ক সম্বন্ধ জানা থাকা উচিৎ। তিনটিরই জন্ম সূত্র এক, গোত্র এক, শুধু বৈশিষ্ট পৃথক । বাংলা খেয়াল হল একেবারে হিন্দী খেয়ালের সুরের প্রতিবিম্ব, কেবল বাণী অংশ হিন্দীর বদলে বাংলা। হিন্দী খেয়ালকে ভেঙ্গে বাংলা খেয়ালের জন্ম বলে এ গুলোকে ভাঙ্গা খেয়ালও বলা হয়। সুতরাং খেয়াল এবং ভাঙ্গা খেয়ালের মধ্যে বৈশিষ্টগত কোন পার্থক্য নাই। আমি পুর্বেই লিখেছি রাগ প্রধান মানেই হিন্দুস্থানি সঙ্গীত এই ভুল ধারণা নজরুল বাংলায় খেয়াল বা ভাঙ্গা খেয়াল রচিত করে সমাজচোখে ভেঙ্গে দিয়েছিলেন। বাংলা ভাষায় খেয়াল, ধ্রুপদ ইত্যাদির প্রয়োগ করে নজরুল কঠোর পরিশ্রমযোগে অসংখ্য রাগাশ্রিত গান রচনা করেন।এ সময়(১৯৩৭ -৪২০ তাঁকে গভীর রাত পর্যন্ত সংগীত রচনায় নিমগ্ন থাকতে দেখা যেত একেবারে ধ্যানস্থ অবস্থা। তাঁর সজ্ঞান জীবন নাট্যের শেষ পর্বের দিনগুলি ধ্যানী তানসেনের মত সংগীতময় ও ধ্যানসর্বস্ব হয়ে উঠেছিল।কবি সভা- সমিতি ছেড়ে,বন্ধুবান্ধব ছেড়ে নিস্তব্ধ গৃহে সুরসৃষ্টির দুরূহ মৌনতপস্যায় নিয়োজিত হয়েছিলেন।

এবার নজরুলের অপরিসীম পরিশ্রমের আর একটি সৃজন রাগাশ্রয়ী কাব্যগীতিগানের বাণী রাগের উপর ভিত্তি করে গাওয়ার ফলে অপরূপ সুরের মাদকতার ভাবাবেগে বাণীমুর্তি স্পষ্ট আলোয়ে ফুটে উঠে। বলা হয়ে থাকে সুরের অংশ মার্গ সংগীতাশ্রয়ীক্লাসিক্যাল; আর বাণীর অংশটুকু কাব্যাশ্রয়ী আধুনিক। সুরের মাদকতা আর বাণীর সৌন্দর্যের অপরূপ লীলা দেখাবার অবকাশ এসব গানে থাকে। এবার সরাসরি কবির উদ্ধারকৃত রাগরাগিণীর কথায় আসি যা কালের গর্ভে লুপ্তপ্রায় ছিল। তিনি এগানগুলি রচনা করে নাম দিয়েছেন হারামণি পর্যায়ের গান। এই বৈশিষ্টের কয়েকটি গানের সুর ও প্রথম কলির নাম করছিঃবসন্ত মুখারী বসন্ত মুখর আজি, আনন্দীদূর বেণুকুঞ্জে মুরলী মুহু মুহু, কর্ণাটি সামন্তকাবেরী নদী জলে কে গো বালিকা, নীলাম্বরী শাড়ি পরি নীল যমুনায়, ইত্যাদি রাগ হারামনি পর্যায়ের।

কবি নিজে যে সব রাগরাগিনী সৃষ্টি করেছেন সেগুলি নবরাগ মালিকা পর্যায়ের অন্তর্ভুক্ত। কবির গান রচনাকালে কবিকে সঙ্গ দিতেন শ্রদ্ধেয় জগৎ ঘটক। তাই তাঁর মন্তব্য এখানে অধিক গুরুত্ব রাখে। উত্তরকালে যখন তিনি রাগ সঙ্গীত অবলম্বন করে বাংলা গান রচনায় আত্মনিয়োগ করেন, সেই সময় তাঁর ভাব সমাহিত মনের অচেতনায় কয়েকটি নতুন রাগ-সৃষ্টির প্রেরণা পান। এই সময় তিনি দুর্লভ সংগীতগ্রন্থ সংগ্রহ করে বহু অপ্রচলিত রাগের গান রচনায় তন্ময় হয়ে যান। এই গানগুলি রচনা কালে তাঁর হারামণি, নবরাগ প্রভৃতির সৃষ্টি।নতুন রাগগুলি সম্বন্ধে কবি বলতেন,--এগুলো আমার স্বপ্নে পাওয়া রাগ। মার্গ সংগীত রচনাকালে তাঁর একনিষ্ঠ মন আহার নিদ্রা ভুলে এমনি বিভোর হয়ে থাকতো যে,নিদ্রাকালেও তিনি ওরই স্বপ্ন দেখতেন। সেই সময় তিনি অবচেতন মনে এই সব নতুন রাগের যে আভাস পেতেন, তাকেই অবলম্বন করে তাঁর এই সকল গান রচনা।উনার রাগ রাগিণীর অসংখ্য গানের কথা আর তাদের পর্যালোচনা করতে গেলে সময়ের সঙ্কুলান হবে না এমনি তাঁর ব্যাপ্তি। নজরুলের হাতে বিভিন্ন রাগ রাগিণীর সংমিশ্রণে সুরের ঔজ্জ্বল্য বেড়েছে, সুর হয়ে উঠেছে মধুর সঞ্জীবনী সুধার মত প্রাণদায়িনী।

নজরুল বিদেশী সুর অবলম্বনে বাংলা গানের সমৃদ্ধি ঘটিয়ে গানকে আকর্ষণীয় করেছেন। যে কোন ভাষার সুরে হোক বাংলাগানে সেই সুরের ভাণ্ডারে ধরে রাখার উনার ক্ষমতা ছিল। মধ্যপ্রাচ্যের অনেকগুলি দেশের বিভিন্ন সুর তিনি সংগ্রহ করেছেন এবং হুবুহু সেই সুরের ফ্রেমে বাংলা কথা বসিয়ে দিয়েছেন যেমন তুরস্কের লোক সংগীতের সুরে তিনি লিখলেনশুকনো পাতার নুপুর পায়ে নাচিছে ঘুর্ণি বায় এবং ইজিপসিয়ান ড্যান্সের সুরে মোমের পুতুল মমীর দেশের মেয়ে নেচে যায় আরবী লোকগীতির অনুকরণে চমকে চমকে ধীর ভিরু পায়’ –গানগুলো এপ্রসঙ্গে স্মরণীয়। আরবী সুরে- রুম ঝুম রুম ঝুম, কিউবান ড্যান্সের সুরে দূর দ্বীপবাসিনীইত্যাদি।

-- এবারে লোকসংগীতের কথা বললে রবীন্দ্রনাথের কথা সর্বাগ্রে বলতে হবে কারণ তিনিই প্রথমত উদ্যোগী ভূমিকা নিয়েছিলেন। তবে নজরুল ব্যাপক গীতি রচনা ও সুর সংযোজনা করে বাংলার সাধারণ মানুষের বুকে সেই সুর ছড়িয়ে দেবার দায়িত্ব নিয়েছিলেন। বাংলা লোকসংগীতের ধারার সাথে উত্তর ভারতীয় লোকসংগীতের ধারা দুটি সমানভাবে মিশেছে নজরুল গীতিতে। বাংলা লোকসংগীতের মধ্যে ঝুমুর,সাঁওতালী,বাউল, রাম প্রসাদী , ভাটিয়ালী, ভাওয়াইয়া, কীর্তন,ভজন,কাজরী ইত্যাদি আর উত্তর ভারতীয় লোকসঙ্গীতের মধ্যে নাত, গীত, গজল, কাওয়ালী,হোরি , লাওনী, বিহারী প্রভৃতি ।তবে এপ্রসঙ্গে একটি কথা বিশেষ স্মরণীয় আগে আমীর-ওমরাহ্‌ এমনকি জমিদার-জোতদার, অভিজাত ধনি সম্প্রদায় লোকগীতিকে অবজ্ঞা করে দূরে সরিয়ে রাখতেন। এই গানগুলি যে চিত্তকে উদার করার ক্ষমতা রাখে মানুষের হাসি কান্নার উপলব্ধিকে কেন্দ্র করেই, সে সম্পর্কে সম্যোক কোন ধারনাই তাদের ছিল না। নজরুল লোকগীতিকে বিশেষ মর্যাদায় ভূষণ করলেন, লোকগীতিকে সকলের প্রাণের দ্বারে আপনার করে পৌঁছে দিলেন। বাংলাসংগীত ধারার ইতিহাসে, লোকগীতি এখন একটি উল্ল্যেখযোগ্য অধ্যায়।

নজরুলের কোরাসের কথা বলতে গেলে তা শুধুমাত্র দেশাত্মক বোধকে সীমাবদ্ধ রইল না। ছাত্রদলের গান, মার্চসংগীত,ধীবর-কৃষকের গান, জাতীয় জাগরণের গান, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির গানেও নজরুল সমবেত গানের ব্যাবহার করে গেছেন। বিদ্রোহাত্মক বা দেশাত্মক কোরাসগুলি তো চিরস্মরণীয়‌। কারার ঐ লৌহ কপাটছাড়াও ধরা যাক ইমন ও কেদারার মিশ্রণে সুরারোপিত দুর্গম গিরি কান্তার মরু দুস্তর পারাবারগানটি তো এখন ঐতিহাসিক পর্যায় উঠে গেছে। নজরুলের গানের বাণীতে গণসংগীতেরও স্পষ্ট ছাপ রয়েছে যদিও সলিল চৌধুরীর সুর ও রচনা সার্থকভাবে স্মরণীয় তবু নজরুলই সুর ও বাণী নিয়ে গণসংগীতের গুড়াপত্তন করেছিলেন বলা যেতে পারে। তবে নজরুলের হাসির গান থাকতেও কেন যেন তাঁর অন্যান্য গানের মত প্রকাশ ঘটেনি।

নজরুলগীতির আরও দুটি বিশেষ স্তম্ভ --ভক্তিগীতি এবং কাব্যগীতি। ভক্তি গীতির কথায় নজরুলের উচ্ছ্বাসিত প্রশংসা করতে হয়। নজরুল রচিত ভক্তিগীতির সংখ্যা, শ্যামা ও ইসলামী মিলিয়ে প্রায় পৌনে এক হাজার। সুর ও বাণী একে অপরের কন্ঠলগ্ন হয়ে এসকল প্রতিটি গান উচ্চগ্রামে স্পর্শ করে গেছে নজরুলপ্রীতি ভক্ত মাত্রেই জেনে থাকবেন। আমরা নজরুলের সুরের বিচিত্র রঙের কথায় ফিরে আসি। ধরা যাক কীর্তনের কথা, সুরের ধারা অবিকল একই সুরে খেলছে, বাউল সংগীত শুনেই বুঝা যায় বাউল অঙ্গেরই গান বা পদাবলীর সুরের গঠণরীতিরও একই ঢং। রাম প্রসাদী গানহাম্বির রাগের উপর যার স্থিতি–‘প্রসাদী একতালায়নিবন্ধ একই সুর, একই লয়। দেখা যায় যার যার অঙ্গনে একই বৈশিষ্ট নিয়ে সুরগুলো বদ্ধ জলাশয়ের মত অবস্থা। সুরের এই একঘেয়েমি হতে নজরুল ভক্তিগীতিকে মুক্ত করেছেন। কোনধরনের বিশ্লেষণে না যেয়ে নজরুল সৃষ্ট অপরূপ ভক্তিগীতির দুএকটি উদাহরণ দিলেই হৃদয় আপনাতেই সিক্ত হয়ে উঠবে বলতে পারি। যেমন শ্মশানে জাগিছে শ্যামা, বলরে জবা বল এবং আমার কালো মেয়ের পায়ের তলায় দেখে যা আলোর নাচন। এখানে বিভিন্ন রাগ রাগিণীসহ সুর তাল লয়ের বৈচিত্র নিয়েও কোন কোন গানগুলি সুরাবদ্ধ হয়েছে।

নজরুলগীতির প্রধান অংশ কাব্যগীতি (প্রেমসংগীত)। প্রকৃতিকে নিয়ে বিশুদ্ধ কাব্য রবীন্দ্রনাথ সৃষ্টি করে গেছেন যেখানে নজরুলের এধরনের গীতির অবদান নাই বললেই চলে। নজরুল সৃষ্ট প্রেমসংগীতকে কাব্য গীতির আলোকে দেখলেও সে সকল গানে রাগপ্রধান, গজল এমনকি লোকসংগীতের বেশ কিছু অংশ এসে যায়। তাই বলা যায় নজরুল দুই তৃতীয়াংশই কাব্যগীতিই রচনা করে গেছেন। মানবীয় প্রেমের আনন্দ-বেদনার দীপ্তময় জীবনকে আশ্রয় করেই নজরুলের এই গানগুলো রচনা যা পার্থিব আলোয়ে বাস্তবায়ন সক্ষম। রবীন্দ্রনাথের গানের মত কোন অতীন্দ্রিয় লোকের চিন্তা ভাবনা এসে এই মিলন-বিরহকে প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি। রবীন্দ্র-নজরুলের কবি মানসের মৌলিক ব্যাবধান গড়ে উঠেছে এখানে। পার্থিবের সীমানাকে অতিক্রম করে রবীন্দ্রনাথের প্রেম হয়েছে আত্মত্যাগে অমর, সদা নির্মলতার কথাই সেখানে টানে। কিন্তু নজরুলের প্রেম কামনা-বাসনার তপ্ত স্পর্শে দীপ্যমান। নজরুল লিখেছেন মানুষের গান, যৌবনের গান প্রেম বিরহ যেন তরতাজা সজীব অবয়রে তার সবকিছু খোলা মেলা। মানবিক প্রেম বিরহের এমন উষ্ণ আবেগ নিয়ে কোন কাব্যগীতি পূর্বে আর লেখা হয়নি। এদের কাব্যধর্মিতার বর্ননা শেষে আমরা সুরের বৈশিষ্টের দিকে সংক্ষেপে এবার নজর দিলে দেখতে পাব সুরগুলো হৃদয়গাহী হয়ে কাব্যগীতিকে আরও স্বকীয়তার রূপ- মাধুর্যে সঞ্জীবিত করেছে।

বঙ্গসংস্কৃতির এক অনন্য ও অসাধারণ চরিত্র কাজী নজরুল ইসলাম। তার কবি প্রতিভার গৌরবময় অবদানে আমাদের বাংলা আজ গানের সুরের প্রাচুর্যে ভরপুর। রাজনৈতিক অঙ্গনে নজরুলের দৃঢ়চেতামন গভীর প্রভাব বিস্তার করে আছে, তিনি কখনও অন্যায়ের সাথে আপোষ করেন নাই। ধনী আর হত-দরিদ্রদের ব্যাবধান তাঁকে পীড়া দিত। তিনি একাধারে যেমন সুরের সাধনায় নিজেকে নিবৃত্ত করে রেখেছিলেন অন্যদিকে তিনি সচেতনাবোধ জাগিয়ে সমাজের কুসংস্কারকে দূর করে জাতীয় স্বত্বার সকল স্তরে ঢেলে শুদ্ধতায় সাজাতে চেয়েছেন। কবির সাধনার নিরলস পরিশ্রমের ফসল এই নজরুল গীতি। আবেগতাড়িত নজরুল তার বিরুদ্ধে সমালোচকদের তাই বলেছিলেন- আপনারা আমার কবিতা সম্পর্কে যা ইচ্ছা হয় বলুন, কিন্তু গান সম্পর্কে নয়। গান আমার আত্মার উপলব্ধি।
ঝিলিমিলি