একটা দল নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন কালিদাস। নিজেই
নাট্যকার, নিজেই নির্দেশক এবং অবশ্যই নিজে
হিরো। চেহারাখানাও যে হিরো হবার মতনই ছিলো ভদ্রলোকের, সে
গল্প তো আছেই। সেইরকমই ঘুরতে ঘুরতে গিয়ে হাজির হলেন কুন্তল রাজ্যে। সে রাজ্যটা যে
এগ্জ্যক্টলি কোথায় ছিলো, সঠিক করে এখন বলা মুশকিল। যতদূর
সম্ভব, ডেকান প্ল্যাটোর দক্ষিণপশ্চিম দিকের খানিকটা অংশ
কুন্তল রাজ্য নামে চিহ্নিত ছিলো। খুব বড় রাজ্য কিছু নয়। অন্তত পোলিটিক্যালি খুব
সিগনিফিক্যান্ট কিছু নয়। কিন্তু শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির চর্চা ছিলো সেখানে।
শিল্পীর কদর ছিলো। তার উপর খবর ছড়িয়েছিলো, সেখানকার
রাজকন্যার স্বয়ম্বর, এবং তিনি স্বয়ং নাকি রীতিমতন
বিদ্যেবুদ্ধির পরীক্ষা নিয়ে তবে পাত্র নির্বাচন করবেন।
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
কালিদাসের কাল
সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়
‘‘মেঘদূত পড়েছো? আষাঢ়স্য প্রথম দিবসে...?’’ জানলার পর্দা সরাতে সরাতে
প্রশ্ন করলো অমৃতদা। বাইরে আকাশ কালো করে এসেছে। বেলা বারোটার সময় বেশ একটা
বিকেল-সন্ধ্যে গোছের লুক দিচ্ছে। মেঘদূত মনে পড়তেই পারে। তবে অমৃতদার মধ্যে এ যাবৎ
কোনওরকম রসকষ-রোম্যান্সের নামগন্ধ পাইনি। ওর স্ত্রীও দিব্যি এই বাড়িতেই আছে।
সুতরাং পত্নী-বিরহে মেঘদূত আওড়ানোরও কোনও গল্প নেই। তবে এক্সেন্ট্রিক লোক তো...
‘‘ওই... মানে অনুবাদ পড়েছি।’’
বললাম আমি।
‘‘হুঁ। মানে খোসাটা খেয়েছো। শাঁসের
স্বাদ পাওনি।’’ বীয়রের মাগটা তুলতে তুলতে বললো অমৃতদা।
আমি হাসলাম। কি আর করা! সত্যিই পাইনি।
আমার সংস্কৃত বিদ্যেয় কালিদাস ওরিজিন্যাল কুলোবে না। অমৃতদার কুলিয়ে বেশি হয়। অমৃত
অধিকারী। ইতিহাসের দুঁদে অধ্যাপক। সংস্কৃত সাহিত্যেও অবাধ গতি। ঘোরতর রকমের
পণ্ডিত। গত বছর আমরা ওদের হাউসিং-এ শিফট করে আসার পর থেকে মাঝে মাঝে আমার
উইকেন্ডের আনওয়াইন্ডিং পার্টনার।
‘‘লোকটাকে নিয়ে যে সব গালগল্প চালু
আছে, সে সব পড়েছো তো?’’
‘‘তা পড়েছি। সেই, যে গাছের ডালে বসে সেই ডালই কেটে ফেলা, তারপর সেই
রাজকুমারীর স্বয়ংবর সভায় চড়-ঘুঁষি মার্কা কি সব যেন... না?’’ ঠাণ্ডা বীয়রে একটা আরামদায়ক চুমুক দেওয়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ে গেলো,
সেই কবে যেন শরদিন্দু বন্দ্যোপধ্যায়ের লেখা পড়েছিলাম কালিদাসকে
নিয়ে। ‘‘শরদিন্দুবাবুর লেখা আছে না? কি
যেন নাম...?’’
‘‘নাটকটার নাম কালিদাস। উপন্যাসটার
নাম কুমারসম্ভবের কবি। একটা ছোটগল্পও আছে, অষ্টম সর্গ বলে।’’
মাগটা গ্লাসটপ টেবিলের উপর রেখে বললো অমৃতদা। ‘‘ভদ্রলোক বেশ ওবসেসড ছিলেন কালিদাসকে নিয়ে। কিছুটা বোধহয় রবীন্দ্রনাথও
ছিলেন।’’
‘‘ওবসেশন হওয়ার মতনই একটা চরিত্র
কিন্তু! প্রথম জীবনে ওরকম বোকা... মানে, ইয়ে। তারপর গিয়ে
ওইরকম কবি... তার মধ্যে আবার রাজকন্যার সঙ্গে বিয়ে...’’
‘‘বিশ্বাস হয়?’’
‘‘অ্যাঁ?’’ আমি
থতমত!
‘‘একটা লোক... আকাট মূর্খ। রীতিমতন
বিদূষী একজন রাজকন্যা তাকে টপ করে বিয়ে করে ফেললো। তারপর যখন বুঝতে পারলো কি
ব্লান্ডারটা করেছে, তখন দূর দূর করে তাড়িয়ে দিলো। তারপর সে
লোক নাকি সরস্বতীর বরে প্রায় রাতারাতি ওইরকম মারকাটারি স্কলার হয়ে গেলো!’’ বীয়রে চুমুক দিয়ে অমৃতদা বললো, ‘‘একটু বাড়াবাড়ি না?’’
আমি জুলজুল চোখে তাকিয়ে রইলাম। ছোটবেলা
থেকে এইরকমই তো জেনে এসেছি। বাড়াবাড়ি কি না তো ভাবিনি কোনওদিন!
‘‘কি? বিশ্বাসযোগ্য
মনে হয় গল্পগুলো?’’ চোখ নাচিয়ে প্রশ্ন করলো অমৃতদা। যেন
আমাকে থতমত খাইয়ে দিয়ে খুব খুশি।
‘‘অ্যাঁ, মানে...
অবিশ্বাস করার কথা তো ভাবিনি কখনও...’’ আমতা আমতা করে বললাম।
‘‘তোমার দোষ নেই। এদেশে কেউই
প্রচলিত কোনও কিছুকে অবিশ্বাস করার কথা ভাবে না। তুমিই বা তার ব্যতিক্রম হবে কেন?’’
শৌখীন ফ্যুয়েল লাইটার দিয়ে ফস করে একটা সিগারেট ধরালো অমৃতদা।
পণ্ডিতের সঙ্গে বিবাদ করা বিপজ্জনক।
সত্যিকারের হলে তো কথাই নেই। তাই চিমটিটা হজম করে গেলাম।
‘‘কিন্তু আমার বিশ্বাস হয় না হে।’’
একরাশ ধোঁয়া ছেড়ে অমৃতদা বললো। বাইরে বৃষ্টিটাও ঝমঝমিয়ে নামলো ঠিক
তখনই।
আমি চুপ করে ওর দিকে তাকিয়ে আছি। বুঝতে
পারছি, একটা গল্পের পটভূমিকা তৈরি
হচ্ছে। এই লোভেই তো পুরনো পাড়ার আড্ডা ছেড়ে ওর সঙ্গে ভেড়া।
‘‘কালিদাস কোথাকার লোক ছিলেন জানো?’’
নড়েচড়ে বসলো অমৃতদা।
আমিও রেডি হলাম। মাথা নাড়লাম। ‘‘নো আইডিয়া।’’
‘‘হুঁ। কেউই জানে না। কালিদাসের
জীবন সম্বন্ধে ইতিহাস আশ্চর্যরকম ভাবে চুপ। অথচ এমন নয় যে, ভদ্রলোক
প্রাগৈতিহাসিক সময়ের মানুষ। যদি ওঁর বিক্রমাদিত্যকে দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত বলে ধরে নিতে
হয়, যেরকমটা বেশির ভাগের ধারণা, তাহলে
সে তো তিনশো আশি খ্রীস্টাব্দের গল্প। যাকে বলে, ওয়েল উইদিন
দ্য পারভিউ অফ হিস্টরি।’’ বীয়রে একটা লম্বা চুমুক দিলো
অমৃতদা।
‘‘তাহলে এই সব গল্প কোথায় পাওয়া
যায়? বেশ ভালো রকমই তো প্রচলিত।’’
‘‘ওই... প্রচলিত। পুরোটাই ফোকলোর।
সোর্স জানা যায়না। সেই জন্যই মনে হয়, বুঝলে..?’’
‘‘কি?’’
খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে অমৃতদা রহস্যময়
গলায় বললো, ‘‘যে লোকটা মেঘদূত, কুমারসম্ভব, অভিজ্ঞান শকুন্তলমের মতন কবিতা লিখতে
পারে, তার পক্ষে এই ধরণের ফোকলোর তৈরি করা কি আর এমন ব্যাপার?’’
‘‘মানে?’’ বীয়রে
চুমুক দিতে গিয়ে প্রায় বিষম খেলাম আমি।
অমৃতদা উত্তর দিলো না। ক্রিস্টালের
সার্ভিং বৌল থেকে কয়েকটা চীনেবাদামের দানা তুলে নিয়ে মুখে পুরলো। তারপর চিবোতে
চিবোতে বললো, ‘‘আচ্ছা, কালিদাস
নামটা শুনে কোথাকার লোক বলে মনে হয়?’’
এটাও আগে ভাবিনি কখনও। কিন্তু এখন ভেবে
মনে হলো, ও নামটা কোনও উত্তরভারতীয়ের
শুনিনি কোনওদিন। যে ক’জন কালিদাসকে চিনি, সবাই বাঙালি। একজন বোধহয় ওড়িয়া ছিলো। বললাম সে কথা।
‘‘এগ্জ্যাক্টলি!’’ সোফার হাতলে একটা ছোট্ট চাপড় মেরে বললো অমৃতদা। ‘‘পুরো
নর্থ ইন্ডিয়া ঢুঁড়ে ফেললেও একটা কালিদাসও পাবে কি না সন্দেহ! বলে কি না কাশ্মীরের
লোক!’’
‘‘কে বলে?’’
‘‘লক্ষ্মীধর কল্লা। কাশ্মীরী
পণ্ডিত। বিশ শতকের গোড়ার দিকে একটা বই লিখেছিলো, ‘দ্য বার্থ
প্লেস অফ কালিদাস’ বলে। প্রমাণ করার চেষ্টা করেছিলো, জায়গাটা কাশ্মীর ছিলো।’’
‘‘কি ভাবে?’’
‘‘প্রধানত লেখায় কাশ্মীরের
নৈসর্গিক বর্ণনার বাহুল্যের উদাহরণ দিয়ে, এবং সেই সঙ্গে কিছু
কাশ্মীরী গল্প-প্রবাদ ব্যবহারের নিদর্শন দেখিয়ে। কিন্তু কথা হলো, তার জন্য কি কাশ্মীরে জন্মাতে লাগে? রবীন্দ্রনাথ যে
মংপুর সৌন্দর্য নিয়ে এত লিখেছেন, তার থেকে কি ধরে নিতে হবে
তিনি মংপুর মানুষ ছিলেন? বা ভারতচন্দ্রের দিল্লির ডিটেইলড
বর্ণনা থেকে কি বুঝতে হবে তিনি দিল্লির অধিবাসী ছিলেন?’’
অকাট্য যুক্তি। মাথা নাড়লাম। কোনও জায়গার
বর্ণনা করার জন্য বা সেখানকার সৌন্দর্য নিয়ে শিল্পসৃষ্টি করার জন্য একজন সংবেদনশীল
মানুষের সেখানে জন্মানোর দরকার হয় না। একটা লম্বা সময় কাটালেই যথেষ্ট। সেই কথাই বললাম।
‘‘ব্যাং অন!’’ আবার সোফার হাতল চাপড়ালো অমৃতদা। ‘‘এইটাই হচ্ছে কথা!
সেযুগের হাজার হাজার বিদ্যার্থীর মতন কালিদাসও গেছিলেন কাশ্মীরে পড়াশোনা করতে,
এবং দীর্ঘদিন ছিলেন সেখানে। ওরকম একটা ন্যাচারালি বিউটিফুল জায়গার
রিফ্লেকশন যে তাঁর মতন রোম্যান্টিক লোকের কবিতায় পড়বে, তাতে
আর আশ্চর্য কি?’’ একটু দম নিলো অমৃতদা। একটা চুমুক দিলো
বীয়রে। তারপর বললো, ‘‘কিন্তু প্রশ্নটা হচ্ছে, কোথা থেকে গেছিলেন?’’
‘‘নামটা কিন্তু ইস্টার্ন ইন্ডিয়াই
সাজেস্ট করে। তাই না?’’
সিগারেটে একটা লম্বা টান দিয়ে অমৃতদা
জিজ্ঞেস করলো, ‘‘নীহার রঞ্জনের বাঙ্গালির
ইতিহাস পড়েছো?’’
বইটা বাড়িতে ছিলো। ‘‘ঠিক পড়া বলে না। তবে উল্টে পাল্টে দেখেছি কয়েক বার।’’
‘‘হুঁ। নীহারবাবু বলেছেন, প্রতি বছর শয়ে শয়ে বাঙালি তরুণ সেকালে কাশ্মীর যেতো লেখাপড়া করতে।’’
আমি আবার নড়ে চড়ে বসলাম। ‘‘বলছো কালিদাসও তেমনই গেছিলেন? মানে,
বাঙালি ছিলেন বলছো?’’ জয়দেব গোস্বামীকে নিয়ে
বাঙালি আর ওড়িয়াদের মধ্যে এককালে টানাটানি হতো, শুনেছি।
কিন্তু কালিদাসকে বাঙালি বলে দাবি করার কথা এই প্রথম শুনছি।
অমৃতদা মুচকি হাসলো। ‘‘বলছি না। জাস্ট একটা ইঙ্গিত দিচ্ছি। একটা পসিবিলিটি।’’
তারপর পা নাচাতে নাচাতে বললো, ‘‘কিন্তু কি
জানো? কালিদাস কোথাকার লোক ছিলেন, বাঙালি
ছিলেন না কাশ্মীরী, তার থেকেও বেশি ফ্যাসিনেটিং বিষয় হলো
তাঁর প্রাথমিক জীবনটা, আর তার সঙ্গে জড়িত ওইসব অদ্ভুত
গল্পগুলো।’’
আমি নির্বাক। তাকিয়ে আছি সামনে বসা সাদা
পাজামা-পাঞ্জাবি পরা মোটা ফ্রেমের চশমা চোখে ছোটখাটো মানুষটার দিকে। আমার সঙ্গে
পরিচয় খুব অল্প দিনের নয়। বছর আষ্টেক আগে বাংলা বক্তৃতার ইতিহাসের উপর একটা
ডকুমেন্টারি ছবির রিসার্চের সময় পরিচয় হয়েছিলো। তারপর আরও দু’একটা প্রোজেক্টে কনসাল্ট করেছি ওকে সাব্জেক্ট ম্যাটার
এক্সপার্ট হিসেবে। কাজের সম্পর্ক ক্রমে বন্ধুত্বে পরিণত হয়েছে। খামখেয়ালী লোক।
স্নব, সময় বিশেষে অভদ্র বলেও দুর্নাম আছে। কিন্তু আমার সঙ্গে
প্রথম থেকেই কোনও কারণে জমে গেছিলো। তারপর এই গত বছর শিফট করে এসেছি এই
সোসাইটিতে... মেয়ের স্কুল কাছে, লাগোয়া বাজার, সোসাইটির নিজস্ব ক্রেশ, ইত্যাদি নানান সুবিধার
পাশাপাশি অমৃত অধিকারীর নিয়মিত সান্নিধ্যের লোভও যার একটা কারণ।
‘‘তোমরা তো আবার অডিও-ভিস্যুয়ালের
লোক। তোমাদের তো স্টোরি ছাড়া চলবে না।’’ অমৃতদা উঠে পায়চারি
শুরু করলো। এই ক’বছরের অভিজ্ঞতায় জানি, এটা ওর গল্প শুরু করার স্টাইল। বীয়রমাগটা এক চুমুকে নিঃশেষ করে মনোনিবেশ করলাম।
‘‘ভাবো...’’ পায়চারি
করতে করতে বলতে আরম্ভ করলো অমৃতদা... ‘‘কাশ্মীরে লেখাপড়া শেষ
করে ফিরে এলেন তরুণ কালিদাস। মাথার মধ্যে উপত্যকার অপার্থিব সৌন্দর্য, সেখানকার মেয়েদের অতুলনীয় রূপ আর সংস্কৃত কাব্যনাটকের অনুরণন।
ছাত্রাবস্থাতেই লেখা শুরু করেছিলেন। ফিরে এসে তৈরি করলেন নাটকের দল। সেযুগে
ভ্রাম্যমান নাট্যগোষ্ঠীদের রমরমা ছিলো, জানো তো? রাজ্যে রাজ্যে ঘুরে ঘুরে পারফর্ম করে বেড়াতো। এখনকার যাত্রাপালার মতন।’’
মাথা নাড়লাম। এটা জানি।
‘‘তো সেইরকম একটা দল নিয়ে বেরিয়ে
পড়লেন কালিদাস। নিজেই নাট্যকার, নিজেই নির্দেশক এবং অবশ্যই
নিজে হিরো। চেহারাখানাও যে হিরো হবার মতনই ছিলো ভদ্রলোকের, সে
গল্প তো আছেই। সেইরকমই ঘুরতে ঘুরতে গিয়ে হাজির হলেন কুন্তল রাজ্যে। সে রাজ্যটা যে
এগ্জ্যক্টলি কোথায় ছিলো, সঠিক করে এখন বলা মুশকিল। যতদূর
সম্ভব, ডেকান প্ল্যাটোর দক্ষিণপশ্চিম দিকের খানিকটা অংশ কুন্তল
রাজ্য নামে চিহ্নিত ছিলো। খুব বড় রাজ্য কিছু নয়। অন্তত পোলিটিক্যালি খুব
সিগনিফিক্যান্ট কিছু নয়। কিন্তু শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির চর্চা ছিলো সেখানে।
শিল্পীর কদর ছিলো। তার উপর খবর ছড়িয়েছিলো, সেখানকার
রাজকন্যার স্বয়ম্বর, এবং তিনি স্বয়ং নাকি রীতিমতন বিদ্যেবুদ্ধির
পরীক্ষা নিয়ে তবে পাত্র নির্বাচন করবেন।
‘‘তাই কালিদাস দলবল নিয়ে উড়িষ্যা,
অন্ধ্র পেরিয়ে কর্ণাটকের দক্ষিণে সেই কুন্তল রাজ্যে গিয়ে উপস্থিত
হলেন। সেকালে রাজরাজড়াদের বিয়ে উপলক্ষে প্রচুর আমোদপ্রমোদ হতো, এবং তার মধ্যে নাচ-গান-নাটক অবশ্যই থাকতো। পার্ফর্মারদেরও পারিতোষিকটা
ভালোই মিলতো। এই সুযোগে চট করে কিছু কামিয়ে নেওয়া ছাড়াও অন্য কোনও গূঢ় উদ্দেশ্য
কালিদাসের মনে ছিলো কি না, কে বলতে পারে? কনফিডেন্সের অভাব থাকার কোনও কারণই তাঁর ছিলো না।
‘‘যাই হোক, কালিদাস
কুন্তল পৌঁছলেন রাজকন্যার স্বয়ম্বরের দিন কয়েক আগে, নগরের বাইরে
ডেরাডাণ্ডা ফেললেন এবং শো আরম্ভ করলেন। লোকের মুখে মুখে তরুণ নাট্যকার-কাম-নটের
খ্যাতি অচিরেই রাজঅবরোধের ভিতর পৌঁছে গেলো। রাজকন্যার কানেও গেলো।
‘‘এই রাজকন্যাটির নাম শরদিন্দুবাবু
তাঁর উপন্যাসে বলেছেন হৈমশ্রী। তা বলুন, তাতে আমার আপত্তি
নেই। কিন্তু এঁকে যেমন সেযুগের আদর্শ রাজকন্যার নিরিখে সর্বগুণান্বিতা, সুন্দরী, সুশীলা বলে বর্ণনা করেছেন, সেটা মানতে আমার একটু আপত্তি আছে।’’ বলতে বলতে
কিচেনে ঢুকলো অমৃতদা। ফ্রিজ থেকে আরেকটা বীয়রের বোতল বার করে এনে আমার হাতে দিলো।
‘‘কেন? কিসের
আপত্তি?’’ বোতল খুলে মাগে বীয়র ঢালতে ঢালতে প্রশ্ন করলাম
আমি।
‘‘ভেবে দ্যাখো... রাজকন্যা বিদূষী।
সুন্দরী হতেও আপত্তি নেই। কিন্তু এক অজ্ঞাতকুলশীল নটের প্রেমে পড়ে তাকে হুট করে
বিয়ে করে ফেলা, যতই ট্যালেন্টেড আর সুপুরুষ হোক না কেন সে,
এ কি সেকালের রাজকন্যার সুশীলতার ডেফিনিশনের সঙ্গে যায়?’’
‘‘কেন? সেকালে
তো শুনেছি মেয়েদের যথেষ্ট ফ্রীডম ছিলো। অন্তত সঙ্গীনির্বাচনটা কারও
ইন্টারফেয়ারেন্স ছাড়াই করে ফেলতে পারতো।’’ অমৃতদার মাগটা ওর
হাতে দিলাম।
‘‘তা হয়তো পারতো। কিন্তু এ যে সে
মেয়ে নয় হে। রাজকন্যা। রাজকন্যাদের বিয়ের ব্যাপারটা চিরকালই সেন্সিটিভ ইস্যু। রাজনীতি-টাজনীতি
অনেক কিছু জড়িয়ে থাকতো তার মধ্যে। কুন্তলের মতন ছোটখাটো রাজ্যগুলো তো এইসব
ম্যাট্রিমনির মধ্যে দিয়েই নিজেদের শক্তিবৃদ্ধি করতো। তাই মেয়ের বিয়েটা জুৎসই না
হলে রাজারা কোনওকালেই খুশি হতেন না। আর তা ছাড়া কবি-শিল্পী-নট সম্প্রদায়ের লোকের
সঙ্গে মেয়ের বিয়ে হলে কোন বাবা খুশি হন? তুমি নিজেও তো প্রায়
ওই গোত্রেরই লোক। বিয়েটাও প্রেম করে করেছিলে বলেই জানি। তোমার শ্বশুরমশাই খুশি
হয়েছিলেন তোমাদের বিয়েতে?’’
মানতে হলো, হ’ননি। বেশ কাঠখড় পোড়াতে হয়েছিলো।
‘‘এক্ষেত্রে রাজামশাইকে
নারীস্বাধীনতার মূল্য চোকাতে হয়েছিলো। মেয়েকে তিনি ছোটবেলা থেকে লেখাপড়া-টড়া
শিখিয়ে সম্পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়েছিলেন। হৈমশ্রী কুন্তলরাজের একমাত্র সন্তান হওয়াও
আশ্চর্য নয়। রাজকন্যার মতিগতি দেখে অন্তত তাই মনে হয়। খানিকটা চিত্রাঙ্গদার মতন
কেস, আর কি! বিদূষী, মুক্তমনা, কিন্তু স্বেচ্ছাচারিনী। অবশ্য এটা আমার থিওরি। চাইলে না মানতেই পারো।
‘‘সে যাই হোক, কালিদাসের মতন বাউণ্ডুলে নাটুকে লোকের সঙ্গে মেয়ের বিয়েতে মোটেই খুশি হ’ননি কুন্তলরাজ, এবং সেটাই স্বাভাবিক। তারপর বিয়ের
কিছুদিন পর থেকে যখন কালিদাস রাজবাড়ির মেয়েমহিলাদের সঙ্গে নিজের অভ্যস্ত লীলাখেলা
শুরু করলেন, তখন ষোলকলা পূর্ণ হলো।’’
‘‘মানে?’’ আমার
চোখ গোল গোল হয়ে গেছে ততক্ষণে।
‘‘মানে যা, তাই-ই।
অল্পবয়সী, হ্যান্ডসাম, ট্যালেন্টেড,
আর তার উপরে ওইরকম আপাদমস্তক রোম্যান্টিক লোক যে সেটাই করবে,
তাতে আর সন্দেহ কি?’’ বীয়রে চুমুক দিলো
অমৃতদা। ‘‘সেই জন্যই আরও সন্দেহ হয় হে, কুন্তলরাজকন্যার রূপ-টূপ নিয়ে।’’
‘‘কিন্তু কালিদাসও তো তাঁকে
ভালোবেসেই বিয়ে করেছিলেন!’’
অমৃতদা হাসলো। একটু খ্যাঁকখেঁকে ধরণের
হাসি। ‘‘প্রাইম মিনিস্টারের মেয়ে যদি
তোমার ফিল্ম দেখে ইম্প্রেসড হয়ে যেচে এসে প্রেম নিবেদন করে তোমায় বিয়ে করতে চাইতো,
তুমি না করতে পারতে? তার রূপ-গুণের তুলনাগুলো
লক্ষ্মী-সরস্বতীর সঙ্গে না হয়ে যদি শীতলা-মনসাদের সঙ্গে হতো, তাও পারতে কি রিফিউজ করতে?’’
কি সাংঘাতিক অ্যানালজি! তাড়াতাড়ি প্রসঙ্গ
পাল্টে বললাম, ‘‘তারপর... কুন্তলে কি হলো?’’
‘‘যা হওয়ার তা-ই হলো। একদিন খবরটা
জানাজানি হয়ে গেলো যে রাজকন্যার কোনও এক কাজিন বা কিঙ্করী রাজামশাইয়ের নতুন
জামাইয়ের সৌজন্যে গর্ভবতী হয়ে পড়েছে।’’
আমি আবার বিষম খেলাম। এ তো রীতিমতন
স্ক্যান্ডাল! কেচ্ছাকাহিনী যাকে বলে!
‘‘কি? হজম
করতে অসুবিধা হচ্ছে?’’ টিপিকাল অমৃত অধিকারী মার্কা খোঁচা। ‘‘কই, তোমাদের অমুক খান বা তমুক কাপূরের বেলায় তো হয়
না? রবীন্দ্রনাথের কেচ্ছাকাহিনীগুলোও তো বেশ তারিয়ে তারিয়ে
পড়ো। কালিদাসের বেলায় অসুবিধা হবে কেন?’’
উত্তর জোগালো না মুখে। শুধু জিজ্ঞেস করলাম, ‘‘তারপর?’’
‘‘তারপর আর কি? রাজামশাই এমনিতেই খুশি ছিলেন না জামাইকে নিয়ে। তার উপর যখন তার এই কেচ্ছার
কথা শুনলেন, একেবারে খুন চেপে গেলো তাঁর মাথায়। রাজকুমারীও
ততদিনে বরের মতিগতি ভালোই বুঝে গেছেন। এমনিতেই একটু এক্সেন্ট্রিক, হুইমজিকাল গোছের ছিলেন। মানে, ইমোশনগুলো একটু চড়া
সুরে বাঁধা ছিলো, আর কি! তাই বাবা যখন বেয়াদব বরকে কঠিন
শাস্তি দিতে চাইলেন, তাঁর বিশেষ আপত্তি হলো না।’’
‘‘মানে? একেবারে...?’’
‘‘না। একেবারে ঘ্যাঁচাং ফু নাও হতে
পারে। তবে অঙ্গচ্ছেদন বা নিদেনপক্ষে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের প্ল্যান হয়ে থাকতেই
পারে।’’
‘‘তারপর?’’
‘‘তারপর পলায়ন। সেটা কি করে
হয়েছিলো, তা তোমরা সিনেমাওয়ালারা বলবে। যদি আমাকে জিজ্ঞেস
করো, বলবো কালিদাসের কোনও এক ক্ষুদ্র প্রেমিকা, মানে লেসার লাভার, অর্থাৎ ওই রাজবাড়ির কোনও এক দাসী
বা কিঙ্করীই খবরটা দিয়েছিলো তাঁকে। পালাতেও সাহায্য করেছিলো রাতারাতি। নিজে সঙ্গে
গিয়ে থাকলেও অবাক হবার কিছু নেই। অষ্টম সর্গ গল্পে কবির যে মুখরা গৃহিনীর কথা
শরদিন্দুবাবু বলেছেন, এই সাহসিনী অভিসারিকার কালে কালে গিয়ে
সেই ফর্ম্যাট নেওয়াটাও বিচিত্র নয়। ততদিনে কালিদাস উজ্জয়িনীর রাজকবি, এবং সেখানকার মহিলামহলের নয়নমণি। সুতরাং, বুঝতেই
পারছো।’’
মাথা ভোঁ ভোঁ করছিলো। দু’বোতল বীয়রের উপর এই ডোজ... হজম করা কঠিন। একটু সামলে
নিয়ে বললাম, ‘‘কিন্তু ওই গল্পগুলো? ওই
যে, গাছের ডাল কাটা... তারপর সেই রাজকন্যার এক আঙুলের উত্তরে
দু’আঙুল দেখানো... আরও কি কি সব... সেগুলো?’’
অমৃতদা কয়েক সেকেন্ড আমার দিকে তাকিয়ে
থেকে হঠাৎ সিগারেটের প্যাকেটটা খুলে আমার দিকে এগিয়ে ধরলো। এমনিতেই হতভম্ব আমি আরও
ভ্যাবাচাকা খেয়ে একটা সিগারেট নিলাম। অমৃতদা লাইটার জ্বালিয়ে সেটা ধরিয়ে দিলো...
আর একটা টান দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ে গেলো, একটু
আগে ও বলেছিলো, মেঘদূতের মতন কবিতা যে লিখতে পারে তার পক্ষে
ওই জাতীয় ফোকলোর তৈরি করা কোনও ব্যাপার নয়!
অমৃতদার দিকে তাকালাম। মুচকি মুচকি হাসছে।
‘‘নিজের জীবনের কেচ্ছা কি আর বুক
ফুলিয়ে বলা যায় হে? বিশেষ করে যার কল্পনার অভাব নেই, তার দরকারই বা কি বলার? দ্য বেস্ট জোক ইজ দ্যাট হুইচ
হিউমিলিয়েটস দ্য টেলার হিমসেল্ফ, জানো তো? কালিদাসও সেটা জানতেন।’’
‘‘মানে বলছো উজ্জয়িনীর লোকজনকে
কালিদাস এই সব গল্প বানিয়ে বানিয়ে বলতেন নিজের সম্বন্ধে?’’
‘‘সবাইকে কি আর বলতেন? ঘনিষ্ঠরা নিশ্চই জানতেন সত্যিটা। বরাহমিহির, বেতালভট্ট,
অমরসিংহ, বররুচিরা কি আর ঘাসে মুখ দিয়ে চলতেন?
বিক্রমাদিত্য নিজেও কি ওসব আষাঢ়ে গল্পে ভোলার লোক ছিলেন বলে মনে হয়?
বলতেন রাজবাড়ির কচিকাঁচাদের। তারা মজা পেতো, এবং
তাদের মুখে মুখেই দাসদাসীদের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে গেছিলো গল্পগুলো।
ঠিক ফোকলোর যেভাবে ছড়ায়। কালিদাস তাই-ই তো চেয়েছিলেন।’’ একটা
তৃপ্তির হাসি হাসলো অমৃতদা... যেন গল্পগুলো কালিদাস না, ও
নিজেই ছড়িয়েছে।
নাঃ! এতটা বাড়াবাড়ি আর নেওয়া যাচ্ছে না!
যত বড় পণ্ডিতই তুমি হও না কেন, কালিদাসের
মতন একজন প্রাবাদিক মহামানবকে নিয়ে এরকম ছেলেখেলা... ‘‘প্রমাণ
করতে পারবে তুমি তোমার এই ক্লেইম?’’
‘‘বয়ে গেছে আমার প্রমাণ করতে।’’
আমায় কাঁচকলা দেখালো অমৃতদা। ‘‘যাও, বাড়ি যাও। বউ অপেক্ষা করছে।’’
সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়