পদাবলী * সোনালি পুপু

সেদিন দুপুরে বাড়ির জন্য ভোগপ্রসাদ নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে যাচ্ছিল। দালান থেকে বাড়ির দিকে নামতে গিয়ে অচেনা মানুষ দেখে থমকে গেলো। শ্যামলা ছিপছিপে চেহারা। এক মাথা কোঁকড়া চুল সিঁড়ির নিচে দাঁড়িয়ে ঠাকুরমশাইকে ডাকছেমাঝ সিঁড়িতে থালা হাতে শৈবলিনীকে দেখে চুপ করে গেলো থেমে গেছে শৈবালঅবাক হয়ে চেয়ে রয়েছে অচেনা ছেলেটার দিকে। বুকের মধ্যে কিসের ঢেউ তোলপাড় করছে তার। কে ? কে এই মানুষটি ? কোথায় দেখেছি একে ? খুব যেন চেনা; তবু নাম মনে করতে পারছিনা কেন? দুজনেই বোকার মত চেয়ে থাকে পিছন থেকে ঠাকুরমশাই,“কে রে,কে ডাকে?”বলে ডাক দিতে হুঁশ ফেরে শৈবালেরতরতর করে সিঁড়ি দিয়ে নেমে দৌড় লাগায় বাড়ির দিকে ধুক ধুক করতে থাকে বুকের মধ্যে ~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~

পদাবলী
সোনালি পুপু

“আমার হৃদি রাস মন্দিরে দাঁড়াও মা ত্রিভঙ্গ হয়ে
একবার হয়ে বাঁকা দে মা দেখা
শ্রী রাধারে বামে লয়ে -----”
খঞ্জনীর মিঠে আওয়াজের সঙ্গে খোলের তালফেরতা ঘুরে সমে এসে পড়লেই সারা শরীরে আলোড়ন দিয়ে ওঠে শৈবলিনীর।
বুড়ো হয়েছেন মন্দিরের পুরোহিত ঠাকুরমশাইদাদু। কিন্তু কি সুরে গলা এখনও।
“স্মরগরল খন্ডনম মম শিরসি মণ্ডনম দেহি পদপল্লব---”
ওহো, খোল তো আবার বলে না। বড়রা শুনলেই এক্ষুনি টুকবেন। বলবেন শ্রীখোল বলতে হয়। সরু সরু পোড়ানো ইঁটের দালান। প্রায় একমানুষ উঁচু।দৌড়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠে আসে শৈবালরোয়াক পেরিয়ে গর্ভগৃহফুলের সাজে সেজে চন্দনের গন্ধ মেখে দাঁড়িয়ে আছেন কষ্টিপাথরের মদনমোহন শ্রীকৃষ্ণ। কি সুন্দর মুখখানা। টিপ দেওয়া চিবুক, খাঁজকাটা ঠোঁট।চোখ আর ভুরুর কি টান। মাথায় চূড়া করা চুলে মালা দিয়েছেন ঠাকুরমশাই। কিন্তু সঙ্গে রূপোর বেড় তাতে ময়ূরের পালকও আছে।আর পাশে আছেন রাধারানী। মুখোমুখি আরেকটি বড় দেউল। নাটমন্দির। মন্দিরের গায়ের লাল মাটির কারুকাজ দেখতে থাকলে দিন কাবার হয়ে যাবে। মহাভারত রামায়ণের গল্পকথা, হাতি, ঘোড়া, মানুষ,গাছ,কি নেই? সুক্ষ্ম কারুকাজে শিল্পীরা জাদু ফুটিয়ে রেখেছে আটচালা ছাদের নীচের মন্দিরে। নাটমন্দির,চাতাল, উঠোন,ভোগের ঘর,সেবায়েতদের থাকার জায়গা, আর মন্দিরে ঠাকুরের সিংহাসন। মুগ্ধ হয়ে চেয়ে থাকে শৈবাল। কি সুন্দর কালপাথরের মূর্তিখান। পাশে সোনার মত ঝকঝক করছেন অষ্ট ধাতুর বৃজদুলালী। বারানসী রেশমি শাড়ি পরনে।হাতে মানতাসা, বাজু। গলায় সাতনরী হার। কানে কুণ্ডল,কানপাশা। মাথায় টিকলি,পায়ে নূপুর। দুজনেরই সাজের ভারি বাহার। এর ওপর আবার ফুলের গয়না। গন্ধে ম ম করে চারদিক।উথালপাথাল লাগে দালানে এলে।

খোলের তাখুটি তাখুটি বোল শুনলেই শিরদাঁড়া সোজা হয়ে দুলে ওঠে শৈবলিনীর কিশোরী শরীর।এবাড়ির সবচে’ ছোট মেয়ে শৈবলিনী।ফর্সা টুকটুকে গায়ের রঙ। পানপাতার মত মুখখানা।নাকটি একটু চাপা, কিন্তু বাঁশির মত খাঁজ দু দিকে। ঠাকুরদাদার বন্ধু,ঠাকুরমশাইদাদু ওকে দেখলেই ভারি খুসি হয়ে বলেন,
“আহা তিল ফুল জিনি নাসা অধর অতুল
রূপের ছটায় রাধে বান্ধুলির ফুল ---”
সুর শুনে পাতলা ঠোঁটের পাপড়ি কাঁপে ছোট্ট মেয়েরফিক করে হেসে পায়ের রূপোর তোড়া ছম ছম করতে করতে দালানের পিছন দিকের ছায়ায় চলে যায় সে। একেবারে ছোটবেলা থেকেই মন্দিরে আসতে ভারি পছন্দ শৈবালের। কেমন নিশির ডাকের মত ওকে টানে সুন্দর গন্ধমাখা জায়গাটা

ওদের কত কত পুরুষ আগের কোনো মহাশয় প্রতিষ্ঠা করে গেছেন রাধামাধবকে এই মন্দিরেএ বাড়িতে সবার সব কাজের আগে নন্দদুলালের কাজ। এদিককার লাল মাটির গ্রামগঞ্জে ওদের জমিদার বলে। আগে রাজাই বলত। এখন দেশটা একটু অন্য রকম হয়ে যাচ্ছে। সাহেবসুবো এসে দিল্লী দখল করেছে শোনা যায়।জনিদার বাড়ির পুরুষরা ইদানীং একটু সন্ত্রস্ত হয়ে থাকেন।বাইর মহলের বৈঠকখানায় নানান আলোচনা চলে। মুসলমান শাসকদের সঙ্গে তবু কিছু পরিচয় হয়েছিল।এই লালমুখো বিদেশী যবনদের ধরনধারন কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। এরা হিঁদুর দলে আসবেন, নাকি মোঘল পাঠানদের মত তাদেরও তোপ দেগে উড়িয়ে দেবার ইচ্ছেয় আছেন, তা রাধামাধবই জানেন। সাবধানের মার নেই। সবাইকে চোখ কান খোলা রাখতে বলা হচ্ছে বার বার। মেয়ে মহলেও একটু আধটু দোলা লাগে। মাঝে মাঝে বৈঠক খানায় জল, পান, হুঁকো,পাখার যোগান দিতে যাওয়া মেয়েরা খবর নিয়ে আসে ভিতরমহলে। রাতে কর্তারা শুতে এসে বউদের কথার দু চারটে জবাবও দ্যান।

অবশ্যি খুব কম মেয়েরাই এই সব নিয়ে মাথা ঘামায়। তারা কার ক নহর হার,আর বাজু পৈঁছের ঝালর, কে কয় পদ রান্না করতে পারে সেই নিয়েই ভীষণ ব্যস্ত হয়ে থাকে। তার সঙ্গে থাকে ফিসফিস।কোন শরিকের বালবেধবা কোন গোয়ালের মুনিশের দিকে চেয়েছিলকোন বউয়ের ঘর থেকে সোয়ামি রাতে বেরিয়ে চলে যায়। কোন শাশুড়ি বউকে এনে নিজের ঘরে শোয়ান।বা কোন বউয়ের গালে কালশিটের দাগ আদিরস আর বীভৎস রস; এ দুটি রঙের আলপনাই বেশি অন্দরের উঠোনে। কিছু সাত্ত্বিক গেরুয়া রঙের ছোপ ও আছে।সেটি বৃদ্ধ মাজননীর ঘরের দাওয়ায় পাওয়া যায়। এখনকার বড় কত্তার মা এখনও জীবিত আছেন। ছেলে রোজ কাছারিঘরে যাবার আগে সকালে পেন্নাম করে যান মাকে। মা ছোট্ট ছেলের মত তাঁর গালে হাত দিয়ে আদর করেন যখন,অতি বড় কুটনি ঝগড়াটির ও চোখে জল আসে।

মাজননী স্বামী চলে যেতে সঙ্গে সতী হতে চেয়েছিলেন। বড় ছেলেই আটকেছিল তাঁকে মাথার দিব্যি দিয়ে। তার টানেই রয়ে গেছেন মাকিন্তু সংসার থেকে ঢের দূরেএকেবারে আলগা হয়ে। তাঁর ঘর থেকে মদনমোহনের আটচালা দেখা যায়। সকালে উঠে স্নান সেরেই সেদিকে চেয়ে তিনি জপে বসেন। তাঁর ঘরদোরেও মন্দিরের মত চন্দন আর ধুনোর গন্ধ ছড়িয়ে থাকে। বাবা প্রণাম করে কাছারি চলে গেলেই নাতনি শৈবাল এসে উপস্থিত হয়।ঠাকুমা তাকে রাধারানী বলে ডাকেন।তার জন্য এ ঘরের দরজা সব সময় খোলা। জমিদারগিন্নি পাথরের বাটিতে ভেজানো সাবু, কলা, দুধ নিয়ে শাশুড়ির সকালের জল খাবার দিতে আসেন। কনিষ্ঠ কন্যাকে ঠাকুমার বিছানায় গড়াতে দেখে ধমক লাগান মা।
ঠাকুমা হেসে বলেন, “থাক না বউমা।আমার কিছু অসুবিধে নেই।রাধেকে দেখলেই আমি মদনমোহনকে কাছে পাই।”
মায়ের চোখের দৃষ্টিও আদরে নরম হয়ে আসে। তবু বলেন, “বাসি কাপড়টাও তো ছাড়েনি মা।”
মায়ের হাতে সকালের প্রসাদের থালা।আস্তে আস্তে বিছানা থেকে নেমে মায়ের সামনে এসে হাত পাতেন রাধারানী।
“পসাদ দাও, আমি শাড়ি ছেড়ে আসবো।”
ঠাকুমা হেসে বলেন, “খুব সাবধান দিদি।প্রসাদ নিইয়ে যতক্ষন মুখে জল না দিচ্ছো ও মুখে কিন্তু মিছে কথা বাজে কথা বলার উপায় নেই, মনে রেখো
মা মুখ টিপে বলেন, “তবে তো এইবারেই জিগেস করতে হয়, কাল ঠাকমার আচারের বয়েমগুলো রোদে দিলাম, কম কম লাগছিল কেন?”

ছোট মুখে মনোহরা আর মর্তমান কলার টুকরো ঠোসা আছে, চোখ দুটো বড় বড় হয়ে ওঠে শৈবলিনীর।চোঁচা দৌড় দেয় নিজেদের ঘরের দিকে। পিছনে মা আর ঠাকুমা হেসে কুটোপাটি। বড় ছেলের বউকে নিইয়ে সুখী হয়েছেন শাশুড়ী। আরও চার ছেলে, তিন মেয়ে আছে তাঁর।ছেলেরা সবাই যে বিদ্বান বা ভারি ভাল মানুষ তা নয়। কিন্তু দাদার ব্যক্তিত্বের সামনে মাথা নিচু করে থাকে। পরিবারে ঢেউ ওঠে না বিশেষ। মেয়েদের দূরে দূরে বিয়ে হয়েছে। উৎসবে অনুষ্ঠানে ছাড়া তারা আসতে পারে না। বড় গিন্নির তিন ছেলের পর শৈবাল। মেয়ে হতে গিয়ে ভারি কষ্ট পেয়েছিলেন তিনি। কবিরাজ মশাই বলে গিয়েছিলেন, আর হয়ত সন্তান হবে না; অনেক কষ্টে এইটিকে বাঁচানো গেছে। মনে পড়লেই মদনমোহনের উদ্দেশে কপালে হাত ঠেকান কত্তামা।আর দরকার নেই। এই চারটি সুস্থ থাক ঠাকুর, এই আমার যথেষ্ট। বড় গিন্নি বুদ্ধিমতী রাশভারি মেয়ে। উপযুক্ত সঙ্গী পেয়েছেন বলেই বড় কর্তা সহজে পরিবার সামলে রাখতে পারেন। অন্দর মহলে বড়সড় ঝামেলা দানা পাকতে পায়না। খুচরো চেষ্টা যে একটু আধটু হয়না এমন নয়। জমিদারবাবুর খুড়তুতো ভাইয়েরা,বিধবা জ্ঞাতিবোন,ভাগনেরা এই বাড়িতেই আশ্রিত। অর্থের, বিত্তের তারতম্য ঈর্ষার নখ দাঁত নিয়ে এগিয়ে আসে মাঝে মাঝে।

সেই সময়েই বড় তরফের গৃহিণী দশভুজা হয়ে দাঁড়ান। অনেক নালিশ বিবাদ তাঁর হস্তক্ষেপে, মৃদু গম্ভীর গলার ভর্ৎসনায়, একজোড়া কানের দুল বা একবাটি পায়েসের আদরে মিটে যায়। অনেক দুঃখী মনের ক্ষোভের ঘায়ে সমবেদনার প্রলেপও পড়ে।কোন বিধবা কার দিকে তাকালো প্রশ্ন উঠলে তিনি ঢাল হয়ে দাঁড়ান সে মেয়েমানুষকে আড়াল করে। পরে নিজের ঘরে ডেকে কি জিজ্ঞাসা করেন, কি উপদেশ দিয়ে ঘরে পাঠান সে কেবল সেই গালিখাওয়া মেয়েরাই জানে। কিন্তু বাইরের তোলপাড় থেমে যায়। অনেক সময় শ্বাশুড়ীকে খাবার দিতে এসে মৃদু স্বরে কিছু জানান হয়ত। তিনিও দুচার মুহুর্ত চোখ বুজে জপ করে,তাঁর মতামত জানান।

এমনি করেই চলছে সংসার। বড় হচ্ছে শৈবলিনী রাধারানী। গ্রীষ্ম বর্ষা শরৎ পেরিয়ে বারোটি বসন্ত ছুঁয়ে ফেলেছে শৈবলিনী।দিনে দিনে মন্দিরের দরজার খিলান বেয়ে ওঠা মাধবীলতার মত উপচে পড়ছে রূপ।যে দেখে সেই ফিরে চায়। ঠাকুরের কাজ করতে ভারি ভালবাসে শৈবাল এই জন্যেই ঠাকুমার সঙ্গে তার ভাবটা আরও বেশি।সকালে উঠে কাপড় ছেড়েই সাজি ভরে ফুল তুলতে লেগে যায়। ঘরে এসে ঘাড় কাত করে বসে বসে দেখে ছুঁচে সুতো ভরে ঠাকমা রঙ মিলিয়ে কেমন মালা গাঁথছেনসাদা টগর বেলির গোড়ে, মাঝে মাঝে সবুজ তুলসী পত্র।আবার খানিক ছেড়ে চাঁপারাধারানীর জন্য হলুদ করবী চাঁপা, মাঝে গোলাপের লকেট।বেশি গরমের দিনে বেলি যূঁই দিয়ে চুড়ি বাজু ও গাঁথেন।নাকি ফুলের গয়না আর চন্দনের প্রলেপ দিলে তাপ কম লাগবে। আরাম হবে রাধামাধবের।
“সত্যি ঠাকুমা ?গরম কম হয় ?”
“--সুন্দর মোর নওলকিশোর, এস হে শ্যামল নয়নাভিরাম...” ঠাকুমার গলায় সুরের ঢেউ ওঠে মনের সবখানি মাধুরী বুঝি মালার সঙ্গে গেঁথে রাধাশ্যামকে পড়ানোর চেষ্টায় থাকেন তিনি।তারমধ্যেই ফিক করে হাসেন কখনওবলেন, কমে বইকি রাধে। তোমায়ও কখনও ফুলশয্যার জন্য ফুলের গয়না,চন্দনের পত্রলেখায় সাজাবো,সে সৌভাগ্য কি আর আমার হবে ?তখন বুঝবে না হয়-”
মালা গাঁথা হলে ভেজা পরিস্কার ন্যাকড়া দিয়ে ঢেকে দ্যান ঠাকুমাবুকের কাছে সাজি নিয়ে দৌড় দেয় শৈবলিনীপিছনে ঠাকুমা ডাক দেন।
“ছায়ায় ছায়ায় যাও দিদি।পাথর শান তেতে গরম হয়ে আছে।” 
দুপুরের রোদে ফুলের সাজি নিয়ে পৌঁছোলে,ঠাকুরমশাই মুগ্ধ হয়ে বলেন, “দেখো গো শ্যামরায়,রাধে স্বয়ং মালা পড়াতে এয়েচেন। রোদের তাপে হাতে পায়ে পদ্ম ফুটে উঠেছে যে। এ পুজো না নিয়ে প্যারিমোহন থাকবে কি করে? শুক বলে আমার কৃষ্ণের চূড়া বামে হেলে; আর সারি বলে আমার রাধার চরণ পাবে বলে, চূড়া তাইত হেলে-”
বড় হয়েছে। প্রশংসা শুনলে একটু লজ্জা পায় এখন শৈবালঅস্বস্তি কাটাতে গলা মেলায়, বৃন্দাবনবিলাসিনী রাই আমাদের—

এ বছর ঝুলন পূর্নিমায় কোট্টা পালাগানের ফরমায়েশ দিয়েছেন। সুধাচরন চক্কত্তি মশায় মহকুমা শহরে ঘুরে এসে খবর দিয়েছেন একটি দলের। নাকি ভারি সুন্দর পালা গায়। তাঁকেই রাহাখরচ দিয়ে বলা হয়েছে গরুর গাড়িতে সেই দলকে নিয়ে আসার জন্য। এমনিতেই চারপাশের সমস্ত গ্রাম থেকে কীর্তন গাইতে কত মানুষ আসে এ সময়। পূর্নিমার সাত দিন আগে থেকে কাঠের কারুকাজ করা দোলনায় বাঁকাশ্যাম আর রঙ্গিন প্যারী সেজেগুজে দুলতে থাকেনবাড়ির যে যখন স্নান সেরে শুদ্ধ হয়ে আসে ছোট ছোট ঘণ্টা লাগানো দড়িতে টান দিয়ে দোল দিয়ে নম করে যায় ঠাকুর দালানে। বিকেলে রোদ পড়তে পড়তে বিরাট চাঁদোয়ার নিচে কীর্তনিয়াদের সুর শোনা যায়সন্ধে বেলা অন্দরমহলের দিকের দালানে মা পিসিমারাও ভাল শাড়ি পরে ঘোমটা দিয়ে মাদুরে বসেন এসে। শৈবাল সারা দিন ঘুরঘুর করে নন্দলালার চারপাশে।শুনে শুনে শেখা সুর তার মিঠে গলায় আর্তি নিয়ে ঘোরে,“মাধব বহুত মিনতি করুঁ তোয় –”

সেদিন দুপুরে বাড়ির জন্য ভোগপ্রসাদ নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে যাচ্ছিল। দালান থেকে বাড়ির দিকে নামতে গিয়ে অচেনা মানুষ দেখে থমকে গেলো। শ্যামলা ছিপছিপে চেহারা। এক মাথা কোঁকড়া চুল সিঁড়ির নিচে দাঁড়িয়ে ঠাকুরমশাইকে ডাকছেমাঝ সিঁড়িতে থালা হাতে শৈবলিনীকে দেখে চুপ করে গেলো থেমে গেছে শৈবালঅবাক হয়ে চেয়ে রয়েছে অচেনা ছেলেটার দিকে। বুকের মধ্যে কিসের ঢেউ তোলপাড় করছে তার। কে ? কে এই মানুষটি ? কোথায় দেখেছি একে ? খুব যেন চেনা; তবু নাম মনে করতে পারছিনা কেন?

দুজনেই বোকার মত চেয়ে থাকে
পিছন থেকে ঠাকুরমশাই, “কে রে,কে ডাকে?” বলে ডাক দিতে হুঁশ ফেরে শৈবালেরতরতর করে সিঁড়ি দিয়ে নেমে দৌড় লাগায় বাড়ির দিকেধুক ধুক করতে থাকে বুকের মধ্যে
কে রে ?

বিকেলে মেয়েদের সঙ্গে ঠেলাঠেলি করে দালানের একেবারে সামনে এসে বসে শৈবলিনীঝুঁকে ঝুঁকে এদিক ওদিক চায় এত লোকের ভিড়ে কোথাও দেখা যায় কি সেই ছেলেটাকে ?
পাশে বসা খুড়তুতো বোনেরা কনুই দিয়ে ধাক্কা মারে

এই অমন ছটফট করছিস কেন? সামনে এগুতে এগুতে যেমন চলেছিস,এবার ধপাস করে পড়বি দালান থেকে বুঝবি ঠ্যা্লা
নিজেকে সামলে গায়ে আঁচল টেনে পিছিয়ে বসে শৈবাল
রসকলি কাটা সুন্দরী বোষ্টমী গাইতে বসেছেন আসর আলো করেফুলের মালা গলায়মাথায় চূড়া করে বাঁধা চুলেও সাদা ফুলের মালা

রাধার কি হইল অন্তরে ব্যথা
বসিয়া বিরলে থাকয়ে একলে
না শুনে কাহারো কথা ---”

পর দিন সকাল সকাল ঠাকুমার ফুলের সাজি নিইয়ে মন্দিরে হাজির শৈবাল মালা চন্দন দিয়ে দিয়েও বসে আছে চৌকাঠের বাইরে ঠাকুরমশাই বললেন, “তুমি ঘুরে এস দিদি,পুজোর এখনো দেরী আছে। তারপর তো প্রসাদ
মুখ নিচু করে পাথরের মেজেতে আঁক কাটে শৈবাল তারপর বলে, “কালকে কে আপনাকে ডাকতে এসেছিল দাদু ? ঐ যে আমি যখন ভোগ নিয়ে যাচ্ছিলাম।”
পুষ্পপাত্রের থালা থেকে একটু চমকে মুখ তোলেন পুরোহিত ভুরুতে ভাঁজ পড়ে। দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হয়ে ওঠে একটু মেয়ের মুখে দৃষ্টি পেতে বলেন, “কে ? কার কথা বলছ রাধে ?”
মুখ নিচু করেই জবাব দেয় শৈবাল। “ওই যে, কালো মতন একটা ছেলে; সিঁড়ির নিচে থেকে আপনাকে ডাকছিল।”
“ওঃ সেতো ওই নতুন পালা গানের দলের লোক কেন বল তো ?”
“নাহ ওমনিই। কখন আগে দেখিনি তো
“হুঁওরা ভিন গাঁয়ের লোক ভিন জাতেরও। তোমার দেখার মত লোক নয় মা।”
নিজেকে সামলে নিয়ে চোখ তুলে উঠে দাঁড়ায় শৈবলিনী “আমি আসছি দাদু।পরে ঘুরে আসছি।”

গায়ে আঁচল টেনে নেমে যেতে যেতে ভয় করে একটুঠাকুর মশাই দাদুর গলায় কেমন যেন ধার ফুটে উঠল।

দুপুরে কাজকম্ম সেরে নীলাম্বরী পড়ে ঠাকুরকে দোল দিতে এলেন বড়গিন্নি মধ্য তিরিশে তাঁর সৌন্দর্য শরতের ভর্তি পুকুরের পদ্মের মত ফুটে থাকে মানুষের চোখ মুগ্ধ হয়েও সম্ভ্রমে নিচু হয়। ঠাকুরমশাইয়ের কথা শুনে, হেসে বললেন, “এত চিন্তা করছেন কেন কাকা, অচেনা মুখ, তাই জিগেস করেছে। মানুষটা কত বড় ?”
ঠাকুরমশাই চুপ করে থেকে বললেন, “আমিও সেই ভাবছিলাম। কিন্তু একটু আগে সে ছোঁড়াও জিগেস করতে এল কিনা, কাল দেখলাম, মেয়েটা কে। বকুনি দিয়ে ভাগিয়ে দিয়েছি। কিন্তু দেশ কাল জানোতো মা। রাধে আমাদের আদরের জিনিস। তাই আর কারো কানে যাতে না যায়,তোমাকেই বললাম। আমি তোমাদের পরিবারের সঙ্গে এত দিন রয়েছি, নিজেকে বাইরের লোক বলে ভাবতে তো পারিনা।”
দীর্ঘশ্বাস ফেলেন গিন্নি। “না কাকা, একদম ঠিক করেছেন আমায় জানিয়ে। আমি দেখে নিচ্ছি।”

বড় গিন্নি নিজের ঘরে ফিরে চুপ করে বসে রইলেন খানিক। এত আদরের মেয়ে। আরও কিছু দিন বুকের মধ্যে রাখবেন আশা ছিল। ঠাকুরের ইচ্ছে নয় বুঝি। বুক ভেঙে আসে। চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ে মুছে ফেলে তাড়াতাড়ি প্রণাম জানান মন্দিরের উদ্দেশে। “মধুসূদন মঙ্গল কর। মেয়ে সন্তান। পরের ঘরে ত দিতেই হবে। সেইখানে রানীর আদর পায় যেন।” দুপুরে কর্তা পানটি নিতে একবার ভিতর ঘরে আসেন। দু চারটে কথাও হয় তখন দুজনায়। আজ গিন্নি বললেন,“শোনো ঐ যে সম্বন্ধের কথা বলছিলে মেয়ের; বললে ঘটক এসেছিল পাশের গ্রাম থেকে, তাদের বলেছ কিছু?”
কত্তা অবাক হয়ে বললেন, “ কই আর বললাম। তুমিই তো না করলে। বললে আরও দু দিন থাক কাছে কাছে। এত কি তাড়া কুলীনের ঘরে মেয়ে ত দুচার দিন রাখাই যায়। তোমার বাক্যি না শুনে আমি চলি কি?”
ভারি মিষ্টি হাসির চালাচালি হয় চোখে চোখে। খাটে বসে পড়ে কত্তা একটু অন্যমনস্ক হন।
“যাই বল বড় বউ,বড় ভাল ঘর ছিল গো আমাদের চেয়েও ঢের বেশি অবস্থাপন্ন। ছেলেটির স্বভাবচরিত্র ও ভাল। আমি খোঁজ নিতে লোক পাঠিয়ে ছিলাম।
বিরাট লম্বা চওড়া,টকটকে রঙ, ভারি মানা্ত মেয়ের পাশে।”
গিন্নি বলেন, “তবে এবার আমাদের সম্মতি জানিয়ে লোক পাঠাও। আজ পুজো করতে গিয়ে মদনমোহনের কাছে আদেশ পেয়েছি। এখানে কাজ করলেই মঙ্গল হবে।”
কর্তার মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে “বলছ ?বাঃ ঝুলনের উৎসবের মধ্যে কথা সুরু হবে এত ভারি ভাল কথা। জয় রাধামাধব।” হাত জোড় করে কপালে ঠেকিয়ে পানটি মুখে পুরে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়েন কর্তা।

নায়েবমশাইকে খবর দিতে হবে।

এই সাত দিন ধরে দালানের ভিড়ের মধ্যে থেকে হাজার উঁকি ঝুঁকি দিয়েও সেই মুখটি আর দেখতে পায়নি শৈবাল কাল পূর্নিমার উৎসব শেষ হয়েছে। আজ চাঁদোয়া টাদোয়া খুলে নিয়ে চলে যাবে সব লোক।কীর্তনের দল খোল খঞ্জনী গুছিয়ে নিচ্ছে।নহবত বসেছিল মন্দিরের বড় দরজার পাশে, সেই সানাইয়ের সুরটুকু খালি ভেসে আসছে এখনো। শৈবাল ভোর বেলা তাড়াতাড়ি উঠে গায়ে জল দিয়ে শাড়ি পালটায়। একবার মন্দিরে যেতেই হবে, এক্ষুনি। সবাই জিনিসপত্র গোটাচ্ছে যেখানে, সেখানে তো থাকবেই ছেলেটা ?”
মা এসে দাঁড়ান ঘরের দরজায়।
“এত সকালে কোথায় যাচ্ছ মা?”
“- একটু মন্দির ঘুরে আসি-”
“না মাএকটু পরে আমার সঙ্গে যাবে। আজ তোমার পাটিপত্র
কেমন অচেনা লাগে মায়ের মুখের শব্দ গুলো পাটিপত্র ? সেতো বিয়ের আগে হয়।
“কি পাটিপত্র মা ?”
“পাশের মহলের জমিদার বাড়ি থেকে ঘটক এসেছিল রাধে। বাবার সঙ্গে সব কথা হয়ে গেছে। কুষ্ঠী মিলিয়ে ওনারা বলেছেন রাজযোটক বাবা পাত্র দেখে এসেছেন। ফর্সা সুন্দর ছেলে।
আজ ও তরফের গুরুজনেরা তোমাকে দেখে আশীর্বাদ করলে, পাটিপত্র হবে।
তুমি একলা কোথাও বেরবে না সোনা আমি তোমায় নিয়ে যাব মন্দিরে দাঁড়াও।”
সারা পৃথিবীটা শূন্য হয়ে যাচ্ছিল শৈবলিনীর।
চেনা ঘর বাড়ি জীবন সবকিছুর থেকে এরা কোথায় ঠেলে বের করে দিচ্ছে ওকে? যন্ত্রনা করে বুকের মধ্যে।আর্ত কণ্ঠে বলে, “আমার মদনমোহন? আর কখনও তার কাছে আমায় তোমরা যেতে দেবে না মা? আমি দেখতেও পাবো না তাকে ?”

খাঁচায় আটকে পড়া পাখির মত ছটফট করে ওঠে মেয়েটা কাঁদতে থাকে অঝোরে। তার যন্ত্রনা দেখে মায়ের বুকের মাঝে মোচড় দিয়ে ওঠে বুকের মধ্যে মেয়েকে টেনে নেন তিনি। চোখের জলে ভেসে যান এত ব্যথার হদিশ পেয়ে  মা টের পান তাঁর ছোট্ট মেয়েটা ব্যথার পথ পেরোতে পেরতে নারী হয়ে উঠছে। তার মদনমোহন বুকের মধ্যে এসে আসন পাতছেন। সেই ছবি সঙ্গে নিয়েই সে সংসারের লম্বা রাস্তা পেরোবে।

দুজনের চোখের জল মিলে যায় একসাথে। সানাইতে ইমনের সুর বুকভাঙা বন্দিশের ঢেউ তোলে,“ও বৃজকে নন্দলাল তোরে বিনা মোহে চৈন নাহি।” 
     সোনালি পুপু