সর্বাণীর সাথে আজকাল মাঝে মাঝেই দেখা করেন
হরিবাবু। মনে রঙ ধরছে আস্তে আস্তে, বেশ
বুঝতে পারছেন। সর্বাণী একদিন নিজের বাড়ি নিয়ে যাবেও বলেছে, বিয়েটা
শীঘ্র ফাইনাল হয়ে যাবে। পাড়ার লোকে, এমনকি শ্যামও খানিক
হাসাহাসি করছে বটে, তবে হরিবাবু পাত্তা দিচ্ছেন না, বিয়েটা উনি করেই ছাড়বেন! সর্বাণীকে নানাবিধ উপহার দিতে ও তার সঙ্গে সময়
কাটাতেই ব্যস্ত তিনি। মিনাক্ষী বোধহয় মনে খানিক কষ্ট পেয়েছে, কি আর করা যাবে, বিয়ে তো একজনকেই করবেন হরিবাবু। বাধ
সাধছে মালতী, মাঝেই মাঝেই বাড়িতে চলে আসে, নানারকম রান্না করে আনে, অহেতুক গল্পও জুড়ে দেয়,
হরিবাবুর প্রেমে পড়েছে নির্ঘাত। হরিবাবু বিরক্তি দেখালেও কিচ্ছু মনে
করে না,~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
বসন্ত এসে গেছে
ব্রততী সান্যাল
“এক”
বেলা একটা বাজতে চললো, আজও এলো না সে। ‘সে’ শুনে রোমান্টিক কল্পনার মোটেও প্রয়োজন নেই, এখানে ‘সে’ বলতে হরিবাবুর রাঁধুনি ময়নাকে বোঝানো হচ্ছে।
মোদ্দা কথা, আজকেও ‘মা তারা’ হোটেলে গিয়েই মধ্যাহ্নভোজন সারতে হবে তাকে, কি
বিরক্তিকর! পাঞ্জাবিটা কোনরকমে গলিয়ে ব্যাজার মুখে রাস্তায় বেরোলেন হরিবাবু,
হোটেলে ঢুকে সবে মাছভাতের অর্ডারটা দিয়েছেন, দেখেন
একগাল হেসে তার দিকেই এগিয়ে আসছেন শ্যামবাবু, ভ্রাতৃসম এক
প্রতিবেশী।
-“কি ব্যাপার দাদা, আজও রাঁধুনি আসে নি নাকি?”, শ্যামবাবুর প্রশ্নে বড়
মুষড়ে পড়েন হরিবাবু।
-“দুঃখের কথা আর কি বলবো! ভালো
লাগে বলো, রোজ হোটেলের রান্না খেতে? তা
তুমি এখানে? পলা বাপের বাড়ি গেছে বুঝি?”, হরিবাবু প্রশ্ন করেন।
-“আজ্ঞে হ্যাঁ, সেই সুযোগে আমিও ভাবলাম একটু জিভের স্বাদ বদলানো যাক! তবে আপনার জন্য
সত্যিই দুঃখ হয় দাদা। পলা তো বলে, সারাটা জীবন ভাইকে মানুষ
করতে গিয়েই কেটে গেল দাদার! এখন বুড়ো বয়সেও একা থাকতে হচ্ছে!”, শ্যামবাবুর কথা শুনে হরিবাবুর মনটা বড় হুহু করে ওঠে। ভাইটা বউ ছেলে নিয়ে
বছর দুয়েক আগে বিদেশ চলে যাবার পর বড্ড একা হয়ে পড়েছেন তিনি।
-“যখন একুশে পা দিলাম, মা ভাইয়ের জন্ম দিয়ে ইহলোকের মায়া ত্যাগ করলেন। পাঁচ বছর পর, হার্ট অ্যাটাকে গেলেন বাবা। সেই থেকে ছোট্ট ভাইটাকে মানুষ করেছি আমিই,
লেখাপড়া করিয়েছি, বিয়ে দিয়েছি।চাকরি ও ভাই—
এই নিয়েই জীবনটা কাটিয়ে দিলাম।
আজ যখন রির্টায়ার করলাম, ভাইটা দিব্যি চাকরির বাহানা
দিয়ে পরিবার নিয়ে আমেরিকায় কেটে পড়লো! একেই বলে কপাল, বুঝলে
শ্যাম!”, প্রায় কেঁদে ফেলতে গিয়েও বেয়ারা ধোঁয়া ওঠা প্লেট
নিয়ে আসছে দেখে সামলে গেলেন হরিবাবু।
“দাদা, একটা
পরামর্শ দিচ্ছি, অন্যভাবে নেবেন না যেন। আপনি একটা বিয়ে করে
ফেলুন। দেখবেন, জীবনটা
কেমন বদলে যায়!”, শ্যামবাবুর কথা শুনে আঁতকে ওঠার উপক্রম হয়
হরিবাবুর, আর একটু হলে চেয়ার থেকেই পড়ে যাচ্ছিলেন!
-“বলো কি! বাষট্টি বছর বয়সে বিয়ে?
আমাকে কি পাগল ঠাউরেছো নাকি? একা থাকলেও
মাথাটা ঈশ্বরের কৃপায় এখনো পর্যন্ত ঠিকঠাকই আছে!”, রাগত
স্বরে বলে ওঠেন তিনি।
-“ ছি ছি, কি
বলেন দাদা, পাগল ঠাউরাবো কেন? আজকাল তো
বাষট্টি কোন বয়সই নয়! সেদিনই কাগজে দেখলাম পঁচাত্তর বছরের বৃদ্ধ ও সত্তর বছরের
বৃদ্ধা বিয়ে করছেন। তাহলে আপনার করতে বাধা কোথায়? আপনাকে
দেখলে কে বলবে, বাষট্টি বছর বয়স? অন্তত
এবার তো জীবনটা উপভোগ করুন! আমি বলি কি দাদা, আপনার চাহিদা
অনুযায়ী খবরের কাগজে বিজ্ঞাপনটা দিয়েই দেখুন না!”, শ্যামবাবুর
কথায় হরিবাবু কোন উত্তর না দিয়ে অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে খাওয়ার দিকে মনঃসংযোগ করলেন,
আজকালকার ছেলেছোকরাদের কথার সত্যিই কোন লাগাম নেই, ঠিক এই কারণেই দেশটা উচ্ছন্নে যাচ্ছে!
“দুই”
ময়না তো ফিরে এসেছে, কিন্তু তার রান্না আজকাল হরিবাবুর মুখে রুচছে কই?
-“তুমি খেতে বসে এমনি করে নাক
সিঁটকোলে আমি কিন্তু আর আসবুনি বলে দিলাম, জেঠু!”, ব্ল্যাকমেল করেও কোন লাভ হয় নি।
হরিবাবুর হৃদয়ে যেন দোলা লেগেছে হঠাৎ, স্ত্রীয়ের হাতে রান্না খেতে বড় ইচ্ছে করে। রাত্রিবেলা
মশারির খুঁট টাঙাতে গিয়ে মনে হয়, সহধর্মিনী থাকলে নিশ্চয়
সাহায্য করতো। সন্ধ্যের মুখে বারান্দায় দাঁড়িয়ে হাওয়া খেতে খেতে মনে হয়, স্ত্রী থাকলে হয়তো পিছন থেকে হঠাৎ জাপটে ধরতো, বিয়েটা
না হলে জীবনটা পূর্ণতা পায় না। অগোছালো বাড়িটা দেখে জীবনে একজন নারীর প্রয়োজন
ভীষণভাবে বোধ করেন তিনি। শ্যামটা সত্যিই বড় বিচক্ষণ, অবশেষে
সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন তিনি।
আজ রবিবার, খ্যাতনামা একটি নিউজ পেপারে হরিবাবুর পাত্রী চেয়ে বিজ্ঞাপনটা বেরিয়েছে।
গতকাল রাত থেকেই উত্তেজনাতে যেন টগবগ করে ফুটছেন তিনি, লোকে
হাসাহাসি করবে ঠিকই, তবে হরিবাবুর তাতে কিছু যায় আসে না,
মূল পয়েন্টে ফোকাস করাই এখন তার লক্ষ্য।
“তিন”
“আমি মিস মিনাক্ষী রায়, বয়স তিপ্পান্ন বছর, ডিভোর্সী। আপনার বিজ্ঞাপনটা
দেখলাম, আমিও বিয়েতে ইচ্ছুক, বর্তমানে একাই
থাকি। তাই যোগাযোগ করেছিলাম।”, হরিবাবু খুব মন দিয়ে লক্ষ্য
করছেন ভদ্রমহিলাকে। বয়কাট চুল, রিমলেশ চশমা, ব্র্যাণ্ডেড ঘড়ি, স্লিভলেস ব্লাউজ— চিরসবুজ হরিবাবুর পাশে ভালোই মানাবে! তবে এখন থেকেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললে
চলবে না, মোট তিনটে প্রস্তাব পেয়েছেন তিনি। বাকি দুজনের
সঙ্গে ইতিমধ্যেই দেখা হয়ে গেছে, ইনি সর্বশেষ। খুব ভেবেচিন্তে
জীবনসঙ্গিনী নির্বাচন করতে হবে।
প্রথমজন সর্বাণী মিত্র, বছর পঞ্চান্নর বিধবা, এক
পুত্রসন্তানের জননী, যে বর্তমানে ইতালিতে কর্মরত। তাই
একাকীত্ব কাটাতে ভাইবোনের উৎসাহে বিয়ে করতে নেমেছেন ভদ্রমহিলা। মিনাক্ষীর মতো অতটা
স্টাইলিশ না হলেও এখনো বেশ সুন্দরী ও প্রাণবন্ত, আর হাসিটা
ভারি মিষ্টি। “পঞ্চাশের পরেই তো জীবনটা প্রকৃত অর্থে শুরু
হয়।”, বলেছেন তিনি।
দ্বিতীয়জন মিস মালতী কর্মকার, বছর সাতান্ন বয়স। প্রথম দর্শনেই মনে মনে বাতিল করেছেন
হরিবাবু। নব্বই কেজির কাছাকাছি হবে ওজন, ব্যবহারে
বিন্দুমাত্র আধুনিকতার ছোঁয়া নেই, গলার আওয়াজটা ষাঁড়ের মতো।
খালি দাঁত বার করে হাসে ও ড্যাবড্যাব করে হরিবাবুকে দেখে। বলে, “বিয়ের পর রোজ লাউচিংড়ি করে খাওয়াবো, খালি আমার নাক
ডাকাটা সহ্য করতে হবে ও মাঝে মাঝে পিঠটা চুলকে দিতে হবে।”, সারাজীবন
নাকি নার্সের চাকরি করেছেন, তাই বিয়ে করার সুযোগ পাননি। কেউ
বিয়ে করতে চায় নি, এই কথাটা কি আর কেউ স্বীকার করে?
“চার”
সর্বাণীর সাথে আজকাল মাঝে মাঝেই দেখা করেন
হরিবাবু। মনে রঙ ধরছে আস্তে আস্তে, বেশ
বুঝতে পারছেন। সর্বাণী একদিন নিজের বাড়ি নিয়ে যাবেও বলেছে, বিয়েটা
শীঘ্র ফাইনাল হয়ে যাবে। পাড়ার লোকে, এমনকি শ্যামও খানিক
হাসাহাসি করছে বটে, তবে হরিবাবু পাত্তা দিচ্ছেন না, বিয়েটা উনি করেই ছাড়বেন! সর্বাণীকে নানাবিধ উপহার দিতে ও তার সঙ্গে সময়
কাটাতেই ব্যস্ত তিনি। মিনাক্ষী বোধহয় মনে খানিক কষ্ট পেয়েছে, কি আর করা যাবে, বিয়ে তো একজনকেই করবেন হরিবাবু। বাধ
সাধছে মালতী, মাঝেই মাঝেই বাড়িতে চলে আসে, নানারকম রান্না করে আনে, অহেতুক গল্পও জুড়ে দেয়,
হরিবাবুর প্রেমে পড়েছে নির্ঘাত। হরিবাবু বিরক্তি দেখালেও কিচ্ছু মনে
করে না, ময়নার সঙ্গেও দিব্যি ভাব করে ফেলেছে।
গতকাল সন্ধ্যেয় সর্বাণীর দিদির
অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে, তখন তাঁরা বাবুঘাটে বসে
গল্প করছিলেন। ফোনে সংবাদ পেয়ে সর্বাণীকে কাঁদতে দেখে বুকটা মোচড় দিয়ে উঠলো
হরিবাবুর, “কিছু টাকা দেবে গো? খুব
দরকার, ”, সর্বাণী অসহায় দৃষ্টি মেলে বলেছিল। পঞ্চাশ হাজার
টাকা দিয়েছেন হরিবাবু, তখনই, পরদিন
সকালে বাড়িতে এসে আরো কিছু নিয়ে গেছে সর্বাণী, শোধ করে দেবে
হরিবাবুর হাত ধরে কথা দিয়েছে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, তারপর
থেকে ফোনটা ‘নট রিচেবেল বলছে’, দিদি কোন হসপিটালে ভর্তি, তাও
গর্দভের মতো খোঁজ নিয়ে রাখেন নি হরিবাবু। সত্যিই কি ঠকে গেছেন? শোভাবাজারে বাড়ি বলেছিল সর্বাণী, খুঁজতে গিয়েছিলেন
সেখানে, খালি হাতে ফিরেছেন। পুলিশে ডায়েরি করে মাথায় হাত
দিয়ে বসে রইলেন কিছুক্ষণ। এইভাবে তাকে উল্লুক বানিয়ে কেটে পড়লো সর্বাণী? নাঃ বিয়ে করার শখ মিটে গেছে, আর ও পথে নয়।
সপ্তাহখানেক পর ফের বড় একা বোধ হতে লাগলো, সর্বাণীকে এখনো ধরতে পারে নি পুলিশ, আর পারবে বলেও মনে হয় না। আচ্ছা, মিনাক্ষীকে একবার
ফোন করলে হয় না? একটু গল্পই নাহয় করা যাবে, কোন ফাঁদে তো আর পা দিচ্ছেন না!
-“একজন খ্যাতনামা কবির সঙ্গে সদ্য
আলাপ হয়েছে, জানো। বড় ভালো মানুষ। রেডি হচ্ছি, নন্দনে দেখা করার কথা আজ। খুব ভালো থেকো গো।”, মিনাক্ষীর
কথায় কান্না পেয়ে গেল হরিবাবুর। একেই বলে, কারোর পৌষ মাস,
কারোর সর্বনাশ, নিজের হাত কামড়াতে ইচ্ছে করছিল
সেই মুহূর্তে, ঠক করে রিসিভারটা নামিয়ে রাখলেন তিনি।
“পাঁচ”
সপ্তাহখানেক কেটে গেছে। যথারীতি পাড়াপড়শীর
হাসির খোরাক হয়েছেন হরিবাবু। লোকে আজকাল দেখলেই মুখ টিপে হাসছে, গোটা পাড়াতে তার বিবাহবিভ্রাট কাহিনী চাউর হয়ে গেছে।
বিয়ে করতে গিয়ে এমনভাবে ঠকে যাবেন, স্বপ্নেও কল্পনা করেন নি
হরিবাবু।
ময়না আসে নি আজও। আবার যেতে হবে “মা তারা“ হোটেলে, পাঞ্জাবিটা গলাতে যাবেন, কলিংবেল। “ধুর কে রে বাবা!” গজগজ করতে গিয়ে দেখেন মালতী,
যথারীতি টিফিন ক্যারিয়ার হাতে। ‘ইলিশের ভাপা
বানায়েছিলুম, নিয়ে এলুম। খেয়ে নিন তো।”, অনুমতি না নিয়েই ঘরে ঢুকে এলো সে। “ছ্যা, কি অবস্থা ঘরদোরের। সাফও করতে পারেন না বুঝি? দাঁড়ান
আমি একটু গুছিয়ে দিই টেবিলটা।”, টেবিল গুছোতে গুছোতে
হরিবাবুর দিকে তাকায় সে, বলে, “আপনার
চোখমুখ অমনধারা শুকিয়ে গেছে কেন? ওই হারামি মেয়েছেলেটার খোঁজ
মিললো কিছু? আসুন খেয়ে নেবেন।”, মালতীর
গলার স্বরটা আজ আর ষাঁড়ের মতো ঠেকছে না, বরং বেশ মোলায়েম
লাগছে। মুখখানা বেশ সরল, আজ প্রথমবার লক্ষ্য করলেন হরিবাবু।
প্রায় দেড় সপ্তাহ পর এলো মালতী, কই বিরক্ত লাগছে না তো,
বরং এতক্ষণই কেমন অসহনীয় লাগছিল! গোলগাল চেহারা নিয়ে কেমন ছোটাছুটি
করে ঘর গোছাচ্ছে, যেন বাড়ির গিন্নি, নিজের
মনেই হেসে ফেলেন হরিবাবু। দূরে কোনো রেডিওতে বুঝি আচমকা বেজে উঠলো, “বসন্ত এসে গেছে.. ”
©ব্রততী সান্যাল